ডাক্তার সাহেব পর্ব ৩৪+৩৫

#ডাক্তার সাহেব
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৩৪

পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম মিহু। কানের কাছে এমন জোরে চিৎকার করেছে যে ভয় না পেয়ে উপায় ছিল না। মিহুর এ কাজটায় কিছুটা বিরক্ত হয়ে চোখ গুলো খানিকটা উপরে তুলে বললাম

– খেয়ে ধেয়ে কাজ নেই তোর?এভাবে কেউ চিৎকার দেয় নাকি। হার্ট এটাক হলে কী হত?

মিহু হালকা হাসলো। মিহুর চেহারাটা বেশ মিষ্টি, হাসি দিলে তার গালে টুল পড়ে। টুল পড়াটা স্থায়ী রেখে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল

– ডাক্তার সাহেব আছে কী করতে? কিন্তু এখনও তুই এভাবে হা করে দাঁড়িয়ে কী ভাবছিস? ২ টা বাজতে চলল তোর মা তো সেই কখন থেকে তোর খামখেয়ালিপনা নিয়ে বকবক করছে৷ তুই এত দেরি কেন করছিস? তৈরী হবি না? এক ঘন্টা পরেই তো উনারা চলে আসবেন।

মিহুর কথায় আমার টনক নড়ল। জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললাম

– কথা তো ভুল বলিসনি। ঐদিকে যা শাড়ি পড়তে হবে।

– কোনটা পরবি?

– দেখি মাকে জিজ্ঞেস করে।

বলেই মায়ের কাছে যেতে নিচ্ছিলাম, মিহু আটকে দিয়ে খাটের উপরে রাখা একটা প্যাকেট দেখিয়ে বলল

– তোমার নাগর তোমার জন্য শাড়ি পাঠিয়েছে আর মায়ের কাছে যেতে হবে না।

শাড়ির প্যাকেটটা খাটের উপর দেখে খুশিতে আমার মন নেচে উঠল। দ্রূত শাড়ির প্যাকেটটা হাতে নিলাম। প্যাকেটটা খুলে দেখলাম লাল জামদানি শাড়ি। পুরো শাড়িতে হালকা সৌখিন কাজের বুনন। নীলকে কোনো একদিন কথায় কথায় বলেছিলাম আমার বিয়েতে আমি জামদানি শাড়ি পরব। নীল কথাটা মনে রেখেছে। আমরা মেয়েরা সত্যিই অদ্ভুত । ছোট ছোট বিষয়গুলো দিয়ে আমাদেরকে খুব সহজেই অনেক বেশি খুশি করা যায়। একটু মায়া ভালোবাসার কাছে তখন ভরি ভরি টাকা অনেকটায় মূল্যহীন হয়ে যায়। মেয়েদের একটা স্বভাবগত ধর্মই হলো অল্প মায়াতে, অল্প যত্নে গলে যাওয়া।

খুব বেশি দেরি করলাম না শাড়িটা হাতে নিয়ে ঝটপট পরে ফেললাম। নীলের কথা মতো মোটা করে কাজল দিলাম চোখে , ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিপ। মনে হচ্ছে না এটা ঠোঁট , মনে হচ্ছে ঠোঁট দুটো রক্তজবা ফুল। নিজের প্রশংসা নিজেই করে ফেলতেছি। বিয়ের সময় মেয়েদের রূপে আলাদা সৌন্দর্য ফুটে উঠে। তখন হয়তো মেয়েদের রূপ লাবণ্য না চাইতেও বেড়ে যায়। আয়নায় নিজেকে দেখে মুচকি মুচকি হাসছিলাম আর নীলকে কল্পনা করছিলাম। এমন সময় মনে পড়ল নীল তো বলেছিল কপালে টিপ দিতে কিন্তু আমার তো টিপ নেই। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না৷ অনেকক্ষণ ভেবে লাল লিপস্টিক দিয়েই কপালে গোল করে টিপ এঁকে নিলাম। এর মধ্যেই মিহু কানের কাছে এসে আস্তে করে বলল

