ডাক্তার সাহেব পর্ব ৯

#ডাক্তার সাহেব
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৯

আমি নিজেকে সামলে মায়ের দিকে তাকাতেই ভয় পেয়ে গেলাম। মা জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। এটো হাতটা না ধুয়েই মায়ের কাছে গেলাম।

– তোমার কী খুব কষ্ট হচ্ছে মা?

মা মৃদু গলায় নিঃশ্বাসটা প্রখর করে বলল

– একটু শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বালিশটা একটু উপরে তুলে দে। আর খুব খেতে মন চাচ্ছে। মরিচ দিয়ে ঝাল করে আম ভর্তা খেতে ইচ্ছা করছে। একটু করে দিবি। এভাবে না খেয়ে থাকলে তো কষ্ট হয় বেশি।

– মা কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো। সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন চাইলেও তিনদিন মুখে কিছু খেতে পারবে না। একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো।

আর কোনো কথা মায়ের মুখ থেকে আসলো না। আমার হাতটা তার বুকে চেপে ধরে চোখটা বন্ধ করল। মা, মেয়ের এ দৃশ্যটা আমাকে এটাই উপলব্ধি করাচ্ছে যে, সময়ের তাগিদে কখনও মেয়েরাও মা হয়ে যায়। যে মেয়ে মায়ের আচঁলের নীচে আশ্রয় খু্ঁজে সময়ের সাথে সাথে সে মেয়ের আঁচলের নীচেই তার মায়ের আশ্রয়স্থল হয়। মায়ের বুকের সাথে নিজের কানটা মিশালাম। এ স্পন্দনের গতিবিধি যেন অসম্ভব শান্তি দিচ্ছি। কখনও যদি এ স্পন্দন নিভে যায় তখন আমার কী হবে সেটা ভেবেই যেন বুক চেপে কান্না আসছে। মাঝে মাঝে মনে হয় সৃষ্টিকর্তা এ কঠিন নিয়ম কেন করল। এত মায়া মমতা দিয়ে কেনই বা তার কাছে নিয়ে যায়। কেনই বা আমরা চাইলে সবকিছু নিজের করে আজীবন রাখতে পারি না। চোখে জল টলমল করছে। চোখটা বন্ধ করলে এ বুঝি জলটা পড়ে যাবে। মাকে বুঝতে দেওয়ার আগেই মায়ের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে বেড থেকে পাশের চেয়ারে বসলাম। নিজের চোখে আসা জলটা মুছে নিয়ে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলাম রিদি ফোনে কার সাথে যেন বিড় বিড় করছে। অনীল না তো? প্রশ্নটা মনে আসতেই কেমন যেন এক ঝটকা করুণ অনুভূতি বুকের বা পাশটায় অনুভূত হলো। কানটা বেশ খাড়া করে তাদের কথোপকথন শুনতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তার কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য আমি ধরতে পারলাম না। কাছে গিয়ে ফোনটা জোরে ধরে টেনে নিতে নিতে বললাম

– কার সাথে কথা বলছিস তুই?

বলেই ফোনের দিকে তাকালাম। অনীলের নম্বরটা স্ক্রিনে হার্টলক দিয়ে সেভ করা। নম্বর সেভের ধরণ দেখে মনে হচ্ছিল আমার হার্ট ব্লকেই হয়ে যাবে। ফোনটা কেটে গেল। হয়তো আমার কন্ঠস্বর শুনেই নীল কলটা কেটে দিয়েছে। কেমন লাগছে এ অনুভূতি ব্যক্ত করার মতো অভিব্যক্তি আমার নেই। শুধু চুপ হয়ে রিদির ফোনটা ওর হাতে দিয়ে দিলাম। মেঝেতে ধপাশ করে বসে স্তবির হয়ে গেলাম। নীলকে চিনি দুদিন হবে তবুও তার প্রতি এত ভালোবাসা কেন জাগছে। কেনই বা তার জন্য বুকটা ভার হয়ে যাচ্ছে। নিজের ফোনটা হাতে নিয়েই নীলকে কল দিলাম। সে কলটা ধরে হ্যালো বলল। সহস্র কষ্টের স্তর যেন তার কন্ঠ সুর শুনেই হালকা হতে লাগল। বুকের বা পাশের ব্যথাটা ছড়িয়ে পড়ে যেন মিলিয়ে গেল। হালকা সুরে বললাম

– কী করতেছো?

