ডাক্তার সাহেব পর্ব ৩১

#ডাক্তার সাহেব
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৩১

মিহু আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল

– সিঁথি অসুস্থ হওয়ার সাথে সাথে কী তোর মাথাটাও বিগড়ে গেছে? মানে সুইসাইডাল স্টেপ নিলে কী মানুষের পাগল হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে?

আমি রাগে কপাঁলটা কুঁচকে ঠোঁট দুটোকে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে পরক্ষণেই তা ছেড়ে দিয়ে বললাম

– তোর কী আমাকে পাগল মনে হচ্ছে? এমনিতেই পাগলের দৌড়ানি খেয়ে এসেছি মেজাজ অনেক গরম। এখন আবার মেজাজ গরম করবি না।

মিহু আমার মথায় ধাক্কা দিয়ে উত্তর দিল

– একা একা এখানে কার সাথে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছিলি? এখন যতদোষ সব আমার। এভাবে তো পাগলে কথা বলে। যেভাবে কথা বলতেছিলি মনে হচ্ছিল সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। আমি তো দূর থেকে লক্ষ্য করে অবাক হয়ে গিয়েছি তুই এমন করছিস কেন।

মিহুর কথাটা শুনে আমি চুপ হয়ে গেলাম। তাহলে একটু আগে আমার সাথে কে কথা বলেছে। মনে হচ্ছে সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত রোগী আমি। কল্পনায় কিছু একটা কল্পনা করছি যেটা বাস্তব রূপ ধারণ করছে। নীল বলেছিল কল্পনা শক্তি প্রখর হলে মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়। তখন বাস্তব আর কল্পনার পার্থক্য বুঝতে পারে না৷ কল্পনায় ঘটে যাওয়া সবকিছুই তার কাছে মনে হয় বাস্তবে ঘটছে। কিন্তু আমি তো নীলকে নিয়ে এমন চিন্তা করি না তাহলে এমন কেন হলো? যতই ভাবছি ততই যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। নিতান্তই আমার কল্পনা ভেবে উড়িয়ে দিতে পারছি না। আবার বাস্তবও বলতে পারছি না। ধুর ছাই কী নিয়ে পড়লাম!জিন, ভূত,কল্পনা যাই হয়… হোক নিজেকে এত চিন্তার মধ্যে রাখতে পারব না। মিহুর দিকে তাকিয়ে বললাম

– বাদ দে সেসব কথা। যা হবার হয়েছে। এত ব্যখ্যা দিতে পারব না৷ তা ক্লাসে যাবি না?

– হুম যাব তো। কলেজে তো তোর ব্যপারটা বেশ ভালো করে রটে গিয়েছে।

– কোনটা?

– তুই যে হাত কেটে মরতে চেয়েছিলি।

– ভালো হয়েছে রটেছে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলব তাকেও কেটে দেখতে কেমন লাগে। মানুষের কথায় পাত্তা দেওয়ার সময় আছে নাকি।

– মাঝে মাঝে মানুষের কথাও পাত্তা দিতে হয়। সমাজ নিয়েই আমাদের বাস। সমাজ কী বলে সেদিক ও বিবেচনা করতে হবে। এই যে তোকে নিয়ে মানুষ কত অভিযোগ করে, দোষ দেয় আদৌ কী তুই ঐরকম? মোটেও না। কিন্তু তুই কথা বেশি বলিস আর একটু উড়নচণ্ডী হয়ে চলিস তাই তোকে নিয়ে মানুষ যা পারে বলতে থাকে। এই যে পিংকি কম করে হলেও ৫,৬ টা প্রেম করেছে। তবুও তাকে সবাই কত ভদ্র, কত ভালো বলে। শুধুমাত্র মিনমিনা স্বভাবের জন্য। তাই বলি কী মাঝে মাঝে মানুষের কথাও গায়ে মাখিস। দোষ না করেও দোষের দায় কেন নিবি? মানুষ কে তো পাল্টাতে পারবি না নিজে পাল্টে যা।

