ডাক্তার সাহেব পর্ব ১৩+১৪

#ডাক্তার সাহেব
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১৩

সে ঠোঁটটা এগিয়ে দিয়ে আমার কানের কাছে এসে যা বলল তা শুনে আমার শরীরটায় নতুন মাত্রায় রক্তচড়া অনুভূতির জ্বালা ধরে গেল।

– তোমার দাঁতগুলো যে কোদালের মতো কখনও কী লক্ষ্য করেছো আয়নায়? এ কোদালের মতো দাঁত দিয়ে আমার ঠোঁটে খাবলা বসাতে লজ্জা লাগেনি! ছিহ…ছিহ… লাজ সরম কী সব গুলিয়ে খেয়েছো? দিন কে দিন কী থেকে কী হচ্ছ? আমি যদি দাঁতের ডাক্তার হতাম তাহলে তোমার দাঁতগুলো সার্জারি করে কোদাল আকার থেকে কুড়াল আকারে আনতাম। ঠোঁটের চারপাশ এখনও ব্যথায় টনটন করছে। আর দুপুরে কী বিরিয়ানি খেয়েছিলে নাকি? মুখ থেকে বিরিয়ানির গন্ধ আসছিল। ছিহ….ছিহ…. ঠিকঠাক মতো খাওয়া দাওয়া করে মুখও ধুও না। তার উপর আরেকজনের ঠোঁটের উপর খাবলা বসাও। কী গিদররে বাবা…। আচ্ছা তুমি কী গোসল ঠিক করে করো নাকি সেটাও দু একদিন পর পর করো? কাল থেকে একই জামা পরে আছো। তোমাকে কত পরিষ্কার ভাবতাম সে তুমি কী না এত গিদর। আর শুনো মেয়ে হুটহাট এ কোদালের মতো দাঁত নিয়ে খাবলা বসাবা না আমার ঠোঁটে। নিজেকে সামলাও। মাথার তার ছুটে গেলে বলো তোমার বাবাকে বলে পাবনার টিকেট কেটে আনি।

নীলের কথা শুনে শরীরটা রাগে গজগজ করতে লাগল। রক্ত যেন মাথায় চড়ে বসল। আমার দাঁত কোদালের মতো? দাঁত নাহয় একটু বড়ই তাই বলে কোদালের মতো? নীলকে ধরে জোরে ধাক্কা দিয়ে পেছন দিকে ফেলে বললাম

– দুপুরে আমি শুটকি দিয়ে ভাত খেয়েছি। হুদাই মানুষকে পঁচাতে ভালো লাগে তাই না? কোদালের মতো দাঁত মানে কী? এ দাঁতের অনেক গুণ সেটা তুমি বুঝবে কী করে। সে ঘিলু তোমার নেই। আর হাসপাতালে প্রতিদিন গোসল করার পরিবেশ থাকে না এটা সবার জানা। তবে সারা শরীরে সুগন্ধি মাখানো সেটা কী নাকে যাইনি! জীবনে অনেক বেদ্দব দেখেছি তোমার মতো বেদ্দব পোলা দেখিনি। কীভাবে প্রেমিকার প্রশংসা করতে হয় তাই তো জানো না। আসছে প্রেম করতে।

– বয়সে তোমার ১২ বছরের বড় আমাকে বেয়াদব বলো সাহস তো কম না। তোমার বাবার কাছে বিষয়টা বলতে হবে।

আমি মুখটা কাচুমাচু করে বললাম

– বাবাকে এখানে আনতে হবে কেন? আমরা আমরাইতো। বাবার কথা বাদ দাও। কথায় কথায় বাবা, বাবা করবে না। অনেক রাগ উঠে যায়। শুধু শুধু রাগ তুলো।

