ডাহুক নদীর তীরে পর্ব -০৭+৮

#ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-৭)
#হালিমা রহমান

ডানহাতের কনুই দিয়ে সোনালীর পেটে মৃদু আঘাত করে তথা। নিচু স্বরে বলেঃ” কি বলছো এগুলো?পাগল নাকি তুমি?”

_”আরে এত সৌন্দর্য আমার হজম হয় না।ছেলেটা কি সুন্দর! ভালো করে দেখ।একদম তুর্কি নায়কদের মতো দেখতে।”

_”ছেলে বলছো কেন?আঙ্কেল বলো। তোমার চাইতে তার বয়স অনেক বেশি হবে বোধহয়। দেখলেই বুঝা যায়।”

সোনালী মুখটাকে চুপসে ফেলে।তথার হাত চেপে ধরে বলেঃ” প্রেমের ঢেউয়ে ভেসে যাবে বয়স।বয়সের কারণে এতো সুন্দর ছেলেটাকে কিছুতেই আঙ্কেল বলতে পারব না।ক্রাশকে কেউ আঙ্কেল বলে?আমি তার নাম ধরে ডাকব। আমার কোকিল কন্ঠে সহস্র মাইল দূর থেকে গলা উচিয়ে বলব-ওগো অমুক,চলো প্রণয়কাব্যের সুখী দম্পতি হই।আমাদের প্রেমের সাক্ষী হোক জগৎ-সংসার।প্রেমের জোয়ারে ভাসিয়ে ভেসে যাই আমরা,ভেসে যাক বিশ্বের সবাই।”

সোনালীর কথা বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলে তথা।মুখ টিপে বলেঃ ” ইঁচড়েপাকা মেয়ে।এই বয়সেই এতো! আরেকটু বড় হলে কি করবে?”

_” কি জানি।আমি বোধহয় বিশ্বপ্রেমিকা হব।রাস্তা-ঘাটে সুন্দর ছেলে দেখলেই প্রেমে পড়বো।”

ডিরেক্টর আখতার হোসেন এগিয়ে যান ইউসুফের দিকে।প্রায় পাঁচ বছর যাবৎ পরস্পর পরিচিত তারা।এই পাঁচ বছরে সম্পর্কে জোয়ার-ভাটা হয়েছে অনেকবার।কখনো উন্নতি,কখনো অবনতি।তবে,সম্পর্কটা টিকে আছে এখনো। উর্ধতন-অধস্তনের সম্পর্ক। ইউসুফের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়ান ডিরেক্টর। ইউসুফ বয়সে ছোট হলেও তাকে তোয়াজ করে চলেন ডিরক্টর।ইউসুফের সামনে গেলেও তার হাঁটু কাঁপে।

_” মি. হোসেন, পৌঁছাতে এতো দেরি হলো যে?”

_”রাস্তায় জ্যাম ছিল,স্যার।তাছাড়া এতো দূরের রাস্তা, ব্রেক নিতে হয়েছে অনেকবার।”

_”ওহ।তা আপনার টিম মেম্বারদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিন।একটু আলাপ হোক। ”

_” জ্বি স্যার।”

আখতার হোসেন বার দুয়েক কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করেন।সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে বলেনঃ ” ইনি আহমেদ ইউসুফ।এই বাড়ির মালিক তিনি। আমাদের প্রজেক্টে বড় একটা এমাউন্ট ইনভেস্ট করেছেন স্যার।এখানের অর্ধেক ব্যয়ভার স্যার বহন করবেন।”

_” পার্টনারশিপের কাজ নাকি এটা?”— ডিরেক্টরের কথার শেষেই শাফিনের প্রশ্ন শোনা যায়।

_ ” হ্যাঁ। ”

_” কিন্তু এগ্রিমেন্ট পেপারে লেখা ছিল এটা একক প্রযোজনার কাজ।”

_” স্যার আনঅফিশিয়ালি ইনভেস্ট করেছেন।তাই একক প্রযোজনার কথা লেখা হয়েছে।”

_ ” এটা আবার কেমন নিয়ম?”

_” নিয়ম-কানুনের ব্যাপারে তোমার চাইতে আমি বেশি ভালো জানি, শাফিন।”— খুব কঠিন শোনায় ডিরেক্টরের গলা।

শাফিনের দিকে একবার নজর দেয় ইউসুফ। এখানে হাতেগোনা দশটা ছেলে আছে।দশটা ছেলের মাঝে পাঁচটাই ডিরেক্টরের লোক।বাকি পাঁচটা বাইরের।সবার মাঝে এই ছেলেটাকে ভিন্নরকম লাগে।অনেক মানুষের মাঝেও তার দিকেই চোখ আটকায় আগে।জীম-টীম করে বোধহয়।আকর্ষণীয় চেহারা।পোশাক-পরিচ্ছদ জানান দেয় সে অভিজাত ঘরের ছেলে।গলার স্বরটাও বেশ সুন্দর।ডিরেক্টরের উপরে রেগে যায় ইউসুফ।মনে মনে অশ্রাব্য কিছু গালি দেয়।এই ঘোড়ার শুটিংয়ের জন্য এতো সুন্দর ছেলের দরকার ছিল?শালা আসলেও একটা বলদ।

