চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব -৩৯+৪০+৪১+৪২

#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩৯

চলতি সময়ের মধ্যেই যেন সূর্যকরোজ্জ্বল গগনের মন ক্ষুণ্ণ হলো। আঁধার নামলো মেঘের কোল ঝুড়ে।
শেফালি ফুলের নরম গায়ে অনিল আঁচড় কাটতেই দোলায়মান হলো তারা। কয়েকটা ঝরে পড়লো নিমেষে। ঝপঝপ শব্দ করে শালিকের দল উড়ে গেল দিগন্তে। হয়তো আজ ধরণির বুক জুড়ে নামবে এক মুঠো শীতলতা। বদ্ধ এক কক্ষে হাতে উষ্ণ কফির কাপটি চেপে নির্বাণ কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া সকল কিছু তাপসিকে খুলে বলল। অতঃপর জানালার বাহিরে তাকিয়ে দেখতে থাকলো বিষণ্ণ আকাশটিকে। পাশেই তাপসি দু’হাতের মাঝে কফির কাপটা চেপে ধরে অপ্রসন্ন কন্ঠে বললেন, “ভিসি স্যার এইটা কিভাবে বলতে পারলেন যে, আপনি শিক্ষক-ছাত্রীর সম্পর্ক হীন করেছেন? এই কথাটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? তাহলে তো বলা চলে, পৃথিবীর সব শিক্ষকই এই হীন কাজটি করেছেন, কেননা তারাও কোন না কোন স্টুডেন্টকেই বিয়ে করেছেন। এখন কি সবাইকে সাসপেন্ড করবেন নাকি তিনি? হাস্যকর লাগলো ব্যাপারটা আমার কাছে।”

নির্বাণ স্মিত হাসলো, “আপনি এখনো ধরতে পারেননি বিষয়টা। শিক্ষক-ছাত্রীর সম্পর্কটা অযুহাতমাত্র দেখিয়েছেন তিনি, আসল কাহিনী হচ্ছে আমি সামান্য একজন লেকচারার হয়ে তার পারমিশন ছাড়াই ট্রাইবুনালদের ডেকেছিলাম আর তাকে কিছু না জানিয়ে কাহিনি করেছিলাম সেটাই তার ইগোতে লেগেছিল। যার জন্য তিনি মিটিংয়ে নিজ থেকে আমার কথা উঠিয়ে, নিজেই সকল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর তিনি এসব করেছেন শুধুমাত্র নিজের পাওয়ার দেখাতে। কিন্তু সে তো আর জানে না, ভিতরের খবর কোনটাই আমার অজানা না।”

“আজব তো! এটা কোন কথা নাকি?”

“আপনি নিজেই একবার ভাবুন, তার যদি শিক্ষক-ছাত্রীর বিয়ে নিয়ে সমস্যা হতো তাহলে মুহিব স্যারের বিয়েতে গিয়ে তিনি এক হাড়ি দই খেয়ে শেষ করতেন নাকি? মুহিব স্যারও তো এই ভার্সিটিরই অন্যের ডিপার্টমেন্টের এক ছাত্রীকে বিয়ে করেছেন। তাও ঘটা করে। কথা কিন্তু তখনও কম উঠেনি, বেশ সমালোচনায় ছিলেন তিনি। তবে সেটা নিয়ে কি ভিসি স্যারের মাথাব্যথা হতে দেখেছেন? না, কারণ ভার্সিটি লেভেলে এসে এই বিষয়টা অতি সাধারণ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও পাছে লোকে সব জায়গায় কথা বলে। সবাই সবকিছু ভালোভাবে নিতে পারেনা। এখনো এমন কিছু মানুষ আছে যারা শিক্ষক-ছাত্রীর বিয়ে ভালো চোখে দেখে না।”

তাপসি ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকালেন, “তা নাহয় বুঝলাম কিন্তু আপনি কি তাহলে লোকভয়ের জন্য ছেড়ে দিলেন চাকরিটা?”

নির্বাণ দৃষ্টি কফির কাপটায় নিবদ্ধ করে বলল, “ভুল বললেন। লোকভয় আমার মধ্যে কোন কালেই ছিল না। আর থাকবেও না। আমি চাকরিটা ছেড়েছি অন্য কারণে।”

তাপসি কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কি সেই কারণ?”

“মন উঠে গিয়েছে এই প্রফেশন থেকে। আগের মত সেই টান অনুভব করি না। কালক্রমে রিজাইন আমি করতামই। হয়তো আজ না করে একমাস পর করতাম, পার্থক্য শুধু এখানেই।”

“বুঝলাম। তবে আপনি যখন সব জানতেন তখন ভিসি স্যারের মুখের উপর কিছু বললেন না কেন?”

“তার সাথে তর্কে জড়ানোর ইচ্ছা আমার ছিল না তাই। বললে তো কত কিছুই বলা যায়। হয়তো আজ মুখ খুললে এমন কিছু বলে ফেলতাম যা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তখন আবার বিশ্রি এক ঘটনা ঘটে যেত।”

তাপসি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, “আপনি পারেনও বটে। তা আপনার কি মনে হয় স্যারের মুখের উপর রেজিগনেশন লেটার দিয়ে এসেছেন তিনি ঝামেলা করবেন না?”

নির্বাণ কাপে আলতোভাবে অধর ছুঁয়ে নির্বিকার কন্ঠে বলল, “ঝামেলা করার সুযোগ নেই তার কাছে। কারণ আমি এখানকার সাধারণ একজন লেকচারার, কোন প্রফেসর না যে যখন তখন রিজাইন করতে পারব না বা তিনি আমার উপর কোন এলিগেশন লাগিয়ে ঝামেলা সৃষ্টি করবেন।”

“আছেন আর কতদিন?”

“মাস শেষ হওয়া পর্যন্ত আছি৷ ”

তাপসি আড়ষ্ট কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “তার মানে আর এক সপ্তাহ?”

“হ্যাঁ।”

“এরপর কি করবেন ভেবেছেন?”

নির্বাণ একপলক তাকালো তাপসির দিকে, “পরিকল্পনা আছে একটা। যদি সেটার মতই সব তাহলে সেটেল হতে বেশি সময় লাগবে না আশা করি।”

“যাক ভালোই।”

নির্বাণ স্মিত মুখে তাকিয়ে কফির কাপটা টেবিলের উপর রেখে বলল, “উঠি এখন। আমার ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে। থ্যাংক্স ফর দ্যা কফি।

তাপসি মৃদু হাসলো। নির্বাণ সেন্টার টেবিলের উপর থেকে নিজের বই নিয়ে বেরিয়ে গেল। কলাভবনের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কিঞ্চিৎ সময়ের জন্য দাঁড়ালো। নিষ্প্রভ চাহনিতে তাকালো সুদূরে মাথা উঁচিয়ে থাকা বটমূলটার দিকে। তারই নিচে বন্ধুমহলের আড্ডায় স্পর্শী ম্লানমুখে বসে আছে। মাঝে মধ্যে বন্ধুমহলের কথায় মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে তুলছে ঠোঁটের কোণে। বুঝতে দেরি নেই, বিগত দিনের ঘটনা থেকে এখনো ঠিকঠাক বেরিয়ে আসতে পারেনি সে। রেশ রয়ে গিয়েছে এখনো৷ যদিও মেয়েটাকে সে কয়েকদিন ভার্সিটি আসতে নিষেধ করেছিল, সাথে কোনকিছু নিয়ে মন খারাপ করতেও কিন্তু মেয়েটা তার কথা শুনলে তো। বড্ড অবাধ্য সে। এই যে এখনো, ঝোড়ো হাওয়ার মাঝে বসে আছে৷ ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লেগে গেলে? তার উপর কখন ঝুম বৃষ্টি নেমে পড়ে কে জানে? বুদ্ধি-সুদ্ধিও বোধ হয় লোভ পাচ্ছে মেয়েটার। স্পর্শীকে নিয়ে কি যে করবে নির্বাণ কে জানে? দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দ্রুত কয়েকটি শাণিত শব্দে বাক্য এঁটে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিল স্পর্শীকে। অতঃপর মুঠোফোনটা পকেটে পুরে হাঁটা দিল ক্লাসের দিকে।

_____________________

আকাশ জুড়ে তখন কৃষ্ণমেঘের রাজত্ব। দিবালোক হয়েও যেন নিশুতি রাতের প্রহর চলছে। কিঞ্চিৎ সময় যেতে না যেতেই গা ঝাঁকুনি দিয়ে এক পলশা বৃষ্টি নামলো তপ্ত ধরার মধ্যখানে৷ আলতোভাবে ছুঁয়ে সিক্ত করে তুললো শুভ্রতায় মোড়ানো কোমল ফুলের গা। অকৃত্রিম ঘ্রাণে মাতোয়ারা হলো আশপাশ। নিজের মন ভোলাতে বিষণ্ণচিত্তে সামনে দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল স্পর্শী। শীতল কণাগুলো ছুঁয়ে দিতে থাকলো ম্রিয়মাণ নয়নে। অকস্মাৎ ফোনটা বেজে উঠলো তার। নির্বাণ ফোন দিয়েছে৷ স্পর্শী ফোন তুলতেই নির্বাণ জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় তুমি?”