নীল হালকা হাসলো। তার হাসির দিকে তাকিয়ে যেন আমি চুপ হয়ে গেলাম। এ হাসি যেন আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। নীল তো কোনো হিরো না, দেখতেও হিরোর মতো না। তবুও কেন তাকে ভালো লাগে। তবুও কেন তার স্পর্শ পেতে আমার ব্যাকুল মনটা আকুল হয়ে থাকে। তার প্রতি থাকা সবটা অভিমান কেনই বা চলে যায় তার হাসি দেখে। যতবার সে হাসে ততবার কেনইবা কারণে অকারণে তার হাসিতে আমি ডুবে যাই। আমার ভেতরে তার জন্য ঢিপঢিপ করে। মনে হয় এই আলো নিভছে, এই আলো জ্বলছে। আলো জ্বলা নিভার এ পরিক্রমাটা অনেকটা বিদুৎ চমকানোর মতো। আমি নীলের দিকে তাকিয়ে আছি। তার হাসির রেশ এখনও কাটেনি। রেশটা তার মুখে বরাবরেই অনেকক্ষণ স্থায়ী হয়। বিষয়টা অন্য কারও চক্ষুগোচর না হলেও আমার চোখ এড়িয়ে যেতে পারে না। রেশটাকে বিস্তৃত করে বলল

– প্রিয়সী এত রাগ বা এত আবেগ ভালো না। আস্তে ধীরে হাঁটো। ভালোবাসাকে সুন্দর করে উপভোগ করো। এত তাড়াহুড়ো করলে থুবরে পড়বে। নিজের অস্তিত্ব কখন যে বিলীন হয়ে যাবে বুঝতে পারবে না। নিজেকে নিয়ে ভাবো। নিজের ভাবনায় অন্য কাউকে এত পরিমাণ আনবে না যেটাতে তোমার স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যহত হয়। তোমার স্বাভাবিক আচরণ বদলে যায়। এবার একটা সত্যি কথা বলব?

আমি হালকা হালকা দম ছেড়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম

– বলো।

– তোমাকে সত্যিই অনেক মায়াবী লাগে। তোমার এ চোখ আমাকে ভীষণ ভাবে টানে। তোমার এ চোখের মায়ায় ডুবে যেতে মন চায়। তবে বয়সের ভারে সে পাগলামিটা তোমার মতো করতে পারি না। মনে ইচ্ছা জাগে আমি যদি সেই ২১ বছরের টগবগে যুবক হতাম তাহলে তোমাকে আঁকড়ে নিজের করে দখল করে নিতাম। মাঝে মাঝে মানুষ গাজার নেশায় মাতাল হয় না, কারও চোখের নেশাতেই তার মাতাল হওয়ার জন্য যথেষ্ট। তোমার চুলগুলো যখন সামনে এসে পড়ে তখন আমার ঠোঁটের স্পর্শে তোমার চুল গুলো সরিয়ে দিতে মন চায়। কিন্তু তফাৎ টা কোথায় জানো?

বলেই নীল চুপ হয়ে গেল। নীলের এ নিস্তবতায় যেন আবেগের অতল সাগরে তলিয়ে যাওয়া থেকে হুট করে ভেসে উঠলাম। হালকা গলায় জবাব দিলাম

– কী?

– তফাৎ টা হচ্ছে তুমি চাইলেই পাগলামি করতে পারো আমি পারি না। তোমার বয়স যখন ২০ পার হবে তখন এ কথা গুলো মনে হয়ে হাসবে তুমি। তখন তোমার জীবনে হয়তো আমি থাকব, হয়তো না। যদি তোমার জীবনে না থাকি তাহলে এ কথা গুলো মনে করে আমাকে স্মরণ করবে। আমি চাই তুমি ধীর, স্থির হও। এ বয়সটা অনেক খারাপ। তুমি যেটাকে ভালোবাসা বলে দাবি করছো সত্যি বলতে সেটা আবেগ ছাড়া কিছুই না। যদিও এ কথাগুলো তোমাকে হাজার বার বললেও মানবে না বা বুঝবে না। তাই বলছিও না। তোমার পাগলামি গুলোই তোমার কাছে নিয়ে আসে আমাকে। এ পাগলামিগুলো যেন আজীবন তোমার মাঝে থাকে। সময়ের সাথে যেন হারিয়ে না যায়। ধীর স্থির হলেও যেন এ পাগলামি সুপ্ত অবস্থায় তোমার মাঝে বিরাজমান থাকে সেটাই চাই। এই পাগলামিগুলো যেন নির্দিষ্ট কারও জন্য বরাদ্দ থাকে সেটা চাই৷

নীল চুপ। আর আমি নীলের দিকে অকোপটে তাকিয়ে আছি। চোখটা তার চোখ থেকে সরাতে পারছি না। নীল যতই বলুক এটা আমার আবেগ তবে আমি জানি নীলকে কতটা ভালোবাসি আমি। যদি ভালো না বাসতাম নীলের ঐ চোখে ডুবে থাকতে পারতাম না। নীল তার হাত দিয়ে আমার চোখের সামনে হাতটা নাড়িয়ে বলল

