#জলারণ্যের_ওপারে
——————————
৯.
নতুন এক সূর্যোদয় হলো। নতুন ভোরের সূচনা হলো। সেইসাথে শুরু হলো মোহনার জীবনের নতুন অধ্যায়। ভেতরের ঝলসানো অনুভূতি গুলো নতুন করে তরল রূপে পরিণত হয়েছে। সবকিছুতে একটা ভালোলাগা নামক অনুভূতি উড়াউড়ি করছে। ফজরের নামায পড়ে রান্নাঘরে গেল মোহনা। রুমি তখন চায়ের পানি বসিয়েছে মাত্র। মোহনাকে দেখে বললো, ‘ওমা! তুমি এতো সকালে আসলে যে? এই তিনদিন তো ঠিকমতো ঘুমাওনি। কালই ফিরলে হসপিটাল থেকে। যাও গো যাও। এখানে থাকতে হবেনা।’
মোহনা হেসে বললো, ‘আমাকে নিয়ে ভাবতে হবেনা ভাবি। আমি ঠিক আছি। তুমি বরং তোমার আর আমাদের নতুন অতিথি যে আসবে তার খেয়াল রাখো। এখনথেকে সকালে চা আর রান্নাবান্না আমিই করব।’
রুমি কিছুটা লজ্জা পেলো। তারপর মোহনার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আরে একি! তোমার চুল থেকে তো টুপটাপ করে পানির ফোঁটা পড়ছে।’
‘আসলে ভাবি, হেয়ার ড্রায়ারটা হঠাৎ কাজ করছেনা।’
‘আচ্ছা বাদ দাও। ভেজা চুলে নারীর সৌন্দর্য কয়েক গুন বাড়ে।’ বলে মুচকি হাসলো রুমি। মোহনা মাথানিচু করে হাসলো। রুমি আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘ভাইয়ার অবস্থা কেমন?’
মোহনা চা বানাতে বানাতে বললো, ‘এখন পুরোই ভালো আলহামদুলিল্লাহ। আসলে যেভাবে ভেবেছিলাম, ততটা জখম হয়নি। হালকা একটু চিরেছে। ভালো বোধ করছেন দেখেই তো কাল হুলুস্থুল কাণ্ড করে ফিরে এলেন।’ বলে হাসলো মোহনা। সৌমিককে নিয়ে তিনদিন থাকতে হয়েছে হসপিটালে। এই তিন’দিন স্বামীর সেবা করতে এতটুকুও কার্পণ্য করেনি মোহনা। নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছে, সময়মত ঔষধ খাইয়েছে, গা মুছিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ করে মোহনা যেন একজন পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী হয়ে উঠলো। স্বামীর জখমগুলো যেন তাকেও কষ্ট দিতে লাগলো। তিনদিন পর যখন নিজেকে পুরোপুরি সুস্থ মনে করলো সৌমিক, তখনই বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিলো এবং বাড়ি ফিরে এলো রাত আটটায়। এই তিনদিন মোহনা যতই সৌমিককে দেখেছে, ততই তার ভেতর এক অদ্ভুত মায়া জন্মেছে। দূর্ঘটনার সময় নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে মোহনা আগলে রেখেছিলো সৌমিক, যতবারই এই কথাটা মনে পড়ে ততবারই নাম না জানা অনুভূতিরা এসে কড়া নাড়ে মোহনার হৃদয়ে। সমুদ্র সমান মায়া জন্মায়। এতো মায়া কেন হলো? সে জানেনা। হয়তো আল্লাহর রহমত। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে তো আল্লাহ অনেক রহমত বর্ষণ করেন।
‘মায়ের কাপে আধা চামচ চিনি দিও। মা চিনি কম খান।’
রুমির কথায় ঘোর কাটে মোহনার। বললো, ‘ফুপুর ডায়বেটিস?’
‘হুম।’ হেসে বললো রুমি। মোহনা চা বানিয়ে এক কাপ দিলো রুমিকে। এক কাপ টেবিলের ওপর রেখে গেল মনিরের জন্য। আর এক কাপ নিয়ে গেল নমিরুনের জন্য উনার ঘরে। নমিরুন তখন কোরআন পাঠ করছিলেন। মোহনাকে দেখে মিষ্টি করে হাসলেন। মোহনা হেসে চায়ের কাপ আর বিস্কিটের পিরিচটা রাখলো উনার সামনে। বললো, ‘চা টা খেয়ে নিন। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।’
উত্তরে নমিরুন হাসলেন শুধু। কিছু বললেন না। মনেমনে অনেক খুশি হলেন। ঘরের বউ নিজের সংসার নিজে সামলানোর দায়িত্ব নিয়েছে।
★
টুকটাক কাজ সেরে নিজের ঘরে গেল মোহনা। তখন সকাল আটটা বাজে। ঘরে ঢুকেই দেখলো সৌমিক সবেমাত্র ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে। মোহনা বললো, ‘আপনি উঠে গেছেন? চা দিব এখন?’
