চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব -৩৬+৩৭+৩৮

#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩৬

“স্পর্শী আমার বিয়ে করা স্ত্রী। সি ইজ দ্যা ওয়াইফ অফ নির্বাণ সাইয়্যেদ।”

কথাটি যেন সকলের কর্ণকুহরে বজ্রনির্ঘোষের ন্যায় তরঙ্গিত হলো। আশ্চর্যান্বিত ভাব ভর্তি হলো দৃষ্টির কানায় কানায়। ওষ্ঠ্যদ্বয়ের মাঝে কিঞ্চিৎ দূরত্ব বিদ্যমান। স্পর্শীর অবস্থাও বিপরীতমুখী নয়। সে দৃষ্টি তুলে নির্বাণের পানে নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এমন কিছুর প্রত্যাশা সে কোন কালেই করেনি। আর করবেই বা কি করে? নির্বাণের ব্যক্তিত্ব তো কহে বলে বেড়ানোর মত নয়। সে তার জীবন অত্যন্ত একান্ত রাখতে পছন্দ করে। নির্বাণের নাম আর শিক্ষাগত যোগ্যতা ব্যতীত কেউই তার ব্যাপারে সামান্যটুকু তথ্য জানে না। এমনকি, তার কলিগরা পর্যন্ত না। ক্লাসে বা স্টাফরুমে কেউ যদি কখনো তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন করেও থাকে তাহলে নির্বাণ সে-টা সুক্ষ্মভাবে এড়িয়ে চলে। সেখানে আজ সে নিজ থেকে সকলের সামনে স্পর্শীকে নিজের স্ত্রী বলে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, বিষয়টা এলাহি কান্ডের ন্যায় ঠেকলো সকলের নিকট৷ তবে, অবিশ্বাসের এক ছাপ তখনও বিদ্যমান সকলের মাঝে। অকস্মাৎ কেউ একজন চিত্তে সাহস জুগিয়ে বলে উঠলো, “আপনি যে সত্য বলছেন সেটা কিভাবে বিশ্বাস করি আমরা? নিজের অবৈধ সম্পর্ক লুকাতে মিথ্যাও তো বলতে পারেন আপনি।”

যুবকটির সাহসিকতা দেখে সকলেই হতবাক, ভাবলো এবার নির্বাণ নিশ্চয়ই রাগে ফেটে পড়বে। তিক্ত মুখের বাণীতেই বিষিয়ে দিবে টগবগে যুবকটির চঞ্চলতা। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে নির্বাণ আজ রাগলো না। শীতল নয়নে তাকালো সে। নির্মল কন্ঠে সকলের দিকে একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, “সোশ্যাল মিডিয়ায় যখন আমাদের ছবি সেই জঘন্য শিরোনাম সহকারে ভাইরাল হলো তখন সবাই নিমিষেই সেটা বিশ্বাস করে ফেলেছিল। কেউ তো একবারও প্রশ্ন বা যাচাই করতে আসেনি সেই পোস্টটার সত্যতা কতখানি তাহলে এখন এই প্রশ্ন আসছে কেন?”

কিয়ৎকালের ব্যবধানেই সকলের মুখশ্রী বিবর্ণ আকার ধারণ করলো৷ কণ্ঠনালিতে বাঁধলো হরতাল। নির্বাণ স্মিত হাসলো, পুনরায় প্রশ্ন করলো, “এখন কেন প্রমাণ চাচ্ছে সবাই? যেখানে আমি আগেই বলেছি ছবিগুলো সত্য আর আমরা দুইজন বিবাহিত সেখানে দ্বিধায় থাকছে কেন? তার মানে কি বুঝব আমি, সোশ্যাল মিডিয়ায় র‍্যান্ডমি যে কেউ এসে যা ইচ্ছা তাই লিখে পোস্ট করুক না কেন সেটা শতভাগ গ্রহণযোগ্য এবং বিশ্বাসযোগ্য কিন্তু যাকে আপনারা দীর্ঘ সময় ধরে দেখে আসছেন তার বলা কথা নয়? প্রমাণ দিয়ে নিজের কথা বিশ্বাসযোগ্য করাতে হবে? এমন পার্থক্য কেন? এখন গিয়ে প্রশ্ন কেন উঠে, মানুষটার বলা কথাগুলো কতখানি সত্য? আদৌ সত্য তো?”

এবার নীরবতার পরিমাণ যেন দৃঢ় হলো। উত্তর দেওয়ার মত বর্ণ,শব্দ,বাক্য জমা নেই ভান্ডারে। নির্বাণ এবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো, “সবটা সত্য নাকি মিথ্যা এই প্রশ্নটা এখন কেন আসে? আগে কেন পোস্টটা দেখামাত্র এই প্রশ্নটা মাথায় আসেনি? কেউ কেন কোন যাচাই করোনি? আমার জানা মতে, ছবিতে তো অশ্লীল কিছু ছিল না, তাহলে তখন এই প্রশ্ন মাথায় না আসার কারণ কি?”

এবারও নিরুত্তর রইলো সবাই

কি উত্তর নেই কারো কাছে? এর কারণ জানো কেন? কারণ হচ্ছে আমরা বাঙালি জাতি, আমরা খেটে খেতে নয় বরং আমাদের সামনে একটা জিনিস সুন্দর করে সাজিয়ে-টাজিয়ে পরিবেশন করে দিলেই সে-টা আমরা আহার করতে পছন্দ করি। হোক সে-টা ভালো বা মন্দ। এখানেও বিষয়টা একই। তোমাদের সকলের সামনে সাজিয়ে-গুছিয়ে একটা জিনিস পরিবেশন করা হয়েছে আর তোমরাও সেটা অনাহারে আহার করেই চলেছ। সমালোচনা করে, চারদিকে শেয়ার করতে তো একদমই ভুল-নি। আর মূল জিনিসটাকে চার ডিগ্রি বাড়িয়ে বলা তো আমাদের বাঙালি জাতির জন্মগত অভ্যাস। সেটা নাই বা বলি। কিছু সময়ের ব্যবধানে কোন বিচার-আচার না করেই চরিত্রহীন আর চরিত্রহীনা ট্যাগটা লাগিয়ে দিয়েছ। অশ্রাব্য ভাষায় যা নয় তাই বলে গিয়েছ। তোমাদের আচরণ দেখে যা বুঝেছি, এইটাই হচ্ছে বর্তমানে মর্ডান জাতির নমুনা।”

এতটুকু বলে নির্বাণ স্থির হলো৷ সকলের মাথা তখন নত। তবে লজ্জায় নাকি সংশয়ে তা বুঝা গেল না। নির্বাণ সেদিক তাকিয়ে বলল, ” তোমাদের মন-মানসিকতা ঠিক কোন পর্যায়ে চলে গিয়েছে সে-টা ফেসবুকে ঢুকে কমেন্ট বক্সে গেলেই দেখা যায়। না বুঝো তোমরা কোন সম্পর্কের শুদ্ধতা, না চিনো কোন সম্পর্কের মাধুর্যতা। বুঝো শুধু ফেসবুক। কোন একটা পোস্ট দেখেছ তার ভিত্তিতেই মানুষের চরিত্র কেমন সে-টা নির্ণয় করে ফেলছ, অথচ জানার চেষ্টা-ই করছো আসল ঘটনাটা কি? দোষ অবশ্য তোমাদেরও না, এই জেনারেশনের-ই। যেখানে আজ কাল ভাই-বোন একসাথে বের হতে পারে না, একসাথে বের হলেই তাদের নোংরা চোখে দেখা হয় সেখানে আমাদের তোমরা রেহাই দিবে ভাবাই বিলাসিতা।”

নির্বাণ এবার স্পর্শীর ধরে রাখা হাতটা টেনে তাকে তার পাশে এনে দাঁড়ালো। অতঃপর স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বলল, “যাই হোক, অনেক বলে ফেলেছি আর কিছু বলার ইচ্ছা বা শক্তি কোনটাই আমার নেই। তবে, সময় মত সব প্রমাণ হাতের নাগালে পেয়ে যাবেন আপনারা, সে সাথে আমাদের কাবিননামার ছবিও। স্পর্শী আমার বউ এটা নিয়ে কারো মনে সন্দেহ থাকুক তা আমি চাই না। আর হ্যাঁ, পরবর্তীতে যেকোনো ঘটনায় নিজের বিচার-বুদ্ধি পাশে না রেখে প্রয়োগ করতে শিখো। নিজের মনুষ্যত্ব বিলীন হয়ে যেতে দিও না। দ্যাটস অল!”

