জঠর পর্ব ২+৩

#জঠর
#পর্বঃ২_৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

শরতের বিকেলের শুভ্র নীলাভ ঝলমলে আকাশের মতো দুই চোখে চেয়ে আছে পিউলী। উচ্ছ্বাসিত অন্ত:করণে নিত্যতার অভিলাষ। বারংবার হৃদপ্রকোষ্ঠে মাতৃস্নেহের অনুপস্থিতিতে কাতর হওয়া দুঃখের সমুদ্রে পালতোলা নৌকা পেয়েছে সে। মা পেয়েছে পিউলী।

ঊষরে আকস্মিক মৃগতৃঞ্চিকার মতো নায়েলের বিয়ের কথা শুনেছিল হৃতি। কিন্তু সেই মৃগতৃঞ্চিকা সত্যরূপে তার সামনে দৃশ্যমান হতেই বিচলিত, উৎপীড়িত সে। ঘন বর্ষার অবিশ্রান্ত ঝুমঝুম বৃষ্টিতে সিক্ত তার আঁখিদ্বয়। হাঁপিয়ে উঠতেই নিজের ঘরের দিকে তটস্থ পায়ে ছুটে যায়। পিউলী বাবার মুখের তাকাল। তার চোখে উদ্ভূত প্রশ্নের উত্তর দিতে অপারগ নায়েল। মিষ্টি করে হেসে বলল—

“ঘরে যাও মামুনি। পাপা আসছি।”

মাথা ঝাঁকায় পিউলী। ছোট্ট ছোট্ট কদম ফেলে নিজ গন্তব্য হেঁটে চলে। রাগের নগ্ন প্রকাশ ঘটালেন সায়েরা। দগ্ধ গলায় বললেন—

“বিয়ে যখন করতেই হবে তাহলে আমার মেয়েটাকেই বিয়ে করতে। কম কীসে হৃতি? পিউলীর মা হওয়ার যোগ্যতা নেই ওর না- কি তোমার স্ত্রীর?”

নায়েল সংকীর্ণ গলায় প্রত্যুক্তি করে—

“খালামনি, আমি আপনাকে আগেও বলেছি। হৃতিকে সবসময় আমি বোনের মতোই দেখেছি। আমার পক্ষে ওকে বিয়ে করা কখনোই সম্ভব নয়।”

“তাহলে ওই বাইরের মেয়েটাকে বিয়ে করলে কেন?”

নায়েল অনুদ্বেগ গলায় বলল—

“কারণ, পিউলী চেয়েছে।”

নায়েল ওঠে পড়ে। নিজ কক্ষের দিকে পদযুগল বাড়ায়। সায়েরা সম্পর্কে নায়েলের মা হলেও তাকে সে খালামনি বলেই ডাকে। নায়েলের মা মারা যাওয়ার পর তার বাবা নওশাদ সাহেব সায়েরাকে বিয়ে করেন। সায়েরা ডিবোর্সী ছিল। হৃতি তার বোনের সন্তান। এখানে থেকে পড়ালেখা করে সে। হৃতির বাবা,মা গ্রামে থাকে। সায়েরা চেয়েছিলেন হৃতিকেই যেন নায়েল বিয়ে করে। কিন্তু তার সেই আশায় পানি ঢেলে দিল পিউলী।

নওশাদ সাহেব নির্লিপ্ত। উদাসীন হয়ে বসে আছেন তিনি। নায়েল তার মেয়েকে নিয়ে ওভার পজেসিভ। সায়েরা খসখসে গলায় বললেন—

“আপনি কিছু বলছেন না কেন? এসব ঝামেলার কী দরকার ছিল?”

নওশাদ সাহেব মাথা তুললেন। মিহি গলায় বললেন—

“কী বলতে চাইছ তুমি?”

জ্বলে ওঠল সায়েরা। রুষ্ট গলায় বলল—

“নায়েল কেন ওই মেয়েটাকে বিয়ে করে আনলো? আমার মেয়েকে বিয়ে করতে ওর কী সমস্যা?”

