ঝরা_ফুলের_কান্না পর্ব ১+২

সত্য ঘটনা অবলম্বনে,,,
#ঝরা_ফুলের_কান্না
#রাবেয়া_সুলতানা
#১

হসপিটালে এসেছি কিছুক্ষণ হয়েছে। এরইমধ্যে জানতে পারলাম আমার স্বামী হিমেল আমার একটা কিডনি বিক্রি করতে নিয়ে এসেছে। সবচেয়ে বড় কথা কী জানেন? আমার এই একটাই কিডনি আছে। দু’টোর মধ্যে একটা একবছর আগে বিক্রি করেছে এখন দ্বিতীয়টা। কথাটা শুনে আমি হতভম্ব। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি ডাক্তার নাহিদের কথা শুনে। টলমল লাল চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিনি অদ্ভুত ভাবে বললেন,” দেখুন মিসেস মানুষের অভার হতে পারে,স্বামীর প্রতি অন্ধ ভালোবাসা থাকতেই পারে। তাই বলে আপনি কিডনি বিক্রি করে দিবেন?”
সম্পূর্ণা টলমল চোখে হেঁচকে উঠতেই নাহিদ নার্সকে বলে এক গ্লাস পানি দিলো। সম্পূর্ণা ঢকঢক করে একটানে সব পানি খেয়ে গ্লাসটা নাহিদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে,” আমি জানতাম না আমার আগের একটা কিডনি নেই। আর আজও জানি না আমি এইখানে এসেছি কিডনি বিক্রি করার জন্য। কিন্তু স্যার আমার জীবনে যাকে বিশ্বাস করে যার হাত ধরে সব প্রাচুর্য ছেড়ে চলে এলাম সে এমনটা কীভাবে করতে পারে?”
নাহিদ বলল,” আপনার হাতে বেশি সময় নেই। যে কোনো সময় আপনার স্বামী চলে আসতে পারে। আপনি যদি চান আমি তাহলে এইখান থেকে আপনাকে পালাতে সাহায্য করতে পারি।
সম্পূর্ণা নাহিদের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে, ” আমার যে যাওয়ার জায়গা নেই। আর যাবই বা কী করে? ভাড়াটাও আমার কাছে নেই।”
ডাক্তার নাহিদের মনে হয়তো সে সময় দয়া হয়েছিল একটা অসহায় মেয়ের জীবন বাঁচাতে। পকেট থেকে একহাজার টাকার একটা নোট বের করে দিয়ে যান এইখান থেকে। আশা করছি আপনার ভাড়াটা মিটে যাবে।
সম্পূর্ণা হাত দুটো জোড় করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে হাটতে লাগলো। কোথায় যাবে সে? মা বাবার কাছে? যাদের সমাজের চোখে চুনকালি লেপ্টে এসেছিল। তারা কী তাকে এত সহজে মেনে নিবে? তবুও হাঁটছে সে। চট্টগ্রামের কদমতলী বাস স্টেশনে এসে দুইশো টাকার একটা টিকেট কেটে নোয়াখালী আসার জন্য একটা বাসে উঠে পড়লো। দেড় বছর আগেই ঠিক এইভাবে পালিয়ে এসেছিল এই শহরের বুকে। তবে এই শহর খারাপ নয়। খারাপ নিজের কাছের মানুষটাই। তাই একবুক কষ্ট, ভয় আর ভালোবাসার প্রতি অবিশ্বাস নিয়ে ফিরে যাচ্ছে নিজের গন্তব্যে।

