ঝরাপাতা পর্ব ১

#ঝরা_পাতা🍂🍂
#Nishi_khatun
#পর্ব_০১

বিয়ের ভরা আসরে ছোট বোনের রিজেক্ট করে দেওয়া বরের সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে।এটা কি স্বপ্ন! না কি সত্যি!তা অনুভব করতে আমি নিজেই নিজের হাতে চিমটি কেটে দেখি না সত্যি এটা!

গুণিজনেরা ঠিক কথায় বলে,”কেউ কাউকে বাঁশ দিলে সে সময় সেখানে না যাওয়াটা মঙ্গল!নয়তো সে বাঁশের ঝাড়ে আপনিও আটকা পড়তে পারেন।ঠিক যেমটা আজ আমার সাথে হচ্ছে! ”

রাইসা’র হবু বর প্রচুর রাগী।সে রাগে জেদের বসে আমাকে বিয়েটা করছে।এটা মোটেই আমাদের দুজনের জন্য ভালো না।সে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে কাজী সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।সে কাজী সাহেব কে বলছে আমাদের দু জনের বিয়ে পড়াতে।

আরে যেই লোকটাকে রাইসা নিজেই ঠিকমতো
চেনে না জানে না।হঠাৎ করে কয়েকদিনের মধ্যে কি ভাবে বিয়ের জন্য পটিয়েছে তা রাইসা ছাড়া অন্য
কেউ জানে না।
এখন হঠাৎ করে সে বিয়ের ভরা আসরে বিয়ে ভেঙ্গে অপমানিত করলো কেনো বুঝতে পাড়লাম না।
তার বিয়ের জন্য রাজি হওয়া থেকে শুরু করে বিয়ে ভাঙ্গার গল্পটাও অদ্ভুত।

এসব চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে আমি তার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়াতে বড্ড বেশি ঝটফট করছি কিন্তু তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না।
সে উল্টা আমাকে আরো জোড়ে হাত শক্ত করে ধরে জোড়ে ধমক দিয়ে বলে,”এই মেয়ে আমার কাজে যদি কোনোরকম বাধা দিয়েছো তাহলে তোমার চৌদ্দপুরুষ কে জেলের ভাত খাওয়াই ছাড়বো।বিয়ের আসরে আমাকে এভাবে অপমান করার জন্য আমি তোমার বাড়ির লোকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করতে পারি বুঝলে মেয়ে?আর এ বাড়ির মানুষ কেউ খুন হোক তা বুঝি তুমি চাইবে না?”

আমি আমার মামা মামীর দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি!মামা মামী ও আজ আমার বড্ড বেশি অচেনা লাগছে।তারা কি ভাবে সহ্য করছে এসব অন্যায় আবদার বুঝতে পারছি না।আরে রাইসা আমার নিজের বোন না।সে আমার মামাতো বোন।আজ পর্যন্ত কোনোদিন ও রাইসা কে নিজের ছোট বোন ছাড়া মামাতো বোন ভাবতে যায়নি। আজ সে মেয়েটাও আমার এই অবস্থার মজা নিচ্ছে।
আজব কাহিনী যার সাথে বিয়ের কথা তাকে বিয়ে না করে আমাকে নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে গেছে।
আর এই অপরিচিত মানুষটাকে এতো সাহস কে দিয়েছে আমাকে স্পর্শ করার।

নাহ! এভাবে অপমান সহ্য করা যায় না!
আর বিয়েটা কোনো ছেলে খেলা নয়!
যখন ইচ্ছা যাকে তাকে বিয়ে করে নিবো!
আর পরে ভালো না লাগলে ছেড়ে দিবো।
আমি পরিবার থাকতেও অনাথ হতে পারি
তার মানে এটা নয় আমার আত্মসম্মান নেই।

আমি এবার লোকটার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে বলি,”এই যে মিস্টার আপনি আমার হাত ছেড়ে দিন নয়তো আমি চিৎকার করে মানুষ জড়ো করবো।”

হবু বরটা আমাকে বিদ্রূপ করে বলে,”বিয়ের আসরে এতো লোক জড়ো হয়ে আছে কেউ কিছু বলছে না।এরপর ও তোমার চিৎকার করে লোক জড় করার কথাটা কিন্তু মোটেই হজম হচ্ছে না বুঝলে মেয়ে।”