নওশাদ সাহেব শ্বাস ফেললেন। চাপা গলায় বললেন—

“পিউলী ওই মেয়েটাকেই ওর মা হিসেবে চেয়েছে। মেয়েটা আমাদের জন্য যা করেছে তা ভোলা যাবে না। আর বিয়ে করার ব্যাপারটা একান্ত নায়েলের সিদ্ধান্ত। তাতে হস্তক্ষেপ করা আমি সমীচীন মনে করছি না।”

সায়েরা সরোষে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন—

“ভাবুন তো, যদি ওই মেয়ে কোনোভাবে নায়েলের সন্তানের মা হয় তখন কী হবে?”

শঙ্কিত আঁখিপল্লবে তীব্র ভয়ের প্রকট হলো। নওশাদ সাহেবের অন্তঃরিন্দ্রিয়তে উচাটন শুরু হলো। ত্রস্ত গলায় বলে উঠলেন—

“নায়েল সবকিছু ভেবেচিন্তে- ই করেছে। মেয়েটাকে সব জানিয়ে রাখবে হয়তো।”

“যদি আমার কথাই সত্যি হয় তখন? পুরুষ মানুষ ও। কতদিন নিজেকে আটকে রাখবে নারী দেহের স্বাধ থেকে?”

গর্জে উঠলেন নওশাদ সাহেব। দারাজ গলায় বললেন—

“মুখে লাগাম লাগাও। জন্ম না দিলেও সম্পর্কে ও তোমার ছেলে। একটু তো লেহাজ করো সম্পর্কের। আর ভুলে যেয়ো না লুবানা এখনো বেঁচে আছে।”

কাউচ থেকে হন্তিদন্তি হয়ে উঠলেন নওশাদ সাহেব। স্ত্রীর এমন বেহুদা কথায় তার মস্তিষ্কে যন্ত্রণা শুরু হলো।
,
,
,
হাজারো স্বপ্নের ভীড়ে মেয়েদের অন্যতম স্বপ্ন সংসার, স্বামী, সন্তান। নিজের হাতে গড়া ছোট্ট বাবুই পাখির বাসা, আদরে ভরা স্বামী, ভালোবাসার প্রতীক সন্তানকে নিয়ে সহস্র মেয়ের বুকের হৃদগহীনে থাকে সুপ্ত বাসনা। তা আজ এক নিমিষে শেষ হয়ে গেছে অর্হিতার।

অর্হিতার চোখে জল নেই। ভাগ্যকে দোষ দেওয়া ছেড়ে দিয়েছে সে অনেক আগেই, যখন তার বাবা, মা মারা গেছে তখন থেকে। আত্মীয়-স্বজনরা নামের সাহায্য করতেও এক পা এগিয়ে আসেনি। দুঃসম্পর্কের এই মামা, মামি-ই সেদিন তাদের দুই ভাইবোনকে আশ্রয় দিয়েছিল। পড়ালেখা করছে অতি কষ্টে। যখন থেকে নিজের উপর ভরসা তৈরি হলো তখন থেকেই টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ চালাতে শুরু করে। মামা, মামি এমনিতে তো তাকে দু’বেলা খেতে দেয়নি। বাড়ির সব কাজ করিয়ে নিয়েছে তার বিনিময়ে। নাজুক নারী হাত হয়েছে খরা মৃত্তিকা।

আফসোস হচ্ছে অর্হিতার। মাস খানেক আগ বান্ধবীর বাবাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েই পরিচয় নায়েলের সাথে। পরিচয় বললে ভুল হবে। পিউলীর জন্য দিগ্বিবিদিক শূন্য হয়ে রক্তের জন্য দৌড়ে বেরাচ্ছিল নায়েল। সেই পরিস্থিতিতেই স্বর্গদূত হয়ে উপস্থিত হয় অর্হিতা। তার রক্তেই নতুন জীবন পায় পিউলী।

ভেজানো দরজা মেলে ভেতরে ঢুকে নায়েল। তাকে দেখেই খলবলিয়ে ওঠে অর্হিতা। গজগজ করে বলল—

“উপকারের এই প্রতিদান দিলেন আপনি? ”

নায়েল ছোট্ট শ্বাস ফেলল। বিনয়ী গলায় বলল—

“আপনি আমার সামনে আর কোনো পথ রাখেননি।”

“তাই বলে ভাইয়াকে টাকার লোভ দেখাবেন?”