স্পর্শী আশপাশে তাকিয়ে সে এখন কোথায় তা জানালো নির্বাণকে। জায়গায় সনাক্ত করতে পেরে নির্বাণ বলল, “সেখানে দাঁড়িয়ে থাকো আসছি আমি। ভুলেও ভিজবে না৷”

স্পর্শী অবসন্ন কন্ঠে সম্মতি জানিয়ে ফোন রাখলো। কিয়ৎকাল পরই নির্বাণ গাড়ি নিয়ে স্পর্শীর সামনে হাজির হলো। ভিতর দিয়ে গেট খুলে দিয়ে স্পর্শীকে দ্রুত ভিতরে এসে বসতে বলল সে৷ স্পর্শী একপলক নির্বাণের দিকে তাকিয়ে নীরবে উঠে বসে দরজা লাগালো। নির্বাণ এবার পকেট থেকে রুমাল বের করে স্পর্শীর আর্দ্র হাতটি মুছে দিল। অতঃপর মুখে-চোখে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু জলগুলো মুছে দিল খুব যতনে। কপালের কিনারে আঘাতপ্রাপ্ত স্থানটাও দেখে নিল একবার, তাতে পানি ঢুকেছে কি-না। মেয়েটা যে বেখেয়ালি আচরণ করে, তার দ্বারা কোন ভরসা নেই৷ নির্বাণের চিন্তিত মুখ দেখে স্পর্শী বলল, “আমি ঠিক আছি।”

নির্বাণ তাও সরে আসলো না। ভালোমত আঘাতটা দেখে নিল আরেকবার। অতঃপর সরে এসে গম্ভীর কন্ঠে বলল, “তোমাকে আজ ভার্সিটি আসতে মানা করেছিলাম আমি।”

স্পর্শী মাথা নত করলো। আজ ভার্সিটি আসতে চায়নি সে কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু নোটসের জন্য আর ল্যাব স্যারের আর্জেন্ট ডাক পড়ায় অগত্যা আসতে হলো তাকে। এখন এতে কি করবে সে? মিনমিন কন্ঠে উত্তর দিল সে, “গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। আবার ল্যাব স্যারও ডেকেছিলেন সবাইকে তাই…..”

“বুঝেছি আর বলতে হবে না৷ সকালে খেয়েছ কিছু?”

স্পর্শী মাথা দোলালো৷ যার অর্থ সে খেয়েছে। নির্বাণ এবার আর কিছু না বলে স্পর্শী সান্নিধ্যে এগিয়ে দিয়ে তার সিটবেলটা লাগিয়ে দিল। সাথে সিটটা কিছু পিছনের দিকে হেলিয়ে দিয়ে বলল, “রেস্ট নাও এখন। মাথা কোনরকমের প্রেশার দিও না।”

একটু থেমে আবার বলল সে, “পানি পড়েছে মাথায় একটু, কাপড়টা নামিয়ে নাও। নাহলে পরে মাথাব্যথা করবে। এখানে আমি বাদে তো কেউ নি।”

স্পর্শী স্মিত মুখে তাকালো। মাথার কাপড় নামিয়ে গা আলগা করে বসলো সিটে। নির্বাণ সেদিক আর তেমন একটা গুরুত্ব না দিয়ে গাড়ি চালানো শুরু করলো। কিছু সময় ড্রাইভ করার পর পরই গাড়িটা থামলো। কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই নির্বাণ গাড়ি থেকে নেমে গেল। স্পর্শী সেদিকে হতবিহ্বল নয়নে তাকালো। তৎক্ষনাৎ প্রশ্ন জাগলো মনে, “আরেহ! হঠাৎ লোকটার কি হলো? এই বৃষ্টির মধ্যে গেল কোথায় সে?” প্রশ্নটির জবাব খুঁজে পেতে বেশি অপেক্ষা করতে হলো না স্পর্শীর। কিছু সময়ের ব্যবধানেই নির্বাণ একটা পলিথিন হাতে নিয়ে ফেরত এলো৷ স্পর্শী ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই নির্বাণ পলিথিনটা স্পর্শীর কোলে দিয়ে নিজের চুলের মাঝে হাত গলিয়ে দিয়ে মাথা ঝাঁকাল। অল্প সময়ের ব্যবধান হলেও বেশ খানিকটা ভিজে গিয়েছে নির্বাণ। স্পর্শী অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে সেদিক তাকিয়ে একবার নিজের কোলে তাকালো, আইসক্রিম রাখা আছে তাতে। স্পর্শী স্তম্ভিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি এইটা আনতে বাহিরে গিয়েছিলেন?”

নির্বাণ ছোট করে বলল, “হু!”

“আপনি পাগল? বৃষ্টিতে ভিজে কেউ আইসক্রিম আনতে যায়?”

নির্বাণ শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো, “সমস্যা কি এতে?”

“সমস্যা নেই বলছেন?”

“নেই তো।”

স্পর্শী ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, “হঠাৎ এমন পাগলামি করলেন কেন?”

“বৃষ্টির দিনে আইসক্রিম খাওয়া কি তোমার অভ্যাস নয়?”

স্পর্শী থমকালো। গোল গোল চোখে তাকালো। ঠোঁটের কোণে ফুটল নিরন্তর হাসি। কোন এক সময় কথায় কথায় স্পর্শী নির্বাণকে জানিয়েছিল বৃষ্টিমুখর দিনে আইসক্রিম খাওয়া তার ছোটবেলার অভ্যাস। প্রায়শই সে বৃষ্টি দেখতে দেখতে বা ভিজতে ভিজতে আইসক্রিম খেতে প্রচন্ড পছন্দ করে। এমন সময় তার মন খারাপ থাকলেও সেটা ভালো হয়ে যায়। কিন্তু কথাটি সে একবারই বলেছিল নির্বাণকে। সেই হিসাবে মানুষটা সেই কথা এখন অবধি মনে রেখেছে তা ভাবতেও পারেনি স্পর্শী। বিস্ময়-বিহ্বল কন্ঠে সে বলল, “আপনার এখনো মনে আছে কথাটা?”

নির্বাণ মনে মনে বলতে চাইলো, “প্রেয়সীর মন ভোলানোর বিষয়বস্তু কি আর ভুলে থাকা যায়?”
কিন্তু মুখে বলল অন্যভাবে, “ভুলার বিষয়বস্তু তো ছিল না যে, মনে থাকবে না।”

স্পর্শীর হাসলো। কোল থেকে পলিথিন ব্যাগটা নামিয়ে রেখে নিজের ওড়নার একপাশ টেনে বলল, “এদিক আসেন। মাথায় পানি জমে আছে এখনো, মুছে দিচ্ছি।”

নির্বাণ একবার ‘দরকার নেই’ বলতে গিয়েও বলল না। স্পর্শীর নরম চাহনিতে আহত হয়ে পরাজিত সৈন্যের ন্যায় মাথা ঝুঁকিয়ে নিল। স্পর্শী আর এদিক-সেদিক না তাকিয়ে নিজের কাজে মন দিল৷ নির্বাণের চুল ভালোমত মুছে দিয়ে স্পর্শী ক্ষান্ত হলো, নির্বাণও আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। ততক্ষণে স্পর্শী পলিথিন থেকে কোণ-আইসক্রিমটা নিয়ে খেয়ে শুরু করেছে। নির্বাণ আড়চোখে একবার তাকালো। স্পর্শীর অধরের কোণে মাধুর্য লেগে থাকতে দেখে মন প্রশান্ত হলো। যদি প্রণয়িনী নারীটি জানতো তার সামান্যটুকু হাসির জন্য মানবটি প্রলয়কারীও হয়ে উঠতে পারে তাহলে হয়তো সে কখনোই মন ক্ষুণ্ণ করার স্পর্ধা করতো না।
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৪০

