চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব -৪৩+৪৪+৪৫+৪৬

#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৪৩

ঘড়ির কাঁটার বিরচণ তখন নয়ের ঘরে। পরিবেশ মোহিত রৌদ্রস্নাতের আবেশে। দূরে প্রগাঢ় আকাশের শেষ রেখায় মিলিত হয়েছে সমুদ্রের একাংশ। গা আবৃত নীলাঞ্জনছায়ায়। নয়ন যায় যেদিক, আরাম লাগে সেদিক। সতেজ নিঃশ্বাসে বন্য ফুলের ঘ্রাণ৷ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কমতি নেই কিঞ্চিৎ পরিমাণও৷ সৌন্দর্যের এই মাপকাঠি মাপতে মাপতে কখন যে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ফেলল স্পর্শী বুঝে উঠতে পারলো না। যখন বাস এসে থামল নিজ গন্তব্যে, ক্লান্তিমাখা শরীরগুলো নড়েচড়ে উঠল, কোলাহল বাড়লো মিনিটে মিনিটে ঠিক তখনই স্পর্শীর খেয়াল হলো নিজ অবস্থানের। বাস খালি হওয়ার পূর্বেই স্পর্শীরা নেমে পড়ে। বাস থেকে নেমে সর্বপ্রথম হোটেলে গিয়ে উঠে তারা। কোনমতে হাত-মুখ ধুয়ে ছুটে খাওয়ার উদ্দেশ্যে। নিজের আশ মিটিয়ে পুনরায় হোটেলে ফেরত আসে সকলে। দশ-বারো ঘন্টা রাস্তার আঁকেবাঁকে ঝাঁকুনি খেয়ে, নির্ঘুম-অর্ধনিদ্রিত রাত কাটানোর পর শরীর তীব্রভাবে টানছে বিছানাকে। আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকা যেন দায় সকলের নিকট৷ বিশ্রামের জন্য বড্ড ক্লান্ত মন। সেই যে খাওয়া-দাওয়া করে একেকজন রুমে এসে দরজা দিয়েছে, খুলেছে পড়ন্ত সাঁঝের কয়েক প্রহর পূর্বে। খাওয়া-দাওয়া হলো দ্বিতীয়বারের মত। অতঃপর দুই জুটি বেরিয়ে পড়ে ঘুরার উদ্দেশ্যে৷ রাস্তায় পাঁচ মিনিটের দূরত্বে কলাতলী সি বিচ অবস্থিত হওয়ায় প্রথম যাওয়া হলো সেখানে। পশ্চিমাকাশে অর্ধনিমগ্ন সূর্যটি তখন সমুদ্রের গহীনে মিইয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। হলদেটে আকাশ, পেঁজো মেঘের সমারোহ বুকে ধারণ করে স্রোত বইছে অসমান। চারজনে হাতে ডাব নিয়ে সূর্যাস্তের প্রহর গুণতে থাকে একমনে। মাঝে মধ্যে গল্প চলে একে অপরের সাথে। সূর্যাস্তের পর ঘন্টাখানেক বিচেই ঘুরে-ফিরে রাত আটটার নাগাদ তারা হোটেল ফিরে আসে। খাওয়া-আড্ডায় রাত দশটা বাজে তাদের। রুমে কারো মন না টিকায় দ্বিতীয়বারের মত বেরিয়ে পরে তারা। স্পৃহা আর নাহিদ আশেপাশেই থেকে যায়। ঘুরে ঘুরে মার্কেট দেখতে থাকে আর খোশ আলাপে মত্ত হয়। এদিকে নির্বাণ আর স্পর্শী হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রসৈকতেই আসে। পরিবেশ তখন খানিকটা কোলাহলমুক্ত। সকাল-বিকালের মত মানুষের ঠ্যালা-ঠ্যালি নেই বললেই চলে। মুঠো ভর্তি তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আঁধারিয়া অম্বরে। মধ্যখানে নিখুঁত আকৃতির চন্দ্রমা খিলখিল করে হাসছে কৃষ্ণ জলের ধারায়৷ হাতের মাঝে হাত গলিয়ে স্পর্শী বালুময় পথে হেঁটে চলেছে। চোখের দেখায় অকৃত্রিম, অপার্থিব দৃশ্য স্মৃতি বন্দী করছে সে। হঠাৎ এক দামকা হাওয়ার আবির্ভাব হলো, এলোমেলো হলো রমনীর উন্মুক্ত কেশ। চোখে-মুখে এসে পড়ে কয়েক গাছি চুল। নির্বাণ থামে। হাত উঁচিয়ে খুব সন্তর্পণে চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দেয়। স্পর্শী মিষ্টি হাসে। আদুরে কন্ঠে বলে, ” ওদিক চলেন। পানিতে পা ভেজাব।”

নির্বাণ মাথা ঝাঁকায়, “আচ্ছা চল।”

নির্বাণের সম্মতি পাওয়া মাত্র স্পর্শী সেদিক ছুটে৷ এক কিনারে জুতো জোড়া খুলে রেখে শৈথিল্য জলে পা ডুবায়। নির্বাণ হাত শক্ত করে ধরে, খেয়াল তার স্পর্শীর দিকে। জমিন পিচ্ছিল, স্পর্শী পড়ে না যায়। এদিকে পানির সংস্পর্শে এসে বাচ্চাসুলভ হয়ে উঠে যুবতীর প্রাপ্তমনস্ক মন। দুই-এক পা ফেলে কদম মিলিয়ে চলার আহ্বান যায় নির্বাণকে। নাকচ করতে না মানবটি। শর্তক কন্ঠে বলে, “দেখে-শুনে হাঁটো। শামুক-ঝিনুক থাকে, পা কেটে যাবে।”

স্পর্শী হাসে,”কাঁটবে না।”

কথাটা বলে স্পর্শী আরও কিছু পানিতে হাঁটাচলা করে তীরে ফিরে আসে। সৈকতের পাশ দিয়ে চলাচলের সময় সামনের দিকে নজর যায় তার। কিছু হাত দূরত্বেই কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ নারী বিচের কিনার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আর হাসি-মজা করছে। সম্ভবত রাশিয়ান তারা, ঘুরতে এসেছে এখানে। পড়নে তাদের শর্টস এবং ক্রোপ টপ। যার দরুন শরীরের বেশিরভাগ অংশই উন্মুক্ত। ভিনদেশি মুভি-সিরিজে এমন পোশাকে নারী অজস্রবার দেখেছে সে। কৃত্রিম পর্দায় স্বাভাবিক এবং তাদের মানানসই দেখালেও, বাস্তবে অস্বস্তিবোধ হয় স্পর্শীর। সাথে লজ্জা পায় কিছুটা। সে তার মনকে বোঝাতে অসক্ষম হয় যে, “তাদের সংস্কৃতি ভিন্ন। তারা এমন পোশাক পরিধান করতেই সাচ্ছন্দ্যবোধ করে। স্বস্তি অনুভব করে। তারা ভিনদেশি।”
শুধু আনমনে আওড়ায় যে, “এদের কি জামা-কাপড়ের অভাব নাকি? আরেকটু কাপড় পড়লে কি হতো?”

কথাটা বলে চোখ ঘুরিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় নির্বাণের পানে। নির্বাণ সামনের দিকেই তাকিয়ে আছে। মুহূর্তেই ফুঁসে ওঠে সে৷ পায়ের আঙুলের উপর ভর করে নির্বাণের গালের দুইপাশে হাত গলিয়ে জোড়পূর্বক নির্বাণের মুখ তার দিকে ঘুরায়। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে, “এদিক তাকান। ওদিক কি দেখছেন?”

নির্বাণ হতভম্ব হয়ে তাকায়। নিজের গাল থেকে স্পর্শীর হাত নামিয়ে হাতের মাঝে নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠে বলে, “মানে? কোথায় দেখছি আমি?”

“বউ থাকতে অন্য পর নারীদের দিকে তাকাতে লজ্জা করে না?”

নির্বাণ নিজের বিস্ময়কর ভাব তুকাতে না পেরে বলে, “কার দিকে তাকালাম আমি?”

স্পর্শী বলে, “ন্যাকা সাজবেন না। আমি দেখেছি।”

স্পর্শী কথা আগা-গোড়া বুঝতে না পেরে নির্বাণ এদিক-সেদিক তাকালো। দূরে শ্বেতাঙ্গ নারীদের দলদের চোখ পড়া মাত্র ঘটনা বুঝতে বেগ হয় না তাকায়। কিছু বলার পূর্বেই স্পর্শীর হাত ছাড়িয়ে পুনরায় নির্বাণের মুখ টেনে এদিক ঘুরায়। চেঁচিয়ে বলে, “আবার তাকিয়েছেন আপনি৷ সাহস তো কম না। আমি ব্যতীত অন্য কারো দিকে তাকানো নিষেধ আপনার। এক্কেবারে নিষেধ। বুঝেছেন?”

