জানি দেখা হবে পর্ব ২৫+২৬

#জানি_দেখা_হবে ❤
Israt Jahan Tanni
#Part_25
..
বিছানার এক পাশে গুটিশুটি মেরে বসে আছে তারা। জীবনে এমন একটা দিন আসবে সেটা কখনো কল্পনাতেও আনেনি তারা। ধ্রুবর জীবনে তারা আবারও ফিরবে, এটা ভাবাটাও যেনো তারার কাছে বোকামি মনে হতো। কিন্তু আজ!! একি হলো। ধ্রুব কেন এমন করলো? আর ধ্রুব জানলোই বা কি করে তারা এখানে আছে? অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আচ্ছা, তুরিনের সাথে কি ধ্রুবর ঝগড়া হয়েছে? এজন্যই কি ওর সাথে রাগ করে ধ্রুব ওকে নিতে চাচ্ছে? যখন আবার ওদের ঝগড়া মিটে যাবে তখন নিশ্চয়ই আমাকে আবারও বের করে দিবে! ভাবতেই আতংকিত হয়ে উঠছে তারা। উফফফ কেন এমন হচ্ছে।
তারা নিজের মাথাটা দু’হাতে শক্ত করে চেপে ধরে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে । কোনো বাধ মানছেনা। সে ধ্রুবকে ভালোবাসে, মন থেকেই ভালোবাসে। কিন্তু যে ব্যাথাটা আগেও পেয়েছে সে ব্যাথাটা আবারও পেতে চায়না ও। এটার যে খুব জ্বালা। সহ্য করা যায়না।

আকাশ নিজের রুমে পায়চারি করছে। চোখদুটো লাল হয়ে আছে ওর৷ নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করছে সে। কিন্তু যখনই সকালের কথাটা মাথায় আসছে সব বিগড়ে যাচ্ছে। এতোদিন পর কেন ফিরে এলো তারার প্রাক্তন স্বামী? কেনই বা সবটা উলট পালট করে দিতে চাইছে। তারার ব্যাপারে যতোটুকু জেনেছে ও, তাতে তো ওর প্রতি ওর স্বামী খুবই অনাসক্ত ছিলো। মোটেও সহ্য করতে পারতোনা মেয়েটাকে। কত কষ্টই না সহ্য করেছে মেয়েটা। আজ যখন আকাশ মেয়েটাকে নিয়ে একটু সুখের দিকে এগিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখাচ্ছে, তারাকে নিয়ে যখন ও একটু ভালো থাকার আশা করছে, তখন মাঝখান থেকে কেনই বা এসে সবটা লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে সে? অনেক কষ্ট পেয়েছে তারা। আর কোনো কষ্টের নাগাল ও তারাকে পেতে দিবেনা। চোখমুখ শক্ত হয়ে আসছে আকাশের। দ্রুত নিজের রুম থেকে বের হয়ে তারার রুমের দিকে গেলো আকাশ।
.
তারা এখনো আগের মতো বসে আছে। দুহাটুতে মাথাটা ভর দিয়ে বসে আছে ও। হটাৎ মাথায় কারো হাতের স্পর্শে মাথা তুলে উপরে তাকায় তারা।
আকাশের মা ওর মাথায় হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে। মুখটা মলিন হয়ে আছে উনার। অন্যহাতে একটা দুধ ভর্তি গ্লাস। উনাকে দেখে তারা নিজেকে স্বাভাবিক করতে চাইলো। স্বাভাবিক ভাবে বললো…
— বসুন আন্টি।
আকাশের মা দুধের গ্লাসটা পাশে রাখা ছোট্ট টেবিলটার উপর রেখে তারাকে নিজের দিকে টেনে নিলো। তারা যেনো মায়ের স্পর্শ পেলো। তারার মাথাটা উনি নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলে তারাও নিজেকে উনার সাথে আরো ঘনিষ্টভাবে জড়ালো। আকাশের মা তারার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। হটাৎ কি হলো কে জানে, তারা হাউমাউ করে কেদে দিলো। আকাশের মা ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো..
— কাদিস না মা। আমার দিকে তাকা।
তারা নিজের কান্না নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা। অঝোরে কেদেই যাচ্ছে। কাদতে কাদতে বলতে লাগলো..
