তাসের ঘর পর্ব -১২ ও শেষ

#তাসের_ঘর
#নীরা_আক্তার
#পর্ব-১২(শেষ পর্ব)
আজকাল শেফালি বেগম তনুর সাথে বেশ খারাপ ব্যবহার করে।ব্যপ্যারটা আন্জুআড়া বানুরও চোখে লাগছে খুব।আন্জুআড়া বানু নিজেকে সামলাতে না পেরে একদিন বলেই বসে,
-তনুর সাথে এভাবে কথা বলো না ভাবি,তুমি তো ওকে ছোটবেলা থেকে মানুষ করেছো!একবার ওর মুখের দিকে তাকাও কতোটা কষ্ট পায় ও তোমার ব্যবহারে!

শেফালি বেগম কিছুটা হকচকিয়ে বলে উঠে,
-তুমি কি করে আশা করো আমি তেমার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নাতি-নাতনীর আশা ভুলে যাবো।
কিছুক্ষণ থেমে তিনি আবার নিজে থেকেই বলে উঠে,
-আজকাল অনেক চিকিৎসার পদ্ধতি বেরিয়েছে, আল্লাহ দিলে টাকা পয়সার ও তো কোনো অভাব নেই।দেখো কি হয়,পরে যদি নাই হয় তখন ভাবা যাবে….

-না হলে কি করবে ভাবি?
শেফালি বেগম আন্জুআড়া বনুকে কোনো উওর দেয় না।

মায়ের জোরাজোরিতে রূপ বার কয়েক তনুকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়।
তবে বিষয়টায় যে রূপের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই তনু তা বেশ বুঝতে চাইছে।
রিপোর্ট থেকে শুরু করে ডাক্তারের সাথে তার করা সম্পূর্ণ কনভার্শেসনের কোনো কিছুই সে তনুকে জানায় না।
তনু বেশ রেগে আছে রূপের উপর।রূপ বিছানায় হেলনা দিয়ে শুয়ে ফোন চাপছে।রূপকে বার কয়েক ডাকার পরও তার কোনো রেসপন্স নেই।
তনু আরো রেগে যায়।রূপের হাত থেকে ছো মেরে ফোনটা নিয়ে নেয়,
– কি হলো ফোন নিলি কেন?
-ডাকছি তো
-হু
-কি হু?
-শুনছি তো বল
-ডাক্তার কি বলেছে?
-কোন ডাক্তার?
-কোন ডাক্তার মানে।আমাদের বাচ্চা কবে হবে?
-এতো বাচ্চা বাচ্চা করিস কেন?তুই নিজেও তো একটা বাচ্চা!
-ধ্যাত বলো না।
-কিছু না
-বলো না…
-বললাম তো কিছু না

তনু একটু থেমে যায়।আস্তে ধীরে বলে উঠে,

-শোনো না…ডাক্তার কি আমার কোনো প্রবলেমের কথা বলেছে? আমার জন্যই কি!!

রূপ একটু সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে উঠে
-বলেছে তো।ডাক্তার এটাও বলেছে আমার জন্য নাকি মেয়ে দেখে রেখেছে আমি রাজি থাকলেই হাসপাতালেই বিয়ে দিয়ে দেবে।মেয়ে কিন্তু তোমার চেয়ে সুন্দরী
-তুমি দেখেছো?
-না ডাক্তার বললো…
-আমি তাহলে কম সুন্দরী তাই তো?

তনু রূপের দিকে তাকিয়ে আছে রূপ হো হো করে হেসে উঠে।তনু কেঁদে দেয়।রূপ তনুকে জড়িয়ে ধরেছে,
-আজকাল মা তোমাকে খুব কথা শুনাই তাই না তনয়া
-বাদ দাও আমি কিছু মনে করি না।হাজার হোক শ্বাশুড়ি বলে কথা।
-কষ্ট পেয়ো না তনু আমি আছি তো।
-তুমি আছো বলেই তো আমি আছি।

রূপে নানু আপু বেড়াতে এসেছেন।কিছুদিন এ বাড়িতে থাকবেন।তনুকে তিনি অবশ্য আগে থেকেই চিনেন।রূপের আম্মু যখন বাবার বাড়ি যেতো তনুকেও সাথে নিয়ে যেতো।তনুকে তিনি আদর করেন।
রূপ আর তনুকে দোয়া দেন।

রূপ তনুকে কাছে ডেকে বসিয়ে নেন
-কি বাবা বাচ্চা কবে নিবা?আমার দিন তো ফুরায়ে এলো নাতীর মুখ দেখছি এখন পুতীর মুখ না দেখলে হয়!
তনু চোরের মতো মাথা নিচু করে নেয়।
তিনি আবারও প্রশ্ন করেন,
-তোমরা কোনো পদ্ধতি করে রাখছো নাকি বউয়ের কোনো সমস্যা আছে?

