#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ৩৭
🍂🍂🍂
গায়ে জড়ানো সাদা শাড়িটা রক্তে লাল রং ধারণ করেছে। এক প্রকার নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে শুভ্রতা। শুভ্রতার মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে বসে আছে চন্দ্র। চন্দ্রর চোখ বার বার কান্নার কারণে ঝাপসা হয়ে আসছে।
~এই শুভ্রতা, এই মেয়ে? চোখ খোলো! এই মেয়ে প্লীজ জ্ঞানে থাকার চেষ্টা করো। আমরা এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি, আর একটু ধৈর্য ধরো প্লীজ। এই অরণ্য! গাড়ির বেগ বাড়া না।
অরণ্য যথাসম্ভব দ্রুত বেগে গাড়ি চালাচ্ছে। তারপরও চন্দ্র ক্ষণে ক্ষণে অরণ্যকে ধমক দিয়ে বলছে গাড়ি দ্রুত চালাতে। এবার ধমক দিতেই অরণ্য মিররে চন্দ্রের দিকে তাকালো। শুভ্রতাকে স্বযত্নে বুকে জড়িয়ে কাদঁছে আর পাগলের মতো বিলাপ করে যাচ্ছে। এক পলক তাকালো অর্ণবের দিকে। যার চোখে মুখে ভয়, চিন্তা স্পষ্ট।
~আহনাফ, নিজেকে শক্ত কর। এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না।
চন্দ্রর কানে যেনো অরণ্যের কোনো কথা ঢুকলোই না। সে নিজের মতো শুভ্রতাকে ডেকেই চলেছে। অরণ্য দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। অরণ্য নিজেকে কোনো মতো সামলে রেখেছে। ভেবেই নিয়েছে শুভ্রতা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত সে আর শুভ্রতা, চন্দ্রের মুখের দিকে তাকাবে না। এমন দাম্ভিক, কাঠিন্য মেজাজের মানুষই যদি এভাবে ভেঙে পড়ে। তবে সেও নির্ঘাত ভেঙে পড়বে। তবে আবার নিজ ভাবনায়ই এলো। চিকিৎসা তো তারই করতে হবে। শুভ্রতার দিকে না তাকিয়েও উপায় নেই।
_____________________________________
করিডোরে বেশ চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে তিলোত্তমা। মনে মনে শুধু বলছে শুভ্রতা যেনো সুস্থ হয়ে যায়। তিলোত্তমার ঠিক সামনেই মাথা নত করে দাড়িয়ে আছে অর্ণব। সে ভেবেছিল হুট করে দেশে এসে শুভ্রতাকে সারপ্রাইজ দিবে কিন্তু সে যে নিজেই উল্টো শক খাবে তা সে কস্মিনকালেও ভাবেনি। অর্ণব অপারেশন থিয়েটারের দিকে তাকালো। অপারেশন থিয়েটারের সামনে দাড়িয়ে আছে চন্দ্র। গায়ের শুভ্র রঙের পাঞ্জাবিটা শুভ্রতার রক্তে লাল হয়ে আছে। দৃষ্টি তার দরজার ওপাশে শুয়ে থাকা শুভ্রতার দিকে। সে সচ্ছ কাচের সামনে দাড়িয়ে দেখছে ওপাশে চিকিৎসারত প্রিয় মানুষটাকে। চন্দ্রের অভিব্যক্তি বুঝার চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে অর্ণব। সারা রাস্তা সে চিৎকার চেঁচামেচি করেছে। শুভ্রতাকে নিয়ে পাগলামি করেছে। হাসপাতালে এনে অপারেশন থিয়েটারেও সে সাথে ঢুকতে চাইলে কঠোরভাবে মানা করে গেছে অরণ্য। চন্দ্রকে অন্য সবাই খুব সহজে বুঝতে না পারলেও সে ঠিক জানে তার বন্ধুকে। অপারেশন করতে পারবে উপরে উপরে সে বললেও শুভ্রতার এই অবস্থায় সে ভেতরে ঠিক ভেঙে পড়েছে। এটা তার ব্যবহারেই স্পষ্ট। শুভ্রতাকে ভেতরে নেওয়ার পর সেই যে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে গত ৩ ঘন্টার মধ্যে নিজে সরে দাঁড়ানো দূরে থাক একবারের জন্য দৃষ্টি পর্যন্ত সরায়নি। শুধু গম্ভীর কন্ঠে কয়েকজন মানুষের সাথে কথা বলেছে। যারা নিতান্তই অপরিচিত অর্ণবের কাছে।
~স্যার আপনার কথা মতো ৫ ব্যাগ রক্ত আনিয়েছি।
~দাড়িয়ে থাকো ওমর। কিছুক্ষণের মধ্যেই নার্স নিতে আসবে।
চন্দ্রের কথা কর্ণপাত হতেই লোকটা রোবটের মতো এক পাশে দাড়িয়ে রইলো। অর্ণব ভ্রু কুঁচকে পর্যবেক্ষণ করছে সব। চন্দ্র যে বেশ পাওয়ারফুল মানুষ তা ইতিমধ্যেই ওর আর বাকি সবার আচরণে খুব ভালোই বুঝতে পেরেছে ও। ওর ভাবনার মধ্যেই আরো কয়েকজন মানুষ সেখানে হাজির হলো। এর মধ্যে একজন ছেলে নরমাল ড্রেস পরিহিত আর বাকি সবাই একই রকম জামা পড়ে আছে। তাদের ড্রেসকোডই জানান দিচ্ছে তারা এই লোকটার দেহরক্ষী। মাহতাব সোজা তিলোত্তমার পাশে এসে বসলো। এই সময় ভাইয়ের কাছে যাওয়া মানেই আগুনে হাত দেওয়া।
~ডক্টর কি বললো? আর এতো রাতে এই মেয়ে হাইওয়েতে কি করছিলো? ভাইয়ের অবস্থা দেখেই বুঝা যাচ্ছে বিরাট অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।
তিলোত্তমা নিশ্চুপ। হাতে শুভ্রতার চিঠি। চিঠিটা মাহতাবের দিকে এগিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বললো,
~অ্যাকসিডেন্ট করেনি। সুইসাইড এটেম্পট করেছে।
~হোয়াট!
