ঝিলের ওপারে পদ্মফুল পর্ব -১০

#ঝিলের_ওপারে_পদ্মফুল
তন্বী ইসলাম -১০

শাপলা অন্যমনস্ক হয়ে তাকালো পদ্ম’র দিকে। ওর বলা কথা তার মাথার উপর দিয়ে যেনো গেছে। সে আবারও পদ্মকে প্রশ্ন করলো
“কি যেনো বললি পদ্ম?
এবার পদ্ম’র মন বলছে শাপলাকে কাঁচা খেয়ে ফেলুক। দাঁত কটমট করতে লাগলো সে, চোখেমুখে বেজায় তেজ। শাপলা ভ্রু বাকিয়ে প্রশ্ন করলো
“তুই এমন করতেছিস কেন?
“আমার ব্যারাম উঠছে তাই এমন করতাছি। দেখিস, এই জন্মে তুই আমার সাথে কথা কইবি না। কইলে লবন মরিচ মাইখা খাইয়া নিমু তোরে।
বোনের এমন রুপ শাপলাকে চিন্তায় ফেললো। মনে মনে ভাবতে লাগলো, পদ্ম অসুস্থ হয়ে যায় নাই তো? জ্বীন ভুতে ধরেনি তো আবার?
শাপলার কপালে চিন্তার রেখা স্পষ্ট। সে জলদি করে পদ্ম’কে চেপে ধরলো। চিন্তিত গলায় বললো
“তোর হঠাৎ কি হইছে পদ্ম? এমন কথা কেন বলতেছিস বোন আমার?
পদ্ম আবারও রেগেমেগে চেচিয়ে বললো
“তুমি যাবি আমার সামনে থেইকা? একে’তো যখন তখন মাঝখানে আইসা ঢুইকা পরিস আর এখন এমন ভাব করিস যেনো কিছুই বুঝিস না। যা এখান থেইকা যাহ।

শাপলা পদ্ম’র থেকে খানিক দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে বিস্মিত চোখে দেখতে লাগলো। পদ্ম আবারও ফুসে উঠে বললো
“দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া তামশা দেখোস? যাইতে বলছি না?
শাপলা এবার বুঝলো বোন তার রাগ করেছে। সে মৃদুহেসে বললো
“আম্মা ডাকতেছে খাওয়ার জন্য, খাবি না?
“আমার সামনে আরেকটা কথা কইলে এইবার তোরে খামু আমি।
শাপলা হাসলো। বললো
“আমার সাথে রাগ দেখাস? আম্মারে বলি তুই শ্রাবণ ভাইয়ের নাম্বারের খোঁজ করতেছোস?
পদ্ম যেনো এবার কিছুটা গুটিয়ে গেলো। আমতা-আমতা করে বললো
“আমারে ভয় দেখাস কেন আপা? আমি না তোর একমাত্র ছোট বোইন। পদ্ম’র চোখেমুখে অসহায়ত্বের ছাপ। শাপলা হেসে বললো
“আর ঢং করা লাগবে না। আয়, খেতে আয়।
খাবার খেতে বসেও খেতে পারছেনা পদ্ম। ভাত যেনো গলা দিয়ে তার নামছেই না। বার বার শ্রাবণ ভাইয়ের কথা মনে পরছে। অল্পবয়সী আবেগি মন বিধায় সকালের কথাটা মনে পরতেই বেশ আফসোস হচ্ছে তার। যে শ্রাবণকে সে এতটা পছন্দ করে, সেই শ্রাবণ ভাই আজ তাকে একটা সামান্য চুমু খেতে চেয়েছিলো, অথচ তার বোনের জন্য সবটা বিগড়ে গেলো! মনে হলেই শাপলার উপর বেজায় রাগ হচ্ছে পদ্ম’র। আলেয়া খেয়াল করলেন পদ্ম শুধুই ভাতে হাত দিয়ে ঘাটাঘাটি করছে, অথচ খাওয়ার নাম নেই। মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন শাপলার দিকে সে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। আলেয়া বেশ অবাক হয়ে বললেন
“খাস না কেন পদ্ম?
পদ্ম শাপলার ওদিক থেকে চোখ সরিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। করুণ গলায় বললো
“খিদা নাই আম্মা।