রূপ হাসতে হাসতে উওর দেয়,
-নানুআপু সমস্যা তো আমারও থাকতে পারে শুধু ওরে প্রশ্ন করো কেন?
-নাউজুবিল্লা কি বলো নানা তোমার সমস্যা থাকবে কেন।তুমি আমার যুয়ান পুরুষ তোমার সমস্যা কি!পুরুষ মানুষের আবার সমস্যা থাকে!

রূপ একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
-নানুআপু সমস্যা কি শুধু মেয়েদেরই থাকে?
-তুমি পুরুষমানুষ এইসব মেয়েদের ব্যাপ্যার বুঝবা না।যাও তুমি যাও তোমার বউয়ের সাথে কথা বলি।

রূপ যেতে না চাইলেও শেফালী বেগম রূপকে বকে পাঠিয়ে দেয়,
“এখন মেয়েদের কথা হবে মেয়েদের মাঝে তুমি পুরুষমানুষ কি করবা?যাও ঘরে যাও”

রূপ উঠে চলে যায়,
তনু কে কাছে ডাকে,তনু কাছে যেতেই হাত ধরে বসিয়ে দেয়,
-বউ তোমার কি কোনো সমস্যা হয়?
তনু উওর দেয়
-কিসের সমস্যা?
শেফালী বেগম ধমকিয়ে প্রশ্ন করে,
-বুঝিস না কি সমস্যা
নানুআপু তনুর হাতে একবোতল পানি ধরিয়ে দেয়
-এই নাও পানি পড়া,এটা মাজারের পানি পড়া যারা খায় তাদের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাচ্চা হয়।তোরও হবে চিন্তা করিস না।
তনু নিতে চায় না শেফালী বেগম জোড় করে হাতে পানি পড়া গুজিয়ে দেন!
তিনি সাথে করে এক জোড়া বাতাবি লেবুও এনেছেন,
-বউ এই জোড়া একসাথে খাবা!তাহলে জোড়া বাচ্চা হবে।বহু কষ্টে এই জোড়া জোগাড় করছি। বছরে একবারই ধরে। অনেক গুনের জিনিস এখনই খাবা কিন্তু।

তনু বিষ্ময়ের সাথে তাকিয়ে আছে।
-এতোগুলো একসাথে খাবো
-হয় একসাথে খাবা।যাও এখনই খাও।দোয়া কালাম পড়িও।

তনু ঘরে যায়।রূপ বিছানায় উবু হয়ে শুয়ে বই পড়ছে।তনু বাটি ভর্তি বাতাবি লেবু মাখা নিয়ে বসে পরে রূপের পাশে
রূপ মুখ তুলে তাকায় তনুর দিকে
-এগুলো কি?
-লেবু দেখো না?
-গাছের সব বাতাবি লেবু নিয়া বসছো পেট খারাপ করবে না?
-না করবে না।

রূপ উঠে বসে,
তনুর হাত থেকে নিয়ে এক চামুচ খেতে নিলে তনু বলে উঠে
-নানুআপু শুধু আমারে খাইতে বলছে?পানি পড়াও দিছে
রূপের কপালে জড়িয়ে উওর দেয়
-কেন?
-এগুলো খাইলে বাচ্চা হয়!
-কিহ?যতোসব আজগুবি কথা!
-হুম্ম।তুমি খাইলে তোমারও হবে
-কি বলিস?
-হুম্ম
রূপ হাসতে হাসতে একচামুচ খায়
-বাচ্চা তোর হোক বা আমার হওয়া নিয়ে তো কথা।একজনের হইলেই হইলো

তনু মুখ ভেংচি কাটে
-এগুলো সব কুসংস্কার!নানু আপু পুরানো দিনের মানুষ ওনু এগুলো বিশ্বাস করতেই পারেন তাই বলে তুই এইসব আজগুবি কথা মানবি নাকি!