– নীল ভাইয়া চলে এসেছে। একটু পরেই তোদের দুজনের আশা পূরণ হবে। শোন তোর বিয়ে হলে নীলের সাথে নীলের ভূতটাকে আমার সাথে সেটিং করিয়ে দিবি বুঝছিস।

আমার বুকটায় হালকা কম্পন দিল নীল এসেছে শুনে। হার্টবিট কেন জানি আজকে অযথায় উঠানামা করছে বেশি। নিজেকে সামলাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। সবকিছুই স্বপ্ন লাগছে। মনে হচ্ছে কোনো স্বপ্নের জোয়ারে আমি ভাসছি। এর মধ্যেই বাইরে থেকে নানু হালকা ডেকে বলল

– সিঁথি বের হ তাড়াতাড়ি । নাগরের সামনে যাবি না? একদম কথা বলবি না বেশি। কাজী বিয়ে পড়ানোর সময় আবার আবেগে হেসে দিস না। সুন্দর করে তাদের সামনে যাবি। সবাইকে সালাম দিবি। ভদ্র মেয়ের মতো থাকবি।

নানুর ডাকে আর তর সইল না সোজা উঠে বের হতে লাগলাম। মনে হচ্ছিল যত তাড়াতাড়ি বিয়ে হবে ততই তাড়াতাড়ি নীল আমার হয়ে যাবে। এখন একটু দেরি করা মানে বিয়েটা অনেকটা পিছিয়ে যাওয়া। আমার অস্থিরতা আর তাড়াহুড়ো দেখে মিহু আমার হাতটা ধরে চিমটি কেটে বলল

– সিঁথি সাবধানে যা। শাড়ির কুচিতে লেগে পড়ে যাবি নাহয়। আর এত অস্থিরতা ভালো না একটু স্থির হ। আর শোন পাশে তোর দেবরটা কিন্তু আমার।

মিহুর কথা শোনার পর মনে হলো আমি একটু বেশিই ছটফট করছি। মনে হচ্ছিল আমার মনে শিলাবৃষ্টি হচ্ছে। শিলা গুলো আমার অন্তরের দেয়ালে লেগে কম্পন তুলছে। আর সে কম্পনের গতিবেগে আমার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে ক্রমেই। নিজেকে একটু সামলে নিলাম। মিহু ঘরেই বসে রইল। আমি নিজেকে স্থির করে আস্তে করে তাদের সামনে গেলাম। নীলের বাবা,মা,তিন বোন আর নীল আর সুনীল আরও তিনজন অচেনা মানুষ বসে আছে। নীলের মা আজ আমায় সামানাসামনি প্রথম দেখেছেন। এর আগে ফোনে কথা হলেও সামনাসামনি দেখা হয়নি। চোখ পড়ল সুনীলের দিকে। তাকাতেই কেমন জানি মুচকি মুচকি হাসছে। দুজনই আজকে একই রকম পাঞ্জাবি পরে এসেছে। কে নীল কে সুনীল বুঝা ভীষণ কঠিন। তবে আমার চোখ ফাঁকি দেওয়া এত সহজ ব্যপার না। সুনীলের কানে একটা তিল আছে যেটা নীলের নেই।

আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম সবাইকে সালাম দিয়ে। নীলের মা উনার পাশে জায়গা করে দিয়ে বললেন

– মা আমার পাশে বসো। তোমাকে ভারি মিষ্টি লাগছে। চোখগুলো মাশআল্লাহ। ছবির চেয়েও তুমি হাজার গুণ সুন্দরী। চিন্তায় ছিলাম আমার এ কালো ছেলেটার একটা সুন্দর বউ পাব কিনা। তবে আজকে বুঝলাম আমার বউমা শুধু সুন্দর না বরং অনেক সুন্দর। পরীর মতো একদম। অনি এতদিনে একটা কাজের কাজ করেছে। আসো মা পাশে এসে বসো।

নীলের মায়ের কথা গুলো শুনে আমার মনটা জুড়িয়ে গেল। আমি আস্তে পায়ে উনার পাশে বসলাম। পাশ থেকে তামান্না মুচকি হেসে বলল

– ভাবী বলেন তো অনি ভাইয়া কোনটা?

