তনুশ্রী পর্ব ২

#তনুশ্রী♥
#লেখক:হৃদয় আহমেদ
#পর্ব_২

আজিদ লতিফাকে মেরে আধমরা করে ঘর থেকে রেগে বেড়িয়ে গেলেন। সেই লাঠির ভাঙা অংশ পড়ে আছে লতিফার পাশেই। ব্যাথায় গোঙ্গাচ্ছে লতিফা। ওঠার সামর্থ নেই তার। ব্যথায় অবস তার পুরো শরীর!

______________

– তনু যে? তা এখানে এত রাতে?

বড়মামীর মুখের দিকে চেয়ে রয় তনু। তিনি কথা না বাড়িয়ে ভতরে নিয়ে আসেন তনুকে। লতিফার বাবা একজন বিত্তবান শ্রেণির লোক ছিলেন। দালানের বাড়ি দিয়েছিলেন আর শিক্ষত ছিলো পরিবারের ছিলো সবাই। তাই এতটা শুদ্ধ কথা বলতে পারেন তনুর মামী। বাড়ির কাজের লোকটা লোক আয়রা ছাড়া সবাই শুদ্ধ বাংলায় বলতে পারে। তনুকে চেয়ার পেতে বসতে দেন তনুর বড়মামী। তার ছোটমামা এখনো অবিবাহিত। বয়সও বেশি নয়।

এক গ্লাস পানি তনুর সামনে আসতেই সে ডকডক করে সবটা খেয়ে নেয়। তনুর বড়মামা বাড়িতে থাকেন না। কাজের সূত্রে বাইরেই থাকতে হয় তাকে। লতিফার ছোট ভাইয়ের নাম ইশয়াখ, তনুর ছোটমামা।

তনুর পাশে বসেন তার বড়মামী ইশা আম্বানি।’ আম্বানি’ এ বাড়ির পদবি। এমনকি বাড়ির নামও আম্বানি ভিলা। তনুর মামী তনুকে আদর সুলভ জিজ্ঞেস করলেন,

– এত রাতে আসতে গেলে কেন তুমি? যদি কোন বিপদ হতো তখন?

– আম্মায় পাঠাইছে।

– এত রাতে?

– না হইছে কি..।বলে থামে তনু। ইশা আবারো জিজ্ঞেস করে,

– বলো। কিছু হয়েছে? নাকি এবারে তোমাকে মারতে চাইছেন তোমার আব্বা?

– আব্বায় আমার বিয়া ঠিক করসে। আমার থেইকা পনেরো বছরের বড় একজনের সাথে। আম্মায় চায় নাই এ বিয়া হোক। তাই এইহানে আমারে পাঠানো।

– তোমার বাপ এমন কেনো? আগের ফুটফুটে মেয়েটাকে কি ভাবেই না মারছে। পুলিশ যে কেনো ছারলো..? আর তোমার এই বয়সে বিয়া ঠিক করেছে? ঠিক করেছো এখানে এসে। পালিয়ে পাঠাইছে না?

– হু।

– আসো খেয়ে নাও। আমি তোমার শোয়ার ব্যাবস্হা করছি।

তখনি সেখানে ইশয়াখের আগমন। প্রথম এসেই তার চোখ পড়ে তনুর ওপর। এর আগে যখন এসেছে তখন বয়স আট থেকে নয়। আর এখন তার দেহ সাদা ধবধবে। উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো মুখ। কালো কেশ। ইশয়াখ নিজের লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে তাকায় তনুর দিকে। কথা শুরু করতে বলে,

– কেমন আছো তনু? অনেকদিন পর আসলা।

উত্তরে মৃদু হেঁসে মাথা নাড়ায় তনু। ইশয়াখ চলে যায় এখনকার মতন।
মাথার উপরে টিন থাকলেও দেয়ালের বাড়িটায় কমতি নাই রুমের। কিন্তু ইশা তাকে নিজের কাছে রাখতে চান। তিনি তো একাই থাকেন তনুকে রাখলে তার একটু ভালো লাগবে। সবাই মিলে খাওয়ার ঘরে চলে যায়। তিনজনেই খেতে বসে। খাওয়ার মাঝে ইশয়াখ তনুকে জিজ্ঞেস করে,

– কোন ক্লাসে পড় তনু?

– পড়ি না।

– কেন?

