চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব -৩২+৩৩+৩৪+৩৫

#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩২ + ৩৩

পরবর্তী সময়গুলো গড়ালো খুব দ্রুত। চলমান স্রোতের ন্যায়। মাস বদলালো, রমজান শেষে ইদ এলো। রৌদ্রজ্বল এক সাধারণ সকাল হলো অন্যরকম। ছোট সোনাপাখির দল ঘুম থেকে উঠে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে নতুন জামা গায়ে জড়িয়ে ছুটলো বাড়ির গুরুজনদের পিছন পিছন, সালামি পাওয়ার আশায়। গৃহকর্মীরা সে যে সূর্য উঠার আগে রান্নাঘরে ঢুকলো বের হলো একবারে ঘেমে নেয়ে। টেবিলে পরিবেশিত হলো নানান ধরনের মিষ্টান্ন, মজাদার খাবার। পরিবেশটা মড়ানো উৎসব এবং খুশির আমেজে।
স্পর্শী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সজ্জিত করতে ব্যস্ত। কাঁধের পাশে নীল পাড়ের বেগুনি রঙের আঁচলটা ভালোমতো আটকে দিয়ে কুঁচিতে মন দিল সে৷ কোমর অব্দি ছড়ানো সিক্ত চুলের শেষাংশ থেকে চুয়ে চুয়ে পানি পড়ে ভিজে যেতে থাকলো শাড়ি, ব্লাউজের কিনার। কিন্তু সেদিকে কি আর রমনীর খেয়াল আছে? সে তো মগ্ন অন্যের ধ্যানে। কতদিন পর কাঙ্ক্ষিত মানুষ মানুষটিকে সামনাসামনি দেখতে চলেছে, খুশি কি আর সহে তার? সপ্তাহ খানেক হলো মানুষ চলে গিয়েছে তার সান্নিধ্য হতে৷ ব্যস্ততা আছে বলে। যাওয়ার পর আর না ফিরলেও খোঁজ নিয়েছে প্রতিনিয়ত। কাজের সুবাদে ঢাকার বাহিরে অবস্থান করেও প্রতিদিন নিয়মমাফিক ফোন করে তদারকি করেছে ঠিকই। দূরে থেকেও নিজের শরীরের সামান্যটুকু অযত্ন নিতে দেয়নি স্পর্শীকে। মাঝে মধ্যে স্পর্শী অভিমান করলে, তাকে ভিডিও কলে বসিয়ে নিজের যাবতীয় কাজ সেরেছে ব্যস্ত পুরুষটি। তবুও একা হতে দেয়নি। শেষ পর্যন্ত দূরে থেকেও সুস্থ করে তুলেছে তাকে। কিঞ্চিৎ দূর্বলতা থাকলেও সেটা গায়ে লাগার মত নয়।

স্পর্শী চোখে কাজল টানা মাত্র সাহেলার ডাক পড়ল, নির্বাণ এসেছে। মুহুর্তেই হার্টবিট মিস করলো যেন। মনটা হলো উৎফুল্ল, প্রফুল্ল। কোনমতে নিজের সাঁজ শেষ করে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল ড্রয়িংরুমের দিকে। সোফায় মিজান সাহেবের পাশে হাতে ফিরনির পিরিচ নিয়ে বসে আছে নির্বাণ। দুইজনের মধ্যে চলছে ব্যাপক আলোচনা৷ স্পর্শী ড্রয়িংরুমে পদচারণ করতেই নির্বাণের দৃষ্টি গেল সেদিকেই। একমনে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো সেদিক কয়েক মুহূর্ত। মোহগ্রস্ত নয়নে দেখতে থাকলো নীলাঞ্জনে আবৃত এলোকেশী কন্যাকে। অধরের কোণে দেখা দিল মিষ্টি হাসি৷ স্পর্শীর অবস্থাও বিপরীতমুখী নয়। সেও ব্যস্ত হলো নীলাভ্র রঙের পাঞ্জাবী পরিহিত শ্যাম পুরুষের স্নিগ্ধ মুখটি দেখতে। কয়েক সেকেন্ড নিভৃতে গড়িয়ে যেতেই নির্বাণ দৃষ্টি সরালো, পুনরায় মনোযোগ দিল মিজান সাহেবের কথায়। ভাব এমন যে, সে এতক্ষন মনোযোগ দিয়েই মিজান সাহেবের কথা বলছিলো এদিক তো সে ভুলেও তাকাই নি। স্পর্শীর ভ্রু কুঞ্চিত হলো, “নির্বাণ কি খেয়াল করেনি সে আজ তার পছন্দ মত সেজেছে? পরিপাটিভাবে শাড়ি পড়েছে, হাত ভর্তি মেহেদী দিয়েছে, চোখে কাজল টেনেছে, কিছুই কি খেয়াল করিনি সে? এত অবজ্ঞা কিসের?”

বেশ অভিমান হলো স্পর্শী৷ রাশ ভারি অভিমান নিয়ে নিজের দিকে তাকালো সে। কোনদিক খাপছাড়া লাগছে কি-না পর্যবেক্ষণ কর‍তে৷ কিন্তু কোন খুঁত খুঁজে পেল না। এরই মাঝে স্পৃহা স্পর্শীর পাশে এসে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করলো, “তুই এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস?”

স্পর্শী পাশ ফিরে তাকালো, “কিছু না। আচ্ছা দেখতো, আমাকে কি আজ বাজে লাগছে?”

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকালো, “কই না তো। এই শাড়িতে তো বেশ মানিয়েছে৷ সুন্দর লাগছে।”

স্পৃহার কথা শুনে স্পর্শী দৃষ্টি ঘুরিয়ে সামনে তাকালো। স্পৃহাও স্পর্শীকে অনুসরণ করে সেদিকই তাকালো। অকস্মাৎ বলে উঠলো, “তুই আর ভাইয়া কি কাপল আউটফিট পড়েছিস নাকি? কাটিং, ডিজাইন সব সেম যে?”

স্পৃহার কথা শুনে স্পর্শী একবার নিজের দিকে এবং নির্বাণের দিকে তাকালো৷ তার শাড়ির উপর অংশ গাঢ় নীল এবং নিচের কুঁচির অংশ বেগুনি, গোলাপির সংমিশ্রণে তৈরি। নির্বাণের পাঞ্জাবীও ঠিক তেমনই৷ ইদ উপলক্ষে ওই বাড়ি থেকেই তার জন্য এই শাড়ি আর কিছু কামিজ নিয়ে এসেছিল নাহিদ। পাশাপাশি সাহেলা,মিজান,স্পৃহার জন্যও৷ গতকাল রাতেই নির্বাণ ফোন করে জানিয়েছিল নিলুফা তাকে যেতে বলেছেন, তাই সে সকালবেলা ওকে নিতে আসবে। সেই সাথে জোড় দিয়ে বলেছিল, সে যেন তাদের দেওয়া শাড়িটা পড়ে। তার মানে কি নির্বাণ জেনে শুনেই তাকে শাড়ি পড়তে বলেছিল?

পরবর্তীতে আর কিছু ভাবার পূর্বেই স্পৃহা বলল, “মা তোকে ভিতরে ডাকছে। চল!”

স্পর্শী একপলক নির্বাণের দিকে তাকালো অতঃপর ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে গেল সাহেলার রুমের দিকে। স্পর্শী নিজ অবস্থান থেকে সরে যেতেই কারো আড়দৃষ্টি সরল হলো। প্রিয়তম মানুষটাকে মন ভরে দেখতে না পারার আক্ষেপে দীর্ঘশ্বাস বেরোলো বুক চিরে।

