চিরসখা পর্ব -০৪

#চিরসখা (৪)

আসাদের মায়ের সাথে মেধার ঝামেলা হয়ে গেলো সেন্টমার্টিন থেকে ফেরার এক মাস পর। জীবন চলছে তার যথা নিয়মে। মেধা নিজের ভুবন নিয়ে ব্যস্ত। ভোরে অফিসের গাড়ি আসলে মেধা উঠে পরে। রান্নাঘরে ঢোকার আগে আসাদের মা ওকে নাস্তার বক্স দেন। দায়সারা ‘ধন্যবাদ’ জানিয়ে মেধা চলে যায়। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত করে ফেরে মেধা। সোজা রুমে এসে হেয়াল অয়েল ম্যাসাজ করতে বসে। আসাদের মা পারতপক্ষে তাকে ডাকেন না। ছুটির দিনে সবাই দুপুরে ভালোমন্দ খেতে বসলে মেধাকে আসাদের পাশে পরিপাটি সেজে বসতে হয়। মেহমান এলে মুখ রক্ষার্থে তাদের প্লেটে মিষ্টি পরিবেশন করে। সরকারী ছুটি থাকলে মেধা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। ওদিন তার বা আসাদের তাড়া নেই। এর ভেতর একটা অঘটন ঘটে গেলো। বদ মেজাজ করে চাকরী হারালো। হিরকের সাথে সম্পর্কের কথা প্রিয় কলিগ কানিজের অজানা ছিলো না। বিয়েতে দাওয়াত না পাবার শোধ হালকা খোঁচায় মারলো।
–সিলেটের পর সেন্টমার্টিন! মাই গড! মেধা, কি লাকি তুমি। আমরা বিয়ের পর একবার কক্সবাজার গিয়ে সমুদ্রের চেহারা ভুলে গেলাম। তুমি বিয়ে আগে পরে ঘুরছো। তাও আবার, টেস্টবাড বদলে বদলে। কয় জনের ভাগ্য হয়, একবার প্রেমিক একবার স্বামীর সাথে প্রি এন্ড পোস্টহানিমুন করার।
–আপনি যা ভাবছেন, তাই করলে এরপরের বার ভাইয়াকে বলবো সাথে যেতে। কানিজ মেধার কথার জবাব না দিয়ে সোজা বসের কাছে কমপ্লেন করে । বস কানিজকে চেয়ারে বসিয়ে রেখে মেধাকে ঝেড়েছে। মেধা টুকটাক উত্তর দিতে গিয়ে অধৈর্য হয়ে বসের সাথে দুর্ব্যবহার করে বসে। বাড়ি ফিরে গুম হয়ে ছিলো মেধা। বড় বোনকে তখন ফোন করে চাকরির জন্য বলেছে। রাশাদের কান থেকে আসাদ পর্যন্ত খবর পৌছে গেলো। মেধার হাতে পরদিন নামকরা পার্লারের কুপন ধরিয়ে অফিস গেলো আসাদ। নিজের পরিচর্যা করলে মেয়েদের মন ভালো হয়, কথা সত্যি। কিন্তু, মেধা কারো দয়া চায় না। বিশেষত, আসাদের তো নয়ই। কুপন ডাস্টবিনে ফেলতে গেলে আসাদের মা দেখে এগিয়ে আসেন।
–অফিসের লাঞ্চে ভাত নিয়ে যাও।
–চাকরি চলে গেছে। সিভি দিচ্ছি এখানে ওখানে। হয়ে যাবে।
–আসাদকে বলো। ওর চেনাশোনা আছে।
–আমি নিজে খুঁজতে পারবো।
–ওর অফিসে পোস্ট খালি হলে এপ্লাই করো।
–এক জায়গায় চাকরী করার ইচ্ছে নেই, মা।
–কুপন তোমার দরকার না থাকলে রুপাকে দিয়ে দাও।
