জলছবি পর্ব ১৮+১৯

#জলছবি
#পার্ট_১৮
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
টুনির মা আশেপাশে না তাকিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে আসা লোকদের বলতে লাগলো,
“দেখেন দেখেন, আমার কথা বিশ্বাস হইলো? যুবতী মাইয়া মাইনষের ঘরে পোলা মাইনষের কাম কি?” বলেই পৈচাশিক এক ভাব নিলেন। কথা শেষে যখন সামনে তাকালেন তখন ‘ভূত দেখার’ মতো চমকে গেলেন। একজন ছেলে থেকে কি করে এতো মানুষ হয়ে গেলো সেই হিসেব-ই যেন মেলাতে পারলেন না। যেই চার পাঁচজন মুরব্বী নিয়ে এসেছিলে তাদের মধ্য থেকে একজন বললে,
“কি গো টুনির মা? আপনে যে কইলে একজন ছোকরা। এরা তো মনে হইতাছে ঘরের মেহমান। আপনে কি মশকারা করলেন নি?”
টুনির মা প্রতিত্তুরে বলেন,
“অ্যাঁ?”
তারপর চোখ দুটো গোলগোল করে সবাইকে দেখে নোলকের দিকে তাকালো।
নোলক শুরুতেই টুনির মায়ের মতলব ধরে ফেলেছে। এবং নবনী যে সঠিক ধারনাই করেছিল তাও বুঝতে বাকি রইলো না। পরিশেষে আল্লাহ পরিকল্পনায় তুষ্টি অনুভব করলো। এবং টুনির মাকে কৌশলে ব্যাঙ্গ করার জন্য কার্টুর টাইপ চওড়া হেসে বলল,
“ওমাহ কুটলি চাচি! আপনাকে দাওয়াত দেইনি বলে এত রাগ হলেন যে, এলাকার সবাইকে মাইকিং করে নিয়ে আসলেন! ইশশিরে! আগে বলবেন না, আপনার আমার আপুর বিয়ে খাওয়ার এতো শখ? থাক রাগ কইরেন না। আসেন আসেন, আসন করে বসেন।”
টুনির না বাকরুদ্ধ। এমন ভাবে হেয় হবে তা যেন ভাবতেই পারেন নি!
নোলক অন্য গুরুজনদের দিকে তাকিয়ে নমনীয় কন্ঠে বলল,
“আসলে আপুর বিয়েটা হুট করে প্ল্যান ছাড়াই হয়ে গেলো যে, কিছু জানাতে পারিনি। অপরাধ নেবেন না চাচারা। আসুন বসুন। আমার আপুর জন্য একটু দোয়া করে জান।”
তাদের ভেতর থেকে একজন নোলকের ভদ্রতা সন্তুষ্ট হয়ে বললেন,
“না, না মা। কোনো অসুবিধে নেই। তোমরা কেমন তা তো আমরা জানি। টুনির মায়ের কথায় উল্টো অন্যকিছু ভেবে বসেছিলাম, তোমরা বরং কষ্ট পেও না। আনন্দে ব্যাঘাত ঘটালাম।”
তারপর প্রায় সকলে মিলে টুনির মাকে এক প্রকার ধমকা-ধমকি করতে করতে বেড়িয়ে গেলেন। টুনির মা মিনমিন করে কিছু বলতে গেলে আরো বেশি ধমক খেল। সকলে চলে যাওয়ার পরও কিছুক্ষণ নির্লিপ্ত ভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন টুনির মা। নোলক প্রথমে মুখ টিপে হাসলো। তারপর টুনির মার একটু কাছে ঝুঁকে বিদ্রুপের ন্যায় সুর তুলে বলে,
“ও টুনির মা,
তোমর কুটনামী সফল হইলো না,
আর কত কাল কুটনামী করবা?
বয়স তো কম হইলো না!”
শেষ করে বিস্তর হাসে। তারপর বলে,
“সুন্দর হইছে না, গানটা? এই লিরিক্স দিয়ে ‘টুনির মার’ সেকেন্ড ভার্সন বের করা যাবে। কি বলো?”
টুনির মা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বেড়িয়ে যেতে যেতে বলে,
“বেয়াদপ, পাঁজি মাইয়া। আজ শয়তানি কইরা পার পাইয়া গেছোস দেইখা ভাবছস সবসময় পার পাবি? আমার লগে বেয়াদপি? উচিত শিক্ষা দিয়াই ছাড়মু।”
নোলক আরো ক্ষ্যাপানোর জন্য পুনরায় সুর তুলে বলে,
“ও টুনির মা?
তুমি এমন ক্ষেইপা গেলা ক্যা?
হুমকি ধামকি দিয়া-মিয়া
আতংকে ফালাইলা!”
এতক্ষণ সবাই খানিক ভয় সংশয় নিয়ে চুপচাপ সবটা দেখলেও, নোলকের এই ভিন্নরূপী প্রতিক্রিয়া ও বিদ্রুপ দেখে না হেসে পারলো না। ইশান বলল,
“ইনি কি আমাদের সমাজের সেই তথাকথিত ‘পাশের বাসার আন্টি’?”
নোলক বোনের পাশে এসে বসে একগাল হেসে বলল,
“নাহ, ইনি হচ্ছে বাসের পাশার কুটলি চাচি! তাই না আপু?”
নবনী মৃদু হেসে বলে,
“ফাজিল!”
সবার মাঝে হাসির রোল পড়ে যায়।

