চন্দ্ররঙা_প্রেম_২ পর্ব শেষ

#চন্দ্ররঙা_প্রেম_২
#পর্বঃ২৬ (শেষ)
#আর্শিয়া_সেহের

উর্বিন্তার বিয়ের দিন পাকাপোক্ত হয়ে গেছে। যে ছেলের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে সে প্যাথলজিস্ট। উর্বিন্তাকে প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়েছে তাদের। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে গেছেন তারা । উর্বিন্তা অনুভূতিশূন্য, ভাবলেশহীন, নির্বিকার ভাবে ঘুরছে। ছোট থেকে তার জন্য পাগলামি করা ছেলেটা আর একটাবার পাগলামি করুক এটাই চায় সে।

দিন কেটে যাচ্ছে কিন্তু ছেলেটা আর পাগলামি করলো না। বিয়ের তিনদিন আগে উর্বিন্তা নিজে থেকেই কল করলো শান্তকে। প্রথমবারেই শান্ত কল রিসিভ করলো। উর্বিন্তা নিজেকে শান্ত রাখতে চেয়েও পারলো না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ফোনের ওপারে শান্ত তখনও একেবারেই চুপ করে বসে আছে। উর্বিন্তা ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে আটকালো। এতোটাই জোরে কামড়ে ধরলো যে ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে এলো। হেঁচকি তুলে কেঁদে শান্তর উদ্দেশ্যে বললো,
-“এই তোর ভালোবাসা? এমন ভালোবেসেছিস এতো বছর ধরে? কই গেছে তোর সব ভালোবাসা? তোর ভালোবাসা এখন আমাকে খুন করছে শান্ত। বাঁচা আমাকে।”

-“কোনো প্রয়োজনীয় কথা থাকলে বলো ,উর্বি। আমার পড়া আছে। এসব কথা শোনার সময় নেই।”

উর্বিন্তা চিৎকার করে কেঁদে বললো,
-“আর তো তিনটা দিন। তারপর চাইলেও আর শুনতে হবে না এসব কথা। বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে আমার। তোর এবার শান্তি হবে।”

উর্বিন্তার বিয়ের কথা শুনে শান্তর বুক কেঁপে উঠলো। মাথাও ঝিম মেরে উঠলো। এতো এতো মানুষের ভীড়ে এই একটা মেয়েকেই ভালো লেগেছিলো তার। ভালোবাসার মানে বোঝার আগে থেকেই ভালোবেসেছিলো এই মেয়েটাকে। নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে পুরোটা এই মেয়ের অস্তিত্বেই জড়িয়ে ছিলো সে। আর সেই মেয়েটা এখন অন্য কারো অর্ধাঙ্গিনী হয়ে যাবে ভেবেই শান্তর দম আটকে এলো। তবুও সামলালো নিজেকে।

উর্বিন্তা সবসময় তাকে ক্যারিয়ারে ফোকাস করতে বলেছে। কখনো পাশে থেকে ক্যারিয়ার গড়তে বলেনি। উর্বিন্তা সবসময় দূরত্ব বাড়িয়েছে তার ভালোর জন্য কিন্তু মেয়েটা এটা দেখেনি যে ওই দূরত্বটা তাকে আরো বেশি কষ্ট দিয়েছে। মেয়েটার কাছে ভবিষ্যৎ, ক্যারিয়ার এগুলাই বেশি ইম্পর্ট্যান্ট যা তার এখনো গোছানো হয়নি।

ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে শান্ত বললো,
-“কনগ্রাচুলেশন। জীবনে অনেক সুখী হও।”

এটুকু শুনেই উর্বিন্তা ফোনটা আছাড় মারলো। দেয়াল ঘেঁষে বসে দু’হাতে চুল খামচে ধরলো। হাঁটুর উপর মাথা ঠেকিয়ে কেঁদে কেঁদে বললো,
-“আমি তোকে ভালোবাসি শান্ত। তোকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। একটাবার ফিরিয়ে নিলে কি ক্ষতি হতো বল? আমি আজ বুঝতে পারছি রে, বেঁচে থাকার জন্য ক্যারিয়ারের চেয়ে বেশি প্রয়োজন কারো সঙ্গ,কারো ভালোবাসা। একটাবার ক্ষমা করলে খুব কি ক্ষতি হতো তোর?”

