#ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-৯)
#হালিমা রহমান
বিশাল এক খাটের এককোনে সোনালী, আরেক কোনে তথা।দোতলার এই ঘরটা শুধু তথা ও সোনালীর।বিষয়টা ভালো লেগেছে তথার।গাদাগাদি করে থাকা যায়? দুজনে বেশ আরামে থাকতে পারবে এই ঘরে।তাছাড়া,সোনালীর সাথে বেশ ভাব তথার।রুমমেট হিসেবে সোনালী একদম পার্ফেক্ট।আর কোনো মেয়ের সাথে তথার পরিচয় নেই।একদম অচেনা কারো সাথে রুম ভাগ করতে হলে একটু সমস্যাতে পড়তেই হতো।দোতলায় অনেকগুলো ঘর।এক ঘরে দুজন করে থাকছে।তথাদের ঘরটা একটু কোনার দিকেই।তাদের রুমের পাশেই আরেকটা রুম।তথা ঘরে ঢুকার সময় দেখেছে রুনটা তালাবদ্ধ। কেউ বোধহয় থাকে না সেখানে।তথা খাট বসে এদিক-ওদিক নজর বুলায়।বিশাল ঘরে একটা খাট,একটা আলমারি,একটা টেবিল, দুটো চেয়ার।আর আছে কয়েকটা ফুলদানি। ফুলদানিতে কৃত্রিম ফুল। ফুলগুলো নতুন রাখা হয়েছে মনেহয়।সাদা রঙের কাপড়ের ফুলে একফোটা ধুলো-ময়লা নেই।তথাদের খাটের পিছনের দেয়ালে একটা দামী পেইন্টিং। তাতে স্থান পেয়েছে অসামান্য সুন্দরী এক নারী।সাদা রঙের শাড়ির উপর শরীরে একগাদা গয়না।মিষ্টি হেসে চেয়ে আছে সামনের দিকে।এরকম সুন্দরী নারী বাস্তবে আছে কি না তা জানে না তথা।তবে এই বংশের অতীত ইতিহাস যে খুব একটা ভালো ছিল না তা বেশ বুঝতে পারছে তথা।এ বাড়িতে আসার পর থেকে দুটো জিনিস খুব চোখে পড়েছে তথার।এক – ফুলদানী আর দুই -নারীমূর্তি ও সুন্দরী রমনীদের পেইন্টিং।যাদের অব্যবহৃত বাড়িতে এতো এতো নারীচিত্র , তাদের চরিত্র যে কতখানি কালিমালিপ্ত ছিল তা বুঝতে কষ্ট হয় না।আচ্ছা,আগের রাজা-বাদশা- জমিদার সবার কি এই একটাই দূর্বলতা ছিল?নাটক-সিনেমাতেও তো এগুলোই দেখায়।তথা অনেক আগে একটা হিন্দি ছবি দেখেছিল।ছবিটার মূল উপজীব্য ছিল এক মধ্যেবয়স্ক জমিদারের বহুবিবাহ। লোকটা একের পর এক বিয়ে করতেই থাকে, করতেই থাকে। পনেরো তম বিয়ের পর আবার তার শখ জেগেছে সে বিয়ে করবে।পাত্রী হিসেবে পছন্দ করে রাজবৈদ্যের মেয়েকে।মেয়েটার বয়স তখন সবে এগারো।অন্যদিকে জমিদারের বয়স পঁয়তাল্লিশ। রাজার পছন্দের কাছে হার মানে রাজবৈদ্য।পুতুল বিয়ের নাম করে কাপুরুষটা রাজার সাথে ছোট্ট মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা করে।ছবির এর পরের অংশটুকু আর দেখেনি তথা।এটুকু দেখেই তার গা ঘিনঘিন করেছে।একটা বাবা কখনো এরকম করে? তথা নিজের বাবাকে দেখেনি,বাবার কোলের উষ্ণতা অনুভব করেনি।তবুও সে জোর দিয়ে বলতে পারে,বাবারা কখনো এতোটা কাপুরুষ হয় না।বাবাকে না দেখুক,পিতৃসম চাচাকে তো দেখেছে।তার চাচাও কোনোদিন এমন কাপুরুষের মত আচরণ করতে পারতো না।বাবারা কখনো কাপুরুষ হয় না, তারা হয় বীরযোদ্ধা।তাছাড়া জমিদারেরও আক্কেলের অভাব।কি করে পারলো মেয়ের বয়সী একটা শিশুকে বিয়ে করতে?আগের দিনের বেশিরভাগ জমিদারদের বোধহয় আর কোনো কাজ ছিল না।সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চেপে ভোগ-বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিয়েছে।এজন্যই টিকতে পারেনি।শাসনের নামে শোষণ করলে কেউ আবার বেশিদিন টিকে থাকতে পারে?
তথার চোখ যায় জানালার দিকে।একটা বিশাল বড় জানলা আছে ঘরে।জানলা দিয়ে বাড়ির পিছন দিকটা দেখা যায়।বড় বড় ডালপালা মেলে দিয়ে বয়স্ক গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে।অন্ধকারে গাছগুলো চিনতে পারলো না তথা।চেনার চেষ্টাও করলো না।চোখ ফিরিয়ে নিলো।ইউসুফের কথাগুলো মনে আছে তথার।এ বাড়িতে নাকি জ্বিন-ভূত আছে।থাকতেও পারে। এতো এতো বয়স্ক গাছের ভীড়ে জ্বিন-পরী না থাকাই বরং অস্বাভাবিক। তথার গায়ে কাটা দেয়।সে খুব ভীতু মেয়ে।জ্বিন-ভুতের কথা শোনার পরেও অন্ধকারে তাকিয়ে থাকার সাহস তার নেই।
_” এই তথাপু,তোমার কি ক্ষুধা লেগেছে?”
