তবুও তুমি পর্ব ৫

###__তবুও_তুমি__###
৫ম পর্ব

” বাবা গো ” এই বলেই রাসেল ভাই লাফিয়ে উঠলো। সারা নাক মুখ ভর্তি পানির ছিটা। চোখ দিয়ে আগুন বের করে বলল ” নিপা তুই আমাকে পানি মেরেছিস”। আমি মাথা নিচু করে জবাব দিলাম ” আমি তো ভেবেছিলাম আপনি বোধহয় বেঁহুশ হয়ে গেছেন তাই নাক মুখে পানি ছিটা মেরেছিলাম”। ” পুরো এক গ্লাস পানি মেরেছিস আমার মুখে আর বলতেছিস পানির ছিটা মেরেছিস। এক্ষুনি দূর হ আমার সামনে থেকে। না হলে চড়িয়ে মুখের দুধ দাঁত সহ ফেলে দেবো “। ইসস কি একটা মজাই না হল। পিছনে ফিরে বত্রিশ দাঁত কেলাতে কেলাতে বের হয়ে আসলাম। টের পাচ্ছিলাম অবাক নয়নে আমাকে দেখছে পিছন থেকে উনি।মনে মনে হয়ত ভাবছিল এই মেয়েলোকের এত সাহস হয় কি করে আমাকে পানি মারার।কালকে রাতের চুল ধরার প্রতিশোধ তো একটু হলেইও নিয়েছি। ইয়াহু, বলেই যেই লাফ দিয়েছি ছোট মামা আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে। তাড়াতাড়ি অন্যদিকে তাকিয়ে সোজা রুমে চলে আসি।রুমে এসে ড্রেস চেঞ্জ করে হালকা একটু সেজে নিলাম। যত যাই হোক না কেন ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা। আমার খুব ভাল লাগে দু চোখে কাজল দিতে। কাজলটা অবশ্য কিছুক্ষন পরে লেপ্টে যায় তাও ভাল লাগে। বটল গ্রীন কালারের গাউনের সাথে ম্যাচ করা চুড়ি। মাথায় একটা টায়রা দিলাম। আমি এমনিতেই ফ্যামিলির সবার কাছে উট হিসেবে পরিচিত। কারণ হাইটটা একটু বেশিই সবার থেকে তাই কখনই হিল জুতা পরা হয় না। ভাইয়ার বিয়ে উপলক্ষে পেন্সিল হিল একটা জুতো কিনেছিলাম। রেডি হয়ে যখন বের হলাম খালা খালু তখন বের হচ্ছে। কানের দুলটা ঠিক করতে করতে দেখলাম অফ হোয়াইট শার্ট আর ব্লাক জিন্স পরে রাসেল ভাই ভাইয়ার বেডরুমের সামনে দাঁড়িয়ে ফোনে জানি কি খুব মনোযোগসহ দেখছে। বাম হাতের কব্জিতে মোটা চেইন এর রিস্টওয়াচ। পায়ে শু বাম হাতের উপরে কোটটা ফেলে রাখা উফফ আর এত হ্যান্ডসাম হওয়ার দরকারটা কি ছিল। খালাকে দেখেই সে বলে উঠলো ” আন্টি আমরা এই কয়জনই আছি বাসায় এখন যাওয়ার ব্যবস্থা কি বিয়ে বাড়ি পর্যন্ত? “। সে ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে কতক্ষন চুপ করে থেকে আবার খালার দিকে তাকালো। ” আচ্ছা রাসেল আর শরীফ (বড় ভাই) তোমরা দুই জন নিচে যেয়ে সিনজি ম্যানেজ করো। বাকি যারা যারা ছিলাম সবাই মোটামুটি নিচে এসে দাঁড়ালাম। ও মা মাত্র তিনটা গাড়ি পাওয়া গেল। সবাই গাদাগাদি করে উঠতেই ভাবছিলাম যাব কি করে এই অবস্থায়? হঠাৎই রাসেল ভাই বলে উঠলো ” আপনারা যান আমি