#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ২৬
ইয়াদ কোনো উত্তর দিলো না, সে এক দৃষ্টিতে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে। ইমা ইয়াদের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতেই ভয়ে পিছিয়ে গেলো।
ইমা ভয়ে কাঁপা গলায় বললো, এই ছবি,,, কারা উনারা ?
ইয়াদ রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে বললো, আমার বাবা-মা।
ভয়ে ইমার মুখ কালো হয়ে গেছে। ইয়াদের কথা শুনে ইমা ছবিতে থাকা মহিলার দিকে ভালো করে তাকালে বুঝতে পারলো এটা মিসেস রুবিনা কবির। ছবিতে সোফায় বসা ইয়াসির হামিদের গলায় দড়ি জাতীয় কিছু পেঁচিয়ে ধরে আছে রুবিনা আর একজন পুরুষ যাকে ইমা চিনতে পারলো না।
ইমা আগের মতোই বললো, আপনার মা আপনার বাবাকে খুন করার চেষ্টা করেছিলো কেনো ? আর আপনি এই ছবি কোথায় পেলেন ? এটা তো দেখে মনে হচ্ছে অনেক আগের ছবি।
ইয়াদ চাপা কষ্ট নিয়ে বললো, আমার বাবাকে খুন করার চেষ্টা করা হয়নি বরং তাকে খুন করা হয়েছে আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে।
ইমা চমকে উঠে বললো, আপনার বাবা খুন হয়ে থাকলে এই বাড়িতে আপনার বাবার পরিচয়ে যিনি আছেন তিনি কে ?
ইয়াদের চোখে পানি টলমল করছে। প্রতিদিন দেখা স্বপ্নটা আজ চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠলো।
ইয়াদ ধরা গলায় বললো, মিসেস রুবিনা কবিরের পাশে যাকে দেখতে পাচ্ছো, সেই আজকের মুখোশধারী ইয়াসির হামিদ। আমার বাবাকে খুন করে আমার বাবার পরিচয় নিয়ে এই ভদ্র সমাজে ভদ্রলোক সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ইমা কিছুই বুঝতে পারছে না সব তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ইমা ইয়াদের থেকে একটু দূরত্ব রেখে ধপ করে বসে পড়লো বেডে। ইয়াদ কিছু একটা ভেবে ছবিটা রেখে ভালো করে এলবাম খুঁজে দেখতে লাগলো। ইমা এতক্ষণ ইয়াদের কাছে থাকা নিজের এলবামটা খেয়ালই করেনি।
এলবাম দেখে ইমা বললো, আপনি এটা কোথায় পেলেন আর এটাতে কী খুঁজছেন ?
ইয়াদ ব্যস্ত গলায় বললো, ছবিটা এই এলবাম থেকেই বের হয়েছে। তার মানে এটাতে আরো ছবি আছে।
ইমা যেনো আকাশ থেকে পড়লো ইয়াদের কথা শুনে। তার এলবাম থেকে এই ছবি কীভাবে সম্ভব ?
ইমা বলে উঠলো, আপনি পাগল হয়ে গেছেন এটা আমার বাবা-মায়ের এলবাম। এটাতে এই ছবি কোথা থেকে আসবে ?
এটা আমার বাবা-মায়ের এলবাম কথাটা বারবার ইয়াদের কানে বাজতে লাগলো৷ ইয়াদের হাত থেমে গেছে ইমার কথা শুনে। তাতে ইমার বলাও বন্ধ হয়ে গেছে। ইয়াদ হঠাৎ ইমার দিকে তাকালো।
গম্ভীর গলায় বললো, তোমার বাবার নাম কী ?
ইমা অবাক হয়ে বললো, আপনি আমার বাবার নাম জানেন না ? বিয়ের সময় শুনেছিলেন না ?
ইয়াদ রেগে ধমক দিয়ে বললো, যেটা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও।
ইমা ভয়ে কেঁপে উঠলো ইয়াদের ধমকে, কাঁপা গলায় বললো, ইমরুল আবিয়াত।
ইমার একটা কথায় ইয়াদের সব হিসাব মিলে গেলো এক ঝটকায়। ইমার বাবার নাম আগে শুনলেও কখনো অতোটা গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেনি। যাকে খুঁজছে সে ইয়াদের নিজের কাছেই ছিলো কখনো ভেবেই দেখেনি। নিজের আশেপাশে রেখে সারা দুনিয়া খোঁজে মরছে। ইয়াদ আবার এলবামটা এলোমেলো করে খুঁজতে লাগলো।
ইমা বলে উঠলো, কী হলো আপনি আবার এটাতে কী খুঁজছেন এভাবে। এই ছবি এখানে কী করে আসবে ?
ইয়াদ কঠিন গলায় বললো, এখানে না থাকলে আর কোথায় থাকবে। ছবিগুলো এখানেই থাকা উচিত আর,,,
ইয়াদ কথা শেষ করার আগেই আরো বেশ কিছু ছবি বের হয়ে এলো এলবামের কভার পেইজের ভেতর থেকে। ইমা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে ছবিগুলোর দিকে।
বেশ কিছুটা সময় পর ইমা রেগে বললো, কী হচ্ছে এসব বলবেন প্লিজ ? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনার বাবার খুনের ছবি আমার বাবা-মায়ের এলবামে কোথা থেকে এলো ?