আমি হালকা হেসে বললাম

– তোমার ডান পাশের প্রথম টা তোমার অনি ভাইয়া।আমার চিনতে মোটেও ভুল হয়নি।

নীলের বাবা হালকা হেসে বলল

– আমিই তো আমার ছেলেদের গুলিয়ে ফেলি তুমি তো মা ভালোই আলাদা করতে পেরেছো৷

আমি মুচকি হাসলাম। তবে বিপত্তি একটাই আমি অনীলকে নীল বলে ডাকি আর তাদের বাসায় সুনীলকে নীল বলে ডাকে আর অনীলকে অনি বলে ডাকে। দেখা যাবে আমি অনীলকে নীল সম্বোধন করে কিছু বলব আর সবাই ভেবে নিবে সুনীলকে বলছি। এটা যে ওদের বাসায় যাওয়ার পর মহা মসিবতের কারণ হয়ে দাঁড়াবে এখন বুঝতে পারছি।

তামান্নার পাশেই বসে আছে রুবা আর রুনা আপু। নীলের বড় দুবোন৷ যারা দুজনেই বিবাহিত এবং ঢাকায় স্যাটেল। মজার ব্যপার হলো তাদের দুজনের বিয়ে হয়েছে আপন দুই ভাইয়ের কাছে। ভাইয়ারা ব্যবসায়ী কাজে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ায় আজকে আসতে পারেনি। এর পাশেই দুজন পুরুষ এবং একজন বেশ রূপবতী মধ্যবয়স্ক মহিলা বসে আছেন। তাদের সম্পর্কে এতটা আমার জানা নেই।

এবার নীলের দিকে তাকালাম। নীল ও আমার দিকে তাকাল। নেশায় মিশ্রিত এ চোখগুলো আমাকে আরও কাছে টানছে। কোনো বাঁধায় যেন মানছে না । মন চাচ্ছে এ নেশায় এখনই ডুব দিয়ে তলিয়ে যাই৷ আফিমের নেশার থেকে বড্ড বেশি নেশা ধরে এ চোখের নেশা। যদিও কখনও আফিম খাইনি বা চোখেও দেখিনি তবে তুলনা করার জন্য এটা ছাড়া সুন্দর উপমা আর পেলাম না। এর মধ্যে হবু শ্বশুড় বাবার কথা কানে আসলো। তিনি আমার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন

– শফিও কাজী ডাকো। আগে শুভকাজ সাড়ব তারপর মিষ্টি মুখ করব, খাওয়া দাওয়া করব৷

কথাটা বলেই উপস্থিত সবার সম্মতি জানতে চাইলেন। উপস্থিত সবাই উনার কথায় সম্মতি দিলেন। আমি মাথা নীচু করে নীচের দিকে তাকিয়ে আছি। লজ্জাবতী লতা লাগছে একদম। মনে হচ্ছে এখনই নীলের স্পর্শে নুইয়ে থুবরে পড়ব। কাজীর কথা শুনে যেন বুক আরও ধুকধুক করছে৷ এ আবেগ এ অনুভূতির প্রকাশ করার সঠিন উপমা আমার জানা নেই। জানা নেই কীভাবে তার প্রকাশ করে অনুভূতিকে উপভোগ করতে হয়।

বেলা বাজে চারটে। উপরে ফ্যানটা জোরগতিতে চলছে তবুও আমি ঘামছি। গরমে না বরং ভলোবাসায় উষ্ণ আবেশে। কাজী বসে আছে। বিয়ের সকল ব্যাপারগুলো সুন্দর করে সাজানো হলো। রেজিষ্ট্রেশন এখন করা যাবে না কারণ আমার বিয়ের বয়স কম শুধু কাবিন নামা তৈরী করেছে আর বিয়ের কালিমা পড়ানো হবে।

বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। আমার কানে কাজীর কথা ভেসে আসলো

– বলো মা কবুল।

আমি বুঝতে পারছিলাম না আমি কী করব? এখন কবুল বলব নাকি অপেক্ষা করে বলব। জোরে বলব নাকি আস্তে বলব। কেমন জানি ছটফট লাগছে। অস্থির লাগছে। কিছুটা স্তবির হয়ে গেলাম। পুনরায় কাজী বললেন

– বলো মা কবুল?

আমি শুধু চুপ হয়ে গেলাম। পাশ থেকে দুটো অচেনা কন্ঠ স্বর ভেসে আসলো যতদূর জানতে পারলাম উনি নীলের মামা, মামি এবং আমাদের উকিল বাবা, মা হয়েছে। উনারা দুজনই নম্র গলায় বললেন

– কী ব্যাপার সিঁথি আমার ছেলের জন্য এত পাগলামি করে কবুল বলছো না যে?

উনাদের কথায় বুঝতে পারলাম আমাকে কবুল বলতে হবে। আমি নিজেকে সামলে চোখটা বন্ধ করে বললাম

– কবুল,কবুল,কবুল।

আরও বলতে যাব নানু থামিয়ে দিয়ে বলল

– বু রে একবার বললেই হয় তুই এতবার বলতেছিস কেন? তিনবার হয়ে গেছে আর বলিস না। এত ভালোবাসা আমার নাতনি জামাই সহ্য করতে পারবে না।

নানুর কথায় যেন সে সমাবেশে হাসির হিরিক পড়ল। হাসির হিরিক বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। এবার নীলের কবুল বলার পালা। নীলকে বলার সাথে সাথেই কবুল শব্দটা কানে আসলো।

অদ্ভুত শীতলতার বাতাস যেন শরীরে এসে দোলা দিল। এত শীতল কেন লাগছে! আমার নীল আমার হয়ে গেল! ভাবতেই যেন বুকটায় অস্পষ্ট অনুভূতি গুলোও বেশ স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মনের অজান্তেই আমার হাসিটা মুখে প্রস্ফুটিত হলো। সবাই এক সাথে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠল। মনে হচ্ছিল জীবনের সকল বাঁধা অতিক্রম করে আমি আমার নীলকে পেয়ে ফেলেছি। এখন আমার জীবনে কোনো বাঁধা নেই, নেই কোনো আশঙ্কা,নেই কোনো ভয়। ভালোবাসার পূর্ণতা আমি পেয়ে ফেলেছি। এ ভালোবাসা আমি কখনও হারাব না। কখনও এ ভালোবাসা আমার থেকে দূরে যাবে না।। তবে আমার এ ভাবনাটা তাৎক্ষণিক মলিন হয়ে গেল আকস্মিক এক ঘটনায়।
#ডাক্তার সাহেব
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৩৫

দরজায় খটখট আওয়াজ করছে কারা যেন! দরজাটা খুলতেই কয়েকজন পুলিশের আগমন ঘটল। তাদেরকে কারা যেন জানিয়েছে এখানে বাল্য বিবাহ হচ্ছে। বিষয়টা এত দূর জানাজানি কী করে হলো কারও বোধগম্য হচ্ছে না। বাবা কিছুটা ভয়ার্ত। নীলের বাবার মুখটাও শুকিয়ে আছে। নীল ও হতভম্ব। এ বিষয়টা নিয়ে চাকুরিটা চলে গেলে শুধু বিপদ না মহা বিপদ হবে। নীলের স্বপ্ন সব ধুলিসাৎ হয়ে যাবে সে সাথে হতাশাও তাকে গ্রাস করবে। আর প্রত্যক্ষ্য হোক বা পরোক্ষ হোক এটার দায় এড়ানো যাবে না। দায় টা আমার উপরেই পড়বে। তাই আমারও গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল খাঁ খাঁ মরভূমির মতো।

