#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ৩৮
🍂🍂🍂
~তমা? এই তমা?
~হুঁ?
মাহতাবের ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো তিলোত্তমার। চোখ ফিরিয়ে জানালার বাহিরে চেয়ে দেখলো সন্ধ্যা নেমেছে। তিলোত্তমা সোজা হয়ে বসতেই মাহতাব উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,
~ভাবির জ্ঞান ফিরেছে।
~হ্যা?
তিলোত্তমার চোখ চকচক করে উঠলো। ঠোঁটে ফুটলো স্বস্তির হাসি। মাহতাবও হাসছে। তিলোত্তমা ছুট লাগালো কেবিনের ভেতর। অর্ণব, অরণ্য আর একজন নার্স আছে। শুভ্রতা বেডে হেলান দিয়ে মাথা নিচু করে চুপ করে বসে আছে। দৃষ্টি তার বাম হাতের ক্যানোলার দিকে। ডান হাতে ফ্র্যাকচার হয়েছে, মাথায় ব্যান্ডেজ, গায়ের বিভিন্ন অংশ ছিলে গেছে। তিলোত্তমা গিয়ে শুভ্রতার সামনে বসলো। তিলোত্তমা বসতেই শুভ্রতা মাথা তুলে তিলোত্তমার দিকে তাকালো। ঠোঁটে একটু হাসি টানতেই তার ডান গালটা জ্বলে উঠলো। অনুভব করলো মাথায় সুক্ষ্ণ শির শির অনুভুতি। শুভ্রতা সহ রুমে সবাই অবাক। শুভ্রতা এক প্রকার হা করেই চেয়ে আছে। তিলোত্তমা জিজ্ঞেস করলো,
~আমাদের কথা একবারও ভাবলি না! কোন দুঃখে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলি তুই? আমাদের ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা করতে তোর বুক কাঁপলো না? এত সাহস পাস কোথায়?
শুভ্রতা হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো। ডানে বামে একবার চেয়ে দেখলো তারপর তিলোত্তমার চোখের সামনে হাত নেড়ে বললো,
~আমাকে বলছিস?
~নয় তো কি তোর ভুত কে বলছি! কেনো এমন ফালতু পদক্ষেপ নিতে গেলি বলতো!
শুভ্রতার এবার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। কপাল কুঁচকে বললো,
~মাথা ঠিক আছে তোর? অরণ্য ভাইয়া! অ্যাকসিডেন্ট করলাম আমি আর মাথা ওর আউট হয়ে গেছে। দ্রুত এর চিকিৎসা করান। অলরেডী থাপ্পড় খেয়েছি। আর খেতে রাজি না।
তিলোত্তমা চোখ ছোট ছোট করে অরণ্যের দিকে তাকালো। অরণ্যও একই ভাবে শুভ্রতার দিকে চেয়ে আছে।
~আমার এত মরার শখ হলে আমি ওই অচেনা রাস্তায় কেনো যেতাম শুনি? ঘরে ঘুমের ওষুধ ছিল, শাড়ির অভাব ছিল না। আর বাড়িতে কি ধারালো জিনিসের অভাব ছিল নাকি? মরবার জন্য সব রেখে ওই গাড়ির ধাক্কা খেতে যেতাম নাকি? পাগলে পাইছে আমারে!
~তুই সুইসাইড করতে যাসনি?
