ঝরা_ফুলের_কান্না পর্ব ৩+৪

#ঝরা_ফুলের_কান্না
#রাবেয়া_সুলতানা
#৩

আতিকা বেগম নিজেকে সামলাতে না পেরে ধপাস করে খাটেই বসে পড়লেন। সেলাইয়ের দাগ চকচক করছে।
কোনোমতে নিজেকে শক্ত করে,” তোর কী এইখান থেকে যাওয়ার পর কিডনিতে পাথর হয়েছে নাকি? কিন্তু কিডনিতে পাথর হলেও তো কিডনি ফেলে দেয় না। তাহলে কী হয়েছে?”
সম্পূর্ণা অনায়াসে বলল,” হিমেল বিক্রি করে দিয়েছে মা।”
কথাটা শুনে আতিকা বেগম আঁতকে উঠে,” বিক্রি করেছে মানে? তুই বিক্রি করতে দিয়েছিস?”
-” আমি তো জানতামই না। এইখানে আসার আগে ও আবার আমার দ্বিতীয় কিডনিটা বিক্রি করতে নিয়ে গিয়েছিল সেখানেই একজন ডাক্তার আমাকে সব বলে। আর ওই ডাক্তারই আমাকে পালিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। না হলে হয়তো তোমরা আমার লাশটাকেও খুঁজে পেতে না। কারণ তোমাদের জেদ তো আর আমাকে খুঁজতে যেত না। তাই না?”
আতিকা বেগমের মাথাটা ঘুরছে। মেয়েকে কী থেকে কী বলবেন বুঝতে পারছে না। এত বড় জানোয়ার মানুষ হয় কী করে? অবশ্য ও তো আগে থেকেই জানোয়ারের মতোই ছিল। শুধু আমার মেয়ের চোখেই ভালো।
সম্পূর্ণা নিজে থেকে আবার বলল,” আমরা যখন এইখান থেকে যাই তখন থেকে ওর হাতে কোনো কাজ ছিল না। আমার কাছে তো কিছুই ছিল না তখন। সেখানে গিয়ে কত দিন না খেয়ে ছিলাম। কোনো মতো টুকটাক কাজে একবেলা খেলে দু’বেলা না খেয়ে থাকতে হতো। তবুও যেন ভালো ছিলাম। পরে ও একটা মুদীখানায় কাজ পায়। লোকটা ভালো ছিল। বেতন ছাড়াও মাঝেমধ্যে আমাদের সাহায্য করতো।যেমন চাল,ডাল,সাবান অনেক কিছু এমনিই দিয়ে দিতো হিমেলকে। আমাদের একরুমের একটা ঘরও দিয়েছে থাকতে। মাস শেষে টাকা পেয়ে ঘর ভাড়া আর সংসার ভালোমতো না চললেও কোনো অভিযোগ করিনি মা। কারণ আমি তো নিজের ইচ্ছে গিয়েছি তাই না। তাই কাকে বলবো বলো? আমার তো ওই শহরে আপন কেহ নেই যে নিজের সময় ফেলে আমার কথা শুনবে। দুইমাস যেতেই হিমেল আবার বিভিন্ন রকমের নেশা করতো। কত বুঝিয়েছি আমার কথা শুনতো না। কয়েকমাসের মাথায় আমাকে বলল হসপিটাল যেতে। বললাম কেন? সে বলল, অনেকদিন খেয়ে না খেয়ে আছি আমার কোনো সমস্যা হয়নি তো? তাই ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবে। সেখানে গিয়ে আমাকে অপারেশন করানো হবে। কিন্তু কিসের আমি জানি না। শুধু অনেকগুলো রিপোর্ট দেখিয়ে আমায় বলল আমাকে নাকি অ্যাপেনডিসাইটিস অপারেশন করা হবে। কিন্তু আমার তো সেই ধরনের কোনো লক্ষণই নেই। ওকে যখন বললাম,” হিমেল আমার তো পেটে ব্যথা কিংবা অন্য কোনো সমস্যা নেই।”
সে আমায় বলল,” তুমি কী আমার থেকে বেশি বোঝ? ডাক্তার ওরা না-কি তুমি? ডাক্তার বলেছে এখন কম সমস্যা আছে যদি বেড়ে যায় তখন তোমাকে বাঁচাতে প্রবলেম হয়ে যাবে।”
