তিক্ততার সম্পর্ক পর্ব -২৩+২৪+২৫

#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ২৩

ইমা রঙিন কাগজে মোড়ানো বাক্সটা একটু একটু করে খুললো। প্রথমেই নিজের ছোটবেলার পছন্দের কিছু খেলনা আর জামাকাপড় পেলো। সেগুলো দেখে মুচকি হাঁসলো তবে চোখের কোণে পানিও জমা হলো। সেগুলো আলতো করে ছুঁয়ে ভেতরে আরো একটা বাক্স পেলো। সেটা খুলতেই একটা খাম পেলো এটা দেখে ইমার বেশ কৌতূহল হলো। অনেকটা কৌতূহল নিয়ে খামটা খুললো দুই পৃষ্ঠার একটা চিঠি কিন্তু প্রথম লাইন পড়ে কৌতুহলের বদলে এক ঝাঁক কষ্টরা ইমার মনকে ঘিরে ধরলো।

আমার কলিজার টুকরা ইমা পরী
আজ আমার ছোট ইমা পরীকে বধূ সাজে দেখে চোখ জুড়িয়ে গেছে রে মা। আজ আমার শেষ স্বপ্নটাও পূরণ হলো।

ইমা বুঝতে পারলো তার মা তার বিয়ের দিন লিখেছে এই চিঠিটা। সেটা চিন্তা করে আবার পড়তে শুরু করলো সে।

যখন তুই চিঠিটা পড়ছিস হয়তো তোর কপালের ভাজে বিরক্তি ফুটে উঠেছে কিন্তু যখন শেষ করবি তখন হয়তো চোখের কোণে পানি জমে যাবে। আজ তোকে একটা মায়ের গল্প বলবো, একটা অসহায় মায়ের গল্প। তোর বাবাকে তোর নানাভাই মেনে নেয়নি বলে তার সাথে পালিয়ে গিয়েছিলাম। তোর দাদা দাদী অনেক আগেই মারা গিয়েছিলেন তাই তোর বাবা অনেক কষ্টে নিজের পড়াশোনা শেষ করেছে। আমি যখন তোর বাবার হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় তখন তার কোনো চাকরি ছিলো না। ইমরুল ঢাকায় এসে ছোট একটা টিনের ঘর ভাড়া নেয়। এক বন্ধুর সাহায্যে চারটা টিউশনি জোগাড় করে। তা দিয়ে চলতে শুরু করে আমাদের ছোট একটা সংসার। এক বেলা খেলে আর এক বেলা উপোস থাকতে হয়। ভাতের অভাব হলেও ভালোবাসার অভাব পড়েনি কখনো। এভাবে কোনো মতে এক মাস পার হয়ে গেলো, তোর বাবা ভালো একটা চাকরি পেয়ে গেলো তখন আমাদের দিন বদলাতে শুরু করলো। তোর বাবার বসটা খুব ভালো ছিলো। বেশ সুখে কাটছে আমাদের দিন মাঝে মাঝে তোর বাবা আমাকে ঘুরতেও নিয়ে যেতো নানা উপহার দিতো। কিন্তু সে সুখ বেশি দিন সইলো না। চাকরির এক বছরের মাথায় হঠাৎ একদিন হন্তদন্ত হয়ে তোর বাবা বাসায় ফিরলো। দেখে মনে হচ্ছে প্রচন্ড ভয় পেয়ে আছে আমি তার দিকে পানি এগিয়ে দিলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে সে উত্তরে কিছু না বলে আমাকে জানালো তার চাকরি চলে গেছে আর একটা সমস্যা হয়েছে এই শহরে আর থাকা যাবে না, তাড়াতাড়ি সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে। আমার কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রাতেই আমাকে নিয়ে গ্রামে ফিরে গেলো। তারপর থেকে সে অনেক ভয় পেয়ে থাকতো। এক গ্রামে থেকেও তোর নানাভাই আমাদের সাথে অপরিচিতর মতো আচরণ করতো। গ্রামে ফিরে আসার পর আবার সংসারে অভাব দেখা দিলো। গ্রামের স্কুলে শিক্ষক হিসেবে চাকরি হলো তার, তবে যে বেতন হয় তাতে সংসার চালানো কষ্ট। এদিকে বিয়ের তিন বছর পার হয়ে গেলো আমার বাচ্চা হয় না সে নিয়ে গ্রামের মানুষ নানা কথা বলতে লাগলো। রাত হলে আমি ডুকরে কেঁদে উঠতাম তোর বাবা আমাকে সান্তনা দিতো৷ মানুষটা সবসময় ছায়ার মতো আমার পাশে থাকতো। এদিকে তেমন টাকাও নেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। হঠাৎ একদিন জানতে পারতাম আমার ভেতর আরো একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে। সেই অনুভূতি হয়তো তুইও একদিন অনুভব করতে পারবি৷ মা হওয়ার অনুভূতির সাথে পৃথিবীর কোনো অনুভূতির তুলনা হয় না। আর সেখানে তুই তো ছিলি আমার বহু প্রতিক্ষার ফল। যেখানে সারারাত চোখের পানি ফেলতাম সেখানে তখন সারারাত জেগে তোকে নিয়ে স্বপ্ন সাজাতাম। মেয়েরা প্রথম মা হলে চায় তাদের যেনো ছেলে হয় কিন্তু আমি চাইতাম আমার যেনো একটা মিষ্টি মেয়ে হয়। যাকে সবসময় আমি পুতুলের মতো সাজিয়ে রাখবো। তোর বাবা আমার অনেক খেয়াল রাখতো কোনো কাজ করতে দিতো না। নিজেই সব করত একা একা। আল্লাহ আমার মনের আশা পূরণ করলো। একদিন নতুন ভোরের আলোর সাথে তোর আগমন হলো। সেদিন তোকে কোলে নিয়ে খুশিতেই আমি আর তোর বাবা কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলেছিলাম।

এতোটুকু পরে ইমা থামলো। চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে কিছু পড়তে পারছে না। তার মায়ের এতো ভালোবাসা সে এভাবে অপমান করেছে ভাবতেই চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। চিঠির প্রতিটা শব্দ পড়ে ইমা যেনো অনুভব করতে পারছে তার মায়ের অনুভূতিগুলো। ইমা দু’হাতে চোখের পানি গুলো মুছে আবার পড়তে শুরু করলো।

তুই যখন ছোট ছোট আঙ্গুল দিয়ে আমার আঙুল আঁকড়ে ধরতি খুশিতে আমার মন নেচে উঠতো। তুই ছিলি তোর বাবার কলিজা তোর জন্য কী করবে না করবে ভেবে পেতো না সে। তোর জন্য আরো দুটো টিউশনি জোগাড় করলো। নতুন নতুন জামা, খেলনা আরো কত কী কিনে আনতো। তোর কথা শুনেও তোর নানার রাগ একটুও কমেনি। তোর মুখের প্রথম মা ডাক আমার দুনিয়া পাল্টে দিয়েছিলো। তোর জন্মের পর দুটো বছর আমার কাছে আমার টানাপোড়েনের সংসার টাকেও একটা জান্নাতের টুকরো মনে হয়েছে। তবে কথায় আছে সবার কাপলে সুখ সয় না। তোর আর আমার কপালও ছিলো তেমনই। এক মুহুর্তে আমার জান্নাতের টুকরো সংসারটা মরুভূমি হয়ে গেলো। তোর বাবা ঢাকা গিয়েছিলো কোনো এক কাজে কিন্তু সন্ধ্যায় তার লাশ ফিরে এলো উঠানে। আমি সেদিন কাঁদতে পারিনি পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। তোর বাবার হাতের আঙুল টেনে তুই কেঁদেছিলি চিৎকার করে। এক মুহুর্তে সব এলোমেলো হয়ে গেলো। সেদিন তোর নানাভাই উপস্থিত হলো আমার বাড়িতে উঠোনে তখনও তোর বাবার লাশ। দাফন শেষে সাথে নিয়ে গেলো আমাকে। দুদিন শুধু তোকে জড়িয়ে রুমের কোণে বসে ছিলাম। তুই কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়তি উঠে আবার কাঁদতি। আমি তাকিয়ে দেখতাম তোকে, ভাবতাম দু বছরের মেয়েটা কীভাবে বুঝে বাবা হারানোর কষ্ট।