আমি নিজেই তার মুখে এমন কথা শুনে নির্বাক হয়ে গেছি।চারিদিকে এতো মানুষ কানাঘুষো করছে কিন্তু কেউ আমাকে সাহায্য করতে আসছে না।
এরা এমন কেনো?অন্যের কষ্টের মলম হতে পারে না।কিন্তু কষ্টের উপর লবন ছিটানোর ব্যবস্থা করতে পারে।এসব ভেবে কান্না করতে করতে হিচকি উঠে আসে। বেশি কান্নার জন্য কথা বলতে পারছি না।
এদিকে এতো শক্ত করে হাতটা ধরে আছে মনে হচ্ছে এখুনি বাধ ভেঙ্গে রক্ত বেড়িয়ে আসবে।
আমি আস্তে আস্তে নিজের সব জোড় করা ছেড়ি দিলাম।

হঠাৎ দেখি সে আমার হাতটা হালকা করে ছেড়ে দিয়েছে।হাতটা আলগাভাবে ধরতেই আমি নিজেকে তার কাছে থেকে ছাড়িয়ে সোজা মামা মামির সামনে দৌড়ে চলে আসি।

কিন্তু তাদের দেখছি আমাকে নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই।তারা হয়তো আমাকে আজ কুরবানি করতে চাইছে।

আমি মামার সামনে দাঁড়িয়ে বলছি,”মামু জান এসব ঠিক হচ্ছে না।আপনি ঐ লোকটাকে এখানে থেকে চলে যেতে বলুন!”

মামা আমার সামনে এসে মাথা নিচু করে বলছে,”অর্ণা মা! যা হচ্ছে তা হতে দাও।তোমার ও তো বিয়ের বয়স হয়েছে।আজ না হয় কাল তোমার বিয়ে দিতে হবে।
তাহলে আজকে এই বিয়েটা করে নাও।
এতে আমাদের সম্মান ও থাকবে।আবার তোমার কন্যাদানের দায় থেকে আমি মুক্তি পাবো।”

আমি মামাকে বলেছি,”মামু জান!দেখুন এমন কথা বলবেন না আপনি!আমি এখন এভাবে অচেনা কাউকে বিয়ে করতে চাইছি না।আর ঐ লোকটাকে তো নাহ!
যার সাথে রাইসার বিয়ের কথা ছিলো।
প্লিজ মামু জান লোকটাকে কথাটা বোঝান একটু।”

মামু জান কিছু বলবেন! তার আগেই মামী মা ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে ওঠেন,”অপয়া মুখপোড়া মেয়ে।
তোকে কতোবার নিষেধ করেছিলাম আমার মেয়ের বিয়েতে না আসতে? তারপর ও এসেছিস কেনো?
দেখ তোর অপয়া ছায়া আমার মেয়েটার উপর পড়তেই বিয়ের আসরে সে না করে দিয়েছে।
ছেলেটা যদি এখন আমাদের নামে কেস কাচারি করে তাহলে আমাদের এই সমাজে যা মান_সম্মান আছে সব ধুলাই মিশে যাবে।
তার সাথে বিয়ে বাড়িতে যদি বিয়ে না হয়!
তাহলে কতো কাহিনী হবে জানিস তুই?
সমাজের সামনে কি করে মুখ দেখাবো আমরা?
একদিক দিয়ে ভালোই হবে অনেক টাকা পয়সা
খরচ হয়েছে এই আয়োজ করতে।তোর যদি এখন বিয়েটা হয় তাহলে এ বাড়ি থেকে আজ অপয়া বিদায় হবে।আরে তুই বিয়েতে না করছিস কি করে?
তুই তোর অতীতের কথা ভুলে গেছিস?
তোর মা মরে তো তোকে তোর বাপের ভরসায় রেখে গিয়েছিল। তোর বাপ তো রাখে নাই তার সাথে।
আমরা দয়াকরে তোকে বড় করেছি।
তার প্রতিদান হিসাবে না হয় এই বিয়েটা করবি আজ।আর আমাদের ঘাড় থেকে বিদায় হয়ে যায়।”

আমি মামী মা’র সব অভিযোগ অভিমান শুনে সেখানে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নাকাটি করতে থাকি।আমার মামার আরেকটা মেয়ে আছে রাইমা।সে আমাকে অনেক ভালোবাসে।

রাইমা এসে বলে,”আপু তুমি বিয়েটা করে নাও।য
দি সুখ থাকে তাহলে সুখি হবে নয়তো বাকিটা তোমার ভাগ্য।এইভাবে অপমানিত হয়ে প্রতিদিন মরার থেকে বিয়ে করে জীবিত মরাই ভালো।ঐ বাড়ির মানুষেরা হয়তো রোজ তোমাকে উঠতে বসতে মৃত মায়ের খোঁটা দিবে না।”