তার কথায় সেদিন বিশ্বাস করেছিলাম মা। আর কোনো প্রশ্ন করেনি। কারণ আমি তো ভাবতাম পৃথিবীতে ওই আমার একমাত্র আপন লোক। যার কাছে নিজের সব কষ্ট বলা যায়। যে আমার ভালো চায়। হয়তো ওই টাকায় সে নেশা করেছে।বাজার করেছে।আমাকে দুটো সুতির শাড়ি দিয়েছে। আবার আমার সেলাইয়ের জায়গার ব্যথা কমানোর ঔষধ এনেছে। তারপরও তো আমার স্বামী ছিল। ভালোবাসতো। তারপর তো দুইদিন আগের কাহিনি। যেটা আর আমাকে আটকাতে পারিনি। ছুটে আসতে হয়েছে তোমাদের কাছে।”
কথাগুলো বলতে বলতে হাউমাউ করে কাঁদছে সম্পূর্ণা।
আতিকা বেগম নিস্তব্ধ, নির্বিকার, স্থির হয়ে বসে আছেন। চোখ দিয়ে অনবরত পানিগুলো ঝরে পড়ছে।
যদি একটাবার মেয়েটার খবর নিতো তাহলে হয়তো এইদিন দেখতে হতো না। কেন যে এত পাথর হলাম কে জানে।
আতিকা বেগমের পায়ের কাছে বসে সম্পূর্ণা বলল,” আমায় মাপ করে দাও। তোমাদের মুখে চুনকালি মেখে আমিও শান্তি পাইনি মা। ও মা মাপ করে দাও না আমায়। তোমরা মাপ না করলে এই পৃথিবীতে বাঁচার ইচ্ছে আমার নেই। মা গো মাপ করে দাও না।”
আতিকা বেগম সম্পূর্ণাকে উঠিয়ে নিজের কাছে বসিয়ে,” মা কখনো সন্তানকে খারাপ বোধদোয়া করেন না। সবসময় আল্লাহর কাছে বলেন,” সন্তান যাই করুক না কেন ভালো থাকুক।”
সারারাত মা মেয়ে একসাথে কাটিয়ে দিলেন। সম্পূর্ণা মা’কে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে। কতদিন এমন ঘুম ঘুমালো জানে না সে। আজ সে ছোট্ট সম্পূর্ণাকে যেন ফিরে পেয়েছেন আতিকা বেগম।

পরের দিন সকালে সাইফুল ইসলাম আতিকা বেগমকে বারবার জিজ্ঞেস করলেন। সম্পূর্ণার সাথে কথা হয়েছে কি-না হিমেলের ব্যাপারে। আতিকা বেগম ভাবলেন সম্পূর্ণার একটা কিডনি নেই এইটা বললে সাইফুল ইসলাম কষ্ট পাবেন।হয়তো নিজেকে সামলাতে পারবেন না। আর পুলিশের কাছে বললেও ঘটনা ঘাটাঘাটি হবে। মেয়েকে দ্বিতীয়বার বিয়েটা আর দেওয়া যাবে না। মানুষে জেনেশুনে এমন মেয়ে বিয়ে করবে? করবে না। তাই তিনি দুঃখ কষ্টের কথা বললেন,নেশা করে সেটাও বললেন। এবং নেশার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে সম্পূর্ণা চলে এসেছে। রাতবিরেত মারধর করে তাই।”
সাইফুল ইসলাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে টেবিল ছেড়ে উঠার আগেই থানা থেকে ফোন এসেছে।
ওসি সাহেব সালাম দিয়ে বললেন,” সাইফুল সাহেব, আপনি গ্রামের সম্মানিত একজন ব্যক্তি। আমরা থানা থেকে গিয়ে আপনাদের অপদস্ত করতে চাইনি। কারণ গ্রামের মানুষেরা থানা থেকে পুলিশ গেলেই বিরাট কিছু ভেবে নেয়। তাই আমি আপনাকেই ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতে চাই। ব্যাপারটা আসোলে কী? শুনলাম আপনার মেয়ে ফিরে এসেছে?”