সৌমিক সরু চোখে তাকালো মোহনার দিকে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরখ করলো। সৌমকের এমন চাহনি বিব্রত করছে মোহনাকে। মোহনা বললো, ‘এভাবে তাকাবেন না তো।’
‘ভাবছি…’
‘কী?’
‘ভাবছি… এই তিনদিন এতো সেবা করলে যে?’
‘শুকরিয়া করুন। যদি আপনার জায়গায় আমি হতাম তাহলে আপনাকে আমার সেবা করতে হতো।’
‘সে বুঝলাম। স্বামীর জন্য মায়া আছে তাই করেছো। কিন্তু…’ বলে ভ্রু কুঁচকালো সৌমিক।
‘কী? কিন্তু কী?’ মোহনা ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
‘এই তুমি সকাল সকাল গোসল করলে কেন? মানে, আমি কি ঘুমের ঘোরে কিছু করেছি? আমাদের মধ্যে রোম্যান্স হয়েছে? মানে, বড় রোম্যান্স?’ চোখ বড়বড় করে বললো সৌমিক। মোহনার মুখ তখন হা হয়ে গেল। সে ফোস ফোস করে বললো, ‘আপনি… আপনি আসলেই একটা যা-তা! গোসল কি শুধু ঐসব করলেই করে নাকি হ্যাঁ? আমি… আমিতো… আরে ধুর!’ বলে চলে যেতে লাগলো মোহনা। তারপর আবার বললো, ‘চা দিচ্ছি, টেবিলে আসুন। আর শুনুন, আপনার জন্য আমার মায়া আছে এটা কে বললো? বয়েই গেছে!’ বলেই বেরিয়ে গেল মোহনা। সৌমিক হাসতে লাগলো ঠোঁট কামড়ে। এমন সময় নিহানের কল এলো। সৌমিক রিসিভ করলো, ‘হোয়াটস আপ?’
‘ইমো, ফেইসবুক, ভাইবার, মেসেঞ্জার!’
‘শালা চুপ। আমাকে দেখতে আসলিনা একবারও!’
‘গিয়েছিলাম। কিন্তু কেবিনে তোর কাছে যাইনি কারণ তোর বউ ছিলো।’
‘তো সমস্যা কোথায়?’
‘ভাবলাম, বন্ধুর নতুন নতুন বিয়ে। দেখা যাবে কেবিনেও রোম্যান্স লাগায় রাখসে। তাই আর যাইনাই। আফটার অল এটাতো তুই।’ বলেই খিকখিক করে হাসলো নিহান। সৌমিক বললো, ‘এখনও সজ্ঞানে নিজে একটা চুমুর ফিল নিতে পারিনাই। আর তুমি মামা রোম্যান্স মারাও?’
‘কেন মামা? তুমি হিজরা নাকি?’
‘এই শোন, আমার পুরুষত্বে আঙুল তুলবিনা।’ ঝাঁঝের গলায় বললো সৌমিক। ওপাশে নিহানের হাসি শোনা গেল। হাসতে হাসতে সে বললো, ‘তা নয়তো তোরে আর কী কমু বল? মানে! সিরিয়াসলি? সৌমিক… সৌমিক কিনা এখনও নিজের বউয়ের সাথে রোম্যান্স করেনাই। আমি উপরে উঠবো প্লিজ আমারে দড়ি দে।’
‘আমার অসহায়ত্ব নিয়ে মজা করো না। নাহলে অভিশাপ দিব যাতে তোরও এমন এক্স ওয়ালা বউ মিলে।’ অসহায়ের মতো বললো সৌমিক।
‘এক্স, ওয়াই, যা কিছু ওয়ালাই হোকনা কেন। তোর মতো সাজায়ে রাখবনা আমি। প্রথম রাতেই কাম তামাম।’
‘সত্যিই তুই একটা ডট ডট!’
‘তোর ডট ডট মানে মাদার*, বাইন*, আরো কয়েকটা আছে। আমারে এরমাঝে কোনটা কইলি?
‘তুই… তুই…’
‘হইছে থাম থাম। হবে একটা।’ সৌমিককে থামালো নিহান। বললো, ‘ট্রিপের কথা মাহফুজ বলছিলো তো। প্লান কী?’