নির্বাণ হাসে। মেয়েটা যে এই মুহূর্তে বড্ড জেলাস ও ইন্সিকিউর তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ অবশিষ্ট রইলো না নির্বাণের। যদিও সে ভিনদেশি সেই নারীর দলবলকে খেয়ালই করে নি তবুও মজা নেওয়ার জন্য সে বলে, “বুঝলাম তবে এভাবে এভাবেই তো আর কথা দেওয়া যায় না, বিনিময়ে কিছু যে চাই আমার।”

স্পর্শী হতবিহ্বল নয়নে তাকায়, “মানে কি?”

নির্বাণ স্পর্শীর কানের পাশে ঝুঁকে, “সুন্দর এক দৃশ্য দেখা থেকে বঞ্চিত করছো আমায় তার বদলে বিশেষ কিছু কি আমার প্রাপ্য নয়?”

স্পর্শী চোখ পাকিয়ে তাকায়, “কিছু পাবেন না আপনি। চলেন আমার সাথে, এক্ষুনি হোটেল ফিরবো আমি।”

নির্বাণ গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলে, “তাহলে তুমি একা যাও। আমি থাকব আর কিছুক্ষণ।”

“বেশ! তাহলে থাকেন। কিছুক্ষণ কেন সারারাত থাকেন। ভুলেও রুমে ফেরত আসবেন না আর আপনি। কাল সকাল হোক চলে যাব আমি।”

কথাটা বলে স্পর্শী মুখ ঝামটা মেরে চলে যেতে নিলে নির্বাণ তার হাত ধরে টেনে নিজের সান্নিধ্যে নিয়ে আসে৷ স্পর্শীর মাথা নিজের বুকের মাঝে মিশিয়ে নিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে, “তোমার থেকে দৃষ্টি সরলে না-হয় আমি অন্যের দিকে তাকাব।বুঝো না কেন তুমি? তখন মজা করছিলাম।”

স্পর্শী মুখ গুঁজে বলে, “মজা হোক আর যাই হোক আপনি বলবেন কেন এমন কথা?”

“আচ্ছা আর বলব না। ঠিক আছে?”

স্পর্শী স্মিত মুখে মুখে বলে, “হু আছে।”

স্পর্শীর কথা রাখতেই নির্বাণ সেখান থেকে হোটেলে ফিরে আসলো৷ লিফটের কাছে এসে বাটন প্রেস করতেই দরজা খুললো৷ সাথে সাথে চোখের সামনে ভেসে উঠলো আপত্তিকর এক দৃশ্য৷ ভিনদেশি এক যুগলের মধ্যকার একান্ত কিছু মুহূর্ত। স্পর্শী এবার আপাদমস্তক লজ্জায় বেষ্টিত হয়ে দ্রুত চোখ ঘুরিয়ে নির্বাণের বুকে মুখ গুঁজে বিরবির করে বলে, “তবা! তবা!”

তবে নির্বাণ নির্বিকার থেকেই দৃঢ় কন্ঠে বলে, “সরি টু ইন্টারাপ্ট।”

কথাটা বলে নির্বাণ স্পর্শীকে নিয়ে সিড়ির দিকে চলে আসে। স্পর্শী তখনো লজ্জায় কুঁকড়ে নির্বাণের সাথে লেগে আছে। সিড়ি দিয়ে উঠার সময় স্পর্শী বিরবির করে বলে, “কি নির্লজ্জ এরা। মাথায় কি সামান্যটুকু কান্ডজ্ঞান নেই নাকি? লিফটে কিভাবে.. ছিহ!”

বিরবির করে বলা সত্ত্বেও নির্বাণের কর্ণকুহর পর্যন্ত সম্পূর্ণ কথাটি এসে পৌঁছায়। সে থেমে স্পর্শীর কানের কাছে এসে বলে, “সবাই তো আর তোমার বরের মত এত ধৈর্যশীল না। বুঝলে!”

স্পর্শী কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে নিবার্ণের বুকে কিল বসিয়ে বলে, “মুখে লাগাম নেই কেন আপনার? নির্লজ্জ একটা।”

নির্বাণ স্পর্শীর এক হাত ধরে বলে, “তাই নাকি? তা উপাধি যেহেতু দিয়েই দিয়েছ সেহেতু আজ তোমাকে নির্লজ্জের ডেফিনিশন না শিখিয়ে ছাড়ছি না আমি। আসো!”

স্পর্শী তৎক্ষনাৎ বলে ওঠে, “না..”

নির্বাণ স্পর্শীর ঠোঁটদ্বয়ের মাঝে আঙ্গুল চেপে ধরে, “হুস! কোন কথা না।”

অতঃপর স্পর্শীর হাত চেপে ধরে তাকে নিয়ে উপরে আসে। রুমে ঢুকে দরজা দেয় সে। শব্দ হয় কিঞ্চিৎ পরিমাণ। আড়চোখে তাকায় নিস্তব্ধতা।

________________

পরবর্তীদিন সকালে সকলে বের হলো হিমছড়ির উদ্দেশ্যে৷ একপাশে সুবিস্তৃত সমুদ্র সৈকত আর অন্যপাশে রয়েছে সবুজ পাহাড়ের সারি। আকাশ, সাগর, পাহাড়ের অপূর্ব বন্ধনে আবদ্ধ অপার্থিব সৌন্দর্যে মোড়ানো পরিবেশটা যে কারো মন ভালো করতে সক্ষম। নিস্পন্দ, নির্জন পাহাড়ের গহীনে জলপ্রপাতের কলধ্বনি সুধা যেন। স্পর্শী সবকিছুই ক্যামেরা বন্দী করে নেয়। স্মৃতি হিসাবে ক্ষুদ্র মেমোরিতে জমা পড়লো কয়েক’শ ছবি। সারাদিন ঘুরাঘুরি করার পর সন্ধ্যার একটু আগেই ফিরে আসে তারা৷ যে যার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল প্রথমে। স্পর্শী ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসতেই দেখে নির্বাণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে। স্পর্শী নিজের চুল মুছে এগিয়ে গেল সেদিক। ততক্ষণে নির্বাণ কল কেটে দিয়েছে। স্পর্শী জিজ্ঞেস করে, “কে ফোন করেছিল?”

নির্বাণ স্পর্শীর দিকে তাকায়৷ সিক্ত চুলে তখনও গড়িয়ে পানি পড়ছিল। স্নিগ্ধ মুখখানি একটু বেশি নিষ্পাপ লাগছিল। আবছা চন্দ্রপ্রভায় স্পর্শীর গলদেশে লেপ্টে থাকা গভীর প্রণয়ের লালাভ চিহ্নটি চোখে বিঁধলো খুব করে। নির্বাণ স্মিত হেসে স্পর্শীকে কাছে টেনে তার পিঠ নিজের বুকের সাথে ঠেশ দিয়ে ধরে। স্পর্শীর পেট জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রেখে বলে, “মৃন্ময় ফোন করেছিল। রুদ্রের কেস নিয়ে আপডেট দিতে।”

স্পর্শী কপালের ভাঁজ পড়ে, “কি বলল সে?”

“রুদ্রের কেসের রায় দিবে সামনের সপ্তাহে, যেতে বলেছে একবার। ওর সকল ক্রাইম প্রমানিত হয়েছে, আশা করা হচ্ছে চৌদ্দ বছরের জেল হবে। সাথে জরিমানা তো আছে।”

“হলে তো ভালোই।”

নির্বাণ স্পর্শীর গালের সাথে গাল লাগিয়ে বলে, “হুম। তা আমার কাছে কিন্তু একটা গুড নিউজ আছে।”

স্পর্শীর কন্ঠ কৌতূহল শোনায়, “কি সে-টা?”

নির্বাণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত কন্ঠে বলে, “আমার চাকরি হয়ে গিয়েছে।”
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৪৪

নির্বাণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত কন্ঠে বলে, “আমার চাকরি হয়ে গিয়েছে।”

কথাটা কর্ণগোচর হওয়ামাত্র স্পর্শী হৃষ্টচিত্তে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় নির্বাণের দিকে, “সত্যি?”

নির্বাণ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “হ্যাঁ! এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এনালিটিক্যাল কেমিস্ট হিসেবে জয়েন করছি নেক্সট মান্থে।”

স্পর্শী শুকরিয়া আদায় করে বলে, “এটা হলো কবে?”

“তিনদিন আগে।”

স্পর্শী চোখ বড় বড় করে তাকায়, “আর আপনি আমাকে এখন জানাচ্ছেন? আগে জানান নি কেন?”