ইমা পড়া বন্ধ করে চিঠিটা বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। বাবা হারানোর কষ্ট তখন না বুঝে কাঁদলেও জীবনের প্রতিটা মুহুর্তে না কেঁদেও সেই কষ্ট ভোগ করেছে ইমা। বেশ কিছু সময় কেঁদে মনটা একটু হালকা করে আবার পড়তে লাগলো তার মায়ের লেখা। চিঠিটার অনেক জায়গা দেখে মনে হচ্ছে পানি পড়ে শুকিয়ে গেছে। হয়তো মায়ের চোখের পানি।

তোর বাবা মারা যাওয়ার প্রায় মাস পর রুম থেকে বের হলাম। রুমে বসে সারাদিন চোখের পানি ফেলতাম। কখনো মা জোর করে খাওয়াতে পারতো আবার কখনো ব্যর্থ হতো। এর মধ্যে তোর মণি একবার এসেছিলো তবে আমার সাথে দেখা করেনি। সেদিন বাইরের আলো গায়ে লাগালাম চোখ খুলে রাখতেও কষ্ট হচ্ছিলো। এক চাচাতো বোন জোর করে নিয়ে গেলো গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে। দেখা হলো যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো তার সাথে। সরকারি চাকরি করতো ছুটিতে গিয়েছিলেন। আমাকে দেখে থমকে গিয়েছিলেন তিনি তবে আমি তার দিকে তাকায়নি। সে আমার কোলে থাকা তোর দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছিলো পরে আমাকে সেটা জানায়, সাথে থাকা আমার চাচাতো বোন। তার দুদিন পর বাবার কাছে আবার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। দুদিন সময় লেগেছিলো তার নিজের বাবা মাকে রাজি করাতে। তাদের এতো ভালো ছেলের সাথে, কোনো এক বাচ্চার বিধবা মাকে মেনে নিবে না। সে নাকি তার বাবা-মাকে বলেছিলো রাজি না হলে সে কোনোদিন বিয়েই করবে না। তাই বাধ্য হয়ে রাজি হয় কিন্তু আমি রাজি হতে পারিনি। ইমরুলের মৃত্যুর মাত্র এক মাসের মাথায় বিয়ের কথা শুনে পাগলের মতো আচরণ করেছিলাম। বাবাও জোর করে নি আর, কিন্তু তার মাস খানেক পর বড় আপু আবার আসলো বাড়িতে। জানি না বাবাকে কী বুঝিয়ে ছিলো বাবা প্রায় উঠে পড়ে লাগলো বিয়ে দিতে। প্রতিটা দিন আমাকে যুদ্ধ করে হতো বিয়ে না করার জন্য। আমি তোকে আর ইমরুলের স্মৃতি নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। একটা বছর পার হলো তোর বয়স তখন তিন বছরে পরেছে অনেক কথা বলিস কিন্তু বুঝতে পারি হাতে গোনা কয়েকটা। সেদিন হঠাৎ বাবা আমার রুমে এসে তোকে কোলে নিয়ে বলে আমি যদি বিয়েতে রাজি না হই তাহলে তোকে এমন জায়গায় পাঠাবে যেখান থেকে আমি তোকে কখনো খুঁজে পাবো না। ভয়ে সেদিন আমার মুখ নীল হয়ে গিয়েছিলো, তুই ছিলি আমার প্রাণ তোকে ছাড়া আমি নিশ্বাস নিতেও ভুলে যেতাম। তখন আর কিছু মাথায় আসেনি শুধু মনে হয়েছে তোকে বাঁচাতে হবে বাবার হাতে থেকে। ইমরুল চলে যাওয়ার পর একমাত্র তুই ছাড়া আমার জীবনে আর কিছুই নেই। তোর জন্য যেখানে নিজের জীবন দিতে পারবো সেখানে বিয়ে কথাটাও খুব সহজ মনে হয়েছে তোর জীবনের কাছে। তোকে বাঁচাতে ভয়ে সেদিন রাজি হয়ে যায় বাবার কথায়। সারাটা রাত তোকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে পার করেছি। পরদিন বিয়ে হয়ে যায় তৌহিদুরের সাথে, পারি দিলাম আবার সেই ঢাকা শহরে সাথে তৌহিদুরের বাবা-মা। যে শহরে প্রথম পা রেখেছিলাম তোর বাবার সাথে। যেখানে তোর বাবার সাথে হাতে হাত রেখে হেঁটেছি অনেক পথ। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু কেউ মনে হচ্ছিলো গলা চেপে ধরে আছে। তৌহিদুর আমাকে ভালোবাসতো কিন্তু আমি তাকে কোনোদিন মন থেকে মানতে পারিনি। তৌহিদুর আমাকে ভালোবাসলেও তার মা আমাকে দেখতে পারতো না, আমার থেকে বেশি তোকে সহ্য করতে পারতো না। আড়ালে মারতো তোকে, এক বছরের মাথায় তাহেরের জন্ম হয়ে তৌহিদুরের ইচ্ছায়। তাকে তুই সহ্য করতে পারতি না, মারতি আর তাতে রেগে তোকে মারতো তৌহিদুরের মা। এসব আমি সহ্য করতে পারছিলাম না তাই মায়ের কাছে রেখে আসি তোকে। তৌহিদুর রাজি ছিলো না তোকে মায়ের কাছে দিতে কিন্তু আমি জোর করি কারণ সে আসল সত্যিটা জানতো না। কেনো তোকে মায়ের কাছে দিতে চাইছি। দিন, মাস, বছর পার হতে লাগলো তুই বড় হতে লাগলি তোর নানু কাছে আর তাহের আমার কাছে। আমি মাঝে মাঝেই যেতাম তোকে দেখতে কিন্তু তুই যত বড় হচ্ছিলি তত পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছিলি। একটা সময় গিয়ে বুঝতে পারলাম মেয়ের ভালো করতে গিয়ে আমি আমার মেয়েটাকেই হারিয়ে ফেলেছি। খুব কেঁদেছিলাম সেদিন, যেদিন তুই আমাকে বলেছিলি আমি তোকে আর তোর বাবাকে ভালোবাসি না বলেই আরেক লোককে বিয়ে করেছি নিজের সুখের জন্য। আমি তোর মা হওয়ার যোগ্য না।

ইমা সেদিনটার কথা মনে করে আবার চিৎকার করে কান্না করতে লাগলো। আর মা তার জন্য এতোকিছু সহ্য করেছে আর সে নিজের মাকে যা নয় তাই বলে অপমান করেছে। কীভাবে পেরেছিলো এতো ছোট বয়সে মাকে এতো বাজে কথা বলতে। সবকিছুর জন্য দায়ী মণি নামক অমানুষটা। মা হয়ে সে কীভাবে পারলো আরেক মায়ের থেকে তার সন্তানকে, না না শুধু সন্তান নয় কলিজার টুকরাকে আলাদা করতে। কাঁদতে কাঁদতে ইমার চোখ মুখ ফোলে গেছে। তবু চিঠি শেষ করার জন্য আবার পড়তে লাগলো।

আজ হয়তো তোর অযোগ্য মাকে মাফ করবি, জমিয়ে রাখা অভিমানগুলো মুছে ফেলবি। মায়ের কথা মনে পরলে চলে আসিস। তুই অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে নিলেও এই মায়ের মনে তোর জন্য ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নেই। আর তৌহিদুরের বাড়ির দরজা তোর জন্য চিরকাল খোলা থাকবে। মানুষটাকে তুই বা আমি মেনে না নিলেও আমরাই তার জীবনের অ-মূল্য রত্ন। সেদিন এই মানুষটাও কেঁদেছিলো তোর অপমানে, পারলে মাফ চেয়ে নিস একবার। বাক্সে কিছু গহনা আছে তোর বাবা আমাকে দিয়েছিলো যখন ঢাকায় ভালো চাকরি করতো তখন৷ হাজার কষ্টেও কখনো এই জিনিসগুলোর দিকে হাত দিতে দেয়নি। আজ থেকে এই সবকিছু তোর। মাকে মাফ করলে মায়ের কাছে চলে আসিস মন চাইলে।
ইতি
তোর অভাগী অযোগ্য মা

