চিত্তদাহ লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা পর্ব ৩৩

0
503

#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ৩৩

🍂🍂🍂

চোখ খুলতেই শুভ্রতা নিজেকে তার ঘরে পেলো। মাথার পাশে তিলোত্তমা চিন্তিত হয়ে বসা। শুভ্রতা উঠে বসতেই তটস্থ ভঙ্গিতে জমেলা তার পাশে এসে বসলো,

~বইন! খারাপ লাগতাছে বেশি? কি হইছিলো তোর?

শুভ্রতা খেয়াল করলো ঘরে আরো অনেকেই আছে। রুপা, রাত্রি, চিত্রা, রেনু, অনিকা, শ্রেয়া আর তার মা। কেউ খাটে তো কেউ ফ্লোরে বসে আছে। টেবিলের কাছের চেয়ারটা ফাঁকা। হয়তো সেখানেই বসে ছিল জমেলা। চন্দ্ররা এখনও আসেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো ফিরবে। জমেলা এটা সেটা বলে কাঁদছেন। ঘরের সবাই কাঁদছে। শুভ্রতা চুপ করে তার নানীর দিকে চেয়ে আছে। মানুষটা কয়েকদিন আগেই মেয়ের অসুস্থতা দেখে তার গায়ে হাত তুলেছিলো আর আজ কেমন জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। স্বাভাবিক। মেয়ের শেষ সম্বল সে। হটাৎই নিচ থেকে ভাঙচুরের শব্দে চমকে উঠলো সবাই। সবার চোখে মুখে আতঙ্ক দেখা দিলো। ছুটে গেলো নিচে। শুভ্রতা স্বাভাবিক চোখেই সবার যাওয়া দেখলো। তিলোত্তমা স্থির দৃষ্টিতে শুভ্রতার দিকে চেয়ে বসে রইলো। সে ঘর থেকে গেলো না। দুজনেই জানে নিচে কে ভাঙচুর করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রেনু দৌড়ে এলো।

~আপামনি, খালু আইছে।

শুভ্রতা আস্তে ধীরে নিচে গেলো। তার মধ্যে কোনোরূপ তাড়া দেখা দিলো না।

~সাজানো সংসার ভেঙ্গেও শান্তি হয়নি যে এখন সংসারের জিনিসপত্রও ভাঙছেন।

আবসার ক্ষিপ্ত চোখে চেয়ে হাতে থাকা ফুলদানিটা আছার মারলেন।

~কেনো করলি এমন? ওর জানাজায় পর্যন্ত আমাকে যেতে দিলি না।

শুভ্রতা জবাব দিলো না। আরাম করে সিড়ির ঠিক মাঝখানে গিয়ে বসলো। এখান থেকে সুন্দর পুরো ড্রয়িং রুম দেখা যাচ্ছে। কথা বললেও সবাই বেশ ভালো করে শুনতে পাবে, চিল্লিয়ে বলা লাগবে না।

~ওর মুখ দেখতে পারিনি, শেষবার হাসপাতালে দেখাও করতে পারিনি, শেষে ওর জানাজায়ও যেতে দিলি না। এতোটা নির্দয় তুই! কি পেলি এসব করে?
~আমার মাকে মেরে আপনার বউ কি পেলো? আগে তার জবাব দিন।
~আমার বউ?
~ইতিকে ছাড়াও আর কতজনকে বিয়ে করেছেন আপনি?
~মুখ সামনে কথা বল শুভ্রতা।

শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। এক দফা সারা ঘরে ছড়িয়ে থাকা জিনিসপত্রের ভাঙ্গা টুকরোগুলোর দিকে চোখ বুলালো।

~মুখ আমার ঠিকই আছে। আগে আপনি জবাব দিন। কেনো আমার মায়ের কাছে আপনার বউকে পাঠিয়েছিলেন? হাসপাতালে যাওয়াটা কি খুব জরুরী ছিল? আমার মাকে কেনো মারলেন আপনারা?

আবসার থমকালো। সে জানতো না ইতি হাসপাতালে গিয়েছিল আজ।

~কি বলেছে ইতি?
~সেটাতো আপনি আর আপনার বউ জানে।
~আমি জানি না শুভ্রতা। সে হাসপাতালে গিয়েছিল আমি জানতাম না।

শুভ্রতা তাচ্ছিল্য হাসলো। ধীর পায়ে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রতিবারের মতো বাবার এলোমেলো চুল আর শার্টের কলার ঠিক করে দিয়ে ধরা গলায় বললো,

~বাবা, পৃথিবীর সব সম্পর্ক ছিন্ন করা গেলেও মা-বাবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা যায় না। এইযে আপনি আমার সামনে দাড়িয়ে আছেন! আমার মনটা তীব্র ঘৃণায় বিষিয়ে উঠছে। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি আপনার প্রাণটা কেড়ে নিয়ে আপনাকে আমার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেই। এতে যদি আমার সারাজীবন জেলে থাকা লাগে আমি তাও হেসে মেনে নিতে রাজি। আপনাকে আমার মা ছাড়া অন্য কারো পাশে দেখতে ভালো লাগে না।

আবসার কিছু কঠিন কথা শুনাতে চেয়েও পারলেন না। মেয়েকে ইদানিং বেশ ভয় পায় সে। যে মেয়ে আগে তাকে দেখলেই আহ্লাদী হয়ে উঠতো সে এখন তাকে দেখলেই কঠোর রূপ ধারণ করে। মেয়ের চোখে এখন আর তার জন্য মায়া দেখতে পায়না সে। শুভ্রতা এবার কণ্ঠ একটু নরম করলো। বাবার বুকে মাথা ঠেকালো। আবসারের মনটা যেনো শীতল হয়ে উঠলো। শুভ্রতা শান্ত কণ্ঠে বললো,

