চিত্তদাহ লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা পর্ব ৪৯

0
496

#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ৪৯

🍂🍂🍂

সকাল থেকেই প্রচন্ড কাশছে শুভ্রতা। গত কয়েকদিনে সে ঠান্ডা জাতীয় কিছু খেয়েছে কিনা তার মনে পড়ছে না। আবারো মুখ দিয়ে তাজা রক্ত বেরিয়ে আসতেই হকচকালো সে। মুখ মুছতে মুছতে দ্রুত কল লাগালো ডাক্তার মিজানকে। ওপাশ থেকে কল রিসিভ করতেই শুভ্রতা অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো,

~সকাল থেকে নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। বাড়ির মানুষ দেখলেই চিন্তিত হয়ে পড়বে। ঘরের বাইরে বের হতে পারছি না। কি করবো?
~আপনার গায়ে কি জ্বর আছে?
~সকালে মাপিয়ে ছিলাম। আছে একটু।

ডাক্তার মিজান ভাবার জন্য একটু সময় নিতে চাইলেন। শুভ্রতার মনে হলো তার কাছে এতো সময় নেই। শুভ্রতা আবারো বললো,
~আমার হাতে খুব বেশি সময় নেই, তাই না?
~আপনি একটু নিয়মিত এসে চেকআপ করিয়ে যাবেন। ওষুধ লিখে দিবো, সেগুলো খাবেন। আপাতত প্রেসক্রিপশন লিখে ছবি পাঠাচ্ছি।

মিজানের কথা শেষ হতেই কল কাটলো শুভ্রতা। শীত শীত লাগছে। গায়ে কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে রইলো।
_____________________________________

🍂বর্তমান🍂

নুর ডায়েরীটা বন্ধ করলো। কিছু ভালো লাগছে না। কেনো যেনো গুমোট লাগছে তার। মনে হলো তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। উঠে গিয়ে জানালা খুলতেই বৃষ্টির ছিটা তার গায়ে লাগলো। সে চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিলো। বৃষ্টির সময় পরিবেশে আলাদাই একটা ঘ্রাণ থাকে। নুরের একটু মন ভালো হলো হয়তো। সে চোখ মেলে তাকালো। জানালার বাহিরে হাত পেতে দাড়িয়ে রইলো কিছু পল। মনে পড়লো তার ভার্সিটি লাইফের কথা….

শ্রাবণের মাঝামাঝি সময়। হটাৎ এক বিকেলে বন্ধু মহল আক্রমণ করলো শুভ্রতার বাড়িতে। বাড়ি এসে দেখলো শুভ্রতা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। শুভ্রতাকে এইসময় ঘুমাতে দেখে তাদের কারোরই তেমন ভালো লাগলো না। বৃষ্টির দিনে বৃষ্টিবিলাস না করে কম্বল গায়ে মুড়িয়ে ঘুমানো। ব্যাপারটা নিতান্তই দৃষ্টিকটু। তারা এসেছে এখানে বৃষ্টিবিলাস করতে আর এই মেয়ে ঘুমাচ্ছে। ওরা ইশারায় কিছুক্ষণ কথা বললো। এর পর এক সাথে লাফিয়ে পড়তে চাইলো শুভ্রতার বিছানায়। তার আগেই শুভ্রতা চোখ বন্ধ রেখেই বিরক্ত কন্ঠে সতর্কবাণী শুধালো,
~লাথি মেরে একেকটাকে এই বৃষ্টির মধ্যে বাড়ি থেকে বের করবো বলে দিচ্ছি। ঘুমাতে দে।

নুর সহ সকলেই হা করে চেয়ে রইলো কিয়ৎক্ষণ। রিদিতা মাথা চুলকে বললো,
~তুই কি করে বুঝলি আমরা এসেছি?
~তোর গা থেকে ডেট এক্সপায়ারড পারফিউম এর গন্ধ আসছে। এই গন্ধতেই বুঝা যায় তুই এসেছিস। নাউ লেট মি স্লিপ।

শুভ্রতার কথায় রিদিতা কপাল কুঁচকে তাকালো। ঠোট চেপে হাসতে লাগলো বাকিরা। তিলোত্তমা ১,২,৩ বলতেই সকলে একসাথে চিল্লিয়ে উঠলো,
~ঘুম থেকে উঠঠঠঠ!!!! বৃষ্টিবিলাস করবো আজজ!!!!