_” না।কেন?”
_” আমার খুব ক্ষধা পেয়েছে।আমাদেরকে খেতে-টেতে দেবে না? ”
_” কি জানি।তাছাড়া খুব বেশি রাত হয়নি এখনো।আরো পরে হয়তো খেতে ডাকবে।আমার কাছে শুকনো খাবার আছে।খাবে? ”
_” অবশ্যই।না খেলে ওগুলো নিজের কাছে রেখে দিয়েছ কেন? ক্ষুধার্ত মানবীকে তোমার চোখে পড়ছে না?”
তথা মুচকি হাসে।খাট থেকে নেমে আলমারির থেকে নিজের ব্যাগ বের করে।দু- প্যাকেট চিপস এখনো আছে।সোনালীর দিকে চিপসের প্যাকেট বাড়িয়ে দেয় তথা।সোনালীও বেশ আরাম করে আয়েশী ভঙ্গিতে চিপস খায়।তার সত্যিই খুব ক্ষুধা পেয়েছে।
_” আচ্ছা তথাপু,তুমি এখানে চান্স পেলে কি করে? শতদল মাল্টিমিডিয়ার খবর কি করে পেয়েছ তুমি?”
_” আমার চাচার মাধ্যমে।ডিরেক্টর আখতার হোসেন আমাদের গ্রামের লোক।শতদল মাল্টিমিডিয়ায় কাজের খবরটা সর্বপ্রথম কাকাই আমায় দেয়।এরপর অনেকটা শখের বশেই একটা স্ক্রিনটেস্ট দেই।ভোজভাজির মতো সিলেক্টও হয়ে যাই।”
_” তোমার বাবা-মা নেই?”
_” না। চাচার কাছেই মানুষ হয়েছি।”
_” এতোদূর আসতে নিষেধ করেনি তোমায়?প্রথমবার তো তাই বলছিলাম আরকি।”
_” কাকি তো কিছুতেই আসতে দিবে না।কাকার সহায়তায় এসেছি এখানে।কাকা না থাকলে কিছুতেই আসতে পারতাম না।এই কাজটা আমার জন্য খুব দরকার ছিল।”
_” কি এমন দরকার যে ঘর-বাড়ি ছেড়ে এতোদূর আসতে হলো?”
_” আমার একটা ছোটবোন আছে।রুবাইদা নাম।ক্লাস টেনে পড়ছে এবার।ওর পিত্তথলিতে পাথর হয়েছে।পাথর নাকি আরো আগেই হয়েছিল।কিন্তু ধরা পড়েছে দেড় মাস আগে।রুবাইদার যখন খুব পেট ব্যাথা করতো , তখন আন্দাজে যেকোনো একটা ব্যাথার ঔষধ বা গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ খেয়ে নিত।আমাদেরকে বলতো না।ওর সমস্যা আমাদের চোখে পড়েছে মাস কয়েক আগে।পেট ব্যাথায় একদম পাগলের মতো করতো।পরে আমি আর কাকা হাসপাতালে নিয়ে যাই। আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্টে পিত্তথলির পাথর ধরা পড়ে।রুবাইদার ট্রিটমেন্টের জন্য অনেক টাকার দরকার।কাকা একা কিছুতেই পারবে না।কাকাকে সাহায্য করার জন্য একটা চাকরি খুঁজছিলাম।ঠিক সেই সময়ে এখানে চান্স পাই।অভিনয় আমার শখ আবার একইসাথে এই মুহূর্তে আমার দরকার।তাই দেরি করিনি।সুযোগটা লুফে নিয়েছি একদম।”
একটানা এতোগুলো কথা বলে হাঁপিয়ে উঠলো তথা।খাটের একপাশে উঁচু করে রাখা বালিশে হেলান দেয়।সোনালী খাওয়া বন্ধ করে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তথার দিকে।তার কপালের চামড়াগুলো দুই ভ্রুর মাঝখানে জড়ো করা।সোনালীকে দেখে মনে হচ্ছে সে গভীর ভাবনায় মগ্ন।তথা তাই ঘাটলো না ওকে।বেশ কিছুক্ষণ পর সোনালী নিজ থেকেই আবার প্রশ্ন করে তথাকে।
_ ” আচ্ছা তথাপু,এই রিপোর্টের কথা আর কে জানে?”
_” শুধু আমি আর কাকা ।আর এখন তোমাকে বললাম।কেন?”
_ ” ওই যে তখন তুমি বললে না,তোমার কাকি এখানে আসতে দিতে চায়নি।তাই বললাম।যদি তিনি মেয়ের অসুখের কথা জানতেন তাহলে বোধহয় নিষেধ করতেন না।তিনি মা।তিনি নিশ্চয়ই চাইবেন তার মেয়ের চিকিৎসা হোক।”
_” কাকির হার্ট খুব দূর্বল।তাই বলিনি।রুবিও মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী।ও জানলে হয়তো ভেঙে পড়বে,পড়াশোনা ছেড়ে দেবে।তাই ওকেও বলিনি।”
_ ” ডাক্তার ওকে কোনো ঔষধ দেয়নি?”
_” দিয়েছে।এখনি অপারেশন সম্ভব না।তাই ব্যাথা দমিয়ে রাখার জন্য ঔষধ দিয়েছে ডাক্তার।”
_” ঔষধ দেখে প্রশ্ন করেনি রুবি?”
