চাতকের_তৃষ্ণা_তুমুল_বর্ষা পর্ব ৮

#চাতকের_তৃষ্ণা_তুমুল_বর্ষা – ৮

‘ছুটি?’

মুষড়ে পরা আমি নিজেকে সামলে নিলাম। পাতলা শাড়ি টেনেটুনে নিজেকে ঢেকেঢুকে মাথা উঠিয়ে বসলাম।

‘তুই এইখানে কী করিস? একা একা? সবাই ওইদিকে ডাকে তোরে? বাড়ির বড়বউ, তার খবর নেই। আদরের ছোটমেয়েরও খবর নেই।’ ফিচেল হাসি হাসল মিজাভাই। আমার কাটার উপর লবণ ঢেলে দিলো যেন। তিক্ততা মিশিয়ে আমিও ঝাঁজের সাথে বললাম ‘আপনি এইখানে আসছেন কেন?’

‘আমিতো আম্মুর ওষুধ নিতে আসছি। তুই কি কান্দিস নাকি রে?’

আমি উত্তর দিলাম না মিজাভাইর প্রশ্নের!

মিজাভাই চলে গেলো। আমি ভাবতে থাকলাম, এই এত এত কটুক্তি, ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ আর আজকের অপমানের পরে আমার বেঁচে থাকার কোনো প্রয়োজন আছে কীনা! এই জীবন রেখে কী লাভ? কিভাবে মিতাভাইর সামনে যাব আমি আর কোনোদিন? মরে যাব আমি? মরে যাওয়াই উচিত। কিভাবে মরে যাব?

‘ছুটি?’

‘আপনি আবার কেন এসেছেন?’

‘আরেহ! আমার উপর চেতিস কেন? আমি কি তোরে কখনও কিছু বলছি?’

‘বলেন না মানে কী? কী বলেন না? কে বলতে বাকি রেখেছে আমাকে? কী বলতে বাকি রেখেছেন আপনারা? শুধু ভালোবাসি বলে সব সহ্য করে যাই আমি। নিজেকে ছোটো করতে করতে এতোখানি নিচে নামিয়ে ফেলেছি তাও। সবাই কত বড় বড় বুলি শেখায়, সম্মান, আত্মমর্যাদার গালভারি কানভরা শব্দ শেখায়, আমি কিচ্ছু শুনিনা, শুধু ভালোবাসি বলে। সেই ভালোবাসা আমাকে পায়ে দলে মুচড়ে দিয় যায়। পথের ধুলোর মতো ঝাড়া দিয়ে ফেলে দেয়, তাও আমি তার পায়ের ধুলো মাথায় দেওয়ার আশায় চাতকের মতো দিন গুনি। আর আপনারা কী চান? মরে যাই তাই চান? বেশ মরে যাবো আমি। তারপর বিয়ে দিয়েন আপনি আপনার ভাইকে কনক আপার সাথে!’ অসম্ভব তারস্বরে চিৎকার করে কেঁদেকেটে এক নিঃশ্বাসে বললাম আমি মিজাভাইকে। সে একটু অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে। তারপর জোর করিয়ে সোফার উপর বসিয়ে ঘরের পাখা ছেড়ে দিলো। এক গ্লাস পানি এনে আমার হাতে দিলো।

‘আমাদেরই ভুল হয়েছে। তোর উপরে রাগ করেছি শুধু আমরা। রাগ করে তোকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি আর তুই আরও বেশি ভুল করেছিস। শোন না, রাগ করিস না। আমি তো একটু ইয়ার্কি করিই বেশি। এক ঢোঁকে পানিটা খেয়ে ঠান্ডা হয়ে বলতো দেখি কী সমস্যা?’

আমি নাক টানতে টানতে কিছু না বলেই উৎসুক হলাম মিজাভাইর কথায়।

‘অবশ্য তুই আমাদের কথা শুনতিও না। এমনিতেই তোর বয়স কম। এই আঠারো উনিশের সাইকোলজি অনেক জটিল। তার উপরে সবার ছোটো হওয়ায় আদরে বাঁদর হয়ে বাঁদরামিই বেড়েছে, মেন্টাল গ্রোথ কিছু নেই। তুই যেটা করেছিস সেটা পনেরোর কিশোরীরা করে। তাও অতি সাহসী হলে! অত কঠিন মিতাভাইকেও তুই যাস্ট খেলে দিয়েছিস!’

