তবে ভালোবাসো কী পর্ব -০৫

#তবে_ভালোবাসো_কী
#Mehek_Enayya(লেখিকা)

#পর্ব ০৫

নিজ কথায় নিজেই ফেঁসে যায় মাহানুর। এখন আরহামকে কী উত্তর দিবে! আশেপাশে তাকিয়ে বলার মতো কিছু কথা ভাবতে লাগলো। অবশেষে পেয়েও গেলো।

-কিছু বলছিলাম না। আকাশ কালো হচ্ছে হয়তো বৃষ্টি হবে!

আরহাম বাঁকা হেসে মাহানুরের দিকে একটু ঝুঁকে যায়। সচেতন মাহানুর দূরে সরে যেতে নেয় কিন্তু আরহাম তার হাত ধরে আটকে দেয়। আরহাম এই প্রথম মাহানুরের ভীত রূপ দেখলো। সে মাহানুরকে জ্বালাতে আরেকটু ক্লোস্ড হয়ে বসে। মাহানুরের হাতে হাত দিয়ে দুষ্ট স্বরে বলে,

-আমিও দেখতে চাই কত হ*ট আমার একমাত্র ওয়াইফ। তো কবে দেখাচ্ছেন?

-কী দেখাবো?

-এখন বুঝিয়ে বলতে হবে? আমার জানা মতে তুমি তো এডাল্ট মেয়ে!

মাহানুর বুদ্ধি খাঁটিয়ে নিজের পা দিয়ে আরহামের পায়ে লা*ত্থি দেয়। সাথে সাথে আরহাম মাহানুরের হাত ছেড়ে দেয়। মাহানুর দূরত্ব বজায় রেখে বসে। আরহাম কিছু বললো না। খাওয়া শেষে এখন আইসক্রিম অর্ডার করেছে। একজন ওয়েটার এসে দিয়ে যায় তাঁদের আইসক্রিম। মাহানুর দাঁত দেখিয়ে হেসে আইসক্রিম খেতে থাকে। হঠাৎই বাহিরে ঝুঁম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। মাহানুর বৃষ্টি দেখে খুশিতে আত্মহারা। ধীরে ধীরে বৃষ্টির তেজ বাড়তে থাকে। রাস্তাঘাট একদম ফাঁকা হয়ে যায়। এক দুইজন মানুষ ছাতা নিয়ে চলাচল করছে। মাহানুর দ্রুত খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ায়। আরহাম বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

-কোথায় যাচ্ছ?

-বাহিরে বৃষ্টিতে ভিজবো।

-না এই বৃষ্টি ভালো নয়। জ্বর ঠান্ডা লাগবে।

-কিছু হবে না। টাটা।

আরহাম আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইলো মাহানুরের যাওয়ার দিকে। তার একটা কথাও শুনে না এই মেয়ে! না এভাবে চললে হবে না তাকে আরো কঠিন হতে হবে। আরহামও বিল পে করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়ে। মাঝ রাস্তায় মাহানুরকে বাঁদরের মতো লাফাতে দেখে তার মন চাইলো এখনই তুলে আছাড় দিতে। অনেক কষ্টে নিজের রাগ শান্ত করে এগিয়ে যায় মাহানুরের কাছে।
মাহানুর আরহামকে খেয়াল করেনি নিজের মতো এনজয় করে যাচ্ছে। আরহাম তেড়ে এসে মাহানুরের হাতের কব্জিতে শক্ত করে ধরে। মাহানুর বিরক্ত হয়ে বলে,

-হয়েছে কী? এভাবে ধরেছেন কেনো?

আরহাম কোনো উত্তর দেয় না। মাহানুরকে ধরে টেনে নিয়ে আসে গাড়ির সামনে। গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলে,

-ভিতরে যেয়ে বসো।

-আমি যাবোই না আপনার সাথে। নিজের ইগো নিজের কাছেই রাখুন।

-বাড়াবাড়ি করছো কিন্তু মাহানুর!