শান্ত থম মেরে বসে আছে বিছানায়। নয়টা বছর ধরে যে মেয়েকে ভালোবাসছে সেই মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাবে। এই মেয়েটার সাথে হারিয়ে যাবে তার জীবনের অনেক কিছু। তার শৈশব, কৈশোরের পুরোটা জুড়ে এই একটা মেয়েরই বসবাস ছিলো। এই মেয়েটাকে সে যে কোনো কিছুর বিনিময়ে অর্জন করতে চেয়েছিলো। সে এমনটা করতো ও যদি মেয়েটা একবার তার পাশে এসে দাঁড়াতো। কিন্তু নাহ! মেয়েটার শুধু ক্যারিয়ার লাগবে, ভালো একটা ভবিষ্যৎ লাগবে। সে থাকুক ভালো কোনো ভালো ভবিষ্যৎওয়ালার সাথে।

শান্ত কিছু বই, কয়েকটা কাপড় একটা ব্যাগে গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লো রুম থেকে। রুমঝুম ড্রয়িং রুমে বসে ছিলো। শান্ত নিচে এসে রুমঝুমের সামনে দাঁড়ালো। মাথা নিচু করে বললো,
-“আমি তোমাদের বাড়িতে যাচ্ছি ভাবি। রুশান ভাইয়ের সাথে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসি।”

রুমঝুম উঠে দাঁড়ালো। শান্তর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-“সে যা কিন্তু হঠাৎ যাচ্ছিস যে? কিছু হয়েছে তোর?”
শান্ত হালকা হেঁসে বললো,
-“না ভাবি। কিছুই হয়নি। সবার খেয়াল রেখো।”

শান্ত এগিয়ে গেলো মেইন দরজার কাছে। দরজাতে দাঁড়িয়ে পেছনে ঘুরলো একবার। বিষাদময় হাঁসি হেঁসে বললো,
-“ভাবি, আমার উর্বিটার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। দোয়া করো ওর জন্য।”
বলেই ধপধপ পায়ে বেরিয়ে গেলো।
রুমঝুমের মাথায় যেন বাজ পড়লো। উর্বিন্তার বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনেও শান্ত চুপচাপ আছে কিভাবে? এই ছেলেটা আদৌ ঠিক হবে তো?

সন্ধ্যা হয়ে গেলো শান্তর যশোর পৌঁছাতে। রেজাউল সাহেব তাহমিদকে নিয়ে গার্ডেনে বসে ছিলো। শান্তকে বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দেখে তাহমিদ দৌড়ে গেলো শান্তর কাছে। রেজাউল সাহেব হেঁসে উঠে এলেন। হ্যান্ডশেক করে বললেন,
-“হেই ইয়াং ম্যান,কেমন আছো?”
শান্ত হাত বাড়িয়ে হেঁসে বললো,
-“ভালো আছি আংকেল। আপনার শরীর কেমন?”
-“আমার শরীর ভালোই থাকে । ভেতরে চলো।”

শান্তকে নিয়ে রেজাউল সাহেব ভেতরে চলে গেলেন। মেঘা শান্তকে দেখে মিষ্টি হেঁসে বললো,
-“আরে শান্ত, বাড়িতে সবাই কেমন আছে তোমার?”
-“জ্বি আপু ভালো। আমার তোমার সবার বাড়ির লোকজনই ভালো আছে।”
মেঘা হাঁসি দিয়ে বললো,
-“আর শান্ত সাহেব কেমন আছে?”
শান্ত শব্দ করে হেঁসে বললো,
-“সে তো সবসময় ভালো ।”
মেঘা শান্তকে সোফায় বসতে বলে দোতলায় রুশানের রুমটা পরিষ্কার করতে গেলো শান্তর থাকার জন্য।

গতকাল পুনমের প্রেগনেন্সি টেস্ট করানো হয়েছে। সে তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা। এই কথা জানার পর রুশান নিচতলায় শিফট হয়ে এসেছে। পুনমকে দোতলায় রেখে কোনো রিস্ক নিতে চায়না সে।

শান্তকে মেঘা উপরের ঘরে রেস্ট করতে পাঠিয়ে দিলো। রুশান বাড়িতে ফেরেনি এখনো। শান্ত ফ্রেশ হয়ে ছাদে গিয়ে বসলো। আজ আকাশে চাঁদ তারাদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো আজ চাঁদের অমাবস্যা। ঠিক শান্তর মনের অমাবস্যার মতোই। শান্ত চুপচাপ মনোযোগ সহকারে অন্ধকার বিলাস করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।

রুশান রাত সাড়ে আটটার সময় ফিরলো। এসেই শুনতে পেলো শান্ত এসেছে। হুট করেই শান্তর আসার পেছনের কাহিনী বুঝতে পারছে না রুশান। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো সে। ডাইনিং থেকে খাবার নিয়ে খাইয়ে দিলো পুনমকে। খাওয়া শেষে পুনমকে শুইয়ে দিয়ে পা বাড়ালো ছাদের দিকে। শান্তকে না নিয়ে খাওয়া যাবে না।

শান্ত কারো পায়ের আওয়াজ শুনেও নড়াচড়া করলো না। সে বুঝতে পারলো রুশানই এসেছে হয়তো। রুশান ধীর পায়ে এসে শান্তর পেছনে দাঁড়ালো। সে কিছু বলার আগেই শান্ত বললো,