_” ওরে বাবা! করবে না আবার? ওর কত কত প্রশ্ন।এতো ঔষধ কেন? পেট ব্যাথা না থাকলেও ঔষধ কেন খাব?ঔষধগুলো এতো বড় বড় কেন? হাজারটা প্রশ্ন ওর।”
_” কি বলে বুঝ দিয়েছো?”
_” বলেছি ওগুলো গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ।”
_” ওহ,আচ্ছা।”
তথা বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে।ফুরফুরে মনটা খারাপ হয়ে গেছে রুবাইদার কথা ভেবে।বোনটা তার খুব আদরের।তথার যখন পাঁচ বছর,তখন রুবাইদার জন্ম।রুবাইদা তথার আপন বোন না।তাই রুবাইদার জন্মের পর, পাড়া-প্রতিবেশীরা তথাকে দেখলেই আফসোস করতো।স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে তাকে ডেকে ডেকে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞেস করতো।আকলিমা বেগম আগের মতো আদর করে নাকি,খাইয়ে দেয় নাকি,ইকবাল মিয়া ঘরে ফিরেই আগে তথার খোঁজ নেয় নাকি–এরকম হাজারটা প্রশ্ন।তথা তো তখন তাদের এতো প্রশ্নের উদ্দেশ্য বুঝতো না।সেও সরল মনে ঘরের কথা পরের কাছে বলতো।প্রতিবেশীদের প্রশ্নের উত্তরে আগ্রহের সাথে বলতোঃ” কাকি এখন মোটেও আদর করে না।খাইয়ে দেয় না,গোসল করিয়ে দেয় না।সারাদিন রুবিকে নিয়ে থাকে।রুবিকে খাওয়ায়, গোসল করায়।কাকাও আদর করে না।কাজের থেকে এসে আগে রুবিকে কোলে নেয়।রুবিকে সারামুখে চুমু দেয়।রুবির জন্য সেদিন এক সেট জামা এনেছে। আমার জন্য এনেছে শুধু একটা চিপস।এখন আমাকে কেউ আদর করে না।”
প্রতিবেশীরা তখন আফসোস করতো।আহারে! চাঁদের টুকরা মেয়েটার কপাল বুঝি ভাঙলো।নিজের অংশকে পেলে আর কেউ পরের অংশকে আদর করে? তথা তো আর আপন মেয়ে না।নিজের পেটের মেয়ে হলে এমন বদলে যেতে পারতো? উঁহু কখনোই না।
এসব নিম্নস্তরের কথা-বার্তা তথার মনে প্রভাব ফেললো।সে তো আর আপন- পর বুঝতো না।খালি বুঝতো রুবির জন্য ওর আদর কমে গেছে।রুবি না থাকলে কাকা-কাকি আগের মতোই আদর করতো।রুবি আছে বলেই তথাকে কেউ আদর করে না।এরপর থেকে তথা রুবির ধারে-কাছেও যেতো না।ঘরের কারো সাথে কথা বলতো না।নিজের কাজগুলো নিজেই করার চেষ্টা করতো।সারাদিন ঘরে বসে থাকতো।তথার এই অসংলগ্ন আচরণ আকলিমা খাতুনের চোখে পরে কয়েকদিন পরেই।এক সন্ধ্যায় রুবিকে ঘুম পাড়িয়ে তথার ঘরে গেলেন তিনি।তথা তখন খাটে বসে পড়ছিল।আকলিমা বেগম যেয়ে তথার পাশে বসেন।তথার চুলে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করেনঃ ” তথা, কি হইছে তোর মা?”
_” কিছু না”– আকলিমা খাতুনের হাত নিজের মাথা থেকে সরিয়ে দেয় তথা।
আকলিমা খাতুন রাগ করলেন না।তথার দিকে আরেকটু চেপে বসলেন।তথাকে জড়িয়ে ধরে বললেন ঃ” আমার মার কি হইছে? কাকির উপর রাগ করছে?”
তথার অপরিণত মনের অভিমান ঝরে পড়ে মুহূর্তেই।কাকির বুকে মাথা গুজে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে।
_” আমাকে তোমরা আদর করো না।সবাই শুধু রুবিকে আদর করে।”
_” কে কইছে তোরে?”
_” আমি বুঝতে পারি।আবার ঐ পাশের বাড়ির আন্টিরাও বলে।আমি তোমাদের আপন মেয়ে না।তোমরা এখন আর আদর করবে না আমাকে।”
আকলিমা খাতুনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।এই বিষাক্ত অভিযোগ মেয়েত মাথায় ঢুকানোর কোনো দরকার ছিল? আকলিমা খাতুন মেয়ের থেকে সবটুকু শুনেন।তারপর মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেঃ” রুবি তো এখন অনেক ছোট। তাই ওরে সময় বেশি দিতে হয়।আমার তথা মা কি রুবির মতোন পিচ্চি? তুই যখন এইটুকু আছিলি,তখন তোরেও এমনেই পালছি। আমার তথার মাথায় অনেক বুদ্ধি।তুই বল,রুবিরে সময় না দিলে সে বড় হইতে পারব?আর কাকির অনেক কাজ থাকে না?কাকি কি সবদিকে নজর দিতে পারি? মাইনষের কথা আর শুনবি না।এই যে আমি তোরে আদর কইরা চুল বাইধা দেই,তোর পছন্দের খাবার রান্না করি– ওরা কি এগুলি করে? ”
তথা মাথা নাড়ে।আকলিমা খাতুন মেয়ের চুলের উপর চুমু দেয়।
_” ও গো কথা আর শুনবি না।আমরা যা করি তোর ভালোর লেগাই করি।রুবি তোর ছোট বইন।তুই না বড়? বড় বইনেরা ছোট বইনেরে আদর করে।তুই করোছ না কেন? আদর না করলে রুবি তোরে আপু ডাকব না।তোর কাছেও যাইব না।এডা কি ভালো হইব?”