সাইফুল ইসলাম শান্ত আর অসহায় গলায় বললেন,” জি।”
-” এখন তো আপনাদের বাড়ির ওই মহিলা,মানে আপনার মেয়ের শ্বাশুড়ি মামলা করতে আসছে। কোনো রকম বুঝিয়ে কাগজ কলমে লেখে বলেছি মামলাটা নিয়েছি। এখন আপনি যদি সত্যটা কী বলতেন তাহলে ভালো হতো। আমরাও সামনে এগুতে পারতাম। আসোলে আমরা যতটুকু জানি আপনার ফ্যামিলি এবং আপনি অনেক ভালো মানুষ । যদি উনার ছেলেকে খুন করেই আসতো তাহলে চট্টগ্রাম থেকে নিশ্চয়ই ফোন আসতো। ফোন যখন আমাদের থানায় আসেনি তাহলে ব্যাপারটা অন্যকিছু। ”
-” আপনি ঠিক ধরেছেন। ওই মহিলা আমাদের বাড়িতে এসে অনেক গালাগালি করে। যখন তখন এসে আজেবাজে হুমকি দেয়। তারপর আতিকা বেগমের বলা কথাগুলো বলতেই ওসি সাহেব বললেন,” আপনাদের থানায় আগেই জানানো উচিত ছিল। এবং আপনাদেরই উচিত ছিল নারী নির্যাতনের মামলা করা। যখন করেন নাই ব্যাপারটা আমরা দেখতেছি।”
ওসি সাহেব সালাম দিয়ে রেখে দিলেন।

কয়েকদিন কেটে যেতেই সম্পূর্ণা আগের থেকে এখন ভালো আছে। বড় ভাবির সাথে টুকিটাকি কাজে সাহায্যও করে। পুলিশ হিমেলের মাকে হুমকি দিয়েছে যদি আবার ওদের বাড়ি গিয়ে কোনো রকম ঝামেলা করে তাহলে হিমেলের মা’কেই জেলে ভরে রেখে দিবে। এবং হিমেল যদি নোয়াখালী আসে তাহলে তাকে যেখাই পাক ধরে নিয়ে যাবে।হিমেলের মা সারা গ্রাম করেছে সাইফুল ইসলাম টাকা খাইয়ে পুলিশদের কিনে নিয়েছে। বাজারে গেলে অনেকে অনেক কথা বললেও সাইফুল ইসলাম কানে তুলে নেন না। আমজাদের সাথে বাজারে দেখা হতেই একদিন দুজনে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিতে দিতে সম্পূর্ণার কথা তুললো। এবং সাইফুল ইসলামও সব খুলে বললেন। আমজাদ শুনে বলল,” তোর মেয়েকে একটা বিয়ে দিয়ে দে। ভালো ছেলে দেখেই দে। তোর তো টাকা পয়সার কম নেই। মেয়েও দেখতে শুনতে ভালো।”
-” এমন ছেলে আমি পাব কই বল? গ্রামের সবাই জানে। সব শুনে ভালো ছেলেরা আসে না। সবাই উল্টো টিপনি কাটে।”
-” ঠিক আছে তাহলে আমি একটা ভালো ছেলে দেখে তোকে জানাবো। অবশ্য আমাদের এলাকায় যত ছেলে আছে সবগুলোই প্রবাসী। তুই আবার প্রবাসীর কাছে দিবি নাকি?”
-” ভালো হলে দিয়ে দিব। ধরে রেখে লাভ কী? মেয়েটার জীবন তো আর নষ্ট হয়ে যেতে দিতে পারি না।”
-” হুম ঠিক বলেছিস।”
সেদিন রাতেই সাইফুল ইসলাম আতিকা বেগমকে বলতেই সম্পূর্ণা সব শুনে নিয়েছে। কিন্তু বাবাকে কি বলবে তার জীবনে কোনো পুরুষ মানুষের স্থান দিতে সে পারবে না। তবে বাবাকে বলে এবার আর কষ্ট বাড়াতে চান না। তাদের যদি মনে হয় তারা বিয়েটা দিলে আমি ভালো থাকবো তারাও শান্তিতে থাকবে তাহলে হাসি মুখে না হয় ওদের জন্য আরেকবার আগুনে পা বাড়ালাম।

এতক্ষণ আফরা সম্পূর্ণার অতীত শুনে গালে হাত দিয়ে টলমল চোখে তাকিয়ে আছে সম্পূর্ণার দিকে। সম্পূর্ণা আফরার দিকে চোখ পড়তেই,” আপনি কাঁদছেন নাকি? লেখিকাদের কাঁদতে নেই। তারা শুধু শুনে আর গল্প তৈরি করে। আপনার সাথে আমার দেখা করা স্বাদ ছিল। যখন শুনেছি আপনি আমার সম্পর্কে আত্মীয় হোন তাহলে সুযোগটা হাত ছাড়া করতে চাইনি। তাই আজ রাতটা আপনার সাথে থাকার একটা বাহানা ছিল। আপনার লেখা ফেসবুকেই পড়েছিলাম মোটামুটি ভালো লেখেন। তবে আমার খুব ইচ্ছে ছিল কাউকে দিয়ে গল্পটা লেখাবো নিজের জীবনের। বড় বড় মাপের লেখকরা তো আমাকে সময় দিবেন না। আর তাদের সাথে যোগাযোগ করারও সামর্থ্য আমার নেই। তবে আপনিও অনেক ভালো লেখেন।তাই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছি।
আফরা গাল থেকে হাত নামিয়ে,” মুচকি হেসে, চা খাবেন আপনি?”