_” স্যার,আপনি কিছু বলবেন?না বললে সবাইকে ভিতরে নিয়ে যাই?অনেকটা দূরের রাস্তা অতিক্রম করে এসেছে। “— মামুনের কথায় কিছু বলে না ইউসুফ।সোজা হয়ে দাঁড়ায়।তথার দিকে আলগোছে একবার চোখ বুলায়।সুন্দর মুখটা শুকিয়ে আছে।উৎসুক চোখে এদিকেই তাকিয়ে আছে সে।ইউসুফ অনুতপ্ত হয়। আরেক ছেলের দিকে নজর দিতে যেয়ে প্রেয়সীর কষ্ট চোখে পড়লো না।বাস থেকে নেমে এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে তার।

_” গুড ইভিনিং। আমি আহমেদ ইউসুফ। এই বাড়িতে থাকাকালীন আপনাদের সমস্ত দায়-দায়িত্ব আমার।তাই আশা করছি কোনো সমস্যা হবে না।সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন।আমার বাড়িতে আপনাদের স্বাগতম।ভিতরে আসুন, প্লিজ।এতোক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ”

ইউসুফ ভিতরে পা বাড়ায়।সদর দরজা থেকে বাড়ির ভিতরের দিকে চলে গেছে এক প্রশস্ত রাস্তা।অমসৃণ পথের দু’ধারে ছোট ছোট নুড়িপাথর।তথার কাঁধে একটা মাঝারি আকারের ব্যাগ।সোনালীর কাঁধেও।বাকি সবার কাছে লাগেজ।ইউসুফের পিছে মামুনও বাড়িতে প্রবেশ করেছে।ডিরেক্টর সবার সামনে এসে দাঁড়ান।মুচকি হেসে বলেনঃ ” চলো তাহলে।তোমাদের যাত্রা শুভ হোক।”

_” এতোক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখার কোনো মানে আছে? ম্যানার্স নেই কোনো।ইউজলেস।”

পুনমের কন্ঠে বিরক্তি ঝরে পড়ে। দীর্ঘ ভ্রমণের পর এতো নিয়ম-কানুন পালন, ভদ্রতা দেখানো সত্যিই কষ্টকর।তবে পুনমের কষ্ট বা বিরক্তি কোনোটাকেই গুরুত্ব দিলেন না আখতার সাহেব।পুনমের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললেনঃ” তোমার ধারালো জ্বিভকে সংযত করো, পুনম।এটা তোমার মামাবাড়ি নয় যে যখন আসবে তখনই তোমাকে আদর করে ঘরে তুলবে সবাই।ভিতরে এসো সবাই।”

তথার পিছু পিছু সোনালী হাঁটে।লোহার দরজার কাছে দুটো বাতি।বাতি দুটো হলেও আলো খুব কম।এই আলোতে সামনের দু-হাত দেখা যায় কেবল।তথা ফোনের আলো জ্বালে।এদিক-ওদিক ফোন ঘুরিয়ে বাড়ির সামনের দিকটা দেখে।সদর দরজা থেকে মূল বাড়িতে যাওয়ার জন্য অনেকটা পথ অতিক্রম করতে হয়।প্রশস্ত পথের দু-ধারে সাড়ি সাড়ি সুপারি গাছ।বাড়ি ও এই পথটুকুই পাকা করা।এই জায়গাটুকু দিয়ে পুরো উঠানটাকে দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে।উঠোনের উত্তরদিকে এক বিশাল অশ্বত্থ গাছ চোখে পড়ে।গাছের নিচে একটা বাঁশের বেঞ্চ।মাটি থেকে এর উচ্চতা তিন ফুট হবে বোধহয়।অশ্বত্থ গাছের পাশেই একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ।বিশাল ডাল-পালা ছড়িয়ে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে যেন।আরো নাম না জানা অনেক গাছ আছে এখানে।বাড়িটাকে নতুন রঙ করা হয়েছে তা দেখলেই বুঝা যায়। মূল ভবনের দু’পাশে মোটা মোটা দুটো থাম।থামের সামনে উঁচু ত্রিকোণ বেদির মতো একটু জায়গা। তার উপর বিশাল এক বাজপাখি।পাখির পুরো দেহ ও ডানাদুটো হয়তো জমিদার বংশের আভিজাত্যের প্রতীক।সাত-আটটে সিড়ি বাওয়ার পর কাঠের দরজা চোখে পড়ে।মামুন ও ইউসুফ দরজার এককোনে দাঁড়িয়ে আছে।সবাই পৌঁছালে দরজা খুলে সবাইকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে ইউসুফ। প্রথম ঘরটাই বসার ঘর।ঘরের মাঝে রং-বেরঙের বিশাল তিনটে সোফা।সোফার পিছনে উত্তর দিকের দেয়ালে একটা বিশাল তৈলচিত্র।তৈলচিত্রে শোভা পাচ্ছে এক বলিষ্ঠ সুপুরুষ । গোঁফে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। একদম জীবন্ত যেন।তথা অভিভূত হয়।অজান্তেই বলে ফেলেঃ” বাহ! খুব সুন্দর তো।ইনি কে?”