এরপর থেকে রুবি যেন তথার প্রাণ হয়ে উঠলো।রুবি তার সর্বক্ষণের খেলার সাথী,আদুরে পুতুল।রুবির কখন কি দরকার, রুবির ইচ্ছা,রুবির চাহিদা-শখ এসব তথার চাইতে বেশি আর কে জানে?রুবির জন্য নিজের কলিজাটাও কেটে দিতে হয়তো দ্বিধা করবে না তথা।বড় আদরের,বড় সাধের বোন তার।টাকার অভাবে রুবির চিকিৎসা বন্ধ হয়ে থাকবে–তা কি কখনো মেনে নিবে তথা? উঁহু, কখনোই না।এজন্যই তো এতোদূরে আসা।পড়াশোনা বাদ দিয়ে,ঘর-বাড়ি বাদ দিয়ে আজ এখানে এসেছে তথা।সংসার চালিয়ে,রুবির চিকিৎসা চালানো একেবারে অসম্ভব ইকবাল মিয়ার পক্ষে।তাই তো হাজার বারণ পায়ে ঠেলেছে তথা।কোনোদিন আকলিমা খাতুনের নিষেধ অমান্য করেনি।এবার এতো মরিয়া হয়ে কেন নিষেধ অমান্য করলো? সব তো এই রুবির জন্যই।না হয় মায়ের মতোন মানুষটার কথা অমান্য করতো? অন্য কোনো চাকরি বা উপায় থাকলে তথা পঞ্চগড় আসতো না।কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত কোনো ভালো মানের চাকরি করার যোগ্যতা তার নেই।সবে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে।এতুটুকু পড়াশোনায় টিউশনি ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।আর টিউশনির টাকায় রুবির চিকিৎসা তো দূরের কথা সংসারের তিনবেলা খাবারের যোগাড় করাও সম্ভব না।সবকিছু ভেবে-চিন্তেই কাকির অবাধ্য হয়েছে তথা।এই কাজটা একইসাথে তার শখ এবং প্রয়োজন।রুবির চিকিৎসার প্রয়োজনীয় খরচাপাতি আখতার হোসেন দিচ্ছেন।তথার পারিশ্রমিক তিনি শুটিংয়ের আগেই দিয়ে দিয়েছেন।কয়েকদিন পরেই রুবির অপারেশন। কাকি যখন তথার অবাধ্যতার সঠিক কারণ জানবে,তখন নিশ্চয়ই আর রাগ করে থাকতে পারবে না।তথা চোখ বন্ধ করে।মনে মনে আল্লাহর কাছে মন খুলে বোনের জন্য দোয়া করে।
–” রুবিকে ঠিক করে দেও, খোদা।প্রয়োজনে আমার সুস্থতার একাংশ রুবিকে দান করো।তাও ওকে সুস্থ করে দেও,প্লিজ।”
***
চারদিকে নিস্তব্ধ রাত।কোথাও কোনো সাড়া-শব্দ নেই।যে যার ঘরে সুখনিদ্রায় মজে আছে।গ্রামে একটু রাত হলেই চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায়।আর গভীর রাত হলে তো কথাই নেই।চারদিকে কেবল শব্দহীনতা। তথা ঘুমিয়ে কাদা।সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বেশ তৃপ্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছে সে।ঘড়িতে বোধহয় আড়াইটা বাজে।হুট করে দু-চোখের পাতা খুলে ফেলে সোনালী।একটুখানি মাথা উঁচু করে তথার দিকে তাকায়।সে ঘুমিয়ে আছে।পা টিপে টিপে খাট থেকে নেমে দাঁড়ায় সোনালী।একটুও শব্দ হয় না।পরনের ঘাগড়া পাল্টে কালো রঙের জিন্স পরে নেয়।চুলগুলো মাথার উপরে শক্ত খোপায় বেঁধে নেয়।মোবাইলের সিম খুলে অন্য একটা সিম ভরে নেয়।তারপর আরো একবার তথার দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
ধীরে ধীরে শব্দহীন পায়ে হাঁটে সোনালী।হৃৎপিণ্ডে তুমুল শব্দ হচ্ছে।সোনালী ভীতু মেয়ে নয়।কিন্তু তবুও খুব ভয় হচ্ছে এখন।মনে হচ্ছে এই বুঝি কেউ পিছন থেকে ডাক দেয়,এই বুঝি হাতেনাতে ধরে ফেলে তাকে।এখানে আসার আগে আহমেদ বংশের ইতিহাস পড়েছে সে।কোন জমিদার কি করেছে,যে কতখানি খারাপ ছিল তার সবটাই জানে সোনালী।তাই ভয়টা একটু বেশিই হচ্ছে। আহমেদ ইউসুফ ভয়ংকর মানুষ।সোনালীকে ধরতে পারলে সে যে কি করবে তা আন্দাজ করতে পারে না সোনালী।দুরুদুরু বুকে ধীরে ধীরে নিশাচর প্রাণীর মতো নিচতলায় চলে আসে সোনালী।দরজা খুলে বেরিয়ে আসে বাইরে।কোনো বাতাস নেই আশেপাশে। গুমোট আবহাওয়া।গাছের একটা পাতাও নড়ছে না।আজ বোধহয় অমাবস্যা চলছে।চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার।এই অন্ধকার সোনালীর জন্য আশীর্বাদ। আপাতত তাকে দেখা যাবে না।একটা বিশাল গাছের পিছনে চলে যায় সোনালী।হাতের উল্টোপিঠে ঠোঁটের উপরের ঘাম মুছে নেয়।অতি সন্তর্পণে মোবাইলের আলো জ্বালে। কল করে কাঙ্ক্ষিত নম্বরে।বার দুয়েক রিং হয়।কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই নির্ধারিত ব্যক্তিটি ফোন ধরে।
সোনালী নিচু গলায় বলেঃ” হ্যালো,সোনালী বলছি।”
_” মিস সোনালী, টেল মি ইয়োর কোড নম্বর প্লিজ।”–ওপাশ থেকে খ্যাটখ্যাটে গলা শোনা যায়।
সোনালী বিরক্ত হয় খুব।এই রাতদুপুরে কত ঝুঁকি নিয়ে ফোন করেছে।এতো ঢং করার সময় আছে?
#ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-১০)
#হালিমা রহমান
দূরে কোথাও একটা কুকুর উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলো।রাতের নিস্তব্ধতাকে একদম চিড়ে ফালা ফালা করে ফেললো হতচ্ছাড়া প্রাণীটা।এক মুহূর্তের জন্য সোনালীর সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে।মনের কোনে জমে তীব্র ভয়।কোনো বিপদ আসতে চললো নাকি?সোনালী দু’ বার আল্লাহর নাম জপে।এই যাত্রায় বেঁচে ফিরতে পারলে এসব কাজ ছেড়ে দিবে–এই প্রতিজ্ঞাও করে মনে মনে।
_” মিস সোনালী, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?”
ফোনের কথা ভুলেই গিয়েছিল সোনালী।ডিপার্টমেন্ট হেডের কথা শুনে দাঁতে জ্বীভ কাটে।ব্যস্ত সুরে বলেঃ” ইয়েস স্যার,শুনতে পারছি।”
_” গিভ মি ইয়োর কোড নম্বর।”
_” এস.এম.জি.ফোর।”
_” ওখানের কী অবস্থা?”
_”এখন অবধি ভালো স্যার।কিন্তু কতক্ষণ এরকম অবস্থা থাকবে তা বলতে পারছি না।”
_” মুখোমুখি হয়েছেন?”
_” জ্বি স্যার।”
_” কেমন লাগলো?”
_” আহমেদ ইউসুফ খুব আকর্ষণীয় একজন পুরুষ।খুব বেশি কথা বলে না বোধহয়।তবে একটা জিনিস আমার চোখে পড়েছে স্যার।”
_” কি?”
_” এখানে একটা মেয়ে আছে।তথা নাম।ওর দিকে ইউসুফ কিভাবে যেন তাকায়।তথার দিকে তাকানোর সময় ওর চোখের দৃষ্টি বদলে যায়।আমার মনে হয়,তথা আহমেদ ইউসুফের পছন্দের একজন মানুষ।”
_” দুজনের দিকেই নজর রাখো।আহমেদ ইউসুফের অতীত ইতিহাস ভুলে যেওয়া না। আরেকটা কথা মনে রেখো, তোমরা সবাই কিন্তু বিপদে আছো।এক পা এদিক-ওদিক করো না।”
_” একটা কথা বলব, স্যার?”
_” বলো।”
_ ” এতো ঝামেলা করার কি দরকার,স্যার? এরচেয়ে বন্দুকের ছয়টা বুলেট ওই হারামজাদার পেটে ভরে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়।ওর মতো শয়তানের বাচ্চা পৃথিবীতে না থাকলে কি হবে?”
_” মিস সোনালী, স্ল্যাং ইউজ করবেন না।এজন্য আপনার শাস্তি হতে পারে।দূরে আছেন বলে ভাববেন না আপনি নিয়ন্ত্রণহীন।”
থতমত খায় সোনালী।মেয়েটার এই এক দোষ। কথার আগে মুখ দিয়ে গালি বেরিয়ে যায়।সোনালী নিচু স্বরে বলেঃ” সরি স্যার। তবে আমার বুদ্ধিটা কিন্তু মন্দ নয়। ”
_” আহমেদ ইউসুফের অপরাধের প্রমাণ নেই। প্রমাণ থাকলে অনেক আগেই তাকে ধরতাম আমরা। প্রমাণ জোগাড় করতেই আপনি সেখানে গেছেন।তাছাড়া, ওর হাত অনেক লম্বা।প্রমাণ ছাড়া একরাতও রাখা যাবে না।তাহলে বুঝতেই পারছেন,প্রমাণ হাতে না আসা পর্যন্ত আমরা কিছুই করতে পারব না।”
_” বুঝতে পারছি স্যার।”
_ ” নজর রাখুন ওর উপর।বিন্দু পরিমাণ প্রমাণ মিললেই,টিম বি তাদের কাজ শুরু করে দেবে।আপনিও ঢাকা ফিরতে পারবেন।তবে একটা কথা মাথায় রাখবেন,আহমেদ ইউসুফ যেকোনো সময় দেশ ছাড়তে পারে।দেশ ছাড়লে আমরা আর কিছুই করতে পারব না।তাই দেশে থাকতেই যা করার করতে হবে।”
_” আমাদের হাতে বোধহয় এখনো একমাস সময় আছে স্যার।”
_” বলা যায় না।সব কাজে ইউসুফ উপস্থিত থাকে না।সাবধানে থাকবেন মিস সোনালী। আশা করছি সফলতার সাথে কাজ শেষ করার পর আবার আপনার সাথে দেখা হবে।”
_” ইনশা….”