পরিবেশ তখনও দীর্ঘ বর্ষণের প্রেমে মাতাল। দোলায়মান গাছের পাতা৷ সিক্ততায় মোড়ানো শেফালি,শিউলি গা। নিষুপ্তি পরিবেশে কৃষ্ণমেঘের ডাক ঝংকার তুলছে৷ জানালার ধারে মৃদু শব্দ হচ্ছে। বাতাসের বেগে কেঁপে কেঁপে উঠছে সুক্ষ্ম কাঁচের কপাট৷ ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব পড়েছে। স্পর্শীর গা কাঁটা দিয়ে উঠতেই সামনে খুলে রাখা বই স্থিরচিত্তে বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। মাথার উপর ঘূর্ণমান যন্ত্রটি বন্ধ করে খালি হাতে খোঁপা করে বেরুলো রুম থেকে উদ্দেশ্য পার্শিয়াকে খোঁজা। গতকাল থেকে দেখা নেই তার। স্পর্শী কয়েকবার পার্শিয়ার নাম ডেকে উঠলো কিন্তু সাড়া মিললো না কোনবার। অনেক খোঁজাখোঁজির পর স্পৃহার বিছানার তলায় তার সন্ধান পাওয়া গেল। বিছানার শেষপ্রান্তে গুটিসুটি মেরে বসে আছে সে। স্পর্শী নিচের দিকে মাথা নুয়ে খুব আদরমাখা কন্ঠে ডাকল, হাতে ইশারা করল। কিন্তু পার্শিয়া আসল না, মুখ ঘুরিয়ে সেখানেই একগুঁয়ে হয়ে বসে থাকলো। অনেক ডাকাডাকির পরও যখন পার্শিয়া এক চুলও নড়লো তখন স্পর্শী হাত বাড়িয়ে ওকে কাছে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করলো। পার্শিয়া তা দেখে অন্যপাশের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল৷ স্পর্শীও তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়াল। পার্শিয়া একঝলক স্পর্শীকে দেখে মুখ ঝামটা মেরে রুম থেকে বেরিয়ে গেল৷ স্পর্শী বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকালো সেদিক। বুঝতে দেরি নেই, তার ক্ষুদ্র মনে পাহাড় সম অভিমান জমেছে। এটা সহজে ভাঙ্গার নয়। স্পর্শী দ্রুত পায়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো। পার্শিয়াকে ড্রয়িংরুমের সোফায় অলসভাবে বসে থাকতে দেখে পিছন থেকে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নিল। পার্শিয়া প্রথমে কিছু না বললেও স্পর্শীকে দেখামাত্র নেমে পড়ার জন্য তোড়জোড় লাগালো৷ স্পর্শী জোড় করে পার্শিয়াকে কোলে বসিয়ে অনুনয় সুরে বলতে থাকে, “আমার বাচ্চাটা রাগ করেছে আমার সাথে? সরি সোনা! ভুল হয়ে গেছে এবার, আমি আর বকা দিব না। এবারের মত মাফ করে দাও। সরি!”

কথাটা বলে পার্শিয়ার গালের সাথে নিজের গাল ঘেঁষে দিল সে। কিন্তু তাও পার্শিয়া কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। স্পর্শী অবাক হয়ে বলল, “বাব্বাহ! এত রাগ?”

পার্শিয়া মুখ ঘুরিয়ে নিল। যার অর্থ, হ্যাঁ সে অনেক রাগ তার সাথে। একটুও কথা বলবে না সে। স্পর্শী স্মিত মুখে বলল, “আচ্ছা বাবা সরি তো। আর রাগ করে থাকে না। আমি আর কখনো তোমায় বকব না।”

আরও কতক্ষণ আহ্লাদ কন্ঠে স্পর্শীকে মানানোর চেষ্টা করলো। সর্বশেষে পার্শিয়ার মনও গললো তবে রাগ সম্পূর্ণ গেল না। সে ‘ম্যাও,ম্যাও’ শব্দ করে অভিযোগের ঝুলি নিয়ে বসলো। তীব্র আক্রোশ সেই কন্ঠে৷ স্পর্শী চুপচাপ শুনলো কথাগুলো আর আনমনে হাসলো। মন্থর গতিতে পার্শিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত করলো তাকে। বিড়ালছানা অবস্থা থেকেই পার্শিয়া স্পর্শীর সাথে আছে। স্পর্শী শুরু থেকেই একদম আদুরে বাচ্চার মত বড় করেছে তাকে। যার জন্য তার টান,ভালোবাসা,অভিমান একটু বেশি স্পর্শীর প্রতি। বাড়ির সকলে তাকে যা ইচ্ছা তা বলুক সেটা তার গায়ে না লাগলেও, স্পর্শীর সামান্য বকা তার সহ্য হয় না।
স্পর্শী পার্শিয়াকে আদর করতে করতে বলল, “মানুষ না হয়েও এত রাগ তোর, মানুষ হলে কি করতি কে জানে?”

পার্শিয়া কি বুঝলো কে জানে, উচ্চস্বরে চেঁচাতে লাগলো। স্পর্শী নিজের কপাল চাপড়ে বলে, “আরেহ তোর দুর্নাম করিনি, চেঁচানো বন্ধ কর।”

পার্শিয়া সরু দৃষ্টি তাকিয়ে থামলো। স্পর্শী হাসে, “এমন করতে থাকলে নির্বাণ কিন্তু তোকে ঘরে জায়গায় দিবে না৷ ভদ্র হো একটু।”

এই কথার প্রেক্ষিতে পার্শিয়ার মুখ ছোট হয়ে এলো। সে স্পর্শীর গায়ের সাথে লেগে মৃদুস্বরে ডাকতে থাকলো। স্পর্শী কিছু না বলে ওর সাথে খেলায় মত্ত হলো। ঘণ্টাখানেক এভাবে অতিবাহিত হওয়ার পর পার্শিয়া স্পর্শীর কোলে ঘুমিয়ে পড়লো। স্পর্শী পার্শিয়াকে কোলে করে নিজের রুমে এসে শুয়ে দিল। অতঃপর মুঠোফোন হাতে নিলে দেখতে পেল স্ক্রিনে নির্বাণের তিনটি মিসডকল ভাসছে৷ স্পর্শী দ্রুত কল ব্যাক করলো৷ দুইবার রিং হতেই নির্বাণ ফোন ধরলো। স্পর্শী সালাম দিয়ে দ্রুত বেগে বলতে শুরু করে, “ফোন আমার সাথে ছিল না তাই কল শুনিনি আপনার।”

নির্বাণ সালামের উত্তর দিয়ে ধীরে সুস্থে উত্তর দেয়, “ব্যস্ত হতে হবে না। আগেই বুঝেছিলাম বিষয়টা আমি।”

স্পর্শী চট করে জিজ্ঞেস করে বসে, “আপনি এত বুঝেন কিভাবে বলুন তো?”

“তুমি আপাদমস্তক আমার মুখস্ত বলে।”

স্পর্শী থমকালো। সর্বাঙ্গে খেলে যায় সহস্র শিহরণ। মানুষটার প্রত্যেক কথাই এমন, না থমকে পারা যায় না৷ ছোট বাক্য তার অথচ অনুভূতি রাজ্যসম। স্পর্শীকে চুপ থাকতে দেখে নির্বাণ প্রশ্ন করে,

“মন এখনো খারাপ?”

“নাহ! ঠিক আছি এখন।”

নির্বাণ এই প্রসঙ্গে আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। অন্য সংলাপে গেল৷ শেষে স্পর্শীকে কিছুদিন ভার্সিটি আসতে সম্পূর্ণ নিষেধ করলো। স্পর্শী যদিও বা জানতে চাইলো এর কারণ কি কিন্তু কি মনে করে যেন প্রশ্নটা করলো না। নীরবে সম্মতি জানালো।

________________

সময় গড়ালো স্রোতঃস্বিনীর ন্যায় । দিন পেরিয়ে সপ্তাহ শেষ এলো, ঘনিয়ে এলো কাঙ্ক্ষিত দিন। কোলাহল বাড়লো, গুঞ্জন উঠলো সকলের মাঝে। কানে কানে ছড়িয়ে গেল নির্বাণের রিজাইন করার কথা। যদিও এবার কেউ সমালোচনা করার সুযোগ পেল না তবে আফসোস করলো ঠিকই। যে যাই বলুক না কেন, দিনশেষে সকলের উপলব্ধি এক বিন্দুতে এসেই মিলিত হয় যে একজন ভালো স্যার তারা তাদের মাঝ থেকে হারিয়ে ফেলছে। অজান্তেই খারাপ লাগা কাজ করছিল সকলের চিত্তে৷ বদরাগী হলেও নির্বাণের পড়ানোর ধরণ ছিল অন্য সব টিচার হতে ভিন্ন। সাথে, নির্বাণের দেওয়া নোটসগুলোর কার্যকরতা ছিল বেশ। পরীক্ষার আগে তার নোটসগুলো পড়লেই সিলেবাস কভার করতে পারতো সকলে। কেউ স্বীকারোক্তি করতে না চাইলেও সত্য এইটাই, নির্বাণের যাওয়াটা সকলের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। এমনটা কেউই চায়নি।