একটু সহানুভূতি পেয়েছিলাম মিজাভাইর গলায় যাহোক, শেষটুকু আবার সেই বিদ্রুপে ঠাসা!

‘ছুটিরে এরকম হয়, জানিস? ইনফ্যাচুয়েশন, অবসেশন, এডিক্টিভ লাভ এইসব টার্মের সাথে ভালোবাসা, প্রেম এগুলো সব গুলিয়ে যায়। এই দেখ তোর মনে হয় না, মিতাভাই একেবারে পারফেক্ট একটা মানুষ, দেবদূত টাইপ? এমন মানুষ আর একটাও নেই পৃথিবীতে, মনে হয় না? মিতাভাইকে না পেলে তোর জীবনের কোনো মানে নেই এসব মনে হয় না? বা ধর এরকম হয় কখনো, ছোটচাচা, ছোটচাচিকেও জীবনে দরকার নেই এরকম মনে হয়। হয় তো?’

একদম আমার মনের কথা। আমি মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম। কী করে বলছে সব মিজাভাই। ডাক্তার বলেই কী?

‘আবার এইযে তুই যেটা ভাবছিস, শুধুও সেটাই ঠিক মনে হয়। আমি, পিউ, মিলা, তোর বাবা মা, আমার বাবা মা সবাই যা বলে সব ভুল মনে হয়, তাই না? মিতাভাইকে নিয়ে আলাদা থাকতে ইচ্ছে করে, আমাদের সবার থেকে দূরে তাই না?’

আমি লজ্জিত চোখে মাথাটা উপরনিচ করলাম শুধু। আমার মনে হয় তো, মিতাভাইকে নিয়ে কোনো দূরদেশে চলে যাই। ম্যাপল গাছের ছায়ায় ছোটো একটা কটেজ থাকবে আমাদের, সামনে ড্যাফোডিল আর টিউলিপের ঝাড়! চেরির ডালে বসন্তের কোকিল ডেকে যাবে নিরবতা ভেঙে, কুউউউ – কুউউ! কখনো বরফে ঢেকে যাবে চারপাশ, সাবেকি ফায়ারপ্লেসে কাঠের আগুন জ্বালিয়ে আমরা মুখোমুখি বসে কফির কাপে চুমুক দেবো!

‘মিতাভাইর জন্য সব ছেড়েছিস তুই। সব। এইযে তুই পড়াশোনা করিস – ভালো ছাত্রী, এটা কিন্তু তুই না। এটা মিফতাহুল ইসলামে মুগ্ধ মেয়েটা। তুই হলি সেই হারমোনিয়াম ছাড়াই বিশুদ্ধ নজরুলগীতি গেয়ে সবাইকে চমকে দেওয়া মেয়েটা। নজরুলের গান সঠিক সুরে গাওয়া কিন্তু অনেক কঠিন জানিস তো! সুর নিয়ে, ছন্দ নিয়ে লোকটা এমন সব এক্সপেরিমেন্ট করে গেছে যে ভাবলেও আমার মাথা ঘুরে যায়। নজরুলগীতি হচ্ছে বিশুদ্ধ সঙ্গীত! যাকগে, নজরুলকে ছেড়ে তোর কথায় আসি। তুই সেই গানই ভুলে গেছিস! গুনগুন করেও গাইতে শুনিনা তোকে কখনও। কারণ মিতাভাই তোর গান শোনে না, পছন্দ করে না! ‘

করুণচোখে তাকালাম মিজাভাইর দিকে। কিভাবে মিলে যাচ্ছে সব কথাগুলো। মিজাভাই কি আমার মনের ভিতর ঢুকতে পারে? আমার মন পড়তে পারে ও?