ইমা ফ্লোরে বসে চিঠিটা বুকে আঁকড়ে চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে, একবার কেনো বললে না মা, একবার কেনো সব বললে না। আমি দিনের পর দিন তোমাকে কষ্ট দিয়ে গিয়েছি তুমি সহ্য করে গেছো, কেনো মা কেনো ? তুমি আমার জন্য এতো কষ্ট সহ্য করেছো আমি কখনো বুঝতে চেষ্টা করিনি। সবসময় নিজের কষ্টটাকে বড় করে দেখেছি। আমার কষ্টগুলো আমি নিজের হাতে আমার জীবনে টেনে এনেছি। তোমাদের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজের জন্য বেছে নিয়েছি #তিক্ততার_সম্পর্ক। সেদিন তোমার সাথে ফিরে গেলে হয়তো আমার জীবনটা অন্যরকম হতো। বাবা-মা দুজনের ভালোবাসা পেয়ে জীবনটা তিক্ততার নয় মধুর হতো। তোমার কাছে একবার ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ তুমি দিলে না মা, কেনো ? একবার তোমার বুকে পড়ে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে মা।

ইয়াদের বাসার প্রত্যেকটা রুম সাউন্ড প্রুব তাই ইমার এই আর্তনাদ আর চিৎকার বাইরে যাচ্ছে না। কাঁদতে কাঁদতে ইমার চোখ গেলো বাক্সের দিকে তাতে একটা ছবির এলবাম। খুলে দেখতে লাগলো তার বাবা-মায়ের অনেক ছবি। কতো সুন্দর লাগছে দুজনকে একসাথে। একেবারে পার্ফেক্ট কাপল ছিলো দেখেই বুঝা যাচ্ছে। ইমার মায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ আর বাবার নাকি ধবধবে সাদা ছিলো। ছবিতে তেমন বুঝা যাচ্ছে না তবে নানুর কাছে শুনেছে ইমা। ইমার গায়ের রং আর মুখের আদল তার বাবার মতো হয়েছে সবসময় বলতো তার নানু। ইমা নিজের বাবা-মায়ের ছবির উপর আলতো করে হাত বুলাচ্ছে আর চোখের পানি ফেলছে। তার জীবনে এতো চোখের পানির কারণ হয়তো সে তার মায়ের চোখের পানি ঝড়িয়েছে বলে। ইমা একটা একটা পৃষ্ঠা উল্টে ছবি দেখতে লাগলো৷ অনেক সময় পর তার বাবা মায়ের ছবির বদলে শুধু তার ছোটবেলার ছবি বের হতে লাগলো। এরপর থেকে ইমাকে ছাড়া তার বাবা-মায়ের একটা ছবিও পেলো না। সব ছবিতে সে তার বাবা-মায়ের সাথে নাহলে তার একার ছবি। ইমা এলবামটা আঁকড়ে ধরে নীরবে চোখের পানি ফেলতে লাগলো এবার। এই এলবামই হয়তো ইমার, তাহেরা আর ইমরুলের জীবন এলোমেলো করে দেওয়ার মূল। হয়তো এই এলবামে এমন কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে যাতে এলোমেলো হয়ে গেছে তাহেরার সাজানো জান্নাতের টুকরোর মতো ছোট সংসারটা৷ আবার এই এলবামই হয়তো একদিন ইমা, ইয়াদ, ইয়ানা, ইশান আরো অনেকের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিবে। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে ইমা চমকে উঠে সেদিকে তাকালো। ইয়াদকে ঢুকতে দেখে ইমা আরো অবাক হলো। কারণ এতো আগে ইয়াদ কখনো বাসায় আসে না। ইয়াদ রুমে এসে ব্লেজারটা বেডে ছুঁড়ে দিয়ে পায়ের শো খোলে স্লিপার পরে আর কোনোদিকে না তাকিয়ে কাবার্ড থেকে নিজের ড্রেস বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। ইমার কেনো জানি ইয়াদকে স্বাভাবিক লাগছে না। ইমা দ্রুত সব সরিয়ে ফেললো তবে তাড়াহুড়াতে এলবামটা সাইড টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দিলো। হঠাৎ দরজায় কেউ নক করলে ইমা গিয়ে দরজা খোলে দেয় আর দেখে ইশান দাড়িয়ে আছে।

ইশান মুচকি হেঁসে বললো, কেমন আছো ভাবি ? তোমার সাথে তো আমার কথাই হয় না।

ইমা জোর করে হাসার চেষ্টা করে বললো, এই তো আলহামদুলিল্লাহ।

অতিরিক্ত কান্না করার জন্য ইমার গলা অনেকটা বসে গেছে আর চোখমুখ লাল হয়ে ফোলে গেছে। ইশান প্রথমে খেয়াল না করলেও ইমার গলার আওয়াজ শুনে ভালো করে খেয়াল করলো।

চিন্তিত গলায় বললো, ভাবি তোমার গলা এমন লাগছে কেনো ?

ইমা অপ্রস্তুত হয়ে বললো, না এমনই আমি ঠিক আছি ? ভাইয়া তুমি কেনো এসেছো বললে না ?

ইমার কথা বিশ্বাস না করলেও ইশান ব্যাপারটা ঘাটালো না৷ অভিমান করার ভান করে বললো, কেনো ভাবি প্রয়োজন ছাড়া কী আমি তোমার সাথে কথা বলতে আসতে পারি না ?

ইমা ব্যস্ত গলায় বললো, আরে তা কেনো হবে ? আসলে কখনো আসো না তো তুমি, তাই আর কী ?

ইশান চাপা কষ্ট নিয়ে মুচকি হেঁসে বললো, ভাইয়া আমাকে তার আশেপাশে পছন্দ করে না তাই যতটা সম্ভব দূরেই থাকি।

ইমা বুঝতে পারলো ইশানের মুচকি হাসির পিছনের লুকানো কষ্টটা তবে সে কী করবে ইয়াদ তো তাকেও নিজের আশেপাশে সহ্য করতে পারে না।

ইশান পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললো, আসলে ভাইয়ার সাথে কিছু জরুরি কথা ছিলো।

চলবে,,,,,#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ২৪

ইশান পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললো, আসলে ভাইয়ার সাথে কিছু জরুরি কথা ছিলো।

ইমা ওয়াশরুমের দিকে তাকিয়ে বললো, তোমার ভাইয়া তো কেবল ফ্রেশ হতে গেলো সময় লাগবে মনে হয়।

ইশান বললো, ঠিক আছে তাহলে আমি পরে,,,

ইশান কথা শেষ করার আগেই ইয়াদ ওয়াশরুম থেকে বের হলো এলোমেলো পায়ে। ইয়াদকে দেখে ইশানও ভ্রু কুঁচকালো কারণ ইয়াদকে একদমই সুস্থ স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। ইশান আর ইমার চিন্তা ভাবনার মাঝেই ইয়াদ পরে যেতে নিলো। ইমা দৌড়ে গিয়ে ধরলো আর ইয়াদও নিজেকে একটু সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলো। ইমা ইয়াদের গায়ে হাত লাগতেই চমকে উঠলো। ইমার মনে হচ্ছে সে গরম চুলায় হাত দিয়ে দিয়েছে। ইশানও এগিয়ে এসেছে ইয়াদের দিকে। ইমা একপাশে ধরলে ইশান অন্যপাশে ধরলো।

ইশান চমকে উঠে বললো, ভাইয়া তোমার তো জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে।

ইয়াদ ইশানকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে কাঁপা গলায় বললো, আমার কিছু হয়নি আমি একদম ঠিক আছি।

ইমা খানিকটা রাগী গলায় বললো, জ্বরে ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছে না তাও বলছে আমি ঠিক আছি। এতো জ্বর নিয়ে আপনাকে এখন শাওয়ার নিতে কে বলেছে ?