আলেয়া চাপাস্বরে বললেন
“খিদা নাই কেন? কিছু তো খাস নাই!
পদ্ম আবারও অসহায় মুখে বললো
“অতকিছু জানিনা আম্মা, শুধু জানি খিদা নাই।
আলেয়া আর কোনো কথা বাড়ালো না। পদ্ম’ও কোনো কথা না বলে স্টিলের পানিভর্তি গ্লাসটা নিয়ে ভাতের মধ্যেই হাত ধুয়ে ফেললো। শাপলা অবাক হয়ে দেখলো বোনের কান্ডকারখানা।
আকাশে আজ পূর্ণ চাঁদ উঠেছে। জোছনার আলোয় সারা উঠোনটা ঝকঝকে দেখা যাচ্ছে। সচরাচর জোছনার আলোয় বাইরে এসে হাটাহাটি করতে বেশ লাগে পদ্ম’র কাছে। তবে আজ কিছুই তার ভালো লাগছে না। একটা চেয়ার টেনে ঘরের সামনেই বসে রইলো সে। খানিক বাদে কারো হাতের ছোয়ায় ঘার ঘুরিয়ে তাকালো পদ্ম। শাপলাকে দেখে খানিক বিরক্ত হলো সে। বিরক্তিকর কন্ঠে বললো
“ওহ তুই।

আবারও সামনে ফিরে তাকালো পদ্ম। একটা মোড়া টেনে এনে পদ্ম’র সামনে রেখে সেটাতে বসলো শাপলা। মিহিগলায় বললো
“আজ এমন করতেছিস কেন পদ্ম?
“জানিনা।
পদ্ম’র দৃষ্টি শুন্যে। কি দেখছে সে নিজেও জানে না। শাপলা ক্ষীণ গলায় আবারও বললো
“শ্রাবণ ভাইয়ের জন্য খারাপ লাগতেছে?
পদ্ম ভ্রু বাকিয়ে রাগীস্বরে বললো
“তো আর কোন ভাইয়ের জন্য খারাপ লাগবে? খারাপ লাগার মতো আর কোনো ভাই কি আমার আছে? ওই একমাত্র শ্রাবণ ভাই ই’তো আছে।
শাপলা হাসলো। বললো
“তুই আসলেই একটা পাগলী।
“তো আইছিস কেন পাগলীর ধারে? তোরে কে কইছে আসার লাইগা?
“মনে হইতেছে শ্রাবণ ভাই তোর মাথাটা পুরাটাই সাথে করে নিয়া গেছে, তাই এমন আবোল তাবোল বলতেছিস।
পদ্ম আঁড়চোখে তাকালো শাপলার দিকে। শাপলা চলে গেলো সেখান থেকে। পদ্ম গালে হাত দিয়ে চেপে ধরে ভাবনার জগতে বসলো। ইচ্ছে করছে জোরে জোরে চেচিয়ে কান্না করুক।

খানিক বাদে আবারও ফিরে এলো শাপলা। ওকে দেখতে পেয়ে পদ্ম চেচিয়ে বলে উঠলো
“আবার আমার চোক্ষের সামনে আইলি কেন?
“আমারে দেখলে এমন জ্বলস কেন তুই?
“তুই সকালে কি করছিলি ভুইলা গেছোস?
শাপলা এবার বিস্ময়ে বললো
“আমি আবার কি করলাম সকালে?
পদ্ম মুখ ঘুরিয়ে নিলো, মাথা থেকে উড়ে গেছিলো শ্রাবণ আর ওর সকালের ঘটা ঘটনাটা শাপলার অজানা। শাপলা হেসে তার হাতে থাকা মুঠোফোনটা পদ্ম’র কানে চেপে ধরলো। পদ্ম চেচিয়ে শাপলাকে আবারও কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফোনের ওপাশ থেকে কলিজা ঠান্ডা করা সেই শীতল কন্ঠ থেকে বেরিয়ে এলো সেই চিরচেনা ডাক
“পদ্মফুল…
পদ্ম বিস্ময়ে কিছুটা সময় জমে রইলো। ওপাশ থেকে আবারও বললো
“আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস পদ্মফুল?
পদ্ম অবাক হয়ে তাকালো শাপলার দিকে, শাপলার ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি। পদ্ম এবার ফোনের দিকে নজর দিলো। একগাল হেসে উচ্ছ্বাস ভরা কন্ঠে বললো
“শ্রাবণ ভাই!