-বেশ করছি।

মাহানুর রেগে সামনে পা বাড়াতে নিবে তার আগেই আরহাম জোর করে মাহানুরকে গাড়ির ভিতরে ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসে এই বৃষ্টির মধ্যেই ড্রাইভ করতে থাকে। মাহানুর রাগে ফুসছে। ভিজে দুইজনই টুইচুম্বর। বৃষ্টি কমছেই না। এতো বৃষ্টির মধ্যে ড্রাইভ করতে অসুবিধা হচ্ছিলো তাই আরহাম মেইন রোডের কিনারে গাড়ি থামায় কিছু সময়ের জন্য। টিসু বের করে নিজেই মুখ মুছতে থাকে। মাহানুরের দিকে এগিয়ে দেয় টিসু। মাহানুর দেখেও না দেখার ভান করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।

-হেজাব খুলে ফেলো। ভিজে একদম খারাপ অবস্থা হয়েছে। বেশিক্ষন মাথায় থাকলে মাথা ব্যাথা করবে।

আরহামের কথায় মাহানুর সহমত হলো। কিন্তু আরহামের সামনে হেজাব খুলবে! হেজাব সুন্দর করে বাঁধায় ওড়না আর নেয়নি। এখন জামা ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। একটু অস্বস্তিতে পড়ে যায় মাহানুর। আরহাম বিষয়টা লক্ষ্য করে বলে,

-আমাকে নিয়ে এতো ভেবে লাভ নেই অন্যদিকে তাকিয়ে আছি। আমি তোমার হাসব্যান্ড। অধিকার আছে আমার। আর পরপুরুষের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু দেখার ইচ্ছে আমার নেই। যা দেখার সরাসরি একদম বাঘের বাচ্চার মতো দেখবো।

মাহানুর আরহামের কথায় মুখ ভেংচি দেয়। পিন খুলে সযত্নে নিজের হেজাব খুলে ফেলে। হেজাবের ওড়নাটা বুকে দিয়ে টিসু দিয়ে মুখ মুছে নেয়। আরহাম এক দৃষ্টিতে বৃষ্টির দিয়ে তাকিয়ে আছে। একটু বেশিই রোমাঞ্চকর পরিবেশ বলে মনে হলো আরহামের!

-হয়েছে আমার এখন ঐদিকে মুখ করে বসে থাকতে হবে না।

আরহাম মাথা ঘুরিয়ে মাহানুরের দিকে তাকায়। হাতে কী জানো করছে মাহানুর! আরহাম ভালো করে লক্ষ্য করে দেখে কাল তার মা বিয়ের উপলক্ষে যে রিংটা মহানুরেকে দিয়েছিলো সেটা এখনও মাহানুরের হাতে। অজান্তেই দুই ঠোঁট প্রসারিত হয় আরহামের। সামনের চুলগুলো পিছনে সরিয়ে মাহানুর জিজ্ঞেস করে,

-কী হয়েছে? একা একাই হাসছেন কেনো?

আরহামের দৃষ্টি আকর্ষণ করে মাহানুরের লিপস্টিক বিহীন অধরজোড়া। পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকে সেইদিকে। মাহানুর বুঝতে পারছে না আসলে আরহামের হলো টা কী?

-এইযে আরহাম ভাইয়া, শুনছেন? হ্যালো।

মাহানুরের উচ্চস্বরে কথা শুনে ধেন ভেঙে যায় আরহামের। নজর সরিয়ে ফেলে। মাহানুর দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,

-আপনি কী আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার প্রেমে পড়ে গেলেন নাকি?

আরহাম কোনো উত্তর দিলো না। বৃষ্টি কমতেই গাড়ি স্টার্ট দেয়। ফাঁকা রাস্তা হওয়ায় কয়েক মিনিটের মধ্যেই খান বাড়িতে চলে আসে। মাহানুর ওড়না সুন্দর করে শরীরে পেঁচিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে।

-কল টল দিলে ধরিও।

-একদমই ধরবো না। বাই বাই টাটা।

মাহানুর চলে গেলো। আরহাম মাহানুরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। তারপর বেরিয়ে পড়ে তার বাসার উদ্দেশ্যে। ড্রইংরুমে সবাই একসাথে বসে চা খাচ্ছিলো। মাহানুর সদর দরজা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতেই সবাই এগিয়ে আসে তার দিকে। ইন্টারভিউ স্টার্ট!

