তাসের ঘর পর্ব -০৯

#তাসের_ঘর
#নীরা_আক্তার
#পর্ব-৯
“এই পৃথিবীতে সব থেকে বেশি বিশ্বাস আমি দুইজন মানুষকে করতাম,একজন তনুর বাবা আর একজন তুমি রূপ….অথচ তোমরা দুইজনই আমাকে ভীষনভাবে ঠকালে”
আন্জুআড়া বানু কথাগুলো বলে নিজের ঘরে চলে যায়।একটু পরই গ্রাম থেকে মেয়ে পক্ষআসার কথা ছিলো।
রূপের বাবার বন্ধুর মেয়ে।সব ঠিক ঠাক থাকলে আজই বিয়ে পড়িয়ে দেবে বলে ঠিক করেছিলেন আন্জুআড়া বানু।
****
রূপ সারাদিন ভেবে পায় না কি করবে।এদিকে তনুও সারাদিন থমথমে মুখ করে আছে।না কিছু খাচ্ছে না কারো সাথে কথা বলছে।

রূপ বার কয়েক তনুর সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেও সে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
একটু আগে তনু রূপের ঘরে গিয়েছিলো তাকে পড়ার জামা দিতে,
তনু জামা রেখে ফিরে যেতে নিলে রূপ তনুর হাত ধরে নেয়
-কথা বলিস না কেন
-ইচ্ছে করছে না
-আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না?
-না তো….তোমার সাথে কেন হবে না।আমার তো আমার স্বামীর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না যেই স্বামী একটু পর নতুন বর সেজে অন্য মেয়ের কাছে যাবে।বিয়ে করবে বাসর করবে…

রূপ একটু রাগী গলায় বলে উঠে
-কি সব বলছিস।মাথা ঠিক আছে।
-ঠিকিই তো বলছি।
-কি চাস?
-কিছু না
-তনয়া
-সংসার করতে চাই।সবার সমনে বুক ফুলিয়ে বলতে চাই তুমি আমার স্বামী আমি বেঁচে থাকতে আমার স্বামীকে অন্য কারো হতে দেবো না।এমন লুকোচুরির সম্পর্ক চাই না আমি।

তনু কথা বাড়ায় না রূপের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে হাটা দেয় নিজের ঘরের দিকে।

রূপ বিছানায় বসে পড়ে।
বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে যায়।একটু আগে অবশ্য শেফালী বেগম রূপকে তাড়া দিয়ে গিয়েছে তবে রূপের কোনো হেলদোল নেই।

এবার আন্জুআড়া বানুর আগমন ঘটে।রূপকে এভাবে বসে থাকতে দেখে বেশ রাগারাগি করে।
রূপ এবার ভিষন রেগে যায়।প্রথমবারের মতো মামনীর চোখে চোখ রাখে
-মামনী আমি বিয়ে করতে পারবো না
আন্জুআড়া বানুও ভণিতা না করেই উওর দেয়,
-বলেছি না তনুর সাথে তোমার বিয়ে আমি দেবো না।
-আমি অলরেডি তনুকে বিয়ে করে ফেলেছি
-মজা করছো?
-না সত্যি বলছি।অনেকতো হলো লুকোচুরি।
-মাথা ঠিক আছে তোমার রূপ
-আমি তনয়াকে বিয়ে করেছি মামনী।তনয়া আমার বিবাহিত স্ত্রী। এক স্ত্রী থাকা অব্থায় আমি আরেকজনকে বিয়ে করতে পারবো না।
-কি সব বলছে
-এখন কি তোমাকে কাবিননামা দেখাবো?তাহলে বিশ্বাস করবে?
এবার আন্জুআড়া বানু ধপ করে বিছানায় বসে পরে
রূপ যে মজা করছে না তা সে বেশ বুঝতে পারছে।
-রূপ আমি তো…তোমার ভালোর জন্যই বলেছিলাম তনুর থেকে দূরে থাকতে।

-আই আম সরি মামনী।আমি তোমায় ভালোবাসি। ঠিক তেমন তনুকেও ভালোবাসি।ওকে আর কষ্ট দিতে পারবো না।

আন্জুআড়া বানু অবাক চোখে তাকিয়ে আছে রূপের দিকে।অনেক ক্ষন দুজনই চুপ।
আন্জুআড়া বানু মৌনতা ভেঙ্গে রূপকে বলে উঠে
-এই পৃথিবীতে সব থেকে বেশি বিশ্বাস আমি দুইজন মানুষকে করতাম,একজন তনুর বাবা আর একজন তুমি রূপ….অথচ তোমরা দুইজনই আমাকে ভীষনভাবে ঠকালে
-আই আম সরি মামনী
-তোমাকে ইটস ওকে বলার মতো কোনো কাজ তুমি করোনি রূপ।

কথাটা যেন রূপে বুকে গিয়ে বাঁধলো।
আন্জুআড়া বানু কথাগুলো বলে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।
****
ডুব দেয় অতীতের পাতায়….