— কেন আমার সাথে এমন হয় আন্টি? আমিতো উনার কথাতেই ও বাসা ছেড়ে চলে আসছিলাম। নিজেকে স্বাভাবিক করতে চাইছিলাম। তাহলে কেন আজ উনি এলেন? আমার পুরোনো ব্যাথাটা কেনই বা নতুন করে জাগিয়ে দিলেন।
হেচকি তুলে কাদতে লাগলো তারা। আকাশের মা বললো…
— ওতো তোকে নিয়ে যেতে চায় তারা। তুই যেতে চাস না তোর স্বামীর কাছে?
— উনার জীবনে অন্য কেউ আছে আন্টি। সে আর কেউ না, আমার নিজেরই ছোট বোন। সৎ হলেও বোন তো। আমরা এক মায়ের পেটে আসিনি। কিন্তু আমাদের দুজনেরই বাবা তো একজনই। আমি কিভাবে সেখানে ফিরে যাবো?
— নিজেকে সামলা তারা। তোর স্বামী তোকে নিতে চাইছে, তার মানে তোর বোনের সাথে নিশ্চয়ই কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। আর দেখলিতো ছেলেটা বলছিলো, তোকে নাকি অনেকদিন ধরে খোজে চলেছে।
— কেন খোজবে ও আমাকে? আর কেনই বা আমাকে নিতে চাইবে আবার? দ্বিতীয় বার যেনো আমাকে আবারও ঘর থেকে বের করে দিতে পারে সেইজন্য? বলেই আবারও কাদতে লাগলো তারা।
আকাশের মা কি বলবেন বুঝতে পারছেনা।
— দেখ মা, ওর সাথে কি হয়েছে, এখন তোকে নিতেই বা চাইছে কেন সেটা আমি জানিনা। তবে ছেলেটাকে দেখে আমার মনে হচ্ছেনা যে ও তোর সাথে আবারও একইরকম আচরণ করবে। ওর চোখদুটোতে আমি দেখেছি, ও তোকে কতটা চায়। ওর চোখেমুখে আমি কোনো অসৎ উদ্দেশ্য দেখতে পায়নি রে মা।
উনি আর কিছু বললেন না। পাশের টেবিল থেলে দুধের গ্লাস টা নিয়ে তারার মুখের সামনে ধরে বললেন…
— দুধটা খেয়ে নে। সারাদিন কিছু খাস নি।
— আমি খাবোনা আন্টি। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললো তারা।
— খেয়েনে বলছি তারা। ধমকের সুরে বললেন উনি।
তারা মুখটা অন্যদিকে করে রেখেছে এখনো।
আকাশ তারার রুমের সামনে এসে দেখলো মা দুধের গ্লাস নিয়ে তারাকে জোরাজুরি করছে। কিন্তু তারা খাচ্ছেনা। আকাশ রুমে ঢুকে বললো..
— গ্লাসটা আমার হাতে দাও মা। আমি দেখছি কিভাবে না খেয়ে থাকে। বলেই মার হাত থেকে দুধের গ্লাসটা নিয়ে নিলো আকাশ। তারার কোনো ভাবান্তর হলোনা। আকাশের মা দুধের গ্লাসটা ছেলের হাতে দিয়ে বললেন….
— দেখ খাওয়াতে পারিস কিনা। সারাটা দিন কিছুই খায়নি মেয়েটা। কথাটা বলেই উনি চলে গেলেন।

আকাশ তারার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। গতকাল পর্যন্ত যে মেয়েটাকে নিয়ে সে একা রাজত্ব করার কথা ভেবেছে, তার সামনে আজ আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী এসে হাজির হয়েছে। আচ্ছা, তারা কি চলে যাবে সেই প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে? আকাশের জন্য কি একটুও খারাপ লাগবেনা ওর?
মুহুর্তেই মনের সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিলো আকাশ। তারাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো..
— এটা খেয়ে নাও প্লিজ।
তারা আকাশের দিকে তাকালো। বড্ড মায়া আকাশের মুখটায়। এই মায়াভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে আর না করতে পারলোনা তারা।
..

— কিরে, কি খবর তোর? কোনো খোজ খবরই পাচ্ছিনা যে। দেখাও নেই।
— আমি সিলেট আছি একটু। দেখা পাবি কি করে?
— বাহঃ সিলেট গেলি কখন?
— গতকাল এসেছি। অফিসের কাজে।
— আমাদেরও বলতে পারতি। আমরাও যেতাম। যাইহোক, সেটা বাদ দে। কিছু জানিস কি?