হিমেল এসে পুরো হসপিটাল তন্নতন্ন করে খুঁজে না পেয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আশেপাশে খুঁজতে লাগলো। সম্পুর্ণা এই শহরটা চেনে না বললেই চলে। তাই হিমেল বেশিদূর পর্যন্ত খুঁজতে পারছে না। হঠাৎ মাথায় এলো কদমতলী বাস স্টেশনে যায়নি তো? ভাবতেই যেন মনটা আছাড় খেল। বন্ধুর একটা মোটরবাইক নিয়ে কদমতলী গিয়ে পৌঁছালো। সেখানে গিয়ে জানতে পারলো নোয়াখালীর বাস বিশ মিনিট আগেই ছাড়া হয়ে গেছে।
হিমেল সম্পূর্ণার খোঁজ আর নিলো না। নিজের একরুমের বাসায় এসে মেজেতে বসে পড়লো। ভাবতেই লাগলো ঘন্টা কয়েক আগের কথা। সম্পূর্নাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে বলেই সকালে বের হয়েছিল। সুন্দর করে সেজেছিল সে। একটা সুতি শাড়ি গোল্ডপ্লেটের একজোড়া চুড়ি।কান-গলা খালি তবে একটা খোপা করেছিল সে। চোখে কাজল পুরো যেন বাঙালি বউ। বেশ লাগছিল তাকে। হিমেল ভাবতে ভাবতেই যেন রাত পুরিয়ে যাচ্ছে। শুধু অপেক্ষা সম্পূর্ণা তার কাছেই ফিরে আসবে। ভালোবাসার টানে ফিরে আসবে। কারণ ও ছাড়া সম্পূর্ণার এই শহরে যাওয়ার জায়গা নেই।তবে অনুশোচনার নেই চোখেমুখে বিন্দুমাত্রও।

ভোরে এসে নোয়াখালী চৌমুহনীতে বাস থেমেছে। সবাই একে একে নামলেও সম্পূর্ণা থমথমে হয়ে বসে আছে নিচের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ একটা ছেলে এসে, ” আপা আপনে নামবেন না? নোয়াখালী এসে গেছে কিন্তু।”
সম্পূর্ণা কথাটা শুনে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আস্তেআস্তে বাস থেকে নামলো। দেড় বছর পর নিজের মাতৃভূমিতে পা রাখেছে। যাবার সময় ভাবেইনি এভাবে তাকে আবার ফিরে আসতে হবে।
বাস থেকে নেমে সিএনজি স্টেশনে এসে একটা সিএনজি ভাড়া করলো নিজের বাড়িতে যাওয়ার জন্য। একটা বার গিয়ে দেখাই যাক না। মা হয়তো ফেলে দিবেন না। দরকার হলে মা’য়ের পায়ের উপর পড়ে থাকবো। আমাকে যে ক্ষমা নিতেই হবে মা’য়ের কাছ থেকে।

ফজরের নামাজের আজান দিচ্ছে চারদিকে। আতিকা বেগম সদর দরজা খুলতেই কানে ভেসে আসছে মসজিদের মুয়াজ্জিন বলছে, ” আস সালাতু খাইরুম মিনান্নাওম।
আস সালাতু খাইরুম মিনান্নাওম।(ঘুম হতে নামাজ উত্তম)
তিনি হাই তোলতেই সামনের উঠানের দিকে তাকিয়ে দেখেন নিজের মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। বাহিরে বিদ্যুৎ এর লাল বাতির আলোতে মেয়েকে লালবতি লাগছে।
আতিকা বেগম হতভম্ব হয়ে পা বাড়িয়ে এক পা এক পা করে মেয়ের কাছে এগিয়ে আসলেন। সম্পূর্ণা নিজেকে সামলাতে না পেরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মা’কে জড়িয়ে ধরেছে।আতিকা বেগম মুক্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন বিস্ময় নিয়ে। কোথায় থেকে এসেছে মেয়েটা? এতদিন খুঁজেও যাকে পায়নি আজ সে নিজে এসেছে! মেয়েটাকে দেখে মনেই হয়নি মেয়েটা সুখে আছে। অনেক কষ্টনিয়েই কী এসেছে আমার মেয়েটা? ভাবতে ভাবতেই একটা হাতে নিজেও জড়িয়ে ধরলেন। সম্পূর্ণার এমন হাউমাউ কান্না শোনে বাড়ির আশেপাশের ঘরগুলো থেকেও লোক বেরিয়ে এসেছে।