– আব্বায় দেয় না।

– ও।

খাওয়ার মাঝে কথা বলা পছন্দ করেননা ইশা। তাই এর বেশি আর কথা হয়না সেখানে।

খাওয়া শেষ! সবাই সবার ঘরে। ইশা তনুকে জাপটে ধরে শুয়ে আছে। তনু উত্তরে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। তার মাকে মনে পড়ছে। মায়ের সাথে কাটানো সময়গুলো মনে পড়ছে। যে মাকে ছাড়া তনু একটা মিনিট ভালো থাকেনা সে মাকে ছাড়া কিভাবে ঘুম আসবে?
‘আব্বায় ক্যান এমন করলো? কি করছিলাম আমি যে এত তাড়া বিয়া দিয়ার? আমার মেলা(অনেক) টাকা থাকলে আমি আব্বার মুখে ছুড়ে মারতাম। আল্লাহই জানে আম্মা কেমন আছে! আব্বা কি বেশি মারবো আম্মারে?’
এসব ভাবতে ভাবতে কেঁদে ওঠে তনু। তার তৃষ্ণা জেগেছে। মাকে একপলক দেখার তৃষ্ণা!

_____________

মোড়ল বাড়ি! বিরাট কয়েক বিঘা একাই ঘেরাও করে স্থাপিত ১৯০১ সালে। কারুকাজে বিচিত্র দৃশ্যের যেন এক রাজপ্রসাদ গড়ে তুলেছেন মইনুল মোড়লের পূর্বপুরুষ। দোতলার এক বিরাট বাড়ি। কেউ ভেতরে ডুকলে ভরকি খাবে নিশ্চিত। তেমনি গোলকধাঁধায় পড়েছে আজিদ ইশকুল। মেয়েকে কোথাও পাঠিয়েছে কথাটা শুনেই তিনি বেধোরে পিটিয়েছেন বউকে। তারপর মোড়ল বাড়ি বলে ছুট লাগিয়েছেন। রাতের ঘন অন্ধকার তিনি তোয়াক্কা করেননি। শেয়ালের হাঁক,ঝিঝি পোকার ডাকে তৈরি ভুতুড়ে পরিবেশ তার কাছে তখন নগন্য। দরকার টাকার! সোনার হরিণ পালিয়েছে তার। মেয়েকে দেয়ার বদলে তিনি পাবেন কয়েক হাজার টাকা। যেন বিক্রি করছেন তনুকে মোড়ল বাড়ির কাছে!

– কে ওখানে?

আজিদ কন্ঠস্বর লক্ষ্য করে তাকায়। মইনুল সূর্যমুখী গাছগুলোর ওপরপানে দাড়িয়ে। আজিদ ছুটে যায় সেখানে। আজিদের ঘাম ছুটছে একপ্রকার। মইনুল ভ্রু কুঁচকে বলে,

– এত রাতে আপনি এখানে? কি মতলব? বলেছিলাম তো বিয়েটা হলেই টাকাটা পেয়ে যাবেন!

আজিদ চোরের মতো এদিক ওদিক দেখে।

– হেই মাইয়া থাকপো তারফরে তো বিয়া! মাইয়া ভাগছে। নিজ বউই আমার সয়তান!

– তারমানে?

– তনুরে কোনহানে লুকায়া রাখছে লতু।

– তর বউয়ের বেশিই দেমাগ দেখছি।

– তাইলে কন? পিঠির(পিঠের) চামড়া ছিড়া ফালাইছি তবুও একটা কথা কয় নাই। আত্মীয়তো হাজার হাজার। কোনহানে রাখছে ক্যামনে খুজমু?

মইনুলের কপালে চিন্তার ছাপ পড়ে। কি করবে এখন? শরীরে এক অংশ কাটলেও যেন এক্কেবারে খারাপ দেখা না যায় তাই ফুটফুটে তনুকে বাছাই করা। গ্রামে ওর থেকে বেশি ভালো আর নাই বললেই চলে। এবারে কি করবে? আর তূরও ওকেই চায়!
উনি ভাবতে ভাবতেই বলেন,

– তুমি এখন এখান থেকে যাও। আমি দেখছি!

মইনুল নিজের লুঙ্গির এক কোন হাতে নিয়ে অন্দরমহলের দিকে পা বাড়ালেন। চিন্তিত আজিদ ঠায় দাড়িয়ে রয়। মইনুল লক্ষ্য করে বললেন,

– যান মিয়া! আমি দেখছি। কালকের মধ্যই ঘরের হবু বউরে পাওয়া যাইবো। আপনি যান এখান থেকে।

আজিদ অন্ধকারে বেড়িয়ে যায় বাড়ি থেকে। রেখে যায় নিজের চিন্তার ভার!
মজিদ অন্দরমহলে গিয়েই তূরের ঘরেরদিকে পা বাড়ায়। বেঘোরে ঘুমোচ্ছে তূর। মইনুল তাকে ডাকেন। হকচকিয়ে ওঠে তূর। ঘুমো ঘুমো চোখে বলে,

– এখন কোন অপরেশন আছে নাকি? আমি যাইতে পারবো না।

– তনু পলাইছে!