তনু খেতেই থাকে রূপ হাত থেকে বাটিটা কেড়ে নেয়।

***
শেফালী বেগমের মাথা প্রচুন্ড গরম হয়ে আছে।সকাল থেকে তিনি নিজ ঘর থেকেই বের হননি।খাওয়া দাওয়া তো দূরের কথা।আন্জুআড়া বানু শেফালী বেগমের সাথে কথা বলতে গেলে তিনি সাফ জানিয়ে দেন প্রয়োজনে তিনি রূপের বিয়ে দেবেন,কিন্ত তারপরও তার একটা নাতি অথবা নাতনী চাই।চাই মানে চাই।

রূপ মায়ের কাছে যায়।শান্ত গলায় প্রশ্ন করে,
-মা এমন কেন করছো?
-বাবা আমি কি নাতি নাতনীর মুখ দেখবো না?
-আল্লাহর ইচ্ছা হইলে অবশ্যই দেখবা!
-তনুর কি কোনো সমস্যা আছে?ডাক্তার কি বলছে!আমার থেকে কিছু লুকাস না বাবা।
রূপ চোখ মুখ শক্ত করে প্রশ্ন করে
-যদি সমস্যা থাকে তাহলে কি করবা?
-তোর আরেকটা বিয়ের ব্যবস্থা করি?

এবার রূপের মাথাটা গরম হয়ে যায়
-শুধু মাত্র একটা বাচ্চার জন্য এতো বছরের ভালোবাসা জলাঞ্জলি দেবো?বাচ্চা তো যেকোনো অনাথ আশ্রম থেকেও পাওয়া যায়।আমরা না হয় কোনো অসহায় বাচ্চার দায়িত্ব নেবো!!

শেফালী বানু রূপকে ধমকিয়ে থামিয়ে দেয়,
-যারে তারে টোকাইয়া নিয়া আবসি আর আমার তারে মানা লাগবে?
রূপ একটু চেচিয়ে উঠে,
-তার মানে তোমার কথা অনুযায়ী তনুর সমস্যা থাকলে আমার তনুকে ছেড়ে দিয়া আরেকটা বিয়ে করতে হবে নিজের জন্য তাই তো?
-ছাড়বি কেন!তনু থাকবে সমস্যা কি!
-থামো তো মা।
-রূপ

রূপ ঘরে যায়।কিছু কাগজ পত্র হাতে করে নিয়ে আসে,মায়ের কাছে দেয়,
-নাও দেখো
-কি এগুলি
-রিপোর্ট। সমস্যা তনুর না আমার এখানে সব লিখা আছে দেখো।
শেফালী বেগম অবাক চোখে তাকিয়ে আছে রূপের দিকে
-তোমার কথা মতো যার সমস্যা আছে তারে ছাইড়া দেওয়া উচিত তার মানে তনুর উচিত আমারে ছাইড়া দেওয়া।মামনী তনুর জন্য ছেলে দেখো।আমার জন্য শুধু শুধু তনু কেন মাতৃত্বের সাধ থেকে বন্ঞ্চিত হবে।

তনু এতোক্ষণ চুপ ছিলো।এবার সব মৌনতা ভেঙ্গে সে কান্না করতে করতে রূপকে জড়িয়ে ধরে।
-পাগল হইছো তুমি?কি সব বলো।তুমি যেমনই হও আমি তোমাকে ভালোবাসি।আর কিছুই জানি না আমি!
-সত্যিই বললাম।বলতে চাইনি কারন নিজেকে ছোট মনে হয় কিন্তু মা বুঝলো না।তনু আমার সব কিছু মেনে নিয়ে তুই থাকবি আমার সাথে?
তনু কান্না করে,চুপ করে থাকে,মৌনতা সম্মতির লক্ষণ

শেফালী বানু কান্না করছে।সে তনুর কাছে ক্ষমা চায়।সত্যিই সে বড্ড ভুল করে ফেলেছে।

এতোকিছুর মাঝে আন্জুআড়া বানু কোনো কথা বলছে না অবাক চোখে তাকিয়ে আছে রূপের দিকে।রূপ যেন জ্বলজান্ত ভালোবাসার প্রমান!!

সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত পরিস্থিতি বেশ স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে।শেফালী বেগমও আগের মতোই স্বাভাবিক। তনুর প্রতি তার ভালোবাসা কয়েকগুন বেড়ে গেছে।রূপ আন্জুআড়া বানুর পাশে গিয়ে বসে পড়ে,
-ডাকছিলে মামনী?
-হুম্ম।রূপ প্রত্যেকবারের মতো এবার আর প্রশ্ন করব না তুমি তনুকে ভালোবাসো কি না,কারণ আমি জানি হয়তো এই পৃথিবীতে তোমার থেকে বেশি কেউ তনুকে ভালোবাসে না।