_” ইনি আমার দাদা।জমিদার আহমেদ জুলফিকার। আমাদের বংশের সর্বশেষ জমিদার।”

_” ওনাকে অনেকটা ইউরোপীয়ানদের মতো দেখায়।বিশেষ করে চোখ দুটো।নীল চোখ আমাদের দেশে সচরাচর দেখা যায় না।ওনার চোখ দুটো কিন্তু খুব সুন্দর।যেন চোখের মাঝে এক বিশাল মহাসমুদ্র ধরে রেখেছেন।”— তৈলচিত্রের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কথাগুলো বলে তথা।

_” আমার বড়মা মানে দাদার মা ছিলেন ইউরোপীয়ান। বড়বাবা যখন জমিদার ছিলেন তখন এদিকে ঘুরতে আসেন ইংল্যান্ডের নাগরিক উইলিয়াম ফ্রেডারিক এবং তার মেয়ে ফিয়োনা।আগের জমিদারদের অবস্থা তো শুনেছেনই।ইংরেজদের সাথে বেশ শখ্যতা ছিল তাদের।বড়বাবার আতিথেয়তায় খুশি হন তারা।বড়বাবার উপর বেশ সন্তুষ্টও হন।ফ্রেডারিক খুশি হলেন আর তার মেয়ে ফিয়োনা বড়বাবার প্রেমে পড়লেন।বড়বাবাও ছিলেন অবিবাহিত। বড় মায়ের প্রস্তাব অমান্য করতে পারেননি।দুজনে শেষমেশ বিয়েই করে ফেললেন।আমার বড়মা এই বিয়ের জন্য ধর্মও ত্যাগ করেছিলেন।দাদা বড়মায়ের চোখ পেয়েছেন।তাছাড়া, পড়াশোনার জন্য তিনি বেশ কয়েক বছর তার নানার কাছে ইংল্যান্ডে ছিলেন।বুঝতেই পারছেন,চেহারায় অনেকটা বিদেশিদের ছাপ চলেই এসেছে।”

_ ” ভেরি ইন্টারেস্টিং। আপনি কি আপনার দাদাকে দেখেছেন?”

_” উঁহু। আমার জন্মের প্রায় পনেরো বছর আগে মারা গেছেন দাদা।এসব আমি বাবার কাছে শুনেছি।”

তথার আগ্রহ দেখে মুচকি হাসে ইউসুফ।নাতিকে রেখে দাদাকে পছন্দ করেছে এই মেয়ে।আশ্চর্য! ছবির মৃত সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে লাভ আছে?তার হাত কয়েক দূরেই তো জীবন্ত এক সৌন্দর্য দাঁড়িয়ে আছে। তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলে কি হয়?ইউসুফ কোনদিক দিয়ে কম।এরকম ছেলে কি আর কোথাও দেখেছে তথা?

_” আপনারা আমার পিছু পিছু আসুন।সবার থাকার ব্যবস্থা দোতলায় করা হয়েছে।”—মামুন সিড়ির কাছে যেয়ে দাঁড়ায়।
ডুপ্লেক্স বাড়ি।বসার ঘরের এককোনেই কাঠের সিড়ি।সিড়ির একপাশে একটা নারীমূর্তি।এই ঘরে মূর্তির অভাব নেই।এখানে-ওখানে প্রায় ছয়-সাতটা মূর্তি আছে। আছে বিশাল একটা টেবিল ও খান পাঁচেক ফুলদানী।বিশাল ঘরে তিনটে জানলা।জানলায় মোটা পর্দা টেনে দেওয়া।এককোনে একটা পিয়ানো চোখে পড়ে।তবে পিয়ানোটা বোধহয় কেউ বাজায় না।পিয়ানোর উপরটায় খানিক ধুলো জমে আছে।তথা চোখ ঘুরিয়ে পুরো ঘরটা দেখলো।আদর্শ শুটিং স্পট বটে।দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।

মামুনের আগেই পুনম উঠে যায় সিড়ি বেয়ে।তার আচরণে বিরক্তি যেন ফুটে বেরোচ্ছে।কি অসামাজিক! তথা মুখ বাকায়।তথার পাশে থাকা সোনালীর চোখেও পুনমের এই আচরণ খট করে বাজে।তথার কানের কাছে ফিসফিস করে বলেঃ” এটা কে গো, তথা আপু?ভদ্রতা নেই নাকি?”

_” আস্তে সোনালী।এটাই নায়িকা।ওর নাম পুনম।”

_” এটাই নায়িকা! ছিঃ! কি অভদ্র।”

সোনালীর কথায় কিছুই বলে না তথা।সিড়ির এককোনে যেয়ে দাঁড়ায়।অন্যরা উপরে উঠছে।তথার বিপরীতেই ইউসুফ দাঁড়ানো।সে আড়চোখে তথার দিকে তাকায়।ঘর্মাক্ত মুখে লেপ্টানো কাজল, সাথে অগোছালো একগোছা চুল–নিতান্ত মন্দ নয়।সিল্কি চুলগুলো বিনুনি করা।মেয়েটা চুলে তেল দিতেই পারে না।তেল দিলে নাকি গরম লাগে।তাই হাজার চিরুনি চালালেও তথার চুল অগোছালো থাকবেই।এখনো চুলগুলো অগোছালো।বিনুনির বাইরে ছোট চুলগুলো বেরিয়ে আছে।কিছু চুল কপালে,কিছু চুল কানের দুলের সাথে গলার কাছে লেপ্টে আছে।মুহূর্তেই ইউসুফের মনে অবাধ্য কিছু ইচ্ছে জাগে।ইচ্ছে হয় তথার চুলগুলোতে চিরুনি চালাতে, চুলগুলো গুছিয়ে বিনুনিতে বাধতে ইচ্ছে হয়,সযত্নে লেপ্টে যাওয়া কাজল মুছে দিতে ইচ্ছে হয়,গলার কাছে -নাকের কাছের ঘামগুলো আদুরে ভঙ্গিতে মুছে দিতে ইচ্ছে হয়।শরীরে শিহরন জাগে ইউসুফের। মেয়েটা নিশ্চিত এক জাদুকরী। নাহয় পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে হঠাৎ করে বসন্ত আসবে কেন ইউসুফের জীবনে?এতোকাল কোথায় ছিল এই বসন্ত? কোথায় ছিল এতো প্রেম,এতো রঙ? মেয়েটা হুট করে সামনে এলো।একা আসেনি সে।এসেছে ঘোর বর্ষা নিয়ে।না,না বর্ষা নয়।ঘোর বসন্ত নিয়ে এসেছে সে।ইউসুফের রঙহীন জীবনে সে এসেছে বসন্তের এক দমকা হাওয়ায় চেপে।
ইউসুফের পাশ দিয়ে ধীরপায়ে সিড়িতে উঠে তথা।বাড়ির পরিবেশে অর্ধেক ক্লান্তি কেটে গেছে তার।রুমে যেয়ে এখন ঠান্ডা পানিতে গোসল করবে সে।তারপর বাড়িতে কথা বলবে। কথার শেষে একটা লম্বা ঘুম দেবে।আহ! চারদিকে শুধু শান্তি।
তথা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ইউসুফের নাকে ধাক্কা দেয় তীব্র জেসমিনের ঘ্রাণ।এ যে তথার পারফিউমের ঘ্রাণ তাতে সন্দেহ নেই।তবে এই কৃত্রিম ঘ্রাণেও অভিভূত হয় ইউসুফ।মোহাবিষ্টের ন্যায় সেও ধীরপায়ে তথার পিছু পিছু হেঁটে চলে।সেদিকে আহাম্মকের মতো চেয়ে থাকে সোনালী।অজান্তেই ইউসুফ তার পা মাড়িয়ে দিয়েছে। ইঁচড়েপাকা সোনালীর চোখে ইউসুফের মোহ ধরা পড়ে।নগ্নভাবে ধরা পড়ে তথার জন্য ইউসুফের চোখের মুগ্ধতা।ভয়াবহ আহত হয় সোনালী।মুখটা চুপসে আসে তার। অজান্তেই মুখ ফুটে বেরিয়ে আসে আক্ষেপের সুর

