ছায়া সঙ্গিনী পর্ব -১১

#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-১১
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

সকালের স্নিগ্ধ আবহাওয়ায় শরীরে হালকা শীতের আবাস দিচ্ছে।তার‌ উপর দক্ষিণ পাশের জানালা খুলে রাখা।হুরহুর করে স্নিগ্ধ ঠান্ডা বাতাস প্রবেশ করছে চার দেওয়ালের মাঝে। সাধারণ থ্রিপিস পরে আছি আমি, বোরকা খুলে রেখে দিয়েছে। বোরকা পরে তো এতো সময় থাকা যায় না তাই।স্যুপের ট্রে টা পাশে রেখে ওরনা টা পুরো শরীরে জড়িয়ে নিলাম। তারপর রাহাত কে বললাম,
– এখন কোন কথা না বলে খাবার খেয়ে নাও। তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে হবে তো নাকি?

রাহাত মলিন মুখে বললো,
– তুমি যদি এভাবে আমার পাশে থাকো তাহলে আমি সারাজীবন এভাবেই অসুস্থ হয়ে থাকতে চাই!

রাহাত কে চোখ রাঙিয়ে বললাম,
– কিসব অলোক্ষুনে কথাবার্তা বলছো? আমাকে একদম রাগাবে না বলে দিচ্ছি।রাগলে কি করবো তুমি নিজেও জানো না কিন্তু।

– কি করবে শুনি?

আমি পুরো রুমটা একবার চেক করে দেখলাম, তেমন কিছুই চোখে পরলো না যেটা দিয়ে আমি আহত হতে পারি! এদিকে রাহাত বাঁকা হাসি দিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
– কি বলো?

চট করে মাথায় বুদ্ধি এলো,তাই ফট করে বললাম,
– ঐ যে থাই গ্লাস দেখতে পাচ্ছো? সেখানে হাতটা ঢুকিয়ে গ্লাস টা বন্ধ করলে কেমন হবে বলো তো?
_________

মুহূর্তেই কারো মুখশ্রী জুরে আঁধার নেমে এলো। শুধু তাই নয় লোকটা এরকম কান্ড করবে আমার ধারণার বাহিরে ছিল।এই প্রথম রাহাতের জন্য নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে।যে মুখে কথা গুলো বলেছি সে মুখটা ঝলসে দিতে পারলে বেঁচে যাই যেন! কি দরকার ছিল এভাবে বলার? একটু সুন্দর করে বললেই তো ও খাবার টা খেয়ে নিত।
থাই গ্লাস নিয়ে কথাটা বলতেই রাহাত দাঁতে দাঁত চেপে ধরে নিজের কপাল থেকে সাদা ব্যান্ডেজ টা টান দিয়ে খুলে ফেলে!
চোখের পলকে কি থেকে কি হয়ে গেল! আমি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলাম। তখন মা কেবিনে ঢুকে দেখে সদ্য সেলাই করা স্থান থেকে গড়িয়ে র*ক্তের ধারা ব‌ইতে শুরু করেছে। আমার গলা দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছিল না তখন, মনে হচ্ছিল কোনো অদৃশ্য শক্তি আটকে রেখেছে!মা হেঁচকা টানে বসা থেকে দাড় করিয়ে আমাকে বলে,
– ব‌উ? তুমি আমার ছেলেরে কি ক‌ইছো অয় ক্যান এমন করলো? চুপ ক‌ইরা আছো ক্যান? তুমি তারে বাধ্য করছো এই কাম করতে?কতা ক‌ওনা ক্যান? আমার ছেলেডার র*ক্ত সব র*ক্ত যাইতাছে গা।অ আল্লাহ আমি কি করুম।

মায়ের আহাজারি শুনে ডাক্তার নার্স রাহাতের কলিগ সবাই দৌড়ে আসে।ডাক্তার সব কিছু রেডি করে আবার নতুন করে ব্যান্ডেজ করার জন্য। কিন্তু রাহাত তখন সবাই কে অবাক করে বলে, আমি ব্যান্ডেজ করবো না!
একজন আর্মি অফিসারের এই ধরনের কাজ তার উপর এই কথা শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি আগের মতই ছলছল চোখে তাকিয়ে আছি, কিছুই বলতে পারছি না। গলাতেই সব দলা পাকিয়ে আছে।মা পাগলের মতো বুঝিয়ে চলেছে,
– বাপ আমার ডাক্তরের কতা হুন, এমন করতাছস ক্যান?

