চেকমেট পর্ব ১৩

#চেকমেট
#পর্ব-১৩
প্রিয়ন্তি বিস্ফোরিত চোখে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো। শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আমাদের নামে এরেস্ট ওয়ারেন্ট আছে মানে? আমরা কী করেছি?”

দারোগা সাহেব বললেন, ম্যাম প্লিজ থানায় চলুন। থানায় গেলেই বুঝতে পারবেন ঘটনা কী।

লাবণী পাশে দাঁড়িয়ে প্রিয়ন্তির এক হাত ধরে ঠকঠক করে কাঁপছে। প্রিয়ন্তি নিজেও ভীতু। তবুও যথেষ্ট সাহস সঞ্চার করে বলল, কিন্তু আমরা কী করেছি?

“আপনাদের পাশের ফ্ল্যাটের দম্পতিদের মার্ডারের অভিযোগে গ্রেফতার করা হলো। ”

প্রিয়ন্তি অবাক গলায় বলল, কী!

“ম্যাম দেরি করবেন না। চলুন তাড়াতাড়ি। ”

এইটুকু সময়ের মধ্যে লাবণী একটাও কথা বলল না। দাঁড়িয়ে থাকা সময়টুকু প্রিয়ন্তির হাত ধরে ছিলো। শেষকালে টলমল পায়ে হেটে পুলিশের জিপে উঠলো।

দুজনকেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এক জায়গায় নেয়া হলো। লাবণী তো প্রায় মূর্ছা যাবার মতো অবস্থায়। প্রিয়ন্তি বেশ শক্ত আছে সে তুলনায়। আগেও একবার থানায় এসেছিল বলেই হয়তো ভয়, ডর কম। বেশ কিছু সময় কেটে যাবার পর সৌরভ ঘরে ঢুকলো। আজ অনেকদিন পর সৌরভের সাথে প্রিয়ন্তির দেখা হলো। সৌরভ হেসে বলল,

“কেমন আছ প্রিয়ন্তি?”

প্রিয়ন্তি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, নাটক হচ্ছে! এখানে তুলে এনে এখন জিজ্ঞেস করছ কেমন আছি!

সৌরভ হেসে ফেলল। বলল, মেয়েরা এতো শক্ত নার্ভের হতে পারে সেটা তোমায় না দেখলে জানতাম না।

লাবণী মুখ খুলল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ভাইয়া এসব কী হচ্ছে! আমার মাথায় তো কিছু ঢুকছে না।

সৌরভ লাবণীকে আশ্বস্ত করে বলল, লাবু তুমি রিলাক্সে থাকো। আমার বিশ্বাস তুমি এর সাথে জড়িত না। তবুও ডিউটির খাতিরে তোমাকেও এখানে আনা হচ্ছে।

প্রিয়ন্তি অধৈর্য্য গলায় বলল, তোমার কী মনে হচ্ছে যে খুন টা আমরা করেছি?

সৌরভ গম্ভীর গলায় বলল, মনে হচ্ছে না তবে প্রমাণ বলছে যে খুন টা তোমাদের কারও মাধ্যমে হয়েছে। লাবণী এবার কেঁদে ফেলল শব্দ করে। প্রিয়ন্তি লাবণীর উদ্দেশ্য বলল,
“লাবু এসব আজগুবি গল্পে বিশ্বাস করিস না। ”

সৌরভ প্রিয়ন্তি কে বলল, তোমার আমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আজগুবি গল্প বানাচ্ছি?

প্রিয়ন্তি তার স্বরে চিৎকার করে বলল, তা নয়তো কী! আমরা দুটো মানুষ কে খুন করে বাসায় এসে ঘাপটি মেরে বসে ছিলাম! আর কেন খুন করেছি? টাকার জন্য?

সৌরভ হেসে বলল, বেশী উত্তেজনায় আবার সত্যি কথাগুলো বলে ফেলো না প্রিয়ন্তি।

প্রিয়ন্তির রাগ আরও দ্বিগুণ হলো। বলল,
“তোমাকে আমি দেখে নেব। আত্মীয়ের গুষ্টির তুষ্টি কিভাবে করি সেটা এবার দেখো। ”

সৌরভের চোয়াল শক্ত হলো। বলল,
“প্রথমত আপনি এখন পুলিশ কাস্টডিতে আছেন। তাই ভুলে যান যে আমি আপনার আত্মীয়। আর দ্বিতীয় কথা হলো শক্তপোক্ত প্রমাণ যা পাওয়া গেছে তাতে মিনিমাম চৌদ্দ বছরের সাজা কনফার্ম। আর তৃতীয় কথা হলো এতো গলাবাজি এক মিনিটের মধ্যেই বন্ধ করে দেয়া যাবে।”

প্রিয়ন্তি রাগে ফুসতে লাগলো। দারোগা সাহেব সেই টিফিন বক্স আর তুশলের ড্রয়িং খাতাটা নিয়ে হাজির হলো। প্রিয়ন্তির মুখের রঙ পাল্টে গেল মুহুর্তেই। লাবণী অস্ফুটস্বরে কিছু একটা বলল যেটা স্পষ্ট শোনা গেল না।

সৌরভ ড্রয়িং খাতাটা বের করে লাবণীর দিকে দেখিয়ে বলল, দেখোতো লাবণী মিল আছে কী না!