নিপাকে নিয়ে আসতেছি “। চোখে কুঁচকে তার দিকে চেয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম ভাল মনে করে বলতেছে নাকি কম্বল সরিয়ে পানি মেরেছিলাম সেই জন্য শাস্তির কোন প্লান করে নিতে চাচ্ছে! মিনমিনিয়ে খালাকে বললাম ” আমি আপনাদের সাথে যাই?” খালা বলল ” দেখ নিপা পিছনে কি চারজন করে বসেছি তোর ড্রেস নষ্ট হয়ে যাবে এর চেয়ে ভাল তুই রাসেলের সাথে আয়”।

কোন উপায় না পেয়ে আস্তে করে তার বাইকের পিছনে চড়লাম। মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়ে নিলাম। কেন যে পানি মারতে গেলাম কোন শয়তান যে ভর করেছিল তখন! উফফ ভাবতেই পারছি না। সব গুলো গাড়ি ছেড়ে দিলেও রাসেল ভাই বাইক স্ট্যার্ট দিল না আমি বললাম কি হল চলেন দেরি হয়ে যাবে তো। পিছনে ফিরে আমার দিকে একবার চাইল। চাহনির স্টাইল দেখেই বুঝলাম কাহিনী বেশি ভাল না। গম্ভীর কন্ঠে বলল ” ধরে বসবি ঠিক করে নাকি কাদায় ফেলবো? “। এটুকু বলতেই আমি তাড়াতাড়ি কাধেঁর উপরে হাত দিয়ে বসলাম। বলাতো যায় না যে তার ছেঁড়া পাবলিক সত্যিই যদি কাঁদায় ফেলে দেয় তখন কি হবে। আমার কেন জানি না খুব ইচ্ছা রাসেল ভাই কোন পারফিউম দেয় সেটা একবার দেখবো। উনার কাছে আসলেই এই পারফিউমের ঘ্রাণে আমি যেন মাতাল হয়ে যাই। প্রায় চলে এসেছি বিয়ে বাড়ির কাছে তখন একটা ব্রেক করে রাসেল ভাই গাড়ি থামালো। হঠাৎ বাইক থামাতে দেখে বলে উঠলাম
___ কি হল গাড়ি থামালেন যে, এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। সবাই অপেক্ষা করতেছে৷
___ এএএ উনি মহারানী ভিক্টোরিয়া হয়ে গেছে। সবাই উনার জন্য বরণ ডালা নিয়ে বসে আছে।
___ এটা কেমন কথা আমি কখন বলেছি যে বরণ ডালা নিয়ে বসে আছে।
___ শোন বেশি প্যাট প্যাট করবি না। কি আমার মানুষ একটা উনি না গেলে বিয়েই হবে না৷
এসব শুনে খুব জিদ লাগছিল মনে চাচ্ছিল দুপুরের মত আবার এক গ্লাস পানি মারি। না না এক গ্লাসে হবে না পুরো এক বালতি পানি উনার মাথায় দেই যাতে এই ওভেনের মত গরম মাথাটা ঠান্ডা হয়ে যায়। আস্তে করে হাত ভর দিয়ে বাইক থেকে নেমে সোজা হাটাঁ শুরু করলাম। যে এটুকু পথ হেঁটেই যাব এত কটু কথা শোনে কে। ওড়নার টান পড়তে বুঝলাম হয়েছে কি! ঘুরে দেখি রাসেল ভাই ওড়নার মাথা ধরে রেখেছে। ” বাইক থেকে নামলি কেন? বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার তর সইছে না তাই না! সাদ না পাদ কে জানি আছে তার জন্য মন আকুপাকু করছে” এটুকু বলেই আগুন স্বর্বস্ব দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো সে। দুই