তখন দ্বিপ্রহর। রোদের উত্তাপ মোলায়েম। সোনালী,কমলাটে রোদ্দুরের ছটা গড়িয়ে পড়েছে বড় বটমূলের উপর। বাতাসে পুষ্পের পরাগ ভাসন্ত।কৃষ্ণচূড়ার শেষপ্রান্তে এক চড়ুই পাখির দল কিচিরমিচিরে মশগুল। শহীদ স্তম্ভের সামনে নির্বাণকে ঘিরে গোল করে দাঁড়িয়েছে কয়েক’শ স্টুডেন্ট। অনুনয় সুর সকলের, অন্তিম বিদায় জানাচ্ছে তারা নির্বাণকে। অনেকে অনুরোধ করছে নির্বাণকে থেকে যাওয়ার জন্য, অনেকে আবার নিজের করা ভুলের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হচ্ছে৷ বেশির ভাগ সকলে ধরেই নিয়েছিল নির্বাণ বিগত দিনেগুলোয় ঘটে যাওয়া ঘটনায় তাদের ব্যবহার দেখে রুষ্ট হয়ে চলে যাচ্ছে। নির্বাণ যেহেতু তার এবং স্পর্শীর কাবিননামা সোশাল সাইটে দিয়ে দিয়েছিল সেহেতু কারো মনে আর কোন সন্দেহ অবশিষ্ট ছিল না। যার দরুন, সকলের মাঝে অনুশোচনাবোধটাই প্রখর ছিল। নির্বাণ সকলকে বুঝ দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলল। অতঃপর বিদায় নিয়ে ভীড় থেকে বেরিয়ে এসে দূরে নজর যেতেই আঁটকালো হালকা আকাশি রঙের কামিজ পরিহিত শ্যাম কন্যাটির পানে। মুখ মলিনতায় বেষ্টিত হলেও দৃঢ়৷ নয়ন দু’টি অক্ষিকাচে এক গাঁদা প্রশ্ন। নির্বাণ স্থিরচিত্তে এগিয়ে গেল নারীটির দিকে। নিভৃতে পকেট থেকে গাড়ির চাবিটা বের স্পর্শীর হাতে গুঁজে দিয়ে মৃদুস্বরে বলল, “গাড়িতে গিয়ে বসো, আমি আসছি।”

কথাটা বলে নির্বাণ অন্যদিকে চলে গেল আর স্পর্শী সেদিক তাকিয়ে থেকে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো। দীর্ঘ বিরতি নিয়ে আজই প্রথম ভার্সিটি এসেছিল সে। ভার্সিটি আসার পর পরই বন্ধু-বান্ধব এবং বিভিন্ন জনের কাছ থেকে নির্বাণের রিজাইনের খবরটি পেল সে। প্রথমে কারো কথায় বিশ্বাস করতে না চাইলেও শেষে এখানে এসে বিশ্বাস করতেই হলো নির্বাণ আসলেই রিজাইন করছে। এখন মনের মাঝে একটাই প্রশ্ন থেকে যায়, “কেন?”

__________________

স্পর্শী গাড়িতে এসে বসেছে পনেরো মিনিট হতে চলল। ঘড়ির কাঁটা টুকটুক করে সামনে দিকে পদার্পণ করেই চলেছে৷ স্পর্শী সিটে মাথা হেলিয়ে আঁখিপল্লব বন্ধ করে থাকলো। মনের মাঝে তখন তীব্র অভিমান, সাথে হাজারো প্রশ্ন। সব প্রশ্নর শেষেই ‘কেন’ শব্দটা সুবিন্যস্তভাবে এসে লেপ্টে যাচ্ছে। অশান্ত মস্তিষ্ক তালগোল পাকাচ্ছে সবকিছু, পরোক্ষভাবে দোষী দেখাচ্ছে তাকে। মিনিট যত গড়ালো স্পর্শীর ধৈর্য ধরে রাখা ততই দায়সমান হয়ে দাঁড়ালো। আর কিছু সময় যাওয়ার পর আবির্ভাব হলো নির্বাণের। সে গাড়িতে উঠে বসামাত্র স্পর্শী চোখ মেলে তাকালো৷ এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে সোজা নির্বাণের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে, “এর জন্যই আমাকে ভার্সিটি আসতে মানা করেছিলেন? যাতে আমি এসব সম্পর্কে কিছু জানতে না পারি?”

নির্বাণের নির্বিকার কন্ঠ, “কোনসব?”

“আপনি জব থেকে রিজাইন করেছেন, কিন্তু কেন? আর আমাকে জানান নি কেন?”

প্রশ্নের বিপরীতে নির্বাণ পাল্টা প্রশ্ন করে, “আগে জানালে কি করতে তুমি? রিজাইন নিতে দিতে না আমায়?”

স্পর্শী তীর্যক দৃষ্টিতে তাকায়, “কি করতাম জানি না তবে বিষয়টা কি আমার আগে জানার উচিৎ ছিল না?”

“হয়তো ছিল।”

নির্বাণের হেয়ালি দেখে স্পর্শী অপ্রসন্ন কন্ঠে বলে, “তাহলে কেন জানালেন না? টিচার হওয়া না আপনার ড্রিম জব ছিল? কেন ছাড়লেন সেটা?”

“কারণ আমি সিউর ছিলাম তোমাকে জানালে তুমি কখনো আমায় রিজাইন করতে দিতে না। তাই জানায়নি। আর রইলো জবের কথা, সেটা করতে এখন আমার মন টানে না। আমি আরও আগে থেকেই জবটা ছাড়ার কথা ভাবছিলাম।”

স্পর্শী তৎক্ষনাৎ কোন প্রশ্ন না করলেও কিয়ৎক্ষণ পর বলে উঠে, “আপনার রিজাইনের পিছনের কারণ কি আমি? সত্যি করে বলবেন প্লিজ।”

নির্বাণ হঠাৎ রেগে গেল। পরুষ কন্ঠে বলে, “একটু বেশি বুঝো তুমি। আমি একবারও বলেছি কারণ তুমি? সবকিছুতে নিজেকে টেনে আনবে না। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আমার নিজের কিছু কারণ ছিল। ভিন্ন পরিকল্পনা আছে আমার। আজ নাহলেও কাল আমি রিজাইন করতাম।”

স্পর্শী মাথা নুয়ে নিল। ভয়ার্ত মনে সাহস জুগিয়ে বলে, “হয়তো আপনার ভিন্ন কারণ ছিল কিন্তু আমাকে কি একবার বলা যেত না? অন্যের কাছ থেকে কেন জানতে হলো আমায়? সামান্যটুকু ভরসা কি নেই আপনার আমার প্রতি?”

নির্বাণ স্পর্শীর হাতটা নিজের মুঠোয় নিল। কন্ঠস্বর নেমে এলো কয়েকগুণ, “তোমাকে কোন প্রকার টেনশন দিতে চাচ্ছিলাম না। চেয়েছিলাম সব কাজ নীরবে শেষ করে নিতে কিন্তু শেষে কিভাবে কথা পাঁচকান হলো জানা নেই আমার। তোমাকে কষ্ট দেওয়ার কোন ইচ্ছে আমার ছিল না।”

স্পর্শী প্রত্যুত্তর করলো না। অভিমান কি আর এত সহজে ভাঙ্গে? নির্বাণ নিজের সর্বস্ব দিয়ে স্পর্শীকে বুঝানোর চেষ্টা করলো। দীর্ঘ সময় ব্যয় করার পর স্পর্শীর মন একটু গললো। সে নরম চোখে তাকালো নির্বাণের পানে। নির্বাণ তা দেখে বলে, “এভাবে তাকাচ্ছো কেন? বেকার বলে কি এখন আমায় ত্যাজ্য বর করার পরিকল্পনা করছ নাকি?”

নির্বাণের কটাক্ষ ধরতে পেরে স্পর্শী কপট রাগ দেখিয়ে বলে, “করলেও কি? লাভ তো আপনারই, বিয়ের দাওয়াত পাবেন একটা। তাও নিজের বউয়ের। এমন ভাগ্য কি আর সবার হয়?”

নির্বাণ প্রখর দৃষ্টিতে তাকালো। পরমুহূর্তেই স্পর্শীর হাত ধরে টান মেরে নিজের সান্নিধ্যে নিয়ে এসে বলে, “এমন ভাগ্যের দরকার নেই আমার। শতবার হলেও বিয়ে তুমি আমাকেই করবে। আমি ব্যতীত অন্য কোন অপশন তোমার লাইফে নেই। মনে থাকে যেন।”

কথাটা বলেই নির্বাণ স্পর্শীকে ছেড়ে দিল। অতঃপর নিজের সিটবেল লাগিয়ে স্পর্শীর কোল থেকে চাবিটা নিয়ে গাড়ি চালাতে শুরু করে গমগম কন্ঠে বলল, “নিজের সিটবেল লাগাও স্পর্শী।”

স্পর্শী হতবিহ্বল নয়নে তাকিয়ে থাকে। এই প্রথম নির্বাণ তার সিটবেল নিজ থেকে না লাগিয়ে দিয়ে মুখে বলছে। মানে এত রাগ? তাও এই সামান্য কথাতে? স্পর্শী কিছুক্ষণ নীরব থেকে নিজের সিটবেল লাগালো। তীব্র অভিমান মনে নিয়ে আনমনে আওড়ালো, “রাগ করার কথা কার, আর রাগ করছে কে? ভালোই!”
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৪১