তারপর অনেক কথা হয়, আনন্দ হয়, মজা হয়। সবকিছুতেই, সবার সাথেই নোলকের অস্থির সংযোগ। এতসবের ভেতর থেকেও আদ্রকে লক্ষ্য করতে ভুলে না। ইতিমধ্যে অবশ্য জেনে গিয়েছে আদ্র এবং ইশান দুজন একই ক্যাম্পাসে আরমানের জুনিয়র এবং প্রাক্তন রুমমেট। প্রাক্তন বলার কারন এখন আর এক সাথে সাথে না। দুজনকেই আরমান ছোট ভাইয়ের নজরে দেখে, পছন্দ করে, ভালবাসে। ইশান বলে,
“আরেহ! বিয়ে বিয়ে ফিল পাচ্ছি না কেন? কেউ একটু গান-টান গাও? এই অগ্নিশর্মা? একটা গান শুনাও তো ঝটপট? আগুন আগুন গান।”
নোলক চোখ কপালে তুলে পাল্টা প্রশ্ন করে,
“আমি? অসম্ভব। ইহা একখানা অসম্ভব কথা।”
আদ্র ফোড়ন কেটে বলে,
“আমি তো জানতাম অসম্ভব অসম্ভব কর্মকান্ড করাই কারো প্যাশন!”
নোলক বলে,
“মোটেও না।”
আদ্র হাসে। এই ছেলেটার হাসিটা ঠিক কেমন যেন। নোলক অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো, আদ্র’র হাসি ওর ভালো লাগছে! আদ্র’র কথাতেও তেমন রাগ হচ্ছে না। সবার কথার মাঝে হুটহাট আদ্র’র বলা ছোট ছোট কথা গুলোই কানের কাছে বাজতে থাকে অনবরত! ভারী অদ্ভুত! এই বুঝি মুগ্ধতার শুরু!

এরপর….এরপর কেটে গেলো ছয়মাস। এই ছয়মাসে, হ্যাঁ অল্পদিন। তবে এই অল্পদিনে কারো বিস্তর কোনো পরিবর্তন না হলেও অল্পসল্প পরিবর্তন অবশ্য হলো।
ফয়সাল আরো দুটো টিউশনি নিলো। মায়ের জন্য মাস শেষে টুকিটাকি কিছু কিনে নিয়ে অমূল্য সেই হাসি দেখার জন্য, ছলছল চোখ দেখার জন্য, জড়িয়ে ধরে ‘ভালোবাসি মা’ বলার জন্য। যথা সম্ভব লুবনাকে নিজের ভাবনায় ঠাঁই না দেয়ার অনবরত চেষ্টা চালাতে লাগলো। যদিও এতে বাধা হয়ে দাঁড়াল লুবনা নিজেই!
কারণ লুবনার ভাবনায় ফয়সালের জায়গা হলো। রাতদুপুরে ফোন দিয়ে বলা শুরু হলো,”দোস্ত, বাসার সামনে আয় তো একটু। খুব ইম্পরট্যান্ট কথা আছে। কলেজ যাওয়া অব্দি অপেক্ষা করতে পারছি না।”
কিন্তু বাস্তববাদী ফয়সাল প্রতিবারই রুক্ষ স্বরে বলতো,
“আমি তোর জামাই লাগি? আমার সাথে রাতবিরেতের কিয়ের কথা? ঘুমা ফাজিল! বড়লোক বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে, বড়লোকের মেয়ের সাথে কথা বলা আমার পোষায় না, বুঝলি?”
লুবনা রাগে অভিমানে ফোন কেটে দিতো। কিন্তু সে এ-ও জানতো, যতই উপর উপর কঠিন ব্যবহার করুক, এই ছেলে কখনই ওর মুখ ফুটে চাওয়া কোনো কিছু অপূর্ণ রাখে না। হলোও ঠিক তাই। মিনিট দশেক পর লুবনার ফোনে ফোন আসতো। লুবনা মিষ্টি হেসে ফোন কানে দিয়ে বারান্দায় আসতো। চেকপ্রিন্টের শার্ট আর জিন্স পরিহিত বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা টগবগে যুবকটাকে দেখে মুখের হাসি আরো প্রশস্ত হতো।
ওপাশ থেকে ফয়সাল কটকটে কন্ঠে বলে উঠতো,
“কি বলবি বল? সময় দুই মিনিট, ফ্যাস্ট।”
“এক মিনিট দাঁড়া আমি নিচে আসি।”
বলেই পা টিপেটিপে সবার আড়ালে বাড়ির নিচে নেমে আসে। ফয়সালের সামনে দাঁড়িয়ে বার’কয়েক শ্বাস নিয়ে বলে,
“এতো জলদি আসলি কি করে? আর এই বাইক কার?”
ফয়সালের খামখেয়ালি উত্তর,
“তোর জামাইর।”
লুবনা অসন্তুষ্ট হয়ে বলে,
“ধুর ভাল্লাগে না। কার বল না? তোর?”
ফয়সাল বাকা হেঁসে বলে,
“হাহ! টাকায় কামড়ায় না। আর আমি কি তোর জামাই? ফাহাদের বাইক। আজাইরা পকপক না করে ক্যান ডাকছিস ক?”
লুবনা নাকমুখ কুঁচকে বলে,
“ছিঃ তুই ওই বেদ্দপ ছ্যাঁচড়াটারে আমার জামাই কইলি ক্যা?”
ফয়সাল বাইক থেকে চাবির রিংটা খুলে নিয়ে হাতে ঘুরাতে ঘুরাতে বলে,
“শোন? আলালের ঘরের দুলালিদের জন্য ফাহাদেরাই জোটে। তুই ব্যতিক্রম হবি ক্যান? ক্যান ডাকছিস ক, নইলে আমার ঘুম ভাঙানোর জন্য কানের নিচে দিমু এক চড়।”
লুবনা মুখ ফুলিয়ে বলে,
“তুই ঘুমাইতেছিলি? আমি তো মিস করতেছিলাম।”
ফয়সাল একটা গালি দেয়। আরো কিছু বলতে গিয়েও বলে না। বাইক উঠে বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে যায়। লুবনা দাঁড়িয়ে থাকে, অভিমানে ঠোঁট উল্টে আসে। ফয়সাল কিছুদূর গিয়ে আবার ফেরত আসে। লুবনার অভিমানী মুখটার দিকে একটু চেয়ে বলে,
“আবার যদি এই একই কাজ করিস কোনোদিন, সত্যি সত্যি থাপ্পড় খাবি। এমন আহ্লাদী মুখ করলেও ছাড় পাবি না। মনে থাকে যেন। এখন গিয়ে ঘুমা। দ্রুত যা। নয়তো ধরে নিয়ে ফাহাদের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিবো।”
বলেই পুনরায় চলে যায়। লুবনা ফুঁসতে ফুসতে বলে,
“একশবার এমন করবো, হাজারবার করবো। আর কি বললি? বেয়াদপ, নির্দয়, পাষাণ! তোরে বিয়ে দিয়ে দিবো ঐ ছ্যাঁচড়া ফাহাইদ্দার সঙ্গে, কুত্তা-বিলাই!”