_______________

ত্রিশ মিনিটের উর্ধ্বে হলো স্পর্শী শ্বশুরবাড়ি এসেছে। এই প্রথম এখানে আসা তার৷ যার দরুণ, স্পর্শীর আপ্যায়নে কোন কমতি রাখে নি নিলুফা৷ স্পর্শী বাসায় আসামাত্রই তাকে নিজের সাথে সাথে রাখছেন। নাহিদের সাথে দেখা হলে সে কুশল বিনিময় করে বাহিরে চলে যায়, পুরোনো বন্ধুমহলের সঙ্গে আড্ডা দিতে।
স্পর্শীর নিলুফার সাথে কথার ফাঁকেই চারদিকে চোখ বুলালো। নির্বাণদের ফ্ল্যাটটা তিন/চারজন থাকার জন্য মাত্রাতিরিক্ত বড় বলা চলে। বেডরুম, ড্রয়িং, ডায়নিং বাদে ছোট একটা স্টাডি রুম আছে। সেখানের পুরোটাই কাগজপত্র আর বইয়ে ঠাশা। বুঝতে অপেক্ষা নেই স্টাডিরুমটা কার। নিলুফা স্পর্শীকে নিজ উদ্যোগে একবার পুরো বাসাটা ঘুরিয়ে দেখালেন। অতঃপর স্পর্শীকে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে আড্ডায় মশগুল হলেন। সময়টা পাড় হলো সেখানেই।
বাসায় আসার পর স্পর্শীকে নিলুফার সাথে ব্যস্ত দেখে নির্বাণ নিজের রুমে চলে গেল। ভাবলো, কিছু সময়ের ব্যাপার। সে অপেক্ষা করে নিবে৷ কিন্তু ঘড়ির কাঁটা যখন মিনিট,সেকেন্ড পেরিয়ে ঘন্টায় পদার্পণ করলো তখনই শ্যাম পুরুষটির শান্ত মন অধৈর্য হয়ে উঠলো। বদ্ধ রুমে ক্ষান্ত হয়ে বসে থাকতে না পেরে এদিক-সেদিক ঘুরঘুর করতে থাকলো। শেষে কাজ না পেয়ে স্টাডিরুম থেকে একটি উপন্যাসের বই নিয়ে সোফায় বসে পড়লো। নিজের সবটুকু মনোযোগ বইয়ের পাতায় স্থির করার ব্যর্থ প্রয়াস করলো কতক্ষণ। কিন্তু যার মন অন্যতে মগ্ন, সে কি আর পারে কবির উপন্যাসিক অক্ষর-বর্ণের মায়ায় নিজের মনকে ভোলাতে?
কিছুসময়ের ব্যবধানে স্পর্শী নিলুফার রুম থেকে বের হলো৷ স্পর্শীকে দেখামাত্র নির্বাণ তড়িঘড়ি করে বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজলো, মুহুর্তেই অভিব্যক্তি স্থিরচিত্ত করে ফেললো সে। ভাব এমন, সে এতক্ষণ যাবৎ ধরে একমনে বই-ই পড়সিল। অথচ কিয়ৎক্ষণ পূর্বের দৃশ্য ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম।
স্পর্শী ধীর পায়ে নির্বাণের কাছে এসে বসে। নির্বাণ দৃষ্টি তুলে তখনই, “কথা শেষ হলো?”

স্পর্শী হাতে পরিহিত স্বর্ণের বালার দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ! মা নামাজ পড়বেন এখন।”

“অহ আচ্ছা। বালা কে দিয়েছে মা?”

স্পর্শী সম্মতি জানালো, “হুম, ইদ উপলক্ষে দিয়েছেন।”

কথাটা শুনে নির্বাণ হাতের বইটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। মন্থর কন্ঠে বলল, “রুমে চল৷”

স্পর্শী কথা বলল না আর। চুপচাপ উঠে দাঁড়ালো, ছোট ছোট পা ফেলে চললো নির্বাণের পিছু পিছু। অভিমানের রেশ তখনও বিদ্যমান। নির্বাণের রুমে ঢুকতেই স্পর্শী থমকালো। রুমটা তুলনামূলক একটু বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সামন্যটুকু ধূলিকণা খুঁজে পাওয়া দায়। সে সাথে, সব জিনিস সাজানো-গোছানো। যেন সে-টাই তাদের আদর্শ স্থান। এমন কি বিছানার চাদরও একদম টান টান, কোন ভাঁজ নেই তাতে। বিশৃঙ্খলতা তো নেই-ই। কোন ছেলে মানুষের রুম যে এত সুন্দর, গোছানো-সাজানো হতে পারে তা হয়তো নির্বাণের সাথে বিয়ে না হলে জানাই হতো না। অপরদিকে, স্পর্শী হচ্ছে নির্বাণের বিপরীত। সে বরাবরই আগোছালো প্রকৃতির৷ ঠেকায় না পড়লে কখনো নিজের রুম গুছায় না। একটা জিনিস নিয়ে অন্য জায়গায় রেখে দেওয়া তার স্বভাব। শেষে কি-না স্পর্শী তার বিপরীতমুখী কাউতে আবদ্ধ হলো? হুমায়ুন আহমেদ ঠিকই বলেছেন, “এই পৃথিবীর প্রায় সবাই, তার থেকে বিপরীত স্বভাবের মানুষের প্রেমে পড়ে।”
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো সে। নৈঃশব্দ্যে হেটে গিয়ে বিছানার উপর বসলো। নির্বাণ দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে ডেক্সটপ টেবিলের উপর বইটা রেখে নিচের ড্রয়ারটা খুলে কিছু একটা করতে থাকলো। অতঃপর ঘুরে স্পর্শীর দিকে তাকালো, “তোমার চোখের নিচে কাজল লেপ্টে গিয়েছে। টিস্যু আছে সেখানে মুছে নাও, বাজে দেখাচ্ছে।”

স্পর্শী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো নির্বাণের দিকে। গল্প, উপন্যাসে এই লেপ্টে যাওয়া কাজল নিয়েই কবিরা কয়েক’শ লাইন লিখে ফেলে, অথচ এই মানুষটাকে দেখো। স্পর্শীর অভিমানের পাল্লা ভারী হলো। সে আকাশ সমান রাগ নিয়েই উঠে দাঁড়ালো, কিছুটা শব্দ করেই হেটে গেল আয়নার সামনে। আয়নাতে তাকাতেই ভ্রু কুঁচকে এলো তার। তার কাজল তো লেপ্টে যায়নি, তাহলে নির্বাণ মিথ্যে বলল কেন? ঘুরে দাঁড়াতে চাইলো সে কিন্তু তার পূর্বেই নির্বাণ তার পিছে এসে দাঁড়ালো। আয়নার ভিতর দিয়েই স্পর্শী নির্বাণের দিকে তাকিয়ে রোষিত কন্ঠে বলল, “মিথ্যে বললেন কেন আপনি? ঠিকই তো আছে সব।”

“তাই নাকি?”

নির্বাণের হেয়ালিপূর্ণ কন্ঠ। স্পর্শীর এবার প্রচন্ড রাগ হলো। একে তো সকালবেলা তার দিকে ঘুরেও তাকায়নি, আসার সময়ও গাড়িতে সাধারণ দুই-এক বাক্য ছাড়া কোন কথাই বলেনি সে, বাসায় এসেও একই হাল, এখন আবার হেয়ালি করছে। মানে চাচ্ছেটা কি সে? স্পর্শী একরাশ বিরক্তি নিয়ে সেখান থেকে সরে আসতে নিলে নির্বাণ বাঁধ সাধলো। নির্বাণ স্পর্শীকে তার দিকে ঘুরিয়ে পকেট থেকে ছোট একটা বক্স বের করে স্পর্শীর হাতে দিল। স্পর্শী দ্বিধাগ্রস্ত নয়নে তাকালো নির্বাণের দিকে। নির্বাণ তা দেখে বলল, “খুলো!”

স্পর্শী এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে বক্সটা খুললো। বক্সের ভিতরে নিদারুণ সাদা ও নীল রঙের পাথরের কারুকাজ করা লাভ শেপড এক জোড়া এয়ারিং আর পেনডেন্ট। মগ্নতা,স্নিগ্ধতার প্রভাব এত ছিল যে স্পর্শী স্তব্ধ না হয়ে পারলো না। নির্বাণ কিছু না বলে নিভৃতে বক্স থেকে পেনডেন্টটা নিয়ে স্পর্শীকে পুনরায় আয়নার সামনে ঘুরিয়ে দিল। খুব সন্তর্পণে স্পর্শীর চুলগুলো একপাশে নিয়ে তার গলায় পেনডেন্টটা পড়িয়ে দিল। অতঃপর স্পর্শীর কোমরে হাত গলিয়ে দিয়ে তার কাঁধের পাশে আলতোভাবে অধর ছুঁয়ে দিয়ে চিবুক রাখলো। বিভোর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “পছন্দ হয়েছে?”

স্পর্শী দ্রুতগতিতে মাথা নাড়লো, “অনেক!”

বিয়ের পর এই প্রথম নির্বাণের কাছ থেকে কোন উপহার পাওয়া তার। পছন্দ না হয়ে উপায় আছে? বস্তুত, উপহারটা এখন তার জানের চেয়েও প্রিয়।

নির্বাণ মিহি হাসলো, “আর শাড়ি?”

স্পর্শী কিছুটা অবাক হয়ে বলে, “শাড়িটা কি আপনি নিজে কিনেছেন?”

“হু! এই প্রথম মা বাদে কোন নারীর জন্য শাড়ি কিনেছি। অনেক ঘুরেও কোন শাড়ি পছন্দ হচ্ছিল না তোমার জন্য। শেষে এই কাপল আউটফিটটাই নজর কেড়েছিল। কিন্তু তোমার পছন্দ নিয়ে একটু কনফিউজড ছিলাম। তবুও কেন জানি মনে হয়েছিল তোমাকে এই রঙে বেশ মানাবে। এখন দেখছি আসলেই মানিয়েছে।”

স্পর্শী হৃষ্টচিত্তে অধরের কোণে হাসি ফুটালো, “আপনার দেওয়া সবকিছুই আমার প্রিয়।”

“আর আমি প্রিয় নই?”