~ও ভাই! মা, বাবা, বন্ধুবান্ধব সব গেছেই এখন কি এই আকাম করে নিজের খোদাকেও হারাবো নাকি? ডিপ্রেসড আছি বুঝলাম। পাবনার রোগী হয়ে যাইনি।
শুভ্রতা এবার অর্ণবের দিকে তাকালো। বিরক্তির সুরে বলল,
~সব দোষ এই শালার আর এর দুলাভাই এর। ও হ্যা, এই জঙ্গলেরও দোষ আছে।
~আমরা আবার কি করলাম? (অরণ্য, অর্ণব)
~পিছন থেকে যতক্ষণ ধরে ডাকতেছিলি ততক্ষণে চাইলে দশবার দৌড়ে গিয়ে আমার জান বাঁচাইতে পারতি। আবার কথা বলস! বেটা খবিশ! তোদের জন্য একটা থাপ্পর খাইলাম।
~কিন্তু তুই ঐখানে গিয়েছিলিই বা কেনো? আর রাস্তার মাঝখানেই বা কি করছিলি?(অর্ণব)
অর্ণব প্রশ্ন করতেই শুভ্রতার চোখে মুখে নামলো ঘোর অন্ধকার। আগের সব কিছু মনে করতেই মাথা ব্যাথা শুরু হলো। মাথা ধরে চোখ চেপে মৃদু আর্তনাদ করতেই মাহতাব বললো,
~মাত্র জ্ঞান ফিরেছে ভাবির। একটু সময় দাও ওকে। এসব কথা পরে বলো। (মাহতাব)
~আহনাফ কোথায়? (অরণ্য)
~জানি না তো। ভাবির জ্ঞান ফিরছে দেখেই তো হন হন করে বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে। (মাহতাব)
~খুজে দেখ পাগলটা আবার কোথায় গেছে। ৩ দিনে আমাদের ডাক্তার থেকে পাবনার রোগী বানিয়ে ছাড়লো এই ছেলে। (অরণ্য)
মাহতাব বেরিয়ে যেতেই কেবিনে অনিকা, উসমান আর চিত্রা প্রবেশ করলো। পেছন পেছন রাত্রিও এলো। উসমান এসেই শুভ্রতার বা গালে এক চর বসিয়ে দিলো। শুভ্রতা বাদে সবাই হতবাক। শুভ্রতা গালে হাত দিয়ে চুপ করে চেয়ে আছে। তার মনে হলো এবার তার মাথা ঘুরছে। উসমান রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। চোখে জল। এই দুই চোখই জানান দিচ্ছে সে শুভ্রতার এই পদক্ষেপে কতটা ভয় পেয়েছেন। বোনের শেষ স্মৃতিকেও সে আগলে রাখতে ব্যর্থ।
~এমন পদক্ষেপ নেওয়ার আগে একটাবার আমাদের কথা ভাবলি না! আমাদের কথা না ভাব, অন্তত আহনাফের কথা ভাবা তোর উচিত ছিল না? এতোটা স্বার্থপর কি করে হতে পারলি তুই? কি করে পারলি আত্মহত্যা করতে?
শুভ্রতা ফিক করে হেসে দিলো। উসমানের মনে প্রশ্ন জাগলো, “মাথার আঘাতের জন্য শুভ্রতা পাগল হয়ে যায়নি তো?”। শুভ্রতা হাত বাড়িয়ে মামাকে পাশে বসতে ইশারা করলো। উসমান এসে বসলেন। শুভ্রতা মামার বুকে মাথা ঠেকালো। মাথায় একটু চাপ লাগতেই মাথাটা ব্যাথায় শিরশির করে উঠলো। মাথাটা তুলে চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিয়ে আবারো হালকা করে মাথাটা রাখলো। দুর্বলতার জন্যে গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। তবুও ধীরে ধীরে বললো,
~আমি তো সুইসাইড করতে যাইনি মামা। এসব তো পাপ। আমি শুধু তোমাদের থেকে দূরে যেতে চেয়েছিলাম। হটাৎ দেখলাম মা আমার কাছে এসেছে। আমাকে তার সাথে যেতে বললো। আমি তো মায়ের বাধ্য মেয়ে। মায়ের কথা অমান্য করতে পারিনি তাই তাকে অনুসরণ করতে শুরু করলাম। কখন যে রাস্তার মাঝে চলে গেলাম বুঝতেই পারিনি। অর্ণব ওদের ডাক শুনেই যখন ওদের কাছে আসতে চাইলাম তার আগেই এসব হয়ে গেলো। আমার মনে অন্য কোনো ভাবনা ছিলো না। সত্যি!