— কি জানবো? কপাল কুচকে বললো ধ্রুব।
— সত্যিই কিছু জানিস না তুই? অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বললো রবি।
— সরাসরি বল কি বলবি। আমার হাতে সময় নেই। রুক্ষ মেজাজে বললো ধ্রুব।
— এতো রেগে আছিস কেন?
— দেখ, কি বলবি বলে ফেল। আমি খুবই ঝামেলায় আছি।
— তুরিন আর ওর মাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে তোর শশুর।
— রিয়েলি? অবাক হয়ে বললো ধ্রুব।।
— হ্যাঁ রে বাপ। আজ সকালেই খবর পেয়েছি আমি। মা মেয়েকে বেধড়ক পিঠিয়েছে আগে। তারপর ঘাড় ধরে বের করে দিয়েছে।
— তুই কি করে জানলি?
— ভুলে যাস কেন বারবার, ওরা আমার শশুরবাড়ির লোক। বলেই হেসে উঠলো রবি।
ধ্রুব একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো…
— তারাকে পেয়েছি রবি।
— সত্যি? কোথায় ও? ঠিক আছেতো? তোর সাথে কথা বলেছে? বাবুটা কেমন হয়েছে রে? ছেলে নাকি মেয়ে? এক দমে বললো রবি।
– একটু দম নিয়ে প্রশ্ন করনা রে ভাই।
– ওহ স্যরি স্যরি। এতোদিন পর ওর কথা শুনে নিজের মনকে বাধ দিতে পারি নাই রে। মেয়েটা ভালো আছে তো?
ধ্রুব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বললো..
— নাহ রে, ও ভালো নেই। আমি জানি ও ভালো নেই।
— কোথায় আছে এখন?
— আছে একটা বাসায়। আমি ওকে আনতে চেয়েছিলাম। আসেনি আমার সাথে। আবারও জোরে শ্বাস নিলো ধ্রুব।
— মন খারাপ করিসনা ধ্রুব। মেয়েটার সাথে যা হয়েছে, এরপর ও আর কাউকে কিভাবে বিশ্বাস করবে বল।
— খুব কষ্ট হচ্ছে রে আমার। ওকে না পেলে আমি মরে যাবো রে।
ফোনটা কান থেকে সরিয়ে দ্রুত কেটে দিলো ধ্রুব। তানাহলে ওর কান্নার আওয়াজ হয়তো রবি শুনে নিবে। চোখের পানিগুলো বাধ মানছেনা আজ ধ্রুবর। তারার মুখটা এখনো চোখে ভেসে আসছে। বুকটা ভেংগে যাচ্ছে বোধহয়। তারার অনুপস্থিতি ধ্রুবকে শান্তি দিচ্ছেনা। কই, তুরিনের জন্য তো কোনোদিন ওর এমন অনুভূতি হয়নি। তাহলে কি তুরিনকে কোনোদিন ও ভালোই বাসেনি। এইসব প্রশ্ন মাথায় আসাতে নিজেই খুব অবাক হচ্ছে ধ্রুব।
..

পরেরদিন বেলা দশটার দিকে তারা তারা নিজের রুমেই শুয়ে আছে। আকাশ আর আহাদ অনেক আগেই অফিসে চলে গেছে৷ আকাশ যেতে চায়নি৷ কিন্তু সীমা জোর করে পাঠিয়েছে। আকাশ যাবার আগে বারবার সীমাকে বলে গেছে যেন তারার খেয়াল রাখে। কোন সমস্যা হলে যেন ওকে ফোন করে।
তারাকে ডাকতে এসে সীমা দেখলো তারা শুয়ে আছে। সীমা মাথায় আলতো করে হাত দিয়ে বললো….
— তুমি ঠিক আছো তারা?
— আমি ঠিক আছি ভাবী। বলে উঠে বসলো ও।
— একটু নিচে আসতে পারবে?
— কেন ভাবী?
— এসোই না।
তারা সীমার পিছু পিছু নিচে নামলো। ড্রয়িংরুমে গিয়েই ও স্তব্দ হয়ে গেলো। পা দুটি থেমে গেছে এক জায়গাতেই। তারার দৃষ্টি সামনে বসে থাকা লোকটার দিকে। তারাকে দেখে ধ্রুবর বাবা বললো…
— কাছে আসবি না মা?