আচমকা নির্বাণের এমন প্রশ্নের পৃষ্ঠে স্পর্শী লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। মুহুর্তেই প্রত্যুত্তর করতে পারলো না কিছু। আমতা আমতা করলো কিছুক্ষণ, “না মানে হ্যাঁ….ধুর।”

“কি বল?

স্পর্শী মাথা নুয়ে লজ্জালু কন্ঠে বলল, “জানি না।”

নির্বাণ হাসলো, “থাক জানতে হবে না।”

কথাটা বলে আয়নার মধ্য দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো স্পর্শীর দিকে৷ ক্ষণেই বলে উঠলো, “তোমাকে না আমি লিপস্টিক দিতে মানা করেছিলাম? বিশেষ করে এই রঙেরটা।”

স্পর্শী ভ্রু সংকীর্ণ হলো, “কেন দিলে কি হয়েছে?আপনি বললেই আমার লিপস্টিক দেওয়া ছাড়তে হবে না-কি? আমি তো লিপস্টিক দিবই।”

মুহূর্তেই নির্বাণ স্পর্শীর কানের কাছে এসে ফিসফিসালো, “কি হয় তা না-হয় এখনই দেখে নাও।”

কথাটা বলেই নির্বাণ আচমকা স্পর্শীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল, কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই স্পর্শীর অধরযুগল নিজের সান্নিধ্যে নিয়ে এসে তাতে নিজের অধরযুগল স্থাপন করলো। ঘটনাক্রমে, স্পর্শী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দিতেই ভুলে গেল। তাকিয়ে থাকলো ফ্যালফ্যাল করে। এমন কিছুর জন্য সে মোটেও প্রস্তুতি ছিল না। ধীরে ধীরে প্রণয়ের রঙ গাঢ়তর হতেই স্পর্শী মিইয়ে গেল, নয়ন দুইটি কপাট বন্ধ করলো নিমিষেই। কিয়ৎকাল এভাবেই অতিবাহিত হওয়ার পর নির্বাণ সরে এলো, নিম্ন কন্ঠে বলল,

“মাঝে মধ্যে কিছু নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের শাস্তিগুলো এমনও হয়। বুঝেছ?”

___________________

সায়াহ্নের রক্তিমা ছেঁয়ে যাওয়া আকাশের অন্তরালে সূর্যের অস্বস্তি মিশে যেতেই স্পর্শীকে সাথে নিয়ে নির্বাণ রওনা হলো। চারিপাশ উজ্জ্বল করতে রাস্তার ধারে জ্বলতে শুরু করলো হরিদ্রা রঙের সোডিয়াম লাইটগুলো। বন-গাছালি পেরিয়ে ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চললো শা শা করে। স্পর্শী মনও স্থাপিত হলো সেদিকেই, আচরণে তখনও লজ্জাবত্তা বিদ্যমান। মিনিট কয়েক নিভৃতে কেটে যেতেই নির্বাণ পরিবেশ স্বাভাবিক করতে বলে উঠে, “সামনের সপ্তাহ থেকে কিন্তু ভার্সিটি খোলা, মনে আছে তো?”

“হুম আছে।”

“শরীর খারাপ করলে ভার্সিটি যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি নোটস করে পরে তোমায় দিয়ে দিব নে।”

স্পর্শী মৃদুকন্ঠে বলল, “সেটার প্রয়োজন পড়বে না বোধহয়।”

“না লাগলেও নিবে, পড়ালেখায় বেশ পিছিয়ে আছো তুমি। ইম্প্রুভমেন্ট দরকার তোমার, সো আমার দেওয়া নোটসগুলো ভালো মত পড়বে। এইবার সিজিপিএ খারাপ হলে কিন্তু তোমার কপালে দুঃখ আছে।”

শেষের কথাটা বেশ গাম্ভীর্যতার সাথে বলল নির্বাণ। স্পর্শী নাক ফুলিয়ে মিনমিনে কন্ঠে বলল, “শুরু হয়েছে হিটলার স্যারের হিটলারগিরি। এ জন্যই স্যারদের বিয়ে করা উচিৎ না। একদমই না।”

গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দে স্পর্শীর কথাগুলো নির্বাণ শুনতে পেল না। তাই জিজ্ঞেস করলো, “কিছু বলছ?”

“বলছি, এখন থেকে ভালো মত পড়ব।”

নির্বাণের অভিব্যক্তি দেখে মনে হলো না সে স্পর্শীর কথা আদৌ বিশ্বাস করেছে, তবে এ বিষয়ে আর কিছু বলল না। অন্য কথাতে চলে গেল সে, “আচ্ছা! আর ভার্সিটি খুললে কিন্তু তুমি আমার সাথেই যাওয়া আসা করবে।”

“কেন?”

“তোমাকে নিয়ে আমি কোন রিক্স নিতে চাচ্ছি না।শরীর এখনো দূর্বল তোমার, তাই কিছুদিন তোমার একা যাওয়া আসা নিষেধ।”

স্পর্শী এর প্রেক্ষিতে আর কিছু বলল না। ছোট করে শুধু ‘আচ্ছা’ বলল।

___________________

ছুটিগুলো ফুরিয়ে গেল খুব দ্রুত। ফের ব্যস্ততায় পরিপূর্ণ হলো জীবন। স্পর্শীর ভার্সিটিও খুলে গিয়েছে এক সপ্তাহ হলো। এর মধ্যে দুর্বলতার জন্য সে ভার্সিটি যেতে পেরেছে মাত্র দুইদিন থেকে তিনদিন। তাও নির্বাণের সাথেই। ভার্সিটির ভিতরে দুইজনকে আলাদা আলাদা থাকতে হলেও দূর থেকে স্টুডেন্ট-টিচারের সম্পর্ক বুঝিয়ে রেখেই নির্বাণ যতটুকু পেরেছে স্পর্শীর খেয়াল রেখে গিয়েছে। নিজের পক্ষ থেকে কোন ক্রটি রাখেনি সে। স্পর্শীও বেশ সাবধানতার সাথে চলাফেরা করে গিয়েছে। সে সাথে, নির্বাণের সাথে যাওয়া-আসা করার সময়ও বেশ সচেতন ছিল। স্পর্শীর বন্ধুমহলের সকলেও এতে বেশ সাহায্য করেছে। তবে পিঞ্চ করতে ভুলে নি কেউ।
হাসি-খুশিই যাচ্ছিল সকলের জীবন। তবে সেটা বেশিদিন স্থায়ী হলো না। নিষ্প্রভ এক সকালে ঘূর্ণিঝড়ের প্রলয়ঙ্কারী বাতাস লেগে গেল স্পর্শীর ও নির্বাণের জীবনে। যা কি-না তাদের জীবনের পুরো মানচিত্র-ই উল্টে দিল।

আকাশটা নিত্যদিনকার মতই স্বচ্ছ। রৌদ্রতেজের ক্ষিপ্ত রূপ হতে ধরণীকে রক্ষা করতে শুভ্র মেঘের অহর্নিশ আনাগোনা। সকাল তখন নয়টা, সকালে ক্লাস না থাকায় স্পর্শী তখনও ঘুমের রাজ্যে নিমজ্জিত। এমনই সময় স্পর্শী ফোনটা উচ্চ মাত্রায় শব্দ করে বেজে উঠে। প্রথমবারের আওয়াজে স্পর্শীর ঘুম না ভাঙলেও দ্বিতীয়বার ফোনটি বেজে উঠতেই তার ঘুম ভেঙে যায়৷ আধ-নিভন্ত চোখেই স্পর্শী হাতরে হাতরে নিজের মোবাইলটা খুঁজে বের করলো। কলটা রিসিভ করে কানের কাছে মুঠোফোনটা ধরতেই নিধি চেঁচিয়ে উঠে, “কই তুই?”

সাত-সকাল এমন প্রশ্ন শুনে স্পর্শীর মেজাজ একটু খারাপই হলো। সে মেজাজ দেখিয়ে বলল, “কই আর থাকব? বাসায় আছি ঘুমাচ্ছি। কি হয়েছে?”

নিধি উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, “এদিকে তো বিশ্রি একটা কাণ্ড ঘটে গিয়েছে।”

“কি হয়েছে সেটা বল।”

“রুদ্র……”
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩৪

“রুদ্র……”

হঠাৎ রুদ্রের নাম শুনেই আপনা-আপনি স্পর্শীর ভ্রুকুঞ্চন হয়ে এলো। সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “রুদ্র কি? কি করেছে ও?”