‘এসব ইনফ্যাচুয়েশন এর সিম্পটম। এইযে একা একা কাঁদছিলি, কারণ তোর নিজেকে একা মনে হয়। মনের কথা বলার মতো তোর কেউ নেই। এটা যেমন আমরা তোকে মেন্টাল সাপোর্ট দেই না সেই কারণ একটা, তেমনি তুইও তোর মনের কথা কাউকে বলতে চাসনা, মিতাভাই ছাড়া অন্য কাউকে তোর প্রয়োজন মনে করিস না। তোর বান্ধবিদের সাথে মিশিস না, মিশলেও হয়তো যতটুকু কথা বলিস তার বেশিরভাগ জুড়েই থাকে মিতাভাই। এভাবে তুই একলা হয়ে যাচ্ছিস। যতটা একলা তুই তার চেয়ে বেশি একা ভাবছিস নিজেকে। তাই নারে ছুটিমণি?’

কারও গলায় আমার জন্য এতো স্নেহ পাইনা আমি কতদিন? মন আর্দ্র হতে লাগল আমার।

‘আজ কী হয়েছে? মরে যাওয়ার কথা ভাবছিস নাকি? না মানে, যেভাবে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছিস দেখলাম, ভাবলাম ঝুলেটুলে পড়বি কীনা!’ বাঁকা হাসি হাসল মিজাভাই।

কিছু লোক আছে না, সামান্য আটপৌরে কথাটাকেই পেঁচিয়ে জিলিপি বানিয়ে ফেলে এই মিজাভাই হলো সেইগোত্রের দলপতি।

‘মিতাভাই জানালা দিয়ে কনক আপার দিকে তাকিয়েছিলো।’ প্রগাঢ় অভিমানে বললাম আমি।

মিজাভাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। তারপর আস্তে করে বলল ‘ছুটিরে মরে যাওয়া তো খুব সহজ! চাইলেই মরে যাওয়া যায়। কিন্তু বাঁচার মতো বাঁচে কয়জনে। এই বেঁচে থাকা, সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটা যে আল্লাহর কতবড় নেয়ামত তা দেখতে হলে আমার সাথে হাসপাতালে যাবি একদিন। একটু বাঁচার জন্য, একদিন বেশি বাঁচার জন্য, এইমূহুর্ত বেশি এই পৃথিবীতে থাকার জন্য মানুষের যে আকুতি, যে চেষ্টা তা দেখলে তোর কষ্ট ওদের হাহাকারের কাছে সরষেদানার সমান মনে হবে। সারি সারি বেডে অসহায় রোগীদের কাতরতা দেখলে তুই বুঝবি, আমরা বাঁচার জন্য খাই, বাঁচার জন্য শ্বাস নিই আর বাঁচার জন্যই ভালোবাসি, ভালোবাসার জন্য কিন্তু বাঁচি না কেউ। তাহলে ভালোবাসা না পেলে মরব কেন? তোর শরীরের ব্যথার ভাগ কেউ নিতে পারবে না, তাহলে মনের ভাগ কেন দিতে চাস? তোরটা তোকেই বুঝতে হবে। তোর জন্যই তুই বাঁচবি। নিজেকে ভালোবেসেই অন্যকে ভালোবাসবি। এইযে তুই মিতাভাইকে ভালোবাসিস। তাকে নিজের জন্য চাস বলেই ভালোবাসিস। নইলে সে কনককে ভালোবাসলেই তোর কিছু আসত যেত না। সবাইকে আমরা নিজের জন্যই ভালোবাসি, নিজের জন্যই চাই। তাই নিজেকে ভালোবাসতে হয় সবচাইতে বেশি। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় সবচেয়ে আনন্দে। বুঝেছিস ছুটকি? এজন্যই মিতাভাইকে ভুলে যাবি তুই। পারবি না?’

আমি তাড়াতাড়ি করে ডাইনে বায়ে জোরে জোরে মাথা নাড়লাম। মিতাভাইকে ভোলা আমার পক্ষে সম্ভব না!