‘হ্যাঁ। ভাবছি এই সপ্তাহেই যাবো।’
‘তোরে শালা পাঠিয়েই কী করব। কিছুতো করবিনা বউয়ের লগে।’
‘করতাম না। জীবনে করতাম না যা। তোর কী?’ ধমকের সুরে বললো সৌমিক। নিহান এবার হেসে দিলো জোরে জোরে। হাসলো সৌমিকও। অনেকক্ষণ হাসলো দুজনে মিলে। তারপর সৌমিক বললো, ‘শোন, এই সপ্তাহেই যাবো। ধর, দু’তিন দিনের মাঝে। মনির ভাইয়াকে বিজনেসের দিকটা সামলাতে দিয়ে যাবো। চিল মারা দরকার মামা।’
‘আচ্ছা তাহলে আমি সবকিছু ব্যবস্থা করি। হ্যাপি হানিমুন।’ বলেই রেখে দিলো নিহান। সৌমিক হেসে হেসে পেছন ফিরে চমকে গেল। মোহনা ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সৌমিক তাকাতেই ধমক দিয়ে বললো, ‘এক ঘণ্টা আগে বলেছি টেবিলে আসুন। চা ঠাণ্ডা হয়েছে, আমাকে আবার গরম করতে হয়েছে।’
‘এক ঘণ্টা! এতো সময় কখন হলো…’ বলে সে মোবাইলে সময় দেখলো। তারপর বললো, ‘বেশি হলে পনেরো মিনিট গড়িয়েছে। তাছাড়া কাজের লোক আছে। তোমাকে কষ্ট করতে কে বলেছে?’
‘আপনার চা কাজের লোক কেন গরম করবে? আমার স্বামীর চা কাজের লোক গরম করবে আমি থাকতে? আশ্চর্য!’ বলে বিরক্তি নিয়ে ট্রেটা রাখলো মোহনা। রেখে পেছন ঘুরলো। দেখলো সৌমিক চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মোহনা আবার বিরক্ত হলো। বললো, ‘কী ব্যাপার? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’
‘তু-তুমি… কী বললে?’ আস্তে করে বললো সৌমিক।
‘কখন কী বললাম?’
‘এইমাত্র।’
‘ওহ, বললাম আমার স্বামীর চা কেন কাজের লোক গরম করবে?’ স্বাভাবিক ভাবেই বললো মোহনা।
সৌমিক আরো বেশি অবাক হলো মোহনাকে এতো স্বাভাবিক দেখে। সে বললো, ‘আচ্ছা, হ্যাঁ তাইতো।’
‘বলছি যে, কোথায় যাবেন?’
‘হ্যাঁ? কোথায় যাবো?’
‘মাত্রই শুনলাম। ফোনে বলছিলেন।’
‘ঐতো, বন্ধুরা আমার আর তোমার জন্য… মানে, সেন্ট মার্টিন যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে।’ ইতস্তত করে বললো সৌমিক।
‘ওয়াও! সেন্ট মার্টিন! সত্যি? আমরা হানিমুনে সেন্ট মার্টিন যাবো!’ খুশি যেন উপচে পড়ছে মোহনার চোখ থেকে। সৌমিক অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মোহনা আবার বললো, ‘আমার বরাবরই ইচ্ছা ছিলো হানিমুনে সেন্ট মার্টিন যাওয়ার।’
‘আমিতো বলিনি যে আমরা হানিমুনে যাচ্ছি।’ ঢোঁক গিলে বললো সৌমিক। মোহনা মাথানিচু করে হাসলো। তারপর আস্তে আস্তে সৌমিকের কাছে এলো। সৌমিকের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী একসাথে কোনো ট্রিপে গেলে সেটা হানিমুন ট্রিপ হিসেবেই ধরা হয়। আমাদের তো এখনও মধুচন্দ্রিমা হয়নি, তাইনা?’
সৌমিক যেন একসাথে দু’তিনটা হার্টবিট মিস করে গেল। তার মনে হলো এক্ষুণি সে হার্ট অ্যাটাক করবে। মোহনা বেরিয়ে যেতে যেতে বললো, ‘চা শেষ করুন। এবার আর গরম করে এনে দেবনা।’
সৌমিকের নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। মাথা ভনভন করছে। হুট করে কী করে এতো বদলালো মোহনা? এতো পরিবর্তন! স্বামী-স্ত্রী… এরকমটা তো সে বলেনা। বিয়ের আগেও অদ্ভুত ব্যবহার করেছে। বিয়ের পরেও এমন ভাব করেছে যেন সে সহ্য করতে পারেনা সৌমিককে। কিন্তু এই কদিন থেকে এ যেন এক অন্য মোহনা হয়ে গেছে। সৌমিক মাথা ঝাঁকালো। আনমনে বসে বসে চা খেতে খেতে ভাবতে লাগলো। প্রেয়সীর মনে কী জায়গা পেয়ে গেল? এতো সহজে?
মোহনা হাসছে খুব হাসছে। সৌমিকের ঐ গোবেচারা চেহারা মনে হতেই হাসতে হাসতে যেন পেট ফেটে যাচ্ছে তার। সৌমিককে বিভ্রান্ত করে খুব মজা পেয়েছে সে। হাসতে হাসতে নিজে নিজেই বলে উঠলো, ‘আমার স্বামী অতো খারাপও না। ভালোই!’ বলে আবার হাসতে লাগলো।
★
চলবে……
©ফারজানা আহমেদ