নিধি কিছু একটা বলতে চাইলো কিন্তু বলতে পারলো না। তার আগেই ওর কাছ থেকে সামি মুঠোফোনটা কেড়ে নিয়ে বলল, “কিছু করে নাই ওই। ওর আজগুবি কথা, কানে দিস না।”

স্পর্শীর কপালের ভাঁজ এবার দ্বিগুণ হলো, “মানে কি? কি লুকাচ্ছিস তোরা? হয়েছেটা কি?”

“তেমন কিছু না। দুপুরে তোর বাসায় আসব আমরা সবাই, তখন সামনা-সামনি সব বলব নে। আর হ্যাঁ, আজ ভার্সিটি আসার প্রয়োজন নেই।”

“মানে কি?”

“তোর এত মানে জানা লাগবে না। আপাতত যা বলেছি তা কর।”

স্পর্শী পাল্টা কোন প্রশ্ন করার পূর্বেই সামি “রাখছি”
বলে ফোনটা কেটে দেয়। স্পর্শী কান থেকে ফোন নামালো, কিয়ৎক্ষণ বিস্ময়বিমূঢ় দৃষ্টিতে নিজের মুঠোফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কি হয়েছে সেটার ধারণা ঠিক করতে না পারলেও, তার বুঝতে দেরি নেই ভার্সিটিতে বড় ধরণের কোন কাহিনী হয়েছে। যা কি-না ঘটিয়েছে রুদ্র, কিন্তু তাকে এখন সেই বিষয়ে বলা হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না তাও বুঝে উঠতে পারলো না স্পর্শী। আচ্ছা, বিষয়টা আবার তাকে ঘিরে নয় তো? ভাবনাটা মাথায় আসা মাত্র স্থির হয়ে আর বসে থাকতে পারলো না স্পর্শী, দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ভার্সিটি যেতে হবে তাকে, ঘটনা কি হয়েছে তা না জানা পর্যন্ত অশান্ত মনের অবকাশ মিলবে না।

________________

“তুই কি পাগল? কোন আক্কেলে তুই স্পর্শীকে ফোন করে সব বলতে গেসোস? একটু কি কথা পেটে রাখা যায় না?”

সামি নিধির উদ্দেশ্যে ক্রোধাগ্নি কন্ঠে বলে উঠল। নিধি পাল্টা প্রশ্ন করলো, “না বলে আর কতক্ষণ?তোর কি মনে হয় আমি না বললে স্পর্শী এ সম্পর্কে কিছু জানতে পারব না? ভার্সিটিতে এখন সবচেয়ে হট এন্ড ট্রেন্ডি টপিক এটাই। সবার মুখে মুখে একই কথা। চারদিকে কি এক বিশ্রি অবস্থা দেখসোস?”

সামি বলল, “মানছি সবটা। কিন্তু ফোনে বলে তুই পুরো ঘটনা ঠিক মত বুঝাইতে পারবি? বুঝাইলেও এরপর স্পর্শী কি রকম রিয়্যাক্ট করবে সেই খেয়াল আছে? ভেঙ্গে পড়বে ওই। ওকে সামলানোর জন্য হলেও আমাদের থাকতে হবে।”

কেয়া বলে উঠে, “কিন্তু স্পর্শীকে জানানো প্রয়োজন। যত যাই হোক, সম্পূর্ণ বিষয়টা ওকে নিয়েই। ইতিমধ্যে কত দেরি হয়ে গেসে দেখসোস?”

সামি সম্মতি জানিয়ে বলে, “জানি,কিন্তু আমি বলতাসি না যে জানাব না। যাব তো ওর বাসায়, তখন জানাবো। এখন তার আগে দেখি কিছু একটা করা যায়নি। নির্বাণ স্যার কোথায় জানোস? তার কানে খবরটা কি গেসে নাকি না, সেটা জানা দরকার। না জানলে তাকে জানাতে হবে আগে। এরপর যা করার সেই করতে পারবে, বিষয়টা আমাদের সকলের নাগালের বাহিরে।”

মাহিন দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “হ্যাঁ এটা করা যায়। তবে, রুদ্র কত নিম্নমানের কাজ করসে সেটা দেখসোস? মানে কি থেকে কি বানাইযয়া দিসে পুরো বিষয়টা? আমার তো গা জ্বলতাসে। ওই শালাকে পাই একবার, জিন্দা যদি পুঁতে না ফেলসি।”

নিধি অপভাষায় একটা কটুকাটব্য করে বলে, “নাম নিবি না ওর। মানুষের কাতারে পড়ে ওই? নর্দামার কিট একটা! রিভেঞ্জ নিতে গিয়ে একটা মেয়ের সম্মানে কিভাবে হাত দিতে পারলো ওই? নরপিশাচ একটা।”

কেয়া মন্থর কন্ঠে বলে, “সব দেখে তো আমারই কান্না পাচ্ছে সেখানে স্পর্শী কিভাবে সহ্য করবে মানুষের এই কটুকথা, ব্যঙ্গার্থ,বাজে কথাগুলো? এমন না হলে কি হতো না? খুব জরুরি ছিল এমন হওয়া?”

নিধি ক্ষীণ স্বরে বলে, “গুজব রটাতে সময় লাগে না, বুঝলি? শুধু এক কান থেকে আরেক কানে গেলেই হয়, বাকিটা চোখের পলকেই আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ে।”

সামি বলে, “থাক আপাতত এই কথা বাদ দে। আগে চল, নির্বাণ স্যারকে খুঁজি। এমনেই দেরি হয়ে গেসে।”

মাহিন সাঁই জানিয়ে বলল, “হুম চল।”

_________________

ভাড়া মিটিয়ে স্পর্শী রিকশা থেকে নামলো৷ মাথায় ওড়নাটা ভালো মত টেনে, নিধিকে কল করবে বলে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করতে করতেই এগুলো সামনের দিকে। ব্যাগ থেকে মুঠোফোনটা বের করে চারপাশে একবার তাকাতেই বুঝতে পারলো প্রায় শতাংশ মানুষ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। কেউ বা পাশের জনকে ডেকে ফিসফিসিয়ে কি যেন বলছে আর ফোনের মধ্যে কিছু একটা দেখিয়ে তার দিকেই ইশারা করছে৷ বিষয়টা অতিমাত্রায় দৃষ্টিকটু ঠেকলো স্পর্শীর কাছে৷ সে সাথে কৌতূহল জাগলো মনের মাঝে। নিজের দিকে একবার তাকালো, তার পোশাক-আশাকে কোন ক্রটি আছে কি-না দেখতে। কিন্তু চোখে পড়ে পড়ার মত কিছু পেল না। স্পর্শী বুঝে উঠতে পারলো না, তাকেই ঘুরে ঘুরে মানুষ কেন দেখছে। একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে স্পর্শী নিধিকে ফোন লাগালো। নিধি ফোন ধরা মাত্র স্পর্শী জিজ্ঞেস করে উঠলো, “কই তোরা?”

নিধির মিহি কন্ঠে প্রত্যুত্তর করলো, “টিচার্স রুমের এদিকে আছি, কেন?”

“আমি ভার্সিটিতেই আছি, স্মৃতিস্তম্ভের দিকে যাচ্ছি।”

নিধি আশ্চর্যান্বিত কন্ঠে বলল, “কিহ! তোকে না আসতে মানা করলো সামি? তাও কেন আসলি তুই?”

“কারণ তো বলেনি, কেন আসব না? আসলে সমস্যা কোথায়? আর হয়েছেটা কি বলবি তোরা?”

স্পর্শীর কথা অনাগ্রহ করে নিধি সামিকে ডাক দিল। স্পর্শী ফোনের এপার থেকেই শুনতে পেল নিধি বলছে, “স্পর্শী ভার্সিটিতে আসছে। কি করব এখন?”

সামি প্রত্যুত্তর করলো, “ড্যাম ম্যান! ওকে না মানা করলাম আমি আসতে? উফফ! মেয়েটা একটা কথাও শুনে না। কই এখন ওই?”