_” তথা আপুতেই কেন মুগ্ধ হতে হবে ইউসুফ?আপনার জুলেখা পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।তা কি আপনার চোখে পড়ছে না?”

_” জুলেখা বলবেন না ছোট্ট মেয়ে।স্যারের মায়ের নাম বিবি জুলেখা।আপনি যদি সেই নাম নিয়ে প্রেমের প্রস্তাব দেন, তাহলে দেখা যাবে স্যার আপনাকে মা বলে ডাকা শুরু করবে।আমি শুভাকাঙ্ক্ষী তাই আগেই নিষেধ করলাম।নাহয় আপনার ছোট মাথায় তো এসব ঢুকবে না।”

একগাল হেসে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে আয় মামুন।পিছনে ফেলে যায় হতভম্ব সোনালীকে।সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে।ওই নাক বোচা লোকটা তাকে তাচ্ছিল্য করলো নাকি বিদ্রুপ? নাকি একসাথে দুটোই?
#ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-৮)
#হালিমা রহমান

_” আমি ঠিকঠাক পৌঁছাতে পেরেছি, কাকি।এবার তো কান্না থামাও।”

কান্না থামে না আকলিমা খাতুনের।মুখে আঁচল গুজে আওয়াজ বন্ধ করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন।ধরা গলায় বলেনঃ” গাড়িতে বমি করছিলি?”

_” না।বমি এসেছিল একবার। পরে তেঁতুলের আচার খেয়েছি।”

_” আচার কিনছিলি?”

ইরফানের কথা উল্লেখ করে না তথা।আকলিমা খাতুনের সাথে একটুখানি মিথ্যা বলে।

_” হ্যাঁ, কাকি।বাস স্টেশন থেকে কিনেছিলাম।”

_” রাইতে খাইছোস?”

_” না,এখনো খাওয়া হয়নি।মাত্র গোসল করলাম।”

_” খাওয়া-দাওয়া করবি ঠিকমতো।আর সময় কইরা ফোন দিবি।তাইলে রাখ এখন।কিছুক্ষণ ঘুমায় থাক।’

আকলিমা খাতুনকে ফোন রাখতে দেয় না রুবাইদা ও মাহাদী।তারা এতোক্ষণ মায়ের কানের সাথে কান লাগিয়ে রেখেছিল।আকলিমা খাতুনের কথা শেষ হতেই, রুবাইদা ছো মেরে ফোন নিয়ে নেয়।একরাশ আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করেঃ” তথাপু,তোমার কেমন লাগছে?”

_” খুব ভালো।জানিস রুবি,বাড়িটা ভীষণ সুন্দর।নাটক-সিনেমায় জমিদার বাড়িগুলো যেমন দেখায়,ঠিক তেমন।”

_” ভিডিও কল দেও না,একটু দেখি।”

_” নেট প্রবলেম অনেক।কথা বলার জন্য বাইরে এসেছি।ভিডিও কল দেওয়া যাবে না।আমি ছবি তুলে রাখব সবকিছুর।আসলে দেখিস।বিকালে খেয়েছিস কিছু?”

_” হ্যাঁ। ফুচকা খেয়েছিলাম।”

_” ভালো।ঠিকভাবে থাকিস।রাখছি এখন। মাথা ব্যাথা করছে খুব।”

_” আচ্ছা।ভালো থেকো।আল্লাহ হাফেজ।”

ফোন রেখে দেয় তথা।এই প্রথম ঢাকা থেকে এতোদূর এসেছে সে।খানিক অসুস্থ লাগছে।তবে সেগুলোকে পাত্তা দিলে চলবে না।তাই সামান্য অসুস্থতাকে গায়ে মাখলো না তথা।বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ঘরে নেট পাওয়া যাচ্ছিলো না।তাই বাইরে এসেছে সে।লোহার গেটটা তালা মারা।এই বাড়িতে বোধহয় মামুন ও ইউসুফ ছাড়া কেউ থাকে না।এখন পর্যন্ত একটা কাজের লোকও চোখে পড়লো না তথার।বাড়িতে ঢুকার জন্য মোবাইলের আলো জ্বালতেই টুংটাং শব্দে ম্যাসেজ আসে তথার ফোনে।

_” পৌঁছে গেছো?”

