চিত্তদাহ লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা বোনাস পর্ব

0
461

#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
বোনাস পর্ব

🍂🍂🍂

বাড়ির ছোট্ট লাইব্রেরীর এক কোণ ঘেঁষে বসে আছে শুভ্রতা। হাতে তার ইংলিশ ফিকশনাল নোভেল। ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে এখন রাত ১২ টা। শুভ্রতার সময়ের দিকে মনোযোগ নেই। সে বই পড়তে ব্যস্ত। তার পায়ের কাছে উল্টো হয়ে পড়ে আছে আরেকটা বাংলা কবিতার বই। কিছুক্ষণ আগে সেখানেও একজন বসে ওই বইটা পড়ছিল। দরজা ঠেলে লাইব্রেরীতে প্রবেশ করলো তিলোত্তমা। হাতে একটা ট্রে। সে এসে শুভ্রতার সামনা সামনি বসলো। তাকে দেখে শুভ্রতা আসন পেতে বসলো। তিলোত্তমা নিজের জন্য রং চা আর তার জন্য ব্ল্যাক কফি নিয়ে এসেছে। শুভ্রতা মুচকি হেসে কফিতে চুমুক দিলো।

~হাসছিস কেনো?

তিলোত্তমা প্রশ্ন করলো। তিলোত্তমার প্রশ্নে শুভ্রতার ঠোঁটের হাঁসি আরেকটু চওড়া হলো। সে কফি মগ এক পাশে রেখে আবারো আগের মত বসলো। বই খুলে চেষ্টা চালালো আগের লাইনটা খুঁজে বের করার। সে ওই লাইনের ওপর আঙ্গুল রাখলো। তিলোত্তমার দিকে চেয়ে বলল,

~দুধ চা প্রিয় মানুষ রং চা খাচ্ছে। কারণ তার সামনে মানুষটি ব্ল্যাক কফি খাচ্ছে। একজন কফি খাচ্ছে, আরেকজন দুধ চা। ব্যাপারটা তোর ভালো লাগেনি। ব্ল্যাক কফি খাওয়া তোর পক্ষে সম্ভব না তাই তুই চা ই ব্ল্যাক নিয়ে এসেছিস। ব্যাপারটা হাস্যকর লাগলো।

শুভ্রতার কথায় তিলোত্তমা একটু হাসলো। সে বই খুলে শুভ্রতার মতোই হাঁটু ভাঁজ করে বসলো। শুভ্রতা তার দিকে চেয়ে আবারো হাসলো। আবারো হাসতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো তিলোত্তমা। শুভ্রতা নিজের বই দেখিয়ে বলল,
~ইংলিশ

তিলোত্তমার বইয়ের দিকে আঙুল তাক করে বললো,
~বাংলা

আবারো হাসলো শুভ্রতা।

~দুই মেরুর প্রাণী আমরা….
~অথচ বন্ধু।
~না!
~তাহলে?
~বান্ধবী।

তিলোত্তমা হাসলো। শুভ্রতা আবার পড়ায় মনোযোগ দিলো। সারা লাইব্রেরীতে পিনপতন নীরবতা। শুভ্রতা একটু পর পরই কফিতে চুমুক দিচ্ছে। তবে বই থেকে দৃষ্টি সরাচ্ছে না। তিলোত্তমা অনেকক্ষণ একটা প্রশ্ন করবে কি করবে না ভাবলো।

~আহনাফ ভাই কই?
~ঘুমায়।

বইয়ের দিকে দৃষ্টি রেখেই উত্তর দিলো শুভ্রতা। একটু আগের হাস্যরত পরিবেশটা হুট করেই বেশ গম্ভীর মনে হলো তিলোত্তমার কাছে।
~তুই কি কিছু নিয়ে চিন্তিত?

তিলোত্তমা আবার প্রশ্ন করলো। শুভ্রতা চোখ তুলে তাকালো। মাথা উঠলো না। আগের মতই নুয়ে রাখলো। সে চোখ ফিরিয়ে বইয়ের দিকে তাকালো আরেকবার। শান্ত গলায় বলল,
~না। মনে হয়… একটু।

~কি নিয়ে?