‘সময়’- তিন বর্ণের সম্মিলনে গঠিত ক্ষুদ্র শব্দটি প্রচন্ড নিষ্ঠুর বোধহয়৷ কারো চাতক পাখির ন্যায় মন যে অপেক্ষার প্রহর গুণতে মগ্ন, ক্লান্ত সে-টা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নিজের গতিবেগে ছুটেই চলেছে। ধীরে নয়, দ্রুত। মায়া-দয়া না দেখিয়ে, অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘতম করে পাষাণ হওয়ার পরিচয় দিচ্ছে যেন। দহনক্রিয়া বাড়লো, অশান্ত হলো মন। আজ প্রায় দুই সপ্তাহ হতে চলল নির্বাণের সাথে স্পর্শীর কোনরকমের কথাবার্তা নেই, দেখা-সাক্ষাৎ নেই। মানুষটা আদৌ ভালো আছে নাকি খারাপ সে খবরটুকু পর্যন্ত নেই স্পর্শীর নিকট। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পুরোপুরিভাবে। স্পর্শী না-হয় অভিমানে খোঁজ নেয়নি, তাই বলে কি নির্বাণও নিবে না? এটা কোন কথা? মানুষটা কি মনে করে তার একাই রাগ আছে, স্পর্শীর নেই? কি বাই বলেছিল এমন সেদিন যে এত রাগ দেখাতে হবে তার সাথে? তার কথার প্রেক্ষিতেই তো সে কথাটা বলেছিল সে। প্রত্যক্ষভাবে তার দোষ কোথায় এখানে? আনমনে কথাগুলো আওড়ে স্পর্শী ক্ষান্ত হলো। পাহাড়সম অভিমান নিজের স্থান দখল করে নিল ছোট মনের এককোণে। ডুবন্ত সাঁঝের হরিদ্রাভ-রক্তিমা আকাশের গহীনে নিষ্প্রভ নয়নে তাকালো সে। ঈষৎ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর স্পর্শীর হাতের মুঠোয় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা ফোনটার কেঁপে উঠামাত্র চোখের তারা চিকচিক করে উঠল। কিঞ্চিৎ আশা নিয়ে ঝটপট তাকালো সেদিক৷ আদৌ কোন মেসেজ বা কল এসেছে কি-না কাঙ্ক্ষিত মানুষটির হতে দেখতে। কিন্তু স্ক্রিনে ‘গ্রামীণ সেরা অফার’ মেসেজটি দেখে মেজাজ চটে গেল তার। আজব তো! এই কোম্পানি ওয়ালাদের কি খেয়ে দেয়ে কাজ নেই নাকি? দিনে কত মেসেজ পাঠায় তারা? বিরক্তিকর! এদিকে যার মেসেজ দেওয়া কথা তার যেন ব্যস্ততার অন্ত নেই। আচ্ছা,মানুষটার কি একটুও মনে পড়ে না তার কথা? দহন হয় না বক্ষঃস্থলে? তার তো হয়। প্রচুর হয়। তাই তো সেদিন থাকতে না পেরে অভিমান ভুলে ফোন করেছিল নির্বাণকে। একবার নয়, কয়েকবার। কিন্তু ফোন তার কখনো বন্ধ ছিল, কখনো বা আনরিচেবল। তখন থেকেই অভিমানের ঘনত্ব দ্বিগুণ হয়। চেষ্টা করে না আর যোগাযোগ করার। কথাটা ভেবে হতাশাজনক নিঃশ্বাস ফেললো সে। শূন্য অনুভব হলো অন্তঃকরণে। মনের মাঝে সে যতই রাগ পুষে রাখুক না কেন সত্য এটাই নির্বাণ তার অভ্যাসে,বদভ্যাসে নয় বরং প্রিয় এক অসুখে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছে, যা কখনো নিরাময় হওয়ার নয়। তার প্রতি নির্বাণের যত্নশীলতা-দায়িত্বশীলতা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কথার পৃষ্ঠে লুকিয়ে থাকা আবেগ-অনুভূতি এতটা প্রখর যে মানুষটাযে ভুলে থাকা অসম্ভব। নির্বাণ বিহীন যেন তার জীবন নির্জীব,নিষ্প্রাণ। ভালো লাগার ছিটে ফোঁটা নেই তাতে। আছে শুধু বিষণ্ণতা৷
মধুর এক ধ্বনি গুঞ্জিত হলো চারদিক, গোধুলির আকাশ আঁধার আকাশের গহীনে ঢাকা পড়ল। স্পর্শী বারান্দা থেকে রুমে এসে অবসন্ন পায়ে এগিয়ে গেল বিছানার দিকে, মুঠোফোনটা বিছানায় ফেলে ওযু করে সালাত আদায় করে নিল। শেষে মোনাজাতে নির্বাণের নামটা রাখতে ভুলল না। রাগ-অভিমান দীর্ঘ হোক তবুও সুস্থ থাকুক মানুষটা। সালাত শেষে স্পর্শী পার্শিয়াকে নিয়ে বিছানায় উঠে বসলো, মন ভুলাতে ল্যাপটপে একটা মুভি ছেড়ে দিল। কিয়দংশ সময় এভাবেই কেটে যাওয়ার পর কলিংবেলের আওয়াজ তার কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হলো। তবে স্পর্শী সেদিক খেয়াল দিল না এতটা, সম্পূর্ণ মনোযোগ তখন নিবদ্ধ তার ল্যাপটপের স্ক্রিনে চলতে থাকা ‘স্পাইডার ম্যান’ মুভিটার দিকে। সবচেয়ে ইন্টেরেস্টিং পার্টটাই চলছে এখন, নেত্রপল্লব ফেলাও দায়। অকস্মাৎ কাঙ্ক্ষিত মানুষটির কন্ঠস্বর এসে তরঙ্গিত হলো কর্ণগোচরে। ভড়কে উঠলো সে। সচকিত দৃষ্টি তাকালো আশেপাশে, মনের ভুল ভাবলো একবার। কিন্তু পুনরায় বাহির হতে মানুষটার শব্দধ্বনি শুনতে পেয়ে প্রায় তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে দাঁড়ালো সে৷ দরজার কাছে এসে সামান্য ফাঁক করতেই ড্রয়িংরুমে বসে থাকা শ্যাম পুরুষটির উপর দৃষ্টি পড়লো। ঠিক তখনই মরুভূমি মনে এক পশলা বৃষ্টি নামলো, তৃষ্ণার্ত চাহনি প্রসন্নচিত্তে জ্বলজ্বল করে উঠলো। কতদিন পর মানুষটি একটু দেখা। যেন শতযুগ। স্পর্শীর দরজার আড়াল থেকেই একমনে, একদৃষ্টিতে দেখতে থাকলো৷ নির্বাণ তখন সাহেলা আর মিজানের সাথে কথায় মশগুল। মাঝে মধ্যে কারো খোঁজে আশপাশ তাকাচ্ছে। স্পর্শী আনমনে হাসলো। পরক্ষণেই নির্বাণের কর্মকাণ্ডের কথা মনে পড়তে অভিমানের দল মাথা চাড়া দিল। সে দরজা ভিড়িয়ে চুপচাপ ল্যাপটপের সামনে বসল। মনোযোগ বাহিরে থাকা সত্ত্বেও জোড়পূর্বক মুভি দেখতে থাকলো।
একটু পর দরজা খোলার শব্দে সেদিক চোখ তুলে তাকালো স্পর্শী। নির্বাণকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নিল সে। হঠাৎ নির্বাণ বলে উঠে, “পার্শিয়া, রুম থেকে যাও তো।”

স্পর্শী বিরোধিতা করে বলে, “পার্শিয়া তুই কোথাও যাবি না। এখানে চুপচাপ বসে থাক।”

নির্বাণ সরু চোখে তাকালো, শান্ত কন্ঠে বলে, “পার্শিয়া থাকলে কিন্তু তোমায় লজ্জায় পড়তে হবে। পরে আমাকে কিছু বল না।”

স্পর্শীর কথার যথার্থ অর্থ ধরতে পেরে রোষানল দৃষ্টিতে তাকালো নির্বাণের পানে। এদিকে পার্শিয়া কি বুঝলো কে জানে, সে মৃদুস্বরে ডেকে উঠে খাট থেকে নেমে নীরবে নির্বাণের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। নির্বাণ সেটা দেখে মৃদু হাসলো। ধীরে দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে স্পর্শীর সান্নিধ্যে এসে বসলো। এক ঝলক ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে বলে, “সাথে চিপস,পপকর্ণ, কোক নিয়ে বসো নি?”

স্পর্শী আড়চোখে একবার তাকালো নির্বাণের দিকে, অতঃপর মনোযোগ দিল মুভিতে। ভাব এমন, মুভি না দেখলে সে এখনই মারা যাবে। নির্বাণ স্পর্শীর কানের কাছে উন্মুক্ত চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বলে, “এখনো রাগ করে আছো?”

স্পর্শী উত্তরের বদলে ভিন্ন এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল নির্বাণের দিকে, “কেন এসেছেন আপনি? কাজ কি এখানে আপনার?”

“কেন কাজ ছাড়া আসা কি নিষেধ? নাকি জরিমানা আছে?”