নির্বাণ হাতের বাঁধন শক্ত করে বলে, “এখানে এসে জানাতে চেয়েছিলাম। একান্ত ভাবে, তাই!”

স্পর্শী গাল ফুলিয়ে বলে, “নট ফেয়ার।”

নির্বাণ স্পর্শীর গালে আলতো করে আধর ছুঁয়ে বলল, “এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার।”

স্পর্শী আরও কিছুক্ষণ কপট রাগ দেখাতে চেয়েছিল কিন্তু নির্বাণের স্পর্শে সেটা পারলো না। গলে গেল মন তার। কন্ঠ মিহি হলো, “মাকে জানিয়েছিলেন?”

নির্বাণ সুক্ষ্মভাবে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ! প্রথমে তাকে এবং দ্বিতীয়তে তোমাকে। বাকি কেউ এখনো জানে না।”

“জানাবেন না?”

“ফিরে যাই তারপর।”

স্পর্শী মাথা দুলিয়ে আরও কয়েকটা প্রশ্ন করে। নির্বাণ সবগুলো প্রশ্নের উত্তরই বেশ গুছিয়ে দেয়। শেষে স্পর্শী জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন কোন সাইডে যাবেন?”

“হ্যাঁ কিছুটা। এই জবটার জন্য আরও মাস খানেক আগে থেকেই ট্রায় করছিলাম।”

“অহ আচ্ছা।”

“হ্যাঁ! ভার্সিটিতে পড়াকালীন আমাদের একজন প্রফেসর ছিলেন। কল্যাণ স্যার! সপ্তাহে একদিন বায়োকেমিস্ট্রি ক্লাস নিতেন তিনি। কিভাবে কিভাবে যেন তার সাথে আমার বেশ সখ্যতা হয়ে যায়। শিক্ষতার বাহিরে তিনি একজন রিসার্চার ছিলেন। আমি ল্যাব সাইডে ভালো ছিলাম বলে তিনি প্রায় তার ল্যাবে আমাকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্টগুলা দেখাতেন। বছর দুই-এক তার আন্ডারে ছিলামও। সেটাই এখন কাজে লেগেছে। আর কল্যান স্যারের সাথে এখন পর্যন্ত ভালো সম্পর্ক থাকায় আমার রেফারেন্সটাও তিনিই দেন।”

স্পর্শী চোখ ছোট ছোট করে বলে, “আপনি তো দেখছি গভীর জলের মাছ।”

নির্বাণ হাসে, “তাই নাকি?”

স্পর্শীর অকপট স্বীকারোক্তি, “অবশ্যই।”

নির্বাণ কথা বাড়ায় না। আলিঙ্গন শক্ত করে কথা ঘুরায়, “তোমাকে এখানে নিয়ে আসার মূল কারণ কি জানো?”

“না। কি?”

“তোমার সাথে কিছু সময় কাটানোর। পরবর্তী সময় আমার খুব ব্যস্ততায় যাবে, যোগাযোগ হয়তো ক্ষীণ হবে। দেখাদেখির সুযোগ হবে না তেমন। তাই ব্যস্ত হওয়ার পূর্বে চাইছিলাম পুরো সময়টা তোমাকে দিতে।”

স্পর্শী নির্বাণের আংশিক কথা বুঝলো আবার বুঝলোও না। সে প্রশ্নবোধক চাহনি নিক্ষেপ করে, “মানে?”

নির্বাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে স্পর্শীকে নিজের দিকে ঘুরায়, “চাকরিটা আমার গুলসানের ওদিকে। এখান থেকে যেয়ে এসে করা সম্ভব না, তাই আমি সেদিকে শিফট হচ্ছি।”

স্পর্শী বার কয়েক পলক ফেলে। নির্বাণের সম্পূর্ণ কথার অর্থ বুঝতে পেরে অভিব্যক্তি মলিন হয়। নিষ্প্রভ চাহনিতে তাকায়, “অহ আচ্ছা। বুঝেছি!”

“কি মন খারাপ করলে?”

স্পর্শী জোরপূর্বক অধরের কোণ টেনে বলে, “নাহ! মন খারাপ হবে কেন?”

শরৎ প্রচ্ছন্ন আকাশে গোলাকৃত চন্দ্রপ্রভায় স্পর্শীর শ্যাম মুখটি একটু বেশি স্পষ্ট দেখাল। গায়ে চন্দ্রমা লেপ্টে আছে খুব আদুরে ভাবে। হিমেল বাতাসের দোলে অর্ধ-সিক্ত কেশ উড়ছে আলগোছে। নির্বাণ স্পর্শীর মুখের কাছে পড়ে থাকা অবাধ্য চুলগুলো খুব সন্তর্পণে কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলে, “অনেকক্ষেত্রে দূরত্ব অনুভূতি ফিকে না বরং প্রগাঢ় করে। আর আমার অনুভূতি কখনো ফিকে হওয়ার নয়। নিশ্চিন্তে থাকো। তোমার পাশে আমি সব সময় আছি।”

স্পর্শী অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকায়। অধর ধারে মিহি রেখা বর্ধিত। মানুষটা তার মন পড়তে জানে নাকি? সে যে আসলেই এই ভাবনায় মত্ত ছিল। নির্বাণ স্পর্শীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “রুমে চল, খাবার অর্ডার দিচ্ছে। খেয়ে রেস্ট কর, ক্লান্ত তুমি।”

________________

রাত তখন দশটা৷ তিনতালা প্রায় ফাঁকা। কয়েকটা রুম সবেমাত্র খালি হয়েছে বলে কোলাহলও নেই তেমন। করিডরের মধ্যখানে জ্বলতে থাকা লাইটটা একবার জ্বলছে, আরেকবার বন্ধ হচ্ছে। কেমন যেন গা ছমছম পরিবেশ। এমন সময় স্পৃহা দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দ্বিধাগ্রস্ত নয়নে এদিক-সেদিক তাকালো। হাতে থাকা ভাঙা চশমাটার ফ্রেমটা মুঠো করে ধরলো। আবছা দৃষ্টিতে ভুতুড়ে পরিবেশটা উপলব্ধি করতে পেরে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। দ্রুত পায়ে হেঁটে পাশের রুমটার দিকে এগিয়ে গেল। পাশের রুমটা নাহিদের। আপাতত নাহিদ ব্যতীত তার কোন গতি নেই। দ্রুত বেগে দরজায় কড়া নাড়ে স্পৃহা। মৃদু কন্ঠে ডাকে, “নাহিদ ভাইয়া! ভিতরে আছেন?”

মিনিটের মাঝেই নাহিদ দরজা খুলে ৷ বলে, “কি হয়েছে?”

স্পৃহা কিয়ৎকাল ইতস্তত করে বলে, “আমার একটা সাহায্য করতে পারবেন?”

নাহিদের ভ্রু কুঞ্চিত হয়, “কি?”

“আশেপাশে কোন চশমার দোকান থাকলে আমায় নিয়ে যেতে পারবেন? আমার চশমার ফ্রেম ভেঙে গিয়েছে। তাই এখন আর্জেন্ট একটা চশমা দরকার। আমি আবার চশমা ছাড়া স্পষ্ট কিছু দেখতে পাই না।”

নাহিদ অনুদ্ধত কন্ঠে জিগ্যেস করে,”ভাঙলো কি করে?”

স্পৃহা মাথা নুয়ে ফেলে। লজ্জায় তার মুখ ঈষৎ লাল দেখায়। আনমনে ভাবে, প্রশ্নটার উত্তর কি করে দিবে সে? সত্য এটা যে অসাবধানতার বশত সে চশমার উপরই বসে পড়েছিল। কিন্তু ব্যাপারটা ভীষণ লজ্জার। নাহিদকে বলবে হো হো করে আসবে সে। তার উপর এই ছেলের ঠোঁট যে পাতলা। ঠুস করে বলে বসবে কিছু একটা। তাই সেই মুহূর্তে মিথ্যের আশ্রয় নেওয়াটাই শ্রেয় মনে হলো স্পৃহার নিকট, “হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল।”

নাহিদ ঠোঁট গোল করে বলে, “অহ আচ্ছা।”

স্পৃহা মাথা ঝাঁকায়, “হ্যাঁ। দোকান আছে আশেপাশে? জানেন কি?”