ঝট করে তিলোত্তমার হাত থেকে চিঠিটা নিলো মাহতাব। তাতে গুটিগুটি অক্ষরে লেখা,
“প্রিয়…
রেনু আপা, অরণ্য ভাইয়া, মামী। জানিনা চিঠিটা কখন পাবে। মায়ের যাওয়ার পর তোমরা আমার জন্য অনেক করেছো। যার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমাদের সুন্দর সংসার, আমার বন্ধুমহলটা যে এভাবে ভেঙে যাবে আমি কল্পনাও করিনি কখনো। কিন্তু বাস্তবে ঠিক এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হলো। দুঃখিত আমার জন্য তোমাদের এত ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। এমন বাজে পরিস্থিতি, এমন বাজে অনুভূতি আমার এর আগে হয়নি। আমার দম বন্ধ লাগছে। এমন জীবন আমি কখনোই চাইনি। এখনও চাইছি না। তাই চলে যাচ্ছি তোমাদের থেকে দূরে। ভালো থেকো।
তিলোত্তমা, আমি দুঃখিত। আমার জন্যে বন্ধুমহলটা এভাবে ভেঙে গেলো। হাজার চিন্তা ভাবনার পর যখন খুজে পেলাম সব নষ্টের মুলেই রয়েছি আমি। আমার আর তোদের মাঝে থাকার ইচ্ছা রইলো না। আমি চাই আমার যাওয়ার পরও আমার বন্ধুমহল এক থাকুক। নিজের খেয়াল রাখবি। রেনু আপারও খেয়াল রাখিস।
(আরেকটা চিঠি ড্রয়িং রুমে টিভির সামনে রাখা।)
ইতি
শুভ্রতা”
চিঠিটা পড়ে মাহতাব তিলোত্তমাকে বললো,
~আরেকটা চিঠি এনেছো?
তিলোত্তমা ব্যাগ থেকে বের করে আরেকটা চিঠি মাহতাবের হাতে দিলো। মাহতাব সেটা খুলতে নিতেই তিলোত্তমা বাঁধা দিয়ে বললো,
~খামের অপোজিট পাশে লেখা এটা আহনাফ ভাইয়ার জন্য।
মাহতাব শুকনো ঢোক গিলে বললো,
~এখনই দিতে হবে? ভাইয়ের মনের অবস্থা খুব খারাপ।
~তিনি কি রেগে যাবেন?
~ঠিক বুঝতে পারছি না। রাগ করবেন নাকি দুঃখী হবেন আমার জানা নেই। যদি রেগে যায়?
~বড় ভাইজান চিঠিটা দিতে বলেছে।
ওমরের কথায় মাহতাব আর তিলোত্তমা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো।
~ভাইয়া কি সব কথা শুনেছে?