আতিকা বেগম মেয়েকে ঘরে তুললেন। সামনের ঘরটায় বসিয়ে,” সবাই কই গো তোমরা দেখে যাও কে এসেছে। আমার লক্ষ্মী আমার ঘরে আবার আসছে। সম্পূর্নার ভাইয়ের বউ আর বাবা উঠে এসেছে। বাবা মেয়েকে দেখে অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে নিলেও বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি। তিন ছেলের পরে মেয়েটা দুনিয়াতে এসেছিল। কত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে বলছি, নফল রোজা রাখার নিয়ত করছি, এতিমখানায় একটা গরু দিয়েছি। তারপর আল্লাহ মুখ তুলে চাইলেন। ছেলেদের দশ বছর পর মেয়েটা আসছে। যেদিন ওর জন্ম হয়েছিল সেদিন পুরো ঘরটা যেন আলোতে ঝলমল করছে। ভালোবেসে নাম দিয়েছিলাম সম্পূর্ণা। ও আসার আগে আমার ঘর অসম্পূর্ণ ছিল। তাই নামটা রাখাতে ওর দাদীও অমত করলো না। তবে মা আবার আলাদা করে নাম রেখেছে হাসিবা জান্নাত সম্পূর্ণা।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সাইফুল ইসলাম মেয়ের পাশে গিয়ে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই সম্পূর্ণা ঝাপটে ধরে আবারও হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
আস্তেআস্তে বাহিরে লোকজন ভিড় জমাতে শুরু করেছে। লোকের নানান কথায় কান না দিয়ে আতিকা বেগম লন্ডনে ফোন দিয়েছেন ছেলেদের কাছে। সম্পূর্ণার বড় দুই ভাই লন্ডনে থাকে আর ছোট ভাই দুবাইতে থাকে। বড় ভাই বিয়ে করেছে চার বছর। তার ঘরে একটা মেয়ে আছে।
সম্পূর্ণা ফিরে এসেছে শোনে ভাইয়েরা খুশি হলেও মনের কষ্টে বেশি কিছু বলতে পারলেন না। হাসি মুখে ফোনটা রেখে দিলো তারা।

সকাল নয়টা। হিমেলের মায়ের কানে পৌঁছে গেল সম্পূর্ণা এসেছে। নিজের ছেলেকে দেখার আশায় পুকুর পাড়ের ছোট্র দোচালা ঘর থেকে দৌড়ে সম্পূর্ণার বাড়িতে এলেন। সদর দরজার সামনে সিঁড়িতে বসে, ” আদীলের বউ ও আদীলের বউ। আমার কথাটা একটু শুনে যাও মা।”
তাবিয়া রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে,” আপনি কেন এসেছেন চাচী। বাবা এসে দেখলে বকাঝকা করবেন। আপনি এইখান থেকে চলে যান।”
-” বকব মানে? ভালো কথার ভাত নাই? কত সুন্দর করে তোমারে ডাকলাম আর তুমি আইসা আমারে জ্ঞান দাও। এখন এইটা বলো আমার ছেলে কোথায়? কোথায় লুকিয়ে রাখছ তারে?”
তাবিয়া নরম গলায় বলল,” আপনার ছেলে তো আসেনি চাচী। ভোর বেলায় শুধু সম্পূর্ণা একাই এসেছিল।”
-” আমার ছেলেকে খুন করে আসছে না-কি? চু*মা**নি যে আমার পোলা নিয়া গেছে এখন আইসা কই লুকাইছে। বাহির কর। এহনি তারে রানের উপর পা দিয়া টাইনা ছেরবো। বাহির কর তোর মা* ননদরে।”
-” চাচী আপনে এইখান থেকে যান। আপনাকে বলছি না আমাদের সাথে এইভাবে কথা বলবেন না?”
আতিকা বেগম চিল্লাপাল্লা শুনে বেরিয়ে এসে, ” তরো এইখানে কে আসতে বলছে? আর এসে এইভাবে মুখ খারাপ করছিস কেন?”
-” মুখ খারাপের কী দেখছোস। তোর মাইয়া বাহির করে নিয়ে আয়। তারপর দেখ আমি কী করি।”
-” তুই কী করবি না করবি সেটা পরে দেখা যাবে। আমার মেয়েটা এখন ঘুমাচ্ছে। জানি না তোর ছেলে আমার মেয়েটার সাথে কী করছে যার কারনে এক কাপড়ে আমার মেয়ে চট্টগ্রাম থেকে এইখানে আসে রাতে আঁধারে। সম্পূর্ণা ঘুম থেকে উঠলেই সব শুনে তারপর ব্যবস্থা নিব।”
-” কী ব্যবস্থা নিবি তুই? তোর মাইয়া রাতের আঁধারেই তো আসবে। বেশ্যার শান্তি আছে? বেশ্যাগিরি করেই তো আমার পোলারে আমার কাছ থেকে ভাগাই নিছে। ”
আতিকা বেগম তাবিয়াকে ভিতরে যেতে বলে,” আমার মেয়ে বেশ্যা না তুই বেশ্যা সেটা পরেই টের পাবি।” কথাটা বলে তিনিও ঘরের ভিতর গিয়ে দরজাটা আটকিয়ে দিলেন। হিমেলের মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে বাড়ির আশেপাশের লোকজন আবার বেরিয়ে এসে তামশা দেখছে।
সত্য ঘটনা অবলম্বনে,
#ঝরা_ফুলের_কান্না
#রাবেয়া_সুলতানা
#২