নির্বাণের ঠান্ডা মাথায় বলা প্রত্যেকটা কথা সৈন্যের ধাঁরালো ন্যায় আঘাত করলো সকলের মস্তিষ্কে। প্রভাব ফেললো মনোবৃত্তিতে৷ অনুশোচনায়, দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে থাকলো বক্ষঃস্থলটি। যার সবটাই নির্বাণ বেশ বিচক্ষণতার সাথে করেছে। স্পর্শীকে নিয়ে উপহাস এবং গালমন্দ করা মানুষদের মধ্যে তার-ই ক্লাসমেটদের সংখ্যা ছিল বেশ৷ যা নির্বাণের দৃষ্টি এড়ায়নি। তাই এর শোধ নিয়েছে এভাবে। প্রত্যক্ষভাবে নির্বাণ তাদেরকে নিজেদের কর্মের শাস্তি না দিলেও পরোক্ষভাবে মানসিক অশান্তিতে এবং তীব্র অনুশোচনায় ফেলে দিয়েছে ঠিকই।নির্বাণের কথা বলার ভঙ্গিমা এমনই যে তার কথা উপেক্ষা করার জোড় কারোই নেই। যদিও সকলের ক্ষেত্রে একই মনোভাব কাজ করে না, তবে তার কথাগুলো কোথাও না কোথাও গিয়ে ঠেকেছে ঠিকই৷ যেটা কি-নাই ছিল নির্বাণের মূল লক্ষ্য।

এদিকে, নিজের বক্তব্য শেষ করেই নির্বাণ যেভাবে স্পর্শীর হাত ধরে এসেছিল সেভাবে বেরিয়ে গেল। স্পর্শী তখনও কোন ঘোরের মাঝেই ছিল, সবকিছুই স্বপ্নের মত লাগছে তার। নির্বাণ যে তার জন্য নিজের কনফর্টজোন থেকে বেরিয়ে এসে স্ট্যান্ড নিয়েছে, কথা বলেছে তা অবিশ্বাস্য ব্যতীত কিছুই মনে হচ্ছে না। কেন না, নির্বাণ কখনো কারো নিজেকে এভাবে তুলে ধরে না। আজ সে এমনটা করেছে শুধুমাত্র তার জন্যই। এ থেকেই বুঝা যায় নির্বাণের জীবনে তার গুরুত্ব ঠিক কোথায় অবস্থিত। স্পর্শীর দৃষ্টি এবার প্রফুল্লচিত্তে আবৃত হলো। অধরদ্বয়ের কোণে জায়গা পেল এক ফালি মিষ্টতা। সকল মান-অভিমান, অভিযোগ গলে পড়তে থাকলো নিজ দায়িত্বেই।

_______________

ওয়েটিং রুমের কাউচের উপরে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বসে আছে রুদ্র। পাশের চেয়ারে তার বন্ধুরা, সকলের চোখে-মুখেই নিঃস্পৃহ ভাব। সকলের কাছ থেকেই মোবাইলফোন নিয়ে বন্ধক রাখা হয়েছে, যার দরুন বাহিরে কি হচ্ছে সে সম্পর্কে তারা মোটেও অবগত নয়। দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করার ফলে তিক্ততা এসে পড়ে সকলের মাঝে। নিজের মনের ঝাল মিটাতে অতি নিম্ন ভাষায় যে যাই পারছে তা বলে চলেছে নির্বাণ এবং স্পর্শীকে নিয়ে। রুদ্রও তাল মিলাচ্ছে তাদের সহিতে। তাদের মুখের ভাষা এতটাই নিম্ন যে সাধারণ কেউ শুনলে কর্ণকুহর হতে রক্তের বন্যা বইতে সময় লাগবে না। এতটাই অশোচনীয় কথাবার্তা চলছিল তাদের মাঝে। কিয়দংশ সময় এভাবেই অতিক্রম হয়ে যেতে ওয়েটিং রুমের দরজা খুললো। দরজা খোলার শব্দে সকলের নেত্র গিয়ে আটকালো সেদিক। ধূসর-কালো রঙের স্ন্যাকারসে মৃদু শব্দ তুলে এগিয়ে এলো নির্বাণ। নির্বাণকে দেখেই রুদ্র অবজ্ঞাসূচক হাসি হাসলো। নিজের জায়গা ছেড়ে দিয়ে উঠে সম্মুখে দাঁড়ালো নির্বাণের। বলল, “কি ব্যাপার স্যার? হঠাৎ এখানে আসলেন যে? কোন বিশেষ ব্যাপার-স্যাপার আছে নাকি?”

নির্বাণ স্মিত হাসলো, “তা অবশ্য আছে বটেই। নাহলে আমার ক্লাস এখনো এত লো হয়নি যে তোমার সাথে আমার দেখা করতে আসতে হবে।”

কথাটা শুনেই রুদ্রের অভিব্যক্তিতে ক্রোধাগ্নি দেখা দিল। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “সেটা দেখতেই পাচ্ছি। তবে, একটা বিষয় কি জানেন তো? আপনার আর আপনার প্রিয়তম ছাত্রীর কুকর্মের বনাম শহর। যেটা এখন চাইলেও আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না। বলি কি, আর কাউকে পেলেন না ভালো? শেষে কি-না একটা নষ্ট-আ….”

নির্বাণ মুহূর্তে কন্ঠস্বর দ্বিগুণ করে বলল, “মুখের ভাষা ঠিক রেখে কথা বলো, নাহলে পরিমাণ যা হবে তা তোমার সহ্যসীমার বাহিরে চলে যাবে।”

“বাব্বাহ! এত ভালোবাসা? আ’ম ইম্প্রেসড। তবে নিজের ভালোবাসা একটা সস্তা মেয়ের উপর অপচয় করছেন না? যে নাকি আপনাকে ইউস ছাড়া কিছুই করছে না। জানেন তো, মেয়েটি বিবাহিত? নিজের কার্য হাসিল করতেই আছে আপনার সাথে। খামাখা ওর জন্য নিজের সম্মানটা হারালেন আপনি।”

কথাটা বলে রুদ্রে আফসোসের সুরে ‘চ’ উচ্চারণ করার মত শব্দ করতে থাকলো। নির্বাণ তা দেখে বলল, “আসলেই তোমাকে দেখে মুখের ভাষা সভ্য রাখা দায়। অকথ্য ভাষা মুখ দিয়ে বেরিয়েই আসে।”

“সেম টু ইউ! আপনাকে তো স্যার হিসাবে কল্পনা করতেও ঘৃণা করে এখন আমার। না জানি এত সম্মান এখনো কেন দিচ্ছি আপনাকে।”

রুদ্রের গা ছাড়া ভাব। নির্বাণ তা দেখে রুদ্রের নিকটে এসে তার কানের সামনে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে, “বলার আর কিছু সময় বাকি আছে তোমার হাতে, বলে নাও। বাট আফটার এ হোয়াইল দ্যা রিয়্যাল কাউন্টডাউন উইল বি স্টার্টেড।”

কথাটা শুনে রুদ্রের ভ্রু কুঁচকে এলো, “মানে কি?”