রাহাত তখন শক্ত কন্ঠে বললো,
– মা ওরে বলো এই ধরনের কথা দ্বিতীয় বার বলবে কিনা?ওর এই নিষ্ঠুরতা আমি নিতে পারছি না।এসব বাক্য যেন মুখে ও উচ্চারণ না করে, প্লিজ মা বলো ওরে।

সবাই তখন আমার দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছে,যেন আমি কোন খু*ন করেছি। মা আমার কাছে এসে,কাদ জাঁকিয়ে বললো,
– কি বলেছোস জানি না,এহন ক আর অমন কতা কবি না?

সবাই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে আমার দিকে আমি কখন সম্মতি দিব। আমি তখন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম কিন্তু রাহাত অস্থির হয়ে বললো, এভাবে বললে হবে না মুখে বলতে হবে। তখন ওর দিকে তাকিয়ে খুব কষ্ট করে বললাম,
– আর বলবো না ইনশা আল্লাহ।

তারপর ডাক্তার ব্যান্ডেজ করে দেয়। নার্স নতুন করে স্যুপ নিয়ে আসলে,মা খাইয়ে দেয় রাহাত কে। খাওয়ানোর পর নার্স মেডিসিন দেয়, সাথে ঘুমের ও।চাই রাহাত শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরে। ঘুমানোর আগে ঘুম ঘুম চোখে,সৈনিক সোহরাব কে বলে দেয় আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে।আর তাই এখন খাবারের টেবিলে বসে আছি আমরা। সবাই খাবার খেলেও আমি খাচ্ছি না।গলা দিয়ে খাবার নামছে না যেন, জোর করে খেলে বুমি হবে তাই বসে বসে নাড়াচাড়া করছিলাম তখন মা বললো,
– ব‌উ খাইতাছস না ক্যান?

– খেতে ইচ্ছে করছে না মা,মা আমি হাত ধুয়ে নেই?

তখন রাহাতের মামাতো ভাই দুজন খাবার খেতে খেতে বললো,
– ফুফু আমরা তাইলে চ‌ইলা যাই? জানোই তো দোকানে কতো কাম আছে। এদিকে তো তোমরা সবাই আছো রাহাতেরে দেখার জন্য।