~যেমনে ফিসফিস করছেন। বড় ভাইজান কেনো আমার মনে হয় অপারেশন থিয়েটারে থাকা অরণ্য ভাইও শুনেছে।
মাহতাব চোখ মুখ কালো করে তাকালো। ওমরের হাতে চিঠিটা দিতেই সে চন্দ্রের কাছে চলে গেলো। মাহতাব আর তিলোত্তমা চন্দ্রের দিকেই চেয়ে আছে। তবে চন্দ্র চিঠিটা পড়লো না। পকেটে রেখে দিলো। মাহতাব আর তিলোত্তমা একে ওপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে চুপ করে বসে রইলো।
______________________________________
অপারেশন থিয়েটার থেকে অরণ্য বেরিয়ে আসতেই মাহতাব, অর্ণব আর তিলোত্তমা তাকে ঘিরে ধরলো। সকলের চোখেই এক প্রশ্ন “শুভ্রতা ঠিক আছে তো?”। অরণ্য বেশ শীতল কণ্ঠে বললো,
~অবস্থা খুব একটা ভালো না। ২৪ ঘণ্টা আন্ডার অবজারভেশনে রাখতে হবে। দুয়া করো যেনো জ্ঞান ফিরে আসে। মাথায় গভীর ক্ষত হয়েছে। কোমায় যাওয়ার চান্স ৭০%।
অরণ্যের আর কোনো কথার অপেক্ষা করলো না চন্দ্র। হন হন করে অটিতে ঢুকে গেলো। শুভ্রতাকে এখনও কেবিনে শিফট করা হয়নি। চন্দ্র ডক্টর হওয়ায় কেউ কিছু বলতেও পারলো না। অরণ্য ক্লান্ত ভঙ্গিতে একটা চেয়ারে বসলো। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলো সকাল ৪ টা বাজে। অর্ণব বাহিরে দাড়িয়ে কেবিনে উকিঝুকি দিচ্ছে। অরণ্য তাকে ডাকলো,
~আমার মনে হয় তোর বাসায় গিয়ে রেস্ট নেওয়া উচিত। অনেক সময় জার্নি করে এসেছিস। তার ওপর এত ধকল গেলো। তুই বাসায় গিয়ে রেস্ট কর।
অর্ণব কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। আগের ন্যায় কেবিনের বাহিরে দাড়িয়ে রইলো।
~নুর ওদের জানাই?
~দরকার নেই। ও বেশ রেগে আছে। বিশ্বাস করবে না। উল্টা পাল্টা কিছু বলে ফেললে উল্টো কষ্ট পাবে।
~আমার মন খচখচ করছে। আর এমনিও আমার মনে হয় না নুর এতটাও রেগে আছে। সে শুভির এই অবস্থার খবর পেলে নিশ্চিত ছুটে আসবে।
অরণ্য কিছুক্ষণ চুপ রইলো। তিলোত্তমা অরণ্যের জবাবের অপেক্ষায় চেয়ে রইলো।
~বেশ বলো। তবে ১ ঘণ্টা পর। এখন ৪ টা বাজে। সবাই ঘুমাচ্ছে হয়তো। ৫ টা বাজে ও নামাজের জন্য উঠবে। তখন কল করে জানিয়ে দিও। আমি এখন বাসায় কিছু বলতে চাইছি না। সকালে জানাবো।
অরণ্য চোখ বন্ধ করে বসে রইলো। মাহতাবও গা এলিয়ে দিলো চেয়ারে। জরুরী মিটিং এর জন্য ঢাকার বাহিরে গিয়েছিলো। বেশ দেরি করেই পৌঁছেছিল সেখানে। হন্তদন্ত হয়ে মিটিং রুমে ঢুকার আগেই ওমর কল দিয়ে জানালো শুভ্রতার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। ভাই, ভাবির চিন্তায় মিটিং ফেলেই ছুটে এসেছে। এর জন্য পরে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে সে জানে। তবে তার কাছে পরিবারই সবার আগে।
_______________________________________
মাহতাব আর অরণ্য ঘুমিয়ে আছে। অর্ণব করিডোরে হাটাহাটি করছে। আর তিলোত্তমা নুরের সাথে কথা বলছে। তিলোত্তমার কথা কানে আসতেই থমকে দাঁড়ালো অর্ণব। পরিবেশ নিবিড় হওয়ায় ফোনের ওপাশের সব কথাই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। সে নুরের কথা শুনে হতবাক। তিলোত্তমা দ্রুত ফোনের সাউন্ড কমালো। তবে তাতে খুব একটা লাভ হলো না। অর্ণব রেগে আছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মাটির দিকে চেয়ে দাড়িয়ে আছে। অর্ণবকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখেই তিলোত্তমার শুভ্রতার কথা মনে পড়লো। শুভ্রতাও রেগে গেলে এভাবেই চুপ করে মাটির দিকে চেয়ে থাকে। নুর কল কাটতেই অরণ্য বলে উঠলো,
~বলেছিলাম না আমি! এবার মনের খচখচানি দুর হলো?
তিলোত্তমা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। নিঃশব্দে উঠে এলো সেখান থেকে। সিড়িতে এসে বসে পড়লো। গাল গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। তিলোত্তমা মুখ চেপে ধরলো। চেষ্টা করলো কান্না আটকানোর। তবে পারলো না। মাহতাব এসে তিলোত্তমার পাশে বসে রইলো। সেও চেষ্টা করলো না ওর কান্না থামানোর। তিলোত্তমাও টের পেলো না মাহতাবের আগমনের। সে কেঁদেই যাচ্ছে। এই কান্নার কারণটা মাহতাবের অজানা। সে কি জন্য কাঁদছে? বন্ধুত্ত্ব ভেঙে যাওয়ার দুঃখে? শুভ্রতার এই অবস্থার জন্য? নাকি নুর তাকে অবিশ্বাস করলো বলে?
~~~
চলবে~
(হ্যাপি রিডিং~)