‘এই দেখ আমরা কতটা স্বার্থপর! তুই চাইছিস মিতাভাই কনক আপাকে ভুলে যাক। কনক আপাকে নাকি সে ভালোবাসত, তুই চাইছিস তার সেই ভালোবাসা সে ভুলে যাক। অথচ তুই কিন্তু তোর ভালোবাসা ভুলতে পারবি না! তুই বলছিস তোর পক্ষে মিতাভাইকে ভোলা অসম্ভব। এখন মিতাভাই যদি বলে সে কনককে ভুলতে পারবে না তবে তাকে কি দোষ দেওয়া যায়? একটা পরিস্থিতিতে পড়ে মিতাভাইকে তুই বিয়ের মতো সম্পর্কে বেঁধেছিস। এমন কথা তুই বলেছিলি হয়তো, এমন পাজল খেলেছিলি যে তার সামনে তোকে বিয়ে করা ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না। তুই ট্র‍্যাপ করেছিস তাকে। এখন তাকে দোষ দিতে পারিস না। তোকে সে কখনও বউ হিসেবে ভাবেইনি। কখনো চায়নি। হঠাৎ করে তোকে মেনে নেওয়া তার জন্য কষ্টের। হয়তো সে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। বা চেষ্টাই করে না। একটু সময় তো তাকে দিতে হবেই।’

‘সময় দিলেই সে ভালোবাসবে আমায়?’ আমি খুব আগ্রহী হলাম মিজাভাইর কথায়।

‘হয়তো, হয়তো না। হয়তো একদিন সে তোকে ভালোবাসবে, আবার হয়তো কোনোদিনই সে তোর হবে না। ছুটি ভালোবাসা খুব সহজ। কখনো একদেখাতেই তুমুল ভালোবাসা হয়। আবার সারাজীবন এক বালিশে ঘুমিয়েও প্রেম হয় না। আবার অভ্যাসেও কেউ কেউ ভালোবেসে ফেলে অভ্যাসটাকে। মিতাভাইর ঘোর থেকে বেরিয়ে আয় ছুটি। সে হয়তো তোর জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণই শুধু, সে তোর জীবন না। নিজেকে সাজিয়ে ফেল। যা ভালো লাগে কর। তাকে পাওয়ার আশা না করলেই হয়তো পেয়ে যাবে কোনোদিন। আর কনকের কথা বলছিস? চোখের দেখাও কী সত্যি হয় সবসময়? না হওয়াটা জরুরি? তুই যে এনগেল থেকে দেখলি সেটাই হয়তো ডাহা মিথ্যা। মস্তিষ্ক এখানেও খেলা খেলে মন নিয়ে। যা আমরা দেখতে চাই, তাই দেখায় আমাদেরকে। তুই মিতাভাইকে নিয়ে ওভারপজেসিভ, বাতিকগ্রস্ত, সন্দেহ করিস তাই খুব নিরীহ একটা জানালায় দাঁড়ানোকে রঙ দিয়ে ফেলেসিস। আমি জানিনা, আবার এমনও হতে পারে সে আসলেই এখনো কনককেই মনে ধরে রেখে আছে।’

আমার চোখ আবার ভিজে এলো। আসলেই মিজাভাই যা বলছে সব ঠিক। আমি শুধু তাই শুনতে চাই যা শুনতে আমি ভালোবাসি। কেউ আমার অপছন্দের কথা বললেই আমি ক্ষেপে যাই, ঝগড়া করি, তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেই। কেউ আমার এই বিয়ের বিরুদ্ধে বললেই আমি সরে আসি সেখান থেকে। আমি ভেবেছিলাম আস্তে আস্তে মিতাভাইর মনে জায়গা করে নেব। কিন্তু সেসব কিছুই তো হলো না। এক ঘরে থেকেও আমরা কত দূরের মানুষ। আর এখন তো আরও দূর হয়ে যাবো। কীকরে বাঁচব আমি?

‘ছুটি?’ আমাকে চিন্তার দুনিয়া থেকে টেনে আনল মিজাভাই।

‘হুম’

‘তুই কয়েকটা দিনের জন্য ছুটি নে, বুঝলি?’

‘মানে? কোথা থেকে ছুটি নেব?’

‘প্রথমত ছুটি নিবি মিতাভাইর কাছ থেকে। তুই এই বিয়ে শেষ হওয়া পর্যন্ত মিতাভাইর সাথে একঘরে থাকবি না, দেখা করবি না, কথা বলবি না, এমনকি ভাববিও না। বুঝেছিস?’

‘এটা অসম্ভব!’

‘অসম্ভবকে সম্ভব করাই ছুটিরাণির কাজ! ফাঁসিয়ে বিয়ে করে ফেললি এখন একটু লেজে ঘোরাতে পারবি না? মেয়েজাতের কলংক তো তুই। এই গল্প অন্য মেয়েদের বললে তারা বাড়ি বয়ে ঠেঙাতে আসবে তোকে!’