~আপনি চলে যান। আপনার বউ বাচ্চা নিয়ে যত দূরে সম্ভব চলে যান। আপনাকে কোনো ভাবে আঘাত করলে মা কষ্ট পাবে। আমি মাকে যতটুকু সম্ভব প্রোটেক্ট করেছি। সে চলে গেছে। আপনার বউ যেই আশায় আমার মায়ের কাছে গিয়েছিলো আমার মা তার সেই আশা পূরণ করেছে। আপনাকে মুক্ত করে দিয়ে গেছেন। আমি আমার মায়ের মত নরম হৃদয়ের হতে পারিনি। হয়তো পারবো না।

শুভ্রতা বাবার বুক থেকে মাথা তুললো। সোজা হয়ে দাড়িয়ে ফের বললো,

~রেনু আপা বলেছে মা মরার আগে আপনাকে ক্ষমা করে গিয়েছেন। আমাকে বলতে বলেছে আমি যেনো আপনার বা আপনার বউয়ের কোনোরূপ ক্ষতি না করি। এটাই নাকি তার শেষ ইচ্ছা। কি অদ্ভুত ভাগ্য আমার তাই না বাবা? আপনার ভুলের জন্য শাস্তিও দিতে পারছি না। তবে আপনি আফসোস করবেন। আমার মাকে শেষবার না দেখতে পারার আফসোস, তার জানাজায় না দাড়াতে পারার আফসোস। এই আফসোস নিয়েই আপনার বাকি জীবন পার হয়ে যাবে। এটাই আপনার শাস্তি।

চন্দ্ররা বাড়িতে প্রবেশ করেছে। মাহতাব এসে সোফায় আরাম করে বসলো। উমাকে মাটি দিয়েই তার লোকদের ফোন করে বলেছে যেনো তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছাড়া পেতেই যে ছুটে এখানে আসবে সেটা সে আগেই আন্দাজ করে রেখেছিল। আবসার কাতর চোখে মেয়ের দিকে চাইলো। গাল গড়িয়ে পড়ছে তার অশ্রুকণা। শুভ্রতা গম্ভীর চিত্তে পিতার কান্না দেখলো। আবসার নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। ঠিক করলেন মেয়ের কথা মতো আর আসবেন না এই বাড়িতে।
___________________________________

আবসার যেতেই শুভ্রতা ঘরের দিকে পা বাড়ালো। পরক্ষণেই মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো। পা খানা ব্যাথায় চিনচিন করছে। ধপ করে পাশের সোফায় বসে দেখলো পায়ে কাঁচ বিধেছে। চন্দ্র ছুটে এলো তার কাছে। অস্থির হয়ে বলে উঠলো,

~দেখি, দেখি! ইশ! কতটা কেটে গেছে! রেনু আপা ফাস্ট এইড বক্সটা….

চন্দ্র কথা শেষ করার আগেই রেনু ফাস্ট এইড বক্স এনে চন্দ্রের হাতে দিলো। চন্দ্রের হাত কাপছে, যেমনটা সেদিন অরণ্যের কেপেছিল। চন্দ্র মনে মনে বললো,

~প্রেয়সীর ক্ষতের চিকিৎসা করতে সত্যিই অনেকটা কষ্টকর।

পায়ে স্যাভলন লাগাতেই শুভ্রতা কুকিয়ে উঠলো। চন্দ্র করুন দৃষ্টিতে তাকালো। যেনো ব্যাথাটা সে নিজেই পেয়েছে।

~সরি, সরি শুভ্রতা। ব্যাথা করছে? জ্বলছে বেশি?

শুভ্রতা মাথা ঝাঁকালো। অরণ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

~তোর হাত কাপছে আহনাফ। সর আমাকে দেখতে দে।

চন্দ্র সরে দাড়ালো। সে বুঝতে পেরেছে বেশ ভালো সার্জন হলেও প্রেয়সীর চিকিৎসা করা তার পক্ষে সম্ভব না। ব্যান্ডেজ শেষে অরণ্য নিজ থেকেই বললো,

~কাটা পা নিয়ে হাঁটতে পারবি? আমি ঘরে দিয়ে আসি?

চন্দ্র নিশ্চুপ হয়ে সায় দিলো। অরণ্য সযত্নে শুভ্রতাকে কোলে তুলে নিলো। ফুপির মৃত্যুতে বোনকে নিয়ে তার মধ্যে অস্থিরতা বেড়েছে। মায়ের থেকে কম ভালোবাসা দেয়নি উমা। বাড়ি এলেই এটা সেটা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়তো তার জন্য। উমা সবসময় বলতো,

~আমি চলে গেলে তোকেই তোর বোনের খেয়াল রাখতে হবে অরু। সে কিন্তু আমার শেষ স্মৃতি।

অরণ্য ভেবে নিয়েছে সারাজীবন তার বোনকে আগলে রাখবে। চন্দ্র এর প্রতিও তার বিশ্বাস অসীম। সময় হলে চন্দ্রের হাতেই তুলে দিবে শুভ্রতাকে।
~~~
চলবে~

(রাতে আরেকটা পর্ব দিবো ভাবছি। কমেন্টে জানাবেন আরেকটা পর্ব চাই কি না। হ্যাপি রিডিং~)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here