শুভ্রতা কান চেপে উঠে বসলো। মাথার বালিশ ওদের দিকে ছুঁড়ে চেঁচিয়ে বললো,
~বাল! সমস্যা কি তোদের?

নুর দাত কেলিয়ে বললো,
~সবাই বৃষ্টিতে ভিজবো। ওঠ।

শুভ্রতা নাক কুঁচকালো। ঘোর আপত্তি জানিয়ে বললো,
~হ্যা,পাগলে পেয়েছে আমাকে! খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, ঘুম রেখে তোদের সাথে যাবো বৃষ্টিতে ভিজতে।

শুভ্রতার আপত্তিকে পাত্তা দিলো না কেউই। তাকে টেনে, ঠেলে ছাদে নিয়ে যাওয়া হলো। বৃষ্টিতে ভিজার ফলে টানা ৫ দিন জ্বর ঠান্ডায় ভুগেছিলো শুভ্রতা। গাল ফুলিয়ে বন্ধুমহলকে বলেছিলো,
~আমার ঠান্ডা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত রোজ এসে ২০ বার করে কান ধরে উঠবস করবি প্রত্যেকে। আর বলবি “আমার ভুল হয়ে গেছে, আমাকে ক্ষমা করে দেন”। না বললে তোদের মায়ের হাতে ঝাটার বারি খাওয়াবো।

শুভ্রতার কথায় সেদিন সকলে সত্যিই ২০ বার করে কান ধরে উঠবস করেছিলো। নয়তো এই মেয়ের যেই রাগ! সত্যি সত্যিই বাড়িতে বিচার দিয়ে আসতো। ওদের কান ধরা দেখে শুভ্রতা খিল খিল করে হাসতো। শুভ্রতার ঠান্ডায় রক্তিম নাক, গাল আর প্রাণ খুলে হাসির কথা মনে পড়তে নুরও শব্দ করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতেই চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মনে পড়লো বিষাক্ত অতীতের কথা। এক সপ্তাহ আগেও সে শুভ্রতার সাথে কথা বলতে চায়নি। শুভ্রতা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেছে অথচ সে একটাবারের জন্য মেয়েটাকে চোখের দেখাও দেয়নি। আজ সে শুভ্রতার সাথে কথা বলতে চায়, তাকে দেখতে চায়, তাকে জড়িয়ে ধরে বলতে চায় “ক্ষমা ধরে দে দোস্ত। তোর ঝাড়বাতি ভুল করে ফেলেছে। ক্ষমা করে দে”। আফসোস আজ শুভ্রতা নেই। আছে শুধু মুঠো ভর্তি স্মৃতি। আচ্ছা, শুভ্রতার তো বৃষ্টি পছন্দ ছিলো না। এখন তো বৃষ্টি হচ্ছে। আজিমপুরের কোনো এক কবরে শুয়ে আছে সে। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে কষ্ট হচ্ছে না তার? বুকটা হাহাকার করে উঠলো নুরের। নিজ ভাবনায়ই তার কান্না পেলো প্রচুর। আচমকা দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনতেই লাফিয়ে উঠলো নুর। রাত ৩ টা ৯ মিনিট। এই সময় কে আসবে? নুর দরজা খুলতেই ঘরে প্রবেশ করলো তিলোত্তমা। নুর অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো তিলোত্তমার দিকে। তিলোত্তমা নিঃশব্দে তার ঘরে প্রবেশ করলো। প্রথমেই চোখ পড়লো শুভ্রতার ডায়েরির ওপর। সে আলতো হাসলো। ডায়েরি হাতে বসলো নুরের বিছানায়।

~তাই বলি, ঘুম কুমারীর ঘরে এতো রাতেও আলো জ্বলছে কেনো।

নুর চুপ করে তিলোত্তমার হাসি দেখলো। হাসলে তিলোত্তমার চোখ দুটো ছোট ছোট হয়ে যায়। তার হাসিতে কোনো আওয়াজ নেই। তার দিকে না তাকালে বুঝা মুশকিল সে হাসছে। তিলোত্তমা ডায়েরি থেকে চোখ সরালো।

~কি দেখছিস?