নিধি বলল, “স্মৃতিস্তম্ভের দিকে যাইতাসে বলল।”

“চল ওইদিকে তাড়াতাড়ি।”

শেষ কথাটা কে বলল সেটা বুঝে উঠার আগেই নিধি বলে উঠলো, “তুই ওদিকটায় থাক, আমরা আসতাছি৷”

স্পর্শী “আচ্ছা” বলার পূর্বেই লাইন কেটে গেল। কপালের ভাঁজ যেন এবার দৃঢ় হলো স্পর্শীর। হচ্ছেটা কি? এমন আচরণ কেন করছে সবাই? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার আগেই তার ডান-পাশ থেকে কারো উচ্চস্বরের বিদ্রুপের হাসি শুনতে পাওয়া গেল, সে সাথে কাউকে নিয়ে অপ্রীতিকর কিছু কথা। যা ছিল অতিমাত্রায় জঘন্য। গা ঘিন ঘিন করে উঠলো স্পর্শীর। সে পুনরায় আশেপাশে তাকালো, কথাগুলো কে বলেছে তা দেখার জন্য। কিন্তু ঠিক ঠাহর করতে পারলো না কথাটা কারা বলেছে৷ তবে একটা জিনিস পরিলক্ষিত করতে পারলো যে, এখনো মানুষ ওকেই দেখে চলেছে এবং নিজের মধ্যে সমালোচনা করে চলেছে। চোখে-মুখে সকলের চরম অবজ্ঞা আর তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভাব এবং ঠোঁটের কোণে শ্লেষের হাসি৷ তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে স্পর্শীর শুধু এটাই মনে হলো সবটা যেন তার জন্য, তার প্রাপ্য এসব। কিন্তু কি করেছে সে? মানুষ কেন তাকে এভাবে দেখছে? কারণ খুঁজে পেল না । চরম হতাশায় পড়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো স্পর্শী। সেই সাথে, সকলের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় প্রচন্ড অস্বস্তিবোধ করলো সে। আজ সবাই এমন কেন করছে কে জানে? কোন কিছু বুঝতে না পেরে হাঁটা দিল সামনের দিকে। কিছু দূর যেতেই রুদ্র এবং ওর বন্ধুরা স্পর্শীর সামনে এসে ওর পথ আটকালো। তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে রুদ্র বলে উঠলো, “কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”

মুহুর্তেই স্পর্শীর অভিব্যক্তি বিরক্তিতে পরিপূর্ণ হলো, “দিস ইজ নান অফ ইউর বিজনেস।”

রুদ্র রম্য কন্ঠে বলে, “অহ তাই নাকি?”

স্পর্শী কথা বলতে চাইলো না। পাশ কাটিয়ে চলে আসতে নিলে রুদ্র স্পর্শীর হাত ধরে বসলো, “আরেহ! কোথায় যাচ্ছ? কথা তো শুনে যাও আমার?”

রুদ্র হাত ধরামাত্র স্পর্শী এক ঝাটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চিৎকার করে বলল, “সাহস কিভাবে হয় তোমার আমার হাত ধরার?”

রুদ্রের ঠোঁটের তখন বিদ্রুপাত্মক হাসি, “আমি হাত ধরলেই তোমার গায়ে ফোঁসকা পড়ে যায় অথচ যখন অন্যদের বিছানায় উঠে পড় তখন কিছু হয় না? গা জ্বলে না? ঘৃণা হয় না নিজের প্রতি? মরে যেতে ইচ্ছে করে না?”

স্পর্শী চেঁচিয়ে উঠে, “একদম চুপ! তোমার সাহস কিভাবে হয় আমাকে নিচু মানের কথা বলার? হু দ্যা হেল ইউ আর?”

“অহ প্লিজ! আর নাটক কর-না৷ এখানে উপস্থিত সকলেই তোমার আসল চেহেরা জানে৷ তুমি যে কতটা নিম্নমানের এবং রাস্তার মেয়ে তা আর এখন কারো অজানা নয়। তাই আর সতী সেজে লাভ নেই। রাস্তার ব** বাদে তুমি কিছু না। এর বেশি তোমার দাম….”

আর কিছু বলার পূর্বেই স্পর্শী রুদ্রের গালে নিজের সর্বোচ্চ জোর দিয়ে থাপ্পড় মেরে বসে। প্রচন্ড রাগে শরীর কাঁপছে তার। স্পর্শী দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “আর একটা কথাও নয়। আমি কেমন তা আমি ভালো করেই জানি। কারো দেওয়া দুই টাকা দামের ক্যারেক্টর সার্টিফিকেট আমার লাগবে না। যে নিজেই নর্দমার কীট সে কি আর অন্যকে জাস্টিফাই করবে?”

রুদ্র ও স্পর্শীর কন্ঠ শুনে আশেপাশে তখন অনেকই জোড়ো হয়ে গিয়েছে। নিজের মাঝেই বিভিন্ন ধরনের সমালোচনা করে চলেছে। তা দেখে রুদ্র মুচকি হাসলো। গালে হাত দিয়েই বলে, “তার মানে বলতে চাইছো, তুমি সতী? একদম পিউর আর ইনোসেন্ট? যদি তাই হয়, তাহলে এই ছবিগুলোর মানে আমাকে একটু বুঝাবেন মিস.স্পর্শী উপস মিসেস.স্পর্শী। আপনি তো আবার বিবাহিত। রাইট?”

কথাটা বলে রুদ্র ফোন বের করে স্ক্রোল করে কিছু ছবি বের করে স্পর্শীর সামনে তুলে ধরে এবং উচ্চস্বরে বলে, “বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও এমন অপকর্ম করতে লজ্জা করে না? কিভাবে পারো নিজের স্বার্থ হাসিল করতে একজনকে ঠকিয়ে আরেকজনের বিছানায় উঠে পড়তে? বিবেকে বাঁধে না তোমার?”

রুদ্রের কথায় স্পর্শী এবার কোন প্রত্যুত্তর করল না। শুধু নির্বাক,নির্জীব,স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকলো রুদ্রের মুঠোফোনে ভাসতে থাকা ছবিগুলো এবং তার উপরে লেখা ক্যাপশনটার দিকে। মুখের ভাষা হারালো যেন তখনই। কিয়ৎকাল ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতেই পুরো বিষয়টা ধীরে ধীরে তার নিকট পানির মত পরিষ্কার হয়ে দাঁড়ালো। তার মানে, সকাল থেকে ঘটা তার সাথে যাবতীয় ঘটনার সূত্রপাত এখান থেকেই।
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩৫

“বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও এমন অপকর্ম করতে লজ্জা করে না? কিভাবে পারো নিজের স্বার্থ হাসিল করতে একজনকে ঠকিয়ে আরেকজনের বিছানায় উঠে পড়তে? বিবেকে বাঁধে না তোমার?”

রুদ্রের কথায় স্পর্শী এবার কোন প্রত্যুত্তর করল না। শুধু নির্বাক,নির্জীব,স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকলো রুদ্রের মুঠোফোনে ভাসতে থাকা ছবিগুলো এবং তার উপরে লেখা ক্যাপশনটার দিকে। মুখের ভাষা হারালো যেন তখনই। কিয়ৎকাল ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতেই পুরো বিষয়টা ধীরে ধীরে তার নিকট পানির মত পরিষ্কার হয়ে দাঁড়ালো। তার মানে, সকাল থেকে ঘটা তার সাথে যাবতীয় ঘটনার সূত্রপাত এখান থেকেই।

“কি এখন কথা বলছো না কেন? সত্য সামনে আসতেই কথা সব নাই হয়ে গেল?”

রুদ্রের হুংকার স্বরূপ কন্ঠে স্পর্শীর ধ্যান ভাঙ্গলো। সে একপলক শীতল দৃষ্টিতে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে পুনরায় মোবাইলের কৃত্রিম স্ক্রিনে ভাসতে থাকা সেই ছবিগুলোর দিকে তাকালো। ছবিগুলো তার এবং নির্বাণের ভিন্ন মুহূর্তের। যা কি-না সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে অতি মিষ্ট। যার মধ্যে নেই কোন অশ্লীলতা, অশালীনতা, আছে শুধু পবিত্রতা, শুদ্ধতা। কিন্তু কালক্রমে বিষয়টা সম্পূর্ণ বিপরীত রূপ ধারণ করেছে। শুধুমাত্র ছবিগুলো তুলে ধরার ভঙ্গিমা এবং শিরোনামে কিছু অকথ্যকথনের জন্যে। যার দরুন তাদের সম্পর্কটা কেউ ভালো দৃষ্টিতে নয় বরং নোংরা দৃষ্টিতেই দেখবে। উপরন্ত শিরোনামটা এমন যে, “শিক্ষকতার নাম নিয়ে শিক্ষক এবং ছাত্রী অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত। জল গড়িয়ে গিয়েছে বহু দূর। দেখুন! নিচের ছবিগুলো তাদের এই অবৈধ মেলামেশার প্রমাণ।”

লেখাগুলো পড়ামাত্র স্পর্শীর শরীর ঘিন ঘিন করে উঠল। তিন বাক্যের শিরোনাম অথচ নির্বাণ এবং তার সম্পর্ককে বনাম করতে যথেষ্ট। তাদের চরিত্রে নোংরামির দাগ লাগাতে ঢেড়। রুদ্র ফের বিদ্রুপ করে বলল, “কি কথা বের হচ্ছে না এখন? সব হাওয়া ফুঁস? আমি কখনো ভাবি নি এই ভোলাভালা চেহেরার পিছনে এমন কুৎসিত এক চেহেরা লুকিয়ে আছে।”

