ডায়েরি পর্ব ৮

#ডায়েরি_পর্ব_৮

জান্নাতুল জান্নাত

২২শে সেপ্টেম্বর ২০১৫ (রাত ১২টা বেজে ০৫ মিনিট)

অনেকদিন লেখা হয়নি৷ ৫ই আগস্টের পর আজই লিখতে বসলাম৷ এতোদিন বাসায় ছিলাম না৷ ৬ তারিখ বিকেলে শ্যুটিংএর কাজে হুট করেই কক্সবাজার গেলাম৷ ফিরলাম ১৪ তারিখ৷ কিন্তু থাকতে পারলাম না বাসায়৷ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অভিনয় করতে গিয়ে সেসব স্থানেই থাকতে হতো৷ একটানা বিদেশ যাওয়া ছাড়া এতোদিন বাসার বাইরে থাকিনি৷ কাজ মোটামুটি সারতেই থাইল্যান্ডে যাওয়ার টিকিট বুকিং করা হয়ে গেলো৷ বাসায় কোনভাবে এক রাত ছিলাম৷ তারপরই থাইল্যান্ড থেকে এ মাসের ২০ তারিখ রাতে ফিরলাম৷ মোটামুটি কাজগুলো সেরে আজ লিখতে বসলাম৷

এতোদিন বাসার বাহিরে ছিলাম৷ সবসময়ই বাইরে গেলে ছেলে মেয়ে তিনটিকে নিয়ে বেশ চিন্তা হয়৷ তনিমাকে একটু আঁচ দিয়েছিলাম আমি৷ ও কিছুটা বুঝেছে৷ তারপর থেকে নিজের ও ভাই বোনদের খেয়াল ঠিকভাবেই রাখে৷ এমনিতে মেয়েরা অল্প বয়সেই অনেককিছু বুঝে আর এ তো মা মরা মেয়ে৷ বাপ মা মরা ছেলেমেয়েগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিই বোঝে৷ জীবনের কঠিন বাস্তবতা এদের অনেককিছু বুঝিয়ে দেয়৷ তনিমাকে বাসায় রেখে আমার বরং উপকারই হয়েছে৷ ওহ্ কাল দিনটা মোটিমুটি ফ্রী আছি৷ তপুকে একটা ফোন করবো এখন৷ দেখি কাল যদি ও আমার সাথে একবার দেখা করে৷ ওর থেকে অনেককিছু জানার আছে আমার৷ আমি তনিমাকে বিদেশে পাঠাতে চাই তাতে তপুর মতামতের দরকার আছে৷ ভাবছি ২০১৬ এর মধ্যেই পাঠাবো৷ নয়তো দেরি হয়ে যেতে পারে৷ আমার চুক্তির ১০ বছর নয় মাস চলছে৷ বেশিদিন তো বাকি নেই৷ বিদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা, পড়ালেখা, থাকার ব্যবস্থা করতে করতেই ছয়মাস লেগে যাবে৷ অনিতা আর অর্ণবকেও পাঠিয়ে দিবো৷ মিছে মায়ার বাঁধনে বেঁধে কি লাভ? বরং আমার কাছে রেখে ওদের ভবিষ্যতটা নষ্ট করছি৷ বিদেশে যদি তিন ভাইবোনকে একসাথে রাখতে পারি তবে তনিমার শিক্ষায় ওরা বিপথে যেতে পারবে না৷ একসাথে পাঠালেই ভালো হবে৷ যা হোক চিন্তাধারা বদলাতে হলো৷ মা হয়ে ওদের সুখটা দেখে যেতে হবে৷