উসমান শুভ্রতার কথা বিশ্বাস করলেন। অনিকা শুভ্রতার বাম হাত নিজের মাথায় রেখে বললেন,
~আমার গা ছুয়ে কসম খা শুভ্রতা। আর কখনো আমাদের ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা মাথায় আনবি না।
~আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কসম খাওয়া গুনাহ, মামী।
~মামী, এই মেয়ে ফের কথা ঘুরাচ্ছে। (তিলোত্তমা)
শুভ্রতা কুটিল হাসলো। কিছু বললো না। সারা ঘরে একবার চোখ বুলালো। সবাই আছে, শুধু খুঁজে পেলো না তার প্রিয় মানুষটিকে, চন্দ্রকে।
________________________________________
~শুভ্রতার জ্ঞান ফিরেছে। শুনলাম এখন সুস্থ আছে।
মদের খালি গ্লাসটা এক পাশে রাখলো সকাল। রকিং চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। চোখে মুখে ছেয়ে আছে অসীম ক্রোধ। চোখ দুটো লাল। যেনো কত রাত ঘুমায় না। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে এগিয়ে আসতেই পিছিয়ে গেলো ইয়াদ। মদের তীব্র গন্ধ সহ্য করতে না পেরে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। এভাবে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াতে সকাল হাসলো। তার সব থেকে কাছের বন্ধু ইয়াদ। দিনের বেশিরভাগ সময় তার সাথে কাটায় সে। তবুও ইয়াদ আর সকালের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। সে মা বাবার উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলে আর ইয়াদ একদমই তার বিপরীত স্বভাবের একটা ছেলে।
এমন বিপরীত স্বভাবের মানুষটা যে কি করে তার সব থেকে কাছের বন্ধু হলো মাঝে মাঝে তা নিয়ে গভীর চিন্তায় পড়ে যায় সকাল। দাঁতে দাঁত চেপে গর্জিত কণ্ঠে বলল,
~শুভ্রতা না। আপা বলে ডাকবি। নেক্সট টাইম যেনো ওর নাম তোর মুখে না শুনি। গট ইট?
ইয়াদকে চুপ করে থাকতে দেখে সকাল হুংকার দিয়ে বললো,
~গট ইট?
ইয়াদ ভয়ে কেপে উঠলো। দ্রুত মাথা ঝাকিয়ে বললো সে বুঝেছে। কাপাকাপা কণ্ঠে সরি বলতেই সকাল শান্ত হলো। রকিং চেয়ারে বসে গ্লাসে মদ ঢালতে ঢালতে বললো,
~রুপাকে বলবি আজ বিকালে এসে যেনো আমার সাথে দেখা করে।
ইয়াদ সকালের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ঘর থেকে বের হতেই স্বস্তির দম ছাড়লো। বিড়বিড় করে বললো,
~শালা অমানুষের বাচ্চা!