ইয়াদ চেয়েও কিছু বলতে পারলো না। অনেক দূর্বল লাগছে শরীর। জ্বরের জন্য লান্সে কিছু খেতেও পারেনি। ইশান আর ইমা আস্তে করে ইয়াদকে বেডে শুইয়ে দিলো। ইমা টাওয়েল নিয়ে ভালো করে চুল মুছে দিতে লাগলো ইয়াদের।

ইশান ইমার দিকে তাকিয়ে বললো, ভাবি তুমি ভাইয়ার পাশে বসো আমি ডক্টরকে আসতে বলছি এখনই।

ইমার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। ইয়াদের চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। এখন তো সেন্সলেসই হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। ইমা না চাইতেও তার চোখ থেকে পানি পড়ছে টপটপ করে। ইশান ইমার উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে গেলো রুম থেকে। ইমা কী করবে বুঝতে পারছে না। ইয়াদের শরীর স্বাভাবিকের থেকে অতিরিক্ত পরিমাণ গরম। ইয়াদের গোঙানির শব্দে ইমার হুঁশ ফিরে। ইয়াদ হঠাৎ কাত হয়ে বমি করে দিলো ইমার গায়ে পড়লো সব, ইয়াদ পিটপিট করে তাকালো একবার ইমার দিকে। ইমা দ্রুত নিজে পরিষ্কার হয়ে এসে ইয়াদের মুখ মুছে দিলো। ইয়াদ প্রচন্ড পরিমাণ কাঁপছে ইমা উঠে কাবার্ড থেকে একস্ট্রা ব্লাংকেট বের করে ইয়াদের গায়ে জড়িয়ে দিলো, দৌড়ে কিচেনে থেকে বাটিতে পানি নিয়ে এসে জলপট্টি দিতে লাগলো। একদিকে ইমা এসব করছে অন্যদিকে চোখের পানি ঝরছে অবিরাম। ইয়াদ আরো অনেকবার বমি করলো, তবে ইমা নিচ থেকে একটা পাত্র দিয়ে এসেছিলো সেটা এগিয়ে দিয়েছে সেটাতে করেছে বমি। হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকলো ইয়ানা।

ভাইয়ার কী হয়েছে ভাবি ?

ইশান ডক্টরের সাথে কথা বলতে বলতে নিচে যাচ্ছিলো তখনই ইয়ানা শুনতে পায় ইয়াদের জ্বর হয়েছে। ইয়ানার রাগ অভিমান কোথায় পালিয়ে গেলো ইয়ানা নিজেও জানে না। ভাইয়ার অসুস্থতার কথা শুনে ইয়ানা স্থির থাকতে পারেনি।

ইমা কাঁদতে কাঁদতে বললো, বুঝতে পারছি না আপু দেখো উনি কেমন যেনো করেছেন। আমার খুব ভয় করছে আপু, খুব ভয় করছে।

ইমা এবার শব্দ করেই কেঁদে দিলো। ইয়ানা ইয়াদের কপালে হাত দিয়ে ছিটকে সরিয়ে নিলো।

ইয়ানা ধরা গলায় বললো, ভাইয়া মনে হয় আজ বৃষ্টিতে ভিজেছে কোন কারণে।

ইয়ানার কথা শুনে ইমা চমকে তাকালো ইয়ানার দিকে। ইয়াদ তো আজ অনেকটা সময় বৃষ্টিতে ভিজেছে সেটা তার জন্যই।

ইমা স্তম্ভিত হয়ে বললো, মানে ?

ইয়ানা বললো, ভাইয়ার বৃষ্টির পানি সহ্য হয় না। ছোট বেলায় আমার সাথে একদিন বৃষ্টিতে খেলেছিলো অনেক সময়। রাতে ভয়ংকর জ্বর হয় ভাইয়ার। যে জ্বর এমনই এমনই যায়নি পাঁচ দিন হসপিটালে ভর্তির ছিলো আর পুরোপুরি সুস্থ হয়েছিলো পনেরো দিন পর। এরপর থেকে ভাইয়া কখনো বৃষ্টিতে ভেজা তো দূর বৃষ্টির ফোঁটা মাথায় ফেলেনি।

ইয়ানা ইয়াদের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে আর বলছে। ইমার হাত থমকে গেছে। আজ তার জন্য ইয়াদের এই অবস্থা হয়েছে। না সে যেতো বৃষ্টিতে ভিজতে আর না তাকে দেখে ইয়াদ এগিয়ে যেতো। ইয়াদকে ছাদে রেখে আসার পর অনেক সময় সেখানেই ছিলো, ইমা একবার বলেওনি চলে আসতে। ইমার এখন নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। ইশান ডক্টর নিয়ে ইয়াদের রুমে প্রবেশ করলো। ডক্টর দেখে ইমা আর ইয়ানা সরে দাঁড়ালো।

ডক্টর ইয়াদের জ্বর মাপলো আর প্রয়োজনীয় চেক-আপ করে বললো, জ্বর ১০৫° ছাড়িয়ে গেছে অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। আর দেখে মনে হচ্ছে জ্বর অনেক আগেই এসেছে কিন্তু গুরুত্ব দেয়নি তাই এখন আরো খারাপের দিকে গেছে অবস্থা।

ডক্টরের কথা শুনে ইয়ানা শব্দ করে কেঁদে দিলো আর ইমা পাথর হয়ে গেছে।

ডক্টরের সামনে ইয়াদ আবার বমি করে দিলো তা দেখে ডক্টর আরো ভীত গলায় ইমাকে জিজ্ঞেস করলো, বমি করেছে আরো ?

ইমা কী উত্তর দিবে সে পাথরের মতো দাড়িয়ে আছে মুর্তি হয়ে। ইমা উত্তর দিচ্ছে না দেখে ইয়ানা ইমার কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বললো, ভাবি ডক্টর তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছে।

ইমা চমকে উঠে বললো, ক,,,কী হয়েছে ?

ডক্টর আবার বললো, বমি করেছে আগে আরো ?

ইমা মাথা দিয়ে সম্মতি জানালে ডক্টর ইশানের দিকে তাকিয়ে বললো, উনাকে এখন আর এখানে চিকিৎসা করা সম্ভব নয় দ্রুত হসপিটালে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন, খারাপ কিছু হয়ে যাওয়ার আগে।

সবাই যেনো পাথরের মর্তি হয়ে গেছে। জ্বরের কারণে কারো এতো খারাপ অবস্থা হতে পারে যেনো কল্পনা করতে পারছে না। ইশান কোনো মতে নিজেকে সামলে ড্রাইভারকে গাড়ি বার করতে বললো কল দিয়ে। ইশান গিয়ে ইয়াদকে কাঁধে তোলে নিলো যদিও ইশান হিমসিম খাচ্ছে ইয়াদকে রাখতে। কোন রকমে গাড়িতে উঠে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। ইমা ইয়াদের মাথা নিজের কোলে নিয়ে বসে আছে আর ইশান ড্রাইভ করছে, ইয়ানা ইশানের পাশে বসে আছে সামনের সীটে। বাড়িতে এতোকিছু হয়ে যাচ্ছে রুবিনা বা ইয়াসিরের কোনো খবর নেই সেদিকে।