কৃত্রিম বাতির আলোকছটায় অর্হিতার উগ্রমূর্তি অক্ষিগোচর হলো নায়েলের। মেয়েটার রাগ যেন শিরায় শিরায় ধাবমান রক্তের সাথে মিশে আছে। নায়েল নরম গলায় বলল—

“আমি বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছি। আপনি রিজেক্ট করেছেন। তাই বাধ্য হয়েছি আমি।”

“কী ভাবেন আপনি নিজেকে?”

“কিছুই না।”

গায়ের ব্লেজারটা খুলে হাতে নিল নায়েল। দরজার পাশে টেবিল। তার সাথে লাগোয়া চেয়ারটা টেনে নির্বিঘ্নে বসল। শ্রান্ত গলায় বলল—

“বিয়ে করা কোনো অপরাধ নয়। তবে আই এম সরি।”

অর্হিতা উষ্ণ গলায় বলল—

” বিয়ে করা অপরাদ নয়। বউ মরা ছেলের কচি মেয়ে বিয়ে করা অপরাদ।”

অর্হিতা এহেন কথায় হাসি আটকাত বেগ পেতে হলো নায়েলে। এক ভ্রু উঁচু করে তার সেই হাসির কারণে টগবগ করে ওঠে অর্হিতা।

“আপনি কী বলতে চাইছেন বলুন তো? আপনার মেয়ের জন্য অন্য কোনো মা পেলেন না? আমাকেই আপনার বিয়ে করতে হলো।”

“ওকে তো আপনি বাঁচিয়েছেন। ও আপনাকেই ওর মা হিসেবে চায়।”

“কিন্তু আমি চাই না। আপনার মেয়েকে আমি চাইইইই না। বুঝতে পেরেছেন।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল নায়েল। ছোট্ট করে বলল—

“এছাড়া আপনার কাছে আর কোনো উপায় নেই। আপনাকে এই বাড়িতেই থাকতে হবে। আমার মেয়ের মা হয়েই থাকতে হবে।”

রাগে থরথর করছে অর্হিতার শরীর। লোকটা কতবড়ো অসভ্য!
চিৎকার করে উঠে অর্হিতা।

“আমি আপনার মেয়েকে বাঁচিয়েছি। সেই খুশিতে আপনি আমাকে মেরে ফেলতে চাইছেন?”

নায়েল ভ্রূকুঞ্চন করে অবাক গলায় বলল—

“আপনি ভুল ভাবছেন। আমি আপনাকে জোর করতে চাইনি। মেরে ফেলব কেন? বরঞ্চ বাঁচিয়েছি। আপনার ভাই বলল, আপনি বাইরের ক্রান্ট্রিতে গিয়ে হায়্যার স্টাডি করতে চান! আমি আপনার জন্য সব ব্যবস্থা করব। শুধু তার বিনিময়ে আমার মেয়েকে আপন করে নেবেন। দ্যাটস ইট।”

রাগে হতবিহ্বল অর্হিতা বিছানার পাশ টেবিল হতে টেবিল ল্যাম্পশেডটা নিয়ে ছুড়ে মারে নায়েলের দিকে। তা সোজা গিয়ে লাগে নায়েলের কপালে। কেটে যায় অনেকটা জায়গা। অর্হিতার রাগ কমলো না। মায়াও হলো না লোকটার জন্য। ভাবে কী নিজেকে। জোর করে বিয়ে করে একটা বাচ্চা ধরিয়ে দিলেই হলো! না। এমনিতেও ও বাড়িতে তার কোনো সম্মান নেই। এখানেও যদি তাই ই হয় তাহলে সে লড়বে। নিজের জন্য-ই লড়বে। অন্যের বাচ্চাকে সে কেন মাতৃস্নেহ দেবে?