সম্পূর্ণা ঘুম থেকে উঠেছে যোহরের আজান কানে আসতেই। উঠে খাটের মাঝ বরাবর পা দুটোকে গুটিয়ে বসে আছে। ডাক্তার নাহিদের কথা কানে বারবার ভেসে আসছে। আপনার তো একটা কিডনি নাই। তাহলে দ্বিতীয়টা কেন বিক্রি করছেন? আচ্ছা! হিমেল কীভাবে পারলো আমার সাথে এমন করতে। আমি তাকে বিশ্বাস করেছি।সত্যিকারের ভালো ভেসেছি। তাহলে কেন এমনটা হলো?
আতিকা বেগম গোসলের জন্য কাপড় নিতে এসে দেখে সম্পূর্ণা পা গুটিয়ে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।
আতিকা বেগম নিজেও জানালার দিকে একবার তাকিয়ে মেয়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,” গোসল করবি?”
সম্পূর্ণা মা’য়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো।
আতিকা বেগম মেয়ের পাশে বসে,” সেকেলে মহিলাদের মতো আধা পুরনো সুতি শাড়ি পরে বসে আছিস কেন? হিমেল কী তোকে জামা কাপড়ও দেয়নি? কানে গলাও তো খালি? মনে হচ্ছে বিধবা বসে আছে।”
সম্পূর্ণা করুণ স্বরে বলল,” মা,,,!
-” এখন আর এইভাবে মা ডেকে লাভ কী? যখন বোঝার তখন যদি বুঝতি তাহলে আজ রাজরানীর মতো থাকতি। বড় বউ ও বড় বউ,একটু এইদিকে আসো।”
তাবিয়া দৌড়ে এসে, ” মা কিছু বলবেন?”
-” তোমার একটা থ্রি-পিস এনে ওরে দাও। পুকুরে গিয়ে ভালো করে ডুবিয়ে গোসল করে আসুক। আর না হলে তুমিই নিয়ে যাও। মাথায় ভালো করে শ্যাম্পু দিয়ে হাত পা ডলে দিও।”
-” ঠিক আছে মা। সম্পূর্ণা, আসো আমার সাথে।”
সম্পূর্ণার নিজেরও মনে হলো গোসল করে আসলে ভালোই হবে। জামাকাপড় ছিল না বলেই তখন না বলতে হয়েছে।

সম্পূর্ণা পুকুরের ঘাটে গিয়ে বসার জায়গাটায় ধপাস করে বসে পড়লো। তাবিয়া চুপ করে আগেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। সম্পূর্ণা বসে পুকুরের ওপর পাড়ে হিমেলদের ঘরটা দেখছে। যে ঘর নিজের হাতে হিমেলের মা সহ বানিয়ে ছিল। ছলছল চোখদুটো পানিতে ভরতি হয়ে গেল। সম্পূর্ণাদের বাড়িটি অনেক বড়। বাড়ির মাঝখানেই দোতলা অট্টালিকা। মানুষ কম বলে তারা নিচ তলায় থাকে আর দোতলায় তালা দিয়ে রাখা হয়। কোনো মেহমান আসলেই তালা খুলে দেওয়া হয়। বাড়ির উঠান পেরুলেই অন্য লোকজনের বসবাস। তাদের ঘরের সামনে দিয়ে সম্পূর্ণাদের রাস্তা। আর রাস্তা থেকে একটু দূর এগিয়ে গেলেই হিমেলদের ঘর। যা পুকুর পাড়ের এক কোণে। হিমেলের মা সম্পূর্ণার বাবার জেঠাতো বোন। বিয়ে দিয়ে ছিল সম্পূর্ণাদের গ্রামের থেকে কয়েক গ্রাম পরেই। হিমেলের বাবা মারা যাওয়ার পর শ্বাশুড়ি বের করে দেয় হিমেলের মা’কে। এসেই তখন বাপের বাড়ি উঠেছিল। কিন্তু ভাইয়ের সংসার বাড়তে থাকে আর হিমেলের মা’কে পুকুর পাড়ে ছোট্ট এক টুকরো জমি দিয়ে সেখানেই ঘর বানাতে বলে। নয় বছরের হিমেলকে নিয়ে কোনো মতে ঘরের চারপাশটা পাটকাঠি আর উপরে খড় দিয়ে একটা ঘর বানিয়ে সেখানে থাকতো।