পরিচিত নম্বর।ইরফানের নম্বর দেখেও কপাল কুঁচকায় না তথা।ইরফানের জন্য তার খারাপ লাগে খুব।লোকটা কেমন যেন।খুব ক্ষ্যাপাটে আর পাগলাটে।মাঝে মাঝে মনে হয়, ইরফান সত্যিই তথার প্রতি খুব দূর্বল।শত হলেও তথার নারী হৃদয়। মায়া-মমতা-দূর্বলতা তারও আছে।ইরফানের আজকের আচরণে খুব অবাক হয়েছে তথা।বাস স্টেশনে কি পাগলামিটাই না করলো!

_” কামিনী ফুল,আপনি এখানে কি করছেন?”

ইউসুফের প্রশ্নে অবাক না হয়ে পারে না তথা।বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করেঃ ” আপনি আমাকে বলছেন?আমার নাম তো কামিনী ফুল না।আমি তথা।”

_” ওহ,সরি।আমি গুলিয়ে ফেলেছিলাম।এতো রাতে এখানে কি করছেন?”

_” ফোনে কথা বলতে এসেছি।ঘরে নেট পাচ্ছিলাম না।”

_” এই ভুলটা আর করবেন না,মিস। সবাই বলে এই বাড়িতে ভূত আছে।অনেক রকমের আওয়াজ পাওয়া যায় রাতে।”

_” সত্যি! আপনি পেয়েছেন কখনো?”

_”আমি তো এই বাড়িতে সবসময় থাকি না।গ্রামবাসীরা বলে,এখান থেকে নাকি রাতে মেয়েদের কান্নার আওয়াজ শোনা যায়।কয়েকদিন আগেও মন্দিরের পুরোহিত অজ্ঞান হয়েছেন এই বাড়ির সামনে।”

গায়ে কাটা দেয় তথার।ভূত-প্রেত বিশ্বাস না করলেও জ্বীন-পরীতে অনেক বিশ্বাস তার।এরা তো আর মিথ্যা নয়।পরিত্যক্ত খোলা বাড়ি, দুষ্টু জ্বীন থাকা অসম্ভব কিছু না।দ্রুতপায়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় তথা।শরীর ভারী ভারী লাগছে একটু।ভয়ের চোটে ইরফানের ম্যাসেজের উত্তর দেওয়া আর হলো না।তথাকে ভয় পেতে দেখে খুব মজা পায় ইউসুফ।খোলা আকাশের নিচে গা দুলিয়ে বেশ কিছুক্ষণ প্রাণখুলে হাসে সে। মিনিট পাঁচেক পর পা বাড়ায় বাড়ির পিছনে।খানিকক্ষণের মাঝেই হারিয়ে যায় বড় বড় গাছের আড়ালে।