-আম্মা কেমন কাটলো আজকের দিন?(হামযা খান)

-বৃষ্টিতে ভিজেছিস মা! জ্বর না হলেই হলো। (মেহরাব খান)

-কোন মার্কেটে গিয়েছিলি নুর? (লুৎফা)

-কী কী কিনে দিলো ভাইয়া? ব্যাগ তো অনেক দেখা যাচ্ছে। (আয়াস)

-পুরো মার্কেটই তো তুলে নিয়ে এসেছো মাহানুর!(সায়রীন)

মাহানুর বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করে সকলের ওপরে। হাজেরা এগিয়ে গিয়ে নিজের শাড়ীর আঁচল দিয়ে মাহানুরের মুখটা মুছে দেয়। বাড়ির ভিতরে আসার সময় বৃষ্টির পানিতে মুখ ভিজে গিয়েছিলো। মাহানুরের হাতের সব ব্যাগ রামিশা আর লুৎফাকে দিয়ে বলে মাহানুরের রুমে নিয়ে যেতে। তারপর মাহানুরকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে রাগী কণ্ঠে সবাইকে বলে,

-মেয়েটা মাত্র আসলো এখন পর্যন্ত বসলোও না আর আপনারা সবাই একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন! (হাজেরা)

-হ্যাঁ ভুলেই গিয়েছিলাম। (হামযা খান)

-মা তুই আগে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নে। পরে শুনবো নে কথা। (মেহরাব খান)

-ঠিক আছে আসছি আমি। (মাহানুর)

লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বিছানায় বসে মাহানুর। নতুন কেনা ফোনটা দেখতে থাকে। তারপর এক এক করে সব জিনিস বের করে বিছানায় রাখে। নাকফুল আর কানের দুলটা সযত্নে আলমিরায় রেখে দেয়। শাড়ী গুলো অত্যাধিক সুন্দর। আরহামের চয়েস আছে! সব কিছু সুন্দর মতো গুছিয়ে রেখে রুমের বাতিটা অফ করে দেয়। বেলকনিতে নীল রঙের ড্রিমলাইট জ্বলছে। সেটার আলোয় রুম আলোকিত হয়ে যায়। বাহিরে তুমুল ঝড় বৃষ্টি চলছে। ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস আসছে। এইরকম ওয়েদারে ঘুমানোর ফিলিংসটাই অন্যরকম। কাবাড থেকে একটি কাঁথা বের করে সেটা মুড়িয়ে ঘুমিয়ে পরে। মাহানুরের কাছে ঘুম ইস অনলি রিয়েল লাভ। এই পর্যন্ত সে কোনো বফঁ গফ রিলেশন নামক সম্পর্কে নিজেকে জড়ায় নি। তার অবশ্য কারণও আছে। মাহানুর এইরকম খাপছাড়া ছিল না। সময় ও কিছু মানুষের জন্য নিজেকে পরিবর্তন করে ফেলেছে মাহানুর।

যখন সে নবম শ্রেণীতে পড়তো তখন তার এক ক্লাসমেটকে ভীষণ মনে ধরে। কিশোরী বয়স ছিল তখন। অনুভূতি গুলো ছিল সধ্য জন্ম নেওয়া। সেই ক্লাসমেটের নাম ছিল সাজিদ। মাহানুর আর সে একসাথে প্রাইভেট পড়তো। মাহানুর ধীরে ধীরে ভালোবেসে ফেলেছিলো সাজিদকে। সে ভাবতো সাজিদ হয়তো তাকে পছন্দ করে না। কিন্তু একদিন প্রাইভেট পড়ার শেষে সাজিদ একটা চিঠি দেয় মাহানুরকে। সেদিন মাহানুরের জন্য ঈদ ছিল। রাতে রুমের দরজা জালনা লাগিয়ে সেই চিঠিটা পরে। সাজিদের মনেও মাহানুরের জন্য অনুভূতি ছিল। নিজের সকল ফিলিং সেই চিঠিতে লিখে দিয়েছিলো। তারপর সরাসরি একদিন সাজিদ মাহানুরকে জিজ্ঞেস করে, আমাকে ভালোবাসো মাহানুর? হ্যাঁ অথবা না বলবা। সেদিন মাহানুর হ্যাঁ বোধক মাথা নারিয়েছিল। ধীরে ধীরে সামনে আগাতে থাকে তাঁদের প্রণয়ের সম্পর্ক। মাহানুরের মনে তখন এক আকাশ সমান ভালোবাসা ছিল সাজিদের জন্য। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন বুনতো সাজিদকে নিয়ে। সে ভেবেছিলো দরকার পড়লে ফ্যামিলি ছেড়ে দেবে কিন্তু সাজিদকে ছাড়বে না।