তাবিয়ার ডাকে সম্পূর্ণা চমকে উঠে তাকাতেই দেখে তাবিয়া তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
-” এইবার চলো গোসল করবে। বেশি দেরি হলে মা বকা দিবেন।”
সম্পূর্ণা মাথা নাড়িয়ে চোখ দুটো মুছে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল।

“আদীলের মা, ও আদীলের মা। নামাজ পড়ে এসেছি। খাবার কী খেতে দিবে?”
সাইফুল ইসলামকে হাত দিয়ে ইশারা করে বসতে বলে তিনি ভিতরে ঘরে গেলেন। তাবিহাও নামাজ পড়ে এসে ভাত আর তরকারি হাড়ি পাতিল টেবিলেই নিয়ে এসেছে। বারবার বাটি আর চামচ নিয়ে রান্নাঘরে দৌড়াদৌড়ি করতে ভালো লাগে না। তাই আতিকা বেগমই বলেন সব টেবিলে উপরেই রেখে দিতে।
আতিকা বেগম সম্পূর্ণাকে ডাকতে গিয়ে দেখে নামাজের মোনাজাতে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলছে,” ছোটবেলা থেকে বাবা, মায়ের, ভাইদের ভালোবাসা নিয়ে বড় হয়েছি। যখন বড় হলাম তখন কেন আপনি আমার মনটা পাথরের মতো করলেন না? তাহলে তো ওই জানোয়ারটার সাথে জড়িয়ে নিজের বাবা-মা’কে ছোট করতাম না। আল্লাহ এখন আপনিই আমায় পথ দেখান আল্লাহ। আমি কী করবো আমি জানি না। আপনি পথ দেখানোর মালিক। আপনি লিখে রেখেছেন সব। আপনিই সব জানেন। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে মোনাজাত শেষ করলো সে। সম্পূর্ণা উঠে দাঁড়াতেই আতিকা বেগম বললেন,” ছেলে মেয়েরা কখন নিজের ভুল বোঝতে পারে জানিস? নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে। বাবা মা সবসময় চায় সন্তান ভালো থাকুক। ভালো একটা ভবিষ্যত হোক। আমার কী ধারণা জানিস? সন্তাদের ভবিষ্যত বাবা মা আগে থেকেই বলতে পারে কিছুটা। এখন চল খেয়ে নে। তোর বাবা তোর জন্য বসে আছে।”
মেয়েকে বাহুডোরে জড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললেন,” জানিস! তোর বাবা আজ সকালেই বাজারে গেছে। তোর জন্য ইলিশ মাছ এনেছে। তুই যাওয়ার পর থেকে তোর বাবা ইলিশ মাছ কিনে আনে নাই। তুই কষানো ইলিশ খেতে বেশ পছন্দ করিস। অবশ্য মাছটা কষিয়ে একরাত রাখলে ভালোই হতো। এখন তো তা সম্ভব নয়। বড় বউ এক পিস মাছ দাও ওর প্লেটে। তুমিও এক পিস নাও। বাকিটা কালকের জন্য তুলে রাখো। তোমার শ্বশুর আবার কষা মাছ খায় না।”
-” ঠিক আছে মা। আপনিও বসুন।”
সম্পূর্ণা খাবার টেবিলে হাত নাড়াচাড়া করছে। সেই কবে ইলিশ মাছ খেয়েছে মনেই করতে পারছে না। হয়তো এই বাড়িতেই খেয়েছে। আর খাওয়া হয়নি তার কষা ইলিশ মাছ।