মা সম্মতি দিলেন, তারপর তারা খাবার খেয়ে রাহাত কে দেখে ফিরে গেলেন গ্রামে।
_______
রাহাত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে, এখন চারিদিকের খবরাখবর নিয়ে তার কোন ভাবান্তর নেই। আমি খুব কাছে গিয়ে চেয়ার নিয়ে বসেছি। নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা ডান হাতটা আমার হাতে তুলে নিলাম।শ্যাম বর্ণের হাতের নখ গুলো লম্বা আর খুব সাদা,বেশ সুন্দর মা শা আল্লাহ। আমার নখ গুলো ও সাদা তবে খুব ছোট ছোট।
হাতটা কিছুক্ষণ বুলিয়ে, খুব ইচ্ছে করছে ঠোঁট ছুঁয়ে দিতে! একবার রাহাতের দিকে তাকালাম, নাহ তার এই মুহূর্তে জেগে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তাই ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশ দেখে গভীর ভাবে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলাম হাতটাতে। কিছুটা লম্বা করে মুখশ্রী টা ফ্যাকাশে হয়ে আছে, গভীর ভাবে পর্যবেক্ষন করে দেখলাম বাম পাশে চোখের একটু দুরত্বে ছোট দাগ মনে হয় পিম্পল হয়েছিল এরকম। তারপর লক্ষ্য করলাম নাকের ডগায় ছোট্ট একটা তিল!যা দেখে মুচকি হাসলাম। শুধু তাই নয় শাহাদাত আঙ্গুল তুলে নেড়ে দিলাম। তারপর কপালের ক্ষত স্থান টা চোখে পরতেই, বুকটা যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। সকালে ব্যান্ডেজ টা খুলে ফেলার পর সেলাই গুলো কিরকম দৃশ্যমান হয়ে উঠে!যা মনে পরলে শরীর শিউরে উঠে।এই প্রথম বার রাহাত এতোটা ভয়াবহ ভাবে আমার সাথে রাগ দেখালো।ওর রাগের সাথে আমি পরিচিত ন‌ই,সব সময় ঠান্ডা মেজাজের মানুষ বলে দেখে এসেছি আমি।আর এই মানুষটা এভাবে রেগে যেতে পারে? সম্পূর্ণ ধারণার বাহিরে ছিল আমার।
আমার যখন রাহাতের সাথে বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে তখন আমার স্কুল ফ্রেন্ড মিলি বলেছিল,
– বান্ধবী জীবনেও এই কাজ করিস না, আর্মি পুলিশ এগুলো বিয়ে করলে কথায় রেগে যাবে।এরা প্রচুর রাগী বদমেজাজী হয়ে থাকে। তখন কথায় কথায় শুনতে হবে,আই কিল ইউ! তাছাড়া তোর অনেক রাগ, রাগে রাগে মিলে স্কয়ার হয়ে যাবে। তখন সারাদিন ঝগড়াই লেগে থাকবে সংসারে, ভালোবাসা বাসি আর হবে না।

তখন আমি বলেছিলাম রাহাত একদম শান্ত প্রকৃতির ছেলে,ওর মধ্যে কোন রাগ নেই।যদিও থাকে তাহলে আমি ম্যানেজ করে নিব। আল্লাহ চান তো এমনিতেই ভালোবাসা তৈরি হবে।

জানালায় হাত রেখে দূরের ঐ শুভ্র নীলাভ আকাশের পানে তাকিয়ে আছি। ভাবছি পুরোনো দিনের কথা। ভাইয়ার ছয় জন বন্ধুর মধ্যে একজন যে সবসময় নিরব দর্শকের মতো মাথা নিচু করে বসে থাকে,আর বাকিরা হ‌ই হুল্লোড় করে পুরো পিকনিক স্পট মাথায় তুলে নিয়েছে যেন। এতো কথাবার্তা ভালো লাগছে না বলে, সাইটে গিয়ে, সুইমিং পুলের কাছে গিয়ে বেঞ্চে বসে থাকি আমি। বসে বসে আপুর ফোন স্ক্রল করছি। হঠাৎ পায়ের কাছাকাছি একটা কালো সাপ দেখে!দিকপাশ না ভেবে দৌড় দেই যার ফলে সুইমিং পুলে গিয়ে পরি। আকস্মিক ঘটনায় বরকে যাই আমি,যার ফলে অল্প পানিতেই হাবুডুবু খেতে থাকি! মানে পানি থেকে যে উঠে দাঁড়াবো সেই জ্ঞান টুকু লোপ পায় আমার। তাছাড়া বোরকা পরা,হাতে আপুর মোবাইল,কাঁদে সাইট ব্যাগ,সব কিছু মিলিয়ে সুচনীয় অবস্থা আমার। আশেপাশের লোকজনের চেঁচামেচি শুনে আপু ভাইয়া তারা দৌড়ে আসে। তখন সবার প্রথমে রাহাত পানিতে নেমে আমাকে উপরে তুলে নিয়ে আসে।নাকে মুখে অনেক পানি ঢুকে যায়। তারপর নিকটবর্তী হাসপাতালে ভর্তি করে পানি বের করা হয়। পানির কারণে নিউমোনিয়া পর্যন্ত হয়ে যায় আমার। শেষে জানা যায় ভাইয়ার বন্ধু রাকিব প্লাস্টিকের সাপ দেখিয়ে আমাকে ভয় দেখায়,যেটা আমি সত্যি সত্যি সাপ মনে করি।এ নিয়ে রাকিব ভাইয়ার সাথে অনেক ঝামেলা হয় রাহাতের। বেচারা রাকিব ভাইয়া ও বুঝতে পারেনি এতো বড় ঘটনা ঘটে যাবে।