নিষাদ আর নিশিতার মান-অভিমান রোজকারকার অভ্যাস। প্রতিবার ঝগড়া শেষেই নিষাদ দীর্ঘশ্বাঃস ছেড়ে বলে,”ছোট নিব্বি টাইপ মাইয়া মানুষের লগে প্রেম কইরা ফাইসা গেলাম। হায়, খোদা! রক্ষা করো। এই ভুল দ্বিতীয়বার আর করমু না! কানে ধরছি, মাফ কইরা দেও।”

সৃজন? ফ্লার্ট এর কম্পিটিশন হলে নিঃসন্দেহে সৃজন-ই সেখানে চ্যাম্পিয়ন হবে। কিন্তু কষ্টের কথা এতো ফ্লার্টিং করেও কাউকেই পটাতে পারে না ছেলেটা। সে নিজেই নিজের উপর দীর্ঘশ্বাঃস ছেড়ে বলে, ”আফসোসরে সৃজন, আফসোস! তোর বুঝি আর এই জীবনে প্রেম-ট্রেম করা হলো না! সবাই ডেটিং-ফেটিং করে বেড়াবে, আর তুই চেয়ে চেয়ে দেখবি! কচু গাছ? ও কচু গাছ? আয়, কাছে আয়, ঝুইলা পড়ি। বাঁইচা থাইকা আর কি করমু?”

শ্রেয়া তার মাথার ছায়া হারানো ব্যথা এখনও ভুলে উঠতে পারলো না। ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ে চোখ ভিজে উঠে। বাবার সঙ্গে কাটানো সুন্দর স্মৃতিগুলো দুঃখী করে তোলে মন-প্রাণ!

নবনী আর আরমানের জীবনে নতুন মাত্রা যোগ হলো। একজনের ব্যাক্ত ভালোবাসা আরেকজনের অব্যাক্ত ভালোবাসার পূর্ণতায় ঝলমলে রঙিন হলো দুজনের জীবন। তবে নবনীর শর্ত অনুযায়ী বাসায় আসতে পারস না আরমান। মাঝে মধ্যে নবনীর এনজিওতে গিয়ে দেখা করে আসে। বাসায় আসলেও দরজা থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ আরমান দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে কয়,
“হায়রে কষ্ট! এই প্রথম কোনো নিষ্ঠুর বউ তার নিরপরাধ, নিরীহ, অসহায় স্বামীকে দরজার দারপ্রান্ত হতে তাড়িয়ে দেয় দূরদূর করে! ইতিহাসের দুঃখ পাতায় এই দুঃখের কাহিনী স্বর্নাক্ষরে লিখে রাখা উচিত।”
নোলক উচ্চস্বরে হেসে এই পাগল প্রেমিকের পাগল জামাইর পাগলামি উপভোগ করে। বোনকে বলে,
“তুমি কেমন নিষ্ঠুর বউ আপু? এমন অসহায় জামাইটারে কেন কষ্ট দাও বল তো?”
নবনী হেসে ‘বোন’ আর ‘জামাই’ দুজনকেই পাগল বলে আখ্যায়িত করে।