আমার শ্বশুর বাবা পুলিশকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলেন যে দুই পরিবার এবং পাত্র পাত্রীর সম্মতিতেই বিয়েটা হচ্ছে। নাছোরবান্দা পুলিশগুলো কেন জানি সেটা মানতে পারছেন না। তাদের ধারণা আমি ছোট বাচ্চা আমাকে জোর করে যোগ্য একটা পোলার সাথে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যার পুরো দায় আমার আর নীলের পরিবারের। আর নীলের উপরও সিভিল সার্জন অফিসে অভিযোগ আনবে বলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। নীলের মুখ অবয়বে ভয়ের ছাপটা ফুটে উঠেছে। যতই হোক চাকুরিটা তার একটা স্বপ্ন। এ চাকুরির জন্য তাকে সাধনা করতে হয়েছে অনেক। এটা চলে গেলে তার অবস্থা করুণ হবে সেটা আমি একটু হলেও উপলব্ধি করতে পারছি এখন। আল্লাহ আল্লাহ করছিলাম সবকিছু যেন ঠিক হয়।

দুই পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। আমার শ্বশুর বাবা আর বাবা বিষয়টা সামাল দিতে বেশ হিমিশিম খাচ্ছে। তবে এ বিষয়ে ফেরেশতার মতো আগমন করলেন আমার মামা শ্বশুড়। তেমন কিছু না পুলিশকে চুপ থাকার জন্য চুক্তি করতে বললেন। পুলিশের হুংকারও ক্রমশেই মলিন হয়ে গেল। এক লাখ টাকা দাবি করা হলো। অগত্যা এক লাখ টাকা পরিশোধ করে ব্যাপারটা মিটানো হলো।

আমাদের দেশটা একটু বেশিই আপডেট হয়ে গিয়েছে। এখানে ছেলে মেয়েদে বিয়ের আগে প্রেমে সমস্যা নেই তবে বিয়তে সমস্যা। যাইহোক এসব ঝামেলা মিটতে মিটতে সময় লেগেছে ঢের। সন্ধ্যা নেমে আসলো চারপাশে। মসজিদের ইমাম সাহেব মাগরিবের আযান দিচ্ছেন। ছেলেরা সবাই মসজিদে যাওয়ার জন্য তৈরী হলো। মেয়েরাও ঘরে নামাজ পড়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগল। আমি উঠে আমার রুমে গেলাম। অযু করলাম। মিহু আর আমি পাশাপাশি বসেই নামাজ আদায় করলাম। নামাজটা শেষ করতেই মিহু আমার হাতটা চেপে ধরে বলল

– সুনীল কিন্তু আমার। ওকে একটু আমার কথাটা বলিস। বিয়েই যেহেতু করতে হবে আগে করলেই ভালো। তোর মতো হয়ে গেলে আরও ভালো। দুই বান্ধবী একসাথে থাকব আমাদের ছেলে মেয়ের বিয়ে দিব কত মজাই না হবে।

আমি মুচকি হেসে বললাম

– নিজের গতি নিজে কর আমাকে বলে লাভ নাই। তুই গিয়ে বল। আর না হয় নীলের দেওয়া গর্ভনিরোধক ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমিয়ে যা।

মিহুর চাপা রাগটা আবারও প্রকাশ পেল। রাগে কপালটা কুঁচকে বলল

– ফাজলামু করবি না। নীল ভাইয়া কাজটা মোটেও ভালো করেনি। নীল ভাইয়ার জন্য এখনও আমি মায়ের কথা শুনি। মা তো আসার সময় বলতেছিলই সিঁথির কী ঐ বজ্জাত পোলার সাথে বিয়ে হচ্ছে!