আমি রাইমা কে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকি।
রাইমা আমাকে ছেড়ে দেয়।আমি সেখানে দাঁড়িয়ে নিজের ভাগ্যের কথা চিন্তা করে কান্না করছি।
এদিকে রাইমা সোজা কাজী সাহেব কাছে গিয়ে আমার সব তথ্য আর যে কাগজপত্র লাগে তা দিয়ে কাবিন নামা ঠিকঠাক করে আসে।

আমি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছি।
আজ বুঝতে পারছি সত্যি আমি ঝড়ে যাওয়া পাতা।
যে পাতা কে কারো দরকার নেই।আমার পরিবারের কেউ নেই তাই তো আজ আমি গাছের #ঝরা_পাতার মতো ঝড়ে যাচ্ছি। আমার সব স্বপ্ন! আশা,ভরসা বিয়ের সাথে সাথে শেষ হয়ে যাবে।
এইসব ভেবেই বুকের মাঝে খুব কষ্ট হচ্ছে।
বুকের মাঝে কেমন যেনো চিনচিন ব্যাথা অনুভব করছি।

এরপর লোকটা এসে সোজা আমার হাত ধরে কাজী সাহেবের সামনে নিয়ে যায়।
ইসলামিক নিয়ম মেনে অচেনা মানুষটাকে বিয়ে করে নেই।

রাইমা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলে,”আপুরে অনেক কষ্ট করেছো তো এ বাড়িতে আর কতো কষ্ট করতে চাইছো? এবার তো নিজের ঝরা পাতার পরিচয় মিটিয়ে নতুন সজীবতার আভাষ আনো নিজের জীবনে।”

মামু জান আমার কাছে এসে আমাকে
জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকি।
এই মানুষটা যদি না থাকতো তাহলে হয়তো আমার কোনো অস্তিত্ব থাকতো না।সেই ছোট বয়সে তো ঝড়া পাতার মতো ঝড়ে গেছিলাম। সেই অবুঝ ছোট মেয়েটার পিচ্চি হাতটা ধরে নিজের বাড়িতে সাথে করে আনেন।মামী মা কখনো আমাকে স্বাভাবিক ভাবে তার সংসারে মেনে নিতে পারেন নাই।মামী মা আমাকে তার সংসারের একটা বোঝায় ভেবে এসেছেন।আর মামু জান সব সময় আমাকে আপদ-বিপদ থেকে রক্ষা করতে চাইতো। মামীর শত শত অভিযোগ, অপমান, অবহেলার সামনে মামা সব সময় নিরব থাকতেন।
কিন্তু মামীর আড়ালে ঠিকি সে ভালোবাসে মাথায় স্নেহো মাখা হাত রাখতো।আজ থেকে সেই হাতটা আর থাকবে না।এটা ভাবতেই খুব কষ্ট হচ্ছে।বুকের মাঝে নিশ্বাস আটকে আসছে আমার।এমন কষ্ট মায়ের কথা মনে পড়লেও হয় না।
আমি মামু জানকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছি।কেউ যেনো আমাকে তার বুকের মাঝে থেকে ছাড়িয়ে নিতে না পারে।
এমন সময় আমার বর এসে সোজা হাতটা ধরে মামার বুকে থেকে ছাড়িয়ে গরুর মতো টানতে টানতে গাড়িতে নিয়ে তার পাশে বসিয়ে দেয়।আমি তার এমন ব্যবহারে অবাক হচ্ছি।মানুষটা এতো খারাপ নিজের স্বার্থের জন্য আমাকে জোড় করে বিয়ে করলেন।

আমি গাড়িতে বসে তার দিকে তাকিয়ে কান্না করতে থাকি।সে আমার দিকে একবার ও না তাকিয়ে গাড়ির বাহিরে দেখতে থাকে।

এরপর গাড়ির ড্রাইভার কে বলতেই ড্রাইভার গাড়ি চালাতে শুরু করে দেয়।
গাড়ি আপন গতিবেগে চলতে থাকে।
আমার আপন মানুষ গুলো আস্তে আস্তে দূরে চলে যাচ্ছে!
আর আমি ভাবতে থাকি কেনো এসেছিলাম এই বিয়ের আসরে।আজ যদি না আসতাম তাহলে এমন কিছুই হতো না আমার সাথে।

এই তো কিছু দিন আগের কথা…

(আপনাদের গঠনমূলক মন্তব্য এবং ভালো রিসপন্স আশা করবো।নয়তো গল্পটা কন্টিনিউয়াস করতে সমস্যা হবে আমার।)
.
.
.
.
.
চলবে..?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here