নাহিদ মাথায় চুলকায়। আশেপাশে আদৌ কোন দোকান আছে কি-না তার জানা নেই। তবে যাই হোক ‘না’ বলবে না। সময় কাটানোর একটা সুযোগ হাতে এসেছে হাত ছাড়া করে কিভাবে সে? বের হয়ে দোকান না-হয় খুঁজে নেওয়া যাবে। এটা বড় ব্যাপার না। কথাটা ভেবে নাহিদ গলা পরিষ্কার করে। বলে, “থাকার কথা। আচ্ছা চল আমার সাথে দেখছি।”

“আচ্ছা।”

নাহিদ রুমের ভিতর থেকে চাবি নিয়ে দরজা ভালো মত আটকে বের হলো। হোটেল থেকে বের হয়ে রাস্তার ধারে পাশাপাশি হাঁটাতে শুরু করলো তারা। স্পৃহা সামনে সুব্যক্তভাবে দেখতে না পেয়ে হাঁটার সময় বেশ কয়েকবার হোঁচট খেল। নাহিদ বিষয়টা লক্ষ্য করে নিভৃতে স্পৃহার হাতটা শক্ত করে ধরলো। বলল, “হাতটা শক্ত করে ধরো। তোমাকে দেখার জন্য আছি আমি।”

স্পৃহা সরল মনেই বলে, “থ্যাংক ইউ।”

নাহিদ হাসে। আনমনে বলে, “আজীবন আছি।”
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৪৫

সময়ের চক্র ঘোরে দ্রুত। চিত্তরঞ্জনকারী ঋতু শরৎ শেষে আগমন ঘটে হেমন্তের। প্রকৃতিতে তখন সৌন্দর্যের জৌলুস নেই, রূপসজ্জার প্রাচুর্য নেই, আছে শুধু কোমলতা। বর্ষার ধারায় সিক্ত পৃথিবী তাপমুক্ত। দিগন্ত বিস্তৃত ধান ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ার খেলা সৃষ্টি করছে আনন্দের হিল্লোল। নীল অম্বর জুড়ে শুভ্র মেঘমালা। বাতাসের বেগে গাড়ি চলছে আশুলিয়া হাইওয়ে। স্পর্শী সিটে গা হেলিয়ে আর্ট এক্সিবিশনের সময়সূচি আরেকবার দেখে নিল। শিল্পকলা একাডেমি সাময়িকভাবে তিনদিনের জন্য একটি চিত্রকর্ম প্রদর্শনী আয়োজন করেছে যার মধ্যে তার দু’টি চিত্রাকর্ম নির্বাচিত হয়েছে। প্রদর্শনী আজ দুপুর থেকে শুরু তাই বেলা হতে না হতেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে সে।টানা কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন আর্ট এক্সিবিশনে তার চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়ে আসছে। অনুভূতি বিশেষ বলে কিছু নেই।তথাপি কেন জানি আজ তার উচ্ছাস, আনন্দের রেখা বেশ বিস্তৃত। প্রবল মনোযোগের সাথে সময়ের কাঁটা গুনছে মন। ঈপ্সিত ব্যক্তিটির দেখা মিলবে বলেই কি এত অস্থিরতা,ব্যাকুলতা? কে জানে। স্পর্শী নিজের অনুভূতির জোড়ার শান্ত করতে নেত্রপল্লব বন্ধ করে ক্ষণকাল স্থির হয়ে বসলো। ভাবতে থাকলো তাদের শেষ সাক্ষাৎকারের কথা। ঠিক দুইমাস আগে, কক্সবাজার থেকে আসার সপ্তাহখানেক পরই নির্বাণ বিদায় নিয়ে ঢাকায় শিফট হয়ে যায়। জয়েন করে নতুন চাকরিতে। সেখান থেকেই যোগাযোগ চলে মুঠোফোনে। ধীরে ধীরে কাজের অবকাশ কমে, চরম ব্যস্ততা ঘিরে ধরে মানুষটাকে। কথা বলার সময় হয়ে আসে সংকীর্ণ। কদাচিৎ কৃত্রিম পর্দায় চোখাচোখি হওয়ার সুযোগ মিলে তো মিলে না। ক্লান্ত থাকে মানুষটা, স্পর্শী বুঝে। তাই নিজের মন আনচান করা সত্ত্বেও নির্বাণ জ্বালাতন করে না বেশি৷ সময়-সুযোগ না হওয়ায় নির্বাণ আসতে পারে না তার সান্নিধ্যে। চলন্ত সময়ে দেখা হয় না একটি বারের জন্যও। তথাপি দূরে থেকে যতটুকু যোগাযোগ হয় নির্বাণ যথাসাধ্য চেষ্টা করে তাকে আগলে রাখার৷ কিন্তু যার দর্শন পেতে তৃষ্ণার্থ আঁখিপল্লব, কথায় কি তৃষ্ণা মিটে? স্পর্শী একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, আর সে-টা পেলেও বটে। আর্ট এক্সিবিশনের বাহানায় ঢাকা আসার জন্য বাসায় মানিয়ে নিল সবাইকে সে। সে সাথে, এক্সিবিশন চলাকালীন সে নির্বাণের সাথে থাকবে বলে জানিয়েও দেয়। নির্বাণের কথা শুনে আপত্তি করে না কেউ। স্পর্শী নিলুফার কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে নির্বাণের বাসার এড্রেস যোগাড় করে নেয়। তবে তাকে বলে রাখে নির্বাণকে যাতে এ বিষয়ে তিনি না জানান। সে ভড়কে দিতে চায় মানুষটাকে। নিলুফা তখন আলগোছে হাসে। তাকে দেখে নির্বাণ রিয়্যাকশন কি হবে তা ভাবতেই উত্তেজনায় স্পর্শী চোখ খুলে বসে। মনের মাঝে চলতে থাকে রাজ্যসম আল্পনা-জল্পনা।

____________________

আর্ট এক্সিবিশনের আজ প্রথমদিন হওয়ায় সেখান থেকে বের হতে সময় লেগে গেল একটু বেশি৷ সায়াহ্নের আকাশে সূর্য হেলে পড়েছে প্রায়। স্পর্শী একবার সময়ে নজর বুলিয়ে রিকশা উঠে পড়ে সে। প্রবল আগ্রহ, উন্মাদনা কাজ করতে থাকে মনের মাঝে৷ কিন্তু সে-টা বেশিক্ষণ টিকলো না। প্রত্যেক মোড়ের আঁকেবাঁকে জ্যামের সম্মুখীন হয়ে, অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘতর হতে দেখে বিষাদ,তিক্ত হলো অনুভূতি। বিতৃষ্ণায় মুখ কুঁচকালো সে। আধা ঘন্টার রাস্তা যেখানে সেখানে পাক্কা দুই ঘন্টার বেশি সময় লাগলো। রিকশা যখন গুলশানের চব্বিশ নাম্বার রোডে এসে থামলো, স্বস্তি মিললো যেন তখনই। সে সময় রাত নয়টা ছুঁইছুঁই। ভাড়া মিটিয়ে নিজের ব্যাগপত্র নিয়ে নেমে পড়ে সে। রাস্তার ধারে হরিদ্রাভ আলো জ্বলছে। যানবাহন শূণ্য পরিবেশ হলেও, জন-মানব শূণ্য নয়। স্পর্শী আশপাশ তাকায়। অ্যাড্রেসটা আরেকবার ভালো মত দেখে নেয় কিন্তু সেটা ঠিক আয়ত্ত করতে না পেরে পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া দুই-এক লোককে জিজ্ঞেস করে অবশেষে সে খুঁজে পায় নিজ গন্তব্যে। সব ততক্ষণ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটে এরপরেই৷ মূল দরজা দিয়ে ঢোকার সময় দারোয়ান আঁটকায় তাকায়। কয় তলা যাবে? কার ফ্ল্যাটে যাবে? তার সাথে সম্পর্ক কি? দারোয়ানের এরূপ শ’খানেক প্রশ্নের বিপরীতে স্পর্শী একবাক্যে উত্তর দেয় আর ভিতরে যেতে চায়। কিন্তু দেয় না সে। সন্দেহপ্রবন দৃষ্টিতে তাকায় সে, “ভাইজান রে পোন দিয়া জিগান লাগবো আফনারে ঢুকবার দিমু কি-না।”

স্পর্শী মেজাজ চটে যায় এবার। সে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে, “আজীব তো! যেখানে আমি বলছি আমি তার ওয়াইফ, সেখানে এত যাচাই-বাছাই এর কি আছে?”

