তাসের ঘর পর্ব -১০

#তাসের_ঘর
#নীরা_আক্তার
#পর্ব-১০
“একবার আসবে প্লীজ,শেষবারের মতো!আমার তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার আছে নয়তো আমি মরেও শান্তি পাবো না”
তন্ময়ের এমন আকুতি চেয়েও ফেরাতে পারছে না আন্জুআরা বানু।ভালোবাসায় যে বড্ড মায়া!!

***
তন্ময় গোটা পরিবার নিয়ে গ্রামে যাচ্ছিলো।তার মামা গত রাতে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান।নিজের বলতে তন্ময়ের মামা আর মামী ছাড়া আর কেউ নেই।খবর পাওয়া মাত্র তন্ময় ভোর রাতেই রওনা হয়ে যায় গোটা পরিবার নিয়ে।তন্ময় একাই যেতে চেয়েছিলো কিন্তু মারিয়া জোর করায় তাকেও নিয়ে যেতে হয়।

হাইওয়ে ক্রস করতে যেতেই গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা খায় এক চলন্ত ট্রাকের সাথে।ঘটনা স্থল থেকে চারজনকে সিফট করা হয় হাসপাতালে।একজনের স্পটডেড আর তন্ময়ের মাথায় আঘাত লেগেছে ইন্টারনাল ব্লিডিং হচ্ছে প্রচুন্ড।হয়তো বেশিক্ষণ বাঁচবে না।
হাসপাতাল থেকে তন্ময় আন্জুআরা বানুকে ফোন করে।খবর পাওয়া মাত্র তিনি কিছু চিন্তা না করে হাসপাতালে রওনা হয়ে যান।

হাসপাতালে পৌছে দেখেন তন্ময় একটা ব্রেন্ঞ্চে বসে আছে।
আন্জুআড়া বানুকে দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে তাকে।তন্ময়ের মাথায় ব্যান্ডেজ করা।
আন্জুআরা বানু বেশ উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করে,
-সবাই ঠিক আছে তো?
আন্জুআড়া বানুকে দেখে তন্ময় বেশ শান্ত হয়ে বসে থাকে কোনো হেল দোল নেই।আন্জুআড়া বানু আবারও প্রশ্ন করে,
-তুমি ঠিক আছো তন্ময়?

তন্ময় আন্জুআড়া বানুর দিকে তাকায়।তন্ময়ের এমন ঠান্ডা দৃষ্টি আন্জুআড়া বানু কখনো দেখে নি,তন্ময় বলতে শুরু করে,

-আমার বাবা আমায় কখনো ভালোবাসেন নি আন্জু!মাকে তার পছন্দ হয় নি।দাদা দাদু জোর করে বাবাকে মায়ের সাথে বিয়ে দিয়েছিলো।দাদুর প্রতি রাগ গুলো বাবা মার উপর ঝাড়তো।বাবা মা কে মারতো।কথায় কথায় অপমান করতো!আমাকেও মারতো।বাবা কখনো আমাদের ভালোবাসেন নি।আমি কখনো দেখিনি বাবা আমার সাথে ভালো করে কথা বলেছে। আমার বন্ধুরা যেখানে তাদের বাবাদের সাথে কাটানো সুন্দর সময়গুলো শেয়ার করতো সেখানে আমি স্মৃতির পাতা হাতরে শুধু বাবার অবহেলা আর আমাকে দেওয়া আঘাত গুলো খুজে পেতাম। আমার বয়স যখন ১১ বছর তখন আমার মা মারা যায়,বাবার অত্যাচার সহ্য করতে পারেনি আমার মা।
কথাগুলো বলার সময় তন্ময়ের গাল বেয়ে কয়েকটা ফোটা পানি মাটিতে পরে

-আন্জু আমি বাবা হতে চেয়েছিলাম।পৃথিবীর সব থেকে ভালো বাবা।আমার চাওয়ার মধ্যে তো কোনো পাপ ছিলো না তবে আমি সেই চাওয়া পুরন করার জন্য পাপ করেছি।তোমার সাথে অন্যায় করেছি।আমায় ক্ষমা করে দাও আন্জু।