এ পর্যন্ত লিখে কলম থামালাম৷ তপুকে ফোন করলাম৷ তৃতীয়বার রিং বাজার পর তপু ওপাশ থেকে রিসিভ করে বললো
-বলো অঞ্জু৷
-কতোটা স্বাভাবিক গলায় কথা বলছো তাই না তপু?
-হ্যাঁ৷ অস্বাভাবিক হওয়ার মতো কিছু দেখছি না তাই তো স্বাভাবিক৷
-তুমি এখনও আমাকে অঞ্জু কেন ডাকো?
-আমি যে ওটাতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি৷ আর চিরটাকাল তো তোমাকে অঞ্জুই ডেকে এসেছি৷
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললাম
-চিরটাকাল? কতদিনই বা তোমার সাথে ছিলাম৷ কতদিনেরই বা সম্পর্ক ছিলো আমাদের?
-তোমার আমার সম্পর্ক তো সাত জনমের৷ তোমার সিঁথি যে আমার হাতের সিঁদুরে রাঙা হয়েছিলো অঞ্জু৷
-সিঁথি? সিঁদুর? এসবের মানে তুমি বোঝো তপু? বলতে পারো কেন ঐ বিয়ের খেলাটা আমার সাথে করেছিলে? কি লাভ হলো তোমার?
-লাভ ক্ষতির হিসেব করে কি জীবন চলে? তনিমাকে যে তোমার কাছে রেখেছো তাতে তোমার কি লাভ হচ্ছে?
-তনিমাকে আমার কাছে রেখে কি লাভ হচ্ছে তা তুমি একদিন জানতে পারবে৷ বললে না কি লাভ হয়েছিলো তোমার?
-বলবো৷ যদি তুমি বলতে পারো আমার হাতে সিঁথি রাঙিয়ে তোমার কি ক্ষতি হয়েছে?
-তুমি কি বলতে চাও ক্ষতি হয়নি? তপু সেদিনের পর থেকে আমি তোমার নামে লুকিয়ে সিঁদুর পড়তাম৷ তোমার মঙ্গল কামনায়৷ তোমার সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলাম৷ আর তুমি আমাকে বিয়ে করে মাঝসমুদ্রে আমাকে একা ফেলে কাপুরুষের মতো পালিয়ে গিয়েছিলে৷ সবচেয়ে বড় কথা হলো তুমি মিথ্যে বলেছিলে তুমি বিবাহিতা হয়েও এক মেয়ের বাবা হয়েও আমার সাথে প্রেমের নাটক করেছো৷ মিথ্যেবাদী একটা৷ ভন্ড প্রতারক৷
-হ্যাঁ, ঠিক বলেছো৷ আর?
-আর কি? হুম আর কি? আমাকে শেষ করে দিয়েছো তুমি৷
-ভেবে বলছো? আমি কি তোমায় নোংরা মনে স্পর্শ করেছি কখনো?
-তোমার মাথা থেকে পা অব্ধি নোংরা৷ তার মন কি করে ভালো হবে৷ তোমার মনে সবসময়ই পাপ ছিলো৷
-তাই বুঝি? আরো কোনো অভিযোগ আছে তোমার?
-তুমি কি করে এতো নির্লিপ্ত আছো তপু? তুমি কি আদৌ কোনদিন আমাকে ভালোবেসেছিলে?
-অঞ্জু আমার প্রথম ভালোবাসা তুমি আর শেষ ভালোবাসাটাও তুমি৷ আজও আমি তোমাকে প্রথম দিনের মতোই ভালোবাসি৷ আজও তোমায় বলতে ইচ্ছে করে ” আমার অঞ্জলী দেয়ার সাথি হবে তুমি?” কিন্তু সেটা সম্ভব না৷
-আর কত মিথ্যে তুমি বলবে? তুমি ঠিক কোন পর্যায়ের মিথ্যেবাদী আমি তো সেটাই ভেবে পাইনা৷ তুমি আমার সাথে কেন মিথ্যে বিয়ের নাটক করলে?
-ও তোমার কাছে বুঝি বিয়েটাই সব? বিয়ে না হলে আমাকে তুমি ভুলে যেতে পারতে? আর বিয়ে হয়েছে বলে পারছো না?