স্পর্শী মন্থর দৃষ্টিতে তাকালো, “সবসময় যে চোখের দেখা সত্যি হয় তা কিন্তু নয়।”

“তাই নাকি? তাহলে তুমি বলতে চাইছো এই ছবিগুলো মিথ্যে? ছবির মধ্যে থাকা মানুষ দু’টি তুমি আর নির্বাণ স্যার না? এডিট সব? বোকা মনে হয় আমাদের? তুমি বলবে আর আমরাও চোখ বন্ধ করে তা মেনে নিব? সত্য যেখানে সামনে সেখানে তোমার মিথ্যে বলার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি।”

রুদ্রের কথার বিপরীতে স্পর্শী কোন প্রত্যুত্তর করলো না। নীরব রইলো। আপাতত কিছু বলা মানেই বৃথা, কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না সে-টা সকলের দৃষ্টিতে লুকিয়ে থাকা অবজ্ঞা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। কতটা ক্ষীণ সেই দৃষ্টি। একটি পোস্ট সকলের চোখে তাকে কোথায় নামিয়ে দিয়েছে ভাবতেই স্পর্শীর মন দুমড়ে মুচড়ে গেল। গলা ধরে এলো বারংবার। এর মাঝেই নিধি,কেয়া,সামি এবং মাহিন সেখানে এসে হাজির হয়। ভীড় ঠেলে কোনমতে সামনে গিয়ে রুদ্র আর স্পর্শীকে সামনা-সামনি দেখে তাদের আর বুঝতে দেরি-নি ঘটনা যা ঘটার ঘটে গিয়েছে। তারা দ্রুত স্পর্শীর পাশে এসে দাঁড়ায় এবং তাকে আড়াল করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে।
এদিকে, স্পর্শীর চুপ থাকাটা রুদ্র স্পর্শীর দূর্বলতা ভেবে পুনরায় আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত হলো, “প্রথমে তুমি আমার সাথে ছিলে। আমার সাথে প্রেম,ভালোবাসার নাটক করে ঘুরিয়েছ কয়েকমাস। এরপর আমাকেই ধোঁকা দিয়ে বিয়ে করে ফেললে তুমি। সকলের সামনে চরিত্র খারাপ আমারটাই দেখালে। কিছু বলেনি তখন, প্রমাণ ছিল না বলে। কিন্তু এখন? প্রমাণ সকলের হাতেই। নিজের স্বামীকে ধোঁকা দিয়ে স্যারের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছ। রাত পর্যন্ত হয়তো কাটিয়েছ। খাঁটি বাংলায় জানো তো এ সম্পর্ককে কি বলে, পরকীয়া।”

সামি চেঁচিয়ে অকথ্য ভাষায় রুদ্রকে একটি শব্দ দিয়ে সম্মোধন করে বলল, “ভাষা ঠিক করে কথা বল। সাহস কিভাবে হয় তোর স্পর্শীকে নিয়ে এভাবে বলার? তুই জানিস আদৌ কাকে নিয়ে কি বলছিস?”

সামির কথা শুনে রুদ্র মোবাইলে একটা ছবি বের করে
সামির সামনে তুলে ধরে বলে,

“তাই নাকি? তাহলে বল এই ছবিগুলো মিথ্যে, এডিট। পারবি বলতে? পারবি না, কারণ এইখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, স্পর্শী নির্বাণ স্যারের গাড়িতে উঠছে। নির্বাণ স্যারকে নিয়েই নিজের বাসায় ঢুকছে। এর মানে আমরা কি বুঝবো? বল? ছোট বাচ্চা নয় এখানে কেউ, এডার্ল্ট সবাই। ছবিগুলোর অর্থ সবাই ভালোমতই বুঝি আর জানি।”

অতঃপর স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বলে, “নিজের সিজিপিএ বাড়ানোর আশাতেই করছো এইসব তাই তো? তুমি তো তুমি, দুশ্চরিত্রতা মেয়ে একটা। কিন্তু স্যারও এমন কাজে লিপ্ত দেখে ঘেন্না হলো। বদরাগী হলেও ভালো ভেবেছিলাম তাকে, কিন্তু এই কি-না তার আসল চেহেরা? না জানি এমন ভাবে কত মেয়ের জীবন নষ্ট করেছেন তিনি। তবে এবার স্যার যেমন ছাত্রীও তেমনই পড়েছে তার ভাগ্যে। দুইজনের চরিত্রেই সমস্যা আছে। স্ল্যা*…..”

পরবর্তী কথাগুলো এতই অশ্রাব্য ছিল স্পর্শী নিজের ধৈর্য আর ধরে রাখতে পারলো না। গলারস্বর দ্বিগুণ করে বলল, “জাস্ট শাট আপ। আর একটা বাজে কথা বললে খারাপ হয়ে যাবে বলছি। কি জানো তুমি আমার আর নির্বাণ স্যারের সম্পর্কে? আদৌ জানো কিছু? না জেনে শুনে কাউকে নিয়ে এভাবে জার্জ করার সাহস তোমায় কে দিয়েছে? সবাইকে নিজের মত রাস্তার নর্দমারকীট ভাবা বন্ধ কর।”

“পরকীয়া যদি নাই হয় তাহলে বলো তোমাদের মাঝের সম্পর্ক কি? কিসের ভিত্তিতে তুমি গলা উঁচিয়ে কথা বলার সাহস পাচ্ছ?”

রুদ্রের প্রশ্নে স্পর্শী তৎক্ষনাৎ উত্তর দেওয়ার জন্য মুখ খুললো, “আমি নির্বাণ স্যারের ব…..”

‘ব’ উচ্চারণ করতে গিয়েও স্পর্শী থমকে গেল৷ কোন জড়তার কারণে বলা হয়ে উঠলো না তার, সে নির্বাণের বউ। উপরন্ত, বিয়ের প্রথমরাতেই নির্বাণ স্পর্শীকে বলে দিয়েছিল, সে তার পারসোনাল আর প্রোফেশনাল লাইফ দু’টোই আলাদা আলাদা রাখতে চায়। এখন যদি সে তাদের বিয়ের বিষয়টা খোলাসা করে দেয় তাহলে সবটাই ঘেটে যাবে। কোন কিছু বলার আগে হলেও নির্বাণের সাথে তার একবার কথা বলা প্রয়োজন। ধৈর্য ধারণ করতে হবে তাকে নাহলে পুরো বিষয়টাই ঘেটে যাবে।
স্পর্শীকে চুপ হয়ে যেতে রুদ্র শ্লেষোক্তি করে বলল, “তুমি নির্বাণ স্যারের কি? বল! এখন বলছ না কেন? মানুষকে বলার কোন গ্রহণযোগ্য সম্পর্ক খুঁজে পাওনি নাকি? তাহলে আমি বলছি, নির্বাণের স্যারের কাছে তুমি ব্যা* মা* ব্যতীত কিছুই না।”

কথাটা শোনামাত্র মাহিন রুদ্রের কলার চেপে ধরে ওর নাক বরাবর ঘুষি মেরে বসে। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে রুদ্র মাটিতে পড়ে যায় এবং সামি তখনই পা দিয়ে রুদ্রের পায়ের কাছে লাথি মেরে বলে অশ্রাব্য ভাষায় কিছু গালমন্দ করে বলে, “তোর সাহস কিভাবে হয় স্পর্শীকে এসব বলার? তোকে তো আজ আমি…”

কথাটা বলে শেষ করার পূর্বেই রুদ্রের বন্ধুরা মাহিন আর সামির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং রুদ্রকে নিচ থেকে উঠিয়ে দাঁড় করায়। বৃহৎ এক গন্ডগোল বাঁধলো তখনই। আশেপাশে ভালোই ভীড় জমেছে। সকলেই নিজেদের মধ্যে কানাঘুষা, সমালোচনা করেই চলেছে,এগিয়ে আসছে না কেউ। অনেকে মজা নিচ্ছে তো অনেকে আবার মোবাইল বের করে ঘটনা সব শুট করছে। অনেকে আবার ভীড়ের সুযোগ নিয়ে মেয়েদের গা ঘেঁষে দাঁড়াচ্ছে, অপ্রীতিকর উদ্দেশ্যে। অবশ্য আমাদের বাস্তব জীবনের চরিত্র এইটাই। কেউ এখানে কারো আপন নয়। নিজ স্বার্থ না থাকলে কেউ কখনো এগিয়ে আসবে না। কখনো না!