তন্ময় কেঁদে দেয়।আন্জুআরা বানু তন্ময়কে ঠিক কি বলে সান্ত্বনা দেবে বুঝে উঠতে পারে না।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও প্রশ্ন করে,
-তুমি ঠিক আছো?
তন্ময় এবার হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে।আন্জুআরা বানু কি বলবে বুঝতে পারছে না।
-আন্জু আমি এমনই হতভাগ্য পিতা যার কাছে নিজের সন্তানকে দাফন কাফন করার মতোও সময় নেই।
আন্জুআড়া বানু চমকে উঠে।তন্ময়ের হাত চেপে ধরে,
-কি হয়েছে তন্ময়? সবাই ঠিক আছে?
তন্ময় একটা ঢোক গেলে,
-আমার এক মেয়ের লাশ ভেতরে আছে।আরেক মেয়ে আইসিইউ তে আছে।বাঁচবে কি না তার ঠিক নেই।মারিয়াও আইসিইউ তে আছে।আর আমি!
-তুমি ঠিক আছো?
-আন্জুআমার কাছে বড়জোড় বিশ থেকে ত্রিশ থেকে মিনিট সময় আছে।
আন্জুআড়া বানু কিছু বলতে চাইলে তন্ময় তাকে থামিয়ে দেয়,
-আমি এক হতভাগা পিতা যে নিজের হাতে নিজের মেয়ের লাশ বয়ে নিয়ে এসেছি।আমার কাছে সময় নেই আমার মেয়ের দাফন করানোর মতো।আমার কি সত্যিই এতো বড় শাস্তি প্রাপ্য ছিলো?
-আমি তোমায় অভিশাপ দেইনি তন্ময়!
-আমি জানি তোমার মন অনেক বড়।পাপ করেছি আমি শাস্তি তো পেতেই হবে।তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ আমি মারা যাওয়ার পর ভেতরে আমার দুধের বাচ্চার লাশটা আছে ঐটার দাফন কাফনের ব্যবস্থা করিও।আর আমার ছোট মেয়েটা যদি অনাথ হয়ে যায় তাকে কোনো অনাথ আশ্রমে দিয়া দিও।আর কিছু চাই না আমি।আমার সন্তান লালন পালন করার দাবী আমি তোমার কাছে রাখবো না।সেটা রাখার মতো যোগ্যতাও আমার নেই।

আন্জুআড়া বানু তন্ময়কে জরিয়ে ধরে।প্রচুন্ড বেগে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।যেই মানুষটার সুখের জন্য সে সর্বস্ব ত্যাগ করতে রাজি ছিলো আজকে সেই মানুষটার হাতেই মাত্র কয়েক মুহূর্ত আছে বেঁচে থাকার জন্য।

তন্ময় মারা যায়।
সে যাত্রায় মারিয়া আর তন্ময়ের ছোট মেয়ে তনু বেচে যায়।মারিয়া বেঁচে গেলেও জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান দুইজনকে একসাথে হারিয়ে ফেলেছে সে।
এই শোক তাকে না বাঁচতে দেয় না মরতে।সে কারো সাথেই কথা বলে না।

এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে যায়।তনু তখনও হাসপাতালে ভর্তি।একদিন ঘর থেকে মারিয়ার মৃত দেহ উদ্ধার করা হয়।সে আত্নহত্যা করেছে।মারা যাওয়ার আগে মারিয়া শেষবারের মতো কথা বলেছিলো,

“আমায় ক্ষমা করে দিস বুবু।আমার জীবনের সব চেয়ে বড় ভুল ছিলো তন্ময়।কিন্তু আমি সেই ভুলটাকেই খুব ভালোবাসি।এতোটাই ভালোবাসি যে আমি তন্ময় কে ছাড়া বাঁচতে পারবো না।”

আন্জুআড়া বানু সে যাত্রায় তাকে সেদিন তাকে সান্ত্বনা দিলেও মারিয়ার কাছে এইসব সান্ত্বনার কোনো মূল্যই ছিলো না।

সে তো ঠিক করেই ফেলেছিলো যে পৃথিবীতে তন্ময়কে ছাড়া থাকতে হবে সে পৃথিবীতে সে থাকবে না।
আবার একরকম ভাবে স্বামী সন্তানের মৃত্যুর জন্য সে নিজেকেই দায়ী করে।সেদিন সেই তো তন্ময় কে জোর করেছিলো তাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য

নিজের গোটা পরিবারটাকে হারিয়ে তনু এখন অনাথ।আন্জুআড়া বানু ভেবে পায় না সে কি করবে,ছোট তনুকে কি তন্ময়ের কথা মতো অনাথ আশ্রমে দিয়ে দেবে নাকি নিজের কাছে রাখবে?

