ছুয়ে_দেখো_আমার_শহর পর্ব ২৯

#ছুয়ে_দেখো_আমার_শহর
#লেখিকা_হৃদিতা_আহমেদ

পর্ব-২৯

বাড়ির চিলেকোঠায় পিয়াসের জাতাঁকলে যখন চারটি সুবোধ বালকের ছালবাকল উঠিয়ে ঝরঝরে গম বের হবার উপক্রম তখনই কোনো দেবদূত এসে জানালো তাদের একজন সঙ্গী আহত।খবর পেয়ে পাঁচজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে হুরপার করে দৌড় লাগায়।

সামিরের রুমে হুরপার করে ঢুকতেই উপস্থিত সকলে বিস্মিত হয়ে পাচজনের দিকে তাকায়।বিয়ে বাড়িতে হয়তো এমন বিরল কাহিনী কেউ কখনো দেখতে পায়নি।বরসহ তার বন্ধুদের বেহাল অবস্থা হয়তো বিয়ে বাড়িতে কারোরই কাম্য নয়।কারো মাথার একটা চুলও স্বাভাবিক অবস্থায় নেই,গায়ের পাঞ্জাবির একহাত গুটানো তো আরেক হাতা হাত বেয়ে কোমড় ছুঁইছুঁই করছে,কারো তো গলার বোতাম গুলোই উধাও।সবথেকে বেহাল অবস্থা বরের ভাইয়ের,দেখে মনে হচ্ছে বেচারাকে কাপড়ের মতো পাটাতনে আছড়ে আছড়ে পরিষ্কার করা হয়েছে।রুমে নিরবতার পতন ঘটে সূর্যের কন্ঠে।
-“কী হয়েছে?”
সূর্যের কথায় শ্রেয়া পুতুলের হাতের দিকে নজর ফিরিয়ে তুলাতে সেভলন লাগিয়ে কাটা জায়গাটা পরিষ্কার করতে শুরু করে।বাচ্চাদের দৌড়াদৌড়িতে ধাক্কা খেয়ে দেয়ালে লেগে বাম হাতটা খারাপ ভাবে ছিলে রক্তারক্তি হয়ে গেছে।এদিকে কপালটাও ফুলে ভোম্বল দাস হয়ে গেছে।পুতুল বাচ্চাদের ধাক্কার কারণে পড়ে গেলেও সে তার বেহাল অবস্থার জন্য তার গায়ে জড়ানো ভয়ংকর পোশাক টাকে দায়ী করেছে।এবং সে মনে মনে শক্ত শপথ করেছে সে আর কখনো শাড়ী পড়বে না,পড়বে না,পড়বে না।একদমই পড়বে না।কাটা জায়গায় সেভলন লাগাতেই উফফ করে উঠে পুতুল।এতক্ষণে পুতুলের দিকে নজর যায় সূর্যের।ডান হাত দিয়ে বাম হাত চেপে ধরে ঠোঁট কামড়ে টলমল চোখ নিয়ে বসে আছে পুতুল।হাত দেখে সূর্য ব্যস্ত গলায় বলল,
-” সিট,কী করে হলো!!?”
বলেই দ্রুত পুতুলের পাশে এসে দাঁড়ায়।শ্রেয়া মুখ না তুলেই গড়গড় করে আসল কাহিনী বলে দেয়।

পৃথিবীর সকল বিরলতম ঘটনা এই বিয়ে বাড়িতেই হচ্ছে।যেমন কিছুক্ষণ আগেই নববধূ বরকে টানতে টানতে বাসর ঘরে ঢুকালো।এদিকে কল্লোল শ্রেয়াকে বেঁধে নিয়ে চন্দ্রবিলাসে গিয়েছে। টম এন্ড জেরি জুরিরা আরেক দফা হাতাহাতি করে চিলেকোঠায় আত্নগোপন করেছে উদ্দেশ্য মাল খেয়ে টাল হওয়া।আর সূর্য অবাক দৃষ্টিতে পুতুলের দিকে তাকিয়ে আছে।কারণ খেয়ে আসার বিশ মিনিটের মাথায় পুতুল তার পাঞ্জাবির উপর সকল খাবার উগরে দিয়েছে।

মিসেস মধুমিতা রাগে গজগজ করতে করতে ছেলের দিকে তাকালেন।পানি ভর্তি বাটি হাতে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন,
-“বার বার বললাম ওকে নিয়ে যাস না।এখন বুঝলি তো মায়ের কথা না শুনলে কী হয়?”
টুকটুকিও বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে বলল,
-“আম্মু একদম ঠিক বলেছে ভাইয়া,আমাকে দেখেও তো একটু শিখতে পারো নাকি?”
বলেই মিসেস মধুমিতার আঁচল ধরে বাইরে হাঁটা দেয়।সূর্য হতাশ ভঙ্গিতে বিছানায় বসে ঘুমন্ত পুতুলের দিকে তাকায়।এই গরমে ব্লাঙ্কেট পেচিয়ে ঘুমিয়ে আছে পুতুল।সূর্য কিছুক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে টুপ করে একটা চুমু একে দিয়ে বলল,
-” সরি”
তার এখন আসলেই আফসোস হচ্ছে, কেন যে পুতুলকে নিয়ে গেছিল?নিয়ে গেল ঠিক আছে, কিন্তু পুকুরে গোসল না করালেই পারতো।দুদিন যাবত সর্দি-জ্বরে মেয়েটার বেহাল অবস্থা।এদিকে হাতেও চট পেয়েছে। বাবাতো হুমকি দিয়ে দিয়েছেন পুতুলের আশেপাশেও যেন না আসে সে।আজ আবার জ্বর বেড়ে বমি-টমি করে অস্থির অবস্থা।বাবা জানলে নিশ্চয় তার ক্লাস নেবে ভেবেই দ্রুত শ্রেয়াকে ফোন লাগায়।