রূপ মামনীর হাত চেপে ধরে,
আন্জুআড়া বানু একটু দম নিয়ে বলে উঠে,
-আমি জানি প্রবলেম তোমার নয় তনুর মধ্যে আছে।তনুর কমপ্লিকেশনের জন্য আমিই দায়ী।সেদিন এক্সিডেন্টের পর ওর প্রপার কেয়ার নিতে পারি নি।আই আম সরি।
-ছাড়ো তো মামনী।সন্তান আল্লাহর দান।আল্লাহর ইচ্ছা হলে হবে আমাদের বাচ্চা।ট্রিটমেন্ট তো চলছেই।
-এইসব কেন করলে বাবা?
-দেখলে না মার মাথাটা কি ভাবে খারাপ হয়ে গিয়েছিলো!আমি চায়না আমার তনুকে কেউ অসন্মান করুক।আমি তনুর সারা জীবনের সুখের দায়িত্ব নিয়েছি।

রূপ বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।আন্জুআড়া বানু কাঁদছে।তবে এটা কষ্টের কান্না না সুখের কান্না সত্যিই ভালোবাসা সুন্দর।মনে মনে আন্জুআড়া বানুর একটু আফসোস ও হয়।

“ইস্ সে দিন যদি তন্ময় এভাবে তার পাশে থাকতো তাহলে হয়তো তার জীবনটা অন্যরকম হতো।কিন্তু না সে তো তাসের ঘর তৈরী করেছিলো।যেই ঘরে ভালোবাসার অভাব ছিলো।সামান্য হাওয়ায় ভেঙ্গে গেছে।তবে তার মেয়ের ঘরে ভালোবাসার অভাব নেই এটাই তো মা হিসেবে শ্রেষ্ট প্রাপ্তি।ভালোবাসা সত্যিই সুন্দর। হাজার অপ্রাপ্তির দুঃখকেও সুখে রূপান্তর করতে পারে”

***
সকাল থেকে রূপকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না।সন্ধ্যে হতে চললো রূপের কোনো পাত্তা নেই।এদিকে ফোনও লাগছে না। তনুর যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে চিন্তায়।আচ্ছা অনুশোচনায় রূপ কিছু করে বসলো না তো!
তনু আর কিছু ভাবতে পারছে না!!

প্রায় সন্ধ্যে নাগাত রূপের ফোন লাগে।রূপ কল রিসিভ করতেই তনু হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে,
-কি হয়েছে কাঁদছিস কেন?
-কোই তুমি?আল্লাহর দোহাই লাগে বাড়ি ফিরে আসো,আমার সত্যিই কিছু চাইনা তুমি হইলেই হবে।প্লিজ বাড়ি ফিরে আসো।আমার তোমারে নিয়া আর কোনো অভিযোগ নাই

রূপ মুচকি হাসি দেয়,ঠান্ডা গলায় উওর দেয়
-কাঁদিস না তনয়া আজ না তোর জন্মদিন!আনি তো তোর জন্য উপহার নিতে এসেছি।আর একটু অপেক্ষা কর প্লিজ।
তনু কিছু বলতে যাবে তার আগেই রূপ ফোন রেখে দেয়।

তনু কিছুটা শান্ত হলেও,চিন্তা মুক্ত হতে পারলো না!!

প্রায় রাত আটটা নাগাদ রূপ বাড়ি ফিরে আসে সঙ্গে একটা সদ্য জাত বাচ্চা।ফুটফুটে একটা মেয়ে বাবু।
তনু দৌড়ে রূপের কাছে যায়।রূপ বাচ্চাটা তনুকে দেখিয়ে বলে
-দেখ বাচ্চাটা দেখতে একদম তোর মতো!
তনু আঙ্গুল উচিয়ে বলে,
-বাচ্চাটা কি আমাকে মা ডাকবে?
-হু ডাকবে তো আর আমাকে বাবা!!
তনু খুব খুশি।রূপ তাকে জন্মদিনের সেরা উপহার দিয়েছে।

সে বছর গড়াতে না গড়াতেই তনু কান্সিভ করে।অনেক কমপ্লিকেশনের মাঝেই তনুর জমজ বাচ্চা হয়।দুইটা ছেলে বাচ্চা হয়েছে।
তনু আর রূপ এখন তিন বাচ্চার বাবা-মা।

মাঝে মাঝে রূপ মজা করে তনুকে বলে,
-তনু নানুআপু কে বলিস এবার জেন তোকে ট্রিপল বাতাবি লেবু খাওয়ায় তাহলে এবার একটা না দুইটা না একসাথে তিনটা বাচ্চা হবে।!!

তনু রাগী চোখে তাকায় রূপের দিকে,রূপ হাসতে থাকে……
ভালোবাসা সত্যিই খুব সুন্দর!!

………………(সমাপ্ত)…………….

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here