স্পর্শী প্রত্যুত্তর করলো না। এমনকি ঘুরে তাকালাও না নির্বাণের দিকে। নির্বাণ আচ্ছন্ন স্বরে বলল, “বেশি রাগ স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না।”

স্পর্শী ব্যঙ্গার্থ করে বলে, “হাহ! লুক হু ইজ টকিং।”

নির্বাণ স্মিত হাসলো, “পঞ্চগড় ছিলাম এতদিন, নেটওয়ার্কের বাহিরে। যার জন্যে ফোন দেওয়া সম্ভব হয়নি কোনভাবে, জানাতেও পারিনি তোমায় কিছু। তোমাকে সেদিন বাসায় নামিয়ে পরেরদিন ভোরেই রওনা দিয়েছিলাম। আর্জেন্ট নোটিশে যেতে হয়েছিল সেখানে, তাড়াহুড়োই ছিলাম তাই জানিয়ে যেতে পারিনি তোমাকে৷ ভেবেছিলাম সেখানে গিয়ে জানাব কিন্তু পরে নেটওয়ার্ক মিলে নি তাই বলাও হয়নি। আজ সকালেই এসেছি আর এখন এখানে। ”

স্পর্শী বলল, “হুম ভালো। আমি কে বাই হই আপনার যে জানাবেন আমায়? আদৌ কি কিছু হই?”

নির্বাণ স্পর্শীর দুই গালে হাত গলিয়ে নিজের দিকে মুখ ঘুরালো। মন্থর কন্ঠে বলে, “কিছু না, আমার সবকিছু হও তুমি। বুঝেছ? পরেরবার এভাবে বলবে না।”

স্পর্শী এক রোখা কন্ঠে বলল, “কেন বলব না? একশোবার বলব। কিছু হই না আমি আপ…”

কথাটা শেষে হওয়ার পূর্বেই নির্বাণ সন্তপর্ণে নিজের অধর স্থাপন করলো স্পর্শীর অধরযুগলে। সুহৃত্তম ব্যক্তিটির সান্নিধ্য পাওয়ামাত্র বরফের ন্যায় গলে পড়ল সকল অভিমান। সর্বগ্রাসা হলো অনড় নারীর মন। কিয়ৎক্ষণ পর নির্বাণ সরে এসে বলো, “এখন বল কি বলছিলে।”

স্পর্শীর অভিব্যক্তি রক্তিমার চাদরে বেষ্টিত হলো। লাজুকলতা দেখা দিল নয়নের আনাচেকানাচে৷ নজর তোলা গেল না আর। নির্বাণ নিচু হয়ে স্পর্শীর গালে অধর ছুঁয়ে দিয়ে বলে, “সরি বউ! আর রাগ করে থাকে না।”

এমন আবেগ মাখা ডাক শোনার পর কার সাধ্য আছে মানুষটার সাথে রুষ্ট হয়ে থাকার? তার তো নেই। একবারেই নেই। স্পর্শী নিজের রাগ ভুলিয়ে নির্বাণের কাঁধের দিকে একাংশ শার্ট মুঠো করে ধরে বুকের বা দিকে মাথা হেলিয়ে দিয়ে আদুরে কন্ঠে বলে, “আপনি অনেক বাজে। অনেক! এমন কেউ করে? আমি ভেবেছি আপনি আমার সাথে রাগ করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। জানেন, কত কষ্ট হয়েছিল আমার তখন?”

“আর এমন হবে না। প্রমিস!”

“হু!”

“একটা কথা জানো কি তোমার সাথে রাগ করার গুণটি আল্লাহ আমাকে দেয়নি। একটুও দেয়নি।”

“একদম ভালো করেছে।”

স্পর্শীর বাচ্চাসুলভ আচরণ দেখে নির্বাণ হাসলো। শান্ত কন্ঠে বলে, “তিন পর আমরা কক্সবাজার যাচ্ছি। রেডি থেকো, ওকে?”

“হঠাৎ কেন?”

স্পর্শী জিজ্ঞেস করলো। নির্বাণ উত্তরে বলল, “দুইজনের মুড রিফ্রেশমেন্টের দরকার তাই৷ অল্প সময়ের ব্যবধানে কম তো আর হলো না।”

স্পর্শী কিছুক্ষণ চুপ থেকে নির্বাণের কাছ থেকে সরে এসে বলে, “আমি যাব না।”

“কেন?”

স্পর্শী মুখ ঘুরিয়ে বলে, “এভাবেই! যাওয়ার ইচ্ছে নেই আমার। ক্যান্সেল করে দিন টিকেটগুলো।”

নির্বাণ ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকায়, “আমি বাসায় পারমিশন নিয়ে নিয়েছি অলরেডি। এখন মানা করে লাভ নেই, আমরা যাচ্ছি এটাই ফাইনাল।”

স্পর্শী রেগে গিয়ে বলে, “আমি যাব না, আপনি গেলে একা যান।”

নির্বাণ উঠে দাঁড়ালো, “আচ্ছা, দেখা যাবে।”

কথাটা বলে নির্বাণ বেরিয়ে গেল। আর স্পর্শী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার যাওয়ার দিকে তাকালো৷ মনে মনে অসন্তুষ্ট হলো প্রচুর। মানুষটা চাকরি গিয়েছে সবে, আর এখনই এত খরচ করা কি ঠিক?
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৪২

অন্তরিক্ষ তখন স্তব্ধ,শান্ত। অজস্র তারার ভিড়ে চন্দ্রপ্রভা। কনকনে বাতাস, পাতা নড়ছে মৃদু মৃদু। রাস্তার ধারে বেওয়ারিশ কুকুরটি ডেকে চলেছে বহুক্ষণ হলো। এখনো শব্দ আসছে বাহির থেকে। তবে তাতে মনোযোগ ভঙ্গ হলো না নির্বাণের। সে আপন মনে ল্যাপটপে কাজ করেছে, দ্রুতগামী হাত দু’টি কি-বোর্ডের পাতায় চলতে ব্যস্ত ভঙ্গিতে। ঠিক তখনই নাহিদ এলো নির্বাণের রুমে৷ না বলে, না কয়ে ধপ করে বসে পড়লো নির্বাণের পাশে। বত্রিশটা দাঁত প্রদর্শিত করে বিস্তৃত হাসে সে, “কি করোস?”

নির্বাণ এক ঝলক তাকায়। গম্ভীরমুখে বলে, “চোখে কম দেখা শুরু করেছিস নাকি? কাজ করছি চোখে পড়ছে না?”

নাহিদ মুখ অন্ধকার করে প্রতিবাদীর কন্ঠে বলে, “তো সেটা কি সুন্দর করে বলা যায় না? ভাবীর বেলায় কত মিষ্টি করে কথা বলোস, আমার বেলায় মুখে বিষ আসে কেন? নারী-পুরুষের মাঝে বৈষম্য এবং সহিংসতা সৃষ্টি করছিস তুই। এটা কিন্তু ঠিক না।”

নির্বাণ বিরক্তি নিয়ে বলে, “এই তুই আসছিস কেন? হোস্টেলে যতদিন থাকোস ততদিন শান্তিতে যায় আমার, বাসায় আসলেই ক্যাঁচাল করোস।”

“কই তোর ভাই ঘামের পানি, নাকের পানি এক করে খেটেখুটে বাসায় ফিরেছে দুইমাস পর। আদরযত্ন করবি,ভালো-মন্দ খাওয়াবি তা না কথা শুনাচ্ছিস আমায়? কেমন ভাই তুই?”

“তুই যে কি কি করে বেরাস তা আমাকে শুনাতে আসিস না। কোন কিছু আমার অজানা না।”

নাহিদ ঘাবড়ায়, “মানে? কি জানিস তুই?”

“তোর হোস্টেল থেকে ফোন এসেছিল এটা জানাতে যে, তুই আসিফ নামের একটি ছেলের সাথে মারামারি করে পালাতক হয়েছিস।”

নাহিদ অস্ফুটস্বরে বলে, “ভাই, মাকে বলিস না কিছু প্লিজ। এবার মা জানলে, মেরেই ফেলবে আমায়।”

“দেখি!”

“দেখি মানে কি? তুই বলবি না মাকে।”

নির্বাণ চোখ ছোট ছোট করে বলে, “তুই ভালো করেই জানিস মা মারপিট পছন্দ করে না, তাও তুই এসবে যাস কেন? মেরেছিস কেন ওকে?”

“ওই শা*, আমার ফ্রেন্ড স্নেহাকে অনেকদিন ধরে উত্ত্যক্ত করছিল। রাস্তা-ঘাটে,বাসার নিচে সব জায়গায়। এমনকি সেদিন নাকি বাজারের রাস্তায় ওর হাত ধরে অসভ্যতামি করেছিল৷ সাথে আরও কাহিনী করে, যা ছিল বাড়াবাড়ি রকমের। স্নেহা তখন কোনমতে নিজের জান বাঁচিয়ে ফিরে আসে। আর পরে আমাদের কথাটা জানায়, খোঁজ নিয়ে জানতে পারি আসিফ আমার হোস্টেলেই থাকে। তো ওকে শিক্ষা দিতে আরকি আমরা বন্ধুরা মিলে একটু….”

শেষ কথা আমতা আমতা করে বলে নাহিদ মাথা চুলকায়। নির্বাণ বলে, “গাধার বাচ্চা, এভাবে কাজ করিস কেন যে ধরা পড়ে যাস? বাঁশ দিবি ঠান্ডা মাথায়, এভাবে সাপ মরবে ঠিকই কিন্তু সেই খবর তোর বা হাত পর্যন্ত জানবে না।”

নাহিদ চোখ বড় বড় করে বলে, “এম আই ড্রিমিং ওর হোয়াট? তুই আমাকে প্রশ্রয় দিচ্ছিস? তুই আদৌ আমার ভাই তো?”