– একটু ব্যস্ত, পরে কথা বলি।

– তুমি রিদির সাথে কথা বলতে পারো আর আমি কল দিলেই বিজি। রিদি তোমার জি এফ নাকি আমি তোমার জি এফ? রিদির সাথে কেন কথা বলতেছো? আমার বেলায় যত ব্যস্ততা তার বেলায় কিছুই না?

– প্রিয় সিঁথি রাণী তোমার পাগল বোনকে একটু উসকে দিচ্ছি। তোমার নীল তোমারেই আছে। এত হিংসা কেন যে , মেয়েদের হয়। বুঝতে পারো না আমাকে? আমার সাথে কথা বলেও কী তুমি আমাকে চিনোনি? ভালোবাসা ছোট্ট শব্দ হলেও এর মহাত্ম অনেক বেশি। হুট করে যেমন ভালোবাসি বলা যায় না আবার হুট করেও এ বন্ধন থেকে ছিন্ন হওয়াও যায় না। প্রেম হয়তো হয়ে যায় সহজে তবে ভালোবাসতে সময় লাগে। রিদি আমাকে কল দেয় অনেক কিছু বলে তাই একটু দুষ্টামি করতেছিলাম। এত সিরিয়াস নিও না। মায়ের পাশে আছো মাকে সেবা করো।

আমার ভেতরটা অনেক শীতল হলো। ভ্যাবসা কষ্টটা নিমিষেই স্তবির হয়ে গেল। বুকের স্পন্দন উঠানামা করে আস্তে আস্তে শান্ত হলো। চোখটা বন্ধ করে বললাম

– রিদির সাথে আর কথা বলবে না। ও কল দিলেও না। আর আসবে কখন?

– সন্ধ্যার পর। এখন একটু ফোনটা রাখি?

– আগে বলো রিদির সাথে কথা বলবে না।

হালকা হাসির শব্দ আসলো। হাসির রেশটা মুখে রেখেই বলল

– জু হুকুম মহারাণী। আর এমন হবে না। এবার খুশি?

– খুশি।

– ফোনটা রাখি?

– রাখো।

কলটা কেটে গেল। মনের ভেতরটা ফুরফুরা লাগছে। চোখের জলটা মুছে স্বস্তির নিঃশ্বাস টানলাম। ততক্ষণে বাবা এসে মায়ের পাশে বসে মায়ের মাথায় হাত বুলাচ্ছে। ফিসফিস করে কী যেন বলছে। আর মা মুচকি হাসছে। বয়স বেড়ে গেলেও ভালোবাসা ঠিকেই তরুণ থাকে। সেটা মা, বাবার এ রোমান্টিক দৃশ্যটা দেখেই উপলব্ধি করতে পেরেছি।

এর মধ্যে ডাক্তার এসে মাকে দেখে গেল কয়েকবার। মায়ের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো আর রিদি তার সাজগোজ নিয়েই ব্যস্ত।

বাবা বাসায় গেছে একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। রাত আটটায় আবার আসবে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের আকাশে রক্তিম সূর্যের আভা ছড়িয়ে অন্ধকার হতে লাগল। আর আমার বুক ধুকধুক করতে লাগল। নীল আসবে কখন সে অস্থিরতা নিজেকে গ্রাস করতে লাগল।