“আগুনে হাত দিয়েছ তুমি, সুতরাং হাত পোড়া এখন অনিবার্য। অপেক্ষা কর, নিজের সকলের কর্মের ফল পাবে তুমি।”

কথাটা বলেই নির্বাণ সরে এলো এবং দরজার দিকে অগ্রসর হলো। যেতে যেতে আনমনে বলে উঠলো, “আমার স্পর্শীকে নিয়ে বলা প্রত্যেক কথার শোধ আমি নিবই। এভাবে ছাড় পাবে না তুমি। আই উইল মেক সিউর ইউ মাস্ট বি ট্রাবল ইন দ্যা লং রান।”
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩৬ [বর্ধিতাংশ]

রৌদ্রতপ্ত অম্বরে স্থিরচিত্তে চলাচল করছে তুলোরাশির দল। দূর থেকে দেখতে তাদের একদম হাওয়াই মিঠাই-এর মত লাগছে। শান্ত,মিষ্টি। সারি সারি গাছ রাজ্যসম অভিমান নিয়ে মাটির গহীনে খুঁটি শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। অনিলের অভাবে নড়চড় নেই পাতার। নৈঃশব্দ্য, নিস্পন্দ পরিবেশ, তবুও অদৃশ্য এক আলোড়নের রেশ বৃদ্ধি পাচ্ছে সকলের অভ্যন্তরে প্রখরভাবে। ঝড় বইছে সামাজিক মাধ্যমে। ঈষৎ প্রহর পূর্বে নির্বাণের বলা প্রত্যেক কথা এখন সকলের কর্ণগহ্বরে ঝংকার তুলছে। সকলের মুঠোফোনের কৃত্রিম পর্দায় এখন শুধু নির্বাণ আর নির্বাণ। যদিও বা অনেকে অনেকভাবেই নির্বাণকে তুলে ধরছে তবুও সেগুলো বেশিরভাগ তার পক্ষেই৷
তখন নির্বাণের বক্তব্য অনেকেই ভিডিও করে নিয়েছিল এবং নির্বাণ যাওয়ার পর পরই কিছুটা কাটসাট করে জাবির মেইন গ্রুপে পোস্ট করে দেয়। সেখান থেকে আবার বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের পাবলিক, পারসোনাল গ্রুপে ভিডিওটা ছড়িয়ে পড়ে এবং চোখের পলকেই ভাইরাল হয়ে যায়। পরিষ্কার হয়ে যায় স্পর্শী ও নির্বাণের মধ্যকার সম্পর্ক। মুখে মুখেও গুঞ্জন তুলতে থাকে নির্বাণ,স্পর্শীর নাম। কালক্রমে খবরটা রুদ্রের নিকট এসেও পৌঁছালো। তবে অবাক হওয়া বা প্বার্শপ্রতিক্রিয়া দেওয়ার আগেই ডাক পড়লো ভিসির রুমে। বাধ্য হয়েই রুদ্র এবং তার বন্ধুমহলের সকল এগিয়ে গেল ভিসির রুমে। যেতে যেতেই সকলে বুঝে নিল, এখন ঠিক কি হতে চলেছে। কেন না, এসব সাধারণ ঝগড়াঝাটির বিষয় ডিপার্টমেন্টের হেডরাই সমাধান করে থাকে। কিন্তু এবার ভিসি যেহেতু নিজ থেকে বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করছেন সেহেতু জল অনেক দূর গড়িয়ে গিয়েছে। পুরো ঘটনাই এখন তাদের বিপক্ষে।
ভিসির রুমে আসতেই সকলে নির্বাণ,তাপসি, ডিপার্টমেন্ট হেডকেও দেখতে পেল। সাথে আরও অপরিচিত কয়েকজন এবং নিজ নিজ বাবা-মাকেও। মুহূর্তে সকলের আত্মার পানি শুকিয়ে এলো। ইতিমধ্যে সকলের বাবা-মাকে যেহেতু ডাকা হয়েছে সেহেতু আজ কারোই রেহাই নেই৷ বড় কিছু হতে চলেছে সামনে। তপ্ত নিশ্বাস ফেললো সকলে। রুদ্রদের দেখে তাপসি মিস তাদের সামিদের পাশে দাঁড়াতে বললেন। সামিরা নির্বাণদের উল্টোপাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। তাপসি মিসের কথা অনুযায়ী রুদ্ররা সামির পাশে মাথা নত করে দাঁড়ালো। ভিসি
একনজর সকলের দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ভার্সিটিতে উশৃংখল ব্যবহার করার কারণ কি জানতে পারি?”

রুদ্র নির্বিকার ভঙ্গিতে নিজের পক্ষ নিয়ে নিজেই বলতে শুরু করলো এবং সব দোষ সামিদের উপর চাপিয়ে দিতে চাইলো। সামি এবং মাহিন এর প্রতিবাদ করে উঠলেই ভিসি বলে উঠেন, “সবাই চুপ! সকলকে বলার সুযোগ দেওয়া হবে।”

কথাটা শুনে সামি আর মাহিন ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে থাকলো। আর এদিকে রুদ্র সুযোগ পেয়ে নিজেকে রক্ষা করতে বানোয়াট এক কাহিনী শুনালো সকলকে। যার মধ্যে কি-না সম্পূর্ণ দোষটাই দেখালো সামিদের। অতঃপর সামিদের যখন বলতে দেওয়া হলো তারা সত্য ঘটনাটাই বলল। যা কি-না ছিল রুদ্রের বলা কাহিনীর সম্পূর্ণ বিপরীত। দুই পক্ষের কথা শুনে তার বা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা টিচারসগুলোর দিকে তাকালো, “এবার আপনারা বলুন আসল ঘটনা কি? মিথ্যে কে বলছে এখানে?”

নির্বাণ বলল, “কে মিথ্যে বলছে তা না হয় আপনি নিজেই দেখে নিন স্যার।”

কথাটা বলে নির্বাণ এগিয়ে এলো। ভিসির পাশে এসে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করে একটা ভিডিও ক্লিপ ছেড়ে দিল সে। যেটাতে কি-না সকালের সম্পূর্ণ ঘটনা স্পষ্টভাবে রিকর্ডেড ছিল। আর এতে পরিস্ফুট বুঝাই যাচ্ছিল রুদ্র স্পর্শীকে বুলি আর হ্যারাস করছিল। তারই প্রতিবাদ করতে সামি,মাহিন এগিয়ে আসে। তারা প্রথমে ওয়ার্নিং দিলেও রুদ্র তাদের উসকিয়ে দেয় এবং একটা ঝগড়া বিবাধ সৃষ্টি করে। এর মাঝে সাধারণ অনেকে আহত হয় প্লাস স্পর্শীও মাথায় আঘাত পায়। সবটা দেখে ভিসির চোখের রেখা সরু হয়ে আসে। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় রুদ্রের দিকে, “এসব কি?”

রুদ্র আমতা আমতা করল, “না মানে স্যার..”

পরিষ্কারভাবে কিছু বলার পূর্বেই ভিসি তেজি কন্ঠে বলে উঠলেন, “ভার্সিটিতে এমন ধরনের বিহেভিয়ার গ্রহণযোগ্য না তা কি জানো না? হ্যারাসিং, বুলিং, ফাইটিং যে নিষেধ এখানে তা কি ভুলে গিয়েছ? তার উপর আমার সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যা বলার সাহস কিভাবে হয় তোমার?”

রুদ্র কিছু বলার আগেই নির্বাণ বলে উঠে, “স্যার! রুদ্রের কীর্তিকলাপ এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। তার বিরুদ্ধে আরও কিছু কমপ্লেইন আছে।”

“কি? দেখাও!”