চোখদুটো বারবার ভারি হয়ে আসছে তার। সাইফুল ইসলাম খেতে খেতে মেয়ের দিকে নজর পড়তেই দেখে ভাতগুলো নাড়াচাড়া করে যাচ্ছে অন্যমনস্ক হয়ে। তিনি গলা খেকিয়ে বললেন,” কিরে মা, খাচ্ছিস না কেন? মাছ বাছতে পারিস না এখনো তাই না? এইদিকে দে আমি বেছে দিচ্ছি।” মাছের পিসটা নিয়ে মাছ বেছে ভাতের লোকমা সম্পূর্ণার মুখে তুলে দিতেই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে পানি। ভ্যালভ্যাল করে কেঁদে বললেন,” এতদিন কেমনে ছিলি মা? মাছ এখনো বাছতে পারিস না। আর আমার সেই মেয়ে কি-না সংসার করবে বলে চলে গিয়েছে। বাবা মুখ ফিরিয়েছি বলে চলেই যাবি? একটাবার বাবাকে জড়িয়ে ধরতে পারিসনি?”
সম্পূর্ণার কান্নার গতিও বেড়ে গেল। কোনো মতো করে একটু খেয়েছে সে। হঠাৎই বাহিরে আবার চিৎকার।
-” বেশ্যা এখনো ঘুমায়নি? আমার পোলারে যে রেখে আসছে মাইরা আসেনি এমন গ্যারান্টি কী? আমার পোলা যাওয়ার পর থেকে আমারে একটা ফোন দেয় না। কত কষ্ট করে ফালছি আমি। মা* এখন ঘরে বসে বসে তামশা দেখায়। এক ব্যাটা হয় না তোরে।তাই আরেক ব্যাটা ধরতে আসছোস?”
হিমেলের মায়ের চিৎকারে আবার সব লোক জমায়েত হয়েছে। আতিকা বেগম আর সাইফুল এবার উঠে এলেন। সাইফুল ধমক দিয়ে বললেন,” তুই আবার আসছোস? তোর কী শরম বলতে কিছু নাই?”
-” শরমনি? শরম তো তোর আর তোর মাইয়ার নাই। লুই* তুই থাকস মা* নিয়া তোর মাইয়া তো তোর মতোই হইবো। মাইয়া তাড়াতাড়ি বাইর কর। আমি সকলের সামনে জিজ্ঞেস করমু আমার পোলা কই?”
সাইফুল ইসলাম জেদে নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে এগিয়ে গেলেন হিমেলের মাকে মারবে বলে। আতিকা বেগম আর তাবিয়া এসে টানাটানি করে সাইফুল ইসলামকে ঘরে নিয়ে গেলেন। এইদিকে দুইজনের মুখ থেমে নেই। বারুদের মতো চলছে একেরপর এক গালাগালি।
সম্পূর্ণা আর নিজেকে সামলাতে না পেরে উঠেই এলো। সম্পূর্ণাকে দেখেই হিমেলের মা দৌড়ে গিয়ে মারতে যাবে লোকজন এসে ধরে ফেলেছে। টেনে উঠানে দাঁড় করিয়েছে তাকে। সম্পূর্ণা দরজার সামনের কয়েকটা সিঁড়ি পেরিয়ে উঠানে এসে হিমেলের মায়ের দিকে আস্তে করে এগিয়ে আসছে। সবাই ভেবেছিল হয়তো সে কিছু বলবে। কিন্তু কেউ কিছু বুঝার আগেই সম্পূর্ণা হিমেলের মায়ের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। সবাই হতবাক হলেও হিমেলের মা সম্পূর্ণাকে ধরতে যাবে তখনই সবাই তাকে টেনেটুনে তাদের বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে এলো। আতিকা বেগম আর সাইফুল ইসলাম হতভম্ব হয়ে গেল। সম্পূর্ণা এমন কাজ কখনোই করবে না। বয়স্ক মানুষদের সাথে সে কখনো খারাপ ব্যবহার করে না। কিন্তু আজ সম্পূর্নাকে দেখে সাইফুল ইসলাম নিচের দিকে মাথা নিচু করে আছে।

দুইদিন কেটে গেল। সম্পূর্ণা এখনো কথা বলেনি। বলবেই বা কী করে? শক্তি যেন তার সাথে নেই। বারবার হিমেলের কথা মনে হচ্ছে? এত ভালোবাসা ছিল আর এখন শুধুই ঘৃণা। কেন এমন হয়? কাউকে বিশ্বাস করা তো দোষের কিছু না।