নুর মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ কিছু না। নুর যেখানে পড়া থামিয়েছে তিলোত্তমা ডায়েরি খুলে সেই পৃষ্ঠায় চোখ বুলাতে বুলাতে আবারো বললো,
~ঘুম আসছে না? গল্প করবি নাকি শুনবি?

নুর ধপ করে খাটে বসলো। একদম তিলোত্তমার সামনাসামনি। জবাব দিলো,

~শুনবো। শুভির কথা।

নুরের মুখে এতদিন পর শুভি ডাক শুনে তিলোত্তমা কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকালো। তারপর সেই আগের মত সীমিত হাসলো। এই হাসির কারণ নুর বুঝলো না। বুঝতে চাইলো ও না। শুধু শুনতে চাইলো। তিলোত্তমা বলতে শুরু করলো…

~শুভ্রতার মায়ের মৃত্যুর তখন আড়াই মাস চলে। শুভি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছিলো। ততদিনে পরীক্ষাও শেষ। তোর সাথে রোজ কথা বলতে চাইতো শুভি। আমি বাধা দিতাম। জানতাম যেই আশা সে নিজের মনে পুষে রেখেছে তা ভাঙলে শুভিও ভেঙে পড়বে। এই কথাটা কোথাও না কোথাও শুভি নিজেও জানতো। ওর মনে হতো তোর সাথে কথা বললেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আদৌ যে কিছুই ঠিক হতো না আমরা সবাই জানতাম। অরণ্য ভাইয়া যখন নিঃশব্দে শুভির পায়ের কাছে বসে তোর জন্য কান্না করতো। শুভি করুন চোখে আমার দিকে চেয়ে থাকতো। আমি ওই চোখের চাহনি বুঝেও যেনো বুঝতাম না। সময়ের সাথে সাথে মায়ের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে শিখছিলো শুভি। তবুও মাঝে মাঝে ভুল করে আন্টিকে ডেকেই ফেলতো। ডাকার পর নিজেই থম মেরে বসে থাকতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কান্না করতো না। শুধু বসে থাকতো। চুপ করে মাটির দিকে চেয়ে থাকতো। কারো কথার জবাব দিতো না। আমরাও ডাকতাম না। সে কান্না শুধু আহনাফ ভাইয়ের সামনেই করতো। অন্য কারো সামনে নিজের চোখের পানি ফেলতে চাইতো না। হটাৎ একদিন আহনাফ ভাই আর চিত্রা আন্টি আমার বাসায় হাজির হলো। মা বাবার সাথে একান্তে কথা বললো অনেকক্ষন। আমি শুধু উকিঝুকি দিচ্ছিলাম। এর পর আমার ঘরে এসে আহনাফ ভাই জানালো শুভিকে বিয়ে করতে চান উনি। তাও আগামীকালের মধ্যেই। তার এমন এক পদক্ষেপে আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম। বুঝাতে চেয়েছিলাম বিয়ে টা খুব তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে। শুভিকে একটু সময় দেওয়া উচিত। সে শুনেনি। কিন্তু সেদিন যখন ভাইয়া বললো “শুভ্রতার ক্যান্সার”। আমি থমকে গিয়েছিলাম। পায়ের নিচের থেকে জমিন সরে গিয়েছিলো যেনো। তোকে অসংখ্যবার কল দিয়েছিলাম আমি। ধরিস নি। শুধু একটা টেক্সট করেছিলি “ডোন্ট ডিস্টার্ব মি”। শুভি রোজ আমাকে শান্তনা দিতো। বলতো সব ঠিক হয়ে যাবে, ঝাড়বাতি আবারো ফিরে আসবে, আমাদের বন্ধুমহল আবারো হাসি আনন্দে মেতে উঠবে। আমি শুধু মনে মনে দোয়া করতাম তাই যেনো হয়। তুই এসেছিস, কিন্তু দেরিতে। এতটাই দেরি যে শুভিকে আফসোস নিয়েই দুনিয়া ছাড়তে হলো। আর একটা দিন আগে এলেও হয়তো শুভির এত কষ্ট থাকতো না। আহনাফ ভাই তো বেশ কয়েকবার তোর বাসায় যেতে চেয়েছিলো। কেউ যেতে দেয় নি। একবার তো লুকিয়ে তোর বাড়ির দরজা অব্দি চলে গিয়েছিল। তাকে টেনে এনেছিল অরণ্য ভাইয়া। অরণ্য ভাইয়া না আটকালে হয়তো আজকে দিনটাই অন্য রকম থাকতো।