স্পষ্ট কথা দুই বাক্য বলে উঠলেন মইনুল। মুহূর্তে ঘুম উধাও হয়ে যায় তূরের। চমকালো স্বরে বলে,

– কবে?কখন?কিভাবে?

– তনুর মা ওকে লুকাইছে। ওর আব্বা যা বললো তাতে খুব পিটিয়েছে মহিলাকে। তবুও টু শব্দ করে নাই। মন দিয়া শোন তূর, ছবি সমেত মাল চাইছে! তনুরে লাগবেই।

এক ঝাপে বিছানা থেকে ওঠে তূর। চোখে ঘুমের ছায়া নেই। যেন সপ্ন দেখছিলো তনুকে নিয়ে আর উঠতেই সে নেই! তূর ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,

– লোক পাঠান আব্বা। ওই মেয়ে চাইই চাই!

তূর আর মইনুল বেড়িয়ে যায় অন্দরমহল থেকে। লোক জড় করে। কম করে হলেও আশি জন বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী! আর পয়ত্রিশ জন রোগা পাতলা। সকলকে এক কথায় বুঝিয়ে দেয়া হয় সবটা! ছড়িয়ে যায় তারা পুরো গ্রামে!

______________
ভোরের আলো ফুটেছে! চিকচিকে সোনালি রোদ ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর বুকে। নতুন দিন আর নতুন আলোর খোজে অনেকে ব্যাস্ত। কেউ ওপারের জন্য মোনাজাতে কাঁদছে তো কেউ মরা ঘুম ঘুমোচ্ছে। বাকি নেই তনুও! কাল রাতের ধকলে তনুও এখনো ঘুমের জগতে। রাত পুহিয়ে সকাল হয়েছে তা তনুর মস্তিষ্ট ঠাউর করতে পারেনি। ইশা কোরআন তেলোয়াত করছেন। সবেমাত্র ফজরের নামজ আদায় করে তিনি বসেছেন। পড়ার আওয়াজ কানে আসতেই তনু চোখ মেলে তাকায়। বিছানায় উবু হয়ে বসে। রাতে তার ঠিক ঘুম হয়নি। কেউ এসেছিলো ঘরে। ইশা আম্বানির ছাড়াও আরও কারো নিশ্বাস টের পেয়েছিলো তনু।তাই প্রায় পুরো রাতই জেগে ছিলো সে! কিন্তু কে ছিলো তা অজানা। বুঝতে পারেনি তনু!
বিছানার থেকে উঁচু চৌকির মতো একটা জায়গায় কুরআন তেলাওয়াত করছেন ইশা। তনু শুনছে মুগ্ধ হয়ে। তার মাও এরকম সকাল সকাল তেলাওয়াত করে আর তনু বিমোহিত হয়ে শোনে।
ইশার পড়া শেষে তিনি লক্ষ করেন তনু উঠেছে। তিনি কুরআনুল কারিমে চুমো দিয়ে ওপরের তাকে রেখে নেমে আসেন চৌকি থেকে।

– নামাজ কালাম পড়ো তনু?

তনু মুচকি হেঁসে বলে,

– ফড়ি তো।

– আজ যোহর থেকে পড়ো! শরীর ঠিক করে কেমন? যাও গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আসো। নাস্তা দিচ্ছি। যাই ইশয়াখকে ডাকি নইলে ও আর উঠবে না।

ইশয়াখের কথা মনে পড়তেই তনু কেন জানি মনে হয় রাতের ওই অজ্ঞাত লোকটা ইশয়াখ ছিলো। পরমুহূর্তেই ভাবে নিজের মামাকে নিয়ে এসব মনে করা ঠিক নয়।
তনু বিছানা ছাড়ে। দু বিঘায় বানানো অট্টালিকা বাড়িতে একজন পুরুষ কাজের লোক আর একজন মহিলা। তনু কলপাড়ে যেতেই তাবিজ চাচাকে দেখতে পায়। উনি ফুল গাছে পানি দিচ্ছিলেন। তনু তাবিজ চাচাকে ডেকে বললেন,

– শুক্রভাত চাচা। কেমন আছেন আফনে চাচা?