তার বড় চাচার মেজো ছেলে আয়াসের ফোন দিয়ে মাঝে মাঝে মেসেজে কথা বলতো। কোনোদিন কলেও কথা বলতো। একমাত্র আয়াসই মাহানুরের বেপারে সবটা জানতো। সাজিদের ব্যবহার এমন ছিল মাহানুর কখন ভাবতেও পারেনি সাজিদ তাকে ধোঁকা দিবে! সম্পর্ক ভালো চলছিল। দশম শ্রেণীতে উঠলো। দুইজন নিজেদের বিয়ের স্বপ্ন দেখতে লাগলো। কলে বিয়ের বিভিন্ন প্লানিং করতে লাগলো। মাহানুর একটু টেনশনে ছিল সাজিদকে নিয়ে। যেহেতু তারা সমবয়সী যদি তাঁদের বিয়ে না দেওয়া হয়! তারা দুইজন পরিকল্পনা করলো যদি ফ্যামিলি রাজি না হয় তাহলে দুইজন পালিয়ে যাবে। অর্ধবাষিক পরীক্ষার কিছুদিন আগে সাজিদের পরিবার জেনে যায় তাঁদের সম্পর্কের কথা। সাজিদের বাবা ছিল একজন আর্মি। সে ছেলেকেও আর্মি বানাতে চেয়েছিলো। একটা খালি ঘরে দরজা লাগিয়ে ইচ্ছে মতো মারে সাজিদকে। সাজিদ এক ফোটা চোখের পানি ফেলেনি। অনেক ফর্সা ছিল সাজিদ। একদম বিদেশীদের মতো। তার সাদা চামড়ায় মারের দাগ বসে যায়। তবুও সে একটা কথাই বলে মাহানুরকে ছাড়তে পারবে না। সাজিদের বাবা তার ফোন নিয়ে নেয়। কিন্তু সাজিদ তার বড় বোন অথবা বন্ধুর ফোন দিয়ে লুকিয়ে মাহানুরের সাথে কথা বলেছিল। সবটা শুনে মাহানুর কান্না করে দেয়। সাজিদ এটা সেটা বলে মাহানুরের কান্না থামানোর চেষ্টা করে কিন্তু মাহানুর থামছেই না। তার প্রিয় মানুষ তার জন্য কষ্ট পেয়েছে ভাবতেই অনেক কষ্ট লাগছিলো মাহানুরের। এভাবেই লুকিয়ে লুকিয়ে কথা হতো তাঁদের। সাজিদের ফ্যামিলি তাকে বিভিন্ন ভাবে টর্চার করে। মাহানুরের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতে না বলে। কিন্তু সে কারো কথা শুনে না।