“হেতি আমারে কইয়া রাহে নাই কেউ তার বাইত যাউনের জন্য আইলে হেতিরে ঢুকবার দিতে৷ জিগান তো লাগবোই আমার। আর রাইত-বিরাতে এমনেই কারো ঢুকবার দিবার পারুম না।”

স্পর্শী মুখ কুঁচকায়, “আমি যে আসছি তা জানায়নি, সারপ্রাইজ দিব বলে। তাই আপনাকে কিছু বলেন নি তিনি। বুঝেছেন? এখন যেতে দিন আমায়।”

দারোয়ান পান চিবুতে চিবুতে বলে, “অফেক্ষা করোন লাগব। ভাইজানের অনুমতি ছাড়া যাইবার দিবা পারুম না। আমগোও কিছু নির্দেশ আচে।”

“আচ্ছা জ্বালা তো।”

দারোয়ান স্পর্শী কোন কথা গায়ে না মেখে সোজা নির্বাণের ফোনে ফোন মিলায়। দুইবার রিং হতেই নির্বাণ ফোন ধরে। দারোয়ান বলে, “ভাইজান আফনার লগে একখান মেমসাহেব দেখা করবার আইসে৷ হেতিরে কি উপরে পাঠাইয়া দিমু?”

নির্বাণ ভ্রু কুঁচকায়, “কে এসেছে? নাম জিজ্ঞেস করেন তার, চাচা।”

দারোয়ান আচ্ছা বলে স্পর্শীকে তার জিজ্ঞেস করে, “আফনের নাম কি?”

স্পর্শী আকাশসম বিরক্ত নিয়ে বলে, “স্পর্শী।”

দারোয়ান নামটা বুঝতে না পেরে বলে, “কিডা?”

স্পর্শী এবার গলা উঁচিয়ে বলে, “স্পর্শী!”

নামটা দারোয়ানের বোধগম্য হওয়ার পূর্বেই নির্বাণের কর্ণকুহরে কন্ঠস্বর এবং নাম দুইটাই ঝংকার তুললো। মানুষটিকে চিনতে ভুল করলো না এক বিলম্বও। অবাক হলো সে। স্পর্শী এখানে এসেছে? এই প্রহরে? বিশ্বাস হলো না বিষয়টা। হতবিহ্বল, বিমূঢ়তা কাটিয়ে উঠার পূর্বেই সে দ্রুত বলে ওঠে, “চাচা, ওকে দাঁড় করান আমি আসছি।”

কথাটা বলেই নির্বাণ ফোন কাটে। দারোয়ান আড়চোখে তাকিয়ে বলে, “ভাইজান কইসে আফনারে দাঁড়াইতে। হেতি আইতাসে।”

কথার বিপরীতে স্পর্শী দাঁতে দাঁত চেপে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। সুন্দর এক সাজানো-গোছানো পরিকল্পনায় আগুণ লাগিয়ে দিয়ে বেটা কি নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে বলছে, ‘সে আসছে।’ মনটা চাচ্ছে তাকে এখনই, এই মুহূর্তে জীবন্ত কবর দিয়ে ফেলতে। তার সারাদিনের কষ্ট এভাবে পানিতে ভাসিয়ে দিল লোকটা? ভীষণ কান্না পায় তার। মানুষটা আশ্চর্যান্বিত চেহেরা দেখার জন্য কতটাই না উৎফুল্ল ছিল সে। এখন তো সব গুড়ের বালি। শুধুমাত্র এই দারোয়ানটার জন্যে। স্পর্শী পারছে না তো কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিতে। নিজের রাগ দমন করে স্পর্শী তপ্তশ্বাস ছাড়ে। ক্ষণকালের মধ্যে নির্বাণ এসে হাজির হয় নিচে। স্পর্শী তাকায় সেদিক। কাঙ্ক্ষিত মানুষটার ঝলক পেতেই যেন মরুর বুকে নামে এক পশলা বৃষ্টি। তৃষ্ণার্থ নয়নের আশ মিটে। পড়নে নির্বাণের বাদামি টি-শার্ট, ব্লু ট্রাউজার। সিক্ত চুলগুলো অবিন্যস্ত রূপে ছড়িয়ে আছে তার ললাট জুড়ে। বুঝতে দেরি নেই, মানুষ বাসায় এসেছে বেশি সময় হয়নি। ফ্রেশ হয়েছিল সবে, এর মাঝেই কাহিনী যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে।
নির্বাণ স্পর্শীর সামনে এসে জিজ্ঞেস করে, “তুমি এখানে কি করছো? আর তুমি যে আসবে আমাকে আগে জানাও নি কেন?”

স্পর্শী দারোয়ানটা দিকে অগ্নিদীপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “কাউকে সারপ্রাইজ দেওয়ার প্ল্যান ছিল কিন্তু কিছু মানুষের মাতব্বরির জন্য সেটা আর হয়ে উঠলো না।”

নির্বাণ একপলক স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে দারোয়ানের দিকে তাকায়। বুঝতে দেরি নেই কাহিনী আসলে কি। নির্বাণ ফাঁকা কাশি দিয়ে বলে, “আচ্ছা তুমি আসো আমার সাথে।”

কথাটা বলে সে স্পর্শী কাছে গিয়ে ওর হাত থেকে ছোট কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে নেয়৷ একহাতে ব্যাগ ও অন্যহাতের মুঠোয় স্পর্শী বাহু ধরে নির্বাণ দারোয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে, “চাচা, ও আমার স্ত্রী। চিনে রাখুন, পরেরবার থেকে ওকে আটকাবেন না আর।”

দারোয়ান মাথায় নাড়ায়, “আইচ্ছা।”

নির্বাণ চলে আসে সেখান থেকে। লিফটে ঢুকে বাটন চাপে। স্পর্শী একপাশে মুখ গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে৷ রা নেই তার মুখে। বিশ্রি এক অনুভূতির সম্মেলন চলছে চিত্তের দুয়ারে। নির্বাণও নীরব থেকে স্পর্শী দিকে তাকিয়ে। বাহির থেকে অভিব্যক্তি তার বেশ শান্ত দেখালেও ভিতরে ভিতরে তখনও ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠতে পারে নি সে। মেয়েটা এতদূর থেকে এসেছে কি শুধুমাত্র ওর সাথে দেখা করবে বলে? ভড়কে দিবে এই আশায়? ঠোঁটের কোণে ফুটে মিহি রেখা। লিফট ফিফ্থ ফ্লোরে এসে থামে। নির্বাণ আগে বের হয়, পিছে স্পর্শী৷ নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে নির্বাণ স্পর্শীকে আগে ভিতরে যাওয়ার জন্য রাস্তা দেয়। স্পর্শী বাসার ভিতর ঢুকতেই নির্বাণও ঢুকে। ব্যাগগুলো নিয়ে সোজা শয়নকক্ষের দিকে চলে যায়৷ ব্যাগগুলো একসাইডে রেখে বলে, “তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও আগে।যাও!”

স্পর্শী মাথায় দুলায়। নির্বাণের স্বভাব সম্পর্কে সে পূর্ণরূপে অবগত। নোংরা অবস্থা সে কখনোই স্পর্শীকে ক্ষান্ত হয়ে বসতে দিবে না। যতক্ষণ না সে ফ্রেশ হয়ে আসছে নির্বাণ ঘ্যানঘ্যান করতেই থাকবে। এত শুচিবাই লোকটা। স্পর্শী ব্যাগ থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়তে নির্বাণ রুম থেকে বেরিয়ে যায়৷

________________

ফ্রেশ হয়ে এসে স্পর্শী শয়নকক্ষ থেকে বের হয়ে সামনের রুমে আসে। চারদিকে চোখ বুলায় সে। দুইরুমের ফুললি ফার্নিশড ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে নির্বাণ। প্রচন্ড সাজানো-গোছানো ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ফ্ল্যাটটি। নিত্যদিনের জীবনে প্রয়োজন সকল কিছুই উপস্থিত এখানে৷ আসবাবপত্র থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিকস,থালাবাসন,গৃহসজ্জার সামগ্রী সবই আছে। দেখে বোঝা দায়, নির্বাণ এখানে একা থাকে। যে কেউ এই ফ্ল্যাটে আসলে এটাই ভাববে নির্বাণ তার সপরিবার অথবা বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকে৷ স্পর্শীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে৷ পুনরায় রুমে এসে মুঠোফোন বের করে বাসায় ফোন দিয়ে জানিয়ে দেয় সে নির্বাণের সাথে আছে। বাসায় কথা বলে ফোন রাখার পর পরই নির্বাণ একগ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে হাজির হয়৷ গ্লাসটা স্পর্শীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “ক্লান্ত তুমি। এটা খাও ফ্রেশ লাগবে।”

স্পর্শী চোখ পিটপিট করে তাকায়৷ হাতে গ্লাসটা নিয়ে বলে, “থ্যাংক ইউ।”

নির্বাণ হাসে৷ স্টাডির টেবিলের সামনে গিয়ে ল্যাপটপের সাটার অফ করে বলে, “তুমি আসবে আমাকে জানালেই পারলে। তোমাকে এগিয়ে নিয়ে আসতাম আমি।”

স্পর্শী গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে তেঁতো মুখে বলে, “পরিকল্পনা ভিন্ন ছিল। নিচে দারোয়ান না আঁটকালে হয়তো সে-টা কার্যকরীও হতো।”

নির্বাণ স্পর্শীর দিকে এগিয়ে এসে ভ্রু কুঁচকে বলে, “কে বলেছে কার্যকরী হয়নি? হয়েছে তো। যাকে তুমি ভড়কে দিতে চেয়েছিলে সে কিন্তু বেশ ভড়কেছে।”

স্পর্শী ব্যঙ্গার্থে বলে ওঠে, “হ্যাঁ খুব।”

নির্বাণ স্পর্শীর দিকে কিঞ্চিৎ পরিমাণ ঝুঁকে বলে, “কি বিশ্বাস হয় না আমায়? তা তোমাকে এখন বিশ্বাস করাতে কি করতে হবে আমায়? জড়িয়ে ধরব নাকি চুমু খাব? নাকি দুইটোই চলবে?”