হাত দিয়ে টেনে আমাকে একদম তার সামনে নিয়ে আসল। তার ঠোঁট আর আমার ঠোঁট এর ফারাক যেন মাত্র দুই ইঞ্চি। ভয়ে আমি চোখ বন্ধ করে ফেলতেই বলল ” যদি দেখেছি আজকে আলগা নাচ নেচেছিস খবর আছে বলে দিলাম”। আমাকে ছেড়ে দিয়েই বাইক স্টার্ট করে সোজা চলে গেল। আর আমি মাথা নিচু করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলাম।আর কত আমাকে অপমান করলে তার শান্তি হবে সেটা আল্লাহ ভাল জানেন। বিয়ে বাড়ি ঢুকতেই কতগুলো মেয়ে মানুষ এসে ঘিরে ধরল আমাকে। এক এক জন এক এক প্রশ্ন করছে। আমার এত দেরি কেন আমি কই ছিলাম এতক্ষন ব্লা ব্লা। কিন্তু এরা কেন এই প্রশ্ন আমাকে করতেছে আজব তো। একটা ব্যাপার এদের কথা শুনে মনে হচ্ছে এই স্বর আমি আগেও শুনেছি কিন্তু কথা হল কাউকেই চিনতে পারছি না কেন আমি। হঠাৎ দেখলাম খালা আসতেছে কেমন করে যে সেই অচেনা মেয়েদের পাশ কাটিয়ে খালার কাছে পৌঁছালাম আল্লাহ মালুম। খালাকে ধরেই বলছি ” দেখেন খালা ওই মেয়েগুলো আমারে কি কি যানি বলতেছে”। খালা জিজ্ঞেস করল কারা? আমি আঙ্গুল তুলে মেয়েদের দলটাকে খালাকে দেখালাম। ওদের দেখেই খালা অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়ল। উনার হাসি দেখে আমি তো অবাক হয়েছিই সাথে ওই মেয়েগুলো পর্যন্ত আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছে খালার দিকে। খালা কোনরকমে হাসতে হাসতে আমাকে নিয়ে গেল। ” ওরে মানতাশা মানহা নিপা তোদের চিনতে পারে নাই” এই বলে খালার কি হাসি। আমি বিস্ফোরিত চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। এখনও বুঝতে পারতেছি না কোনটা বড় আপু কোনটা মানহা আপু আর বাকি গুলোই বা কারা।” নিপা এত বড় হয়েছিস এখনও তোর আক্কেল হল না ” বড় আপুর বিখ্যাত উক্তি শুনে চিনতে পারলাম এটা যে আমার বড় আপু। মানহা আপুর অভ্যাস সবসময় বড় আপুর প্রতিটি কথায় সায় দেয়। এবারও তাইই করল। তখন বুঝলাম যে হ্যাঁ এটা মানহা আপু। বাকি দুই জনের ছটফটানি দেখে বুঝলাম ওই দুইটা জিমি মিলি। কিন্তু কোনটা জিমি কোনটা মিলি সেটাও চিনতে পারলাম না। হায়রে পার্লার কি দারুন জিনিস এমন মেকওভার করে মায়ের পেটের বোন পর্যন্ত চিনতে পারে না। ” নিপা সত্যিই তুই আমাদের চিনতে পারিস নাই” বড় আপুর ঝাঁঝালো প্রশ্নের উওর যে আমি কি দেবো সেটা আমি নিজেই বুঝতেছিলাম না।