– সিঁথি রাণী এভাবে তাকিয়ে থেকো না। এভাবে তাকালে এ বৃদ্ধের যে তরুণ হতে মন চায়।

আমি মৃদু হেসে বললাম

– তরুণ হতে কে মানা করছে? তরুণ হয়ে যাও না!আমার দিকে তাকিয়ে সহস্র যুগ পার করে দাও। আমাকে ভালোবেসে সব উজার করে দাও। আমি তোমাকে ভীষণ ভাবে আঁকড়ে ধরতে চাই।

নীল এবার অট্ট হেসে বলল

– সার্টিফিকেটে বয়স কত? ১৬ হয়েছে?

– হুম হয়েছে।

– তাহলে আরেকটু বড় হও। বিয়ের বয়সটা আরেকটু হোক। এখনেই এসব হাবিজাবি চিন্তা করে আবার খাবলা বসিয়ে দিও না।

কপাল ভাঁজ করে উত্তর দিলাম

– বারবার খাবলা খাবলা করবা না। আমি ইচ্ছে করে এমন করেনি। তুমি আমাকে উস্কে দিয়েছিলে তাই করেছি।

– হ্যাঁ। এখন যতদোষ নন্দঘোষ। বরং এটা বলো যে তুমি তোমার লাজ সরম গিলে খেয়েছো তাই এমনটা করেছো। তা ‘না হলে একটা বিবাহ যোগ্য অবিবাহিত পুরুষের ঠোঁটে কেউ খাবলা বসায়? নেহাতেই বড় অন্যায় করেছো। এসব আর করবে না।

– করলে কী করবে?

– তা জানি না। তবে উচিত না।

– এত উচিত অনুচিত ভাবতে চাই না।

বলেই নীলের কাছে গেলাম। নীল একটু পিছিয়ে বলল

– ছেড়ে দে সিঁথি আর এগুস না। তুই আমার ঠোঁট পাবি কিন্তু ঠোঁটের ভালোবাসা পাবি না।

কথাটা শুনে আমি পিছিয়ে গেলাম। পেট ফেটে হাসি আসলো। মুখটা চেপে হাসতে লাগলাম। এমন সময় কেবিনের দরজাটায় ধাক্কার শব্দ আসলো। বুঝতে পারছিলাম বাবা এসেছে। নীল ঝটপট উঠে চেয়ারে গিয়ে বসলো। আমি নিজেকে সামলে দরজাটা খুললাম। আমার ধারণা মিথ্যা না, বাবায় এসেছে। বাবা আমার দিকে এক ব্যাগ ফল এগিয়ে দিয়ে বলল

– নীলের জন্য কেটে আনো তো।

তারপর নীলের পাশে বসলো। বাবার আওয়াজ পেয়ে রিদি ঘুম থেকে উঠে মায়ের পাশেই বসলো। মুখে হাই তুলতে তুলতে বলল

– খালু কখন এসেছেন?

– মত্রই।

আমি ফলগুলো ধুয়ে ছুরি দিয়ে ফল কাটতে লাগলাম। বাবা নীলের সামনের চেয়ারটায় বসলো। নীলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল

– তোমার ঠোঁট এত লাল হয়ে আছে কেন? ঠোঁটে কী হয়েছে?

বাবার প্রশ্ন শুনে আমার বুক কেঁপে উঠল। নীলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে নিশ্চুপ। বাবা দ্বিতীয় বার প্রশ্ন করলো। রিদির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেও চুপ। রিদির মুখ অবয়ব দেখে বুঝতে পারছিলাম সে বিষয়টা আন্দাজ করতে পেরেছে। আমি চুপ হয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। হার্টবিট যেন দ্রূতগতিতে বাড়তে লাগল। নীলের দিকে তাকিয়ে রইলাম তার জবাবের আশায়। নীলের ঠোঁট নড়ে উঠল। সে বাবাকে বলল….
#ডাক্তার সাহেব
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১৪

সে বাবাকে বলল

– আংকেল এলার্জির সমস্যা আছে আমার। তাই ঠোঁটের চারপাশ চুলকানোর জন্য এমন লাল হয়ে আছে। সকালে গরুর মাংস আর চিংড়ি মাছ খেয়েছিলাম তো সেজন্য। বাসায় গিয়ে ঔষধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। খাবলার দাগও চলে যাবে।

বাবা সব গুলো কথায় স্বাভাবিক ভাবে শুনছিল। শেষের কথাটা শুনে কপালটা কুঁচকে নীলের দিকে তাকাল। বিস্ময়ের রেখা বাবার চোখে মুখে প্রস্ফুটিত। বাবা বিস্ময়টা বহাল রেখেই বলল

– খাবলা মানে?