লাবণী বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

সৌরভ এরপর প্রিয়ন্তির দিকে তাকিয়ে বলল, ২১ তারিখ সারা দেশে সরকারি ছুটি চলছিল। সেখানে তোমার অফিস কী করে চলছিল প্রিয়ন্তি।

জোঁকে নুন পড়লে যেমন অবস্থা হয় প্রিয়ন্তির অবস্থা ঠিক তেমন হলো। গলাবাজি সব বন্ধ হয়ে গেল। তোতলাতে তোতলাতে বলল, অফিসে অন্যকাজ ছিলো হয়তো!

“উঁহু। পুরো অফিস বন্ধ ছিলো। গেট পর্যন্ত খোলা হয় নি।”

প্রিয়ন্তি ঘামতে শুরু করলো। লাবণী অবিশ্বাস্য গলায় বলল, ভাইয়া!

সৌরভ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে টেবিলের উপর রাখা ল্যাপটপ খুলতে খুলতে বলল, আরেকটা জিনিস দেখাই তাহলেই সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।

ল্যাপটপে লাবণীদের বিল্ডিং এর সামনের সিসিটিভি ফুটেজ যেখানে দেখা যাচ্ছে ২১ তারিখ সকালে প্রিয়ন্তি সিকিউরিটি গার্ডের সাথে কথা বলছে। কী বলছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না, তবে অনেকক্ষন ধরে কথা বলছিল। এরপর সিকিউরিটি গার্ড উঠে কোথাও একটা চলে গেল, সেই সময় প্রিয়ন্তির হাত থেকে টিস্যু জাতীয় একটা কিছু পরে গেলে সেটা তুলছে।

এটুকু দেখে দুজনেই জিজ্ঞাসু চোখে সৌরভের দিকে তাকালো। সৌরভ বলল, কিছু বুঝতে পারছ না?

লাবণী মাথা নেড়ে না বলল। প্রিয়ন্তি মুখে কিছু বলল না। তবে হাতের উল্টোপিঠে কপালের ঘামটুকু মুছে নিলো।

সৌরভ বলল, ওয়েট আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। প্রিয়ন্তি কথা বলছে সিকিউরিটি গার্ডের সাথে। প্রায় অনেকক্ষন কথা বলল। খুব বেশী হলে দশ মিনিট ধরে নিলাম। এই সময়টা’য় গেট দিয়ে কেউ আসেও নি যায়ও নি। কিন্তু প্রিয়ন্তি যখন কিছু একটা নিচ থেকে তুলল তখন দেখা গেল গেট থেকে ময়লার গাড়ি বাইরের দিকে যাচ্ছে। অথচ ২১ তারিখ সকালের সিসিটিভি ফুটেজে তাকে একবারও ঢুকতে দেখা যায় নি। তাহলে সে বের হলো কী করে!

সৌরভ হেয়ালির সুরে বলল, ২০ তারিখ এসে থেকে গেছে?

লাবণী বলল, নো ভাইয়া। সিসি ক্যামেরা বন্ধ করা হয়েছে।

সৌরভ বিচিত্র ভঙ্গিতে হেসে প্রিয়ন্তির দিকে তাকালো। লাবণী প্রিয়ন্তির দিকে তাকিয়ে বলল, ছিঃ আপু!

সৌরভ বলল, প্রিয়ন্তি তুমি কী এবারও মুখ খুলবে না?

প্রিয়ন্তি জবাব দিলো না। লাবণী মাথা চেপে ধরে বলল,

“ওহ মাই গড! শেষ পর্যন্ত আমার আপুই কী না! কথাটা শেষ করতে পারলো না। ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। সৌরভ পানির গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে বলল, কাম ডাউন লাবণী।

লাবণী অনুরোধের সুরে বলল, ভাইয়া প্লিজ ব্যাপার টা একটু খুলে বলবে তুমি?

সৌরভ প্রিয়ন্তির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি বলবে নাকি আমি বলব? প্রিয়ন্তি জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। নিজেকে বাঁচানোর জন্য কোনো শব্দ বলার মতো খুঁজে পাচ্ছে না। ”

সৌরভ বলল, ওকে ফাইন। তোমার কষ্ট আরেকটু কম করি। কারণ এরপর তোমাকে অনেক কিছু বলতে হবে তো।