তাবিজ তনুর দিকে অবাক চোখে তাকায়। সেই কত ছোট একটা মেয়ে এসেছিলো আর সে এত বড় হইসে? তিনি উঠে তনুর দিকে এগিয়ে আসেন। এ বাড়িতে থাকতে থাকতে তিনি শুদ্ধ কথা বলতে পারেন।

– কেমন আছো তনু?

– আফনি চিনছেন আমারে?

– না চেনার কি আছে? সেই কত্ত ছোট থাকতে তোমায় দেখছিলাম। এখন কোন ক্লাসে তুমি তনু?

– আমি ফড়ি না তো চাচা।

– কেন? পড়োনা কেন?

– ১৯৭৫ সাল! তিথি আপু আর আমি একলগে স্কুলে যাইতাম। আমি তহন কিলাস (ক্লাস) ফোরে পরি। আপা কিলাশ(ক্লাস) সেবেনে ফড়তো। লুকায়া লুকায়া শাহাজালাল ভাইয়ের সাথে প্রেম করতো আফায়। কথাডা শুধু আমি আর আম্মায় জানতো। আম্মায় কিছুই কয় নাই এই নিয়ে। কারন শাহজালাল ভাই ছিলেন খুব ভালা মানুষ! খুবই ভালা মানুষ! আম্মাও পছন্দ করতো শাহাজালাল ভাইরে। কিন্তু একদিন আব্বা দেইখা ফালায় বোন আর শাহাজালাল ভাইরে। বাড়ি আইসা আম্মারে আর আপুরে খুব পিটায় আব্বা। আপুরে ঘরে নিয়ে দুইডা লাঠি ভাঙে! আম্মা আটকাতে পারে নাই। সেই আঘাতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন আপু। আর তারপর আমারো স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন আব্বা।

তনুর চোখ চিকচিক করে ওঠে। বুকের তার কষ্ট হচ্ছে। তাবিজ চাচা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।

– নিজের মেয়েকে এক্কেরে মেয়ে ফেললো? কি নিষ্ঠুর! শাস্তি পায় নাই?

– পাইসে। তবে তা কয়দিনের মাত্র। তারপর ছেড়ে দেয় পুলিশ!

তনু ‘আসি চাচা’ বলে চলে যায় কলপাড়ে। মুখে পানির ছিটে দিয়ে ছাই দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করে। কুলি করে চলে আসে ঘরে। ইশয়াখ নিজ ঘরে। ইশা রান্না করছিলেন। তনু রান্নাঘরে গেলো। ইশা তনুর উপস্থিতি টের পেয়ে বললেন,

– এখানে আসতে গেলি কেন?যা। রান্না হয়ে গেছে। টেবিলে যা আমি খাবার নিয়ে আসছি।

তনু উল্টোদিক ফিরে যেতে নিলেই ইশা বলে ওঠেন,

– ইশয়াখকে একটা ডাক দিবি তনু? আমি কাজ করতেছি আর না ডাকলে ও আসবে না।

– জ্বি মামী। আমি ডাকতাছি।

বাধ্য মেয়ের মতো তনু চলে যায় ইশয়াখের রুমের দিকে। ইশার ঘরের তিন ঘর পেরিয়ে ইশয়াখের রুম। তনু আস্তে করে দারে টোকা দেয়। সারা নেই! তার কি ভেতরে যাওয়া উচিত? যদি ঘমিয়ে পড়ে? তনু নিজের ওড়না ঠিক করে ঘরে ডোকে। দার পেরিয়ে এক পা যেতেই কেউ হেচকা টানে রুমে ডুকিয়ে নেয় তনুকে। খুলে ফেলে তেরো বছর বয়সি তনুর গা থেকে ওড়না!

_______________বর্তমান____________

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো তূর। বললো,

– তারপর? ইশয়াখ তোমায় ধর্ষন করলো?

তনু হু হু করে কেঁদে ওঠে। বাসরাতের ফুলে বিছানো বিছানার চাদর খামচে ধরে বলতে লাগলো,

– তারপর….

#চলবে….

অনেকে মানছে না এটা থ্রিলার! আমি তাদের বোঝাতে চাইনা। শুধু বলবো গল্পের মাত্র দুটো পথ অতিক্রম হয়েছে। এতটা ব্যাস্ত হবেন না। আর সবাই রেসপন্স করবেন যাতে গল্প সবার কাছে যায়। হ্যাপি রিডিং🥰

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here