হোস্টেলের বেডটার উপর আরামসে শুয়ে কানে ফোন ঠেকিয়ে পদ্মফুলের মিষ্টি কন্ঠটা শুনে মুচকি মুচকি হাসছে শ্রাবণ। সারাটা দিন এই কন্ঠটাকে প্রচন্ড রকমের মিস করেছে সে, কল করা হয়ে উঠেনি সময়ের অভাবে। এই কিছুক্ষণ আগে সে ফ্রি হয়েই সোজা শাপলার নাম্বারে কল করেছে। পদ্ম’কে অতি উচ্ছ্বসিত হতে দেখে শাপলার চোখেমুখে খানিক ভয়ের রেশ দেখা গেলো৷ পদ্ম’র মুখের সামনে মুখ এনে ফিসফিস গলায় বললো
“এইভাবে কথা বললে তুইও মরবি, আর আমারেও মারবি পদ্ম। আম্মা তো ঘরে বইসা থাইকাও সব শুনবো। একটু আস্তে করে কথা বল, নইলে উঠোনের এক সাইডে গিয়ে কথা বল বোন আমার। বোনের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি হাসলো পদ্ম। এরপর ধীরপায়ে সেখান থেকে উঠে উঠোনের এক কর্ণারে চলে গেলো সে।
শ্রাবণ শোয়া থেকে উঠে বসেছে ততক্ষণে। পা দুটো ভাজ করে পায়ের উপর একটা বালিশ রেখে বসে সে বালিশে হাতের ভর দিলো শ্রাবণ। একহাত বালিশে রেখে আরেক হাত দিয়ে কানে ফোন গুজলো। ওপাশ থেকে পদ্ম’র আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছেনা। শ্রাবণ বিস্ময়ে প্রশ্ন করলো
“পদ্মফুল, তুমি কি নেই ওপাশে?
পদ্ম অত্যন্ত ধীর গলায় বললো
“আছি আছি।

পদ্ম’র আছি আছি কথাটা শুনে ফট করে হেসে উঠলো শ্রাবণ। বললো
“বাহ! আমার পদ্মফুল তো অনেক সুন্দর করে কথা বলতে পারে।
শ্রাবণের কথা শুনে লাজুক হাসি হাসলো পদ্ম।
“যাওয়ার পথে তোমার কোনো অসুবিধা হয় নাই তো শ্রাবণ ভাই?
“খুব হয়েছে।
শ্রাবণের কথা শুনে কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেলো পদ্ম। আতংক নিয়ে বললো
“কি হইছে শ্রাবণ ভাই? কোনো বিপদে পরছিলা তুমি? কি বিপদে পরছিলা? এখন সব ঠিক আছে তো?
শ্রাবণ হাসলো। বললো
“পুরো রাস্তাটাতেই তোকে খুব মনে পরেছে, বার বার তোর চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। আসার পর থেকেও আমার কাজে আমি মনোযোগ দিতে পারছি না, বার বার কিছু না কিছু ভুল করেই যাচ্ছি। এর চেয়ে বড় অসুবিধা আর কি হতে পারে!
পদ্ম’র মুখটা হঠাৎ মলিন হয়ে গেলো। খানিক সময় চুপ থেকে আমতা-আমতা করে বললো
“তাইলে তো আমি তোমারে অসুবিধায় ফালাইয়া দিছি শ্রাবণ ভাই। আরেকবার যখন তুমি বাড়ি আইবা, তোমার চোক্ষের সামনেও আমি আসমু না, তাইলেই আমার কারণে তোমার আর অতো অতো সমস্যা হইবো না।