আজ চারদিন হলো পুতুল ভাইরাস জ্বরে কুপোকাত হয়ে আছে।ডক্টর হাই পাওয়ারের এন্টিবায়োটিক দিয়েছেন।কিন্তু এন্টিবায়োটিক খেয়ে দিনে জ্বর উবে গেলেও রাতে তারা আবার উপস্থিত হয়।এসবের মাঝে একটা ব্রেকিং নিউজ হচ্ছে মি.মাহবুব ছেলেকে বয়কট করেছেন।পুতুলের রুমের আশেপাশে তাকে দেখলে নিজের রেজিষ্ট্রেশন করা পিস্তল দিয়ে ছেলের পা উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি জারি করেছেন।সূর্যও বাবার হুমকি মেনে নিয়ে পুতুলের রুমের দিকে যায়না।যদিও সেটা সবাই ভাবে কিন্তু আসল কাহিনী হলো সূর্য রোজ রাতে পুতুলের রুমে পুতুলের পাশেই ঘুমোই।আর তার থেকেও মজার ব্যাপার জ্বরের ঘোরে পুতুলের বলা কথা শুনে গড়াগড়ি দিয়ে হাসে সূর্য।
যেমন গতকাল রাতে পুতুল সূর্যর আঙুল কামড়ে দিয়ে বলেছে সে যেন তিতিয়ার সাথে একদম হেসে কথা না বলে।শুধু হাসি কেন, সে যেন তিতিয়ার সাথে একদম কথা না বলে।তারপর সূর্যর চুল গুলো দু’হাতে টেনেটুনে সূর্যর দিকে তাকিয়ে বলল এখন তো আরো সুন্দর লাগছে,না এভাবে না।বলেই ড্রয়ার ঘেটেঘুটে একটা কাঁচি নিয়ে নিজেই সূর্যর একটা বিশ্রী হেয়ার স্টাইল করার জন্য চুল কাঁটার প্রচেষ্টা চালিয়েছে।সেটার ভিডিও দেখেই সূর্য রুমে বসে গড়াগড়ি দিয়ে হাসছে।এমন সময় টুকটুকি এসে ডিনারের জন্য ডেকে যায়।টেবিলে বসে সূর্য মাকে জিজ্ঞেস করল,
-“পুতুলের কী অবস্থা মা?”
ছেলের কথায় মিসেস মধুমিতা মনে মনে বললো বাঁদর ছেলে রোজ রাতে তো তাকে দেখিসই আবার এখন নাটক করছিস।কিন্তু মুখে বলল,
-“ভালো আছে।”
সূর্য বাবার সামনে ভীষণ স্যাড ভঙ্গিতে খাওয়া শেষ করে নিজের রুমে চলে যায়।মি.মাহবুব ছেলের যাওয়ার দিকে বেশ সহানুভূতি নিয়ে তাকালেন।বেচারাকে পুতুলকে দেখতে না দেওয়ায় বেশ মন খারাপ ভেবে নিজেও একটু মন খারাপ করলেন।
আবছা আলোয় চুপিচুপি পা ফেলে পুতুলের রুমে টুপ করে ঢুকে ঠুপ করে দরজা বন্ধ করে পুতুলের পাশে যেয়ে বসে সূর্য।চারদিনের জ্বরেই বেশ শুকনো দেখাচ্ছে পুতুলকে, মুখে অসুস্থতার ছাপ লেগে আছে।কপালে হাত দিতেই চমকে উঠে সূর্য।মেডিসিন গুলো চেক করে দেখে সব ঠিকঠাকই আছে, সবগুলোই তো খাইয়ে দিয়েছে মা তাহলে আজ আবার এতো জ্বরের কারণ বুঝতে পারলো না সূর্য।দ্রুত টাওয়েলের একপাশ ভিজিয়ে পুতুলের কপালে রাখতেই পুতুল ঝট করে চোখ খুলে তাকায়।হাত দিয়ে ভেজা টাওয়েল সরিয়ে বলল,
-“শীত লাগছে, এটা নিবো না।”
সূর্য ব্লাঙ্কেটটা মেলে দিয়ে বলল,
-“এবার শীত লাগবে না নাও।”
পুতুল হাত-পা ছুড়ে ব্লাঙ্কেটটা সরিয়ে বলল,
-”এটাও নিবো না গরম লাগে।(সূর্যর টিশার্ট টা টেনে বলল)আমি এটা নিবো।”
-“টিশার্ট নিবে?”
পুতুল মাথা নেড়ে হ্যা বোঝালো।সূর্য উঠে পুতুলের ক্লজেট ঘেটে একটা টিশার্ট এনে দেয়।টিশার্ট হাতে দিতেই পুতুল টিশার্ট টা ছুড়ে ফেলে দেয়।সূর্য অবাক হয়ে বলল,
-” কী হলো ফেলে দিলে কেন?”
পুতুল উঠে বসে সূর্যর টিশার্ট ধরে বলল,
-“আমি এটা নিবো,এটা।”
-“আমার টিশার্ট নেবে?”
-“হুম”
জ্বরে যে এই মেয়ের মাথা গেছে বেশ বুঝতে পারছে সূর্য। তাই একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল,
-“আচ্ছা বসো আমি এনে দিচ্ছি।”
বলে যাবার জন্য ঘুরতেই পুতুল টিশার্ট টেনে ধরে বলল,
-“না না, আমি এটাই নিবো।”
-“এটা ভালো না আমি আরেকটা নিয়ে আসছি।”
-“না না না,আমি এটাই নিবো।”
কে শোনে কার কথা পুতুল নিজেই টেনেটুনে টিশার্ট ছিড়ে ফেলার উপক্রম করতেই সূর্য নিজেই খুলে দিয়ে বলল,
-“নাও,নাও, নাও,উফফ ”
পুতুল টিশার্ট হাতে খলখল করে হেসে ফট করে সূর্যর গালে চুমু দিয়ে বলল,
-” থ্যাঙ্কিউ ক্যাপ্টেন, দাড়ান (টিশার্ট দেখিয়ে) এটা পড়েনি।”
বলেই নিজের টপস টা টেনে পেট পর্যন্ত তুলতেই সূর্য খপ করে পুতুলের হাত ধরে টপস টা টেনে নামিয়ে দিয়ে পুতুলকে জাপটে ধরে বলল,
-“এরকম পাগলামি করো না পুতুল।আমি মরে যাবো, একদম মরে যাবো।”
পুতুল সূর্যর বুকে টুপটুপ করে চুমু খেয়ে বলল,
-”ইসস,,,,,এতো মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ কেন? আমি খেয়ে ফেলি ক্যাপ্টেন?”
বলেই সূর্যের উত্তরের অপেক্ষা না করে পট করে কামড় বসিয়ে দেয় পুতুল।