রুদ্রের বন্ধুবান্ধব সংখ্যায় একটু বেশি হওয়ায় সামী ও মাহিন তাদের সাথে পেরে উঠলো না। আহত হলো খানিকটা। এর মাঝেই তাঁদের আরও আহত করতে রুদ্রের বন্ধুদের মধ্যে একজন নিচ থেকে ছোট একটি ইটের টুকরো হাতে নিয়ে তাদের দিকে ছুঁড়ে মারলো। তবে সেটা সামি বা মাহিন কারো গায়ে না লাগলেও, দুর্ভাগ্যবশত স্পর্শীর কপালে গিয়ে সেই ইটের টুকরোটা লাগলো এবং সাথে সাথে কপালের চামড়া ফেটে উষ্ণ রক্তের সরু ধারা কিনার ঘেঁষে চুয়ে চুয়ে পড়তে শুরু করলো। স্পর্শী চাপা আর্তনাদ করে কপাল চেপে ধরলো। রুধিরাক্ত হলো হাত। রক্ত দেখে কেয়া উদ্বিগ্ন,বিচলিত হয়ে পড়লেও নিধি দ্রুত নিজের ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে স্পর্শীর কপালে চেপে ধরলো৷
এদিক, সামিকে আহত দেখে রুদ্র নিজের ক্রোধ প্রকাশ করতে পিছ পা হলো না। সামি-র কলার চেপে ধরে বলল, “স্পর্শীকে বললে তোর এত গায়ে লাগছে কেন? তুই কি ওর আরেক ভা** নাকি?”

অতঃপর স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বলে, “আর কয়টা লাগে তোমার? একজন দিয়ে হয় না? শা* বা…”

রুদ্র নিজের কথা শেষ করার পূর্বেই পিছন থেকে রাশভারি কন্ঠে কেউ খুব জোড়ে চেঁচিয়ে বলে উঠে, “কি হচ্ছে এখানে?”

মানুষটির আওয়াজে এতই জোর আর দৃঢ়তা ছিল যে সকলেই সে সময়ের জন্য স্থির হতে বাধ্য হলো। কৌতূহলের বসে সকলের দৃষ্টি গেল পিছনের দিকে। সামনে নির্বাণকে তারা আগের ন্যায় ভয় বা সম্মান না দেখাতে চাইলেও, পিছনে ডিপার্টমেন্টের হেড-কে দেখে দমে গেল সকলে। কোন প্রকার রা করলো না কেউ। নির্বাণ পুনরায় চেঁচিয়ে উঠলো, “কি হচ্ছে এখানে?”

কথাটা বলা শেষেই নির্বাণ দৃষ্টি গিয়ে আটকালো রক্তেমাখা স্পর্শীর মুখপানে। ক্ষণেই যেন রক্তক্ষরণ শুরু হলো বক্ষঃস্থলের অন্তরালে। মন হলো উৎকন্ঠিত, ব্যগ্র, উদ্বিগ্ন কিন্তু অভিব্যক্তি রইলো অতি শীতল। স্পর্শীও নিধির সাথে ঠেশ দিয়ে দাঁড়িয়ে দুর্বলচিত্তে তাকালো নির্বাণের পানে। দৃষ্টিতে না বলা অনেক কথা,অনেক অভিযোগ। ব্যর্থ,আহত অনুভূতি। নির্বাণ চোখ সরালো আর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে নিজেকে শক্ত রাখা দায় হয়ে দাঁড়াবে তার জন্য। এর মাঝে মাহিন আধোস্বরে পুরো ঘটনাটা বলার চেষ্টা করলো কিন্তু রুদ্র থামিয়ে দিয়ে নিজের মত বানোয়াট কাহিনী বলতে শুরু করলো যেখানে দোষী স্পর্শীরা। তারই প্রতিবাদ জানাতে নিধি,কেয়া বলে উঠল। নির্বাণ তখন কেয়া,নিধিকে চুপ করতে বলে শৈথিল্য দৃষ্টিতে একবার রুদ্রকে পর্যবেক্ষণ করে নিল। যদিও সে পুরো ঘটনা সম্পর্কে অবগত তাও কিছু বলল না সে। নীরবে ডিপার্টমেন্ট হেডের সাথে কথা বলে রুদ্র এবং তার বন্ধুদের পাঠানো হলো এডমিনিস্ট্রেশনের ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করার জন্য। মাহিন আর সামি খানিকটা আহত হওয়ায় তাদের মেডিক্যাল রুমে পাঠানো হলো, চিকিৎসার জন্য। বাকিদের নিজ নিজ কাজে চলে যেতে বলা হলো। ধীরে ধীরে ভীড় কমে আসতেই নির্বাণ স্পর্শীর হাত ধরে সেই জায়গা থেকে নিয়ে আসলো। তবে, তাদের যাওয়ার পানে সকলে একবার আড়চোখে তাকাতে ভুলল না। কথা বলার জন্য হট গসিপ লাগবে তো নাকি?

________________

খালি একটি ক্যাবিনে বসে আছে স্পর্শী। পিনপতন নীরবতা বিরাজমান চারদিক জুড়ে। ক্যাবিনটা টাপসি ম্যামের, নির্বাণের সাথে তার সখ্যতা আছে বলে স্পর্শীর করুণ অবস্থা দেখে সে রুমটা ছেড়ে দিয়েছে। বলা বাহুল্য, তিনি নির্বাণ আর স্পর্শীর ব্যাপারে সবই জানেন তাই বিষয়টা নিয়ে তিনি আর ঘাটেন নি। নীরবে প্রস্থান করেছেন জায়গায়টি। নিধি ও কেয়া গিয়েছে সামি ও মাহিনের কাছে, কিছু দরকার কি-না দেখতে।
স্পর্শী হাত গুটিয়ে মলিন মুখে বসে আছে। তার পাশেই কোলে ফাস্টএইড বক্স নিয়ে বসে আছে নির্বাণ। বৃদ্ধা আঙুল এবং তর্জনীর মাঝে শুভ্র তুলোর অংশটি চেপে ধরে তাতে হ্যাক্সিসল লাগাচ্ছে। অতঃপর কপাল হতে স্পর্শীর হাত এবং রক্তে ভেজা কাপড়টি সরিয়ে দিয়ে খুব সন্তর্পণে আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে চেপে ধরে। ক্ষণেই তীব্র যন্ত্রণায় স্পর্শী ঈষৎ কেঁপে উঠে ঠোঁট, চোখ খিঁচে বসে রইলো৷ নির্বাণের যেন এবার অন্তঃস্থলের দহনক্রিয়া বাড়লো। হাতের স্পর্শ আগের ন্যায় আরও কোমল হলো। তার আপ্রাণ চেষ্টা প্রিয়তম মানুষর যাতে সামান্যটুকু কষ্ট না হয়। শুকিয়ে যাওয়া রক্ত উঠিয়ে নিতেও কি যত্ন তার, যেন একটু ঘর্ষণে কোমল মানবীটি ঝড়ে পড়বে। মাঝে মধ্যে জ্বালার পরিমাণ কমাতে নির্বাণ স্পর্শীর কপালের সামনে মুখ এনে ফুঁ দিচ্ছে। ব্যাকুল কন্ঠে প্রশ্ন তার, “জ্বালা করছে? আর একটু, এতো হয়ে গিয়েছে। সামান্য আঘাত, ঠিক হয়ে যাবে।”

নির্বাণ মুখে বলছে ঠিকই ‘সামান্য আঘাত’ কিন্তু হৃদয় যে বলছে অন্য কথা। যেখানে প্রেয়সীর ক্ষুদ্রতর আঁচড় তার বোধগম্য হয় না সেখানে আজ তার রক্ত জড়েছে। শান্ত সে কিভাবে থাকে? স্পর্শী চোখ মেলে নিবার্ণের দিকে তাকালো। তার মুখের অভিব্যক্তি এতটাই করুণ যে দেখে মনে হচ্ছে ব্যথা সে না বরং নির্বাণ নিজে পাচ্ছে। খেয়াল হলো, নির্বাণের হাত কাঁপছে৷ সেই কাঁপাকাঁপা হাতেই পুরো ড্রেসিংটা শেষ করলো নির্বাণ। সবশেষে মাথায় ওয়ান-টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়ে বলল, “এই নাও হয়ে গিয়েছে। বেশি ব্যথা করছে না তো?”

শেষ প্রশ্নটি করা মাত্রই যেন শক্ত নারীর মনটি দুর্বল হয়ে পড়লো। পাড়লো না আর নিজেকে ধরে রাখতে, আপন মানুষটার কাছে এসে ভেঙ্গে পড়লো সে। বুক চিরে বেরিয়ে এলো তীব্র আর্তনাদ। সম্মানহানির আত্মগ্লানি যেন তাড়া করে বেড়াতে শুরু করলো। ফুপিয়ে উঠলো সে, নয়নের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো তপ্ত জলের বিবর্ণ ধারা। ক্ষণেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটি আগলে নিল তাকে, ঠাঁই পেল তার বুকে ঊষ্ণ আলিঙ্গনের মাঝে। নির্বাণ বলল, “হুস! কাঁদে না। আমি আছি না তোমার পাশে?”