-“আমি ভেবেছিলাম এই পৃথিবীতে আর কারো ভালোবাসা পূর্ণতা পাক বা না পাক, আমার ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে। অথচ দেখো,সবার ভালোবাসাই পূর্ণতা পেলো শুধু আমারটা ছাড়া।”

রুশান ভ্রু কুঁচকে শান্তর সামনে এসে দাঁড়ালো। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
-“কি হয়েছে রে? এসব বলতেছিস কেন?”
শান্ত রুশানের দিকে না তাকিয়েই বললো,
-“উর্বিন্তার বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
রুশান শান্তর সামনে বসলো আরাম করে। শান্তর হাতের উপর হাত রেখে বললো,
-“তুই উর্বিন্তাকে চাস? ওকে বিয়ে করবি? একবার বল।”

শান্ত ভাবনা চিন্তা ছাড়াই উত্তর দিলো,
-“সে যদি আমাকে একটু ভালোবাসতো,আমি তাকে জয় করতাম ভাইয়া। সে তো ক্যারিয়ারের পাগল,আমার পাগল না।”

-“তাহলে মন খারাপ করছিস কেন?”
শান্ত রুশানের এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ‌ পর বললো,
-“আজকে আকাশে একটা চাঁদ থাকা উচিত ছিলো।”

রুশান আকাশের দিকে তাকালো। হালকা হেঁসে বললো,
-“অনেক বছর‌ আগে, এমনই একটা রাতে আমি আর আপু ছাদে এসে বসেছিলাম। সেই রাতটা আলোকিত ছিলো। চাঁদের দিকে তাকিয়ে আমি সেদিন আপুর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য দোয়া করেছিলাম। মন থেকে বারবার একটা কথাই বলেছিলাম, ‘আপুর জীবন যেন চন্দ্ররঙে রাঙা হয়।’
দেখ, সত্যিই আপুর জীবনটা চন্দ্রের মতোই আলোকিত হয়ে আছে।”

শান্তর দৃষ্টি আকাশে নিবদ্ধ । ভারী কন্ঠে বললো,
-“তখন আমার আট বছর বয়স যখন উর্বিন্তাকে প্রথম দেখি। ক্লাসের প্রথম বেঞ্চে দুই বিনুনি করে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দেখছিলো সবাইকে। ঠিক সেই সময়ে মনে হয়েছিল এই মেয়েটা শুধু আমার। সেদিন থেকে উর্বিন্তার জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছি আমি। ওর শত অপমানও কখনো গায়ে মাখিনি। ওর সব কথাই আমার কাছে ভালো লাগতো। আমি মেনে নিতাম। কতগুলো বছর গেলো ভাবতে পারছো? ওই একটা মেয়েই জীবনের সব হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। কিন্তু শেষ অবধি ধরে রাখতে পারিনি তাকে। আমার ভালোবাসা বোঝাতে পারিনি। ও কেন আমাকে ভালোবাসলো না ভাইয়া? ও আমায় বুঝলো না কেন?”

শান্ত চুপ হয়ে গেলো। আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার। রুশান আবারও বললো,
-“তুই চাস উর্বিন্তাকে? এখনো ভেবে বল।”
শান্ত এবারও চুপ করে রইলো। কষ্ট হলেও উর্বিন্তাহীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে সে। এখন তাকে প্রয়োজন নেই হয়তো। তবুও আজ দোটানায় সে। আসলেই কি ভালো থাকতে পারবে সে উর্বিন্তাকে ছাড়া?

রুশান উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
-“ভাব শান্ত। সময় থাকতে ভাব। আর এখন নিচে আয়। খেতে হবে। তুই এলে তবেই খাবো কিন্তু।”

রুশান নিচে চলে গেলো। শান্তর চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো একফোঁটা জল। হুট করেই তার ইচ্ছা করছে আকাশে মস্ত একটা চাঁদ দেখতে । তার জীবনে একটু আলোর খুব বেশি প্রয়োজন।

আকাশের চাঁদটা সবার জীবনে কেনো আলো দেয় না? সবার প্রেমকে কেন নিজ রঙে রাঙায় না? এ পৃথিবীতে সবার প্রেম চন্দ্ররঙের হলে কি খুব ক্ষতি হতো? নাকি সবকিছুতেই সমতা রাখা দরকার এজন্য কিছু চন্দ্ররঙের প্রেমের আড়ালে কিছু অমাবস্যার মতো অন্ধকার রঙের প্রেমের কাহিনী থেকে যায়? প্রশ্নগুলো থেকেই গেলো শান্তর মনে।

শান্ত বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। একবুক শ্বাস নিয়ে অন্ধকারের মাঝে দাঁড়িয়ে নিজ মনেই বললো,
-“ভালো থাকুক সকল চন্দ্ররঙা প্রেম, সেই সাথে ভালো থাকুক অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া প্রেম গুলোও।”

সমাপ্ত।।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here