পড়ন্ত বিকেলে ক্যাম্পাস ইয়ার্ডের দক্ষিণে গাছের নিচে সাফেদ বেঞ্চটাতে বসে একধ্যানে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে অর্ক।গতবছর জন্মদিনে কেক নিয়ে অর্ককে মাখিয়ে একগাল হেসে তাকিয়ে আছে পুতুল।ছবিটাতে হাত ছুয়ে একটা নিশ্বাস ফেলে অর্ক।তার পুতুল বউটা হারিয়ে যাচ্ছে,সবকিছু বদলে যাচ্ছে তার জীবন থেকে।ছোট্ট থেকে যাকে চোখের সামনে একটু একটু করে বড় হতে দেখেছে তার নিশ্বাসের শব্দ টাও বুঝতে পারে অর্ক।কিন্তু ছোট্ট পুতুলটা তার অনুভূতির তিল পরিমাণ ছুতে পারেনি।
বিগত একমাসে পুতুলের কথায়,হাসি,দুঃখে অবাক নামটা বার বার ধাক্কা দিয়েছে অর্ককে।অবাক নামটা আসতেই পুতুলের কন্ঠে একঝাঁক স্নিগ্ধতা ভর করে ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে।পুতুলকে হারানোর একটা দুর্বিষহ অনুভূতি হানা দিচ্ছে মনে।
ভীষণ অস্থিরতা নিয়ে দিন যাচ্ছে অর্কর।আজ অস্থিরতার পাল্লাটা আরো দিগুণ করেছে সূর্য নামের ছেলেটা। পুতুলের জ্বর হয়েছে তাই ছেলেটা ফোন তুলেছে।এর আগে একবার ছেলেটার সাথে তার কথা হয়েছে খালামনির অসুস্থতার সময়।ভিডিও কল কানেক্ট করে হাই হ্যালো বলেছে।ছেলেটা যথেষ্ট সুদর্শন এবং স্মার্ট, তা তার কথা বলার ভঙ্গিতেই বুঝেছে।কিন্তু পুতুলের ফোন তোলার ব্যাপারটা তার একদমই পছন্দ হয়নি।
সব মিলিয়ে সে খুব তাড়াতাড়ি বাংলাদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।তার জীবনে পুতুলের থেকে মূল্যবান আর কিছুই নই।

চলবে
ওই একটু চুপিচুপি লিখেছি বুঝলেন 🤫🤫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here