সম্পূর্ণা অবাক হয়ে,” এতরাতে চা বানাবেন?”
-” ওটা আমার অভ্যাস রাত একটা দুইটায় চা বানানো। আপনি বসুন আমি এখুনি আসছি।”
চায়ের ফাঁকে শুরু হলো আফরার কৌতূহল। প্রশ্ন ছুড়ে মারলো সম্পূর্ণার দিকে,” আচ্ছা আপনি হিমেলের বিষয়টা আমাকে একটু ক্লিয়ার করেন। হিমেলের সাথে প্রেমটা কীভাবে? এবং হিমেল কী আগে থেকেই খারাপ ছিল? বা আপনি পড়াশোনা কতটুকু করেছেন। আমি আমার বড় আপার কাছ থেকে শুনেছি আপনি এইসএসসি পর্যন্ত পড়েছেন। এক্সামটা দিয়েছেন?”
-” না। হিমেলকে তো আমি ছোট বেলায় থেকে দেখতাম। কারণ আগেই বলেছি হিমেল আমাদের পাশেরই। ওর নজরে আমি এসেছিলাম ক্লাস নাইনে।
হিমেলের মা আর হিমেল ওই ছোট ঘরটাতে থাকতো। আমি মাঝেমধ্যে বাড়ির কয়েকটা মেয়ের সাথে ওদের ঘরে যেতাম। হিমেল তখন শুয়ে থাকতো নয়তো আমাদের দেখলে চুপ করে এক জায়গায় বসে থাকতো। তাদের ঘরে অনেক বেলা করে রান্না হতো। তার মা পাশের বাড়ির খালিদ কাকুদের বাসায় বুয়ার কাজ করতো। ওইখান থেকে এসেই রান্না করতো। তারপর খেতো। হিমেল যে দেখতে অনেক স্মার্ট বা সুন্দর ছিল তাও না। তবে শান্ত ছিল আমার কাছে তখন এটাই মনে হয়েছিল। একদিন বিকেলে স্কুল থেকে আসার পথে হিমেল আমায় রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে বলল,” সম্পূর্ণা, কাল সকালে একটু তাড়াতাড়ি আসিস তো। তোর সাথে কথা আছে আমার।”
আমিও আচ্ছা বলে বাড়ি গেলাম।
পরের দিন সকালে,,,,
সত্যি ঘটনা অবলম্বনে,
#ঝরা_ফুলের_কান্না
#রাবেয়া_সুলতানা
#৪

পরের দিন সকালে সম্পূর্ণা স্কুলে যাওয়ার সময় হিমেল দূর থেকে ডাকলো। পিছনে ফিরে তাকিয়ে,” আমাকে ডেকেছেন হিমেল ভাই?”
-“হ্যাঁ। কালকে না তোরে বলছি আমার কথা শুনে যেতে। তুই দেখি কথা না শুনেই চলে যাচ্ছিস?”
-” মনে নেই আমার।”
হিমেল চুপ থেকে বলল,” তোর বড় ভাইকে নাকি বিয়ে করাবি?”
-” হ্যাঁ মেয়ে দেখতেছে। ভালো মেয়ে পেলে বিয়ে হবে।”
-” আমার এক বন্ধুর বোন আছে। খুব সুন্দর এবং ভালোও। তোর মা’কে বলিস দেখে আসতে। যদি যায় আমাকে বলিস।”
-” আপনার কথায় তো মা যাবে না।”
সম্পূর্ণা কথাটা বলে আবার বিড়বিড় করে বলল,”মা বলে আপনি নাকি গাজা খোর। আপনি আপনার মায়ের কথা শুনেন না। আপনার মা অনেক কষ্ট করে, কিন্তু আপনি কোনো কাজকর্ম করেন না। বন্ধুদের সাথে মিশে খারাপ হয়েছেন।”
হিমেল কথাটা শুনে কিছু একটা ভেবে বলল,” ঠিক আছে আমার কথা বলতে হবে না। তোদের ক্লাসের চুল বাঁকাবাঁকা একটা মেয়ে আছে না? আরে যারে সবাই স্কুলে নাকি বলে কাউয়ার বাসা।”
-” হ্যাঁ সীমা নাম ওর।”
-” যাইহোক ওই মেয়েকে বলবি, তোর পাশের ঘরে না-কি মেয়ে আছে? কথাতা বললেই ডিটেইলস সেই বলবে।তারপর না হয় তোর মা’কে নিয়ে যাবি।”
-” আচ্ছা ঠিক আছে।”
সম্পূর্ণা চলে গেল স্কুলের দিকে। হিমেল সম্পূর্ণার সাথে কথা বলার এতদিন ছুতো খুঁজছিল। আর আজ সে এইটা পূর্ণ করেছে। কয়েকমাস থেকেই কথা বলবে বলবে বলে বলতে পারে না সাইফুল ইসলামের ভয়ে। কিন্তু আজ যখন সুযোগ হাতে পেয়েছে হাত ছাড়া করা ঠিক হবে না। কারন তাবিয়াকে সে আগেই দেখে আসছে। হিমেলের দেখে মনে হলো তাবিয়াকে আতিকা বেগম খুবই পছন্দ করবেন।
সম্পূর্ণা স্কুল থেকে এসেই মায়ের গলা জড়িয়ে, ” মা জানো ভাইয়ার জন্য একটা মেয়ে খুঁজে পাইছি। আমার সাথে সীমা পড়ে না ওদের বাড়ির। চলো না বিকেলে বাবাকে নিয়ে দেখতে যাই!”