***

ইরফানের বাড়ির পিছনে একটা মাঠ আছে।তাদের বাড়ির শেষ সীমানা হিসেবে এই মাঠটাকে ধরা হয়।ইরফানের বাবা, সাজ্জাদ সাহেব সস্তার সময় এই জায়গাগুলো কিনে রেখেছিলেন।লোকটা খুব দূরদর্শী। শূন্য থেকে উঠে এসেছেন একদম।একসময় যার নুন আনতে পানতা ফুরাত,তার এখন জমজমাট অবস্থা।বিশাল এক বাড়ি করেছেন,ছোট ছেলেটাকে বিদেশে পড়াচ্ছেন,বড় মেয়েটাকে ডেন্টালে পড়িয়েছেন, ইরফানকে ব্যবসা দিয়ে দিয়েছেন।ধানমন্ডিতে যেই রেস্টুরেন্টটা ইরফানের নামে লেখা,সেটা আগে সাজ্জাদ সাহেবের একক সম্পত্তি ছিল।এই রেস্টুরেন্ট আগে ছিল না।এটা সামান্য ভাতের হোটেল ছিল। টিনশেড হোটেলের এককোনে চটের বস্তার আড়ালে ভাত রান্না হতো।চুলার পাশেই পিঁড়ি পেতে বসে সাত-আট পদের ভর্তা বানাতেন ইরফানের মা খালেদা বানু।আলু ভর্তা, ডিমের ভর্তা,ডালের ভর্তা আরো কত কি।ভাত শেষে বেশি আলু দিয়ে মুরগীর মাংসের ঝোল রাঁধতেন।এরপর কোনো একটা মাছ ভেজে নিতেন।এই ছিল হোটেলের রেসিপি।কখনো কখনো ভোর থেকে কাজ শুরু করতেন খালেদা বানু।একটা মাত্র চুলা,একটা মাত্র রাঁধুনী।খাবার শেষে আবার প্লেট,গ্লাস তাকেই ধুতে হতো।সাজ্জাদ সাহেবও বসে থাকতেন না।কখনো তিনি ওয়েটার আবার কখনো ক্যাশিয়ারের কাজ করতেন।হোটেলের কিছু দূরেই এক কামড়ার একটা রুম ভাড়া করে থাকতেন তারা।সেই নিম্ন অবস্থা অবস্থা থেকে উঠে এসেছেন সাজ্জাদ সাহেব।এককালে যেই মানুষটা নিজের হোটেলে সকাল-সন্ধ্যা খাটতেন,তার বাড়িতে এখন রাত-দিন তিনজন কাজের লোক খাটে।এক সময়ের রাঁধুনী খালেদা বানুকে এখন আর রান্নাঘরে যেতেই হয় না।রান্না-বান্না,কাটাকাটি, ধোয়া-মোছার জন্য আলাদা মানুষ আছে তার।
পরিবারের এতোটা নিম্ন অবস্থা আর কোনো ভাই-বোন না দেখলেও ইরফান দেখেছে।ইরফান সাজ্জাদ সাহেবের অভাবের ঘরের ছেলে।ইরফানের আজো মনে পড়ে সেই ছোট টিনশেডের হোটেলটার কথা।মায়ের আঁচল ধরে এককোনে বসে থাকতো সে।কখনো কখনো সিদ্ধ ডিমের খোসা ফেলে দিত আবার কখনো সিদ্ধ আলুর ছিলে দিত।বাবার সাথে ওয়েটারের কাজও করেছে বারকয়েক।ইরফানের যখন পাঁচ বছর,সাজ্জাদ সাহেব তখন বিদেশে পাড়ি জমান।ছোট হোটেলে হচ্ছে না।দিন বাড়ছে,ছেলে বড় হচ্ছে, খরচ বাড়ছে।হাত গুটিয়ে বসে থাকলে তো হবে না।ঘর-সংসার রেখে সেই দূর দেশ কাতারে পাড়ি দিলেন।দিনে তেলের কারখানায়, রাতে লোকাল ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কাজ করেছেন।দু-বেলা শুকনো রুটি খেয়ে, পরিবারকে ভালোভাবে চলার জন্য হাজার হাজার টাকা পাঠিয়েছেন। এভাবে বছর কয়েক থাকার পর যখন সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়লো,তখন দেশে চলে এলেন।হোটেল ভেঙে ছোট-খাটো রেস্টুরেন্ট দিলেন,মার্কেটে দোকান কিনলেন,পুরান ঢাকায় সস্তায় জমি কিনলেন।সময়ের সাথে সাথে অবস্থা ভালো হয়েছে,ব্যবসা-বাণিজ্য ফুলে-ফেঁপে উঠেছে।দোকানগুলো ভাড়া দিয়ে বড় ছেলেকে ব্যবসা বুঝিয়ে দিলেন সাজ্জাদ সাহেব।ছেলেটার জন্য তার কষ্ট হয় খুব।প্রথম সন্তান হলেও ইরফানের ঝুলিতে বাবার সঙ্গ,ভালোবাসা,স্নেহের পরিমাণ কম ছিল।এর প্রধান কারণ হয়তো অভাব।ভালোবাসা,স্নেহের প্রতিদ্বন্দ্বী যদি হয় অভাব;তবে ভালোবাসা সেখান থেকে লেজ গুটিয়ে পালায়।চাহিদা,অভাবের দিকে নজর দিতে যেয়ে ছেলের দিকে নজর দেওয়ার সময়ই পেলেন না।ইরফানটাও খুব অন্তর্মুখী। নিজের চাহিদার কথা, পছন্দের কথা,ভালোলাগার কথা কখনো মুখ ফুটে বলেই না ছেলেটা।বাবার সাথে একটা সম্পর্ক আছে বটে তবে সেরকম খোলামেলা স্নেহ-ভালোবাসার সম্পর্ক নেই।তাদের বাবা-ছেলের সম্পর্ক অনেকটা আপনি-আজ্ঞেতেই সীমাবদ্ধ। সাজ্জাদ সাহেব যখন দেশ ছাড়লেন, ইরফান তখন পাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলে।আবার সাজ্জাদ সাহেব যখন স্থায়ীভাবে দেশে ফিরলেন,ইরফান তখন বিশ বছরের উঠতি যুবক।এই বয়সের ছেলেরা বাবার কাছে সহজে হাত পাতে না,মন খুলে আবদার করে না, ইচ্ছার কথা জানায় না,ঘরের চাইতে বাইরে বন্ধু-বান্ধবদেরকে বেশি সময় দেয়। তাই তাদের বাপ-ছেলের সম্পর্কে অদৃশ্য একটা সীমারেখা চলেই এসেছে।