এভাবে চলছিল তাঁদের দিন। ধীরে ধীরে সাজিদ একটু অন্যরকম হয়ে যায়। মাহানুরের সাথে কথায় কথায় ঝগড়া করে। অনেক সময় রাগ করে কথাই বলতো না মাহানুরের সাথে। সাজিদের হঠাৎ পরিবর্তন দেখে অনেক কষ্ট পায় মাহানুর। প্রতিরাত সে কান্না করত। সাজিদ কল দিলে তাকে বুঝাতো তার এইরকম সাজিদকে ভালো লাগে না। সাজিদ আগে যেমন ছিল তেমনই জানো হয়ে যায়। সাজিদ হু হা ছাড়া কিছুই বলতো না। একদিন মাহানুরের ভাইয়ের মেসেঞ্জারে কয়েকটা ছবি আসে। ছবি গুলো ছিল কারো মেসেজের স্ক্রিনশর্ট। সাজিদ একটা মেয়ের সাথে ভীষণ নোংরা ভাবে কথা বলছিলো স্ক্রিনশর্ট গুলোতে। আয়াস ও মাহানুর দেখে। মাহানুর তখনই কান্না করে দেয়। সাজিদকে ফোন করে। সাজিদ তাকে অনেক বুঝায়। মাহানুরও ভাবে সাজিদকে সে কোনো মূল্যে হারাতে চায় না। সাজিদই যে তার সব! তাই মাহানুর সবটা ভুলে সাজিদকে একটা চান্স দেয়।

তাঁদের একটুআরেকটু কথা হতো। সামনেই টেস্ট এক্সাম ছিল। মাহানুরের মানসিক অবস্থা ভীষণ খারাপ ছিল। সাজিদকে নিয়ে টেনশন করতে করতে তার পড়াশোনা মন বসতো না। হঠাৎ এক টানা কয়েকদিন সাজিদ মাহানুরের সাথে কোনো কন্টাক্ট করেনি। একটু চিন্তিত হয়ে পরে মাহানুর। কী করবে কী করবে ভেবে পাচ্ছিলো না। তার ভাইয়ের কথা মতো সাজিদকে মেসেঞ্জারে মেসেজ দেয় মাহানুর। তখন সময়টা ছিল রাত একটা। মাহানুরের মেসেজের কিছুক্ষন পরই সাজিদ অনলাইনে আসে। মাহানুর রেগে বলে,

-তুমি লাইন আসো অথচ আমাকে একটু মেসেজ বা কল করে বলতে পারো না! তুমি জানো আমি কত টেনশনে থাকি?

সেদিন রাতে সাজিদ ভয়ংকর একটি মেসেজ পাঠায় মাহানুরকে। যেটা দেখে মাহানুরের পুরো দুনিয়া থেমে যায়।

-মাহানুর আমি আর তোমার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতে চাই না। এখন তোমারও উচিত নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস করা আমার ও। হয়তো তুমি আমার কিসমতে ছিলে না! আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াই বেস্ট।

-তুমি শয়তানি করছো? আমি কিন্তু এমন শয়তানি পছন্দ করি না।

-শয়তানি করছি না মাহানুর।

সেদিনের মাহানুরের চোখের পানির বাধ ভেঙে যায়। অশ্রুর বন্যা বয়ে যায়।

-আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না সাজিদ। আর এইসব কী বলছো তুমি? আমরা দুইজন দুইজনকে ভালোবাসি? কেনো আলাদা হবো আমরা। আমার স্বপ্নের কী হবে?

-এটা ছাড়া কোনো উপায় নেই মাহানুর।

-প্লিজ সাজিদ আমার স্বপ্ন ভেঙ না। দরকার পড়লে আমরা কোনো কথা বলবো না প্লিজ?

-মাহানুর বুঝার চেষ্টা করো?

-আমি কিছু বুঝতে চাই না। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না সাজিদ। আমাকে ছেড়ে দিও না।

সাজিদ আর কোনো রেপ্লায় দেয়নি। ব্লক করে দেয় মাহানুরকে সব জায়গায়। জ্ঞানশূন্য হয়ে চিৎকার করে কান্না করে মাহানুর। আয়াস পাশেই ছিল। মাহানুরকে শান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু সেদিন মাহানুর চুপ হয় না। ভীষণ কঠিন ভাবে মাহানুরের দিন চলছিল। কয়েকবার ম*রে যাওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয়। স্কুল তখন বন্ধ ছিল। প্রাইভেট পড়তেও সাজিদ যেত না। কয়েকমাসের মধ্যে মাহানুরের সাথে আর দেখা হয়নি সাজিদের। টেস্ট পরীক্ষা হয়ে যায়। মাহানুর ভীষণ খারাপ একটা ফলাফল করে। আর সাজিদ এ প্ল্যাস পায়। বন্ধের পর স্কুল খুলে। প্রথম কয়েকদিন মাহানুর স্কুলে যেতে চায়নি। পরে কী মনে করে জানো স্কুলে যেত। সাজিদকে দেখতো। তার বুক কেঁপে উঠতো ভয়ংকর ভাবে। কিন্তু যখনই মনে পড়তো এই ছেলের জন্য সে সারারাত কান্না করে নিজের বেহাল অবস্থা করেছে তখন ভীষণ রাগ উঠতো। নিজেকে শক্ত করে ফেলে। স্কুলে যেত আসতো। বান্ধবীদের সাথে এনজয় করতো। সাজিদের দিকে তাকাতো না। একদিন মাহানুর স্কুলে যাচ্ছিলো তখনই তার সামনে সাজিদের কয়েকটা ফ্রেন্ড এসে দাঁড়ায়। লোলুপ দৃষ্টিতে মাহানুরের দিকে তাকিয়ে বলেছিল,