-” সর তো,মেয়ে দেখতে গেলে ছেলের বাবা মা দুজনেই একসাথে গেলে মানুষ কী বলবে? তোর ভাবি আমি আর তুই গিয়ে দেখে আসি। পরে না হয় তোর বাবা সহ তোর ভাইয়া আর মুরুব্বিরা গিয়ে পাকা কথা বলে আসবে।
সম্পূর্ণা উৎকণ্ঠে বলল,” তাহলে কী লামিয়া ভাবিরে ডেকে নিয়ে আসবো?”
কথাটা বলেই সম্পূর্ণা আর মায়ের কথার উত্তরের অপেক্ষা না করেই লামিয়াদের ঘরে গিয়ে,” ভাবি, ও ভাবি মা আপনাকে ডাকে। বলছে এখুনি যেতে।”
লামিয়া শ্বশুরের জন্য চা বসিয়েছে চুলায়। শ্বাশুড়িকে দেখতে বলে সম্পূর্ণার সাথে বেরিয়ে তাদের ঘরে এসে,” চাচি আমায় ডেকেছেন?”
-” আর বলিস না লামিয়া। সম্পূর্ণা কোথায় নাকি মেয়ের খোঁজ পেয়ে আসছে এখন শুরু করছে দেখতে যাওয়ার জন্য। তুই তো আমাদের সবার বড় বউ তাই তুই আমার সাথে চল। আমি, তুই সম্পূর্ণা গিয়ে দেখে আসি। ভালো লাগলে পরে না হয় তোর চাচা শ্বশুর সহ সবাই গিয়ে পাকা কথা দিবে।”
লামিয়া মুচকি হেসে,” সম্পূর্ণা খারাপ বলেনি চাচি। আদীলেরও তো ছুটি ঘনিয়ে আসছে। আমি বাবাকে চা দিয়ে রেডি হয়ে আসছি।”
-” ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি আয়। যা সম্পূর্ণা তুইও রেডি হয়ে নে।”

সন্ধ্যার আগ মুহুর্তে সম্পূর্ণারা সীমাদের ঘরেই ঢুকলো। হঠাৎ করে এইভাবে এসে কোনো মেয়ের ঘরে গেলে ঠিক হবে না। তাই সীমার মায়ের কাছে আগে সব বলল। সীমার মা হেসেই বললেন,” সীমা স্কুল থেকে এসে আমাকে বলেছে। তবে আপনারা আজ আসবেন সেটা বলেনি। আপনারা বসেন আমি তাবিয়ার মা’কে বলছি। দেখি উনারা কী বলে।”
সীমার মা একটু পর ফিরে এসে,” চলেন ওদের ঘরে যাই।আপনারা মেয়ে দেখতে আসছেন না দেখালেও খারাপ দেখা যায়।
আদীলের মা তাবিয়াদের ঘরে এসে সামনের বসার ঘরে বসলো। তাবিয়ার মা এসে সালাম দিয়ে কোলাকুলি করে তাদের সাথে কথা বললেন। তাবিয়ার ভাইও এসে সালাম দিলো। তাবিয়ার মা হেসে বলল,” আমার ছেলে তো আপনাদের সবাইকে চিনে। আপনাদের বাড়িতে মাঝেমধ্যে যায়। তাই সীমার মা বলতেই আমার ছেলে বলে,” আম্মা আসুক। আমি উনাদের চিনি। উনারা ভালো মানুষ। ”
আতিকা বেগম ম্লান হেসে বললেন,” তোমাকে তো আমি কখনো দেখিনি। আমাদের বাড়িতে কোথায় যাও?”