নির্বাণ মাথা দুলিয়ে একটা ফাইল খুলে ভিসির সামনে টেবিলে রেখে আসে। ভিসি সেটা হাতে নিয়ে চোখ বুলাতেই নির্বাণ বলতে শুরু করলো, “রুদ্রের এরকম বুলিং-র‍্যাগিং, ঝগড়া এবং মারপিট করার আরও পুরোনো রেকর্ড এন্ড কমপ্লেইন আছে। সে সাথে, রুদ্র যে মাদকাসক্ত সেটার প্রমাণও এখানে দেওয়া আছে। আপনি চাইলে দেখতে পারেন।”

নির্বাণ সবটাই খুব সুন্দর করে গুছিয়ে-টুছিয়ে ভিসির নিকট সব তথ্য প্রদর্শন করেছিল বলে তার কোন কিছু বুঝে উঠতে সময় লাগলো না। সে সাথে, অথোরিটি যে এতদিন টাকা খেয়ে রুদ্রকে স্বাধীনতা দিয়ে আসছিল সেই তথ্যও ছিল সেখানে। রিপোর্টটা দেখে বুঝা কষ্টসাধ্য নয় যে, খুব আগে থেকেই এই রিপোর্ট তৈরি করা হচ্ছিল। কেন না, এখানকার সকল তথ্য এতটা সুক্ষ্ম আর পাকাপোক্ত যে তা অদেখা করা একবারেই সম্ভব নয়। ভিসি সাহেব বেশ অভিনিবেশের সহিত সবগুলো পয়েন্ট পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন।
এরই মাঝে, রুদ্রের বাবা-মারা প্রতিবাদ করে উঠেন। নিজের ছেলের পক্ষ নিয়ে বলতে গেলে তাপসি মিস এবং আরেকজন স্যার মিলে তাদের চুপ করি করিয়ে দেন।
অন্যদিকে, সব দেখে ভিসি তৎক্ষনাৎ নিজের সিদ্ধান্ত জানালেন, “তোমাকে বহিষ্কৃত করা হচ্ছে রুদ্র। ইউ আর রাষটিগেট রাইট নাও। তোমার মত স্টুডেন্ট এই ভার্সিটিতে থাকুক তা আমি চাই না। সো ইউ মে ক্যান লিভ নাও৷ আর বাকি সবাইকে দুই সপ্তাহের জন্য সাসপেন্ড করা হলো। যেহেতু তোমরা আজকের ঝগড়া,মারপিটের অংশ ছিলে সেহেতু তোমাদের এই শাস্তি প্রাপ্য।”

কথাটা বলে ভিসি ক্ষান্ত হলেন। রুদ্র করুণ কন্ঠে বলে উঠল, “আপনি এমনটা করতে পারেন না স্যার। আমাকে আরেকটা সুযোগ দিন, আমি নিশ্চিত ভালো হয়ে দেখাব। আর কোন কমপ্লেইন পাবেন না আপনি।”

রুদ্রের সাথে রুদ্রের বাবা-মাও একই কথা বলেন, সুযোগ চাইলেন একটা। তবে ভিসির মন গললো বলে মনে হলো না। সে শুধু বললেন, “ইটস টু লেট নাও।”

কথাটা বলেই তিনি ডেক্স থেকে একটা কাগজ বের করে সেটাতে সাইন করে রুদ্রের দিকে এগিয়ে দিলেন এবং বললেন, “তুমি যেত পারো।”

“কিন্তু স্যার…”

রুদ্রের কথা বলার মাঝেই নির্বাণ বলে উঠে, “না স্যার! কাহিনি তো এখনো শেষ হয়নি। ওকে পুলিশে দেওয়া বাকি আছে।”

ভিসি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “পুলিশে দেওয়া বাকি আছে মানে?”

নির্বাণের কণ্ঠনালিতে খানিকটা আক্রোশ মিশিয়ে বলল, “ওর বিরুদ্ধে সাইবার-ক্রাইমের মামলা আছে। হি ইজ এ ব্লাডি ক্রিমিনাল।”
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩৭

নির্বাণ কণ্ঠনালিতে খানিকটা আক্রোশ মিশিয়ে বলল, “ওর বিরুদ্ধে সাইবার-ক্রাইমের মামলা আছে। হি ইজ এ ব্লাডি ক্রিমিনাল।”

কথাটা শুনে ভিসির কপালের ভাঁজ দৃঢ় হলো। কন্ঠটা উদগ্রীব শোনালো তার, “বলছ কি তুমি?”

প্রশ্নের বিপরীতে জবাব এলো এইটাই, “সাইবার ট্রাইবুনালকে খবর দেওয়া হয়েছে। তারা রাস্তায়, আসছে।”

নির্বাণের কথা শেষ হওয়ার পরমুহূর্তেই রুদ্র আত্মরক্ষার জন্য চেঁচিয়ে উঠে বলে, “মিথ্যে আরোপ সব। কিসের ক্রাইম,কিসের কি? কিছুই করিনি আমি। নির্দোষ আমি! আপনি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। এমন করতে পারেন না আপনি।”

নির্বাণ রুদ্রের অভিমুখ বরফের ন্যায় অতি শীতল দৃষ্টিপাত করে, “আমার কথা বাতাসে ভেসে বেড়ানোর মত নয়। যথেষ্ট প্রমাণ না থাকলে আমি কখনো কারো বিরুদ্ধে কথা বলি না। বাকি তুমি বুঝদার।”

নির্বাণের সুব্যক্ত কটাক্ষ ধরতে পেরে রুদ্রের মুখ পাংশুটে দেখালো। বিবর্ণ,করুণ অভিলাষ দৃষ্টিতে তাকালো নিজের বাবা-মায়ের পানে। কিঞ্চিৎ প্রত্যাশা নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, “কিসের প্রমাণ? আমি যেখানে কিছু করিনি সেখানে প্রমাণ কিসের? মিথ্যে বলা বন্ধ করুন। বাবা-মা তোমরা কিছু বলছ না কেন? আমি সত্যি কিছু করিনি৷ বিশ্বাস কর!”

“কে কি করেছে তা একটু পরই জানা যাবে। তোমার বলতে হবে না তখন, প্রমাণই সব বলবে।”

নির্বাণের কথা শেষ হতে না হতেই রুদ্রের মা রাবেয়া ইসলাম নিজের সন্তানের পক্ষ নিয়ে বলে উঠে, “আপনাদের কোথাও হয়তো বা ভুল হচ্ছে। আমার ছেলে মোটেও এমন না, আজ হয়তো সে ভুল করেছে কিন্তু সে কখনোই কোন অনৈতিক কাজ করতে পারে না৷ ওকে একটা সুযোগ দিন আপনারা।”

রুদ্রের বাবা ইকবাল শেখও রাবেয়া কথার সাথে তাল মিলান। নিজের সন্তানকে রক্ষা করতে নিজের সকল জোর দেখান তিনি। অবিলম্বে উগ্রবীর্য কন্ঠধ্বনিগুলো অনুদ্ধত পরিবেশটি কোলাহলে পরিপূর্ণ করে তুললো। ভারসাম্য রক্ষার্থে ভিসি রুদ্রের বাবা-মাকে তিনি বেরিয়ে যেতে বললেন সাথে অতিরিক্ত সকল মানুষজনকেও। আপাতত তিনি কোনরকমের হট্টগোল চাচ্ছেন না। তার নির্দেশে বাধ্য হয়ে সকলকে বেরিয়ে যেতে হলো। রুমে থেকে গেল শুধু রুদ্র,নির্বাণ,তাপসি আর একজন অচেনা ব্যক্তি। যদিও ইকবাল,রাবেয়া যেতে চাচ্ছিলেন না তাপসি ম্যাম তাদের জোড়পূর্বক বের করে দেন।
রুমের পরিবেশ আগের ন্যায় হতেই ভিসি নির্বাণকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আমাকে কোন কিছু না জানিয়ে সাইবার ট্রাইবুনালদের ডাকেন কিভাবে আপনি? কিসের ভিত্তিতে আপনি তাদের ডাকছেন? কি করেছে ও?”