-সাজিদের সাথে সম্পর্ক নেই তো কী হয়েছে আমরা আছি না! সাজিদের সাথে যেভাবে রাত কাটিয়েছো আমাদের সাথেও কাঁটাতে পারো জান।

সাজিদের বন্ধুদের এইরকম জঘন্য কথা শুনে চোয়াল শক্ত হয়ে যায় মাহানুরের। মানুষ কতটা খারাপ হলে একজন মেয়ের নামে এইরকম নোংরা কথা ছড়াতে পারে! মাহানুর শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করেছিল,

-তোমাদের কে বলেছে যে আমি সাজিদের সাথে রাত কাটিয়েছি?

-সাজিদ নিজেই বলেছে।

স্কুলের সবাই জানতো মাহানুর ভীষণ শান্ত ভদ্র মেয়ে। কিন্তু সেদিন সাজিদের বন্ধুদের কথা মাহানুরকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে দেয়। স্কুলে ঢুকে দেখে উঠানে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে সাজিদ। মাহানুর অগ্নিমূর্তি হয়ে তেড়ে যায় সাজিদের দিকে। ঠাস করে একটা থাপ্পড় মেরে দেয় সাজিদের গালে। আশেপাশের সবাই বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে তাঁদের দিকে। মাহানুরের হঠাৎ থাপ্পড় দেওয়ায় ভড়কে যায় সাজিদ। কোনো কারণ ছাড়াই মাহানুর কেনো তাকে থাপ্পড় মারবে! রাগে সেও মাহানুরকে উল্টো থাপ্পড় মারে। ঠোঁট কেটে যায় মাহানুরের। সে সেদিন আর দমে থাকলো না মাহানুর খান। নিজের পায়ের জুতো খুলে মারতে লাগলো সাজিদকে। আর মুখে ছিল জঘন্য গা*লি। পরে সবাই মিলে তাঁদের আটকায়।

সেদিন থেকেই মাহানুর শপথ করে সে এমন স্ট্রং হবে জানো ফিউচারে ছেলেরাও তাকে দেখলে ভয় পাবে। আর কোনো ছেলেকে ভাও দিবে না। জীবনে অনেক হাসিখুশি থাকবে। এই সাজিদকে দেখিয়ে দেবে তাকে ছাড়াও মাহানুর অনেক সুন্দর ও হাসিখুশি জীবনযাপন করছে। এক বছর সময় লাগে তার নিজেকে পরিবর্তন করতে ও সাজিদকে ভুলতে। কিন্তু সেদিন স্কুলে মাহানুর একটা ভুল করেছিল। না জেনেই সাজিদের ওপর আক্রমণ করা ঠিক হয়নি। সাজিদের বন্ধু গুলো খারাপ ছিল। মিথ্যা বলে সাজিদকে ফাঁসিয়ে দিয়েছিল সেদিন। এখন তার জীবনে সাজিদ নামক কোনো অধ্যায়ই নেই। এক কালো অতীত ছিল যেটা মাহানুর মনে করা প্রয়োজন বলে মনে করে না।

__________________🖤

রাত দশটায় ঘুম ভেঙে যায় মাহানুরের। কোনোরকম ডিনার করে আবার ঘুমের দেশে পারি জমায়। বেচারা আরহাম! লাগাতার মাহানুরের ফোনে কল দিয়েই যাচ্ছে কিন্তু মাহানুর তো ঘুমে বেহুঁশ রিসিভ কীভাবে করবে!