আমি দুই কোমরে দুই হাত দিয়ে বললাম

– আমার বরকে বজ্জাত বললে কিন্তু ঠিক হবে না। মুখ সামলে কথা বল।

ইশ! এ বর বলার মধ্যে কত তৃপ্তি কত আনন্দই না পাচ্ছিলাম। মনটায় বেশ প্রফুল্ল লাগছে। মিহু কিছুক্ষণ হেসে বলল

– বজ্জাত কে বজ্জাত বলব না তো কী বলব হ্যাঁ?

এর মধ্যেই কাশির শব্দ আসলো। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলাম সুনীল দাঁড়িয়ে আছে। আমি সুনীলকে চিনতে পারলেও মিহু পারেনি। সে তার সামনে গিয়ে বেশ অভিমানী গলায় বলল

– ভাইয়া ঐদিন কাজটা ঠিক করেননি। একদম বাজে কাজ করেছেন। এভাবে কেউ কাউকে গর্ভনিরোধক পিল দেয় নাকি। আমি না বুঝে কতগুলো খেলাম। ভাগ্যিস বেঁচে গেছি আমি। মা আমাকে কতগুলো মাইর দিলো জানেন। এখনও পিঠটা ব্যথা করে সেদিনের মাইরগুলোর কথা মনে করলে।

সুনীল মুচকি হাসতে হাসতে বলল

– মিহুমতি কার সাথে কী আকাম করেছেন যে আমার ভাই আপনাকে এ ট্যাবলেট দিল। অহেতুক তো একজন ডাক্তার হাবিজাবি ট্যাবলেট দিবে না। নিশ্চয় কিছু করেছেন। এখন যতদোষ আমার ভাইয়ের তাই না!

মিহু তো পুরোই স্তবির হয়ে গেল। যার সাথে সেটিং করতে চাচ্ছিল তার সামনেই নিজের ইজ্জত এভাবে ফালুদা বানাবে হয়তো আন্দাজ করতে পারেনি।জিহ্বায় কামড় দিয়ে পাশের রুমে ছুট লাগাল। সুনীল এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল

– মিস জরিনা ভাবী সবাই খাবার খাওয়ার জন্য ডাকছে। ভাইয়াও অপেক্ষা করছে। আর আপনার বান্ধবীরও কী আপনার মতো তার কয়েকটা ছেঁড়া আছে।

বলেই চলে যেতে নিল। আমি পিছু ডেকে বললাম

– শুনেন আমি জরিনা না সিঁথি। আমাকে সিঁথি ভাবী বলবেন। আর আমাকে তার ছেঁড়া বলছেন কোন সাহসে। আমি যতই হোক আপনার ভাবী। মিহুকে বলেন সমস্যা নেই আমাকে এমন বলবেন না।

– আচ্ছা জরিনা ভাবী। বলব না।

আমি রাগী চোখে তাকালাম তিনি আর এক দন্ডও দাঁড়ালেন না দ্রূত পায়ে চলে গেলেন।

দুপুরের খাওয়ার পর্ব শেষ হলো সন্ধ্যা সাতটায়। ভীষণ ক্ষুধাও পেয়েছিল তবে এত মানুষের সামনে খেতে পারলাম না। মুরব্বিরা খাওয়ার পর বিদায় নিল। নীল,সুনীল আর মিহু রয়ে গেল বাসায়। বাকিরা সবার গন্তব্যে চলে গেল।

রাত বাজে এগারোটা। মফস্বলে রাত এগারোটা মানে অনেক রাত। চারদিক নিস্তব্ধ। ছাদে সুনীল আর মিহু আছে৷ জানি না তাদের কিছু হচ্ছে কি না। দুজনকেই দুজনের ব্যাপারে বেশ আগ্রহ প্রকাশ করতে খেয়াল করলাম। কবুল বলার পরপরই যেন আমার অস্থির ভাবটা চলে গেছে। মনে হচ্ছে আমি বেশ শান্ত শিষ্ট একটা মেয়ে। একটা কবুল যেন আমাকে একদম শান্ত করে দিল।