আহঃ কতোদিন পর এই নরম কন্ঠটা কানে এলো তারার। তৃষ্ণার্ত বুকটা যেনো একটু পানির ছোয়া পেলো মাত্র। তারার মুখ দিয়ে কথা আসছেনা। আশা আর ওর মা পাশেই দাড়িয়ে আছে। সীমা ইশারা করে তারাকে বললো…
— কি হলো তারা। কিছু বলছো না যে। এ জন্যই কি সেদিন উনার সামনে আসতে চাওনি?
তারা অসহায়ভাবে সীমার দিকে কিছুক্ষণ তাকালো, তারপর চোখদুটো নিজের শশুরের দিকে ফিরালো।
— কিরে মা৷ কথা বলবিনা?
তারা মাথা নিচু করে ফেললো।
সীমা তারাকে আলতো করে ধরে ধ্রুবর বাবার পাশে নিয়ে বসালো। তারাও কোনো বাধা দিলোনা। বাধ্য মেয়ের মতোই চললো।
— আমাদের উপর এতো অভিমান তোর? আমরা কি এতোটাই খারাপ ছিলাম রে মা?
তারা চকিতে তাকালো শশুরের দিকে। বললো…
— কিক.. কি বলছেন বাবা। আপনারা খারাপ হবেন কেন?
— তাহলে কেন আমাদের না জানিয়ে সেদিন চলে এলি বাসা থেকে? আমরা কি তোর কেউই ছিলাম না? আমাদেরকে জানানোর কোনো প্রয়োজনই মনে করলি না কিছু? আমরা এতোটাই পর হয়ে গেছিলাম তোর?
তারা কিছু বলছেনা। কি বলবে সে?
— চুপ করে আছিস কেন? ভেবেছিস কিছুই জানি না আমরা তাইনা? আমরা সব জানি। ধ্রুব সব বলেছে আমাদের।
তারা বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো বাবার দিকে। ধ্রুব সব বলে দিয়েছে মানে? কেন বলেছে? ও নিজেই তো তারাকে মানা করেছিলো যেনো কেউ কিছু না জানে। তাহলে? ভাবতে লাগলো তারা।
ধ্রুবর বাবা একটু নড়েচড়ে বসলেন৷ বললেন.
— তুই কি জানিস, তুই চলে আসার পর কি হয়েছে? অনেক কিছুই পাল্টে গেছে মা। শুধু তাই নয়। ধ্রুবও পাল্টে গেছে।
তারা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে শুধু। মুখে কিছুই বলছে না।

ঘুমের ঘোরে মানুষ যখন খুব ভালো একটা স্বপ্ন দেখে তখন মানুষটি নিজেও জানেনা যে সে স্বপ্নে আছে। স্বপ্নটাকেই বাস্তব আর অতি সুখকর মনে হয় তখন। যখন ঘুম ভেংগে যায়, তখন সে ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে যায় কেন এটা স্বপ্ন হলো? এটা বাস্তব হলোনা কেন? আর স্বপ্নই যদি হবে তাহলে স্বপ্নটা কেন এতো তারাতাড়ি ভেংগে গেলো।
তারার কাছেও এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে সে স্বপ্নে আছে। খুব ভালো একটা স্বপ্ন দেখছে সে। ঘুম ভাংলেই যেনো স্বপ্নটা ছুটে যাবে। আবার পরক্ষনেই ধ্রুব আর ওর পরিবারের সাথে ঘটে যাওয়া জঘন্য ঘটনাটা মনে করে তুরিনের উপর বেশ রাগ হলো তারার। শুধু রাগ নয় প্রচন্ড ঘৃণা হচ্ছে ওর। তুরিন আর ওর মা যে কতোটা জঘন্য সেটা তারা জানতো। কিন্তু ধ্রুবর সাথে ওরা এভাবে ছলনা করবে সেটা কখনো ভাবেনি তারা। বাবার কথা আজ মনে পড়ছে খুব। না জানি কত কষ্টে দিন কাটাচ্ছে বাবা। এই বয়সে একা একা কিভাবে কি করছে ভেবেই বুকটা ফেটে যাচ্ছে তারার।
ধ্রুবর বাবা তারার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো..
— তারা মা!
— জ্বি বাবা, বলুন। শান্তভাবে বললো তারা।
— আমার দাদুভাই কোথায়?
তারা চমকে উঠলো। চমকে গিয়ে শশুরের দিকে তাকালো সে। উনার চোখদুটো খুশিতে ঝকমক করছে। আচমকায় তারার চোখদুটো পানিতে ভরে গেলো। আতকে উঠলেন ধ্রুবর বাবা। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন..