বাড়ির সাথের লাগোয়া মাঠে বসে আছে ইরফান।চারদিকে রাত নেমেছে আরো আগে।শহরে ঝুপঝাপ রাত নামে না।বহু আড়ম্বরে,বহু আয়োজনে একরাশ স্বস্তি নিয়ে রাত নামে এ শহরে।শেষ বিকেলেই এখানে ল্যাম্পপোস্ট আলো দেয়,বাসে বাদুরঝোলা হয়ে মানুষগুলো ঘরে ফিরে, ছেলে-মেয়েরা বাড়ি ফিরে।এতসব কাজের শেষে রাত নামে।ইরফান মাটিতে লেপ্টে বসে আছে। এখানে বসার মতো একটু উঁচু দেয়াল ছাড়া আর কোনো জায়গা নেই।ইরফানের বোন ইমা, অনেকবার তার বাবার কাছে একটা দোলনার আবদার করেছিল।কিন্তু অবহেলায় তা আর লাগানো হয়নি।তাছাড়া ইমা বাড়ি থেকে কম বেরোতো। তাই নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় আবদার ভেবেই সাজ্জাদ সাহেব মেয়ের ইচ্ছে পূরণ করেননি।ইরফান মোবাইলের ম্যাসেজ অপশনে আরেকবার ঢুঁ মারে।প্রতিবারের মতো এবারেও হতাশ হয় সে।না,যার জন্যে আজ তার মন খারাপ;তার পাত্তাও নেই।ইরফান দেয়ালের গায়ে হেলান দেয়।আজ প্রথমবারের মতো নিজেকে ভয়াবহ কিছু অশ্রাব্য গালি দিতে ইচ্ছে করছে।এতোটা নির্লজ্জ,মর্যাদাহীন কবে হলো সে?এতো অবজ্ঞা,এতো তাচ্ছিল্যের পরেও কেন তথার কথাই ভাবতে হবে তার?ইরফানের কি বিন্দুমাত্রও লজ্জা নেই?তথা কে যে তথার কথা ভেবে দেবদাস হতে হবে?নিজেকেই গোঁয়ারের মতো প্রশ্ন করে ইরফান।তার প্রশ্নের আগাগোড়া অভিমান জড়ানো। ইরফান নিজের মাঝেই ডুবে থাকে।মস্তিষ্ক বলছে–” তথা কেউ নয়।তথার চাইতে আত্মসম্মান বড়।যার আত্মসম্মান না থাকে সে আবার মানুষ হয় নাকি?তথা হয়তো একটু ভালোলাগার নাম।কিন্তু আত্মসম্মান অস্তিত্ব। তথাকে ভুলে যা ইরফান।ভালোলাগার প্রাসাদটাকে গুড়িয়ে ফেল।তথা চোরাবালি।ওতে মজে থাকতে নেই।তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।তারচেয়ে তথাকে পিছু ফেলে এগিয়ে যাওয়াই শ্রেয়।দিনশেষে কেউ তো আর তোকে নির্লজ্জ বলে তাচ্ছিল্য করতে পারবে না। ”

ইরফান অন্তকর্ণ খুলে রাখে। আচ্ছা,মন কি বলছে?তারও কি এক কথা?তথা কেবল একটুকরো ভালোলাগার নাম?ভাবনাতে বিভোর হয় ইরফান।তবে তার মন-মস্তিষ্ক সরলপথে চলে না।মন যেন ঘাড় ঝুকিয়ে ভয় দেখায়।সশব্দে নিষেধ করে ইরফানকে। মন বলছে–“কেন ভুলবি ইরফান?সে কোনো ঠুনকো অনুভূতি নয়।তথাকে তোর কবে থেকে ভালো লাগে, বলতো?সেই চব্বিশ বছর বয়স থেকে।অনুভূতির বয়স পাঁচ বছর।পাঁচ বছরে কত দিন হয়,কত মাস হয়,কত ঘন্টা হয়–তা কখনো হিসাব করেছিস?অনুভূতিগুলো বৃদ্ধ।তোর অনুভূতিকে শুধুমাত্র ভালোলাগায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না।এটা প্রথম প্রেম।সেই আদিকাল থেকে চলে আসা বিধ্বংসী প্রেম।প্রেমের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে দোষ কি?প্রেম-ভালোবাসায় আবার আত্মসম্মান কি বাপু?এতো রং-ঢং মেনে প্রেম করা যায়?”

তবে এবার আর মনকে পাত্তা দেয় না ইরফান।মস্তিষ্কের সাথেই তাল মিলায়।ঠিকই তো আত্মসম্মান সবকিছু।তথা তো ভালোবাসেনি।এখানে ইরফানের কোনো জোর নেই।সব চাবিকাঠি ঐ হৃদয়হীনার কাছে। মাথার চুল টেনে ধরে।ভালো লাগছে না কিছু।গলা শুকিয়ে আসছে,শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।মনে হচ্ছে আশেপাশে অক্সিজেনের খুব অভাব।আচ্ছা,ইরফান কি মরে-টরে যাবে।সে শুনেছে মরার আগে নাকি মানুষের অস্থিরতা বাড়ে।ইরফানের এখন সেই দশা।অস্থিরতায় দম আটকে আসছে তার।মেয়েটা পৌছালো কি না কে জানে! তথার চিন্তা মাথায় আসতেই আবারো অসহায়ের মতো হাত-পা ছেড়ে দেয় ইরফান।একটু আগেই ভাবলো তথাকে ভুলে যাবে।সেকেন্ডও যায়নি।দখলদারি মেয়েটা ঠিকই মনের কোনে পড়ে আছে।পুরো পাকিস্তানি হানাদার। যখন-তখন মন-মস্তিষ্কে হানা দেয়।

“যে জন প্রেমের ভাব জানে না
তার সাথে নাই লেনা-দেনা…

_” রাফায়েত থামবি? তুই দেখছিস আমার অবস্থা,তাও গান গাইছিস?আমি মনে হয় মরে যাব রাফায়েত।”

_” ধুর শালা মরবি না।পৃথিবীতে প্রেমের জন্য কেউ মরে না,বুঝলি।আর গানটা তোকে ডেডিকেট করে গাইলাম।তথা প্রেমের ভাব জানে না। তার সাথে আবার কীসের লেনাদেনা?তথাকে ভুলে যাও বৎস।মেয়েটা তোর সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ নয়।তাই তথাকে দোষ দেওয়া যায় না।দোষ তোরই।তোর যন্ত্রণার কারণ তুই নিজেই। ”

_” সবাই শুধু আমাকেই দোষ দেয়। মেয়েটাকে আমি ভালোবাসি,এটাই কি দোষ?”

_” না,এটা দোষ না।তবে প্রত্যাখ্যানের পরেও আঠার মতো লেগে থাকা দোষের।আচ্ছা,বাদ দে এসব।শ্যামলীতে গেলি আজকে, ইমার বাসায় গেছিস নাকি?”