সেদিন সিড়ি থেকে পড়ে আন্জুআড়া বানুর বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে যায়।।।
সেদিন তন্ময় খুব রাগ করেছিলো সাথে খুব কষ্ট ও পেয়েছিলো।তন্ময় যেন একদম চুপ হয়ে গিয়েছিলো।

আন্জুআড়া বানু তন্ময় কেঁদে কেঁদে তন্ময়কে বলেছিলো
-তুমিকি আমায় ভালোবাসো না?আমি সত্যিই সরি
তন্ময় আন্জুআড়া বানুর মাথায় ছোট্ট করে চুমু খেয়ে বলেছিলো ইট’স ওকে।
তবে সত্যিই কি সব ওকে ছিলো!!

আন্জুআড়া বানু বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ে,মানসিক ভাবেও আবার শারিরীক ভাবেও।তখন আন্জুআড়া বানুর এক কাজিন মারিয়াকে আনা হয় বাড়িতে তার দেখাশোনা করার জন্য।কিছুদিন থাকার পর সে চলে গেলোও তার প্রভাব আন্জুআড়া বানুর সংসারকে কতোটা প্রভাবিত করেছিলো তা তিনি তখন বুঝতে পারেন নি।

বেশ কিছুদিন কেটে যায়।আন্জুআড়া বানুর মাঝে বেশ কিছু কমপ্লিকেশন দেখা দেয়।
সে হাজার চেষ্টা করেও কিছুতেই কনসিভ করতে পারছিলো না।তাদের মাঝে দূরত্ব বাড়তে থাকে।

ধীরে ধীরে তন্ময়ের বিহেভিয়ার ও কেমন যেন বদলে যেতে থাকে।সেই আগের কেয়ার ভালোবাসা কিছুই যেন নেই।

আন্জুআড়া বানু তখন বাবার বাড়িতেই থাকতো।তন্ময় মাঝে মাঝে আসতো।বেশির ভাগ সময় সে নিজের বাড়িতেই থাকতো
বছর খানিক এভাবেই কোটে যায়।
একদিন আন্জুআড়া বানু লক্ষ্য করে তন্ময় কারো সাথে ফোনে কথা বলে।তন্ময়কে তার কাছে আসতে বললেও সে তার প্রিয়ো আন্জুকে ইগনোর করতে থাকে।

একদিন আন্জুআড়া বানু কাওকে কিছু না বলেই তন্ময়ের গ্রামের বাড়ি চলে যায়। তন্ময় তখন গ্রামেই ছিলো।
তন্ময় ছোটবেলা থেকেই তার মামা মামীর কাছে মানুষ।
আন্জুআড়া বানু সোজা পৌছে যায় তন্ময়ের মামা বাড়িতে।আন্জুআড়া বানু বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দেখে দোলনায় এক দেড় মাসের দুটো ছোট্ট ফুটফুটে জমজ বাচ্চা দুলছে।আন্জুআড়া বানু কাছে যেতেই একটা বাচ্চা আন্জুআড়া বানুকে দেখে কান্না শুরু করে দেয়।
বাচ্চার কান্না শুনে ভেতর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসে মারিয়া।

মারিয়ে বাহিরে এসে আন্জুআড়া বানুকে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে যায়।মাথাটা নিচু করে নেয়।একটু পর তন্ময় ও বেরিয়ে আসে।

আন্জুআড়া বানুর যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে।
ছুটে তন্ময়ের কাছে যায়।ছোঁ মেরে তন্ময়ের কলারটা চেপে ধরে
-কেন করলে এমন?কেন ঠকালে?বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক। তোমায় সব দিয়েছি আমি,

তন্ময় আন্জুআড়া বানুর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে চেপে ধরে, ছোট্ট করে বলে উঠে,

-সরি আন্জু,আমি শুধু বাবা হতে চেয়েছি।যা তুমি দিতে পারোনি।
-তোমার চাওয়াটাই সব?আমার ভালোবাসা?তার কি কোনো দাম নেই?