২৬.
ইয়াদ চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আশেপাশে দেখতে লাগলো। জায়গাটা তার পরিচিত মনে হচ্ছে না। মাথাটা খুব ভারী লাগছে ডান হাত দিয়ে মাথা ধরতে যাবে কিন্তু মনে হলো কেউ হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আছে। ইয়াদ হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো ইমা তার হাত আঁকড়ে ধরে হাতের উপর ঘুমিয়ে আছে। ওড়নাটা ভালো করে মাথায় পেঁচানো, ছোট করে মুখটা দেখা যাচ্ছে শুধু। গালে চোখের পানির দাগ স্পষ্ট হয়ে আছে শুকিয়ে। আজকাল ইমার দিকে তাকালে ইয়াদের চোখ সরাতে ইচ্ছে করে না তবু সরিয়ে নেয়। ইয়াদ আশেপাশে ভালো করে দেখে বুঝতে পারলো সে হসপিটালে আছে। গতরাতের কথা মনে করার চেষ্টা করলো। ওয়াশরুমে থাকতেই বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিলো তাই তাড়াতাড়ি শাওয়ার শেষ করে কোনোরকমে চেঞ্জ করে রুমে চলে আসে। কিন্তু রুমে পা রাখতেই হঠাৎ সব অন্ধকার হয়ে যায় চোখের সামনে। তারপর ইমা ইশান সবার কথা মনে পড়লো একটু একটু করে। বমি করে ইমার দিকে তাকানোর পর আর কিছু মনে নেই ইয়াদের। বামহাত উচু করে দেখলো স্যালাইন চলছে। নড়াচড়ায় ইমার ঘুম ভেঙে গেলো। ফজরের নামাজ পড়ে কিছু সূরাহ পড়ে ইয়াদের মাথায় ফু দিচ্ছিলো হঠাৎ ইমার হাত আঁকড়ে ধরে ইয়াদ তাই হাতটা না ছাড়িয়ে পাশে বসেছিলো। সারারাত না ঘুমানোর জন্য কখন চোখ লেগে গেছে বুঝতে পারেনি। সকালের দিকে ইয়াদের জ্বর কমেছে। সারাটা রাত ইমা কীভাবে পার করেছে সে নিজেও জানে না। ইয়াদকে সে কতটা ভালোবাসে গতরাতে ইয়াদের ঐ অবস্থা দেখে বুঝতে পেরেছে ইমা। সে বুঝে গেছে ইয়াদকে ছাড়া বাঁচা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ইয়াদ যখন জ্বরে ছটফট করছিলো ইমাও ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো বুকের ভেতর থেকে হার্টটা কেউ টেনে বের করে নিচ্ছে। ইয়ানা কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। ইশান ছেলে মানুষ তবু ছটফট করেছে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে। বিপদের রাত নাকি সহজে শেষ হয় না, তার প্রমাণ গতরাতে পেয়ে তারা তিনজন। একেকটা মিনিট একেকটা বছরের মতো মনে হয়েছে। ইয়াদ একটু শান্ত হলে ইশান ইয়ানাকে বলেছিলো বাসায় চলে যেতে। সে আর ইমা থাকলেই হবে। কিন্তু ইয়ানা সাফ জানিয়ে দিয়েছে সে এক পাও নড়বে না যতক্ষণ না তার ভাইয়া তার সাথে কথা বলছে। ইয়ানা ভুলে গেছে গতকাল তার ভাইয়া সম্পর্কে সে কী শুনেছিলো। ইয়ানা বুঝে গেছে তার ভাইয়া যদি পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষও হয় তাহলেও সে তার ভাইয়াকে ছাড়া নিজের জীবন কল্পনা করতে পারবে না। ইমা কেবিনের ভেতরে, ইয়ানা আর ইশান বাইরে বসেছিলো।

ইমা ইয়াদকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো, এখন কেমন লাগছে আপনার ? খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে, ডক্টরকে ডেকে আনবো ?

ইয়াদ কথা বলার চেষ্টা করে বুঝতে পারলো তার শরীর কতটা দূর্বল। বেশ কষ্ট হচ্ছে কথা বলতে তবু বললো, আমি ঠিক আছি।

ইমা হালকা রাগ দেখিয়ে বললো, শরীরে ১০৫° উপরে জ্বর নিয়ে যে লোক বলতে পারে আমি ঠিক আছি সে আর কখন বলবে আমি ঠিক নেই সেটা আমার মতো মানুষের পক্ষে বুঝা সম্ভব নয়।

ইয়াদ দূর্বল গলায় বললো, যতক্ষণ শ্বাস নিতে পারবো ততক্ষণ বলবো আমি ঠিক আছি।

ইমা রেগে বললো, হ্যাঁ আপনি ঠিক আছেন আমিই ঠিক নেই তাই হসপিটালের বেডে শুয়ে আছি। আপনি জানেন আপনার বৃষ্টির পানি সহ্য হয় না। তাহলে কোন আক্কেলে এতো সময় বৃষ্টির মধ্যে বসে ছিলেন তখন।

ইয়াদ আনমনে বললো, চোখের সামনে জান্নাতের হুর নেমে এসেছিলো মনে হচ্ছিলো তাকে একটু কাছ থেকে দেখার জন্য সামান্য বৃষ্টি তো দূর মৃত্যুর সাথেও সাক্ষাৎ করতে পারবো।

ইমা চমকে উঠলো ইয়াদের কথা শুনে। পড়ে ভাবলো ইয়াদ জ্বরের ঘোরে ভুলভাল বকছে তাই কিছু না বলে ইয়াদের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাড়ালো বাইরে যাওয়ার জন্য।

ইমা সামনের দিকে পা বাড়াতেই ইয়াদ পেছন থেকে বললো, কোথায় যাচ্ছো ?

ইমা ঘুরে তাকিয়ে বললো, ডক্টরকে ডাকতে যাচ্ছি, ইয়ানা আপু আর ইশান ভাইকে বলতে যাচ্ছি আপনার ঘুম ভেঙেছে। গতকাল ইশান ভাই না থাকলে কী করতাম আমি জানি না। আপনার অবস্থা দেখে আমি তো নড়াচড়া করতেই ভুলে গিয়েছিলাম।

ইয়াদ অবাক হয়ে বললো, মানে ?

ইমা মুচকি হেঁসে বললো, বড় ভাই হয়ে ছোট ভাইয়ের কাঁধে চড়ে হসপিটালে এসেছেন। ইমার কথা শুনে ইয়াদের চোখ আপনা আপনি বড় বড় হয়ে গেলো। ইয়াদ ইশানের তুলনায় লম্বা আর স্বাস্থ্য দু’দিক থেকেই বেশি। ইশান তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে এসেছে ভেবে ইয়াদের বিষম খাওয়ার মতো অবস্থা হলো। ইমা তা বুঝতে পেরে মুচকি হেঁসে বের হয়ে গেলো। ইয়াদের চোখের সামনে ভাসলো শৈশবের কিছু মধুর স্মৃতি। ইয়াদের বয়স যখন ৮ বছর তখন ইশানের জন্ম, ইয়ানার তখন মাত্র দুইবছর বয়স। গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে শিখেছে। ইয়াদ তখন ভেবে পেতো না কাকে রেখে কাকে কোলে নিবে। দুই ভাইবোন নিয়ে প্রচন্ড খুশি ছিলো ইয়াদ। ইশান যখন একটু বসতে শিখলো দু’জনকে দু কাঁধে নিয়ে সারা বাড়ি ঘুরতো ইয়াদ। পুরনো সুখের স্মৃতি মনে পড়তেই মুচকি হাঁসলো। তখনই কেবিনে ঢুকলো ইয়ানা আর ইশান। ইয়াদের হাসিটা লক্ষ্য করেনি দু’জনের কেউই। তাহলে হয়তো কয়েক মিনিট থমকে দাঁড়িয়ে থাকতো। ইয়াদের হয়তো নিজেরও মনে নেই শেষ কবে খুশি হয়ে হেসেছিলো। মুচকি হেসেছে অনেক তবে সেই হাসিতে কখনো খুশি থাকতো না বরং লুকিয়ে থাকতো হাজারো কষ্ট, রহস্য আর কারো জীবন সমাপ্তির ইঙ্গিত। আজ অনেক বছর পর খুশি হয়ে মুচকি হাঁসলো ইয়াদ সেটা হয়তো নিজেও খেয়াল করেনি সে।

ইয়ানা ইয়াদের দিকে এগিয়ে এসে ব্যস্ত গলায় বললো, এখন কেমন আছো ভাইয়া ?