_” না,বড় আপুর বাড়ি যাইনি আজকে।”

_” নিজের ছোটবোনকে কে বড় আপা ডাকে ইরফান?”

_” আমি ডাকি।সায়েম ছোটবেলায় ইমাকে বড় আপা ডাকতো।ওর সাথে সাথে আমিও ডাকতাম।অভ্যাস হয়ে গেছে।”

_” ইরফান,উঠ এবার।চল বাড়ি যাই।সারাদিন খাওয়া না, গোসল না—কি একটা অবস্থা।শালা,দেবদাস হবি তুই?”

_” জানি না।”

রাফায়েত দীর্ঘশ্বাস ফেলে।যত যাই বলুক না কেন,ইরফানের অবস্থা দেখে হাত-পা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার।মেয়েটা কি পাগল?এতো ভালোবাসা চোখে পড়ে না?তথাকে কষে গালি দিতে ইচ্ছে করে।রাফায়েতের সাধ্য থাকলে এই মুহূর্তে তথাকে ধরে এনে ইরফানের সাথে বিয়ে দিয়ে দিত।ভাইয়ের মতো বন্ধুর এতো যন্ত্রণা সহ্য হচ্ছে না তার।

_” বাস ছাড়ার আগে তথা কি বলেছে,জানিস?”

_” কি বলেছে?”

_” বলেছে,বাবা আমার বউ হিসেবে ওকে মানবে না।”

_” কথাটা কিন্তু খুব বেশি ভুল না।আর কেউ না জানলেও তুই তো জানিস,আঙ্কেল কতটা রক্ষণশীল।”

_ ” আগে এতোটা ছিল না।হুট করেই হয়ে গেছে।”

_” বয়স হওয়ার সাথে সাথে রুচি বদলেছে।তথার নাটকটা অন এয়ার হওয়ার পর, তোর বউ হিসেবে আঙ্কেল কখনোই তথাকে মেনে নিবে না।নায়ক-নায়িকাদেরকে সাধারণ বাঙালি পরিবারগুলো একটু অন্য চোখে দেখে। ”

_” সবাই কি এক হয়?”

_” হয়তো না।কিন্তু আমাদের মাঝে প্রচলিত ধারণাগুলো একইরকম। আমরা ধরেই নেই, ঘর-সংসার এসব নায়ক-নায়িকাদের জন্য নয়।তাছাড়া,তোর ক্ষেত্রে আরেকটা সমস্যা আছে।তুইও বোধহয় আঙ্কেলের কথার বাইরে কিছু করবি না।”

_” রাফায়েত আমার বাবা জীবনে অনেক কষ্ট করেছে।পনেরোটা বছর বিদেশে ছিল।কষ্ট ছাড়া হতদরিদ্র অবস্থা থেকে আজ এই অবস্থায় পৌঁছাতে পারেননি।বাবা এতোটা ত্যাগ স্বীকার না করলে হয়তো আমরা এতো ভালো অবস্থায় থাকতে পারতাম না।আমি হয়তো পড়াশোনা বাদ দিয়ে নিম্ন পদের কোনো কাজ করতাম।আমাদের জীবনকে সহজ করার জন্য যিনি মাথার ঘাম পায়ে ফেললো,তাকে কি অমান্য করব বল।বাবার কথার বাইরে জ্বিভ নাড়ার সাধ্য আমার নেই।”

_” এজন্যই তো বলছি,তথাকে ভুলে যা।এড়িয়ে চল।ভবিষ্যতে যা হবেই তার প্রস্তুতি এখন থেকেই নে।আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, তথার পেশার কারণেই তোদের বিয়েটা আটকাবে।তাছাড়া মেয়েটাও রাজি না।শুধু শুধু নিজের সম্মান খুইয়ে লাভ আছে?”

ইরফান দেয়ালে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়।তার দৃষ্টিতে বিচলতা।মাথার চুল এলোমেলো,গায়ের টি-শার্ট ঘামে ভেজা।মন স্থির করে ফেলে ইরফান।যা হবে না তা ভেবে লাভ নেই। তথা একমুঠো স্বপ্ন যাকে বাস্তবে ধরা-ছোঁয়া যায় না।তথা বাক্সবন্দি রঙিন প্রজাপতি।এক কল্প রাজ্যের সুখময় অনুভূতির নাম তথা।কল্প রাজ্যে এক মস্ত তালা ঝুলিয়ে দেয় ইরফান।আজ থেকে তথা বন্দি।তার কথা আর ভাববে না ইরফান।মিথ্যে স্বপ্নের দিকে আর হাত বাড়াবে না সে।নিজের ইচ্ছেতেই তো চললো এতোদিন। আজ থেকে নাহয় রাফায়েতের বুদ্ধিতেই চলবে।মন নয় মস্তিষ্কের কথায় তাল মিলাবে সে।তথা প্রথম প্রেম।ভুলে যাওয়া সহজ নয়।
তবে ইরফান চেষ্টা করবে।আপ্রাণ চেষ্টা করবে।তথার কথা মনে পড়লেই ধমক দিয়ে মনকে শাসন করবে।তথার নম্বর ডিলেট করে দেবে,তথার সব ছবি ডিলেট করে দেবে।তথাকে নিয়ে অনেক কথা ডায়রিতে লেখা আছে।সেসব পাতা কেটে কুচি কুচি করে ফেলবে। দেখাই যাক সেই ভয়ংকরীর মায়া থেকে বের হওয়া যায় কি না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here