তন্ময় কিছু বলে না।মাথা নিচু করে আন্জুআড়া বানুর হাতটা মুখের কাছে নিয়ে ছোট্ট করে চুমু খায়।

আন্জুআড়া বানু হাতটা ছাড়িয়ে নেয়।মারিয়ার কাছে গিয়ে গাল বরাবর একটা ঠাটিয়ে চড় মারে।প্রচুন্ড রাগে মারিয়ার গলা চেপে ধরে।
-কেন করলি এমন?আমি তো তোকে আমার দুঃসময়ের বন্ধু ভেবেছিলাম তুই তো আমার সুসময়ের কাল হয়ে দাঁড়ালি।

ততক্ষণে গোটা বাড়ির লোকজন জড়ো হয়ে গিয়েছে।মারিয়াকে আন্জুআড়া বানুর কাছ থেকে সরিয়ে নেয় তন্ময়ের মামী।

তন্ময়ের মামী বর্জের মতো গর্জে উঠে আন্জুআড়া বানুর উপর,
-কি ভেবেছোটাকি তুমি, বাজা মেয়ে মানুষ!একটা বাচ্চার জন্ম দিতে পারো না আর এসেছো গোমড় দেখাতে!অনেক দেখেছি তোমার তেজ।আমার ছেলের বউ আর নাতনীদের দিকে চোখ তুলেও তাকাবে না বলে দিলাম।বেরিয়ে যাও বাড়ি থেকে….

আন্জুআড়া বানু সেখানেই বসে হাউ মাউ করে কান্না করতে থাকে।তন্ময় যেন সেখানেই জমে গিয়েছে।

একটু পর আন্জুআরা বানু নিজেকে সামলে নেয়।তন্ময় তার কাছে এসেছে।হাত ধরে উঠানোর চেষ্টা করছে।আন্জুআড়া বানু তন্ময়ের হাত সরিয়ে নেয়।চোখ মুখ শক্ত করে উঠে দাড়ায়।
তারপর কোনো কথা না বলেই সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে থাকে
তন্ময় পেছন থেকে দাড়িয়ে বলে উঠে
-আই আম সরি আন্জু,আমি শুধু বাবা হতে চেয়েছিলাম
আন্জুআড়া বানু হাসে,সব কষ্ট চেপে নিয়ে উওর দেয়
-হয়েছো তো।দেখো তুমি এখন দুইটা ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ের বাবা।তোমার ইচ্ছে পুরণ হয়েছে তন্ময়।স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখে থাকো। আমাকে ভুলো যাও।আমার ছায়াও আর তুমি দেখতে পাবে না।
দূরে মারিয়ে দাড়িয়ে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইতে থাকে বোনের কাছে,
আন্জুআড়া বানু তাকেও হাসি মুখে উওর দেয়
-তোর কোনো দোষ নেই দোষ তো আমার আমিই ভিত্তিহীন তাসের ঘর তৈরী করেছিলাম।সামান্য ঝড়েই ভেঙ্গে গেছে।তন্ময় আমি বাজা নই।আর একটু অপেক্ষা করতে পারতে,হয়তো সবটা ঠিক হয়ে যেতো।

আন্জুআড়া বানু আর এক মুহূর্ত সেখানে দাড়ায় না সোজা বাড়ি চলে আসে।

আন্জুআড়া বানুও তখন ২ মাসের অন্তর্সত্তা ছিলো।তবে ব্যাপ্যারটা সে তন্ময়কে জানায় না।
বাড়ি এসে তন্ময় মারিয়ার এই সব কান্ড সে বাবা আর ভাইদের জানায় সব শুনে রূপের বাবা পারলে তন্ময়কে সেখানেই পুতে ফেলবে এমন একটা অবস্থা আন্জুআড়া বানু স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেয় “তন্ময়ের কোনো ক্ষতি করতে চাইলে তারা বোনের মরা মুখ দেখবে”

তন্ময় বার কয়েক আন্জুআড়া বানুর সাথে দেখা করতে চাইলেও সে দেখা করেনি।সব যেন সেখানেই থমকে যায়।
এতো মানসিক চাপ আর ধকল আন্জুআড়া বানু সহ্য করতে পারে না।এই বাচ্চাটাও মিসক্যারেজ হয়ে যায়।
আন্জুআড়া বানুর জীবনটা যেন সেখানেই থমকে যায়।
তবে তার অন্ধকার জীবনে একটু আলো ছিলো রূপ।ভাইয়ের একমাত্র ছেলে হওয়ায় আন্জুআড়া বানু রূপকে প্রচুন্ড ভালো বাসতো।তবে এই সব ঘটনার পর যেন রূপের প্রতি তার ভালোবাসা কয়েকগুন বেড়ে যায়।রূপ তার একাকী অন্ধকার জীবনে একটু আলো।ছোট রূপও ফুপ্পি কে খুব ভালোবাসতো।

মাঝে কেটে যায় কয়েকটি বছর….

হটাৎ একদিন আন্জুআড়া বানুর ফোনে একটা রং নাম্বার থেকে কল আসে।কলটা রিসিভ করতেই জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর মুহূর্তের সম্মুখীন হন তিনি….

চলবে….

(গল্পটা বেশি বড় করার ইচ্ছে নেই।প্রথমবার লিখছি দয়া করে ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here