ভিসি স্যারের কথা শুনে রুদ্রের বর্ণহীন মুখশ্রীটি ঈষৎ উজ্জ্বল দেখালো৷ চিত্তে প্রত্যাশার ক্ষীণ প্রদীপ জ্বলে উঠলো যেন। নির্বাণ মন্থর কন্ঠে প্রত্যুত্তর করলো, “রুদ্র সোশাল মিডিয়ায় ভার্সিটির গ্রুপে আমার ওয়াইফকে বুলি,হ্যারাস,মানহানি করার উদ্দেশ্যে কিছু ছবি ছেড়ে ছিল, যা এখন ভাইরাল। ভার্সিটির সকলেই এখন এসব নিয়ে কথা বলছে,কটুক্তি করছে। বিষয়টা এখন এত নিম্ন পর্যায়েই চলে গিয়েছে যে তারা সকলে আমার ওয়াইফের চরিত্রের উপর প্রশ্ন তুলছে।”

ভিসি বলল, “সেটা আপনার পার্সোনাল ইস্যু, আপনি কেন সেটা ভার্সিটির ভিতরে টানছেন? রুদ্রকে আপনার পুলিশে দেওয়ার হলে ভার্সিটির বাহিরে গিয়ে দিন, এখানে না। আপনি ট্রাইবুনালদের এখনই ফোন করে আসতে মানা করুন। আমি ভার্সিটির ভিতরে কোনরকম ঝামেলা চাচ্ছি না।”

“সরি বাট এইটা পার্সোনাল ইস্যু না। আমি আমার পার্সোনাল আর প্রফেশনাল লাইফ নিয়ে খুব সর্তক। আমি কখনো দুইটা মিক্সড আপ হতে দেই না। ইস্যুটা পার্সোনাল হলে আমি কখনোই ভার্সিটির ভিতরে এই কথা তুলতাম না। ট্রাইবুনালদের ডাকা তো দূরের কথা। কিন্তু জিনিসটা এখন আমার পার্সোনাল লাইফ কম, প্রফেশনাল লাইফে প্রভাব ফেলছে বেশি৷ তাই আমি বাধ্য হয়েছি এমনটা করতে। আর ইমার্জেন্সি ইস্যুতে টিচারদের অধিকার আছে পুলিশদের ডাকার।”

ভিসি উগ্রস্বর বলে উঠেন, “এটা আমার কাছে মোটেও ইমার্জেন্সি ক্যাস লাগছে না মি. নির্বাণ সাইয়্যেদ। ভার্সিটির এটার সাথে কোন সম্পর্ক নেই।আপনি পার্সোনাল লাইফের শত্রুতা এখানে টেনে আনছেন। তাও আমার পারমিশন ছাড়াই।”

নির্বাণের কপালে দৃঢ় ভাঁজ পড়লো, “বিষয়টা ভার্সিটির সাথে রিলেডেড না সেটা আপনি কিভাবে বলতে পারছেন? এই পুরো ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু ভার্সিটির গ্রুপ থেকেই। আমি এই ভার্সিটির শিক্ষক আর আমার ওয়াইফ এখানের স্টুডেন্ট, আমাদের দুইজনের অনুমতি ছাড়াই আড়াল থেকে ছবি তুলে সেটা গ্রুপে অতি নিম্নপর্যায়ে নিয়ে তুলে ধরা হয়েছে। বাজে কথা বলা হয়েছে, প্রশ্ন করা হয়েছে আমাদের সম্পর্ক নিয়ে। এমনকি, আমার ওয়াইফ ভার্সিটিতে আসলে তাকে অপমানিত,লাঞ্চিত করা হয়েছে সকলের সামনে। এমনকি আঘাতও করা হয়েছে। কলঙ্ক লাগানো হয়েছে আমাদের দুইজনের গায়ে। সম্মানহানি হতে হয়েছে আমাদের দুইজনকেই৷ আপনার ভার্সিটির শিক্ষক,স্টুডেন্টের মানহানি হচ্ছে,বুলি-হ্যারাস হচ্ছে সেটা এখন ভার্সিটির দেখার বিষয় নয় কি? নাম কিন্তু আমার একার না, ভার্সিটিরও হচ্ছে। ভেবে দেখুন একটু।”

কথাটা বলে নির্বাণ একটু দম নেয়। তারপর বলে, “এখনো বলবেন কি এইটা আদৌ ভার্সিটি ইস্যু না?”

ভিসি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “বিষয় যাই হোক, যেহেতু এখানে ভার্সিটির মানসম্মান জড়িত সেহেতু আপনাকে আগে আমাকে ইনফর্ম করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আপনি সেটা করেন নি। যদি এখন ভার্সিটির নাম খারাপ হয় তাহলে এর দায় কে নিবে? আপনার এই পদক্ষেপের জন্য আমি আপনাকে সাসপেন্ড করতে পারি বা চাকরি থেকে বের করে দিতে পারি সেটা কি জানেন?”

“সেটা আপনি করতে পারেন এতে আমার আপত্তি নেই। তবে তার আগে এই মানুষটাকে আইনের হাতে তুলে দিতে চাই, যত যাই হোক না কেন।”

নির্বাণের অনড় কথা শুনে ভিসি থমকালেন। অতঃপর কিছু বলার পূর্বেই সাইবার ট্রাইবুনাল টিম এসে হাজির হয় সেখানে। সাইবার টিমকে দেখে নির্বাণ এগিয়ে যায় এবং কথা বলে নিয়ে রুদ্রকে তাদের হেফাজতে নেওয়ার আহ্বান জানায়। সাইবার টিমও ফটাফট রুদ্রকে নিজের আন্ডারে নিয়ে তার হাতে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে দেয়। পালানোর সুযোগ ছিল না বিধায় রুদ্র পালাতে পারিনি,তবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে অযথা চেঁচিয়ে গিয়েছে ঠিকই। নির্বাণ কথা দীর্ঘ না করে তাপসী এবং অচেনা সেই ব্যক্তির কাছ থেকে তাদেরকে নিয়ে আপ দেওয়া সকল পোস্টের এবং শিরোনামের ছবির প্রিন্ট আউট তুলে দেয় একজন কর্মরত অফিসারের নিকট। অতঃপর একটা মেমোরি চিপ দেয় যেখানে রুদ্রের কর্মকাণ্ড, তাদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ পোস্ট-কথাবার্তার স্ক্রিনশট, স্ক্রিনভিডিও ছিল। সাথে আজকে সকালে ঘটে যাওয়া সম্পূর্ণ ঘটনার লাইভ ভিডিও-ও ছিল। এছাড়া আরও কিছু বুলি,হ্যারাসমেন্ট,এবিউজের রিপোর্ট, কমপ্লেইন ছিল সেগুলোও নির্বাণ অফিসারের নিকট সাবমিট করলো। চোখের পলকেই সকল প্রমাণ সাইবার ট্রাইবুনাল টিমের হাতে দিয়ে রুদ্রের উপর সাইবার বুলিং আর মানহানির মামলা পাকাপোক্তভাবে করে ফেলে নির্বাণ। ট্রাইবুনাল টিমও প্রমাণ সব বুঝে নিয়ে ভিসি এবং নির্বাণের মাধ্যমে কিছু ফরমালিটি পূরণ করিয়ে নেয়। আর জানান, কোনধরনের তথ্য লাগলে তারা যেন সাহায্য করতে আগ্রহী হয়। অতঃপর রুদ্রকে তারা নিয়ে যেতে নিলে নির্বাণ তাদের একটু অপেক্ষা করতে বলে এবং স্থিরচিত্তে রুদ্রের দিকে এগিয়ে যায়। রুদ্রের কান বরাবর মুখ রেখে বলে, “বলেছিলাম না, নিজের সকলের কর্মের ফল পাবে তুমি। নাও, হিয়ার ইজ দি লাস্ট চেকম্যাট।”