স্পর্শী সবে শরবতটা খেয়েছিল৷ নির্বাণের কথা শুনে সে বিষম খেল। নির্বাণ কাছে এসে স্পর্শী পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, “আরেহ বাবা আস্তে৷ মজা করছিলাম আমি।”

কিছুটা সময় লাগে স্পর্শীর স্বাভাবিক হতে। তবে হৃদস্পন্দন তার স্বাভাবিক গতি ছাড়িয়ে অস্বাভাবিকভাবে চলতে শুরু করে। মন কেমন করে উঠে যেন। গাল ঢাকা পড়ে রক্তিম চাদরে, “আপনি দিন দিন অসভ্য হয়ে যাচ্ছেন। নির্লজ্জ লোক একটা৷”

“বউয়ের কাছে নির্লজ্জ হলে সেটা দোষের না।”

স্পর্শী কথা ঘুরানোর জন্য বলে, “বউ বিহীন ভালোই তো চলছে জীবন। আস্ত এক সংসার পেতে বসে আছেন এখানে। আপনাকে দেখে কেউ বলবে আপনি এই বাসায় একা থাকেন?”

নির্বাণ হাসে, “সবাই কি আর ভিতরের খবর জানে নাকি? জানলে নির্ঘাত ধরে বেঁধে আমার আমানত আমার কাছে দিয়ে যেত। তখন কষ্ট পেতে হতো না আমায়।”

স্পর্শী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, “হুহ! যতসব বাজে কথা।”

নির্বাণ স্পর্শীর পাশে বসে, “যাই হোক। এখন বলো ঢাকায় কাজে এসেছ নাকি আমার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে?”

“শিল্পকলায় একটা আর্ট এক্সিবিশনে চলছে। সেখানে আমার আঁকা দুইটা ছবি নির্বাচিত হয়েছে, সে সুবাদে তিনদিন ওই এক্সিবিশন এটেন্ড করতে হবে বলে এসেছি। তবে মূল উদ্দেশ্য এখানে আসাই ছিল।”

শেষের কথাটা স্পর্শী একটু আস্তেই বলে। নির্বাণের কর্ণগোচর হলে সে বলে, “আচ্ছা! তবে পরেরবার এমন পাগলামি করো না৷ রাস্তা-ঘাট নিরাপদ না। আমাকে বল আগে, আমি এগিয়ে নিয়ে আসব নে।”

“আচ্ছা।”

নির্বাণ উঠে দাঁড়ায়, “বুয়া সন্ধ্যায় এসে রেঁধে গিয়েছে, এসো খেয়ে নাও। বাকি কথা পড়ে বলব।”

___________________

পরেরদিন এক্সিবিশন থেকে একটু দ্রুত ফিরলো স্পর্শী। উদ্যোগ নিল আজ সে নিজ হাতে নির্বাণের জন্য রান্না করে, তাকে খাওয়াবে। যদিও রান্না-বান্না এবং ঘর গোছানোর জন্য একটা কাজের লোক রাখা আছে। তিনি সকাল আর সন্ধ্যা দুইবেলা এসে কাজ করে যান। তাকে আজ সন্ধ্যায় এসে রেঁধে যেতে মানা করা হয়েছে। স্পর্শী মুখ-হাত ধুয়ে রান্নাঘরে ঢুকে। সে আগেই নিলুফার কাছে ফোন করে নির্বাণের সকল পছন্দ খাবারের নামসমূহ জেনে নিয়েছে। ফলস্বরূপ, সেই অনুযায়ী রান্নার প্রস্তুতি নিল সে।
রান্না যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে তখন ডোরবেল বেজে উঠলো। ঘর্মাক্ত শরীর নিয়েই স্পর্শী ছুটলো গেইটের দিকে। গেইট খুলে নির্বাণকে দেখে বিস্তৃত হাসলো সে। বিপরীতে নির্বাণও হাসে। ঘরে ঢুকে বলে, “এখন আমার আসলেই মনে হচ্ছে আমি সংসার করছি।”

“হয়েছে। যান এখন ফ্রেশ হয়ে আসেন। রান্না প্রায় শেষ আমার।”

নির্বাণ কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “তুমি রান্না করছো?”

“হ্যাঁ!”

“কেন বুয়া আসে নি আজ? সকালে তো আসলো।”

স্পর্শী বলে, “আমি আপনার জন্য নিজ হাতে রাঁধতে চেয়েছিলাম তাই তাকে আসতে মানা করেছি।”

“শুধু শুধু পাগলামি করো তুমি।”

“জামাই আমার, রান্না আমার, পাগলামিও আমার। আপনার কি, হ্যাঁ? যান এখন, ফ্রেশ হয়ে আসুন।”

স্পর্শীর শাণিত কন্ঠ শুনে নির্বাণ নীরব বনে যায়। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার পানে। অতঃপর বলে, “আচ্ছা। তবে সাবধানে কাজ কর।”

স্পর্শী মাথা নাড়ে। নির্বাণ সেটা দেখে চলে যায় রুমে৷ স্পর্শীও ছুটে রান্নাঘরের দিকে। ভাত চড়িয়েছিল চুলোয়।

ভাত হয়ে গিয়েছে দেখে পানি ফেলতে যায় সে। হাড়িতে ভাতের পাতিল বসানোর সময় অসাবধানতার বশত পাতিল ফুঁসলে গিয়ে ফুটন্ত পানি,ভাত গড়িয়ে পড়ে তার বা হাতে। পাতিল ছুটে যায় নিচে। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো ভাতের দানাগুলো। প্রচন্ড জ্বালা করে উঠে সেই জায়গাটি। তীক্ষ্ণ আর্তনাদ ভাসে বাতাসে। নির্বাণ তখন সবে বাহিরের জামা ছেড়ে ঘরের পোশাক পরিধান করেছিল মাত্র। স্পর্শীর কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে প্রায় একপ্রকার দৌঁড়ে রান্নাঘরের দিকে আসে সে। উৎকন্ঠা হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে? চিৎকার ক…”

প্রশ্ন করার পূর্বেই উত্তর পেয়ে যায় সে। দৃষ্টি গিয়ে নিবদ্ধ হয় স্পর্শীর বা হাতের দিকে৷ মেয়েটা প্রদাহে বা হাতটা ধরেই লাফাচ্ছে আর আর্তনাদ করছে। আঁখির কোণে জলের ধারা। পায়ের কাছে পড়ে থাকা পাতিল থেকে ধোঁয়া উড়ছে। মেঝের অবস্থা এক্কেবারে অশোচনীয়।নির্বাণের আর বুঝতে দেরি নেই এখানে হয়েছেটা কি।ধ্বক করে উঠে মানবটির হৃদয়। শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা হয় তার। কোনরকম নিজেকে সামলে আলগোছে সে স্পর্শীর কাছে এসে ওর হাত ধরে সিংকের নিচে ধরে কলটা ছেড়ে দেয়। দহন,যন্ত্রণায় স্পর্শীর কণ্ঠনালি থেকে কাতর ধ্বনি বেরিয়ে আসে আপনা-আপনি। শরীর কাঁপছে তিরতির করে। নোনাজলের বাঁধ নেই। হাতে ইতিমধ্যে ফোসকা পড়ে গিয়েছে। কালসেটে হয়ে এসেছে ক্ষতস্থানটুকু। দহনক্রিয়া সহ্য করতে না পেরে স্পর্শী কিছুটা নিস্তেজ হয়ে নির্বাণের শরীরের উপর ভড় ছাড়ে। নির্বাণ আগলে নেয় তাকে। পানির নিচে হাতটা ধরে রাখে অনেকক্ষণ যাবৎ। স্পর্শীর তখনও ছটফট করেই চলেছে। আর্তনাদের ধ্বনি স্পষ্ট ভাসছে নির্বাণের শ্রবনেন্দ্রিয়ে গিয়ে লাগে৷ ক্ষত-বিক্ষত হয় বক্ষঃস্থল। আরও বেশ কিছুক্ষণ পানি দেওয়ার পর নির্বাণ স্পর্শীকে রুমে নিয়ে আসে৷ খাটে ঠেস দিয়ে বসিয়ে টুথপেষ্ট নিয়ে আসে সে৷ বাসায় আপাতত কয়েকটা প্যারাসিটামল বাদে ফাস্ট এইড বা মেডিসিন বলতে কিছু নেই। স্পর্শী সান্নিধ্যে বসে নির্বাণ স্পর্শীর হাতটা টেনে ধরে। খুব যত্নে পেষ্টটা লাগিয়ে দিতে থাকে। ব্যথায় স্পর্শী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। জ্বালায় হাত টেনে নেওয়ার চেষ্টা করে। নির্বাণ সম্পূর্ণ পেস্টটা লাগিয়ে দিয়ে স্পর্শীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম কন্ঠে বলে, “কাঁদে না, কিছু হয়নি। ঠিক হয়ে যাবে একটুপর।”