‘হুহ’ ভেঙচি দিয়ে সোজা হয়ে বসলাম আমি। মিজাভাই বলছে ‘ধর কয়েকদিন তোর অদেখায় মিতাভাই তোর অভাব বুঝতে পারল, সে না বুঝলেও তোর জন্য তার মনে কোনো টান আছে কীনা আমি বুঝে নেব। তারপর তাকে বুঝিয়ে দেব। ব্যাটা ছয় যোগ নয় বোঝে, সিক্সটি নাইন বোঝে না!’

‘সিক্সটি নাইন কী?’ আমি জানতে চাইলে মিজাভাই তেড়ে আসল ‘বদমেয়ে, বয়স উনিশ কুড়ি, চৌদ্দ সেজে থাকলে বর তো পালাবেই!’ আবার বসে নিজেকে কুল ডাউন করে বলল ‘তোর বরকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে না দিলে তো সে বুঝবে না সে তোকে ভালোবাসে কি ভালোবাসে না। এখন একটা অভ্যাসে খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে – সে কিছুই বুঝছে না, হঠাৎ তুই না থাকলে যে পরিবর্তন আসবে সেটাতে সে প্রতিক্রিয়া তো করবেই!’

‘যদি কোনো প্রতিক্রিয়াই না করে?’ ভয়ে ভয়ে বললাম আমি।

‘নাও করতে পারে। ইমোশনলেস! আমার তো ধারণা আব্বা আম্মা ওইটাকে লোহালক্করের দোকান থেকে ওজন মেপে কিনে এনেছে। তোর এতো প্রেম করার সখ আব্বার লোহার আলমারিটার সাথে করতে পারতি, বিশ্বাস কর ফিডব্যাক একই হতো!’

আমি হেসে ফেললাম মিজাভাইর কথায়। ভুল কিছু বলেনি সে। ‘হুম সে প্রতিক্রিয়া নাও দেখাতে পারে। তখন আমরা করব কি টাইম বাড়িয়ে দেব। একসপ্তাহ, একমাস, একবছর!’

‘না, না, না একবছর না। একবছর আমি দূরে থাকতে পারব না।’

‘এটারও একটা পরীক্ষা হয়ে যাবে। তোর দিক থেকে টিনএজ ইনফ্যাচুয়েশন নাকি সত্যিকারের জনম জনম কা ভালোবাসা তাও বোঝা হয়ে যাবে। তার কাছ থেকে একবছর দূরে থেকেও যদি তোর এমন প্রেমপ্রেমই লাগে তাহলে বুঝে নেব এটা তোর একচুয়ালি টুরু লাব!’

আমি আবারও হেসে ফেললাম ‘আর যদি টুরু লাব না হয়, তো?’

‘তাহলে বাংলার ঘরে ঘরে, আকাশে বাতাসে আনন্দের ঢেউ জাগবে, লোকে মিজবাউল ইসলামের নামে আনন্দধ্বনি দেবে।’ যাত্রার ঢঙে বললেন মিজাভাই।

‘মিজিবাউল ইসলামের নামে?’

‘হ্যাঁ। বুদ্ধিটা তো আমারই। আর এই হাঁটুর বয়সী কাউকে ভাবি ডাকতে হবে না এর চাইতে আনন্দের কি কিছু হতে পারে?’

‘এসব কথা আপনি আগে কেন বলেননি মিজাভাই?’