-বিয়ে হয়ে আমার কি লাভ হয়েছে? পেয়েছি তোমাকে কখনো একটি বারের জন্য আপন করে?
-তুমি কি এই মাঝরাতে এসব বলার জন্য আমাকে ফোন করেছো? আমাকে ভোরে উঠতে হবে অঞ্জু৷ আর এতো রাতে এসব তুমি কি করে বলছো তোমার স্বামী পাশে নেই?
-স্বামী? সে কে?
-মানে কি? আমি তোমার স্বামীর কথা বলছি৷
-বাদ দাও৷ তুমি কাল দুপুরে আমার সাথে দেখা করতে পারবে?
-কেন? আবার এসব নিয়ে কথা বলতে চাও?
-না৷ তনিমাকে নিয়ে কিছু কথা আছে৷ তাই তোমার সাথে কথা বলতে চাইছি৷ আসলে তোমার আমার কথা তো দশবছর আগেই ফুরিয়েছে৷ এখন তো তনিমার মাধ্যমে টুকটাক হচ্ছে৷
-ও কি ভুল বা অন্যায় কিছু করেছে?
-আরে না৷ অন্য বিষয়৷ খারাপ কিছু নয়৷
-ওহ্ আচ্ছা৷
-রাখছি৷ তুমি ঘুমাও তবে৷
-অঞ্জু শোনো…
-বলো৷
-একটা প্রশ্নের সত্যি উত্তর দিবে?
-চেষ্টা করবো৷
-আগে কথা দাও সত্যি উত্তর দিবে তবেই প্রশ্নটা করবো, নয়তো না৷
-আচ্ছা বলবো, বলো৷
-তুমি কি সুখী?
-সুখের ঠিকানা কেড়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করছো সুখী কিনা? লাখ লাখ টাকার ব্যাংক ব্যালেন্স যদি হয় সুখ, হ্যাঁ তবে আমি সুখী৷ স্বর্ণালঙ্কারে নিজেকে মুড়িয়ে রাখা যদি হয় সুখ, তবে আমি সুখী৷ লাইট ক্যামেরা এ্যাকশন যদি হয় সুখ, তবে আমি সুখী৷ ব্র্যান্ডেড এসি গাড়িতে বসে পৃথিবী দেখা যদি হয় সুখ, তবে আমি সুখী৷ জীবনের অনেক সঙ্গায় আমি সুখী তপু৷ আবার কিছু সঙ্গা আছে যেখানে সুখী নই৷ প্রিয়জনের পাশে দাঁড়িয়ে অঞ্জলী দেয়ার সুখী আমি নই৷ কারো ঘামে ভেজা শার্টের সুগন্ধ নেয়ার সুখী আমি নই৷ একসাথে বৃষ্টিতে ভিজে রোমান্টিকতায় সুখী আমি নই৷ জ্যোৎস্নারাতে কারো হাতে হাত রেখে দুধসাদা আলোতে দেখে লক্ষ কোটিবার প্রেমে পড়ার সুখী আমি নই৷ যাই হোক আমি উত্তর দিয়েছি তুমি বুঝে নাও৷ বললে না কাল দেখা করবে কিনা৷
-হ্যাঁ করবো৷ অঞ্জু একটা অনুরোধ করবো, রাখবে?
-চেষ্টা করবো বলো৷
-কাল হলুদ শাড়ি, হলুদ টিপ আর হলুদ চুড়ি পড়ে আসবে?
-কেন?
-এমনি ইচ্ছে করছে ওভাবে দেখতে তোমায়৷ ঠিক আগের মতো৷
-কি লাভ তাতে?
-ক্ষণিকের জন্য লাভ ক্ষতি ভুলে যাও না? এসো প্লিজ?
-আসবো৷ তোমার “মেহেদি পাতা” কবিতাটা মনে আছে তপু?
-হ্যাঁ৷
-কাল শুনিয়ো আমায় কেমন?
-আচ্ছা৷ ক’টায় দেখা করবে?
-বেলা ১২ টায়৷ স্থানটা কাল মেসেজ করে দিবো৷
-আচ্ছা৷ শুভ রাত্রি৷
-শুভ রাত্রি৷
ফোনটা রেখে বিছানায় চোখ আধবোজা করে হেলান দিয়ে রইলাম৷ সুদূর অতীতের স্মৃতিগুলো মানসপটে ভেসে আসছিলো৷ খুব ভালো লাগছিলো স্মৃতিগুলোর সাথে সময় কাটাতে৷ কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা৷