আন্জুআড়া বানু তনয়াকে নিজের কাছে রেখে দেয় নিজের মেয়ের মতো করে।রূপের বাবা অবশ্য তনুকে রাখতে নারাজ।তনু যেন তার দুই চোখের বিষ। সেই ছোট্ট তনুকে বাড়িছাড়া করতে তিনি কোনো পরিকল্পনা বাধ রাখেন নি।বোনের সংসার ভাঙ্গার এক মাত্র কারণই তো এই তনুই। তবে আন্জুআড়া বানু নাছর বান্দা তনুকে তিনি নিজের কাছেই রাখবেন।তাতে যে যা বলার বলুক।

তনু ছোটবেলা থেকেই বেশ অসুস্থ ছিলো।এক্সিডেন্টে কারনে তার শরীরে বেশ কিছু কমপ্লিকেশন দেখা দেয়।আন্জুআড়া বানু তনুকে নিজের সন্তানের পরিচয় দিলেও সন্তান সমতুল্য ভালোবাসা কখনো দিতে পারেননি।

তনুকে দেখলে তার তন্ময়ের কথা মনে পড়তো।আবার মনে পড়তো মারিয়ার করা বিশ্বাস ঘাতকতার কথা।
কিন্তু দিন শেষে তিনি তনুর মা।জন্ম না দিলেও তনুর প্রতি সমস্ত দায়িত্ব তিনি একা পালন করেছেন।তনুকে তিনি ভালোবাসেন।তনুর জন্য তার মনে সেই ভালোবাসার জায়গাটা বড়োই গভীর।তনু তন্ময়ের একমাত্র স্মৃতি যেটা তিনি বহন করছেন
*****

আন্জুআড়া বানু নিজেকে সামলে নেয়।চোখ মুখ শক্ত করে নিচে নেমে আসে।রূপ সেখানেই বসা ছিলো।মেয়ে পক্ষ এখনো আসে নি।

রূপ মামনীকে দেখো জড়িয়ে ধরে।
-আমায় ক্ষমা করো মামনী
-তুমি যা করেছো ভেবে করেছো?
-জানি না
-কথাটা আগে জানাও নি কেন?আজকে আমাদের সন্মান কোথায় দাড়াবে?
-জানি না
-তাহলে কি জানো?
-শুধু জানি আমি তনুকে ভালোবাসি
-ভালোবাসা রং বদলায় রূপ।
-আমি বদলাবো না।
-তুমি তনুর ব্যাপ্যারে কতোটুকু জানো?
-যতটুকু জানলে তনুর সাথে সারা জীবন থাকতে পারবো ততটুকু
-কিছুই জানো না তুমি।সময় আসলে সব জেনে তুমিও বদলাবে রূপ।জীবনে কমপ্লিকেশন কেউ চায় না।

আন্জুআড়া বানু আর কথা বাড়ায় না।আপাতোতো পরিবারের সন্মান রক্ষা করতে হবে।আন্জুআড়া বানু ফোন করে মেয়ে পক্ষকে।তারা কতোদূর আছে জানা দরকার।বিয়ের আয়োজনটা বন্ধ করতে হবে।
তিনি ফোন করে মেয়ে পক্ষকে। কিন্তু ঐদিকে ঘটেছে আরেক কান্ড। মেয়ে নাকি পালিয়েছে বাড়ি থেকে।কথাটা শুনে তিনি অবশ্য একটু খুশিই হন।মুখ রক্ষা তো হয়েছে।
এদিকে,

বাড়ির সবাই তো অবাক। রূপ সেজে গুজে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়।
রূপের বেরুনোর সময় তনু রূপ কে জিঙ্গেস করে
-কোই যাও?আমার সতীন তো পালালো
রূপ হেসে উওর দেয়
-তোর হবু সতীনের বিয়ে দিতে যাচ্ছি
-বিয়ে মানে?
-বিয়ে মানে বিয়ে।তোর নিজেরও তো এক্সপেরিয়েন্স আছে।তাও এতো মানে মানে করিস কেন?
-আমি যাবো
-রিসিপশনে তোকে নিয়ে যাবো।বিয়েতে না
-কার রিসিপশনে?
-কার আবার অন্তরের আর তোর নাহওয়া সতীনের।
-না হওয়া সতীন মানে?আর এখানে অন্তর ভাইয়া আসলো কোই থেকে?

রূপ একটু সিরিয়াস মুখ করে উওর দেয়…

-তনু আমি মামনীকে বিয়ের কথা বলে দিয়েছি তোকে মামনী যদি তোকে এমন কিছু বলে যেটা তোর মানতে কষ্ট হচ্ছে ভেঙ্গে পরবি না তনু।আমি সব সময় তোর সাথে আছি!
-যেওনা তুমি মা বকবে আমায়।
-আমি অন্তরকে কথা দিয়েছে।আমি তারাতারি ফিরবো।ভয় পাসনা তনু।আমি সব জানি।।
-কি জানো?

রূপ আর কথা বারায় না দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে যায়।বাবার দেওয়া কথা তার রাখতে হবে।আবার এদিকের পরিস্থিতি ও ভালো নয় তারাতরি ফিরতে হবে তাকে যেকোনো সময় ঝড় আসতে পারে…

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here