ইয়াদ নিজের অনুভূতি আড়াল করে বললো, হুম ভালো।

ইয়ানা হঠাৎ রাগী গলায় বললো, তুমি জানো বৃষ্টি তোমার চরম শত্রু তাহলে কেনো গিয়েছিলে বৃষ্টিতে ভিজতে। জানো কতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম গতরাতে তোমার অবস্থা দেখে।

ইয়ানা এসব বলছে আর ইশান একটু দূরে চুপচাপ দাড়িয়ে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ইয়াদ ঘুরে তাকালো ইশানের দিকে। তাতে মুখ কালো হয়ে গেলো ইশান ইয়ানা দুজনেরই। ইশানকে এখানে দেখে না আবার রেগে যায় এমনই ভাবছে দুজন।

কিন্তু তাদের অবাক করে দিয়ে ইয়াদ শান্ত গলায় বললো, দূরে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো এদিকে আয়।

ইয়াদের কথা শুনে ইয়ানা আর ইশান এমনভাবে ইয়াদের দিকে তাকালো যেনো সে পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক কথা বলেছে৷ ইয়াদ ইশানকে কখনো তুই করে বা বিরক্তি গলা ছাড়া কথা বলে না তাই এতেটা অবাক হয়েছে দুজন। ইশান ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো ইয়াদের দিকে।

চলবে,,,,#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ২৫

ইশান ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো ইয়াদের দিকে, অজানা কারণে ইশানের চোখের কোণ থেকে এক বিন্দু পানি গড়িয়ে গেলো। ইশান নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না জাপ্টে জড়িয়ে ধরলো ইয়াদকে। ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো বাচ্চাদের মতো। ইয়াদ ডান হাতটা আস্তে করে ইশানের মাথায় রাখলো। ইয়ানা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দুই ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে, তার চোখেও পানি চলে এসেছে আজ কত বছর পর দুই ভাইকে এভাবে দেখলো।

ইয়াদ মুচকি হেঁসে বললো, ইয়ানা দেখ ঐ খবিশটা ছোটবেলার মতো চোখের পানি, নাকের পানিতে আমার শার্ট নোংরা করে ফেলছে।

ইশান কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি ভাইয়া। তোমার এই দূরে ঠেলে দেওয়া আমাকে খুব বেশি কষ্ট দেয়। প্লিজ আমাকে আর কখনো দূরে সরিয়ে দিয়ো না। যদি কোনো অন্যায় করি তাহলে মারো বকো যা ইচ্ছা করো শুধু দূরে সরিয়ে দিয়ো না কখনো।

ইয়াদ চোখের কোণে পানি নিয়ে বললো, আর কখনো দূরে সরিয়ে দিবো না।

ইয়াদ ইশানকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে চোখ মুছে দিলো আলতো করে। ইশান ইয়াদের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু খেলো।

ইয়াদ মনে মনে বললো, মিস্টার দিসার কবির আর মিসেস রুবিনা কবিরের ছেলে হয়ে যদি তুই দোষী হয়ে থাকিস। তাহলে মিসেস রুবিনা কবিরের গর্ভে তো আমার আর ইয়ানারও জন্ম, তাহলে আমরাও দোষী। বাবা-মায়ের অন্যায়ের শাস্তি কখনো ছেলে মেয়েকে দেওয়া গর্বের কাজ নয়। এতদিন যে ভুলটা করে এসেছি সেটা আর করবো না। আজ থেকে যার যার অন্যায়ের শাস্তি সে সে পাবে অন্যকেউ নয়।

দুই ভাইয়ের মিলে যাওয়া দেখে ইয়ানা বললো, যা বাবা, আমে দুধে মিশে গেলো। এখন কী আমি আঁটি হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাবো নাকি ?

ইয়াদ ইয়ানাকেও নিজের কাছে ডেকে নিলো আর ইশান বললো, আপু তুই তো আমাদের তুই ভাইয়ের কলিজার টুকরা।

ইয়ানা দুষ্টুমি করে বললো, আমি টুকরো হলে আর বাকি কলিজাটা কে ? ||লেখনীতে তাহমিনা তমা ||

ইয়াদ বললো, তুই টুকরো না আমাদের পুরো কলিজটাই তুই।

তিনজনেই হেঁসে উঠলো, ইয়াদের দিকে ইশান আর ইয়ানা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। হাঁসলে তাদের ভাইয়াকে কতো সুন্দর লাগে অথচ আজ কত বছর হয়ে গেছে এই হাসি দেখে না তারা।

ওদের তাকিয়ে থাকতে দেখে ইয়াদ বললো, কী দেখছিস ওভাবে ?

ইশান বললো, তুমি সবসময় এভাবে হাসবে ভাইয়া তাহলে মেয়েদের তোমাকে দেখার পর যেটুকু হুঁশ থাকে তাও গায়েব হয়ে যাবে।

ইয়াদ কিছু বলবে তার আগেই ইয়ানা বললো, আচ্ছা ভাইয়া, তুমি তো কখনো বৃষ্টিতে ভিজো না তাহলে কাল কেনো ভিজেছিলে ?

ইয়াদের চোখের সামনে ভেসে উঠলো ইমার বৃষ্টি ভেজা সেই মুখ, কাঁপা ঠোঁট, ভীত চাহনি যা ইয়াদের হুঁশ উড়িয়ে দিয়েছিলো। ইয়াদ উত্তরে কিছু বলার আগেই ইমা ডক্টরের সাথে কেবিনে ঢুকলো। তিনজনই সেদিকে তাকালো, ইমা ডক্টরের সাথে কথা বলছে এদিকে তার খেয়াল নেই। ডক্টর কাছে আসলে ইয়ানা আর ইশান সরে দাঁড়ালো।

ডক্টর ইয়াদের চেক-আপ করে বললো, জ্বর এখন নেই তেমন, তবে শরীর অনেক দূর্বল। জ্বর আবার আসতে পারে তাই আজ হসপিটালে থেকে আগামীকাল বাসায় চলে যেতে পারবেন। তবে হ্যাঁ জ্বর সেরে গেলেও পুরো এক সপ্তাহ রেস্ট নিতে হবে।

ডক্টরের কথা শুনে ইয়াদের মাথা ঘুরার অবস্থা, এতদিন সে রেস্ট নিবে সেটা ইম্পসিবল।

ডক্টর ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো, মিস্টার ইয়াদ এতবড় বিজনেস সামলান আর একটু নিজের খেয়াল রাখতে পারেন না ? আপনার জ্বর শুরু হয়েছিলো অনেক আগে থেকে, আপনি কোনো গুরুত্ব দেননি। এভাবে নিজের অবহেলা করলে বড় কোনো সমস্যা হতে সময় লাগবে না।

ইয়াদ কিছু বললো না, কারণ সে সত্যি নিজের শরীরের প্রতি বড্ড বেশি উদাসীন। কাজের ফাঁকে কখন খাওয়ার সময় পার হয়ে যায় টেরই পায় না। ইমার জন্য এখন তাও সকালের ব্রেকফাস্ট আর রাতের ডিনারটা সঠিক সময়ে করা হয়। মেয়েটা ইয়াদের না আসা পর্যন্ত খাবার নিয়ে বসে থাকে৷ ইয়াদের খাওয়া শেষ হলে নিজে খায় আর সকালেও ব্রেকফাস্ট না করে বের হতে দেয় না।

ইমা ডক্টরের কথা শুনে বললো, আপনি চিন্তা করবেন না এখন থেকে উনার শরীরের খেয়াল উনি না রাখলেও আমি রাখবো।

স্যালাইন শেষ হলে কিছু তরল খাবার খাইয়ে মেডিসিন খাইয়ে দিতে বলে চলে গেলো ডক্টর। সে চলে গেলে ইশান আর ইয়ানাকে বাসায় চলে যেতে বললো ইমা। যেতে না চাইলে জোর করে পাঠিয়ে দিলো।

——
এদিকে ব্রেকফাস্ট টেবিলে কাউকে দেখতে না পেয়ে রুবিনা সার্ভেন্টকে ডেকে এনে বললো, বাকি সবাই কোথায় ?