আরমানের সুবাদে আদ্র আর ইশানের সঙ্গে প্রায়শই দেখা হতে লাগে নোলকের। কখনো রস্তায় কখনো আরমানের শপে, কখনো বা অন্যকোনো ভাবে। কোনো-না-কোনো ভাবে দেখা ঠিক হয়েই যায়। এই যেমন আজ হলো।

আদ্রর চুপচাপ শান্ত স্বভাবটা হঠাৎ-ই ভালো লেগে যায় নোলকের। আজকাল আর তাকে বেয়াদপ কিংবা অভদ্র মনে হয় না। বরং আদ্রর এই ব্যতিক্রমী স্বভাবটাই ধীরে ধীরে নোলককে আকৃষ্ট করে বসে।
একটা বটগাছের নিচে এসে বসে দুজন।
নোলক জিজ্ঞেস করে,
“আপনার ঝুলিতে কি শব্দের পরিমাণ খুবই কম?”
অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকা আদ্র এবার নোলকের চঞ্চল মুখখানার দিয়ে চেয়ে বলে,
“তাই মনে হলো?”

“তা নয়তো কি? আপনাকে আমার খুবই কিপ্টে মনে হয়। খুব মেপে মেপে, হিসেব করে কথা বলেন। শুনুন? বেশি বেশি কথা বললে, মন ভালো থাকে।”

আদ্র এবার হেসে বলে,
“তাই? কিন্তু আমার লজিক তো অন্য কথা বলে!”
নোলকের চিন্তাহীন কপালেও ভাজ পড়ে। জিজ্ঞেস করে,
“কি বলে?”

“কথা বলার মাত্রা যত কম, কথা বলার মানুষ যত কম, তার দুঃখও ততো কম। সে হিসেব করলে মনে খারাপ লাগার পরিমান খুবই কম আমার। কিন্তু আপনার লজিক তো উল্টো বলে।”

নোলক কৌতূহল নিয়ে আগাগোড়া গম্ভীর ছেলেটাকে দেখে। তার ভালো লাগে। কেন লাগে তা জানা নেই।
“তবে বলছেন, কথা কম বলা ভালো? কথা বলার মানুষ কম থাকা ভালো?”

নোলকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে অন্যরকম হাসে আদ্র। তারপর বলে,
“ভালো কি-না খারাপ তা সঠিক বলতে পারছি না। তবে আমার এই লজিক তৈরি হওয়ার পেছনে একটা যুতসই কারন বলতে পারি।”

নোলক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চায়। আদ্র বলে,
“মানুষ নিজে যেমন, সে চায় তার আশেপাশের মানুষগুলোও তেমন হোক।আমার কথা বলার মানুষ নেই, মন খুলে মনের কথা কইতে পারি না আজ বহুদিন! কথাগুলো চেপে রাখতে রাখতে, শিখে গেলাম কথা না বলে থাকতে। সে কারনেই হয়তো মস্তিষ্ক এই লজিক তৈরি করে বসে আছে।”
নোলক ভালো লাগে। তবুও কেন জানি বিরক্ত হওয়ার ভাব করে বলে,
“আপনি সবসময় এমন করে কথা বলেন কেন? কথা বলতে ইচ্ছে না হলে, বলবেন না। কিন্তু এমন জ্ঞানী জ্ঞানী টাইপ কথা বলবেন না। আমার ভালো লাগে না।”

“আচ্ছা!”