স্পর্শী শুনে না। কেঁদেই চলে। মেয়েটার অশ্রু কোনভাবেই সহ্য হয় না মানুষটার। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে সয়ে যায়। স্পর্শীকে থামাতে না পেরে নির্বাণ ওকে নিজের বুকে চেপে ধরে৷ শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। এসময় শান্ত হয় প্রণয়ী নারীটি। নীরস হয় জলধারা। আঁখিপল্লব এক হয়ে আসে নিভৃতে। নির্বাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। ম্রিয়মাণ মুখে তাকায় স্পর্শীর বা হাতে। উৎকন্ঠিত হয় মন। বিদীর্ণ হিয়া জলসে যায় মুহূর্তে। নির্বাণ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ আনে। খুব সন্তর্পণে স্পর্শী ছুঁয়ে দেয় বালিশে৷ এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে কৃষ্ণময়ী নারীটির বিবর্ণ মুখশ্রীর পানে।
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৪৬

নিশুতি রাত। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে একের ঘর ছাপিয়ে চলেছে সামনের দিকে। নক্ষত্র ভরা আকাশের নিচে রাস্তার ধারে বেওয়ারিশ কুকুর ডেকে চলেছে অনাবরত। থেমে থেমে উত্তরা বাতাস বইছে। পাতা দুলছে। নিষুপ্তিচ্ছন্ন শহরে কোথাও আলো জ্বলছে, কোথাও আবার জ্বলছে না। নির্বাণ চুলো নিভায়। কপালে জমে থাকা নোনা পানির বিন্দুকণা মুছে নিয়ে হাত ধুয়ে নেয়। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে যায় রুমে দিকে। রুমে এসে সর্বপ্রথম চোখ যায় তার বিছানায় শুয়ে থাকা কৃষ্ণকলিটার দিকে। মুখশ্রী পাংশুটে,ম্রিয়মান দেখাচ্ছে। চোখের নিচে খাদ ফুটে জঠেছে। ঠোঁট দু’টো শুকিয়ে চৌচির হয়ে আছে যেন। নির্বাণ বিমর্ষচিত্তে তাকিয়ে থাকে। বক্ষঃস্থলে চলতে থাকে অসহ্যনীয় দহনক্রিয়া। সাথে রাগ হয় প্রচুর৷ ঘটনা ঘটাকালীন নির্বাণের ইচ্ছে করেছিল স্পর্শীকে আচ্ছামত বকতে। কানের নিচে দিতে দুই একটা। কেন সে রান্না করতে গিয়েছিল? কে বলেছিল তাকে রান্না করতে? এত কেয়ারলেস কেন সে? সে কি বুঝে না তার কষ্ট তাকে কত পীড়া দেয়? বুঝে না সে? ষ্টুপিড মেয়ে একটা। এমন হাজারো প্রশ্ন করতে। কিন্তু পারেনি। স্পর্শীর করুণ মুখখানি, তপ্ত জলের বর্ষণ আর আর্তনাদ দূর্বল করে তুলে তাকে। পারে না কণ্ঠস্বর উঁচিয়ে সামান্যটুকু কিছু বলতে। মেয়েটার সাথে গলাবাজি করার ক্ষমতা যে তার নেই৷ কিন্তু তাই বলে যে রাগ ঠান্ডা পড়ে গিয়েছে তা নয়। নিজেকে সামলে নিয়ে আলগোছে গিয়ে স্পর্শীর মাথার পাশে বসে। চুলের মাঝে হাত গলিয়ে দিয়ে মন্থর কন্ঠে ডাকে, “স্পর্শী উঠো। খেয়ে নাও একটু।”

স্পর্শী মৃদুশব্দ করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। সাড়াশব্দ করে না কোন। নির্বাণ পুনরায় ডাকে, “এই স্পর্শী উঠো। উঠতে বলছি না তোমায়।”

তথাপি স্পর্শী উঠে না৷ মেয়েটা প্রচন্ড ঘুমকাতুরে। অনেক ডাকাডাকির পর স্পর্শী সজাগ হয়। অর্ধ-নিভন্ত চোখে তাকায় নির্বাণের দিকে, “ঘুমাতে দিন না৷ ঘুমাবো আমি।”

নির্বাণ স্পর্শীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “খেয়ে নাও। তারপর ঘুমাও৷ নাহলে শরীর খারাপ করবে।”

স্পর্শী বাচ্চাদের মত নাকচ করে উঠে, “উহু! ঘুমাব আমি।”

নির্বাণ একপ্রকার গায়ের জোর খাঁটিয়েই স্পর্শীকে শ্ল্যা থেকে আধশোয়া করে বসায়৷ স্পর্শী তখনও ঘুমে ঢুলছে। নেত্রপল্লব লেগে আসছে বারংবার৷ নির্বাণ বলে, “যাও মুখ ধুয়ে আসো। তারপর খাবে।”

রাজ্যসব বিরক্তি নিয়ে স্পর্শী নির্বাণের দিকে তাকায়৷ অপ্রসন্ন কন্ঠে বলে, “বললাম তো খাব না। খিদে নেই। ঘুমাব আমি।”

অকস্মাৎ নির্বাণের কন্ঠ গুরুগম্ভীর শোনায়, “আমার কথা শুনবে না তুমি?”

ব্যস! নির্বাণের এতটুকু কথাই যথেষ্ট ছিল স্পর্শীকে বাধ্য করতে। স্পর্শী চোখ টান টান করে তাকায়৷ মিহি কন্ঠে বলে, “যাচ্ছি।”

স্পর্শী অবচেতন মনে হাতের উপর ভর দিয়ে নামতে নিলে নির্বাণ বলে উঠে, “আরেহ কি করছো? হাতে জোর দিচ্ছ কেন?”

স্পর্শী ভড়কে উঠে। চটজলদি তাকায় বা হাতের দিকে। সে বেমালুম ব্যথার কথা ভুলে বসেছিল। মনে ছিল না বিধায় হয়তো দহন যন্ত্রণাও অনুভব হয়নি। মনে পড়েই যেন জ্বালা বাড়লো। হাতের চামড়া টানছে খুব। স্পর্শী ঠোঁট কাঁমড়ে সহ্য করে সবটা। অতঃপর তার খেয়াল হয়, ক্ষতস্থানটা তার শুভ্র কাপড়ে বাঁধা। খুব সূক্ষ্মভাবে, নিবিড়ভাবে। স্পর্শীর কপালের মধ্যখান সংকীর্ণ হয়ে আসে। সে নির্বাণের দিকে তাকায়। বুঝতে আর দেরি নেই তার হাতটি কে গজ কাপড় দিয়ে বেঁধে দিয়েছে। নির্বাণ শান্ত কন্ঠে বলে, “আসো! আমি তোমাকে ওয়াশরুমে নিয়ে যাচ্ছি৷”

কথাটা বলে নির্বাণ স্পর্শীকে ধরে। তাকে ধীরে-সুস্থে বিছানা থেকে নামিয়ে ওয়াশরুম পর্যন্ত দিয়ে আসে। বলে, “হাতটা সাবধানে রেখ৷”

স্পর্শী মাথায় নাড়ায়। ফ্রেশ হয়ে আসতেই নির্বাণ স্পর্শীকে নিজের সামনে বসায়। হাত প্লেট নিয়ে ভাত মেখে স্পর্শীর মুখে তুলে দেয়। বলে, “হা কর।”

স্পর্শী চোখ বড় বড় করে অনাবরত নেত্রপল্লব ফেলে। ঘটনাক্রমে বুঝতে পেরে সে মাথা নুয়ে ফেলে। বলে, “ডান হাত ঠিক আছে আমার। আমি নিজ হাতে খেতে পারব। আপনার কষ্ট করতে হবে না।”

নির্বাণ রোষানল দৃষ্টিতে তাকায়,”এত বুঝতে বলা হয়নি তোমায়। যেটা বলেছি সেটা কর।”

স্পর্শী দ্বিতীয়বার কথা বলার জন্য মুখ খুলতেই নির্বাণ ভাতের দলাটা পুরে দেয় তার মুখে। স্পর্শী উপায়ন্তর না পেয়ে খেতে শুরু করে। নির্বাণও কথা না বাড়িয়ে স্পর্শীকে খায়িয়ে দিতে মনোযোগী হয়৷ স্পর্শী বলে, “আপনি খাবেন না?”