দাউদ উত্তর দিলো,” হিমেলদের ঘরে।”
-” ওহ ওদের ঘরতো রাস্তার কোণে পুকুরের পাড়ে। তাই হয়তো তোমাকে দেখিনি।”
কথার মাঝে তাবিয়ার মা উঠে গিয়ে শরবত আর টুকিটাকি নাশতার ব্যবস্থা করলেন। তাবিয়াকেও নিয়ে আসলেন সাথে করে।
-” আমার মেয়ে।”
আতিকা বেগম বললেন,” ওই চেয়ারটা টেনে দেন। ও বসুক।”
তাবিয়া বসতেই লামিয়া হাসি মুখে বলল,” তোমার নাম কী?”
-” জান্নাতুল ফেরদৌস তাবিয়া।”
-” কিসে পড়ো?
-” ডিগ্রি প্রথম বর্ষ।”
আতিকা আর লামিয়া মিলে আরও অনেক প্রশ্ন করলেন। মেয়ে পছন্দ হয়েছে বলে হাতে দু’হাজার টাকা গুজে দিয়ে বাড়ি আসলেন।

আতিকা বেগম রাতেই সাইফুল ইসলাম, আদীল, এবং সাইফুল ইসলামের বড় ভাইয়ের পরিবার সহ বসেছেন। সাইফুল ইসলামের বড় ভাই লিয়াকত আলী বললেন,” লামিয়া এসে তো ভালো ভোট দিয়েছে। এখন যখন আদীলের মায়েরও পছন্দ হয়েছে তাহলে আমরা পরশু গিয়ে পাকা কথা সেরে আসি। কালকের দিনটায় মেয়ে পক্ষকে বল খবর নিয়ে আমাদের ব্যাপারে আর আমরাও খবর নেই। যদি সবকিছু মিলে পজিটিভ হয় তাহলে পরশু পাকা কথা।”
সাইফুল ইসলাম বড় ভাইয়ের কথায় সহমত জানালেন।
পরের দিন সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে আবার হিমেলের সাথে দেখা।
-” কিরে, মেয়ে পছন্দ হয়েছে তোদের?”
-” জি হিমেল ভাই। কাল হয়তো পাকা কথা বলতে যাবে বাবা আর জ্যাঠু।”
-“তোর পড়াশোনা কেমন যাচ্ছে?”
-” ভালো। আপনি আগে তো আমার সাথে কথা বলতেন না। এখন কেন বলেন?”
-” তোকে ভালো লাগে তাই।”
সম্পুর্ণা হিমেলে কথা শুনে কেন জানি ভালো লাগলো। হাঁটছে আর হিমেলের দিকে মাঝেমধ্যে আড় চোখে তাকাচ্ছে।
হিমেল স্কুলে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলো তাকে। এখন প্রতিদিনই হিমেল তাকে কথা বলতে স্কুল গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে। এতে সম্পূর্ণার ভালো লাগতো। যদিও একদিন হিমেল না আসতো সম্পূর্ণা মন খারাপ করে স্কুলে পৌঁছাত তাও আবার বিশ কিংবা পঁচিশ মিনিট লেট করে। কারণ বারবার পিছনে ফিরে তাকাতো হিমেল আসছে কিনা কিংবা একটু গিয়েই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করতো।
এর মাঝে আদীলের বিয়েটা হলো। তার কারণে চার পাঁচদিন সম্পূর্ণার স্কুলে যাওয়া হয়নি। সেই সময়টা হিমেল সম্পূর্ণাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে যেতো। একটা বার দেখার আশায় পুকুরের এই পাড়ে নেমে সাঁতার কেটে তাদের সিমানায় গিয়ে সিঁড়িতে বসে অপেক্ষা করতো। সম্পূর্ণার ঝলক দেখলেই সে ফিরে আসতো আবার। আদীলের বিয়ের দিন অবশ্য তাকে দেখে তাবিয়াদের বাড়ি। কিন্তু কথা হয়নি।আজ যখন সম্পূর্ণা স্কুলে যাবে সেই সময়টা হিমেল দৌড়ে এসে,” সম্পূর্ণা এই সম্পূর্ণা দাঁড়া কথা আছে।
সম্পূর্ণা দাঁড়িয়ে পড়তেই হিমেল হাঁপাতে হাঁপাতে এসে,” কিরে তোকে এত করে ডাকলাম সাড়া দিচ্ছিস না কেন?”
-” খেয়াল করিনি হিমেল ভাই। কেন কিছু বলবেন?”
-” তুই তো বড় স্বার্থপর।”
-” আমি কী করছি?”