— কি হয়েছে মা? কাদছিস কেন? কোথায় দাদুভাই?
তারা কিছু বলতে পারছেনা। পানিতে ভেসে যাচ্ছে চোখদুটো। গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছেনা ওর।
— ওর বাবুটা নেই আংকেল। একটা দুর্ঘটনায় ওকে হারিয়েছি আমরা। শান্ত অথচ তীব্র কষ্টে কথাটা বললো সীমা।
#জানি_দেখা_হবে
Israt Jahan Tanni
#Part_26
..

— ওর বাবুটা নেই আংকেল। একটা দুর্ঘটনায় ওকে হারিয়েছি আমরা। শান্ত অথচ তীব্র কষ্টে কথাটা বললো সীমা।
আতকে উঠলেন ধ্রুবর বাবা। পরক্ষণেই নিজেকে শান্ত করে তারাকে বললেন
— ভেংগে পরিস না মা। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য-ই করেন। এটাতেও হয়তো আল্লাহ ভালো কিছুই রেখেছেন৷
তারা ছলছল চোখে শশুরের দিকে তাকালো।
সীমা আর আকাশের মা মিলে তারার শশুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। যদিও উনি খেতে চাইছিলেন না। তবে উনাদের আতিথেয়তায় আর না করতে পারলেন না উনি।। খাওয়া দাওয়া শেষ করে তারার পাশে বসে ওর মাথায় হাত রাখলেন তিনি। বললেন…

– আমাকে এখন যেতে হবে। আমি উঠছি মা। তুই নিজের খেয়াল নিস।
শশুড়ের কথায় অবাক হয়ে গেলো তারা। ও তো ভেবেছিলো উনি তারাকে নিয়ে যাবেন। আর তারাও কোনো অমত না করে নিজের সংসারে ফিরবে। কিন্তু উনি চলে যেতে চাচ্ছেন। একবারেও তারাকে নেওয়ার কথা বললেন না।
তারা তাকিয়ে আছে শশুরের দিকে। উনি সবার কাছ থেকে হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে তারাকে আবারও বলে চলে যেতে লাগলেন। তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে উনার যাওয়া।
কিছুটা যেয়েই আবার ফিরে তাকালেন উনি। বললেন…
— চিন্তা করিস না। ধ্রুব নিজে এসে তোকে নিয়ে যাবে বিকেলে। তা নাহলে আমিই তোকে সাথে করে নিতাম।
তারা লজ্জা পেয়ে গেলো। তারার লজ্জা পাওয়া দেখে আশা মুচকি মুচকি হেসে বললো….
— দিল তো পাগল হ্যায়..
তারা কিছু বলল না।
..
ধ্রব বসে আছে তারার রুমে। ওর সামনেই মাথা নিচু করে বসে আছে তারা। ধ্রুব এক নজরে তাকিয়ে আছে তারার দিকে। কারো মুখেই কোনো কথা নেই৷ নিরবতা ভেঙ্গে ধ্রুবই বললো..
– আমাকে মাফ করেছো তো তারা?
তারা কিছু বলছেনা। ধ্রুব ওর উত্তরের অপেক্ষায় বসে আছে।
তারাকে নিরব থাকতে দেখে ধ্রুব আবারো বললো..
— আমি জানি, আমি যা করেছি, তা ক্ষমার অযোগ্য। এরপরও বলছি, আমাকে মাফ করো প্লিজ। আমি তোমার সাথে যেসব অন্যায় করেছি তার জন্য আমি সত্যিই অনুতপ্ত। প্লিজ আমায় ক্ষমা করো। বলতে বলতে তারার হাতদুটো নিজের দুহাতের মাঝে বন্দি করে নিলো ধ্রুব। তারা একটু নড়েচড়ে উঠলো।
ধ্রুব বললো…
— গত কয়েকটা মাস ধরে আমি তোমাকে পাগলের মতো খুজেছি বউ। বিশ্বাস করো, আমি সত্যিই তোমাকে খোজেছি।
তারা ধ্রুবর দিকে তাকালো। ওর চোখদুটো ছলছল করছে। চোখ থেকে এক ফোটা পানি পরতে নিলে টুপ করেই সেটা নিজের হাতের তালুতে নিয়ে নিলো ধ্রুব। পানিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললো…
— চোখের পানি অনেক ফেলেছো। এইবার চোখটা মুছে নাও। এই প্রাণ থাকতে আর কোনোদিন ওই চোখ থেকে পানি ঝরতে দিবোনা, প্রমিস।
— মা কেমন আছেন? নিচের দিকে তাকিয়েই বললো তারা।
ধ্রুব একটু হাসলো। বললো…
— যাক, কথা তাহলে ফুটেছে। আমার প্রতি অভিমান ও কমেছে ধরে নিচ্ছি। স্বস্তি পেলাম মনে। বলেই আবারও হাসলো।
তারা কিছুটা অসহায়ভাবে তাকালো ধ্রুবর দিকে।
ধ্রুব বললো…
— সবাই কেমন আছে সেটা কি তুমি জানতে চাও?