শুভ্রতা এবার এক ঝটকায় বই বন্ধ করলো। বইটা এক পাশে রেখে আরো গুটিয়ে বসলো। হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে জবাব দিলো।

~গত দু বছরে যতো বিচ্ছেদ ঘটলো সব আমায় ঘিরে। মা বাবার বিচ্ছেদ, মায়ের মৃত্যু, অরণ্য আর ঝাড়বাতির বিচ্ছেদ, বন্ধুত্বে বিচ্ছেদ, রূপার নিজের ভালোবাসা না পাওয়া। সবটা আমার কারণে।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো শুভ্রতা। তিলোত্তমা কিছু বলতে চাইলো। তার আগেই শুভ্রতা বললো,

~চন্দ্রের জন্যে আমার খুব চিন্তা হয়। মানুষটা আমার জন্য নিজের কি হাল করেছে দেখেছিস? আমার চিন্তা হয়। আমি মরে গেলে কি হবে ওনার, কি করে থাকবেন উনি? ভালো থাকবেন কি করে?

শুভ্রতা অশ্রুসিক্ত চোখে তিলোত্তমার দিকে চাইলো।

~চিত্রা মায়ের অসহায় চাহনীতে আমার হৃদয় পুড়ে। কি অসহায় আমি, কতটা অভিশপ্ত। যাকেই মা ডাকি সে ই তার প্রিয় কিছু হারায়, নিঃস্ব হয়। চন্দ্রকে নিয়ে আমার খুব ভয় হয়। আমি চাই আমি যাওয়ার পরও সে নিজেকে গুছিয়ে রাখুক। আমি তার জীবনে আসার আগের মত গোছালো হোক। সবটাই আগের মত হোক। শুধু পরিবর্তন হিসেবে তার সাথে আমার কিছু স্মৃতি থাকুক। তার এভাবে ভেঙে পড়া আমাকে যে কতটা কষ্ট দেয় আমি যদি তা বলে বুঝাতে পারতাম!

এক ফোঁটা অশ্রু তার নেত্রকোণ গড়িয়ে পড়লো। শুভ্রতা আবারো দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। চোখ মুছে সে তিলোত্তমার দিকে তাকালো। সে করুণ চোখে তার দিকেই চেয়ে। শুভ্রতা মুচকি হাসলো।

~তোর মনে আমায় নিয়ে আরেকটা স্মৃতি লেখা হলো। আজকের দিন।
_______________________________

ঘরে যাওয়ার সময় শুভ্রতা বাইরে থেকে খেয়াল করলো তার ঘরে আলো জ্বালানো। শুভ্রতার মনে আছে সে যাওয়ার আগে ঘরের লাইট অফ করে গিয়েছিল। শুভ্রতার ভ্রু কুঁচকে আসলো। ঘরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলো ঘরে কেউ নেই। শুভ্রতা ধীর পায়ে বারান্দায় গেলো। চন্দ্র দাড়িয়ে। হাতে তার জ্বলন্ত সিগারেট। শুভ্রতার রাগ হলো। চন্দ্রের হাত থেকে ছোঁ মেরে সিগারেটটা নিয়ে বললো,

~কতবার বলেছি এটা না খেতে। আপনি ছাড়তে পারেন না। আমিও দেখি কি আছে এই সিগারেটে।

শুভ্রতা ঠোঁটের কাছে নিতেই চন্দ্র সেটা জোড় করে ছাড়িয়ে নিলো। শুভ্রতা তাচ্ছিল্য হাসলো।

~যে হালে নিজের প্রিয় মানুষকে দেখতে চান না, সে হালে নিজেই থাকেন। ব্যাপারটা হাস্যকর না?

শুভ্রতা ঘরে ফিরে যেতে চাইলো। সে কি করে বুঝাবে সে চায় না তার প্রিয় মানুষটিকে এই হালে দেখতে? শুভ্রতার জানা হলো না চন্দ্র জানে সেসব কথা। সে শুনেছে তিলোত্তমা আর তার কথোপকথন। কি জানি, জানলে হয়তো তার অর্ধেক চিন্তাই কমে যেতো।
~~~
চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here