তখনই দুধের মত ধবধবে সাদা এক মহিলার আবির্ভাব। ” সবাই তাড়াতাড়ি চলো বউ এসেছে ” এটুকু বলেই মহিলা ঘুরে চলে গেল। আমার তাকিয়ে থাকা দেখেই মানহা আপু বুঝে গেল যে আমি চিনি নি উনাকে। ” দেখ নিপা প্লীজ, অন্তত এবার বলিস না যে তুই বড় ভাবিকে পর্যন্ত চিনিস নাই”। মানহা আপু কথা শুনে আমার যেন মাথা ভোঁ চক্কর দেওয়া শুরু হল। বড় ভাবিকে আমার বড় খালাম্মা পছন্দ করে এনেছিলেন।কালো না হলেও প্রায় কালোর কাছাকাছি গায়ের রং। ভাইয়া এই নিয়ে মাঝে মাঝে আফসোস করে বলে ” তানি তুমি আর এক শেড ফর্সা হলেই তাসিন আরো ফর্সা হত”। আজকে ভাবিকে দেখলে হয়ত ভাইয়ার আর আফসোস থাকবে না। আরে আফসোস কিসের বড় ভাইয়ের আগে ভাবিকে চিনতে পারা লাগবে তো।

বউকে এনে বসিয়েছে স্টেজে। আপুরা মিলি জিমি সবাই বউয়ের কাছে যেয়ে ভিড় করছে। আমার এত ভিড়ভাট্টা কখনোই ভাল লাগে না। তাই একটা কোনা দিয়ে সোফায় বসে বসে ফেসবুকের নিউজ ফিড স্ক্রল করছিলাম। এমন সময় ছোট খালু কোথা থেকে হন্তদন্ত হয়ে এসে হাজির। ” নিপা তোমার খালামনি কই?রেনুর ব্যাগে আমার ফোন চশমা। কই যে গেল? ” এটুকু বলেই ছোট খালু আবার খুঁজতে লাগল। কিছু না বলে আমি আবার ফোনের দিকে নজর দিলাম। হঠাৎই এক মেয়ে এসে আমার সামনে হাজির। ” নিপা এই চশমাটা তোর খালুকে দিস তো ” এই বলেই আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি মেয়েটার দিকে। ” তুমি আমার খালামনি?” কোন রকমে ফিসফিস করে এটুকুই বলতে পারলাম। ” নিপা ফাজলামি কম করবি ” খালামনি ঝাড়ি দিয়ে বলল। ” খালামনি খালু তোমাকে খুঁজছিল” এই বলতে বলতেই আবার ছোট খালু এসে হাজির। ” নিপা একটু আমার সাথে চলো তো তোমার খালামনিকে খুঁজবে। আমি পুরুষ মানুষ সব খানে যেতেও পারছি না” ছোট খালুর এ কথা শুনে আমি আর অবাক হলাম না। কারন এখানে এসে অবাক হওয়ার শক্তিও আমার হারিয়ে গেছে। খালামনির দিকে তাকিয়ে দেখি উনি যেন বাক শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। আসলে স্বাভাবিক এমন হওয়ারই কথা। ২৫ বছর সংসার করার পরে বউরে পাশে দাঁড়িয়ে অন্যকে যদি বলা হয় তার বউকে খুঁজে দিতে স্বাভাবিক এমনটা হবেই। কিছুক্ষন ধাতস্থ হয়েই খালামনি তার আগের ফর্মে ফিরে এলো। ছোট খালুকে ঘাড় ধরে ঘুরিয়ে তার দিকে হ্যাঁচকা মেরে ঘুরিয়ে দিল। ছোট খালু প্রথমে ভড়কে গেলেও পরে সামলিয়ে বলল ” আপনি তো মানুষ ভাল না পরপুরুষ এর গায়ে হাত দেন “। খালার লুক দেখে বুঝতে ছিলাম মানুষ আস্ত খাওয়ার উপায় থাকলে হয়ত খালুকে খালামনি আস্তই খেয়ে ফেলত। খালি এটুকু বলতে শুনলাম খালামনিকে ” আজকে বাসায় চলো বুঝাবো মজা “। খালামনি চলে যেতেই খালু ধপ করে আমার পাশে বসে পড়ল। আমার দিকে ফিরে বলল……….

মারিয়া আফরিন নুপুর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here