আর কথা বলতে পারে না সোনালী।তাড়াতাড়ি লাইন কেটে ফোনের আলো বন্ধ করে।ঘামে মেয়েটার পরনের শার্টটা ভিজে গেছে।একে গুমোট আবহাওয়া তার উপর ভয়।সোনালীর অবস্থা পুরো নাজেহাল।সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে।হৃৎপিণ্ডের গতির সাথে পাল্লা দিয়ে সোনালী আল্লাহকে ডাকে।পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা অশ্বত্থ ও কৃষ্ণচূড়া গাছের পিছনে নিজেকে আরেকটু গুটিয়ে নেয়।কোনোক্রমেই এখন সে ধরা পড়তে চায় না।
জমিদার বাড়ির পাকা রাস্তাটুকুতে দুই জোড়া জুতোর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।মসৃণ পথে বিশ্রি শব্দ তুলে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ইউসুফ ও মামুন।সোনালী ঘাড়টাকে একটু নিচু করে বাড়ির লোহার গেটের দিকে তাকায়।গেটটা এখনো তালা দেওয়া।এরা গেট দিয়ে আসেনি।বাড়ির ভিতরের কোনো এক জায়গা থেকে এসেছে।সোনালী যখন বাইরে এসেছে তখন এরা কেউ বাড়িতে ছিল না-এটা নিশ্চিত।তবে কি এবাড়িতে কোনো গুপ্তকক্ষ আছে?অথবা টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করা হতো এমন কোনো ঘর আছে?প্রাচীন আমলের বাড়িতে এসব টর্চার সেল থাকাই স্বাভাবিক।আগের দিনের রাজা-বাদশাহ-জমিদারেরা অপকর্ম করার জন্য হরহামেশাই এসব তৈরি করতো। তাছাড়া, আহমেদ বংশের জন্য এসব স্বাভাবিক বিষয়। জমিদার আহমেদ জুলফিকার যেদিন জমিদার হয়েছিলেন,সেদিন নাকি ভোরবেলাতেই এক কৃষককে একশ চাবুক মেরে আধমরা করে ফেলেছিলেন।দরিদ্র কৃষকের অপরাধ ছিল অতি সামান্য। সকালবেলা ক্ষেতে যাওয়ার সময় তারসাথে জমিদারের দেখা।দরিদ্র-বৃদ্ধ কৃষক জমিদারকে চিনতে পারেননি। তাই রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঝুকিয়ে কুর্নিশ না করে বৃদ্ধ তাড়াহুড়ো করে ক্ষেতে চলে যাচ্ছিলেন।এটাই চোখে লাগে জমিদারকে।বৃদ্ধের এতোবড় দুঃসাহস দমিয়েছেন চাবুক দিয়ে। এতো গেল একদিনের কথা।তার সময়ে এদিকের মানুষের অবস্থা ছিল সবচেয়ে শোচনীয়।আবার মুক্তিযুদ্ধের সময়েও এই আহমেদ জুলফিকার ছিলেন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। বৃদ্ধ বয়সেও মানুষকে শান্তিতে থাকতে দেননি।প্রায় প্রতিদিন এখানে নারকীয় অত্যাচার চলতো।এ গ্রামের বহু বীর সন্তানের রক্ত মিশে আছে এ বাড়ির মাটিতে।এরকম একটা বাড়িতে টর্চার সেল বা পাতাল ঘর থাকাটা স্বাভাবিক।ইউসুফ ও মামুন কি সেখানেই ছিল নাকি অন্যকোথাও ছিল?নাকি এরা বাড়ির পিছনে জঙ্গলে ছিল।এতো এতো চিন্তার ভার নিতে পারে না সোনালী।একটুখানি মাথা তুলে কেবল ইউসুফ ও মামুনের দিকে তাকিয়ে থাকে।ডানহাত জিন্সের পকেটের ভিতর ঢুকিয়ে রিভলবারটাকে শক্ত করে চেপে ধরে।কোনোভাবে ধরা পড়লেই গুলি চালিয়ে দেবে।অকারণে এদের হাতে মরবে কেন?
পাকা রাস্তাটুকুতে পা না থামলেও, বাড়ির কাঠের দরজার সামনে এসে পা থেমে যায় ইউসুফের। ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থাকে বিশাল দরজার দিকে।ইউসুফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মামুনও দাঁড়িয়ে যায়।বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করেঃ” ঘরে যাবেন না স্যার?”
_” দরজাটা খোলা কেন, মামুন?তুমি কি এই দরজা দিয়ে বেড়িয়েছিলে?”