কপালে হাত দিয়ে উজ্জ্বল চোখে চেয়ে আছে নায়েল। মেয়েটার এই ঝড়ো রাগের জন্য-ই এত কাঠখড় পুরিয়ে তাকে বিয়ে করেছে সে। তার প্রতি তিক্ততা এই সম্পর্কের মাঝে দেয়াল তুললেও তার মেয়েকে দেবে আশ্রয়। পিউলীর জীবন সংকটে এই মেয়ে-ই হবে তার হাতিয়ার। যে পিউলীকে রক্ষা করবে ওই অদৃশ্য শত্রুর হাত থেকে।

দশ মাস দশদিন একটা ভ্রুণকে যেমন মা তার জঠরে লালন করে পৃথিবীর ভয়াল আগ্রাসন থেকে রক্ষা করে, ঠিক তেমনভাবে অর্হিতাও তার পিউলীকে রক্ষা করবে সেই নামহীন ভয়ংকর প্রহেলিকা থেকে। যা এখনো বলয় হয়ে ঘিরে রেখেছে তার মেয়েকে। অর্হিতার এই রাগি, জেদি মনে তার মেয়ের জন্য জায়গা করে তুলতে হবে।

পাথরে ফুল ফোটা অসম্ভব। কিন্তু যদি ফোটে, তবে তা অবিশ্বাস্য ! অর্হিতা সেই পাথর, তার বুকে-ই ফুল হয়ে ফুটফে পিউলী। নায়েল সেই আশায় আশাবাদী।

চলবে,,,

#জঠর
#পর্বঃ৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

প্রভাতের মিষ্টি রোশনাই এলোথেলো হয়ে ঢুকে পড়ছে থাই গ্লাসের কাঁচ ভেদ করে। দেয়ালের সাথে লাগোয়া কৃষ্ণচূড়া গাছটায় কচিপাতার সয়ম্বর। শীতল, মিহি প্রভঞ্জনে সয়লাব হয়ে উঠেছে মেদিনী। প্রভাকরের হলদে রঙের দুষ্ট আলো যখন নায়েলের চোখের পল্লবে খেলছে, তখন তার মাথায় লাগা আঘাতের জায়গায় ছোটো ছোটো বারো সেন্টিমিটারের হাতের পাঞ্জার প্রগাঢ়, তুলতুলে স্পর্শে মত্ত হতে থাকে। আঁখি মেলে চাইতেই নায়েলের মুক্ত চাহনিতে ঘেরাও হয় পিউলীর ছোট্ট আনন। বিহঙ্গের মনোহারী হাসি। অলস হাসিতে ওঠে বসে নায়েল। পিউলীর কপালে আস্ত চুমু খেয়ে বলল—

“গুড মর্নিং লিটল বার্ড। ”

পিউলী মুক্তো ঝরা হাসে। কচি কচি ঠোঁটে ইঁদুর দাঁতের হাসি। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল—

“গুড মর্নিং পাপা।”

চোখে হাসে নায়েল। তার সমস্ত অবসাদ, ব্যথা এক নিমিষে মিশে গেল বাতাসে। পিউলী ওঠে দাঁড়ায়। নায়েলের কপালের ক্ষত জায়গায়টায় হাত দিয়ে বারংবার ছোঁয়। কিন্তু অতি সন্তর্পনে। পাছে ব্যথা লেগে যায়! অর্হিতা তার রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় নায়েলকে আঘাত করে। নায়েল প্রতিবাদ করেনি। ড্রেসিং করে ওয়ান টাইম স্ট্রিপ লাগিয়ে নেয়। পিউলীর কক্ষেই জায়গা হয় তার।
বাবার ব্যথায় মন ভারাক্রান্ত হয় পিউলীর। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল—

“ব্যথা পেয়ছ পাপা?”