রাত তখন ৭ টা। কেবিনের দরজাটায় শব্দ আসলো। সে সাথে আমার বুকের ভতরটায় ভূমিকম্প শুরু হলো। আমি জানি নীল এসেছে। তাই বসা থেকে উঠে দরজা খোলার জন্য দাঁড়াতেই রিদি আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দরজাটা খুলল। দরজার ওপাশে নীল দাঁড়িয়ে আছে। রিদি নীলের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আর এদিকে নীল ও মুচকি মুচকি হাসছে। নীল কেবিনে ঢুকতেই রিদি এমনভাবে নড়ল চড়ল যে, সে এখন নীলের কোলে হেলে পড়েছে। নীল রিদিকে শক্ত করে ধরল যাতে করে মেঝেতে পড়ে না যায়। তারপর তার চোখের দিকে তাকাল। রিদিও তাকিয়ে আছে অপলক দৃষ্টিকে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পারলাম না তেমন। কাছে গিয়ে রিদিকে জোরে ধাক্কা দিলাম। সাথে সাথে রিদি মেঝেতে পড়ে গেল। আর কোমড়ে হাত দিয়ে আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকাল। আমি শুধু মুচকি হাসলাম। নীল ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে হয়তো বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। তবে এখন ঠিক কী করা উচিত সেটা তার বোধগম্যও হচ্ছে না। নীল চুপ। রিদি কোমড়ে এক হাত দিয়ে আরেক হাত নীলের দিকে বাড়িয়ে দিল তাকে ধরে তুলার জন্য। ঠিক তখনই আমি রিদির হাতটা ধরে মুচরে ধরে বললাম

– খুব ইচ্ছা নীলের হাত ধরতে তাই না! তোর হাতেই আমি মুচড়ে দিব। এত আল্লাদ কই পাস।

রিদি দম নিতে নিতে বলল

– আমার হাত ছাড়। নাহয় খালামনিকে ডাক দিব।

– তোর খালামনিকে ডাক দিলেও লাভ নেই। ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে এখন, ডাকলেও উঠতে পারবে না। আসছে নীলের সাথে প্রেম করতে। সময় মতো বিয়ে করলে তো তিন বাচ্চার মা হতি

রিদি জোর খাটিয়ে মেঝে থেকে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলল

– আমার ব্যাপারে তোকে কে নাক গলাতে বলেছে। আমি যার সাথে মন চাই প্রেম করব। নীল ভাইয়া তোর কী হয়? আর তার সামনে আমাকে এসব বলে অপমান করছিস কেন? হাত ছাড় বলছি। ব্যথা লাগছে অনেক।

– ব্যথা লাগার জন্যই ধরেছি। হাত ভেঙেই দিব। সে সাথে তোর চোখ ও উপরে ফেলব নীলের দিকে তাকালে। নীল আমার জামাই হয় বুঝছিস।

– ফালতু কথা রেখে হাত ছাড়। আর পাবনা যাওয়ার টিকেট কাট। কে কার কী হয় সেটা কারও অজানা না।

আমি রাগে গজগজ করে হাতটা ছেড়ে দিলাম। রিদি হাতটা ছাড়তেই বলে উঠল

– তোর অনেক বাড় বাড়ছে। আমি তোকে দেখে নিব।

রিদির কথাটা শুনতেই আমার রাগটা আরও বেড়ে গেল। রাগে ফুলে ফেঁপে তার বাহুটা ধাক্কা দিয়ে তাকে পেছন দিকে সরিয়ে দিয়ে বললাম

– কী করবি তুই?

অবস্থা বেগতিক লক্ষ্য করে নীলের এক হাত আমার মুখ চেপে ধরেছে অপর হাত আমার কোমড় চেপে ধরে কোনো রকম কোলে তুলে কেবিনের বাইরে এনে কেবিনের দরজাটা বাইরে থেকে লাগিয়ে দিল। আমি নীলের হাতটা মুখটা থেকে ছুটিয়ে দম নিতে লাগলাম জোরে জোরে। সে আমার বাহু ধরে তার চোখ বরবার আমার মুখটা তাক করাল। তার নেশাদ্রব্যমিশ্রিত চোখে চোখ পড়তে আমি যেন সে নেশায় তলিয়ে পড়লাম।এবার সে আচমকা আমার কাছে আসলো। আমার একদম কাছে। করিডোরটা তখন জনমানবহীন শূন্য হয়ে আছে। আমার নিঃশ্বাসটা ভারী হয়ে যেতে লাগল। দুজন দুজনের ঠোঁটের কাছে আসতেই অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনার সম্মুখীন হলাম।

চলবে

কপি করা নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here