“পরে খাব আমি। তুমি খাও।”

হঠাৎ স্পর্শীর মনে এক প্রশ্ন খেলে যায়, তার হাত থেকে তো পাতিল পড়ে গিয়ে সকল ভাত নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাহলে ভাত রাঁধলো কে? নির্বাণ? স্পর্শী জিজ্ঞেস করে ওঠে, “ভাত কে করেছে? আপনি?”

নির্বাণ এক শব্দে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ।”

স্পর্শী বিস্মিত হয়, “আপনি রান্নাও জানেন?”

নির্বাণ ভাত মাখাতে মাখাতে বলে, “তেমন না। ভাত,ডাল,ডিম ভাজি করতে জানি শুধু। মা শিখিয়েছিলেন।”

“অহ।”

নির্বাণ উত্তর দেয় না৷ নীরবে স্পর্শীকে খায়িয়ে দিতে থাকে৷ নির্বাণের হাবভাবেত পরিবর্তন নজর কাড়ে স্পর্শীর। মনে প্রশ্ন জাগে তখনই, “নির্বাণ কি তার উপর রেগে আছে?” উত্তর পরিষ্কার৷ নির্বাণ রেগে আছে তার প্রতি। তাও ভীষণভাবে। তার মুখের অভিব্যক্তি স্পষ্ট জানান দিচ্ছে কথাটা। স্পর্শীর ইচ্ছে করলো নির্বাণকে প্রশ্ন করার কিন্তু সাহস হলো না। সে নির্বাণের ভয়াবহ রাগ সম্পর্কে অবগত৷ যদিও বিয়ের পর এই পর্যন্ত তার সাথে নির্বাণ সেরকম রাগ দেখায়নি তবুও কখন মোড় কোন দিকে ঘুরে যায় বলা তো যায় না। স্পর্শী তপ্তশ্বাস ফেলে চুপচাপ বাকি খাবারটুকু খেয়ে নেয়।
খাওয়া শেষে নির্বাণ স্পর্শীর দিকে পানি এগিয়ে দেয়। স্পর্শী পান করার পর মুহূর্তে নির্বাণ রাশভারি কণ্ঠ তার কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হয়, “সাবধানে কাজ করতে শিখো। ব্যথা তোমার একার না অন্যেরও হয়। তাই বলছি, তোমাকে যেন আমি পরবর্তীতে কখনো রান্না করতে না দেখি। নাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না। এন্ড আই মিন ইট।”

শীতল কন্ঠে বলা বাক্যসমূহ প্রখর, শাণিত শোনায়। রন্ধ্রের উষ্ণ রক্ত শৈথিল্য করতে এতটুকুই যথেষ্ট। স্পর্শী মাথা দুলায়। আপাতত নির্বাণের কথায় সায় জানানো ছাড়া তার কোন উপায় নেই। নির্বাণ এবার উঠে দাঁড়ায়। রুম থেকে প্রস্থান করার প্রস্তুতি নিয়ে বলে, ” কাল সকালে ডাক্তারের কাছে যাবে আমার সাথে। হাতটা বেশ বাজেভাবে পুড়ে গিয়েছে। এভাবে সারবে না।”

স্পর্শী কিছু বলার পূর্বেই নির্বাণ কক্ষ ত্যাগ করে। বাহিরে এসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। স্পর্শীর হাতের চামড়া যে খানিকটা উঠে গিয়েছে সেই কথা চেপে যায় সে। আপাতত আর টেনশন বাড়াতে চাচ্ছে না। তখন বাসায় কোনপ্রকার সরঞ্জামাদি না থাকায় নির্বাণ দারোয়ানকে বলে সেগুলো আনায়। অতঃপর স্পর্শীর হাত ক্লিন করার সময় দেখতে পায় মাঝ দিয়ে চামড়া কিছুটা উঠে গিয়ে চারপাশে কালসিটে হয়ে গিয়েছে। ফোস্কা পড়েছে বাজেভাবে৷ বার্ণ ক্রীম লাগাতেও নির্বাণের হাত কেঁপেছিল তার ঠকঠক করে। চোখ জ্বালা করছিল তীব্রভাবে।

____________________

ফোন বেজে চলেছে প্রায় মিনিট ধরে। কিন্তু তুলছে না কেউ। এমন নয় যে আশেপাশে মানুষ নেই বা রিংটোন শুনছে না কেউ। শুনছে তবে ইচ্ছে করেই ধরছে না। শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিক৷ অবশেষে সপ্তমবারের মত ফোনটি বেজে উঠতেই কলটি রিসিভ করা হয়। অপরপাশ থেকে দৃঢ় এক পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে আসে, “আমার ফোন ধরছো না কেন তুমি? কতবার কল করেছি আমি সে হিসাব আছে?”

মানবীটি কথা বলে না। নিরুত্তর থাকে। কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে অপরপাশ থেকে অধৈর্য যুবকটি পুনরায় বলে ওঠে, “কথা বলছো না কেন তুমি? স্পৃহা কথা বল। ফোন ধরছিলে না কেন আমার?”

স্পৃহা নির্বিকার থাকে, “আপনার কল যে আমার ধরতেই হবে এমন কথা ছিল কি? ছিল না তো, তাহলে? ”

নাহিদ থমকায়। কণ্ঠস্বর নামিয়ে বলে, “কথা তো আমাকে কষ্ট দেওয়ারও ছিল না। তাহলে দিচ্ছ কেন?”

“আপনি যে দিচ্ছেন সেটার বেলায় কিছু না? আমি দিলেই দোষ?”

“আমি তোমায় কষ্ট দেয়নি। আর না কখনো দিব। তুমি শুধু একবার আমাকে এক্সপ্লেইন করার সুযোগ দাও, আমি বুঝিয়ে বলছি সব।”

স্পৃহা তেঁতে উঠে বলে, “কি বুঝাবেন আর আপনি আমাকে? সবকিছু তো জানা আমার।”

নাহিদ কাতর কন্ঠে বলে, “তুমি একপাক্ষিক জানো। যেটা সম্পূর্ণ সত্য না, এর উর্ধ্বেও অনেক কিছু জানার আছে তোমার।”

“আর কিছু জানার প্রয়োজন নেই আমার। যতটুকু জেনেছি তাই অনেক। আর সহ্য করার ক্ষমতা নেই আমার। আমাকে এখন আমার মত থাকতে দিন।”

নাহিদ কন্ঠস্বর উঁচিয়ে বলে, “আর কত দিব? একমাস সময় কি খুব বেশি নয়? প্রথম দিকে বুঝবে না বলে এতটা সময় দিয়েছি, পরিস্থিতি ঠান্ডা হওয়ার অপেক্ষায়। কিন্তু তুমি এখনো আমার কথা শুনতে নারাজ। করবোটা কি আমি? হাল ছেড়ে বসে থাকব?”

“হাল ধরে রাখতে বলেনি কেউ আপনাকে। ছেড়ে দিন। আর একটা কথা, আমি আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক না। তাই পরবর্তীতে আমাকে আর ফোন করবেন না।”

কথাটা বলে স্পৃহা নাহিদ আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিয়ে ফোনটা অফ করে পাশে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। সব বিষাক্ত লাগছে এখন তার কাছে। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা যেন তার। নিজের অস্থির মনকে কাবু করতে না পেরে ডুকরে কেঁদে উঠে সে। নিজের রাগ, দুঃখ সব একসাথে বিসর্জন দিতে থাকে। এদিকে, নাহিদ হাতে ফোন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার সামনের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে হতাশাজনক নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সে। হরিদ্রাভ আলো মাথায় নিয়ে হাঁটা দেয় নিজ পথে। আফসোস! স্পৃহা জানলোও না দীর্ঘ একঘন্টা যাবৎ ছেলেটা তার বাসার নিচেই দাঁড়িয়ে ছিল। তার সাথে কিঞ্চিৎ পরিমাণ কথা বলার আশায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here