ঘুম ভাঙলো সাড়ে দশটায়৷ অনেকগুলো বছর পর গতরাতে ঔষুধ ছাড়া ঘুমিয়েছি৷ আসলেই নিদ্রাদেবী বড্ড হিংসুটে৷ নইলে কি আর প্রতিদিন আমাকে এতো ঔষুধ খেতে হয়? গতরাতে ডায়েরিটা আর সরিয়ে রাখা হয়নি৷ আবার বসলাম ডায়েরি নিয়ে৷

তপু বলতে পারো অতীত কেন পিছনে ডাকে? দেখো সময়গুলো একরকমেই কেটে গেলো আর এখন? কোথাথেকে তুমি সামনে এলে৷ এলো সাথে তনিমা৷ জীবনের রঙগুলো বদলে যেতে লাগলো৷ তোমাকে হারিয়েছি বহু বছর আগে৷ তোমাকে পাওয়া এ জীবনে আমার আর হবে না৷ তারপরও কেন তোমাকে নিয়ে ভাবলে মনটা ভালো হয়ে যায়? ভাগ্যদেবতা কি আমাদের এক করে দিতে পারতেন না? যা হোক আজ আসছি তোমার মনের মতো করে সেজে৷ জানিনা নিজেকে কতটুকু আটকে রাখতে পারবো৷ তোমাকে দেখলেই মনের সাগর উথাল পাথাল করে৷ পৃথিবীর সকল শৃঙ্খল ভেঙে তোমাতে মিশতে ইচ্ছে করে৷ কেন বেঁধেছিলে এমন ভালোবাসায়? আমি তো তোমার……. নাহ্ আমি তোমার কেউ না৷ কোনোদিন ছিলামও না৷
এখানে লেখার ইতি টেনে উঠলাম৷

স্নান করে কফি খেয়ে এসে তৈরি হতে বসলাম৷ আজ বহুবছর পর নিজেকে সাজাচ্ছি৷ বিয়ের আগে এমন করে নিজেকে সাজাতাম৷ খুব যত্ন করেই সাজলাম৷ খোলা চুলে সিঁথিপাটিতে আজ কি মনে করে যেনো মোটা সিঁদুর টেনে দিলাম৷ প্রায় দশবছর পর হাতে শাঁখা পলা পড়লাম৷ এতো ভক্তিতে সিঁদুর অষ্টমঙ্গলার পর পড়েছি কিনা মনে পড়েনা৷ অভিনয় জগতে আসার পর থেকে সিঁদুর পড়াই বন্ধ হয়ে গেছে৷ শুধু ক্যামেরার সামনে যতটুকু পড়ি৷ আজ যে মনের অজান্তে আবার তপুর নামেই সিঁথিপাটি সিঁদুরে রাঙালাম৷ মা এটা কি অন্যায়? জীবনের সব সময় কি ন্যায় অন্যায় মেনে পথ চলা যায়? যায় না৷ সাজ কমপ্লিট করে তপুকে ঠিকানা মেসেজ করে বেরিয়ে পড়লাম৷

ঘন্টাখানিক পর রেষ্টুরেন্টের সামনে দাঁড়ানো আমি আর তপু৷ ওকে ঠিক সেদিনের সরস্বতী পূজোর দিনের মতো লাগছে৷ ইচ্ছে করছে ওকে ওর পায়ে নিজেকে সমর্পন করি৷ কিন্তু চারিপাশে হাজারো লোক৷ এই মূহুর্তে পৃথিবীতে যদি শুধু দু’জন মানুষ থাকতাম৷ আমি আর তপু……..
চলবে…….

#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here