নায়েল অধর ছড়ায়। আলতো অনুভূতিতে বলল—

“নো, মাই প্রিন্সেস। কাম।”

মেয়েকে পায়ের উপর বসিয়ে গালে চুমু খায় নায়েল। পিউলীর ছোট্ট চুলের অরন্যে হাত গলিয়ে বলল—

“ব্রাশ করেছ?”

“হুম।”

“খেয়েছ?”

“না।”

“কেন?”

শিয়র নত করে পিউলী। বিষণ্ণ গলায় বলল—

“আমি তোমার সাথে খাবো।”

মলিন হাসে নায়েল। নিরুত্তাপ গলায় বলল—

“যাও টেবিলে। পাপা ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

“ওকে পাপা।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে নায়েল।
,
,
,
খাওয়ার টেবিলে সবাই উপস্থিত থাকলেও নেই অর্হিতা। মিঠে অভিমানে শান্ত পিউলী। তার মা কেন আসে না? বারবার সিঁড়ির দিকে চোখ ফেলছে সে। আচমকা পদধ্বনিতে উচ্ছল হাসে পিউলী। অর্হিতা এসে দাঁড়িয়েছে ডাইনিং স্পেস থেকে একটু দূরে। পিউলী উচ্ছ্বাসিত মেজাজে চেয়ার থেকে নেমে এসে ব্যাকুল হয়ে অর্হিতার আঙুল চেপে ধরে। ঝরঝরে হাসির ফোয়ারা বইয়ে বলল—

“মামুনি, এসো, এসো। খাবে চলো।”

অর্হিতার সুপ্ত রাগ বিক্ষিপ্ত হলো। ঝাঁড়া মেরে হাতটা ছাড়িয়ে বলল—

“এই মেয়ে, তোমাকে না বলেছি আমাকে মামুনি বলে ডাকবে না। আমি তোমার মা নই। যাও এখানে থেকে।”

শিরা ফুলে ওঠে নায়েলের। বাবার দিকে দুঃখী দুঃখী চোখে চেয়ে থাকে পিউলী। নায়েল গম্ভীর আওয়াজে বলল—

“নিজের জায়গায় বসো পিউ।”

পিউলী তার ছোট্ট কদমে ফিরে আসে নিজের জায়গায়। তাচ্ছিল্যভরা চাহনি অর্হিতার। উপহাস করে বলল—

“জুতো মেরে গুরু দান।”

ঘরের কেউ কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। অর্হিতার মেজাজ চড়ে গেল দ্বিগুন। নওশাদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে জ্বলন্ত গলায় বলে উঠে—

“আপনি তো তার বাবা তাই না? আপনি পারতেন নিজের অবিবাহিত মেয়ের সাথে একটা বিবাহিত ছেলের বিয়ে দিতে? পারতেন?”

নওশাদ সাহেব কোনো কথা বলল না। নায়েলের দিকে তাকিয়ে গিলে নিলেন কথা। সরোষে ফের বলে উঠে অর্হিতা—

“মেয়ে তো আপনাদের বাসাতেই ছিল। তাহলে আমাকে কেন জোর করে বিয়ে করল আপনার ছেলে?”

হৃতি মৃদু চোখে নায়েলের চক্ষুদর্পণে তাকাল। নায়েল প্রতিক্রিয়াহীন। যেন কিছু শোনেইনি সে। অর্হিতার রাগ মানলো না। রাগে হতবিহ্বল অর্হিতা চওড়া গলায় বলল—

“এই জন্যই হয়তো আপনার বউ মরে গেছে। টাকার প্রভাবে মানুষ কেনাবেচা করা যার স্বভাব তার সাথে এর চেয়ে আর ভালো কী হবে!”