আচ্ছা? শুধুই আচ্ছা? নোলকের ভারী অভিমান হয়। ‘আচ্ছা’ শব্দটাকে খুবই জঘন্য একটা শব্দ বলে বোধ হয়। আর কিচ্ছুটি না বলে মুখ ফুলিয়ে চলে আসতে লাগলে, আদ্র অন্যরকম সুরে ডাকে,
“নোলক?”
নোলকের মনে, মস্তিষ্কের একটা অংশজুড়ে বারবার প্রতিধ্বনি হতে থাকে সেই ডাক, সেই কন্ঠ। কি আশ্চর্য! এ-কি হয়ে যাচ্ছে নোলক কন্যার? সে কি প্রেমে-ট্রেমে পড়ে যাচ্ছে নাকি? কি সাংঘাতিক!
নোলক পেছন না ফিরে সায় দেয়,
“হু?”
“এদিকে আসুন, পাশে বসুন। একটু কথা বলি, কথা শিখি। তুরতুরি রানীর রাগ দেখি, অভিমান দেখি!”
কি সুন্দর, কি সুন্দর! কি সুন্দর তার বলা প্রতিটা শব্দ, শব্দ চয়ন!
নোলক ঠিকই পাশে গিয়ে বসে। মোটা ফ্রেমের চশমাটা ভেদ করে অতি সুন্দর চোখ দুটোর দিকে চায়। নোকলের চোখে তখন হরেক রকম প্রশ্ন খেলে।
আদ্র প্রতিদানে মুখ ফিরিয়ে সামনের দিকে চায়। তারপর তার গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“আজকাল আমি সব ভুলে যাই, উলটোপালটা কথা বলি। অদ্ভুত সব চিন্তা ভাবনা মস্তিষ্কজুড়ে বিচরণ করে। আমার নিষেধ তারা মানে না। আমার কি মনেহয় জানেন? আমি বোধহয় পাগল-টাগল হয়ে যাচ্ছি! আপনাকে ম্যান্টাল ট্রিটমেন্ট করতে বলার শাস্তি স্বরূপ এবার আমারই মেন্টাল ট্রিটমেন্ট এর প্রয়োজন পড়ে যাচ্ছে। হা হা হা!”
নোলকের কপাল কুঁচকে আসে। এই হাসি, এমন কথা নোলকের পরিচিত নয়। ভারী অদ্ভুত ঠেকে। অচিন মানুষ মনে হয়, গুরুগম্ভীর স্বল্পভাষী আদ্রকে।….#জলছবি
#পার্ট_১৯
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
রুম আবছা অন্ধকার। ঘরের জানালার সাদা পর্দাটা ভেদ করে যতটুকু আলো প্রবেশ করতে পারে, ঠিক ততটুকু আলোরই ঠাঁই হয়েছে ছোট্ট রুমটিতে। আদ্র ল্যাপটপে কিছু লিখছিল। সকালের এক ঘন্টা সে টানা লেখালেখি করে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। কিছু চিন্তা করছে এবং দ্রুত কিবোর্ডে হাত চালাচ্ছে। রুমটা আবছা অন্ধকার হওয়ার ফলশ্রুতিতে ল্যাপটপের নীলচে আলোগুলো চশমার স্বচ্ছ কাচে এসে পড়ছে। আদ্র কপাল কুঁচকানো। রাগে কিংবা ক্ষোভে। কারোর প্রতি তার অভিমান নেই তবে ক্ষোভ আছে। এই মূহুর্তের ক্ষোভ হোস্টেলের দারোয়ান চাচা দুইবার ডেকে গিয়েছে যেই মানুষটার জন্য তাকে ঘিরে! সে না গিয়েই তার কাজ করে যেতে লাগলো। যদিও কাজের কাজ কিচ্ছুটি হচ্ছিলো না। এতে করে তার অকল্পনীয় জেদ আরো বেড়ে যেতে লাগলো।