এদিকে আমার সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। নীলকে আমি মোটেও ভরসা করতে পারি না। কী থেকে কী করে বসে বলা যায় না। তার উপর সে বাবাকে বলে দেওয়ার একটা ফন্দি আটতেছে। এখন কী আমার উচিত বাবার সামনে গিয়ে অন্য প্রসঙ্গ টানা নাকি এতে বাবা আরও সন্দেহ করবে। বাবার চোখ মুখে প্রশ্নের বলি রেখা ফুটে উঠেছে। জিজ্ঞাসু চোখে এখনও নীলের দিকে তাকিয়ে আছে। নীল নিজেকে স্বাভাবিক করে হালকা হেসে বলল

– আংকেল এ খাবলা খুবলা দাগ মানে উঁচু নীচু লাল দাগ গুলো। আমাদের এলাকায় এরকম দাগকে খাবলা, খুবলা বলে।

বাবার চোখ মুখ থেকে প্রশ্নের বলি রেখা ঘুচে গেল। ভাঁজ করা কপালটাও স্বাভাবিক আকার ধারণ করল। বেশ জোর গলায় আমাকে বলে উঠল

– সিঁথি ফল কাটা কী হয়েছে? দ্রূত দে তো। বাসায় যেতে হবে। রাত হয়ে যাচ্ছে। দেরি হলে গাড়ি পেতে সমস্যা হবে।

আমি নিজেকে সামলে নিলাম। কিছুটা যেন স্বস্তি মিলল। স্বাভাবিক সুরেই জবাব দিলাম

– হ্যাঁ বাবা প্রায় শেষ। এখনই দিচ্ছি।

বলেই ফলগুলো দ্রূত কেটে বাবা আর নীলের সামনে দিলাম। নীলের মুখে লজ্জার বহিঃপ্রকাশ ফুটে উঠেছে। নীলের এ চেহারায় শুভ্রতার শীতল সম্রভ ফুটে উঠেছে। কেন জানি না অযথায় এতটা সুন্দর ওকে লাগছে । মাঝে মাঝে দুটানায় পড়ে যাই আমার চোখের দৃষ্টি সুন্দর নাকি নীল সুন্দর। চুপ হয়েই পাশে দাঁড়ালাম। বাবার আর নীলের কথোপকথন শুনতে লাগলাম। রিদি আমার দিকে সন্দেহের চোখে এখনও তাকিয়ে আছে। বুঝায় যাচ্ছে বাবা আর নীল বের হলে রিদির ছোবলে পড়তে হবে। তখন নিজেকে কী বলে বাঁচাব জানি না। বাবাকে বুঝিয়ে ফেললেও রিদিকে বুঝানো এত সহজ হবে না। আর যে কম্য করেছি সেটা এতটাও ভালো কম্যও না। কেন যে এমন করে ফেলেছি জানি না। শতবার নিজেকে বাঁধা দিয়েও কেন সামলাতে পারি না জানি না। এটা নিতান্তই আমার আবেগ না তো! নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে কেঁপে উঠলাম। হাজার প্রশ্নের সমাচার মনের ভেতর জাগছে। কোনো কিছুই প্রকাশ করতে পারছি না, শুধু ভেতরে প্রবল বর্ষণ বয়ে যাচ্ছে।

মিনিট দশেক দেখতে দেখতেই পার হয়ে গেল। নীল আর বাবার খাওয়া শেষ। বাবা, মায়ের পাশে বসে মায়ের কপালে কয়েকবার হাত বুলিয়ে নীলকে বলল