গাড়িতে গিয়ে বসলো ইয়াদ। অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। ইদানিং মন মেজাজ খুব খারাপ থাকে ইয়াদের। সকালের এসব কার্যকলাপ তার অপছন্দ। সে উঠতে বসতে সেই সময়টাকে গালি দেয় যেই সময়ে সে সকালের বন্ধুত্ত্ব গ্রহণ করেছিল। সে শুনেছিল সকাল খুব টক্সিক প্রকৃতির হওয়ায় তার কোনো সম্পর্ক বেশিদিন টিকে না, এমনকি বন্ধুত্বও না। সে নাকি সব সম্পর্কও নিয়েই বেশ পজেসিভ। সে ভেবেছিল ইয়াদও বেশিদিন তার বন্ধু থাকবে না। প্রথম দিকে সে সকালকে খুব ভালো একটা বন্ধু ভাবলেও ধীরে ধীরে তার আচরণে বুঝতে পেরেছে মানুষ কেনো সকালের জীবনে থাকতে পারে না। সেও চেয়েছিল বাকিদের মত সকালকে ছেড়ে দিতে। তবে সকাল তাকে ছাড়েনি। সে কোনো কিছুকে নিজের বলে মনে করলে তাকে খুব সহজে ছাড়ে না। যার স্বয়ং উদাহরণ ইয়াদ নিজে। আরেকজন আছে যাকে সকাল মনে প্রাণে চায়। সে হচ্ছে শুভ্রতা। সে শুভ্রতাকে ভালোবাসে বলে দাবি করে। বিয়ের প্রস্তাবও পাঠিয়েছিল। তবে শুভ্রতা মানা করে দেয়। তাইতো সে রুপাকে ব্যবহার করে শুভ্রতাকে পাওয়ার চেষ্টা করে চলেছে। তার ধারণা সে যদি শুভ্রতার থেকে তার সব প্রিয় মানুষকে দুর করে দেয় তবে শুভ্রতা হার মেনে তার কাছেই ফিরে আসবে। ইয়াদের মনে হয়না সে শুভ্রতাকে ভালোবাসে। তার মতে শুভ্রতা সকালের শুধুই জিদ মাত্র। শুভ্রতাকে পেয়ে গেলেই সে সব ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলবে। ছেড়ে দিবে শুভ্রতাকে। সে চায় না শুভ্রতার জীবনটা এভাবে নষ্ট হোক।
________________________________________
নফল নামাজ শেষে নিজ কেবিনে এসে বসলো চন্দ্র। ড্রয়ার থেকে শুভ্রতার চিঠিটা বের করলো। সে এখনও শুভ্রতার চিঠি পড়েনি। শুভ্রতার জ্ঞান ফিরলেই সে চিঠি পড়বে ভেবে রেখেছিল। চন্দ্র চিঠির ভাঁজ খুললো,
“প্রিয় চন্দ্র,
জানেন, মাঝে মাঝে মনে হয় আমি খুব ভাগ্যবতী কারণ আপনি আমাকে ভালোবাসেন। কিন্তু সেই আপনাকেই দেখলে মনে হয় আপনি পৃথিবীর সব থেকে দুর্ভাগ্যবান ব্যক্তি কারণ আপনি আমাকে ভালোবাসেন। আমার জন্য আপনি অনেক কষ্ট করেছেন চন্দ্র। আপনার চোখে আমার জন্য যেমন চিন্তা দেখেছি তেমনি দেখেছি আপনার ধ্বংস। আকাশের চন্দ্র তো একাকিত্বে ঘেরা। আমি চাইনা আপনাকে এমন একাকিত্ব ঘিরে ধরুক। চন্দ্রের শুভ্রতা সবসময় থাকে না, চন্দ্র। চন্দ্র নতুন এক রূপ পায়। কখনো নীল, তো কখনো লাল। আপনার জীবন থেকে শুভ্রতার যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। শুভ্রতাকে ফিরে পাওয়ার আর অপেক্ষা করবেন না চন্দ্র। এমন একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিবেন যে আপনাকে খুব ভালোবাসে আর আপনাকে পাওয়ার জন্য যেকোনো কিছু করতে পারে। ভালো থাকবেন চন্দ্র, নিজের যত্ন নিবেন।
ইতি
আপনার শুভ্রতা”
চন্দ্র চিঠিটা ভাঁজ করে আগের জায়গায় রেখে দিলো। চেয়ারে গা এলিয়ে বসে রইলো অনেকক্ষণ। নিজের মনের অবস্থা বুঝতে হিমশিম খাচ্ছে চন্দ্র। সে পারছে না এখনি শুভ্রতাকে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলে। কিন্তু ওর মা মারা গেছে এখনও মাসও গড়ায়নি। চন্দ্র লম্বা শ্বাস নিলো। নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। চন্দ্র মনিটরের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বললো,
~তোমাকে এসবের জন্য শাস্তি পেতে হবে শুভ্রতা। জাস্ট একটু সুস্থ হয়ে ওঠো। আমাকে ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা মাথায় কি করে আসে আমিও দেখবো।
~~~
চলবে~