— জ্বি।
— গেলেই জানতে পারবে। কেউ ভালো নেই তোমাকে ছাড়া তারা। তোমার যাওয়ার অপেক্ষা করছে সবাই। তোমার বাবাও পাগলের মতো অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। যাবেনা তুমি?
— আমি যাবো ওদের কাছে। আমি যাবো আমার বাবার কাছে। কেদে ফেললো তারা। খুব মনে পরছে আজ বাবাকে।
ধ্রুব তারাকে টেনে নিলো নিজের কাছে। বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো..
— কেদে নাও তারা। এটাই তোমার শেষ কান্না। এরপর আর কান্না করার সুযোগ আমি তোমাকে দিবোনা।
.
নিচে ড্রয়িংরুমে বসে আছে ধ্রুব। তারা উপরে নিজের জিনিসপত্র গোছগাছ করছে। সীমা ওকে সাহায্য করছে। আকাশের মা ধ্রুবকে নিজের মেয়ের জামাই এর মতো আপ্যায়ন করিয়েছে। বিশেষভাবে বলেছে যেন আরেকবার ও ওর বাবা মাকে নিয়ে আসে এখানে। আশা বসে বসে এটা ওটা জিজ্ঞাসা করছে ধ্রুবকে আর কিছুক্ষণ বাদে বাদেই দুলাভাই দুলাভাই বলে হেসে উঠছে।
আকাশ বাসায় ঢুকেই দেখলো ধ্রুব সোফায় বসা। মাথাটাই বিগড়ে গেল ওর।
কোনোমতে ধ্রুবর সামনে এসে দাড়িয়ে রক্তচক্ষু নিয়ে ধ্রুবর দিকে তাকালো সে। ধ্রুব আকাশকে দেখে উঠে দাড়িয়ে মুচকি হাসলো। নিজের হাতটা আকাশের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো..
— ভালোই হলো আপনার সাথে দেখা হয়ে। নাইস টু মীট ইউ।
আকাশ এক ঝটকায় ধ্রুবর হাটটা সরিয়ে দিলো। বললো..
— আবার কেন এসেছেন এখানে? সেদিন কি বলেছি মনে নেই আপনার?
— সব মনে আছে আমার।
— তাহলে কেন এসেছেন আবার?
— আমার বউকে নিয়ে যেতে এসেছি। শান্ত গলায় বললো ধ্রুব।
প্রচন্ড ভাবে রেগে গেল আকাশ। জোরে চিল্লিয়ে বলতে লাগলো…
— হোয়াট রাবিশ? আপনার বউ মানে? কে আপনার বউ?
— তারা। আমার বউ তারা।
— ওর সাথে আপনার সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। আপনি নিজে সে সম্পর্ক শেষ করেছেন।
— বিয়েটা এতোটাও ছেলেখেলা নয়, যে সামান্য ঝরেই সেটা নষ্ট হবে। যদিও আমি অন্যায় করেছি, কিন্তু আল্লাহর কালাম পরে যে সম্পর্ক শুরু হয়েছে সেটা এতো সহজে শেষ হবে কি করে! এরপরও যদি আপনার মনে হয়, আমাদের সম্পর্ক টা ঠিক নেই তাহলে আমরা আবারও বিয়ে করবো। আপনাকে অবশ্যই নিমন্ত্রণ করবো তখন। আসবেন কিন্তু। মুচকি হেসে বললো ধ্রুব।
আকাশের আর সহ্য হলো না ধ্রুবর বলা কথাগুলো। আচমকায় ধ্রুবর শার্টের কলার ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বললো..