‘আগে বললে তুই কি শুনতি আমার কথা? আমাদের মস্তিষ্কে নিউরনের যে খেলা চলে সেগুলো এমনভাবে ফাংশন করা যে আমরা সেসব কথাই মানি, বুঝি যেগুলো আমাদের মনের মতো, আমাদের মতের। বিপরীত কোনো কথা শোনার জন্য আমরা একেবারেই তৈরি থাকি না। বিশ্বাস করি না। আমরা সেসব যুক্তি পছন্দ করি, যেগুলো পছন্দ করতে আমরা ভালোবাসি। যা আমরা পছন্দ করতে চাইনা সেগুলো আমরা শুনতেও চাইনা। তোর কাছে মিতাভাই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে ভালো আর তোর সবচেয়ে প্রিয়। এই ভালো আর প্রিয়টা তুই তোর করে নিতে চাইছিস। যে এর বিপক্ষে বলছে তাকেই তুই অপছন্দ করছিস। এখন ভেবে দেখ মিতাভাই কি মানুষ না? সে কি দোষ গুণের বাইরে? না, তা তো না! ধরলাম সে তোর ট্র‍্যাপে পড়ে তোকে বিয়ে করেছে। যেভাবেই হোক না কেন তোকে বিয়ে করার মাধ্যমেই সে সমাধান পেয়েছে তার সমস্যার। কিন্তু তারপরেই সে তোকে ছেঁটে ফেলেছে আবার ঝেড়ে ফেলেনি কিন্তু, ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছে। তোকে সে বিয়ে করেছে কিন্তু বউ করেনি। আবার তুই কী করবি সেই ভাবনাও ভাবেনি। তোকে কিছু বোঝানোর চেষ্টাও করেনি। হয়তো মিতাভাই তোকে নিয়ে ভাবেইনা। তবে তুই কেন এতো পাগলি হবি? তুই কেন তাকে নিয়ে পড়ে থাকবি?’

‘মিতাভাইকে ছাড়া আমি বাঁচব না। বাঁচতে চাইনা।’

‘তোকে আসলেই উন্ধধুন্ধ মাইর দেওয়া দরকার।’ মিজাভাই আমার পায়ের কাছে আসন করে বসে আমার হাতদুটো টেনে নিলো ‘আমরা কারো জন্য বাঁচিনা ছুটি। কারো জন্য মরিনা। আমরা নিজেদের জন্য বাঁচি। মায়ের ভালোবাসা সবচেয়ে মহান দুনিয়ায়, সেই মাও কিন্তু নিজের স্বার্থেই সন্তানকে ভালোবাসে। তার ভালোবাসতে ভালো লাগে তাই সে ভালোবাসে। তুই ভাবতে পছন্দ করিস, তুই মিতাভাইকে ভালোবাসিস, আসলে এটা বয়সের সমস্যা, ইনফ্যাচুয়েশন – হয়তো আরেকটু বড় হতে হতে এটা কেটে যাবে। কিন্তু ততদিনে জীবনের সৌন্দর্য তোর কাছে ম্লান হয়ে যাবে। তাই নিজেকে সময় দে, নিজের যা ভালো লাগে তাই কর। নিজের জীবন গড়ে নে। অন্তত কয়েকটা দিন মিতাভাইকে দে, নিজেকে দে।’

‘আমি আপনার সব কথা শুনব মিজাভাই। যা বলবেন তাই করব।’

‘আমার কথা তুই কেন শুনবি? তুই শুনবি তোর কথা। অবশ্যই মিতাভাইর ছায়া থাকবে না সেখানে। বুঝেছ, বৌরাণি?’

‘আবার ভেঙাচ্ছেন, মিজাভাই?’

‘কেন? তুই তো আমার বড়ভাইয়ের বৌ। আমার বৌরাণি। নাকি? অবশ্য বয়সে আমি তোর বড় হই। তাড়াতাড়ি পায়ের ধুলো নে তো!’

আমি সত্যি সত্যি খুব ভক্তিসহকারে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম মিজাভাইকে। সে তৎক্ষনাৎ আমার মাথায় হাত দিয়ে বেশ নাটকিয় কায়দায় হাত তুলে দোয়া করল ‘ভালো থাকো, সুখে থাকো, বেঁচে থাকো বৎস, হাজারবছর বেঁচে থাকো! শুধু তোমার ছেলেমেয়ের মা তাড়াতাড়ি মরে যাক!’

চলবে…

afsana asha
(কপি করা যাবে না)

প্রিয় পাঠক, আইডিতে রিপোর্ট পড়ায় রিচ একেবারে নেমে গেছে। গতপর্ব নিয়মিত পাঠকের কাছে পৌঁছায়নি। তো অনুরোধ ,আজকে সবাই যারাই পোস্টটি পড়েছেন একটা কমেন্ট করে যাবেন। কিছু না লিখতে ইচ্ছে হলে একটা লাভ ইমো দিয়ে যাবেন। 😬 সবার রিএক্ট/কমেন্ট আজ চাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here