_” না স্যার।আমি তো পিছনের দরজাটা ব্যবহার করেছিলাম”
_” তাহলে এটা কে খুললো?”— কথা বলতে বলতেই চারদিকে চোখ বুলায় ইউসুফ।অনেক অন্ধকার দেখে মোবাইলের আলো জ্বেলে নেয়।আলো ঘুড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখে।কিন্তু কোনোকিছুই নজরে আসে না তার।মামুন আশ্বস্তের সুরে বলেঃ” কেউ নেই স্যার। আমিই বোধহয় ভুলে দরজাটা লাগাইনি।অকারণে চিন্তা করছেন আপনি।”
_”এই ভুলটা আর কখনো করবে না।রাত নামার সাথে সাথেই দরজা আটকে দেবে।মনে রাখবে এখানে কিন্তু কোনো গার্ড নেই।বিপদ কোনদিক দিয়ে আসে তা বলা যায় না।আগে থেকেই সতর্ক হতে শিখো।”— শেষদিকে খানিক কঠিন শোনায় ইউসুফের কন্ঠ।মামুন ইউসুফের কথার শেষে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়। ইউসুফকে প্রবেশ করার জন্য দরজা খুলে দেয়।ইউসুফের পিছে পিছে সেও ঢুকে।ইউসুফের সামনে খুব নির্বিকার আচরণ করলেও ঘটনাটা খুব ভাবাচ্ছে মামুনকে।কাহিনিটা কি হলো?মামুন তো দশটার দিকেই দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়েছিল।নাকি দেয়নি?বিভ্রান্ত হয়ে যায় মামুন। কপাল কুঁচকে দরজার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে।ঘন্টাখানেক আগে দরজা লাগিয়েছিল না লাগায়নি তা মনে করতে পারে না।
_” মামুন, ডিরেক্টরের দিকে নজর রেখো তো।একপাল শক্তিমান ছেলে নিয়ে এখানে শুটিং করতে এসেছে।আহাম্মক কোথাকার।”
_” ওকে স্যার।”
ইউসুফ উপরে চলে গেলে মামুনও দরজা আঁটকে দেয়।তবে মাথা থেকে বিভ্রান্তিটুকু ঝেড়ে ফেলতে পারে না।কাল থেকে ভালোভাবে নজর রাখতে হবে।এ বাড়িতে কয়েকটা সিসি ক্যামেরা আছে।কিন্তু জিনিসগুলো নষ্ট।একা থাকতো বলেই কখনো সিসি ক্যামেরার দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি।তাই একবার নষ্ট হওয়ার পর আর নতুন করে লাগানো হয়নি।বিরাট ভুল হয়ে গেছে।ভবিষ্যতের চিন্তা মাথায় রাখা উচিৎ ছিল।তবে ভুলের জন্য খুব বেশি অনুতপ্ত হয় না মামুন।বিকল্প খুঁজে নেয় মুহূর্তেই।কালকে থেকে সবার উপর নজর রাখবে।কারো উল্টো-পাল্টা কাজ-কর্ম চোখে পড়লেই কট করে ধরে ফেলবে।এই ভেবে নিচ তলায় তার জন্য বরাদ্দ ঘরে চলে যায়।মামুন নামের ছেলেটা আহমেদ ইউসুফের যোগ্য শিষ্য বটে।
হাত-পা-মেরুদন্ড-ঘাড় সব একসাথে গুটিয়ে বসে ছিল সোনালী।বাড়ির দরজা বন্ধ হতেই হাত-পা ছড়িয়ে মাটিতে লেপ্টে বসে পড়ে সে।এতোক্ষণের আটকে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়ে।হাঁপড়ের মতো উঠা-নামা করে তার বুক।আকাশের দিকে তাকিয়ে লম্বা দম নেয়।বাম হাতের উল্টোপিঠে ঠোঁটের উপর জমে থাকা ঘামগুলো মুছে নেয়।তারপর পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছে নেয় সারা মুখ,গলা,ঘাড়। বেশ কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় সোনালী।বাড়ির সব আলো নিভে গেছে।আশপাশটা পুরো ভূতের বাড়ির মতো লাগছে। মনে হচ্ছে যেন,পথ ভুলে ভুল করে সোনালী মানুষের রাজ্য ছেড়ে ভূতের রাজ্যে চলে এসেছে।এখনই ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করবে,নুপুরের আওয়াজ পাওয়া যাবে,মানুষের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসবে দূর থেকে।ভূতের ছবিগুলোতে তো এসবই দেখায়।অবশ্য এসব ঘটনা ঘটলেও খুব বেশি অবাক হবে না সোনালী।এই শয়তানের বাড়িতে জ্বিন-পরী না অস্বাভাবিক। অন্ধকারেই পাপাচারে পূর্ণ বাড়ির দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে সোনালী।সবকিছুর শেষ আছে।আহমেদ ইউসুফের পাপেরও শেষ আছে।তার শেষটাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে সোনালী।হাতেনাতে শুধু ধরার অপেক্ষা।প্রমাণগুলো একবার হাতে আসুক শুধু।রিমান্ডের মার আর বিখ্যাত ডিম থেরাপি কি জিনিস,তা হাড়ে হাড়ে বুঝবে এই হারামজাদা।বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে আরেকচোট হাসে সোনালী। দরজা-জানলা সে থোড়াই কেয়ার করে।এক পথ বন্ধ হয়েছে তো কি হয়েছে? আরো কত পথ আছে।আগে-পিছে নজর বুলিয়ে বাড়ির পিছনে পা বাড়ায় মেয়েটা।নিশাচর প্রাণীর মতো উবে যায় সারি সারি বয়স্ক গাছের আড়ালে।