— বড্ড বাড়াবাড়ি করছেন আপনি। এর ফল ভালো হবেনা বলে দিলাম।
ধ্রুব শান্তভাবে নিজেকে আকাশের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলো। বললো…
— আপনারা আমার তারার দেখাশোনা করেছেন। ওর বিপদের দিনে সাহায্য করেছেন। আপনাদের সাথে আমি কোনো ঝামেলা করতে চাই না মিস্টার আকাশ সাহেব।
একটু দম নিয়ে ধ্রুব আবারও বললো..
— আপনি কেন এমন করছেন বারবার? তারাকে নিয়ে আপনার এতো টেনশন কেন? আপনি কেন এতো ভাবছেন ওকে নিয়ে।
আকাশ চোখমুখ শক্ত করেই বললো…
— তারা আমার ভালোবাসা। আমি ভালোবাসি ওকে।
বেশ অবাক হলো ধ্রুব। বললো…
— তারা ভালোবাসে তো আপনাকে?
আকাশ দমে গেল কিছুটা। কি বলবে সে? তারা তো আগেই ওকে জানিয়ে দিয়েছে ও আকাশকে ভালোবাসেনা। সে ওর স্বামীকেই ভালোবাসে। আচ্ছা, এখন কি তারা চলে যাবে ওর স্বামীর সাথে?
এইসব ভেবেই মাথাটা ব্যাথা করছে আকাশের।
ধ্রুব বললো..
— কি হলো মিস্টার আকাশ? কিছু বলছেন না যে?
আকাশ কিছু বলতে যাবে তখন সিড়িতে চোখ গেলো ওর। তারা একটা আকাশী রং এর শাড়ি পরে নিচে নামছে। হাতে একটা ব্যাগ। আকাশ স্তব্ধ হয়ে গেল। তারমানে সত্যি সত্যিই তারা চলে যাচ্ছে। আকাশের বুকটা ফেটে যাচ্ছে এই মুহুর্তে। ও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তারার দিকে। তারা এক এক করে ধ্রুব আর আকাশের সামনে এসে দাড়ালো। আকাশ গভীরভাবে তাকিয়ে আছে তারার দিকে। তারা তাকাতে পারছেনা সে চোখের দিকে। ইতস্তত করে আকাশকে বললো…
— আমি চলে যাচ্ছি আকাশ।
আকাশ কিছু বললো না। নজর অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো। তারা তাকিয়ে আছে ওর দিকে। আচমকা আকাশ হনহনিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো।
তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে ওর যাওয়া।
==
আকাশের মা, সীমা আর আশা খুব করে বুঝাচ্ছে তারাকে। ধ্রুব বসে আছে সোফায়। বসে থেকে ওদের কার্যকলাপ দেখছে। এক পর্যায়ে কেদে ফেললো তারা। আকাশের মাকে জড়িয়ে ধরে কাদতে কাদতে বললো..
— খুব মিস করবো আন্টি আপনাদের।
— বোকা মেয়ে, কাদছিস কেন? আজ কি তোর কাদার দিন নাকি? আজ তোর সুখের দিন রে বুঝলি। তুই তোর হারানো সবকিছু ফিরে পাচ্ছিস। তোর স্বামী, তোর সংসার সবকিছু নিজের করে করে পাচ্ছিস৷ এমন দিনে কাদতে আছে? কাদবিনা একদম বুঝলি।
সীমাও বুঝাতে লাগলো তারাকে।
এক পর্যায়ে ধ্রুব বললো….
— এখন যাওয়া যাক তারা।
তারা কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে বললো..
— আপনি একটু অপেক্ষা করুন প্লিজ। আমি আসছি এক্ষুনি।
তারা উপরে চলে গেলো। ধ্রুব ভালো করেই বুঝতে পারলো তারা কেন উপরে যাচ্ছে।
তারা আকাশকে খুজে পেলোনা রুমে। আকাশকে খোজতে খোজতে ছাদে চলে গেল তারা। ছাদের এক পাশে আকাশের দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে আছে আকাশ। তারা ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো ওর দিকে। আকাশ বুঝতে পারলো তারা এসেছে। কিন্তু একবিন্দুও নড়লো না সে।
তারা ওর পাশে এসে দাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালো। আকাশের দৃষ্টি এখনো শূন্যে।
তারা বললো..
— আমাকে বিদায় দিবেননা আকাশ?
আকাশ একটু নড়েচড়ে উঠলো। শক্ত গলায় বললো..
— আমি যদি তোমাকে বিদায় না দেই, তাহলে কি তুমি থেকে যাবে তারা? যাবেনা তোমার স্বামীর সাথে?