আমি বিরক্তবোধ করছিলাম মিহুর কথায়। বিরক্তবোধ নিয়েই উত্তর দিলাম

– একদম পাশের বাসার ভাবীর মতো শুরু করে দিয়েছিস। চল ক্লাসে।

সেদিন কলেজ যাওয়ার পর বুঝেছিলাম জীবনের নতুন কিছু। নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম। আমাকে দেখে সবাই যেন চোখ টিপে হাসছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে আমি মরে না গিয়ে মহা বড় ভুল করে ফেলেছি। জীবনের অধ্যায় গুলো সত্যিই বাহারি ছকে লিপিবদ্ধ। সেখানে কখনও হাসি কখনও কান্না আবার কখনও তিক্ত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। হ্যাঁ আত্মহত্যার পদক্ষেপ টা আমার ভুল ছিল তবে এটা নিয়ে মজা তামাশাটা আমাকে আরও বেশি আশাহত করছে। হয়তো এখন আমি আত্মহত্যা করব না কারণ আমার বাকিসব পরিস্থিতি শীতল। আমার পরিবার, নীল আমার পাশে। কিন্তু যে মানুষটার এমন পদক্ষেপ নেওয়ার পরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় না কিন্তু বেঁচে যায়, সে মানুষটার পরের বার আবার আত্মহত্যা করার প্রবণতা বাড়াবে আশেপাশের মানুষের রঙ বাহারি কথার বুলিতে।

যাইহোক সেসব কথায় তেমন পাত্তা দিলাম না। যতটা পারলাম গা বাঁচিয়ে নেওয়ার মতো ছিলাম। বেলা বাজে দুটো। ক্লাস শেষ। ঘন্টার টুংটাং আওয়াজ আসলো কানে। সবাই এলোপাতারি হয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে আসলো। কলেজে আমার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী মিহু। বাকিরা আমাকে না বুঝলেও সে আমাকে বুঝে, সঠিক পরামর্শ দেয়, সবসময় আমার পাশে থাকার চেষ্টা করে। বাকিরা আজকে অনেক হাবিজাবি কথা বললেও মিহু আমাকে সে সময়টায় সান্ত্বনা দিয়েছে। ক্লাসের মধ্যে এখন আমি আর মিহুই উপস্থিত রয়েছি। মিহু আমার পাশে এসে বলল

– বাসায় যাবি না? এভাবে বসে আছিস কেন?

– এমনি। চল বাসায় যাওয়া যাক।

– নীল ভাইয়ার চেম্বারে যাব ভাবছিলাম।

– কেন?

– রাতে ঘুম হয় না। শুন তুই নীল ভাইয়াকে বলবি তোর রাতে ঘুম হয় না তারপর ট্যাবলেট যেটা দিবে সেটা আমি কিনে খেয়ে নিব। আমার কথা বলবি না কিন্তু।

আড়চোখে মিহুর দিকে তাকালাম যে মেয়ে ক্লাসেও ঝিমায় তার নাকি ঘুম হয়না। তবে সময়ের সাথে সাথে অভ্যাস বদল হতেই পরে তাই তাকে তেমন কিছু না বলে সরাসরি চলে গেলাম নীলের চেম্বারে।

রোগীতে চারপাশ গিজগিজ করছে। এত রোগীর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতেও বেশ কষ্ট হচ্ছে। নীলের চেম্বারে একটার পর একটা রোগী বের হচ্ছে, যাচ্ছে। কোনো সুযোগ পাচ্ছি না যে ঢুকব। অপেক্ষার আর তর সইল না। নীলকে কল দিয়ে বললাম আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি সে যেন রোগী দেখা কমায় তাহলে চেম্বারে ঢুকতে পারব। নীল জানালো ২০-২৫ মিনিট অপেক্ষা করতে এর মধ্যে সব রেগী দেখা শেষ করবে।

বেশ বিরক্ত নিয়েই আমি আর মিহু অপেক্ষা করছি বাইরে৷ টানা ৪০ মিনিট পর একজন ভদ্রলোক এসে বলল

– মেডাম স্যার চেম্বারে যেতে বলেছে।

লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম রহস্যময় হাসি দিচ্ছি। এ রহস্যময় হাসির কারণটা ব্যাখ্যা করতে পারলাম না। ব্যাখ্যা করার বৃথা চেষ্টাও করলাম না। সরাসরি নীলের চেম্বারে ঢুকে গেলাম। দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে বললাম

– আমার রাতে একদম ঘুম হয় না আমাকে ঘুমের ঔষধ দাও তো। সারা রাত আমি ছটফট করি।

নীল আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলল

– আবার কী সুইসাইডের পরিকল্পনা করেছো নাকি? হুট করে ঘুমের ট্যাবলেট চাচ্ছ?

পাশ থেকে মিহু আগ্রহ নিয়ে বলল

– আরে ভাইয়া ঘুম না হওয়াটা তো স্বাভাবিক। লিখে দিন না কোনো ঘুমের ঔষধ।

নীল হালকা হেসে বলল

– ঔষধ কার লাগবে? তোমার নাকি সিঁথির?