আবছা অন্ধকার থেকে রুমটি হঠাৎ আলোকিত হয়ে যাওয়ায় ভ্রু কুঁচকে জানালার দিকে চাইলো আদ্র। ইশানকে দেখে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো। ইশান বাহিরে গিয়েছিল। দ্রুত ফিরে আসা নিয়েও কোনো ভ্রুক্ষেপ দেখা গেলো না। ইশান জানালার কাছ থেকে সরে এসে বলল,
“দোস্ত তোর একটু নিচে যেতে হবে।”
আদ্রর বিশেষ কোনো হেলদুল হলো না। এক নজর ইশানের দিকে চেয়ে পুনরায় ল্যাপটপে মনোনিবেশ করলো। ইশান আবার বলল,
“এই? শুনছিস?”
“না, শুনছি না।”
আদ্র’র খামখেয়ালি উত্তর। ইশান আদ্র’র পাশে বসে ভয়ে ভয়ে বলে,
“এমন করিস ক্যান? সব কিছু নিয়ে এতো কেন এত খামখেয়ালিপনা তোর?”
“কারন খামখেয়ালি মানুষের দুঃখ-কষ্ট থাকে না, ইহজগৎ নিয়ে কোনো বিশেষ ভাবনা চিন্তা থাকে না।”
ইশান মেকি হেসে বলে,
“লেখক হয়েও ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছিস?”
আদ্র ইশানের দিকে চায়। উল্টো প্রশ্ন করে,
“ভুল বললাম?”
ইশান অনেকটা জোর দেয়ার মতো করে বলে, “হ্যাঁ ভুল।”
আদ্র হাসলো। ল্যাপ্টপটা বন্ধ করে বিছানা থেকে নেমে টিশার্ট এর এক কোণা হালকা টেনে ঠিক করে নিয়ে বলে,
“দ্যাট’স হোয়াই তোরে আমি বলদ কই। ঠিকঠাক যুক্তি দিতে না পারলো, অযৌক্তিক তর্ক ঠিকই করতে পারিস। অনেকটা ‘যার জন্য নিচে যেতে বলছিস’ তার মতো।”
ইশান আওয়াজ করে হাসলো। আদ্র বেসিং এ গিয়ে চোখেমুখে পানি দিয়ে বলল,
“সে বারবার কেন আসে? কিসের পিছুটান? আমার অসহ্য লাগে, রাগ হয়। তা কি সে বোঝে না, নাকি বুঝেও বোঝেনা?”
ইশান চুপ হয়ে যায়। আদ্রর কাছে এসে বলে,
“সবকিছু এমন করে কেন ভাবিস? একসাথে থেকে তিক্ততা বাড়ানোর চাইতে আলাদা হয়ে যাওয়া ভালো নয় কি? ওর ও তো নিজের জীবন নিয়ে সুখে থাকার অধিকার আছে। তাই নয় কি? তুই নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে দেখ, তুই কি একজন সত্যিকার অর্থে প্রেমিক পুরুষ ছিলি, কিংবা আদো আছিস? তুই মানুষ হিসেবে, একটা ছেলে হিসেবে যতটা পারফেক্ট, একজন প্রেমিক হিসেবে ততটাই বোরিং। তোর মাঝে পাগলামি নেই, কোনো কালে ছিলোও না। তোর চিন্তা ছোট থেকেই ম্যচিউর’ড। এটা দোষের কিছু না। কিন্তু ও তো ইমম্যাচিউর ছিলো, এখনো খানিক আছে হয়তো। তাই চাইতো ওর ভালোবাসার মানুষটাও ওর জন্য একটু-আধটু পাগলামি করুক। এখানে ওকে একপাক্ষিক দোষ কেন দিচ্ছিস আদ্র? এমন অপরিপক্ব ভাবনাগুলো খুব দ্রুত এলোমেলো চিন্তা করে ফেলা মানুষদের সঙ্গে যায়। তোর সাথে যায় না। যে যেমন থাকতে চায়, তাকে তেমন থাকতে দিতে হয় আদ্র। সেই স্বাধীনতা নিশ্চই সকলের আছে। যেমন তোর তেমন ওরও।”
“তোর মনে হলো, আমি তাকে তার মতো থাকতে দিচ্ছি না? কথাটা উল্টো হয়ে গেলো না, ইশু?”
ইশান আদ্র’র বাহুতে হাত রেখে বলে,
“তা বলিনি। আমি বলতে চেয়েছি, কারো উপর অসন্তুষ্টি রাখবি না। যা হচ্ছে সেটা স্বভাবিক ভেবে নে। নিচে গিয়ে দেখ কি চাচ্ছে মেয়েটা। সকাল থেকে অপেক্ষা করছে।”
আদ্র কিছু বলে না। তোয়ালে দিয়ে মুখ মোছে। ইশান খুব দরদ নিয়ে আবার বলে,
“আমি তোকে শুধু বন্ধু না, আমার ভাই ভাবি। তোর দুঃখ আমায় স্পর্শ করে। ভালোবাসি তোরে দোস্ত। এই পৃথীবিতে কেউ না বুঝলেও আমি বুঝি।”
আদ্র খুব সুন্দর করে হাসে। টিশার্ট চেঞ্জ করে শার্ট পরে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়।
ইশান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। দৃষ্টি উপরে ঘুরতে থাকা ফ্যানটার দিকে। মানুষের জীবন, জীবনের ঘটনাগুলো কি এমনই খুব দ্রুত চলমান?
.
আদ্রকে দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় অপেক্ষমাণ মেয়েটি। পাতলা তুলতুলে মুখখানা বিধাতা যেন সুনিপুণ কারুকার্যে অঙ্কন করেছে। ঐ চোখ? ঐ চোখের প্রেমেই তো আদ্র আগে পড়েছিলো। চোখ সরিয়ে নিলো আদ্র।
কালো রঙের জামদানী শাড়িটার আঁচল দিয়ে অন্যবাহুতে আরো একটু টেনে নিয়ে খুব অপরাধী মুখ করে জিজ্ঞেস করলো,
“খুব বেশি ব্যস্ত ছিলে?”
“ছিলাম।”
“ও! স্যরি, একটু জ্বলালাম।”
আদ্র নিরুত্তর।
“কেমন আছো?”
আদ্র দৃষ্টি অন্যদিকে রেখে জবাব দেয়,
“ভালো।”
“আমি কেমন আছি জানতে চাইলে না?”
আদ্র আরশির দিকে চেয়ে হাসলো। দারুন বিদ্রুপ সেই হাসি জুড়ে। আরশির চোখ এড়ালো না সেই হাসি। বলল,
“হাসছো যে? হাসি পেলো আমার কথা?”
“অযৌক্তিক কথা শুনলে আমার যে খুব হাসি পায়, তা তো নতুন নয়। তুমি তো জানতে।”
“অযৌক্তিক কথা বললাম?”
“ভালো থাকার জন্যই তো সব করলে। ভালো না থেকে খারাপ কেন থাকবে? প্রশ্নটা অযৌক্তিক নয়?”
“ওহ! আমার সব কিছুই তোমার কাছে অযৌক্তিক লাগে আদ্র। সেই আগের মতোই তোমার কাছে তাচ্ছিল্যের পাত্রী হয়েই রয়ে গেলাম! শুধু তোমার এই অনাগ্রহ মনোভাবের কারণেই আমায় হারিয়েছো তুমি।”
“যেখানে তুমি আমার ছিলেই না, সেখানে হারানো প্রসঙ্গ আসছে কেন?”
মেয়েটার চোখ দুটো টলমল করে উঠলো। সেই আগের মতো, ঠিক আগের মতোই রয়ে গিয়েছে ছেলেটা। ব্যাগের ভেতর থেকে কিছু একটা বের করতে করতে বলল,
“তোমার এই খামখেয়ালি একরোখা স্বভাব আর কতকাল বয়ে বেড়াবে? অন্যের মন বুঝতে শিখলে না আর! তুমি আমায় ভালোই বাসোনি কখনও। শুধু আমি হাত বাড়িয়েছলাম বলেই হাত ধরেছিলে। ছাড়িয়ে নিতে চাইলে ছেড়েও দিলে! আটকাওনি কখনো!”
“যে চলে যেতে চায়, তাকে চলে যেতে দিতে হয়। আমিও দিয়েছি। কাউওকে আটকে রাখার ক্ষমতা আমার নেই, কখনো ছিলোও না।”
আরশি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। বলল,
“নিজের মতো যুক্তি দাড় করানো তোমার স্বভাব। পরিবর্তন হয়নি দেখছি।”
তারপর ব্যাগ থেকে বের করা আয়নাটা আদ্র’র দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“আমার মনে হচ্ছে এটার আমার কাছে থাকার প্রয়োজন ফুরিয়ে এসেছে।”
“ফেলে দাও।”
আদ্র ধারালো জবাব।
“ফেলে দিবো?”
“হ্যাঁ, ফেলে দাও।”