এরকম আরো কিছু ঘটনা ঘটে,এর থেকে আমাদের একে অপরকে পছন্দ করা। আব্বু প্রথমে রাজী ছিল না বিয়েতে। আম্মুর খুব পছন্দ হয় রাহাত কে, সেই প্রথম থেকেই আম্মু চাইতো রাহাতের সাথে যেন আমার বিয়ে হয়। আম্মুর ধারণা ছিল এরকম একটা শান্ত শিষ্ট ভালো ছেলে তার রাগী বদমেজাজী মেয়েটাকে আগলে রাখতে পারবে।
_________
দুপুরে রাহাত কে খাবার খাওয়াতে নিলে, রাহাত বললো সে মায়ের হাতে খাবার খাবে। এতে কিছুটা কষ্ট হলো আমার, কিন্তু মুখে কিছু না বলে মায়ের হাতে খাবার দিয়ে দিলাম। তারপর রাহাত দ্বিরুক্তি না করে খেয়ে নিল।
শুধু তাই নয় প্রত্যেক বেলা এভাবেই মায়ের হাতে খাওয়া শুরু করলো রাহাত। আমার সাথে তেমন প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলে না।ওর ক্ষতটা একটু শুকিয়ে আসলে কোয়ার্টারে চলে আসি সবাই। আমি প্রতিদিন নিয়ম করে ক্ষত স্থান গুলো ড্রেসিন করে দেই।সময় মতো মেডিসিন দেই। রাহাত বাসায় বসে থেকেই ল্যাপটবে কাজ করে, ফোনে কথা বলতে শুনে বুঝতে পারলাম ও আবার সেই পার্বত্য চট্টগ্রাম দূর্গম এলাকায় যাবে।

পায়ের ক্ষতটা শুকিয়ে এসেছে, এখন ব্যান্ডেজ করতে নিষেধ করে দিয়েছে ডাক্তার। তাই অফিসে গিয়েই কাজ শুরু করে দিয়েছে।এর মধ্যে একদিন গিয়ে মাকে গ্রামে রেখে এসেছে।
আমাদের মাঝে এখন স্বাভাবিক সম্পর্ক চলছে,খাই দাই ঘুমাই এই আর কি। নির্ঘুম রাত,তাই বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দূরের আকাশ দেখছি। তখন রাহাত এসে বসলো,
– ঘুমাবে কখন?

আমি অনিমেষ চাহনিতে বললাম,
– আমার কথা তাহলে মনে পরলো তোমার? সারাক্ষণ তো কাজ নিয়েই থাক।

রাহাতের এতে কোন ভাবাবেশ নেই,সে বললো অনেক রাত হয়েছে ঘুমাবে চলো। আর শোন আগামীকাল তোমাকে তোমার বাসায় রেখে আসবো। তৈরি হয়ে নিও।

এটুকু কথায় বাতাসের বেগে আমার আঁখিপল্লব দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। তবুও আড়ালে পানি টুকু মুছে নিলাম। আজো কি বাবার বাসাই আমার বাসা?
_______
আমাকে বাবার বাসায় রেখে যাওয়ার সময় তার শেষাক্ত কথা,
– খুব করে অপেক্ষায় ছিলাম কখন তুমি ঘড়িটা পরে বাকিটা আমাকে পরিয়ে দিবে! এতো গুলো দিন একসাথে থেকেও তুমি এই কাজটা করলে না আফসোস।যদি মিশন থেকে বেঁচে ফিরে আসি তাহলে দেখা হবে। তারপর,,,,

#চলবে,,, ইনশা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here