কথা বলে নির্বাণ রুদ্রের এমন অংশে আঘাত করল যা কি-না বর্ণনায় প্রকাশ করার মত নয়। তবে, রুদ্রের অবস্থা যে করুণের চেয়েও করুণ হলো সেটা তাকে দেখেই বুঝা গেল। সাইবার টিমের একজন পরিস্থিতি প্রতিকূলে যেতে দেখে দ্রুত নির্বাণকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং রুদ্রকে নিয়ে তারা বেরিয়ে আসে। রুদ্রকে নিয়ে যাওয়া হলে নির্বাণ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে আনে। অতঃপর পারমিশন নিয়ে নির্বাণ ভিসির রুম থেকে বেরিয়ে আসে এবং একজনের কাছে এসে দাঁড়ায়। তার সাথে হাতে হাত মিলিয়ে হ্যান্ডশেক করে স্মিত মুখে বলে, “এত শর্ট নোটিশে আসার জন্য,হ্যাল্প করার জন্য থ্যাংক্স। তুই না থাকলে হয়তো এসব সম্ভব হতো না আজ।”

ব্যক্তিটি হেসে বলে, “ফরমালিটি করিস না, এসব ব্যাপার না। আর আমার কাজই এটা, তুই বরং আমার হ্যাল্প করলি ওর মত একটা ক্রিমিনালকে ধরিয়ে দিয়ে৷”

নির্বাণ বলল, “তবুও মৃন্ময়, তোর হ্যাল্প ছাড়া পসিবল ছিল না।”

মৃন্ময় পুনরায় হেসে বলল,”হয়েছে, আর প্যারা খেতে হবে না। বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি।”

“ওকে! বাট মেক সিউর, ও যাতে কঠোর থেকে কঠোর শাস্তি পায়।”

“পাবে,চিন্তা করিস না। তা বাসায় যাস কিন্তু! মা প্রায়ই তোর কথা জিজ্ঞেস করে। আর এবার আসলে ভাবীকে সাথে নিয়ে আসিস। বিয়ে-সাদি করে তো বউকে একদম লুকিয়ে রেখেছিস।”

নির্বাণ বলল,”ইনশাআল্লাহ নিব একদিন। তুইও বাসায় আসিস সুযোগ হলে।”

“আচ্ছা। আসি তাহলে এখন,কাজ আছে।”

নির্বাণ সম্মতি জানাতেই মৃন্ময় চলে যায়। মৃন্ময় হচ্ছে নির্বাণের স্কুল লাইফের বন্ধু। দুইজনের মধ্যকার সম্পর্ক ভালো হওয়ায় যোগাযোগ বিদ্যমান ছিল। মৃন্ময় সাইবার ট্রাইবুনালের একজন অফিসার হওয়ার সুবাদে, রুদ্রের সকল কর্মকাণ্ডের সম্পর্কে জানার পর নির্বাণ যখন মৃন্ময়ের সাথে যোগাযোগ করে তখন মৃন্ময় ওকে বলে দেয় কিভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে আর কিভাবে সেটা গুছাতে হবে। সে সাথে, চলমান ঘটনার যাবতীয় প্রমাণ একত্রে জমা করে রিপোর্ট করার বুদ্ধি মৃন্ময়-ই দেয়৷ এমনকি প্রমাণ জোগার করতে সাহায্যও করে। যার দরুন, বিষয়টা হ্যান্ডেল করা নির্বাণের পক্ষে সহজ হয়ে উঠে।

নির্বাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। এখনো অনেক কাজ বাকি,আগোছালো রয়ে গিয়েছে কিছু বিষয়। সেগুলো গুছাতে হবে, সব যে এখানেই শেষ না। তবে আপাতত এসব নিয়ে নির্বাণের মাথা ব্যথা নেই। স্পর্শীকে একবার দেখা প্রয়োজন তার। ঘন্টাখানেক আগে সেখানে বসিয়ে রেখে এসেছিল, আরাম করতে আর বের না হতে। যদিও নির্বাণ মুখে বলেছিল অন্য তবে তার মূল উদ্দেশ্য ছিল স্পর্শীকে এসব ঝামেলা থেকে দূরে রাখার। সে চাচ্ছিল না কোনধরনের ভোগান্তিতে সে পড়ুক বা তাকে আর কোন কথা শুনতে হোক। তাই স্পর্শীকে এসব হতে দূরেই রাখতেই রুমে রেখে আসে আর নিজেই সবদিক সামাল দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এখন স্পর্শী কি করছে কে জানে? যদি খারাপ লাগে বা কিছু দরকার হয়? কেয়া বা নিধিও তো নেই ওর পাশে। একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়েই নির্বাণ দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল টাপসির কেবিনের দিকে। কেবিনের সামনে এসে দরজা খুলে স্পর্শীর নাম নিতে গিয়েও থমকে গেল। চোখ বুলালো চারদিক। রুমটি নীরব,শূন্য। নেই কেউ সেখানে। ক্ষণেই নির্বাণের ভ্রু কুঁচকে এলো। প্রশ্ন জাগলো মনে, “স্পর্শী কোথায়?”
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩৮

মধ্যাহ্নের পরবর্তী প্রহরে শুভ্রনীল অন্তরিক্ষ হলো মেহেদীরাঙ্গা। লাল,হলুদের অপার্থিব মিশ্রণ ভাসমান তুলোরাশির আঁকেবাঁকে। নীরদবাহন স্থির,শান্ত। ঘর্মাক্ত নগরী, অনড় গাছের পাতা। তপ্ত,গুমোট পরিবেশ তবুও কোথাও যেন এক বুক শীতলতা বিরাজমান। জানালার কিনার ঘেঁষে লোহা শিকের গায়ে মাথা হেলিয়ে দিল স্পর্শী। নয়ন দু’টি নিস্তেজতা ,নিষ্প্রাণতায় ঘেরা৷ মন জড়ানো ম্রিয়মাণে। ভালো লাগছে না তার কিছুই, তিক্ত লাগছে সব। স্মৃতিচারণে ভাসছে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো। চেয়েও ভুলতে পারছে না সে। নেত্রপল্লব এক করলো স্পর্শী, ভাবতে থাকলো কিঞ্চিৎ প্রহর পূর্বের ঘটনা।
ভার্সিটিতে থাকাকালীন সকল ঘটনা তাকে আরও পীড়িত করছিল। মনে করিয়ে দিচ্ছিল সকল অপমান,লাঞ্চনা,অবজ্ঞা৷ দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার সেই বদ্ধ রুমে। ছন্নছাড়া, উন্মাদ হয়ে উঠেছিল অনুভূতি। হয়তো আর কিছু সেখান থাকলে রুদ্ধশ্বাস অবস্থা হতো। নিজের সকল ভাবনা, অনুভূতি হতে মুক্তি পেতে তখন কাউকে না বলে নিজে নিজেই বাসায় চলে এসেছিল সে। কিন্তু অপ্রিয় জিনিসগুলো কি আর সহজে পিছু ছাড়ে? রক্ষে তো তার বাসায় এসেও হয়নি। পূর্বে কোনক্রমে হয়তো স্পর্শীর হাত লেগে ওয়াই-ফাই সফটওয়্যারটি অন হয়ে গিয়েছিল যার ফলস্বরূপ বাসার ত্রিসীমানায় আসতে না আসতেই তার মোবাইলের সাথে আপনা-আপনি ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কটি কানেক্ট হয়ে যায় আর নোটিফিকেশনের জোয়ার হানা দেয়। স্পর্শী তখন চেয়ে কোনকিছু অদেখা করতে পারেনি। স্বেচ্ছায় ফেসবুকে ঢুকে পড়ে সে। অতঃপর দেখে, বিভিন্ন পোস্টের উপরে,নিচে তাকে মেনশন দেওয়া হয়েছে অজস্রবার। কমেন্ট সেকশনে অশ্রাব্য, কুরুচি সম্পূর্ণ ভাষায় যা নয় তাই বলা হয়েছে। সেখানে এমন এমন কথা তার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল যে একটা সময় স্পর্শীর মনমানসিকতা, মনোবল দুর্বল হয়ে যায়। হীনম্মন্যতা করে বসে। পরবর্তীতে স্পর্শী নিজের সকল একাউন্ট ডিয়েক্টিভ করে মোবাইলটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে রাখে।
আকস্মিক রিংটোন বেজে উঠায় স্পর্শী নয়ন দুইটির কপাট খুলে তাকায়৷ একপলক তাকালো সেদিকে। জানালার ধার থেকে উঠে দাঁড়াতে আলসেমো লাগছিল বলে স্পর্শী উঠলো না। বাজতে দিল মুঠোফোনটাকে, অপেক্ষা করলো পরিবেশ পুনরায় নিভৃত হওয়ার। সামান্য সময়ের জন্য তা হলোও, তবে স্থায়ী হলো না। পুনরায় বেজে উঠলো ফোনটি৷ একবার-দুইবার নয়, কয়েকবার৷ পরিশেষে স্পর্শী অবসন্ন হয়ে উঠে গিয়ে ফোনটা হাতে নিল। পর্দায় নির্বাণের নামটি দেখে ঘন নিঃশ্বাস ফেললো সে। কারো সাথেই কথা বলার মনমানসিকতা নেই বলে স্পর্শী চাইলো অল্পতে কথা শেষ করতে। তাই সে কলটা রিসিভ করে বলল, “আমি বাসায় আছি, ঠিক আছি। চিন্তা করবেন না।”