তিলোত্তমার চোখ চিকচিক করে উঠলো। একটু থেমে আবারো বললো,
~সে এই বাড়িটাকে এতিমখানা বানাতে চেয়েছিলো। কিছু কারণে হয়ে উঠেনি। আমি চাই ওর ইচ্ছা পূরণ করতে। রিদি ওরাও সাথে আছে বললো। তুই কি আবারো চলে যাবি?

নুর নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো। তিলোত্তমা বুঝতে পারলো তার একটু সময় লাগবে ভাবতে। সে চলে গেলো। নুর নির্মল চোখে তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার পানে।
_______________________________________

🍂অতীত🍂

মিনিটখানেক আগেই রাত্রি এসে বলে গেছে তাকে রেডি হতে। আজ নাকি কোথাও যাবে ওরা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরে তিলোত্তমা এলো। সাথে এলো ১৮-১৯ বছর বয়সী এক মেয়ে। এই মেয়েকে আগে দেখেনি শুভ্রতা। মেয়েটা এসেই তাকে জড়িয়ে ধরলো। ছটফটে গলায় বললো,

~ভাবী, কেমন আছো? তোমার সাথে কত দেখা করতে চেয়েছি জানো! আহনাফ ভাইয়া আর মাহতাব ভাইয়া আনেনি। ওহ, তুমি তো আমাকে চিনো না। আমি তরী। তোমার হবু বরের একমাত্র ফুপাতো বোন। তোমাকে আর তিলোত্তমা ভাবীকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তোমরা দ্রুত আমার ভাবী হয়ে আমার মামার মানে তোমাদের শ্বশুরবাড়ি চলে এসো।

একটু থামলো তরী। এক টানা এতো কথা শুনে শুভ্রতা আর তিলোত্তমাই যেনো হাপিয়ে উঠলো। শুভ্রতা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল তরীর দিকে। তরী আবারো বলতে শুরু করলো,
~জানো ভাবী আজকে হিউজ একটা ক্রাশ খেয়েছি। হায়! আমি তো পুরোই ফিদা। শুনো, তোমরা কিন্তু তার সাথে আমার প্রেম করিয়ে দিবে। জীবনের প্রথম কাউকে ভালো লেগেছে।

তিলোত্তমা আর শুভ্রতা বোকার মত একেওপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। বাকশক্তি যেনো তাদের বিদায় জানিয়ে ইন্নালিল্লাহ হয়ে গেছে। শুভ্রতা জোরপূর্বক হাসলো। একটু পানি খাওয়া দরকার। এই মেয়ের ননস্টপ কথা শুনে তার নিজেরই গলা শুকিয়ে গেছে। সে খাটের পাশে বসে গ্লাস হাতে নিলো। গ্লাসে চুমুক দিলো। তিলোত্তমা জানতে চাইলো,
~আচ্ছা! তা সেই সুদর্শন পুরুষটা কে?
~শুভ্রতা ভাবির ভাই, অর্ণব।

অর্ণবের নাম শুনতেই শুভ্রতার নাকে মুখে পানি উঠে গেলো। কাঁশতে কাঁশতে তার দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। চোখেও পানি চলে এসেছে। শুভ্রতার এই অবস্থা দেখে অস্থির হয়ে উঠলো তরী আর তিলোত্তমা।

~এই তোর কি হয়েছে? তুই এমন করছিস কেনো? তরী, তরী ভাইয়াকে ডাকো। দ্রুত!