থাটা বলে আর দাঁড়াল না ছেলেটা। দ্বীপ্তিহীন তেজ নিয়ে পা বাড়ালো। আরশির মনঃক্ষুণ্ণ হলো ভীষণ ভাবে। চোখ বেয়ে টপটপ করে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। এক হাতে চোখ মুছে, দু কদম এগিয়ে যাওয়া আদ্র’র দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করে,
“তোমার কি এখনও মাথা ব্যথা হয়, আদ্র?”
আদ্র হালকা পেছন ফিরে তাকায়। অমিষ্ট স্বরে বলে,
“আমায় নিয়ে আর ভেবো না। তুমি এখন সেই কলেজ পড়ুয়া কিশোরী কিংবা সদ্য কৈশোর পেরোনো যুবতী নও। নিজের এসব অভিযোগের পাহার গড়ে তোলার সম্পর্ক অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে আরশি। ভালো থেকো।”
আদ্র চলে গেলো আর আরশি টুলটাতে বসে পড়লো। আরশি? কতদিন পর এই মানুষটা মুখ থেকে নিজের নামটা শুনতে পেলো! কই? এতো ভালো তো অন্য কেউ ডাকলে লাগে না আজও!
.
পড়ন্ত বিকেলের শেষ আলোটা এসে পড়লো নোলকের মুখের একটা পাশে। মৃদু বাতাসে উড়ছে খোলা চুলগুলো। আদ্র’র পাশে ঐ অসম্ভব সুন্দর মেয়েটাকে দেখার পর থেকেই ওর মন বিষাদে তলিয়ে আছে।
“কিছু ভাবছো অগ্নিশর্মা? কিছু হয়েছে কি? হঠাৎ দেখা করতে বললে?”
ইশানের কথায় টনক নড়ল নোলকের। ওড়নাটা ভালোমতো জড়িয়ে নিয়ে বলল,
“এমনি বলেছি। বিরক্ত হলেন?”
ইশান হকচকিয়ে বলল,
“আরে বোকা মেয়ে কি বলে! বিরক্ত কেন হবো?”
নোলকের খুব মন খারাপ হচ্ছে ক্রমশ। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। ইশান এই বিষন্ন নোলকে চিনে না। তাই তার খুব অসস্থি হলো। ছটফটে মানুষজন হঠাৎ শান্ত হয়ে গেলে তা খুব দ্রুতই চোখে পড়ে। ইশানও দাঁড়াল। নোলকের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার কি মন খারাপ অগ্নিশর্মা। মনে হচ্ছে তাই।”
নোলক জোরপূর্বক হাসল। ইশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মন খারাপ? কই, না তো! আপনার বন্ধু বলেছে কথা কম বললে, দুঃখ কম লাগে। তাই কথা কম বলার প্র্যাকটিস করছি।”
ইশান হেসে ফেললো। নোলকের কথা বিশ্বাস করে নিয়ে বলল,
“হাও ফানি! হা হা হা!”