“নিয়ত তোর যতদিন ভালো আছে ততদিন আমার সাপোর্ট পাবি তুই। এখন সেটা যে বিষয় নিয়ে হোক না কেন। কিন্তু যেই অসৎ পথে যাবি পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিতেও দ্বিধা হবে না আমার। মনে রাখিস, সবার খোঁজ-খবর কিন্তু কাছে আসে। তাই যা করবি ভেবেচিন্তে।”

নাহিদ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “আচ্ছা, তবে এবার হ্যাল্প কর। মা যাতে কিছু জানতে না পারে, তুই সব মিটমাট করে দে।”

নির্বাণ পুনরায় কাজে মন দিয়ে বলে, “হয়ে যাবে। তবে মনে রাখবি যদি কেউ আসলেই দোষী হয় তাহলে তাকে শাস্তি দিতে সবসময় নিজের হাত ময়লা করতে হয় না। দূরে থেকে কারো অবস্থা করুণ কেন, মরণান্তিকও করা যায়।”

নাহিদ খুশি হয়ে নির্বাণকে জড়িয়ে ধরে ওর গালে চুমু খায়, “ইউ আর দ্যা বেস্ট ব্রাদার ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড।”

নির্বাণ মুহূর্তে নাহিদকে দূরে ঠেলে দিয়ে ছিঁটকে সরে আসে। হাত দিয়ে নিজের গাল ঘেঁষে বলে, “ইয়াক ছিহ! এসব শিখেছিস কোথা থেকে? হোস্টেলে কি এসব করে বেরাস নাকি?”

নাহিদ ভ্রু উঁচু করে তাকায়, “তোর কি আমাকে হাফ-লেডিস মনে হয়?”

নির্বাণ নিজের গাল ঘেঁষতে ঘেঁষতে বলে, “না মনে হওয়ার কারণ দেখছি না।”

“এই ভাবিস তুই আমাকে? ছিহ! আমি মেয়ে মানুষের মধ্যে ইন্টেরেস্টেড, ছেলেদের মধ্যে না।”

নির্বাণ বলল না কিছু। নাহিদ এগিয়ে এসে নির্বাণের পাশ ঘেঁষে বসেমাত্র নির্বাণ চেঁচিয়ে উঠে, “দূরে থেকে কথা বল। কাছে আসার কোন প্রয়োজন নেই।”

নাহিদ ভ্রু কুঁচকে বলে, “ভাবীর বেলায় তো দূর দূর করোস না, উল্টা তখন যেন তোর মনে ক্লোজাপ কাছের আসার গল্পের লিরিক্স চলে। আর আমি কাছে আসলেই যত দোষ হয়।”

নির্বাণ দাঁতে দাঁত চাপে, “বেশি কথা বলিস তুই। গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার থাকলে বল নাইলে ভাগ এখান থেকে।”

নাহিদ ক্যাবলাকান্তের মত প্রশস্ত হাসি হাসে। বলে,”তোর ল্যাপটপ দিবি একটু?”

“কোন খুশিতে?”

“প্রজেক্টের একটু কাজ আছে। আমারটা হোস্টেলে ফেলে আসছি, তোরটা দে না।”

নির্বাণ তপ্তশ্বাস ফেলে নিজের ফাইলগুলো আলাদা ফোল্ডারে সরিয়ে ফেললো৷ অতঃপর সাটার অফ করে ল্যাপটপটা নাহিদের নিকট দিয়ে বলে, “আধাঘন্টার মাঝে ফেরত দিয়ে যাবি।”

নাহিদ খুশি হয়ে বলে, “আচ্ছা। আয় এই খুশিতে আরেকটা চুমু দেই তোকে।”

নির্বাণ চেঁচিয়ে উঠতেই নাহিদ দ্রুত বিছানা থেকে নেমে রুম থেকে দৌড়ে পালায়। আপাতত তার যা দরকার ছিল তা সে পেয়ে গিয়েছে। নির্বাণ অপ্রসন্নতার সাথে সেদিক একবার তাকায়। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা পুনরায় মাথা চাড়া দিতেই গা ঘিন ঘিন করে উঠে তার। বিছানা ছেড়ে দ্রুত এগিয়ে যায় ওয়াশরুমের দিকে, একবার জায়গায়টা না ধুঁয়ে তার শান্তি হবে না। ভাগ্যিস, স্পর্শীর বেলায় তার খুঁতখুঁতে ভাবটা কম নাহলে দিনে কতবার যে তাকে ওয়াশরুমে দৌড়াতে হতো কে জানে।

_____________________

মাঝে দুই দিন কাটে। সায়াহ্নের প্রহর শেষে তিমিরাচ্ছন্ন আকাশের দেখা মিলে। চাঁদ মুখ লুকায় মেঘের আঁচলে, ধ্রুবতারার রাজত্ব তখন। বাতাসের অস্তিত্ব এই আছে তো এই নেই। অর্ধ-নিদ্রামগ্রতায় ডুবন্ত নগরীর কোথাও বাতি জ্বলে, কোথাও জ্বলে না। হরিদ্রাভ আলোয় রাঙ্গা রাস্তায় গাড়ি চলছে বিরতিহীন, শা শা শব্দ করে। ঘড়ির কাঁটা লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। দশের ঘর পেরিয়েছে কিছুক্ষণ পূর্বেই। গাবতলীর মাজার রোডে শ্যামলী বাসস্ট্যান্ডের সামনে উবার আসে থামে। উবার থেকে নেমে পড়ার পরমুহূর্তেই নির্বাণ স্পর্শীকে নিয়ে বাসে উঠে পড়ে। পিছে পিছে উঠে নাহিদ,স্পৃহাও। গন্তব্য তাদের কক্সবাজার। যদিও প্ল্যান হয়েছিল নির্বাণ আর স্পর্শী একাই যাবে কিন্তু শেষ মুহূর্তে নাহিদও যাবে জানায় আর নির্বাণের সাথে টিকেট কেটে ফেলে। তবে সে ভুলবশত দুইটা টিকেট কেটে ফেলে। টিকেটের টাকা রিফান্ড হবে না বলে নির্বাণ স্পৃহাকে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবে। বলা বাহুল্য, স্পৃহার কথা নাহিদই খুব সুক্ষ্ণভাবে নির্বাণের মাথায় ডুকিয়েছিল। পরবর্তীতে নির্বাণ নিজ হতেই মিজানের সাথে কথা বলে স্পৃহাকে সাথে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি নিয়ে নেয়। স্পৃহার যেহেতু এডমিশন টেস্ট শেষ হয়ে গিয়েছিল সেহেতু সেও আর নাকচ করেনি যাওয়ার জন্য।

নিজ সিট খুঁজে পেতেই স্পর্শী জানালার ধারে গিয়ে বসে। বদ্ধ জানালার ভিতর দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকে সে। তার আসার একদম ছিল না কিন্তু বাবার উপর কথা বলতে না পারায় অগত্যা আসতে হলো তাকে। কিন্তু সে তখনও রুষ্ট নির্বাণের সাথে। খামাখা এত টাকা খরচ কেন করতে গেল সে? পড়ে করলে কি হতো না? নির্বাণ ব্যাগপত্র উপরে তুলে রেখে স্পর্শীর পাশে এসে বসতেই আপন ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো স্পর্শী৷ সে ঘাড় ঘুরে একবার তাকালো অতঃপর মাথা উঁচু করে স্পৃহার অবস্থান একবার পর্যবেক্ষণ করে নিল। তাদের থেকে বেশ কয়েক সিট পড়ে স্পৃহা বসেছে বলে তেমন দেখা যাচ্ছে না তাকে। নির্বাণ বিষয়টা বুঝে বলে, “স্পৃহা, নাহিদ একসাথেই বসেছে চিন্তা নেই। নাহিদকে বলেছি স্পৃহার খেয়াল রাখতে।”

স্পর্শী শান্ত চোখে তাকায়, মৌনাবলম্বন করে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় ব্যবধানে। নীরবতাই যেন প্রকাশ করে দিচ্ছে স্পর্শীর অভিমানের পাল্লা ভারী কতটুকু। নির্বাণও কথা বাড়ায় না, অপেক্ষা করে গাড়ি ছাড়ার।

________________

হাইওয়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে গাড়ি চলছে নিজ গন্তব্যে। পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে রাশি রাশি কৃষ্ণমেঘ। বাসের ভিতরে আলো জ্বলছে টিমটিম করে। শান্ত,কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ। অনেকে ঘুমিয়ে পড়ছে, অনেকে তখনও জাগ্রত। নাহিদ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে স্পৃহার দিকে তাকায়। স্পৃহা আঁখিপল্লব এক করে কানে ইয়ারফোন গুঁজে শুয়ে আছে। অভিব্যক্তি শূণ্য প্রায়। নাহিদ ঠোঁট কামড়ালো। আনমনে কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে, “মেয়েটাকে কি আমি গান শোনার নিজের পাশে বসিয়েছি নাকি? কই ভাবলাম একটু কথা হবে, হাসি-মজা হবে, সুযোগ হবে তা না ম্যাডাম কানে ইয়ারফোন গুঁজে আপন দুনিয়ায় মগ্ন। বলি কি আমার কোন দাম নেই তার কাছে? এত অবজ্ঞা কেন আমার প্রতি তার? একটু আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দুটো কথা বললে কি হয়?”