– রুনুর কী ঘুমটা ছাড়বে না? কখন থেকে ঘুমুচ্ছে।

মায়ের পুরো নাম রাহনুমা। বাবা মাকে আদর করে রুনু বলে ডাকে। বাবার মুখে মায়ের প্রতি যে ভালোবাসাটা দেখছতেছি সেটা যেন এতদিন চোখে পড়েও আমার চোখ এড়িয়ে গেছে। হয়তো এতদিন আমার চোখ ভালোবাসায় মগ্ন ছিল না যেটা নীলকে দেখে হয়েছে। নীল তার নম্র মোলায়েম গলায় জবাব দিল

– এটা স্বাভাবিক আংকেল। ১০-১৫ দিন পার হলে ঘুমের রেশ কেটে যাবে।

বাবার মলিন মুখটা এ কথা শুনে যেন একটু ভরসা পেল। আশ্বস্ত কন্ঠে জবাব দিল

– ঢাকায় চলে গেলে মাঝে মাঝে তোমার আন্টিকে দেখতে যেও।

– সে চিন্তা করতে হবে না। আমি সময় পেলেই আন্টির খুঁজ নিব।

– যাইহোক আটটার উপর বাজে। চলো বাসায় যাওয়া যাক।

নীল আর বাবা বাসায় যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে নিল। দুজনেই কেবিনের দরজা দিয়ে বের হচ্ছে। নীলের এ চলে যাওয়াতে কেন জানি না আমার বুকে করুন বীণার তাল বেজে উঠছে। মনে হচ্ছে সে আরেকটু থাকুক। সারাজীবন আমার হয়ে থাকুক। ওকে ছাড়া যেন নিজেকে ছন্নছাড়া আর অসহায় লাগছে। নীল আর বাবা যতক্ষণ না চোখের আড়াল হচ্ছিল ততক্ষণেই আমি খোলা দরজা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। শুনেছি চোখের আড়াল হলেই নাকি মনের আড়াল হয়। ব্যাখ্যাটা বেমালুম ভুল মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কারও চোখের আড়াল হলেও তার অনুপস্থিতি মনের গহীনে উপস্থিতির জানান দেয়। যেমন নীলের অনুপস্থিতে আমাকে আরও বেশি নীলের উপস্থিতি অনুভব করাচ্ছে। আমার অনুভূতির সমান্তরালে শুধু নীলের বিচরণ। রিদির ডাকে নীলের ঘোর থেকে বের হলাম। আমার দুবাহু ধরে রিদি তার দিকে ফিরাল। বেশ কড়া করেই বলল

– তুই যা করছিস সেটা মোটেও ঠিক হচ্ছে না সিঁথি। তোর এ আবেগ তোকে হ্যাংলা, বোহায়া বানিয়ে দিচ্ছে। নীল একটা ছেলে তার কাছে এসব ভালোই লাগবে। তবে প্রয়োজন শেষ হলে দেখবি তোকে ছুরেও ফেলে দিছে।

রিদির কথার মানে বুঝলেও আমি না বুঝার ভান ধরলাম। বেশ হেয়ালি করে জবাব দিলাম

– আরে কী বলছিস… আর কেন এমন বলছিস? কী এমন করেছি! এখানে হ্যাংলামোর কী আছে? আজিব…! নীলকে পছন্দ করি তার মানে এই না যা’ তা করব।

– তুই কী করেছিস সেটা তোর অজানা না। আশা করি আমার থেকেও ভালো জানিস। এসব আবেগ খুব খারাপ জিনিস। নীলকে ভালোবাসার চেয়ে তুই নীলের নেশায় ডুবে যাচ্ছিস। তোর বোধ শক্তি লুপ পাচ্ছে। তুই চিন্তা কর আমরা যদি দেখি কোনো মেয়ে কোনো ছেলের গায়ের উপর ইচ্ছাকৃত দুই দিনের পরিচয়ে হেলে পড়েছে তাকে কী বলব। তোর মনকে তুই প্রশ্ন কর। তারপর তুই যা করেছিস সেটা ভাব। সবমিলিয়ে যা হচ্ছে খুব খারাপ হচ্ছে। আর এগুস না এভাবে। আমি তোর থেকে স্টুডেন্ট খারাপ হলেও বয়সে বড় আর বুঝিও বেশি। তোর এ বয়সটা অনেক খারাপ। নিজেকে সামলা।