খাবার সব গুছিয়ে দিয়ে সার্ভেন্ট চলে যায়। তার খাওয়ার সময় পাশে সার্ভেন্ট দাঁড়িয়ে থাকা পছন্দ করে না রুবিনা তাই খাবার দিয়ে সার্ভেন্ট চলে যায়। দরকার হলে তখন আবার ডেকে নেয়।

সার্ভেন্ট দৌড়ে এসে মাথা নিচু করে উত্তর দিলো, ইয়াদ স্যার রাতে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তাকে নিয়ে সবাই হসপিটালে গেছেন।

রুবিনা উঠে দাঁড়িয়ে বললো, হোয়াট,,,? ইয়াদ হসপিটালে আর আমি এখন জানচ্ছি। আমাকে কেউ জানায়নি কেনো ?

ইয়াসির শান্ত ভাবে বসে খেয়েই যাচ্ছে তার দিকে তাকিয়ে রুবিনা বললো, ইয়াদ হসপিটালে সেটা শুনেও তুমি নিশ্চিন্তে খেয়ে যাচ্ছো ?

ইয়াসির হাতের চামচ প্লেটে রেখে সার্ভেন্টকে চলে যাওয়ার ইশারা করে রুবিনার দিকে তাকিয়ে বললো, অসুস্থ হয়েছে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যা করার ডক্টর করবে, এখানে আমি বা তুমি হাইপার হয়ে কী লাভ হবে ?

রুবিনা টলমল চোখে বললো, ইয়াদের জায়গায় ইশান থাকলে এভাবে বসে থাকতে পারতে ?

ইয়াসির চমকে আশেপাশে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, কোথায় কী বলছো রুবিনা, তোমার মাথা ঠিক আছে তো ? সেদিন রাতেও আমি তোমাকে বারবার চুপ করতে বলছিলাম, বলেছিলাম দেয়ালেরও কান আছে কিন্তু তুমি বলেই যাচ্ছিলে। তোমার বলা শেষে আমি জানলার দিকে তাকিয়ে দেখি সেখান থেকে একটা ছায়া সরে গেলো। এখনো বুঝতে পারলাম না সেটা কে ছিলো ?

রুবিনা বললো, যেই থাকুক তাতে কী সমস্যা ? তুমি ভুলে যাচ্ছো রুম সাউন্ড প্রুব বাইরে থেকে আমাদের কথা শোনা সম্ভব নয়।

ইয়াসির রেগে বললো, একদিন তোমার জন্যই আমরা ডুববো দেখে নিও। রুম সাউন্ড প্রুব হলে কী হবে পর্দা টানা থাকলেও জানলা খোলা ছিলো সেটা কী তোমার চোখে পড়েছে ? যেই থাকুক একবার জানতে পারলে, আমি দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিবো সেটাকেও।

রুবিনা নিজের চেয়ারে বসে বললো, আর কতজনকে এই পৃথিবী থেকে সরাবে তুমি এই প্রোপার্টির জন্য ? আজকাল নিজেকে আয়নায় দেখতে ঘৃণা হয় কতো মানুষের খুনের রক্ত লেগে আছে এই শরীরটাতে।

ইয়াসির তাচ্ছিল্যের হাসি হেঁসে বললো, গ্রাম বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, একশো একটা ইদুর মেরে বিড়াল এখন হজ্জ করতে চায়। তোমার অবস্থা এখন তেমন মনে হচ্ছে আমার কাছে।

রুবিনা রেগে বললো, তুমি থাকো তোমার মনে হওয়া নিয়ে আমি হসপিটালে যাচ্ছি ইয়াদের কাছে।

রুবিনা হসপিটালে যাওয়ার জন্য চেয়ার থেকে উঠতেই ইয়ানা আর ইশান ঢুকলো মেইন ডোর দিয়ে।

তাদের দেখে রুবিনা বললো, ইয়াদ অসুস্থ তোমরা আমাদের জানাওনি কেনো ?

ইয়ানা একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো আর ইশান মায়ের দিকে এগিয়ে এসে বললো, তোমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলে আর ভাইয়ার অবস্থা খারাপ ছিলো তোমাদের জানানোর কথা মাথায় আসেনি ||লেখনীতে তাহমিনা তমা||

রুবিনা বললো, কোন হসপিটালে আছে ?

ইশান সিড়ির দিকে যেতে যেতে বললো, তোমার যেতে হবে না ভাইয়া এখন ঠিক আছে। ভাবি আছে ভাইয়ার সাথে, আমি আর আপু ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে ভাবির জন্য ব্রেকফাস্ট নিয়ে আবার যাবো একটু পর।

ইশান কথা শেষ করে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো রুবিনা ইয়াসিরের দিকে একবার রেগে তাকিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।

ইয়াসির রুবিনার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, ইয়াদের জায়গায় ইশান কেনো তুমি থাকলেও আমার কিছুই যায় আসে না। প্রয়োজন শেষ হলে তোমাদের দু’জনকেও ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমার নিজের ঠিকানায় চলে যাবো।

২৭.
বাড়িটা কেমন নিরবতায় ঘিরে থাকে আজকাল। মানুষ আছে কিনা সেটা বুঝাই দায় হয়ে দাড়িয়েছে। কথা প্রয়োজন ছাড়া রুম থেকে বের হয় না আগে থেকেই। আরমান সকালে ভার্সিটি চলে যায় আর আসে রাতে, সারাদিন কোথায় থাকে সেই ভালো জানে। আরমানের বাবা আমিনুলের দেখা মিলে রাত দশটার পর। ইমা চলে যাওয়ার পর তাও মা ছিলো কিন্তু সেও এভাবে চলে গেলো। একটা কাজের মেয়ে আছে টিয়া, সে বাড়ির কাজ শেষ করে মোবাইল নাহলে টিভি নিয়ে পড়ে থাকে সারাদিন। একেবারে একা হয়ে গেছে ছাহেরা বেগম। দুটো কথা বলার জন্যও কেউ নেই তার পাশে। একা থাকার জন্য নিজের কৃতকর্মের কথা বেশি মনে পড়ে তার। তাহেরা আর ইমার সাথে করা অন্যায়গুলো প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায় ছাহেরাকে। বোনের মৃত্যুর জন্য সবচেয়ে বেশি যে সে দায়ী সেটাও তার অজানা নয়। যদিও আল্লাহ তাআ’লা মানুষের আয়ু যতদিন দিয়েছে ততদিনই সে এই পৃথিবীতে নিশ্বাস নিতে পারবে সেটা সবাই জানে। তবু মানুষের মনে হয় এটা না করলে হয়তো এমনটা হতো না। তাহেরার মৃত্যুর জন্য হয়তো কেউ দায়ী নয়, আল্লাহ তাআ’লা তার আয়ু যতদিন দিয়েছিলো ততদিন সে বেঁচে ছিলো। কিন্তু ইমা আর তাহেরার জীবনের কষ্টের জন্য ছাহেরা দায়ী, সেটা ছাহেরা কোনোদিন অস্বীকার করতে পারবে না নিজেও। আজকাল কথাকে খুব আদর করে ছাহেরা, সবসময় চায় মেয়েটা তার কাছে আসুক কিন্তু যাকে ছোটবেলা থেকে দূরে রেখেছে সে কী আর এখন কাছে আসবে। ছাহেরা বুঝতে পারছে তার আদরের ছেলেটাও দিনদিন কেমন যেনো হয়ে যাচ্ছে। সারাজীবন তাহেরা আর ইমাকে কষ্টে ডুবিয়ে রেখেছিলো সেই কষ্টগুলো যেনো নিজের পথ নিজেই খুঁজে ছাহেরার কাছে ফিরে আসছে। নিজের ভরা সংসার থাকতেও সে আজ একা।

মা আমার কলেজে কিছু টাকা লাগবে ?