-” তোর ভাইয়ের বিয়ের জন্য মেয়েটা তো আমি দেখাইছি তাই না? আর তুই আমার সাথে একটাবারের জন্য কথা বলিসনি। বিয়েতে তো এমন ভাব দেখিয়েছিস তুই আমাকে চিনসই না। আসোলেইরে,বড়লোকেরা এমনই হয়। গরীবকে চোখে পড়ে না।”
-” আপনি ভুল বুঝছেন হিমেল ভাই। আপনার সাথে কথা বলতে দেখলে সমস্যা হবে। কেউ কিছু বললে মুখ আটকানো যাবে না।”
-” বাদ দে এইসব তোর সাথে আমার কথা আছে।”
-” আপনার কথা কাল শুনবো হিমেল ভাই। আজ আমার তাড়া আছে।”
বলেই সম্পূর্ণা দৌড়ে স্কুলের গেইটে ডুকে গেল।
স্কুল থেকে আসার পর মনটা খচখচ করছে। হিমেল ভাই কী এমন বলবে আমার সাথে? শুনে যাওয়াটা ভালোই ছিল। এখন মনে হচ্ছে দৌড়ে গিয়ে শুনে আসি। এখন কী উনি ঘরে থাকবে? কথাটা ভেবেই হিমেলদের ঘরে পা বাড়াতেই আতিকা বেগম এসে,” কিরে,এখনো স্কুল ড্রেস পরে আছিস? যা গিয়ে চেইঞ্জ করে কিছু খেয়ে পড়তে বস। দুইদিন পর এসএসসি পরীক্ষা। আর উনি রংঢং করে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াবে।”
আতিকা বেগম বকবক করতে করতে ছাদের দিকে গেলেন। মায়ের কথা কান না দিয়ে দরজা খুলে পা বাড়াতেই দেখে আদীল বাজার থেকে এসেছে। আসার সময় সম্পূর্ণার পছন্দের চটপটি আর ফুচকা আরও কত কী। কোথায় বের হচ্ছিস এই অসময়? ভেতরে চল দেখ তোর জন্য কী নিয়ে এসেছি।”
আদীল ভিতরে ঢুকে,” তাবিয়া, কয়েকটা প্লেট নিয়ে আসো তো। কথাটা বলে টেবিলের উপর প্যাকেটগুলো রেখে,” কিরে তুই এখনো দাঁড়িয়ে আছিস? যা চেইঞ্জ করে আয়। তোর প্রাইভেট টাইমটা চেইঞ্জ করা দরকার। বিকেলে পড়লে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। কাল স্যারকে গিয়ে বলে আসবো। পারলে তোকে বাড়ি এসে পড়াতে।”
সম্পূর্ণা মুখে কিছু না বলে নিজের ঘরে গেল। মনটা ভিষণ খারাপ লাগছে। আজ খাবারের প্রতি তার কোনো লোভ নেই। শুধু হিমেলের দিকে মনটা বারবার উড়ে যাচ্ছে।
তাবিয়া প্লেট নিয়ে এসে,” ও আসার পর থেকেই কেমন যেন বাহিরে যাওয়ার জন্য চটপট করছে। মাও দেখলাম একবার বকে গেল। ওর যে বয়সটা এইসময়টা খুব খারাপ। কাল থেকে স্কুলে যাওয়ার সময় তুমি নিয়ে যেও। যতদিন আছ নিয়ে যাও।পরে না হয় বাবা কিংবা মা নিয়ে যাবে।”
-” কিন্তু আমি তো সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারি না। যাব কী করে?”
-” চেষ্টা করলে সব হয়। তিন চারদিন গিয়ে অভ্যাস কর।”
তাবিয়ার কথাগুলো সম্পূর্ণা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে কিছুটা শুনেছে। আদীল তাকিয়ে মুচকি হেসে,” ওইখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বস খেয়ে দেখ আজকের চটপটি খুব মজা হয়েছে।”
সম্পূর্ণা স্মিথ হেসে ফুচকার দিকে হাত বাড়ালো। মা মাগরিবের নামাজ আদায় করে এসে,” কিরে তোরা ভাইবোন নামাজ কালাম বাদ দিয়ে ছাইপাঁশ গিলছিস। যা নামাজ পড়ে আয়। তাবিয়াতো দেখলাম আজান দেওয়ার সাথে সাথেই নামাজে গেছে। আর তোদের কানে যায়নি?”