তারা কিছু বললো না। আকাশ বললো..
— যদি এমন কিছু নাই হয়, তাহলে কেন আমার বিদায়ের অপেক্ষায় আছো তুমি? চলে যাও।
— আমাকে ভুল বুঝবেন না প্লিজ। উনি আমার স্বামী। আমি পারবোনা উনাকে ফিরিয়ে দিতে।
— তাহলে আমার ভালোবাসাগুলো আমাকে ফিরিয়ে দাও তারা। তোমাকে নিয়ে আমি যে স্বপ্নগুলো একটু একটু করে মনে বুনেছিলাম সেগুলো ফিরিয়ে দাও আমাকে। ভেজা গলায় তারার দিকে তাকিয়ে অস্ফুট ভাবে বললো আকাশ।
তারা কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা।
আকাশ হেসে দিলো। বললো..
— ভয় পেয়োনা তারা। আমি কখনোই তোমাকে ওরকম পরিস্থিতিতে ফেলবো না, যে পরিস্থিতিতে তুমি বাধার সম্মুখীন হবে।
আজ ধ্রুব যদি তোমার অনিচ্ছায় তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চাইতো তাহলে হয়তো ওর আজ শেষ দিন হতো। অথবা আমার শেষ দিন হতো। কিন্তু যেখানে তুমি নিজেই যেতে যাও, যেখানে তুমি তোমার সুখ খোজে পাও, সেখানে আমি কিভাবে তোমাকে আটকাবো তারা। আমি চাই তুমি সুখী হও। তুমি সুখে থাকো। তোমার সুখেই আমার সুখ তারা৷
তারা দাড়িয়ে থেকে কাদছে।
আচমকায় তারাকে জড়িয়ে ধরলো আকাশ। হাউমাউ করে কেদে ফেললো ও। বললো..
— এই কয়দিনে তোমাকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছি তারা। খুব মিস করবো তোমায়।
তারা পাথর হয়ে দাড়িয়ে আছে। আকাশ যথাসম্ভব দুরে গিয়ে দাড়িয়ে বললো
— সর‍্যি তারা। আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে গেছিলাম।
তারা কিছু বলছেনা।
আকাশ হেসে ফেললো হটাৎ ই। বললো…
— মুখটা এমন করে রেখেছো কেন তারা? দেখো তোমায় কত বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে। এভাবে দেখলে তোমার বর কিন্তু আবারও বেকে বসতে পারে। সো বী কেয়ারফুল। দ্বিতীয়বার আর কোনো ভুল করোনা।
— আকাশ..
— উহু, আর কোনো কথা নয়। বেচারা কখন থেকে তোমার অপেক্ষা করছে। চলো তোমায় এগিয়ে দেয়।
তারা অবাক হয়ে দেখছে আকাশকে। আকাশ তারাকে অবাক করে দিয়ে আবারো বললো…
— তোমাদের যখন সেকেন্ড টাইম আবারও বিয়ে হবে আমাকে কিন্তু ইনভাইট করবে। না করলে কিন্তু আমি নিজেই চলে যাবো তোমার বিয়েতে। পরে কিন্তু আমাকে ছ্যচড়া বলতে পারবেনা।
তারা যেনো আজ অন্য আকাশকে দেখছে। কিছুতেই সে এই আকাশের সাথে আগের আকাশকে মিলাতে পারছেনা।
.

বাসা থেকে বেরিয়ে খানিকটা দুরে গিয়ে একটা টেক্সি পেলো ওরা। টেক্সিটাকে ডেকে ওটাতে উঠে বসলো ধ্রুব আর তারা ।। ধ্রুব আর আকাশ বেশ স্বাভাবিকভাবেই কথা বলে বিদায় নিয়েছে।
গাড়িতে উঠে বসে তারা আকাশের দিকে তাকালো। আকাশ ওদের দিকে তাকিয়ে হেসেই চলেছে। ধ্রুব আকাশের কাছ থেকে বিদায় জানিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতে বললো। তারা তাকিয়েই আছে আকাশের দিকে।
গাড়ি চলে গেছে অনেকটা দুরে। আকাশ পিছনে ফিরে চোখদুটো মুছে নিলো ভালো করে। বুকটা ভার হয়ে আছে ওর। চোখদুটো জ্বালা করছে ভীষণ। চোখের পানি আবারও ভালো করে মুছে নিজের গন্তব্যে পা বাড়ালো আকাশ।

To be Continue…..
To be Continue……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here