–ছোট বাচ্চাকে রেখে ও যেতে পারবে বলে মনে হয় না।
–তুমি বাসায় আছো। অন্য কিছু করার না পেলে আজকে বাবুকে দেখো।
মেধা বুঝতে পারে তাকে বিপদে ফেলা হয়েছে। বোনের মেয়েকে পালতে তার অনীহা। রাশাদের ছেলেকে দুধ বানিয়ে খাওয়ানো, পটি পরিষ্কার করার কাজ সে করতে যাবে কোন দুঃখে। বরং, যা বলার মুখের ওপর বলবে।
–পারব না। অন্যের বাচ্চা পালতে গিয়ে ব্যাথা পেলে দোষ হবে।
–তোমার মায়ের জন্য কুশির রুটি কভার করিয়েছি। নিয়ে যেও। আসলে, তোমার কাছে আমাদের কারো চাহিদা নেই মেধা। দয়া করে, আমার ছেলেকে শান্তি দিও।
আসাদের মা রান্নাঘরে ঢুকে পরেন। দুপুরের পর রুপাকে পার্লারে পাঠাবেন। বিকেলে রাশাদ আসলে নাতিকে তার কাছে রেখে ছেলেকে বউ নিয়ে ঘুরে আসতে বলবেন। কট্রোল করতে গেলে বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন। অতি কঠোর বা অতি কোমল দুটোর মাঝে থাকতে হয়। বিচক্ষণতার সাথে আসাদের মা পরিবেশ নিজের আয়ত্তাধীন করে রাখেন। মেধা মেয়েটাকে তার শুরু থেকে ভালো লাগেনি। বেশী ভালো ছেলের কপালে শেষে একটা ডাট ভাঙা ঝাড়ু জুটলো। ফেসবুক দেখতে দেখতে মেধা নাস্তা খেতে বসে। আজকের মেনু চনার ডালের মুরগীর গিলা কলিজা, পরোটা, হালুয়া। তেল চপচপে পরোটা দেখে মেধার আরেকপ্রস্থ মেজাজ খারাপ। বুয়াকে ডেকে রুটির কথা বলায় আসাদের মা ওকে সেঁকে নিতে বলে। মেধা নাস্তার টেবিল ছেড়ে উঠে যায়। হিরকের মেসে গেলে ও নাস্তা মিস করে যেতো। দুপুরে ডাল ভর্তা, মুরগী, ভাত হোটেল থেকে এনে খেয়ে ঘুরতে বের হওয়া। বাসা বাড়ি সংসার মানে ঝামেলা। মেধার মেজাজের পারদ চড়তে থাকে৷ বুয়া চা দিয়ে গেলে কাপ ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু, এখানে ঝামেলা করার দরকার কি। ডাইনিং এ গিয়ে বিস্কিট নিয়ে আসার সময় মেধা শুনতে পায়, শাশুড়ী আসাদের কাছে তার নামে নালিশ জানাচ্ছে। বিস্কিট খাওয়ার রুচি চলে গেছে মেধার। কুটনী বুড়ির গাঁটেগাঁটে বিষ।

মেধা দিনটা বাড়ির ভেতর ঘুরে ফিরে। রাশাদের বাচ্চার সাথে হালকা খেলা করে। রুপা সত্যি পার্লারে চলে গেলো। অসহ্য লাগে মেধার। রাতে আসাদের কাছে বিচার চাইতে বসে। হাই তুলে আসাদ মেধার কথা শুনে বলে,
–ফেলে দেয়া জিনিষের সদ্ব্যবহার সবাই করে না। যারা করে তারা এক্সেপশনাল।
–সম্পর্কে আমি বড়। রুপা একবার জিজ্ঞেস করতে পারতো।
–মুখে মুখে বড় হওয়া যায় না।
–কাজ করতে হবে বড় হওয়ার জন্য?