নোলকের হাসি পেলো না। দুঃখ যেন আরো হুহু করে বেড়ে গেলো। বেশ রয়েসয়ে বলল,
“একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
ইশান হাসিয় থামিয়ে বলল,
“আরে বাহ! অগ্নিশর্মা অনুমতি নিচ্ছে? বলেন ম্যাডাম? কি জিজ্ঞেস করতে চান?”
নোলক বিপরীতে হাসলো। দু’কদম এগিয়ে গিয়ে আচমকাই জিজ্ঞেস করে ফেলল,
“মেয়েটা কি তার খুব কাছের কেউ?”
ইশান প্রথমে আন্দাজও করতে পারল না, নোলক কোন মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করছে। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ চিন্তা করার চেষ্টা করলো। শেষে ব্যর্থ হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কোন মেয়ে?”
“আপনার বন্ধুর সঙ্গে যিনি ছিল। সকালে দেখেছিলাম।”
“আরশি? আরশির কথা বলছো?”
“জানি না, তার নাম জানি না। কিন্তু খুব মিষ্টি দেখতে।”
ইশান দীর্ঘশ্বাঃস ছেড়ে বলল,
“হুম, তুমি আরশির কথাই বলছো।”
নোলক নির্লিপ্ত চোখে চাইলো। তারপর খুব করুন করে বলল,
“তার খুব কাছের কেউ, তাই না?”
ইশান মৃদু হাসলো। নোলক যেদিক ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল তার বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে অনেকটা ভণিতা করার মতো করেই বলল,
“উমম, প্রিয়? হ্যাঁ, প্রিয়ই বলতে পারো। কারণ আদ্র যেই কম মানুষদের নিজের আপন করেছে তাদের মধ্যে আরশি একজন। ভালোবাসার মানুষগুলো তো প্রিয়ই হয়, তাই না?”
ভালোবাসার মানুষ? নোলক ভীষণ রকম খারাপ লাগলো। সঙ্গে প্রচন্ড রাগ হলো। তবে আদ্র, ইশান, আরশি নাকি নিজের উপরেই তা ঠিক অনুমান করা গেলো না। ভয়ানক অশান্তি হতে লাগলো, মন জুড়ে। ইশান আরো কিছু বলল। কিন্তু সে সব আর কানে গেলো কই? তার কান তো ‘ভালোবাসার মানুষ’ কথাটিতেই আটকে রইলো। মস্তিষ্কজুড়ে অবাধ্য বিচরণ হতে লাগলো এই কুৎসিত শব্দটি। হ্যাঁ, ভালোবাসা নামক শব্দটি তার কাছে এই মূহুর্তে কুৎসিত হিসেবেই গণ্য হলো। হিংসে হলো আরশি নামক মেয়েটিকে।
‘কিন্তু কেন তার এই অস্থিরতা? অন্যকারোর সঙ্গে এই ছেলের প্রণয় থাকলেই বা কি? আর না থাকলেই বা কি? আদ্র তো খুব কাছের কেউ নয়, তবে কেন এই মন পোড়া? কে হয় এই গুরুগম্ভীর ছেলেটি? সে তো এই ছেলেটির প্রিয় মানুষও নয়। ছেলেটিও তো তার খুব আপন নয়। আসলেই নয় কি?’
শেষের কথাটি ভাবতে গিয়ে কোথায় যেন বাধা পেলো। গলায় এসে আটকে যাওয়া দুঃখগুলোকে প্রাণপণ আটকে রাখার চেষ্টা চলমান রেখে, সেই ধরা গলায়তেই বলল,
“আম-আমাকে একটা রিকশা ডেকে দিতে পারবেন?”
ইশান খুব অবাক হলো। শুরু থেকেই নোলককে অস্বাভাবিক লাগছিলো। এবার সেই সন্দেহ পরিপূর্ণ রূপ পেলো। অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কি অসুস্থ, অগ্নিশর্মা। কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে! চলো আমি বাসায় পৌছে দেই।”
নোলক বাধা দিয়ে বলল,
“না, আমি ঠিক আছি। আপনি শুধু একটা রিকশা ডেকে দিন প্লিজ। আমি বাসায় যাবো।”
ইশান তড়িঘড়ি করে ‘অ্যাই রিকশা, অ্যাই?’ হাক ছেড়ে রিকশা থামালো। নোলক প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ে রিকশাওয়ালাকে বলে,’চলুন, প্লিজ।’
নোলক অনুমতি পাওয়ার প্রায় সাথে সাথে রিকশা চলতে আরম্ভ করলো। ইশান কিছু বলার কিংবা করার সুযোগ আর পেলো না।
সে হতভম্ব, আহত, আতংকিত। কয়েক মিনিটে কি হলো তাই যেন দিশা করতে পারলো না।

রিকশা যখন অনেকখানি চলে এলো ইশানকে ছাড়িয়ে, তখন যেন তার মুক্তি মিললো। আটকে থাকা দুঃখগুলো আলগা করে দিলো। কি আশ্চর্য! কিছুদিন আগ অব্দিও অপ্রিয় মানুষটা প্রিয় অন্যকেউ হওয়ায় এতো কষ্ট? কিন্তু কেন? কী কারণ? কেন এই দহন?….(চলবে).(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here