আশকারা পেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক মনটি সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া কিশোরীর মনে রূপান্তরিত হলো। ক্ষীণ কন্ঠে টেনে টেনে কথা বলল সে, “সবাই আমাকে অনেক নিচু চোখে দেখছে। বাজে, বিশ্রী ভাষায় গালি দিচ্ছে। রুদ্র তো সবার সামনে বলেই দিয়েছে আমি নাকি…”

অশ্রাব্য ভাষায় বলা সে কথাটি বলে স্পর্শী পুনরায় ফুঁপিয়ে উঠলো। নাক টানতে টানতে বলল, “সবাই আমাদের সম্পর্ক খারাপ চোখে দেখছে। নোংরা ভাষায় সম্মোধন করছে। কিন্তু আপনার আমার সম্পর্ক নোংরা না, তাই না? বলুন না?”

নির্বাণ স্পর্শীর পিঠে হাত গলিয়ে দিয়ে বলে, “শান্ত হও। নোংরা বললেই আমাদের সম্পর্ক নোংরা হয়ে যাবে না। সত্য এইটাই, তুমি আমার বিয়ে করা বউ।”

স্পর্শী কিছু বলল না ফুঁপিয়ে গেল। সে তো জানে তাদের সম্পর্ক কি কিন্তু মানুষের দেওয়া এত এত অপবাদ কি আর ভোলা যায়? পুরো ক্যাম্পাস জুড়েই এখন তাদের কথা চলছে। নোংরা চোখে, বিশ্রী ভাষায় তুলে ধরা হচ্ছে তাদের সম্পর্ক। একটি নারীর কাছে তার সম্মান সব-চাইতে মূল্যবান। আর আজ সেই সম্মানই হানি হয়েছে। কিভাবে সবটা মেনে নিবে সে? কিভাবে? এখনো যে তার কানে রুদ্রের অশ্রাব্য ভাষা ও অকথ্যকথন কানে ভেসে বেড়াচ্ছে তার।

স্পর্শীর ভিতরকার অবস্থা নির্বাণ সম্পূর্ণরূপে ধরতে না পারলেও আংশিক আঁচ করতে পেরেছে ঠিকই। সান্ত্বনা দিতে নয়, সত্যিকার অর্থেই বলে উঠলো সে, “তোমার সম্মান হানি আমি হতে দিব না স্পর্শী, এতটুকু বিশ্বাস করো আমার উপর। সবকিছুর হিসাব আমি নিব এবং বিশেষ খেয়াল রাখবো কোন ছুট যাতে সে না পায়। সর্বোচ্চ শাস্তিটা যেন লায়। তোমার সকল কষ্টের, ঝরা প্রত্যেকটা রক্তের ফোঁটার এবং অশ্রুর সবকিছুর দাম তাকে দিতে হবে।”

স্পর্শী তখনও নির্বাক। কান্না করতে করতে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিকভাবেই ভারী হয়ে এসেছে তার। নির্বাণ স্পর্শীর মাথায় আদরমাখা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, “সব ব্যবস্থা করা হয়ে গিয়েছে, এতো আর কিছু সময়ের ব্যবধান। এরপর সব ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা কর না৷”

_________________________

মিনিট ত্রিশের পরই ক্লাসের সিআর এসে জানালো ক্লাসে সবাই এসে পড়েছে, নির্বাণ চাইলে এখন ক্লাস নিতে পারে। নির্বাণ হ্যাঁ সূচক উত্তর জানিয়ে দিয়ে সিআর-কে বিদায় করে দেয়। অতঃপর খুব সন্তর্পণে স্পর্শীর চোখ-মুখ মুছে দিয়ে তার হাতের ভাঁজে হাত ডুবিয়ে দিয়ে অগ্রসর হয় ক্লাসরুমের দিকে। নিধিরা যখন ওর কাছে পুরো ঘটনা সম্পর্কে অবগত করতে এসেছিল তখনই সে বুঝেছিল পুরো বিষয় সে নিজ থেকে পরিষ্কার না করলে কিছুই হবে না। তাই সে সিআর-কে আর্জেন্ট ক্লাসের নোটিশ দেয় এবং সকলকে দুই ঘন্টার মাঝে থাকতে বলে। সে সাথে আজ এবসেন্ট থাকলে নাম্বার কাটা হবে বলেও সাফসাফ জানিয়ে দিয়েছিল। সিআরও নির্বাণের কথা অনুযায়ী সকল গ্রুপ আর সাইটে খবরটা দিয়ে দেয় এবং ঘন্টাখানিকের মাঝেই স্টুডেন্টরাও ক্লাসরুমে একত্রিত হয়।

নির্বাণ আর স্পর্শী ক্লাসেরুমে প্রবেশ করার পর পরই সকলের নজর যায় তাদের উপর। বাঁকা চোখে সকলেই তখন দুইজনের হাতের বাঁধনের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে তাদের অপ্রীতিকর ভাবনার আসড়। কেন না, ক্লাসে উপস্থিত কম-বেশি সকলেই প্রায় চলমান ঘটনা নিয়ে অবগত। বিগত ভোররাতে নির্বাণ আর স্পর্শীর ছবি পোস্ট হলেও বেলা হওয়ার পূর্বেই ছবিগুলো সব জায়গায় ভাইরাল হয়ে যায় এমন সকলের নিউজফিডে চলে যায়। যার দরুন, কেউ আর অজানা থেকে যায় না বিষয়বস্তুটি থেকে।
স্পর্শী একবার মাথা তুলে চোখ বুলালো চারদিকে। সকলের চোখেই তখন ঘৃণা,অবজ্ঞার রেশ বিদ্যমান। ওষ্ঠ্যের কোণে ব্যঙ্গাত্মক হাসি। কেউ কেউ এখনো ফোন বের করে ছবি তুলছে, ভিডিও করছে তাদের। পরবর্তীতে রংচং মাখিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করবে বলে হয়তো। সকলের এমন মনোভাব স্পর্শীর সহ্য হলো না, দ্রুত মাথা নুয়ে নিল সে। ক্ষীণ প্রচেষ্টা করলো নির্বাণের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার। তবে পারলো না, হাত ঢিলে করার জায়গায় আরও শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরলো নির্বাণ। মুখের সামনে মাইকটা ভালোমত সেট করে বলতে শুরু করলো, “রিসেন্টলি ভার্সিটির মেইন গ্রুপে এবং বিভিন্ন রিলেটেড গ্রুপে আমাদের দুইজনকে নিয়ে কিছু ছবি পোস্ট হয়, সেগুলো নিশ্চয়ই দেখেছ তোমরা। ছবিগুলো নিয়ে সকলের অনেক মতামত, অনেক চিন্তাধারা। আমাদের সম্পর্ক নিয়েও সকলের বেশ সন্দেহ, কৌতূহল। কিন্তু উপযুক্ত তথ্যের অভাবে সকলেই দ্বিধায় ভুগছো। তবে আসল সত্যটা না জেনেই যা ইচ্ছে তাই বলে যাচ্ছ, হ্যারাস করছ আমাকে এবং স্পর্শীকে। একবারও কি চেষ্টা করেছ সত্যটা জানার? তা আর করবে কেন? রসমাখা একটা নিউজ পেলেই হয়, সেটা সত্য নাকি মিথ্যে যাচাই না করেই শেয়ার করতে জানো তোমরা। উল্টো পারলে আরও এক্সট্রা মশলাপাতি মাখিয়ে বড় করে বিষয়টা তুলে ধরো তোমরা। কিন্তু তোমরা ভুলে যাও কেন, একই মুদ্রার যেমন বিপরীত মুখ থাকে, তেমনই একটি ঘটনারও দু’টি দিক থাকে। ছবিগুলো সত্য ঠিকই কিন্তু সেখানে তুলে আমাদের সম্পর্কটা মিথ্যে। এখন আমার আর স্পর্শীর সম্পর্ক নিয়ে তোমাদের সকলের যত কৌতূহল তাই তো?”

এতটুকু বলে নির্বাণ লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে। পুরো ক্লাস তখন নীরব, মনোযোগী। কেন যেন নির্বাণের অকম্প কন্ঠ তাদের আকৃষ্ট করছে পরবর্তী কথার শোনার। হয়তো বা আগে নির্বাণ কখনো পড়ার বাহিরে এমনভাবে কথা বলেনি তাই আগ্রহ আজ তুলনামূলক একটু বেশি৷ সকলেই এখন অপেক্ষায় নির্বাণেই পরবর্তী কথাটি শোনার জন্যে। কিয়ৎক্ষণ সময় নিয়ে নির্বাণ দৃঢ়কণ্ঠে বলে, “স্পর্শী আমার বিয়ে করা স্ত্রী। সি ইজ দ্যা ওয়াইফ অফ নির্বাণ সাইয়্যেদ।”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here