শ্রাবণ বুঝতে পারলো পদ্ম’র কন্ঠে স্পষ্ট অভিমান। সে হেসে বললো
“আহারে, আমার পদ্মফুল অভিমান করেছে।
“অভিমান করতে যামু কেন, তুমিই তো কইলা আমার জন্য তোমার অসুবিধা হইছে, কাজে ভুল হইছে।
“পদ্মফুল।
পদ্ম অভিমানী গলায় বললো
“হু..
“তোকে না দেখলে কি আমি বাঁচবো?
পদ্ম’র কান্না পেলো এবার। একেতো প্রথমেই মনে একরাশ অভিমান জমিয়ে দিয়েছে, এখন আবার এইসব কথা বলছে। পদ্ম আর কোনো কথা বললো না। শ্রাবণ কিছুক্ষণ পদ্ম’র উত্তরের অপেক্ষা করে শেষে উত্তর না পেয়ে বললো
“পদ্মফুল..
“কি?
“আমাকে মিস করছিস?
“মোটেও না।
শ্রাবণ হাসলো। বললো
“না বললেও আমি জানি তুই আমাকে মিস করছিস।
পদ্ম উত্তর দিলো না, সে’তো ঠিকই শ্রাবণ ভাইকে মিস করছে। শ্রাবণ বললো
“এখন তো তোর সাথে আমার কথা হলোই, অন্যবার যখন মিস করবি, সোজা আমাদের ঘরে গিয়ে আমার রুমে চলে যাবি।
“কেন? ভ্রু বাকালো পদ্ম।
শ্রাবণ হেসে বললো
“আমার বিছানায় একটু হাত বুলিয়ে আসবি, বালিশে মাথা রাখবি কিছু সময়ের জন্য। ওখানে আমার গায়ের ঘ্রাণ মিশে আছে।
পদ্ম এবার সব অভিমান ভুলে গিয়ে লজ্জায় মুখ লুকালো।

এমন সময় আলেয়ার ডাক এলো। তিনি ঘরের বাইরে বেরিয়ে বললেন
“পদ্ম, এই রাইতের বেলা ওইখানে দাঁড়াইয়া কি করস তুই?
পদ্ম ভয়ে তারাতাড়ি করে কান থেকে ফোন সরিয়ে নিলো। চাচীর গলার আওয়াজ শ্রাবণের কানেও গেলো। সেও আর দেরি না করে ওপাশ থেকে কল কেটে দিলো। অপরাধীর মতো মায়ের দিকে এগিয়ে এলো পদ্ম। মাকে কি জবাব দিবে সেটাই সে ভাবতে লাগলো। যদি মা বিন্দুমাত্রও জানতে পারে সে শ্রাবণ ভাইয়ের সাথে ফোনে কথা বলেছে তাহলে আর উপায় নেই। ছেলেদের সাথে মেলামেশা মা খুব কমই পছন্দ করেন, সেটা শ্রাবণ ভাই কিংবা যে কেউই হোক।

শাপলা ঘরে চলে গেছিলো তখনই। মায়ের সামনে বোনকে বেকায়দায় দেখে তারাতাড়ি বেরিয়ে এলো সে। পদ্ম’কে প্রচন্ড পরিমাণে ঘাবড়ে যেতে দেখলো সে। মায়ের দিকে চেয়ে দেখলো মা’ও সন্দিহান চোখে তাকিয়ে আছে পদ্ম’র পানে। শাপলা পদ্ম’র দিক থেকে মায়ের নজর সরানোর জন্য বলে উঠলো
“আম্মা, ঘরে খাটের নিচে কি যানি নড়াচড়া করতাছে, একটু দেখবা তুমি?
আলেয়া শাপলার দিকে তাকিয়ে বললো
“খাটের নিচে আবার কি আইবো?
“জানিনা, তুমি ঘরে আইসা একটু দেখো তো।।
“তোর মোবাইলে কই? মোবাইলের লাইটটা জ্বালাইয়া দেখ কি আছে।
শাপলা খানিক ঘাবড়ে গেলো। মোবাইল তো পদ্ম’র কাছে, তবে এটা ভালো কথা যে মা সেটা খেয়াল করেনি।
শাপলা আবারও বললো
“আমার একা দেখার সাহস নাই। তোমরা দুইজনেই আসো ঘরে। একসাথে দেখি কি আছে। আমার ভয় লাগতেছে খুব।

আলেয়া পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে আবারও চাপাস্বরে বললো
“তারাতাড়ি ঘরে আয় পদ্ম। রাইত বিরাইতে এদিকে ওইদিকে যেনো আর না দেখি তোরে..।

চলবে……

গ্রুপ লিংক : “তন্বী’র উপন্যাসমহল”- Tanni Islam✍️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here