আতিকা বেগম মেয়েকে নিয়ে নোয়াখালী সদরে গেলেন। মেয়ের জন্য জামাকাপড় তো কিছু কিনতে হবে। সাথে সাইফুল ইসলামও গেলেন। সবচেয়ে বড় দোকানটায় তাকে নিয়ে যাওয়া হলো। সম্পূর্ণার এইদিকে নজর নেই। নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আতিকা বেগম নিজেই পছন্দ করে অনেকগুলো জামা নিলো। সম্পূর্ণার এখন পছন্দের কোনো মূল্য নেই। তার পছন্দ শুধুই কষ্ট দিতে জানে।
বাড়িতে ফিরে আসার সময় সাইফুল ইসলামের বন্ধু আমজাদের সাথে দেখা।
-” ভাবি আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?”
-“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভাই।আপনি ভালো?
-” জি ভাবি আলহামদুলিল্লাহ। তোর মেয়ে নাকি সাইফুল? ”
-” হ্যাঁ।”
-” কবে এসেছে? চেনাই যাচ্ছে না ওকে। কেমন শুকিয়ে গেছে।”
-” দুইদিন আগে। তোর সাথে পরে দেখা হলে সব বলব। এখন আসিরে।”
-” ঠিক আছে। আমারও জরুরি কাজ আছে। পরে কিন্তু দেখা করিস।”
আমজাদ হাত নাড়াতে নাড়াতে চলে গেল। তারাও সম্পূর্ণাকে নিয়ে বাড়ি এসে দেখে হিমেলের মা আবার এসেছে। তাবিয়ার সাথে কথা-কাটাকাটি করছে। থানায় না-কি মামলা করেছে সম্পূর্ণার নামে এবং তার পরিবারের সবাকে নিয়ে। সেটাই জানাতে এসেছে।
সাইফুল ইসলামকে দেখে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল সে। আতিকা বেগম শুনে সম্পূর্ণার দিকে তাকিয়ে, ” আসার পর তুই একটা কথা বলছিস না। এখন দেখ যাদের কথা আমাদের পায়ের নিচে থাকার কথা এখন তারাই এসে পুলিশের ভয় দেখাচ্ছে। কী এমন ঘটেছে একটু তো বলবি। আসার পর থেকে জিজ্ঞেস করলেই খালি কান্না করে যাচ্ছিস। কেনরে আমি কী তোর এতই পর?
সম্পূর্ণা নিজের ঘরে চলে গেল ধীরে ধীরে। মা’কে কী সব বলবে? কিন্তু মা মেনে নেবে কী করে? আমার তো একটা কিডনি নেই। মা এটা শুনলেই তো ঠিক থাকতে পারবে না। মাথাটাও কেমন জানি ঘুরে। জার্নি করে এসেছি ভেবেই তো কিছু বুঝতে পারিনি। কিন্তু এখনও তো ঘুরে মাঝেমধ্যে। আতিকা বেগম আবার এসে,” কিরে তোর ভাবা শেষ হয়েছে? এইবার তো বল।
না-কি ওই বজ্জাতের সাথে থেকে থেকে তোর মাথাটাও গেছে?”
সম্পূর্ণা মায়ের পাশ কেটে দরজাটা লাগিয়ে দিলো। তারপর ভেজা গলায় বলল,” আচ্ছা মা তুমি যদি জানতে পারো তোমার মেয়ের একটা কিডনি নেই তাহলে কেমন লাগবে?”
আতিকা বেগম সম্পূর্ণার গালে কষিয়ে একটা থাপ্পড় দিয়ে,” পাগল হয়েছিস তুই? এইসব অলক্ষুণে কথা বলছিস।”
সম্পূর্ণা গালে হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,” হ্যাঁ মা এটাই সত্যি। আমি তোমাকে মিথ্যা বলছি না। কথাটা বলেই জামাটা একটু উল্টিয়ে মা’কে দেখিয়ে, “এই দেখ।”

চলবে,,,,
চলবে,,,,

বিঃদ্রঃ এই গল্পটার কিছু নেগেটিভ কথাবার্তার জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখীত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here