***
খোলা জানলা দিয়ে ঝুপ করে এক চিলতে আলো ঢুকলো ঘরের ভিতর।আকাশে তেজি সূর্যের খরখরে রোদ।তপ্ত রোদ চোখ-মুখ ছুঁয়ে দিতেই ঘুম ভেঙে যায় তথার।আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে।দেয়াল ঘড়ির দিকে একবার নজর দেয়।সাতটা বাজে সবে।আজকে বোধহয় খুব গরম পড়বে।সাতটা বাজেই সূর্যের তাপে ত্বক পুড়ে যায়।তথা একবার সোনালীর দিকে তাকায়।উপুর হয়ে শুয়ে আছে মেয়েটা।ঘামে পিঠ ভিজে আছে।তথা নেমে জানলায় পর্দা টেনে দেয়।সোনালীকে ডাকে না আর।মেয়েটা ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক।
তৃপ্তি সহকারে ঘুমাতে পেরে শরীরটা খুব ফুরফুরে লাগছে তথার।ব্রাশ করে ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুতেই শরীরে আলাদা প্রশান্তি আসে।এদিকের পানি অনেক ঠান্ডা যা এই গরমে স্বস্তি দেয়।সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই খুব ক্ষুধা পেয়ে গেল তথার।হাম্মামখানা থেকে বেরিয়ে রুম থেকে পার্টস নেয়।এবাড়িতে রুমে রুমে গোসলের জায়গা নেই।গোসল করতে হয় দোতলার এককোনে অবস্থিত হাম্মামখানায়।এটা নাকি আগে অন্দরমহলের মেয়ে -বউদের গোসলের জায়গা ছিল।বিশাল এক ঘরে বালতিতে বালতিতে পানি রাখা।এখন অবশ্য দুটো ঝর্ণা ও সাত-আটটা পানির কল আছে।এগুলো নতুন লাগানো হয়েছে।
তথা নিচে নেমে কাউকেই দেখতে পায় না।কেউ বোধহয় ঘুম থেকে উঠেনি এখনো।তথা এদিক-ওদিক নজর বুলিয়ে বাড়ির বাইরে পা রাখে।দিনের আলোয় সবটা চকচক করছে।বিশাল কয়েকটা নারিকেল গাছ আছে এখানে।উঠোনের থেকে একটু দূরে গেলেই বিশাল এক পুকুর নজরে পড়ে।ঘাট বাধানো পুকুর।ঘাটের একাংশ ভেঙে ইট বেরিয়ে আছে।একটা আমগাছ হেলে আছে পুকুরের পানির দিকে।একটা গাছের সরু পাতা বেরিয়ে আছে ঘাটের পাশ দিয়ে।গাছটা চিনে তথা।ওদের গ্রামে এটাকে পাটিগাছ বলে।ঘাস দিয়ে পুরো জায়গাটা পূর্ণ হয়ে আছে।পুকুরটা অব্যবহৃত। তথার খুব ভালো লাগলো এদিকটা।তথাদের ব্যস্ত শহরে সকালের এমন স্নিগ্ধ দৃশ্য দেখা যায় নাকি?পুকুরের দিকে ভালোভাবে তাকাতেই শাফিনকে চোখে পড়ে।ওপাড়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে তথার দিকে।তথা চোখ ফিরিয়ে নেয়।শাফিনকে তার মোটেও পছন্দ না।লোকটার কথা-বার্তা কেমন যেন নিম্নশ্রেণীর। প্রথমদিন তথাকে কি বাজে ইঙ্গিতটাই না করলো!তথা নাকি সুন্দর বলে চান্স পেতে কষ্ট হয়নি।ছিঃ! কি বাজে কথা।
_” কামিনী ফুল, আপনি এদিকে কি করছেন?”
তথা হতাশ চোখে তাকায় ইউসুফের দিকে।আবার কামিনী ফুল।হাহ! কতবার বলবে,ওর নাম তথা।তথা খানিক বিব্রত হয়ে বলেঃ ” আপনি আবার ভুল করছেন।আমি কামিনী ফুল নই,আমি তথা।”
_” আচ্ছা,বাদ দিন।এদিকে কি দেখছেন?এটা তো দেখার মতো পুকুর না।”
_” এদিকটা খুব সুন্দর।”—তথা অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নেয়।লোকটা মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর।খুব বেশি তাকিয়ে থাকা যায় না।চোখ ধাধিয়ে যায় একদম।
_” এদিকেই দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি কোথাও যাবেন?”
_” এখানে কোনো খাবারের দোকান পাওয়া যাবে? যেকোনো একটা শুকনো খাবারের প্রয়োজন ছিল আমার।”
_” আপনার ক্ষুধা পেয়েছে?”
_” হ্যাঁ, কিছুটা পেয়েছে।”
_” তাহলে চলুন কিছু খেয়ে আসি।এদিকে নাকি একটাই চায়ের দোকান আছে।অবশ্য আমিও খুব বেশি একটা চিনি না। ”
ইউসুফের সাথে পা মেলায় তথা।কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করেঃ” আপনি কি গ্রামে ছিলেন না কখনো?জন্মের পরেই ঢাকা চলে গেছেন?”
_” আমার জন্ম তো এইদেশে না।বিদেশে জন্মেছি আমি।”
_” কোন দেশ?”
_” পাকিস্তান।আমি জন্মগত পাকিস্তানী।আমার বাপ-দাদারা এদেশের হলেও আমি পাকিস্তানের। আপনাদের দেশের মানুষেরা আমার বংশের সবাইকে মেরে ফেলেছে।শুধু আমার বাবা-মাই বাঁচয়ে পেরেছেন ওদের হাত থেকে।”
_” কেন?আপনার বংশ কি এমন করেছিল?আপনারা না জমিদার ছিলেন?–তথার আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে।তা দেখে মুচকি হাসে ইউসুফ। তথার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে উদাস গলায় বলেঃ” আমরা বংশগত রাজাকার।মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বংশের সবাই শান্তি কমিটির সদস্য ছিল।যুদ্ধের শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতেই তাদের প্রাণ গেছে।”
চলবে….
চলবে….