সৌরভ লাবণীর দিকে তাকিয়ে বলল, ব্যাপার টা হলো এই জোড়া খুনের প্ল্যান করা হয়েছে অনেকদিন আগে থেকে। তবে প্ল্যান টা একটু অন্যরকম ছিলো সম্ভবত । সারা তাবাসসুম এর সাথে প্রিয়ন্তির দেখা হয় একটা ইভেন্টে। এই দেখা হওয়াটার ভিতরেও একটা নাটকীয়তা আছে আমার ধারণামতে।
এরপর সারা প্রিয়ন্তির মধ্যে দারুণ বন্ধুত্ব তৈরী হয়। সারা সেই বন্ধুত্বের খাতিরে প্রিয়ন্তির থেকে মোটামুটি এমাউন্টের একটা টাকা নেয়। যেটা সে সবার সাথেই করে। মিষ্টি মিষ্টি কথার জালে আটকে টাকা ধার নিয়ে সেটা আর ফেরত না দেবার ধান্দা। যাইহোক এবার টাকাটা ছিলো সারাকে ট্রাপে ফেলার জন্য ইনভেস্ট করা। ব্যস! সারা ফেসে গেল। বন্ধুত্বও ছুটে গেল ভালোরকম, তবে একটা ব্যাপারে সারা আটকে গেছিলো সেটা হলো প্রিয়ন্তির কাছে সারার বিরুদ্ধে কিছু একটা ছিলো। খুবই ভয়ংকর কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কিছু যেটা সারা তাবাসসুম কে দমিয়ে রাখতে পারবে।

শুরু হলো সারার উপর প্রেশার টাকা দেয়ার জন্য। এদিকে সারার হাতেও টাকা একদম নেই বললেই চলে। তাই বলল অপেক্ষা করতে। এরপর সারা অন্য চাল চালল। প্রিয়ন্তিকে বলল, ওকে একটা কাজে হেল্প করতে তাহলে টাকা ফেরত দেবে। প্রিয়ন্তিও সেই কাজে হেল্প করার জন্য একবাক্যে রাজী হয়ে গেল।

প্রিয়ন্তি মাথা নিচু করে কাঁদছে। সৌরভ বলল, এই কাহিনী আমি কাল সারাদিন, রাত ভেবে বের করেছি। কিছু ভুল হলে ধরিয়ে দিবে কিন্তু প্লিজ।

প্রিয়ন্তি জবাব না দিয়ে আরও জোরেশোরে কাঁদতে শুরু করলো।

লাবণী বলল, তারপর?

সৌরভ বলল, সারার প্ল্যান ছিলো জাহাঙ্গীর কবির কে মারা। কারণ জাহাঙ্গীর কবির তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে সেটেল হওয়ার কথা ভাবছিলেন সেটা সারা টের পেয়ে যায়। তাই প্রিয়ন্তিকে নিয়ে প্ল্যান করে জাহাঙ্গীর কবির কে মারার। এক্ষেত্রে প্রিয়ন্তিকে সারার কাছাকাছি থাকতে হবে। তাই কায়দা করে একই বিল্ডিং এ বাসা ভাড়া নেয় প্রিয়ন্তি। তবে পাশাপাশি ফ্ল্যাট কাকতালীয় ভাবে হয়ে যায়। এতে অবশ্য ওদের সাপেবর হয়। সারার প্ল্যান হলো জাহাঙ্গীর কবির কে বিষ দিয়ে মেরে ফেলবে। পটাশিয়াম সায়ানাইড। যাতে কেউ ধরতে না পারে। ঠিক মাত্রায় সায়ানাইড যদি শরীরে প্রবেশ করাতে সক্ষম হয় তবে সাথে সাথে মৃত্যু হলে সেটাকে হার্ট এটাক বলে চালিয়ে দেয়া সম্ভব। কিন্তু জাহাঙ্গীর কবিরের আরেকটা পরিবার থাকার কারনে সারা এই রিস্কটুকু নিজে না নিয়ে প্রিয়ন্তিকে নিয়ে নেয়ায়। কিন্তু প্রিয়ন্তি পটাসিয়াম সায়ানাইড না দিয়ে খাবারের মধ্যে অতি কৌশলে হেমলক দিয়ে দেয়। সারা টেরও পায় না। সে খুশিমনে সালাদ ভেবে হেমলক খেয়ে ফেলে। একসাথে খেলে দুটো আলাদা করা প্রায় অসম্ভব তাই ধরতেও পারে না। এরপর প্রিয়ন্তি খাবারটুকু তুলে বক্সে নিয়ে আসে। কিন্তু এখানে একটা ছোট ভুল হলো বাচ্চাটা তখনই ঘুম থেকে জেগেছে। প্রিয়ন্তি নিজের মুখ ঢেকে গিয়েছিল বলে সেটা না দেখলেও ওর হাতের টিফিন বক্সটা ভালোভাবে দেখেছিল।

লাবণী অস্থির গলায় বলল, ওহ মাই গড! প্রিয়ন আপু এটা কেন করতে যাবে! মার্ডারের মতো এতো জঘন্য কাজ?

কারণ প্রিয়ন্তিকে দিয়ে কেউ একজন করিয়েছে এসব।

লাবণী বিস্মিত গলায় বলল, কেউ একজন?

“সম্ভবত ওর বয়ফ্রেন্ড। আর আমার অনুমান বলছে শুক্রবার তার সাথে আমার দেখা হয়েছে আর অল্প বিস্তর কথাও হয়েছে।

চলবে….
(আজ শেষ করতে পারলাম না। দুঃখিত আর এক পর্ব ই বাকী)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here