কথার গলা শুনে ছাহেরার ভাবনার সুতো ছিঁড়লো। ব্রেকফাস্ট টেবিলে খাবার সামনে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে তখন কথার আওয়াজ কানে এলো।

কথার দিকে তাকিয়ে বললো, কতো টাকা লাগবে আমার রুমে আলমারি থেকে নিয়ে যা।

কথা একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে ঘুরে রুমের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। কথা বেশ বুঝতে পারছে মণিমা আর নানুর মৃত্যুর পর তার মা অনেকটা চুপচাপ হয়ে গেছে। তার চেঁচামেচিতে আর কানে বালিশ চেপে শুতে হয় না এখন। কথা একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো। সময়ের সাথে সবকিছুই পরিবর্তন হয়।

——
পরদিন সকাল সকাল হসপিটাল থেকে চলে আসে ইয়াদ। জ্বর পুরোপুরি যায়নি, থেকে থেকে আবার জ্বর উঠে, তবু তাকে হসপিটালে রাখা যায়নি। ইমা এক মুহুর্তের জন্যও ইয়াদকে একা ছাড়ছে না। একদিন আগেও মায়ের কথা ভেবে চিৎকার করে কান্না করা মেয়েটা আজ স্বামীর সেবা করতে অস্থির হয়ে উঠেছে। ইয়াদ শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে ইমার দিকে। সবসময় অবহেলা করা মেয়েটাই এখন তার ২৪ ঘণ্টা দেখাশোনা করছে। হসপিটালে নার্সকে কিছু করতে দেয়নি ইমা সব নিজেই করেছে। একটু আগেই হসপিটাল থেকে বাসায় এসেছে ইয়াদ আর ইমা। ইয়াদ বেডে বসে আছে আর ইমা রুমটা গুছিয়ে নিচ্ছে, সব এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। ইয়াদের সামনে প্রায় সবসময়ই মাথায় লম্বা একটা ঘোমটা টেনে চলাফেরা করে ইমা, তবে আজ চুলগুলো হাত খোঁপা করে, শাড়ীর আচল কোমরে গুঁজে কাজ করছে। ইমাকে দেখতে একদম পাক্কা গিন্নি মনে হচ্ছে ইয়াদের কাছে।

সব গুছিয়ে ইয়াদের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, চলুন আপনাকে গোসল করিয়ে দেই তারপর আমি গোসল করবো।

ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে বললো, আমি কী বাচ্চা নাকি তুমি আমাকে গোসল করাবে ?

ইমা রাগী ভাব নিয়ে বললো, জ্বরে তো ঠিক মতো দাঁড়ানোর শক্তিও হারিয়েছেন আবার বলছেন বাচ্চা নাকি। জ্বরের জন্য কারো এতো খারাপ অবস্থা হতে আমি জীবনে দেখিনি, এই আপনাকে ছাড়া। আমাকে দেখুন সারাদিন বৃষ্টির মধ্যে বসে থাকলেও কিছু হবে না।

ইয়াদ দৃষ্টি সরিয়ে বললো, যারা রোবট তাদের কিছু হয় না।

ইমা ইয়াদের কথা শুনে শব্দ করে হেঁসে উঠলো, তাতে ইয়াদ মুগ্ধ হয়ে তাকালো ইমার দিকে। হাসলে মেয়েটাকে অসম্ভব সুন্দর লাগে।

হাসি বজায় রেখে ইমা বললো, আমি রোবট লাইক সিরিয়াসলি ? আমি নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে জানি। রোবট শব্দটা আপানার জন্য পার্ফেক্ট৷ না হাসতে জানেন আর না কাঁদতে জানেন। শুধু কথায় কথায় রাগে ফুসফুস করতে পারেন। আচ্ছা আপনি এমন কেনো বলুন তো ||লেখনীতে তাহমিনা তমা||

ইয়াদ সিরিয়াস গলায় বললো, যেদিন সব জানতে পারবে সেদিন নিজেই বুঝে যাবে আমি এমন কেনো।

ইমা ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বললো, কে জানে কবে জানতে পারবো সব । এখন চলুন আমি হেল্প করছি আপনি শাওয়ার নিয়ে নিন। তবে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না পানিতে, দ্রুত করবেন।

ইয়াদ ইমার সাহায্যে শাওয়ার শেষ করে বেডে এসে বসলো। মাথাটা ভারী হয়ে ছিলো এখন ভালো লাগছে। ইয়াদ আশেপাশে নিজের ফোন খুঁজতে লাগলো, না পেয়ে সাইড টেবিলের ড্রয়ার খুলতেই ইমার সেই এলবাম দেখতে পেলো। কৌতূহল নিয়ে এলবামটা হাতে নিলো। খুলতেই খুব সুন্দর আর হাসিখুশী দুজন মানুষের ছবি দেখতে পেলো। ইমার মাকে ইয়াদ চেনে তাই বুঝতে পারলো এটা ইমার বাবা-মায়ের ছবি। একটু পরই ইমার ছোটবেলার ছবি দেখে ইয়াদ হেঁসে ফেললো। হঠাৎ করেই অসাবধানতায় হাত থেকে এলবামটা নিচে পড়ে গেলো। ভেতর থেকে ইমার মায়ের চিঠিটা বের হয়ে আসলো। ইমা সেদিন তাড়াহুড়ায় চিঠি এলবামের ভেতর রেখে এলবামটা ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলো। চিঠির সাথে কিছু ছবিও বের হয়ে গেছে। ইয়াদ আগে চিঠিটা হাতে নিলো। ওয়াশরুমের দরজার দিকে একবার তাকিয়ে নিলো। ইমার হয়তো বের হতে সময় লাগবে, কেবলই তো গেছে। হসপিটালে ছিলো তাই অনেকটা সময় নিয়ে শাওয়ার নিবে এটাই মনে হলো ইয়াদের। চিঠিটা খোলে পড়তে শুরু করলো। অনেকটা সময় নিয়ে ইয়াদ চিঠিটা পড়লো। ইয়াদ নিজের চোখে হাত দিয়ে বুঝতে পারলো জলধারা বয়ে চলেছে দু’চোখে।

ইয়াদ আনমনে বললো, একেই হয়তো বলে মা। শুধু ইমার কথা ভেবে তার মা এতো এতো কষ্ট সহ্য করেছে। সত্যি আমার বুঝতে ভুল হয়েছে, আমার মায়ের মতো নিকৃষ্ট মা যেমন পৃথিবীতে আছে ইমার মায়ের মতো মাও আছে। তাই হয়তো পৃথিবীতে এখনো মানুষ বেঁচে আছে। সবাই আমার মায়ের মতো হলে মানুষ হয়তো কষ্টে নিশ্বাস নিতে ভুলে যেতো।

চিঠিটা পড়া শেষ করে তারপর নিচে পরা ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে সেগুলো তুলতে লাগলো ইয়াদ। কিছু ইমার ছোটবেলার ছবি আর কিছু ইমার মায়ের। ইমার মায়ের ছবি দেখে নিজের মনে তার জন্য অনেকটা শ্রদ্ধা অনুভব করলো ইয়াদ। একটা ছবি উল্টো হয়ে পড়েছে। সেটা তুলে নিজের দিকে করতেই ইয়াদের পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো। ছবিটা দেখে ইয়াদের হাত অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে লাগলো। চোখ দুটো মুহূর্তে রক্তের মতো টকটকে লাল হয়ে গেলো। ইমা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ইয়াদকে দেখে ভয় পেয়ে গেলো।

দৌড়ে ইয়াদের কাছে গিয়ে বললো, আপনার খারাপ লাগছে ? আপনি এমন করছেন কেনো ?

ইয়াদ কোনো উত্তর দিলো না, সে এক দৃষ্টিতে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে। ইমা ইয়াদের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতেই ভয়ে পিছিয়ে গেলো।

চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here