পরেরদিন সকালে চট্টগ্রাম চলে যায় আরহাম। সে চেয়েছিল একবার মাহানুরের সাথে দেখা করতে। কিন্তু এই মেয়েটা তার ফোনই ধরছে না। মনে অভিমানের পাহাড় জমা হয় আরহামের। কিন্তু মাহানুর যে সকালে ঘুমিয়ে ছিল সেটা অজানাই রয়ে গেলো আরহামের। সকাল থেকে ভীষণ জ্বর মাহানুরের। আজ ভার্সিটিও যায়নি। ঔষধ খেয়ে ফের ঘুমিয়ে আছে। বাড়ির সবাই চিন্তিত ভঙ্গিতে একটু পর পরই মাহানুরকে দেখে যাচ্ছে।

দেখতে দেখতে চলে যায় তিন তিনটে মাস। বর্ষাকাল যেয়ে শরৎকালের আগমন ঘটেছে মাসখানেক আগে। জায়গায় জায়গায় সাদা কাশফুলের সমাহার। আজ মাহানুর ও তার বন্ধুরা ঘুরতে গিয়েছে কাশফুল বনে। অনেক গুলো ছবি তুললো। আরহামের সাথে তার মাঝে মাঝে কথা হয়। ঝগড়া ছাড়া তেমন কোনো কথা হয় না দুইজনের মধ্যে! আরহাম এখন নিজের কাজে সম্পূর্ণ ব্যস্ত। তার পদ পরিবর্তন হয়েছে। আগে ছিল ক্যাপ্টেন আর এখন মেজর আরহাম চৌধুরী।

কিছুক্ষন আগেই নতুন সৈনিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যে আরহামকে ডাকা হয়েছিল। একজন ট্রেনিং অফিসার আরহামকে দেখিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলে,

-উনি মেজর আরহাম চৌধুরী। সবাই হয়তো কম বেশি চেনেন তাকে?

-ইয়েস স্যার। (সকলে একসাথে বলে)

-তো আপনাদের সবার আরহাম চৌধুরীর মতো হতে হবে। একদম ফিট আর ফুল অফ অ্যাকশন। বুঝতে পেরেছেন?

-ইয়েস স্যার। (সকলে একসাথে)

আরহাম সবার উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনীদের বিভিন্ন কাজ বর্ণনা দিচ্ছে। সকলে মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনছে। কয়েকজন ছেলে আবার মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে। তাঁদেরও স্বপ্ন আরহাম চৌধুরীর মতোই একজন সেনাবাহিনী হওয়া। নতুন সৈনিকদের মধ্যে দুইটা মেয়েও ছিল। দুইজনই আরহামের কথায় মনোযোগ না দিয়ে আরহামের বডি ফিটনেস দেখতে থাকে। এইরকম একজন পুরুষ যদি তাঁদের ভাগ্যে থাকতো! একটি মেয়ে বলে,

-মেজর আরহাম কিন্তু অনেক হ্যান্ডসাম!

-হ্যাঁ, একদম পারফেক্ট যাকে বলে!

-আমার ভীষণ মনে ধরেছে তাকে!

-লাভ নেই। সে বিবাহিত।

-কী বলো? কার ভাগ্যে জুটলো এই হ্যান্ডসামটা?

-স্যারকে সব জায়গায় আমি ফলো করি। তার ফেইসবুকে রিলেশনশিপ স্টেটাস ম্যারিড দেওয়া। কিন্তু তার ওয়াইফকে মেনশন করেনি। এমন কী ওয়াইফকে ট্যাগ করে কোনো পোস্টই করে না! আমার মতো অনেক মেয়েই তার ভাগ্যবতী ওয়াইফকে এক নজর দেখতে চায়।

-আহ মনটা ভেঙে গেলো!

-এখন স্যারের কথায় মনোযোগী হও।

-হ্যাঁ।

>>>চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here