মিহু কিছু বলার আগেই আমি দ্রূত গলায় উৎসাহ নিয়ে বললাম

– আমার লাগবে। দিতে বলছি দাও।

নীল আবারও হাসলো হেসে বলল

– কষ্ট করে তোমাকে কিনতে হবে না আমি গিয়ে নিয়ে আসতেছি।

বলেই নীল চেম্বার থেকে বের হলো। চেম্বার টা ক্লিনিকের দো ‘তলায়। সাধারণত ২ টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত এখানে রোগী দেখে। চেম্বারের নীচ তলাতেই ফার্মেসী রয়েছে। মূলত সেখান থেকেই নীল ঔষধ আনতে গিয়েছে।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। মিনেট পাঁচেকের মধ্যেই একটা ঔষধের বড় প্যাকেট আমার হাতে দিয়ে বলল

– এখান থেকে প্রতিদিন একটা করে খাবে তাহলে ঘুম ঠিক হবে।

আমি বেশ খুশি হয়েই ঔষধটা হাতে নিলাম। এর মধ্যেই ঐ ভদ্রলোক বাইরে থেকে আওয়াজ দিয়ে বললেন নতুন রোগী এসেছে। নীল আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত গলায় বলল

– এবার চলে যাও। রোগীর চাপ বেশি। রাতে কথা হবে।

কথা না বাড়িয়ে মিহু আর আমি সেখান থেকে প্রস্থান নিলাম। মিহুর হাতে ঘুমের ট্যাবলেটগুলো দিয়ে আমি বাসায় চলে আসলাম। দিন পেরিয়ে রাত নেমে আসলো। খুব বেশি না রাত আটটা বাজে। আমার মাথা থেকে এখনও সুনীলের ভূতটা নামছে না। যতই এড়িয়ে যেতে চাচ্ছি ততই যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় দরজায় খটখট আওয়াজ পেলাম৷ দরজা খুলতেই লক্ষ্য করলাম নীল। আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম

– তুমি আসবে আগে বললে না তো?

অপর পাশ থেকে কাঁপাল কুঁচকে জবাব আসলো

– এই যে মিস…. জরিনা… আমি নীল না সুনীল। অনীল আপনাকে এটা পাঠিয়েছে।

বলেই কী যেন হাতে ধরিয়ে দিল। আমি বস্তুটা হাতে নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাব এর আগেই উনি হনহন করে চলে গেলেন। হাতে লক্ষ্য করে দেখলাম একটা খাম। ভাবতে লাগলাম এটা সিজোফ্রেনিয়া রোগ হলে এ খামটা তো মিথ্যা না। কাগজের খামে কী যেন আছে। খামটা ছিড়তে এক জোরা রূপার নুপুর চক্ষুগোচর হলো। তার মানে নীল আমার সাথে মজা করেছে! সুনীল নীলের জমজ ভাই এই। আমি নীলকে কল দিলাম দুবার। সে রিসিভ করল না। তৃতীয়বারের মাথায় কলটা ধরে বলল

– আমি এক রোগীর বাড়িতে রোগী দেখতে এসেছি পরে কথা হবে।

আমি ফোনটা রাখার আগেই বলে উঠলাম

– তোমার ভাই সুনীল এসেছিল তুমি তার কাছে নুপুর দিয়ে পাঠিয়েছো তা নিয়ে।

নীলের উত্তর শুনে পুনরায় অবাক হলাম। এবার তার কথায় স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে সে যা বলছে সেটা সত্যি। নীল কিছুটা বিরক্ত গলায় বলল

– ফাজলামো করো না। আমি কখন কী পাঠালাম? আর এ সুনীলটা কে? সকাল থেকে এ নাম নিয়ে কী হাবিজাবি বলছো। ভীষণ ব্যস্ত। পরে কথা হবে। রোগীর অবস্থা ভালো না। রাতে কথা না ও হতে পারে।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। কলটা কেটে হাতে থাকা নুপুর গুলো দেখছিলাম আর সেই সুনীলের কথা চিন্তা করছিলাম। নীলের জমজ ভাই না হলে সে কে? মাথা যেন ঘুরপাক খাচ্ছে। সারা রাতেই আমি নুপুর আর সুনীলের চিন্তায় মগ্ন হয়ে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছি মনে নেই।

সকালটা শুরু হলো এক অপ্রিতীকর কাহিনির সূচনা দিয়ে।

চলবে?

(কপি করা নিষেধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here