প্রত্যুত্তরে নির্বাণ উষ্ণতাহীন কন্ঠে বলল, “আচ্ছা।”

স্পর্শী থমকালো। ললাটের মাঝ বরাবর পড়লো দৃঢ়ভাঁজ। শুধু আচ্ছা? আর কিছু না? বিষয়টা নিয়ে আর কিছু ভাবার পূর্বেই কল ডিসকানেক্ট হলো। সাথে সাথেই রাশভারী কৃষ্ণমেঘে আচ্ছাদিত হলো কারো মন। বিষণ্ণ নারীর নয়ন হলো অভিমানের টইটম্বুর। সে নাহয় কথা বলতে চায়নি তাই বলে কি নির্বাণ একটুও কথা বলার চেষ্টা করবে না? খোঁজ নিবে না? সে কি এতই তুচ্ছাতিতুচ্ছ মানুষ তার নিকট? প্রশ্নগুলো মস্তিষ্কে বিচরণ করার পরমুহূর্তেই ভাবনায় এলো, সে-ই তো চাচ্ছিল না কথা বলতে। তাহলে এখন যখন নির্বাণ কথা না বাড়িয়ে রেখে দিয়েছে তার কেন খারাপ লাগছে? অভিমান হচ্ছে? উত্তর জানে না সে। শুধু জানে তার সবকিছু এখন বিষাদ,তেতো লাগছে৷ স্পর্শী ফোনটা অফ করে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। বালিশে মুখ চেপে শুতেই কারণে-অকারণে আঁখিকোণ থেকে উষ্ণ জলবিন্দু গড়িয়ে পড়লো। রক্তিম হয়ে এলো নয়নের শ্বেতাভ অংশ, জ্বালা শুরু হতেই নেত্রপল্লব এক করে নিল স্পর্শী। জোড়পূর্বক অশ্রুগুলো আটকানোর ক্ষুদ্র চেষ্টা। কিছুক্ষণ পর পার্শিয়া এলো। স্পর্শীকে শুয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে গেল ওর কাছে। বিছানায় উঠে মাথার পাশে এসে বসে মৃদুশব্দ করে স্পর্শীকে ডাকতে থাকলো। স্পর্শীর হাতে মাথা ঘেঁষলো, একটু স্নেহের আশায়। চোখ খুলে সামনে পার্শিয়াকে দেখে স্পর্শীর নিজের ক্ষোভ বের করার যেন জায়গায় পেয়ে গেল। সে পার্শিয়াকে এক ধমক দিয়ে বলল, “এখানে কি করছিস তুই? বেরিয়ে যা আমার রুম থেকে, আসবি না আমার কাছে। বেরিয়ে যা বলছি।”

শেষের কথাটি স্পর্শী এত জোরেই বলল যে পার্শিয়া কেঁপে উঠে এক লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়লো। কিয়দংশ সময় স্পর্শীর পানে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে নিজেও এক রাশ অভিমান নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। পার্শিয়া চলে যেতেই স্পর্শী পুনরায় চোখ বুজে নিল। পরমুহূর্তেই তার মনে হলো সে তো দরজা আটকে রেখেছিল,পার্শিয়া রুমের ভিতরে ঢুকলো কিভাবে? স্পর্শী দ্রুত চোখ খুলে মাথা ঘুরালো, দরজার সামনে নির্বাণকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঞ্চিত হলো তার। নির্বাণ এক হাত পকেটে ঢুকিয়ে নিষ্পলক চাহনিতে তাকিয়ে আছে তার পানে। স্পর্শী থমকালো, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানবটিকে কল্পনা বলে ধরে নিল। কিন্তু যখন বুঝতে পারলো মানুষটা বাস্তব, মুখ ঘুরিয়ে নিল সে। তীব্র অভিমান নিয়ে মনে মনে আওড়ালো, “আপনি এখানে কেন? চলে যান। চাই না আপনাকে আমি এখন আপনাকে পাশে।”

কিন্তু মুখে রইলো মৌন, একটা শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ হলো না কণ্ঠনালী হতে। নির্বাণ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। দরজা আটকে এগিয়ে গেল স্পর্শীর দিকে। স্পর্শী আগে দরজা লক করেনি বলেই নির্বাণ নির্দ্বিধে রুমে প্রবেশ করতে পারে। নাহলে যে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হতো তা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তবে, নির্বাণ স্পর্শীর কাজে আজ বেশ রেগে আছে। এভাবে না বলে কেউ আসে? রুমে তখন স্পর্শীকে না দেখে কত ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। মনের মাঝে না চাইতেও অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো বাসা বাঁধতে শুরু করেছিল। যদি নির্বাণ তখন সালেহাকে ফোন না করে স্পর্শীর কথা জিজ্ঞেস না করতো তাহলে হয়তো দুশ্চিন্তায় শেষ হয়ে যেত সে। যদিও ফোন করার পর সাহেলা ভেবেছিলেন স্পর্শী এবং নির্বাণের মধ্যে মনমালিন্য হয়েছে, তবে নির্বাণ সেটা সামলে নেয়। অন্য এক বুঝ দিয়ে দেয় তাকে। অন্যথায় এক বিশ্রীরকম অবস্থায় পড়তে হতো তাকে।
নির্বাণ স্পর্শীর সামনে এসে রাগান্বিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “তুমি না বলে চলে এসেছ কেন?”

স্পর্শী প্রত্যুত্তর করলো না। চুপ থাকলো৷ নির্বাণ পুনরায় শাণিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “স্পর্শী, আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছি। এভাবে চলে এসেছ কেন? এত বেপরোয়া কেন তুমি?”

স্পর্শী এবারও নিরুত্তর রইলো। নির্বাণ বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো স্পর্শীর উত্তরের, কিন্তু ফলাফল শূণ্যের কোটা হতে অনড়। অকস্মাৎ ফোঁপানোর আওয়াজ কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনি হতে বক্ষ কেঁপে উঠলো তার। উষ্মা দৃষ্টিতে হিমানীর প্রলেপ পড়ে। নির্বাণ সন্তর্পণে স্পর্শী মাথার কাছে বসে তার চুলের হাত গলিয়ে দিল। কণ্ঠস্বর হলো খুব আদুরে, “আমি কি একবারও বকেছি তোমায়? কাঁদছ কেন এভাবে তুমি?”

স্পর্শী নীরবচারী হয়ে নোনাজল বিসর্জন দিয়েই গেল। নির্বাণ আবার বলল, “তুমি না বলে চলে আসায় আমি কতটায় চিন্তা পড়ে গিয়েছিলাম জানো? তাই এখন রাগ সামলাতে পারিনি, সরি।”

স্পর্শী কিছু না বলে পাশ ফিরে নির্বাণের কোমর জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজে নেয় পাশে৷ অশ্রুতে ভিজিয়ে দিতে থাকে শার্টের একাংশ। নির্বাণ বিহ্বলিত হয়ে বলে, “আরেহ বাবা! বললাম তো সরি। এবার কান্না থামাও!”