তরী যেতে নিতেই হাত চেপে আটকালো শুভ্রতা। হাত নেড়ে মানা করলো কাউকে ডাকতে। সে বেশ সময় নিয়ে শান্ত হলো। চিন্তিত মুখে বসে রইলো তিলোত্তমা আর তরী। শুভ্রতা শান্ত হয়ে প্রশ্ন করলো,
~অর্ণবকে পছন্দ হয়েছে তোমার?

তরী ভাবার জন্য একটু সময়ও নিলো না। নিঃসংকোচে মাথা ঝাকিয়ে হ্যা বুঝালো। শুভ্রতা এভাবে জবাব দেওয়ায় একটু বিরক্ত হলো। কাঠিন্য ভঙ্গিতে বললো,
~মুখে জবাব দাও।

তরী তৎক্ষণাৎ জবাব দিলো,
~হ্যা ভালো লাগে, খুব ভালো লাগে।

শুভ্রতা মুচকি হাসলো। জানতে চাইলো,
~আর কাউকে বলেছো এই ব্যাপারে?

তরী লাজুক হাসলো। মাথা নত করতে করতে থুতনি বুকে ঠেকে গেছে। সে নত মস্তকেই উত্তর দিলো,
~না। তোমাদেরই প্রথম জানালাম।
~ঠিক আছে। আমি অর্ণবের সাথে কথা বলবো।

তরী লাজুক হেসে মুখ চেপে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। তরীর যাওয়া দেখে তিলোত্তমা হা করে বললো,
~এই গুষ্টির মানুষ লজ্জা পেতেও জানে! এ তো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য।

শুভ্রতা ফিক করে হেসে দিলো। বললো,
~এই পিচ্চির থেকে কিছু শিখ তুই। নিজের পছন্দের কথা কি সুন্দর বলে দিলো। দেখ! কিছু শেখা উচিত তোর। মাহতাব ভাইকে পছন্দ করিস এই কথা আর কতদিন লুকাবি?
~তুইই দেখ। যেমন ভাই তার তেমন বোন। মুখে কিছু আটকায় না।

শুভ্রতা হাসলো। বান্ধবী তার ভাঙবে তবু মচকাবে না।
______________________________________

~খুব সুন্দর লাগছে তোকে।

শুভ্রতা নাক কুঁচকালো। আয়নার নিজের প্রতিবিম্ব দেখে বললো,
~আমার তো মনে হচ্ছে না।

তিলোত্তমা ফোন দেখতে দেখতে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। “কোথায় যাস?” এর জবাব তিলোত্তমা দিলো না। শুভ্রতার কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো। ঘরের দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে ঘরে প্রবেশ করলো রিদিতা, উপমা আর রুপা। এতদিন পর বান্ধবীদের দেখতে পেয়ে খুশিতে আত্নহারা হয়ে উঠলো শুভ্রতা। রিদিতা আর উপমা শুভ্রতাকে দেখতেই ছুটে এলো তার কাছে। জড়িয়ে ধরে কাঁদলোও কতক্ষন। টুকটাক কথার মধ্যেই খেয়াল করলো রুপা এক কোণ এ নিঃশব্দে দাড়িয়ে আছে। শুভ্রতা তাকে ডাকলো,
~রূপ
রুপা হৃদয় কেপে উঠলো। আজ কতমাস পর তাকে এভাবে ডাকলো শুভ্রতা। সে অস্বচ্ছ চোখে তাকালো সামনে। শুভ্রতা হাত বাড়িয়ে ডাকলো “এদিক আয়”। রুপা শাড়ির আঁচল মুখে চেপে ফুপিয়ে উঠলো। আকস্মিক কান্নায় শুভ্রতা কিছুটা হকচকালো। শুভ্রতা ধমকে উঠলো,
~পায়ে কি মেহেদী লাগিয়েছিস? আসতে এত সময় লাগছে কেনো? কাম ফাস্ট!
~শুভি তুই…

বিরক্তিতে “চ” শব্দ করলো শুভ্রতা। নিজেই গেলো রূপার কাছে। পরম স্নেহে জড়িয়ে ধরলো বান্ধবীকে। কতদিন পর আজ ওদের চোখের দেখা দেখতে পেলো সে। রুপা হু হু করে কেঁদে উঠলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো শুভ্রতা। শুভ্রতার ঠোঁটে মুচকি হাসি। এই হাসি প্রাপ্তির, হারানো কিছু ফিরে পাওয়ার আনন্দের।

~দেখি ছাড় তো! চোখের জলে আমার কাঁধ ভিজিয়ে দিচ্ছিস। হয়েছে কি শুনি? কাঁদছিস কেনো?