আদীল কথা না বলে তাড়াহুড়ো করে বাহিরে গেল। রাস্তার মাথায় মসজিদ। জামাত না পেলেও একাই পড়ে নিবে।
আতিকা বেগম এবার সম্পূর্ণার দিকে তাকিয়ে, ” সবার আদরে মাথায় উঠে বসেছিস৷ বাপ ভাই আজ সবগুলো আসুক। কারও ঘরে মেয়ে নাই? আমার ঘরেই কী আহ্লাদি? আসুক সব আজ।”
তিনি বিড়বিড় করতে করতে রান্নাঘরে গেলেন।
সারারাত অনেক কষ্টে কাটিয়ে সকাল সাতটায় সম্পূর্ণা স্কুলে যাবে বলে রেডি হয়ে নিয়েছে। তাবিয়া ঘুম থেকে উঠে এসে,” তুমি এত সকাল যাবে নাকি? স্কুলের সময় তো আরও বাকি আছে।”
সম্পূর্ণা বলল,” আজ তাড়া আছে। তাই যাচ্ছি।”
-” ঠিক আছে তুমি একটু ওয়েট কর তোমার ভাইয়া তোমাকে দিয়ে আসবে।”
-” আরে না। আমি তো এখনই যাচ্ছি না। একটু পরেই যাব। তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। ভাইয়া ঘুমাক।”
তাবিয়া আর বেশি কিছু বলল না। শুধু বলল,” তাহলে নাশতা খেয়ে যাও। তুমি না খেয়ে গেলে,” বাবা উঠে শুনলে মা আর আমাকেও বকাবকি করবেন।”
সম্পূর্ণা কিছু বলল না। জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
সম্পূর্ণা বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু দূর যেতেই দেখে হিমেল আগেই দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। সম্পূর্ণা এগিয়ে যেতেই,” এত লেট করেছিস যে?”
-” ভাবি না খাইয়ে ছাড়লো না। আচ্ছা আপনি আমাকে কী বলবেন বলেন তো?”
-” হ্যাঁ বলবো তো। দেখ আকাশটা কেমন মেঘলা।” সম্পূর্ণা কথাটা শুনে আকাশের দিকে তাকিয়ে, “হু।”
-” ছাতা আনিসনি কেন?”
-” মনে নেই। আর বৃষ্টি তো নেই। আসার আগেই স্কুলে পৌঁছে যাব।”
-” যদি বলি যেতে দিব না।”
-” কী বলেন হিমেল ভাই?”
-” তুই এমন ভাই ভাই করিস কেন? হিমেলও তো বলতে পারিস।”
-” আপনি আমার অনেক বড় না?”
-” তো কী হয়েছে?”
-” শহরে জানিস কী হয়?”
-“কী?”
-” শহরে মেয়েরা নিজের বয়ফ্রেন্ডকে নাম ধরে ডাকে।”
-” তাতে কী? আপনি তো আমার বয়ফ্রেন্ড না।”
-” হতে কতক্ষণ।”
কথাটা বলেই হিমেল সম্পূর্ণার মাথা থেকে সামান্য উপরে হাত দিয়ে, ” দেখ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। আর আমি তোকে এই বৃষ্টির কসম করে বলছি তোকে আমি অনেক ভালোবাসি।”
সম্পূর্ণা থমকে গেল। না হেঁটে হিমেলের দিকে তাকিয়ে, ” আপনি জানেন বাবা শুনলে কী হবে?”
-” তুই এখন বলিস না।”
সম্পূর্ণা দেখে বৃষ্টি সে আগের মতোই পড়ে যাচ্ছে। হিমেলকে কিছু না বলে একটা রিকশা পেয়ে উঠে গেল। স্কুলে থাকা পুরোটা সময় হিমেলের কথাটাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কী বলবে সে? বাবাকে বলা উচিত কথাটা? কিন্তু হিমেল ভাইকে আমারও তো ভালো লাগে। এতদিন তো আমিও চাইছি উনি এই কথাটা বলুক। আজ যখন বলেছে তাহলে আমি এত ভাবছি কেন? উনি তো আমায় সত্যিই ভালোবাসেন। আজ পর্যন্ত কোনো ছেলে আমার সাথে তেমন কথা বলে না। কারণ আমি সাইফুল ইসলামের মেয়ে। কিন্তু হিমেল ভাই আমাকে কত ভালোবাসলে বাবার চিন্তা না করেও আমাকে ভালোবাসার কথা জানিয়েছে।

চলবে,,,,

বিঃদ্রঃ দয়া করে গল্পটা ধৈর্য নিয়ে পড়ুন। হিমেলের ব্যাপার এইখানেই শেষ হয়ে যাচ্ছে না। তাই ধৈর্য ধরে পড়লে সব উওর খুঁজে পাবেন। আর যারা এখনো নিস্তব্ধতার শেষ প্রহর অর্ডার করেননি তারা রকমারি থেকে অর্ডার করতে পারেন। আর রকমারি দিচ্ছে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা।
চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here