রিদির কথা শুনে থমকে গেলাম।৷ সত্যিই তো আমি যা করছি সেটা কী আদৌ ঠিক? কেনই বা ইচ্ছাকৃত কোনো কারণ ছাড়াই নীলের কাছে নিজেকে লুটিয়ে দিচ্ছি। আমি কেন তাকে দেখে সামলাতে পারি না। কেন তার জন্য বুক থৈ থৈ করে। সত্যিই কী এটা আমার নেশা নাকি ভালোবাসা? প্রশ্নবিদ্ধ হলো মনের মধ্যে। বুকটা কাঁপছে। বাঁ পাশটায় প্রচন্ড ব্যথার অনুভব হচ্ছে। নীলের থেকে নিজেকে কীভাবে দূরে সরাব জানি না। আমি কী সত্যিই পারব নীলের থেকে নিজেকে দূরে সরাতে? কেন নীলকে ছাড়া নিজেকে অস্তিত্বহীন মনে হচ্ছে। কেনই বা তাকে ছাড়তে পারছি না। কেনই বা তার অনুপস্থিতির কথা চিন্তা করলে আমি স্তবির হয়ে যাই। চোখ টলমল করছে। রিদি আমার দিকে তাকিয়ে এবার মোলায়েম কন্ঠে বলল

– জীবনের কিছু সময় বিবেক থেকে আবেগের বিস্তার বেশি লাভ করে। সেটা পার করতে পারলেই তুই সফল। ভেবে দেখিস। এসব আবেগে গা ভসিয়ে দিলে ভোগতে তোকেই হবে। তোর বড় বোন আমি তোর খারাপ চাইব না। নীল কেমন ছেলে আমাদের জানা নেই। তাকে কী তোর এতটা বিশ্বাস করা ঠিক হচ্ছে? নিজে নিজে ভেবে যা ভাল লাগে কর। বড় বোন হিসেবে এলার্ট করে দায়িত্ব পালন করলাম।

বলেই রিদি মায়ের পাশটাই গিয়ে বসল। আমার শরীরটা অসাড় লাগছে। বাস্তবমুখী হতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। কেবিনের দরজাটা লাগিয়ে দিলাম। চোখটা বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করতে লাগলাম। রিদি যা বলেছে সেটা মিথ্যা না। তবে আমি আমাকে সামলাতে পারব তো? কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। করুণ হয়ে যাচ্ছে জীবন। এ জীবনের সুর এত বদলায় ক্ষণে ক্ষণে আগে জানা ছিল না। মোবাইলটা বেজে উঠল। নীল মেসেজ করেছে

” বাসায় যাচ্ছি। গিয়ে কল দিব। আর কিছু মনে করেনি। তবে এ পাগলামো আর করো না। ঠোঁটটা এখনও ব্যথা করছে। কালকে কলিগদের সামনে যাব কী করে সে চিন্তায় আছি”।

নীলের মেসেজটা দেখে বারবার মন চাচ্ছিল একটা রিপ্লাই দিই। কিন্তু রিদির কথাগুলো মনে হয়ে হাতটা কেঁপে উঠল। পারলাম না উত্তরটা দিতে। চুপ হয়ে মোবাইলটা পাশে রেখে দিলাম। বুকের ভেতরট চিড়ে যাচ্ছে। কষ্টে যেন কলিজাটা দুভাগ হয়ে যাচ্ছে। নীলকে ছাড়া নিজেকে কল্পনা করতে আমি পারছি না। চোখ বেয়ে জল টুপ টুপ করে গাল বেয়ে মেঝেতে পড়ছে।

ঘন্টা খানেক পার হলো। মোবাইলটা বেজে উঠল। নীল কল করেছে। ধরতে মন সায় দিচ্ছে না। কলটা কেটে দিলাম। সাথে সাথে মেসেজ আসলো

“কোনো সমস্যা”

উত্তর দিলাম না। মোবাইলটা বন্ধ করো শুয়ে পড়লাম। কিছুতেই ঘুম আসছে না। চোখটা বন্ধ করে ঘুমানোর জন্য যুদ্ধ করছিলাম। যখন চোখটা লেগে গেল তখন হালকা চেঁচামেচির আওয়াজে চোখটা খুললাম। অনেকটা হন্ত দন্ত করেই শুয়া থেকে উঠে বসলাম। বুঝতে পারছিলাম না কী হয়েছে? বুকটা কাঁপছে থরেথরে।

(কপি করা নিষেধ)
(কপি করা নিষেধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here