রুপা সরে এলো। তবে শুভ্রতার হাত ছাড়লো না।কান্নার ফলে কথা সব গলায় আটকে আসছে। সে অস্পষ্ট স্বরে বলল,
~মাফ করে দে শুভি। আমি ভুল করেছি। আহনাফ ভাইকে পাওয়ার লোভে আমি নিজের কাছের মানুষগুলোকে হারিয়েছি। যারা আমার সর্বদা ভালো চাইলো তাদের কষ্ট দিয়েছি। মাফ করে দে।

~শান্ত হ, কান্না থামা। তুই ভুল বুঝতে পেরেছিস এটাই অনেক।

রুপা শান্ত হলো না। বার বার নাড়িয়ে না করতে থাকলো। আবারো ক্ষমা চাইতে থাকলো।
~আমার জন্য আমাদের বন্ধুমহল ভেঙেছে। আমি এতটাই নিকৃষ্ট যে ভাই বোনের সম্পর্ককে একটা মানুষের সামনে প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্ক দেখিয়ে উপস্থাপন করেছি। তাও এমন সময় যখন তোর আম্মু মৃত্যুবরণ করেছে। তুই আমাকে যা শাস্তি দিবি আমি মেনে নিবো। তুই আমাকে মেরে ফেল। এই অপরাধবোধ আমার রাতের ঘুম, শান্তি সব কেড়ে নিয়েছে।

মায়ের মৃত্যুর কথা মনে পড়তে শুভ্রতার মনটাও খারাপ হলো। তবে প্রকাশ করলো না। সে শান্তনা দিয়ে বললো,
~ভুলে যা সেসব। অতীত মনে করে আর লাভ কি? অতীত তো আর ঠিক করা সম্ভব না। এগিয়ে যাওয়াই উত্তম। তুই যেমন নিজের ভুল বুঝে ফিরে এসেছিস। একদিন নুরও আসবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।

রুপা ছলছল চোখে শুভ্রতার দিকে তাকাতেই শুভ্রতা কতক্ষন অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। পরক্ষনেই চেষ্টা চালালো হাসি আটকানোর। সে সামনের থেকে সরে গিয়ে তিলোত্তমাদেরও দেখার সুযোগ করে দিলো। ওরা আর হাসি আটকালো না। হুঁ হা করে হেসে উঠলো সমস্বরে। রুপা বুঝতে না পেরে বেকুবের মত তাকিয়ে রইলো ওদের দিকে। নাক টানতে টানতে বললো,
~হাসছিস কেনো? কি হয়েছে?

রিদিতা হাসতে হাসতেই তাকে টেনে আয়নার সামনে দাড় করালো। কান্নার ফলে কাজল লেপ্টে আছে। ঠিক যেনো মঞ্জুলিকা। নাকখানা হয়ে আছে টকটকে লাল। সে তৎক্ষণাৎ টিস্যু দিয়ে লেপ্টে থাকা কাজল মুছতে শুরু করলো। রিদিতা রূপার গাল টেনে দিয়ে বললো,
~ছো খিউট!!!
উপমা হাসতে হাসতে রুপাকে বললো,
~সবাই জানতো তুই এখানে এসে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদবি। তোর উচিত ছিল ওয়াটারপ্রুফ কাজল লাগানোর। এখন বুঝ ঠেলা, মঞ্জুলিকা।
~~~~
চলবে~
(অনেকদিন পর গল্প দিলাম। আজকে যথেষ্ট বড় পর্ব দিয়েছি। এই খুশিতে বেশি বেশি কমেন্ট করবেন। আর খুব শীঘ্রই গল্পটা শেষ করে দিবো। হ্যাপি রিডিং~)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here