–কার দরকার পরেছে তোমাকে দিয়ে কাজ করাবার। কাছে এসো। মাথা টিপে দাও।
–আমার কি দরকার পরেছে তোমার মাথা টেপার।
–সেদিন পা ব্যাথা করায় পা টিপলাম, তুমি ঘুমালে। বাধ্য হয়ে মেধা আসাদের মাথা টেপে। বিশ্রি একটা পরিবার।
আসাদ ঘুমিয়ে গেলে মেধা ফেসবুক খোলে। হিরক ওর বাচ্চার নতুন ছবি আপ্লোড করেছে। বাচ্চা কোলে সইয়ের সব ছবি হিরকের গায়ের সাথে লেপ্টে লেপ্টে তোলা। সই আর হিরকের আলাদা একটা ছবি দেখে মেধার কান্না পায়। এরকম ছবি তার আর হিরকের ছিলো। সই নিশ্চিত দেখে ছবি রিক্রিয়েট করলো। মেধাকে ওর জীবন থেকে সরিয়ে খ্যান্ত হয়নি। আগের স্মৃতি মুছে দিতে চায়। হিরকের প্রোফাইল পাব্লিক করা। মেধা ‘এড ফ্রেন্ড’ অপশনের ওপর হত রেখে দোটানায় পরে। হিরককে ও ব্লক করে ছিলো। বিয়ের পর আনব্লক করেছে। এখন এড রিকোয়েস্ট পাঠালে হিরক এক্সেপ্ট না করলে ইগোতে লাগবে। দোমনায়া থেকে শেষে রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দেয় মেধা।

সকালে আসাদ বের হবার আগে মেধা তৈরী হয়। সারাদিন বাইরে কাটাবে। এক জায়গায় ইন্টারভিউ আছে। আরেক জায়গায় সিনিয়র ভাই দেখা করতে বলেছে। পার্টটাইম কিছু একটা কাজ পেলেও করতে হবে৷ সোজা কথা, এ বাসায় বসে থাকা যাবে না। আসাদ ওর মায়ের বিষয়ে শক্ত। মেধাও নিজের বাড়ি ফিরতে চায় না। ওখানে গেলে মায়ের সাথে নতুন উপদ্রব আপা মেধাকে পান থেকে চুন খসলে কথা শোনাতে বসে থাকে। এখানে রাশাদের বাচ্চাকে অল্প স্বল্প আদর দিয়ে খেলনা কিনে দিলে রুপা আর মা দুজনের মন পাওয়া যাবে। ওখানে আপার বাচ্চার ডায়াপার বদলানো থেকে শুরু করে ঘুম পাড়াতে হবে। থাকার আলাদা রুম জুটবে না। বাচ্চা নিয়ে আপা মাটিতে শোবে না। এমনিতেই মেধা মহা যন্ত্রনায় আছে। উপরি হিসেবে আয়াগিরি করার মুড নেই। এখানে থেকে নতুন জবের জন্য সারাক্ষণ চেষ্টা করা ভলো। অনলাইনে লাইভ এসিসট্যান্টদের দৈনিক ছয় ঘন্টা কাজের দুটা অফার আছে। সকাল- রাত সাথে যাওয়া আসা মিলিয়ে চোদ্দ ঘন্টা বাড়ির বাইরে থাকা যাবে। অনলাইন শপিং করে মেধার হাত খালি। ব্যাংকের টাকায় হাত দেয় না। আসাদ ওকে গাড়ি দিয়ে নামিয়ে দেয়ার আগে একটা খাম দিলো।
–এটা রাখো।
–কি এটা।
–একশ একটা নীলপদ্ম দিতে পারলাম না। প্রেমপত্র।
–রাবিশ।
–রাবিশ হলেও ভ্যালু আছে। খুলে দেখো।
মেধা গাড়ি থেকে নেমে যায়৷ আসাদ চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে। তারপর খামটা ফেলে দেয় রাস্তায়। খামের মুখ খোলা ছিলো। কিছু একশ, পাঁচশ আর হাজার টাকার নোট ছড়িয়ে পরে। মেধা দ্রুত টাকাগুলো তুলে নেয়। একটা ভিখিরি এসে পয়সা চাইলে ব্যাগ থেকে পাঁচ টাকার কয়েন দিতে গিয়ে পরে একটা একশ টাকার নোট দেয়। ‘অন্যের টাকা, দিলে তার কি!’ অফিসের রিসিপশনে বসে মেধা ফোন খোলে। হিরক ওর রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করেছে!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here