আকাশে প্রশস্ত চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় ঘরটা বেশ আলোকিত। জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছি আমি। একদম চুপ হয়ে। নীল আমার পাশে দাঁড়াল। হাত দুটো তার হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল

– কী দেখছো।
– চাঁদটা। আচ্ছা চাঁদ বেশি সুন্দর নাকি আমি?
-চাঁদটা তোমার মতো সুন্দর। আর তুমিও চাঁদের মতো সুন্দর। কারও তুলনা কারও সাথে হবে না।
– তুমি দেখা যাচ্ছে চাঁদের মন রক্ষাও করলে সাথে আমারও।
– তা তো একটু করতেই হয়। বেচারা চাঁদের কত ধৈর্য এত সুন্দর হওয়ার পরও সকল প্রেমিকরা তাকে দেখিয়ে প্রেমিকাদের সুন্দর বলে। কোনদিন জানি চাঁদটা খসে পরে এর প্রতিশোধ নেয়।

নীলের কথা শুনে না হেসে পারলাম না। বেশ জোরেই হেসে দিলাম। নীল কেন জানি না আমার হাসিটা বন্ধ করতে তার ঠোঁটগুলোর সাহায্য নিল। আমি নীলকে জোরে জড়িয়ে ধরলাম। নীলের নিঃশ্বাসের বাতাস আমার মুখে থুবরে পড়ছে। নীলের এই পাগলামো সামলানোর ক্ষমতা আমার নেই। তাই নিজের পুরোটাই নীলের দিকে উজার করে দিলাম। ঘনঘন নিঃশ্বাস গুলো যেন এ ভালোবাসার সাক্ষী দিচ্ছিল।

বাইরে থেকে বাসন কোসনের আওয়াজ আসছে। সাজেদা খালা এসেছে বেশ ভালোই বুঝা যাচ্ছে।সকাল বেলা বেশির ভাগ সময় ঘুম ভাঙে সাজেদা খালার বাসন কোসনের আওয়াজে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সাড়ে ছয়টা বাজে। আমি উঠতে নিলে নীল আমাকে আরও জোড়ে ঝাঁপটে ধরে বলল

– কোথায় যাচ্ছ?

– ছাড়ো… বাইরে যাব।

– বুঝলাম না বিয়ের আগে এত আগুন দেখায়ছো এখন এত শান্ত বিড়াল কী করে হয়ে গেলে।

– বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েরা একটু শান্তই হয়ে যায়। কয়েকদিন পর বাচ্চা কাচ্চার মা হব। এখন পাগলামি মানায় নাকি?

– ওরে আমার পাগলি বুড়িটা এত বুঝধার হয়ে গেছো।

বলেই ঠোঁটের উষ্ণ ছোয়া গালে ছোয়াতে লাগল বারংবার। যতই নিজেকে ছাড়াতে চাচ্ছিলাম ততই যেন আমাকে সে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছিল।

এর মধ্যেই সাজেদা খালার বজ্র কন্ঠস্বর ভেসে আসলো। দুজনই বেশ চমকে গেলাম। সাজেদা খালার চিৎকার আরও বাড়তে লাগল। বুঝতে একটু অসুবিধায় হচ্ছিল যে খালা এভাবে ভেড়ার মতো চিৎকার কেন দিচ্ছে। দুজনই দ্রূত উঠলাম। বাইরে বের হয়ে দুজনই হতভম্ব হয়ে গেলাম। এমন ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা করেনি কখনও। বিষয়টা স্বাভাবিক দৃষ্টিতে নিব নাকি অস্বাভাবিক বুঝতে পারছিলাম না। নীল আর আমি দুজন দুজনের দিকে তাকাচ্ছিলাম আবার মায়ের দিকেও তাকাচ্ছিলাম। লজ্জায় যেন দুজনের মাথায় কাটা যাচ্ছিল।

চলবে?

(কপি করা নিষেধ)
চলবে?

কপি করা নিষেধ

(গল্প আবারও মোড় নিবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here