মনে মনে তীব্র আক্ষেপ প্রকাশ করে নাহিদ হাত ডান দিকে উঠায় আড়মোড়া ভাঙ্গার জন্য। ঘটনা এক ঘটে তখনই। নাহিদের হাতের ডগায় ইয়ারফোনের বাড়তি অংশ আষ্টেপৃষ্টে পেঁচিয়ে যায়। সে দ্রুত হাত সরিয়ে নিয়ে আসতে নিলে খুব জোড়ে টান খায় আর স্পৃহার কান থেকে ইয়ারফোনটি ছিঁটকে সামনের সিটে বারি খায়। স্পৃহা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। চশমার মধ্য দিয়েই চোখ বড় বড় করে তাকায় নাহিদের পানে। ঘটনাক্রমে নাহিদ তখন হতবুদ্ধি, হতবিহ্বল এবং অস্ফুট কন্ঠস্বর, “আ’ম সরি! আমি এটা ইচ্ছে করে করিনি, হুট করে হয়ে গেল এমন।”

স্পৃহার চোখ ছোট হলো, “আচ্ছা সমস্যা নেই।”

কথাটা বলে কোলে নিষ্প্রাণ অবস্থায় পড়ে থাকা ইয়ারফোন কুড়িয়ে পুনরায় কানে গুঁজে নেয়। কিন্তু এবার আর তার ভিতর থেকে কোন ধ্বনি তরঙ্গিত হয় না। বন্ধ হয়ে থাকে। ভ্রু কুটি কুঞ্চিত হয়, নেত্রপল্লব খুলে ইয়ারফোনের দিকে তাকায় সে৷ মোবাইল ঘেটে কতক্ষণ ইয়ারফোনে বারি দেয় চালু হওয়ার আশায়। কিন্তু অবস্থায় পরিবর্তন আসে না। নাহিদ স্পৃহার কর্মকান্ড দেখে জিজ্ঞেস করে, “কোন সমস্যা?”

“ইয়ারফোন চলছে না, নষ্ট হয়ে গিয়েছে বোধহয়।”

কথাটা শুনে নাহিদের মন হৃষ্টচিত্তে নেচে উঠে। কাজটা অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও লাভ তারই হয়েছে। নাহিদ মনে মনে বলে, “একদম ঠিক হয়েছে। এতক্ষণ থার্ড পার্সন হয়ে ছিল শা*, ইন্তেকাল করে পুণ্যের কাজই করেছে।”

তবে মুখে দুঃখী ভাব এনে নাহিদ বলে অন্য কথা, “অহ আচ্ছা, সরি! আমার জন্য হলো এটা।”

স্পৃহা বলে, “প্যারা নেই। তা আপনার কাছে ইয়ারফোন হবে? আমার আবার যাত্রার সময় গান না হলে চলে না।”

নাহিদ তার পরিহিত জ্যাকেটের ডান পকেটে হাত দেয়, এক জোড়া ব্লুটুথ ইয়ারপোডস পড়ে আছে ভিতরে। তবে সে মাথা ডানে-বামে নাড়িয়ে অস্বীকৃতি জানায়, “না নেই। তাড়াহুড়ায় আনতে ভুলে গিয়েছি।”

স্পৃহার মুখ ছোট হয়ে এলো। নাহিদ তা দেখে কথা অন্যদিকে নেওয়ার চেষ্টা করে, সাথে স্পৃহাকে কম্ফোর্ট ফিল করানোর। নাহিদ মজার মানুষ হওয়ায় এক দুই কথায় আড্ডা জমাতেও সক্ষম হয় সে। জড়তা কাটে স্পৃহার, রাজ্যের কথা জুড়ে যায় দুইজনের মাঝে। বাকি যাত্রা স্পৃহার কেমন গেল জানা নেই তবে নাহিদের বেশ ভালোই কাটলো।

_________________

“তোমার রাগ করার কারণটা কোথায়? আসতে চাওনি কেন?”

নির্বাণের প্রশ্ন শুনে স্পর্শী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। বলে, “সেটা বলে লাভ কি এখন? হচ্ছে তো সব আপনার কথা অনুযায়ী, আমার কথা দাম আছে নাকি কোন?”

“তুমি বলেছ আমায় কিছু? না বললে বুঝব কিভাবে? অন্য কোথাও যেতে চেয়েছিলে?”

স্পর্শী রাগান্বিত কন্ঠে বলে, “না!”

নির্বাণ প্রশ্নবোধক চাহনি নিক্ষেপ করে বলে, “তাহলে? সমস্যা কোথায়?”

স্পর্শী কথা পেটে দমিয়ে রাখতে না পেরে বলে, “আপনি খামাখা এত খরচ এখন কেন করতে গেলেন বলুন তো? পরে গেলে হতো না?”

নির্বাণ ভ্রু কুঞ্চিত করে, “হঠাৎ এই কথা উঠল কেন? কেউ কি কিছু বলেছে তোমায়?”

“কে কি বলবে? আমি নিজ থেকে বলছি। মাত্র জব ছেড়েছেন আপনি আর এখনই…”

বাকিটুকু আর না বলে চুপ করে যায়। বাক্য শেষ করতে জড়তা কাজ করে মনে। নির্বাণ স্পর্শীর কথার অর্থ বুঝতে পেরে রসিকতার সুরে বলে, “আদর্শ স্ত্রী হওয়ার ট্রেনিং নিচ্ছ নাকি? এখন থেকেই জামাইয়ের খরচের হিসাব রাখছো? নট বেড! আমার কাছে আসার এত তাড়া তোমার? আগে জানতাম না তো।”

স্পর্শী ফুঁসে ওঠে বলে, “মজা নিচ্ছেন? বেশ! সংসারই করবো না আপনার সাথে আর, যান গিয়ে নতুন বউ খুঁজে নিন। সাক্ষী আমি হবো নে।”

নির্বাণ স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করে, “আমি অন্যের হলে তুমি সহ্য করতে পারবে সে-টা? যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে এখনই বাসের মধ্যে কাউকে তুলে নিয়ে ঝটপট রেজিস্ট্রার করে ফেলব আর হানিমুনটা একবারে কক্সবাজারেই সেরে আসব। কি বল?”

স্পর্শী এবার কাবু হয়। আঘাতপ্রাপ্ত বক্ষঃস্থলে,চিত্তে দগ্ধের কালসিটে দাগ পড়ে। কণ্ঠনালী ধরে আসতে শুরু করে, নয়ন হয় নম। কম্পিত কণ্ঠ কিন্তু প্রচন্ড শাণিত শোনায়, “করে দেখেন না এমন একবার, হাওয়ায় মিইয়ে যেতে সময় লাগবে না আমার।”

নির্বাণ দৃষ্টি শান্ত হয়। উপলব্ধি হয় মজা করতে গিয়ে মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে সে। নির্বাণ এক হাত দিয়ে স্পর্শীকে নিজের বুকে টেনে নেয়। মাথায় টানা কাপড়ের উপর হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, “যেখানে কৃষ্ণকণ্যার মোহ কাটিয়ে উঠার সাধ্য দুর্ধর্ষ রাজার পর্যন্ত নেই সেখানে আমি অনাড়ম্বর একজন। কিভাবে এই দুঃসাহসিকতা দেখাই বল?”

স্পর্শী চোখ বুজে নেয়, কার্নিশ ঘেঁষে পড়ে এক ফোঁটা নোনাজল। শ্যামবর্ণের অধিকারী হওয়ায় শৈশব যার কেটেছিল সকলের তুচ্ছতাচ্ছিল্যে, শেষে কি-না সেই জায়গা পেয়েছে অন্যের রাজ্যের রানির আসনে৷ এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি কি আর হতে পারে? নির্বাণকে আঁকড়ে ধরে স্পর্শী। নির্বাণ তা দেখে হাসে, “আর অভিমান কর না। নাহলে মজাটাই মাটি হয়ে যাবে। আর তোমার বরের চাকরি গিয়েছে তো কি হয়েছে? তার যে দুইটা রেস্টুরেন্ট আছে ভুলে গিয়েছ? সে সারাজীবন বসে থাকলেও ভালোই চলতে পারবে। কোন সমস্যা হবে না, তাই এসব নিয়ে আর ভেবো না। ইঞ্জয় দ্যা জার্নি,ফিল দ্যা মোমেন্ট। এই সময় কিন্তু আর ফিরে আসবে না।”

স্পর্শী ছোট করে ‘হুম’ বলে। সে আপাতত মগ্ন প্রিয় মানুষটির উষ্ণ আলিঙ্গনে। নির্বাণ স্পর্শীকে আগলে নিয়ে বলে, “ঘুমোও! আমি লাইট অফ করে দিতে বলছি।”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here