স্পর্শী স্বস্তঃস্ফূর্ত কন্ঠে বলে, “আমি আপনার কথার জন্য কানছি না।”

কথাটা শুনে নির্বাণ ভ্রু কুঁচকে যায়,”তাহলে কেন কানছো?”

“সবকিছুর কথা ভেবে। আমার ভালো লাগছে না কিছু, অস্বস্তি লাগছে। সবার ওসব অকথ্য ভাষা মনে পড়লেই নিজেকে নিয়ে নিজের এখন বিশ্রী অনুভূতি হচ্ছে।”

নির্বাণের এবার বুঝতে দেরি নি, মেয়েটা এতক্ষণে কাউকে আঁকড়ে ধরার আশায় বসেছিল। যার দরুন, ভরসার হাত নিকটে পাওয়ামাত্র তার লুকায়িত অনুভূতিগুলো চোখের জল রূপে বেরিয়ে এলো। নির্বাণ অনিমেষ কন্ঠে বলে, “ভেবো না ওসব নিয়ে, কেউ এখন আর বাজে কথা বলবে না এসব নিয়ে। সব ঠিক হয়ে গিয়েছে।”

“আদৌ কি সব ঠিক হয়েছে? ছবিগুলো সব সেরকমই রয়ে গিয়েছে।”

“আজ রাতের মধ্যে সব জায়গায় থেকে আমাদের ছবি ডিলিট হয়ে যাবে চিন্তা করো না। তোমার,আমার সম্পর্কও আজকের মধ্যেই সকলে জেনে যাবে। কেউ আর ভুল বুঝবে না।”

স্পর্শী কিছু বলল না। নীরবে নির্বাণের এক প্বার্শের শার্ট শক্ত করে চেপে ধরলো। নির্বাণ স্পর্শীর চোখ মুছে দিয়ে বলে, “তোমার অশ্রু তোমার কাছে দামী না হলেও কারো জন্য কিন্তু অতি মূল্যবান। অপচয় করো না এভাবে, কষ্ট হয়।”

স্পর্শীর কান্না থেমে গেল তখনই। কথাগুলো সোজা গিয়ে তার বক্ষঃস্থলে গিয়ে ঠেকলো। লাজ দেখা দিল চোখে-মুখে। সান্নিধ্যে এসে নিভৃতে মুখ লুকালো। স্পর্শীকে মুহূর্তে বিড়াল ছানার ন্যায় গুটিয়ে যেতে দেখে নির্বাণ হাসলো। কোথায় ভেবেছিল মেয়েটাকে আজ শাসন করবে সে, আচ্ছা করে বকবে। অথচ তার নয়নের দুই ফোঁটা জল দেখে সব হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। আর এমন হবেই বা না কেন? যে মনোহারিণী নারীতার মনের আঙ্গিনায় প্রণয়প্রতুষ্যের সূত্রপাত ঘটিয়েছে, তার কান্না অবহেলা করার সাধ্য কি তার আছে? নেই তো। একদম নেই।
নির্বাণ স্পর্শীর নেত্রপল্লবে আলতো করে অধর ছোঁয়াল অতঃপর আনমনে বলল, “আমার জন্য আর কখনও, কোনদিন তোমায় যাতে কথা শুনতে না হয় সে ব্যবস্থা আমি করছি। এইতো আর কিছু প্রহরের ব্যাপার। এরপর সব ঠিক হবে।”

__________________

নিশুতি শেষ প্রহর কাটিয়ে উদয় হলো নতুন প্রভাতের। পাখির কলরবে মুখরিত পরিবেশ। স্নিগ্ধ,নরম আলোক রশ্মি ধীরে ধীরে প্রতাপ পেতেই ব্যস্ত হয়ে উঠলো নগরী। পিছনের কথা ভুলে নতুন কিছুর সন্ধানে বেরুলো মানব-মানবী। নিত্যদিনকার ন্যায় চলল সব, ব্যতিক্রম দেখা দিল না কিছুই। কিন্তু যাদের জীবনে বিগত দিনগুলো ছাঁপ ফেলে গিয়েছে, আজকের প্রভাত তাদের জন্য ভিন্ন হয়ে দাঁড়ালো। জীবনের মোড় ঘুরলো এখান থেকেই।
বিগতদিন ভার্সিটির প্রাঙ্গণ কোলাহলে পরিপূর্ণ হলেও আজ বেশ শান্ত,ক্ষান্ত। কাউকে নিয়ে কোন রূপ অপ্রাসঙ্গিক কথা নেই কারো মুখে। দৃষ্টিতে হীনতা নেই, অবজ্ঞা নেই। আছে শুধু নমনীয়তা আর শ্রদ্ধা। কিন্তু তবুও যা ঘটার তা তো ঘটেই গিয়েছে, এখন আর কিছু না বললেই বা কি?

ভিসির সামনে দাঁড়িয়ে আছে নির্বাণ। চোখে-মুখে কাঠিন্যভাব স্পষ্ট। ভিসিও কড়া কন্ঠে নিজের বক্তব্য রাখেন, “শিক্ষক-ছাত্রীর সম্পর্ক অভিবাকের তুল্য। সেই সম্পর্ক আপনি হীন করেছেন মি. সাইয়্যেদ। একজন শিক্ষক হয়ে নিজের ছাত্রীকেই বিয়ে করেছেন আপনি। যা অন্যায়। এমনটাই বলে গার্ডিয়ানরা অভিযোগ জানাচ্ছেন আমাদের নিকট। যদিও এই বিষয়টা নিয়ে আমাদের কোন মাথাব্যথা নেই, শিক্ষক-স্টুডেন্ট বিয়ে করতেই পারে। তবে কালকের ঘটনাকে ঘিরে একটু ঝামেলা হয়ে গিয়েছে। গার্ডিয়ানরা সবাই অন্য নজরে বিষয়টা। আবার অথোরিটির মিটিংয়ে-ও এই প্রসঙ্গ নিয়ে সহস্রাধিকবার প্রশ্ন উঠেছে৷ আপনি নিজের হাতে পাওয়ার তুলে নিয়ে আমার অনুমতি ছাড়াই ভার্সিটির ভিতর পুলিশ ডেকেছেন। যা সকলের কাছে দৃষ্টিকটু লেগেছে। তাই এখন সবাই এক সিদ্ধান্তে আসতে চাইছে।”

নির্বাণ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে, “সেটার প্রয়োজন হবে না। আমি আগেই নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।”

“আর সেটা কি?”

নির্বাণ টেবিলের উপর একটা বাদামি রঙের খাম রেখে তা স্থিরচিত্ত সামনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “আ’ম রিজাইনিং৷”

ভিসি বিস্মিত হয়ে বলে, “জি?”

“আমি চাকরিটা ছাড়তে চাচ্ছি। এইটা আমার রেজিংনেশন লেটার।”

“আর ইউ সিউর এবাউট দিস?”

নির্বাণের অনড় কন্ঠ,”হান্ড্রেড পার্সেন্ট।”

“আবার ভেবে দেখুন। আমরা কিন্তু আপনাকে বের করে দেওয়ার কথা ভাবছিলাম না, কিছুদিনের বিরতি দেওয়ার কথাই ভাবছিলাম। সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে আপনি কিন্তু আবার জয়েন করতে পারবেন।”

“বিষয়টা এখন আমার চাকরির না, আমার সম্মানের। তাই আমি আর দ্বিতীয় কোন ভাবনায় যেতে চাচ্ছি না। আশা করি বুঝবেন।”

ভিসি আর কিছু বললেন না। মৌনতা বুঝিয়ে রাখলেন। নির্বাণও কথোপকথন দীর্ঘ করলো না। অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে আসলো সে। আপাতত তার সমস্ত কাজ এখানেই শেষ।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here