নিজেকে কন্ট্রোল করার সমস্ত ক্ষমতা হারালো নায়েল। তীব্র ক্রোধে চেয়ার ছেড়ে ওঠে এসে সজোরে এক চড় বসিয়ে দেয় অর্হিতার গালে। উপস্থিত সকলে হতভম্ব। নায়েল সহজে রাগে না। আর নিজের মেয়ের সামনে তো কখনোই না। পিউলী কেঁপে ওঠে। তার চোখের পাতায় নামে শ্রাবণ মেঘের ঢল। সক্রোধে খেঁকিয়ে উঠে নায়েল—

“আপনার সাথে যা হয়েছে তার জন্য আমি দায়ী। এই ব্যাপারে পরিবারে কোনো মানুষের সামনে আঙুল তোলা যাবে না। এই বাড়ির কুকুরও আমার মেয়ের সামনে জোর গলায় ডাকে না। আর আপনি তো একটা মানুষ! মিনিয়াম ম্যানার্সটুকু আপনার নেই? একটা বাচ্চার সামনে কীভাবে কথা বলতে হয় আপনি জানেন না?”

ছলছল চোখে অর্হিতার ফোঁস ফোঁস করছে। তার চোখের দিকে দৃঢ়তার সাথে তাকিয়ে কাঠখোট্টা গলায় নায়েল বলে উঠে —

“পিউলীর খাবার বক্সে দিয়ে দাও। চলো পিউ।”

নীরবতায় আচ্ছন্ন হয় ঘর। কারো অন্ত:করণে তীব্র আক্রোশ, কারো চেহারায় মলিনতা। কেউবা উল্লাসিত!
,
,
,
খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে পিউলী। চেয়ারে বসে ডেক্স ডিঙিয়ে মেয়ের দিকে কাতর চোখে চেয়ে আছে নায়েল। কেবিনের একপাশে ডিভান। সেখানে নির্বিকার বসে আছে পিউলী। নায়েল চেয়ার ছেড়ে ওঠে আসে। ছোট্ট টি টেবিলের উপর হাত রেখে হাঁটু ভাঁজ করে বসে। মর্মাহত গলায় বলল—

“খেয়ে নাও পিউ।”

“আমি খাবো না। তুমি মামুনিকে মারলে কেন?”

বুকের কার্ণিশ ছুঁইয়ে রক্তক্ষরণ হয় নায়েলের। ছোট্ট করে বলল—

“আই এম সরি।”

“তুমি মামুনিকে সরি বলোনি।”

ফোঁস করে শ্বাস ফেলল নায়েল। গাঢ় গলায় বলল—

“বলব।”

“আর সরি গিফ্ট?”

হতাশ শ্বাস ফেলে নায়েল। মেয়েটার গায়ে হাত তোলা তার ঠিক হয়নি। যে অপরাধে সে অর্হিতার গায়ে হাত তুলেছে সে একই অপরাধে সেও দোষী। নায়েল ভেবে পায় না, লুবানার সাথে দীর্ঘ সময় কাটিয়েও তার প্রতি পিউলীর কোনো মায়া তৈরি হয়নি। কিন্তু অর্হিতাকে প্রথম দেখাতেই তার প্রতি অমোঘ টান অনুভব করেছে পিউলী। হাসপাতালের সফেদ বিছানায় যখন শুয়েছিল পিউলী তখন পুরো পৃথিবীকে বিস্বাদ মনে হয়েছিল নায়েলের কাছে। চোখ পিটপিট করে চেয়ে প্রথমবার যখন পিউলী অর্হিতাকে দেখে আর জানতে পারে যে তার রক্তেই বেঁচে ওঠেছে পিউলী তখন থেকে এক অমীমাংসিত, অজ্ঞাত, আছোঁয়া মায়ায় আবিষ্ট হয় পিউলী। নায়েলকে বাধ্য করে বারবার অর্হিতার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। মায়ের আদরহীন এক সন্তানের আকুতি ফেলতে পারে না নায়েল। বেহায়ার মতো বারবার কড়া নেড়েছে অর্হিতার অন্ত:রিন্দ্রিয়ের বদ্ধদ্বারে। প্রতি বারেই সে ফিরে এসেছে রিক্তহস্তে। তাই বাধ্য হয়ে এমন গর্হিত কাজ করেছে সে। অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে, ক্ষমতার জোর খাটিয়ে মেয়েকে মা এনে দিয়েছে।

কেন, জন্ম না দিলে কী মা হওয়া যায় না?

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here