ইয়াদ কষ্ট চেপে মুচকি হেঁসে বললো, তোমার বাবা নিজে চলে গেলেও এই জঘন্য মানুষগুলোর শাস্তির ব্যবস্থা ঠিক করে গেছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা সব সত্যি সামনে আসার। সময় হয়ে গেছে মিস্টার এন্ড মিসেস কবির আপনাদের পাপ পাহাড় ছুঁয়ে গেছে। এবার শাস্তি পাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যান আপনারা।
ইমা হা করে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে ইয়াদের কথা শুনছে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না তার মাথা ভন ভন করে ঘুরছে।
২৮.
ভার্সিটির করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে ইয়ানা। আজ বৃষ্টি দেখতে নয় আরমানের অপেক্ষায় এখানে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিনের পর ইয়াদের অসুস্থতার জন্য ইয়ানা বা ইশান কেউ ভার্সিটিতে আসেনি। কারো পায়ের শব্দ শুনে ইয়ানা তাকিয়ে দেখলো আরমান আসছে, তার দৃষ্টি সামনে থাকলেও মনোযোগ অন্য কোথাও আছে, তা বেশ ভালো করে বুঝা যাচ্ছে। ইয়ানা আরমানকে দেখে মনে মনে গুছিয়ে নিলো কী বলবে ? আরমান সামনে আসতেই ইয়ানা হালকা কাশি দিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো কিন্তু আরমানের সেদিকে কোনো মনোযোগই নেই। ইয়ানা আরো একবার কাশি দিলো তাতেও লাভ হলো না আরমাব নিজের মতো এগিয়ে যাচ্ছে।
ইয়ানা এবার বিরক্ত হয়ে একটু উচু গলায় বললো, স্যার আপনার সাথে একটু কথা ছিলো।
কারো গলার আওয়াজে আরমানের পা অটোমেটিক নিজের জায়গায় থেমে গেলো। আরমান আস্তে করে ঘুরে তাকালো শব্দের উৎস খোঁজার জন্য।
ইয়ানাকে দেখে এগিয়ে এসে বললো, ইয়ানা তুমি ?
ইয়ানা মুচকি হেঁসে বললো, জী স্যার আমি ?
আরমান ভাবলেশহীন ভাবে বললো, সে ঘটনার পরে আজ দুদিন পর ভার্সিটি এলে। আমি তো মনে করেছিলাম ভয়ে তোমরা ভাইবোন আর এদিকে আসবেই না।
আরমানের কথায় ইয়ানার রাগ হলো তাই বললো, ভয় পাবো কেনো ? ভয় তারা পায় যারা অন্যায় করে আর আমি বা আমার ভাই কোনো অন্যায় করিনি যে ভার্সিটি আসবো না।
আরমান নিজের দু’হাত ক্রশ আকাড়ে বুকে রেখে বললো, তাহলে দুদিন এলে না কেনো ?
ইয়ানা আহত গলায় বললো, ভাইয়া প্রচন্ড অসুস্থ ছিলো, গত দু’দিন ভাইয়ার সাথে হসপিটালে দৌড়াতে হয়েছে তাই আসতে পারিনি।
আরমান ছোট করে বললো, ওহ্,,,, তাহলে আজ যখন এসেছো ক্লাসে না গিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো ?
ইয়ানা মুচকি হেঁসে বললো, আপনার জন্য ?
আরমান তাতে ভ্রু কুঁচকে বললো, আমার জন্য মানে বুঝতে পারলাম না।
ইয়ানা হাসিটা বজায় রেখে বললো, আসলে সেদিন আপনাকে ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি। তাই সেদিনের সেই ধন্যবাদ দিতে আপনার জন্য এখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
আরমান মুচকি হেঁসে বললো, ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই। তোমরা আমার স্টুডেন্ট তাই তোমাদের ভালো খারাপ সবই আমাদের দ্বায়িত্ব। আমি শুধু আমার দ্বায়িত্ব পালন করেছি। তাহলে ঠিক আছে, এখন ক্লাসে যাও আমারও ক্লাসে লেট হচ্ছে।
আরমান আর না দাঁড়িয়ে নিজের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেলো। ইয়ানা সেদিকে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে আছে।
বিড়বিড় করে বললো, এই ব্যাটা কী ফর্মাল কথা ছাড়া কোনো কথা বলতে পারে না। আজব লোক একটা, সবসময় সিরিয়াস হয়ে থাকতে হবে।
ইয়ানা নিজের মতো বকবক করে ক্লাসের দিকে চলে গেলো।
—-
সামনে পরীক্ষা পড়াশোনার প্রচন্ড চাপে আছে কথা। ইমার সাথে চার-পাঁচদিন হলো কথা বলা হয় না। ইমার মায়ের মৃত্যুর পর কথা সবসময় ইমার খোঁজখবর রাখতো ফোনে। তবে চার-পাঁচ দিন হলো ইমাও কল দেয় না আর কথারও দেওয়া হয়ে উঠে না। কলেজ থেকে বের হয়ে ইমাকে কল দেওয়ার জন্য ফোন বের করে রাস্তার পাশে দাঁড়াতেই একটা গাড়ি এসে থামলো কথার সামনে। গাড়িটা এতোদিনে ভালো করে চিনে গেছে কথা। ইশানের সাথে প্রায় দেখা হয় কথার। গাড়িটা সবসময় সাথেই থাকে ইশানের। কথা ভ্রু কুঁচকে গাড়ির দিকে তাকাতেই ইশান বের হয়ে এলো স্টাইল নিয়ে।
ইশান কথার সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেঁসে বললো, কেমন আছেন মিস তোতাপাখি ?
কথা ভ্রু কুঁচকে বললো, আপনি আমাকে তোতাপাখি বলেন কেনো সবসময় ? আমার সুন্দর একটা নাম আছে বলতে পারলে বলেন নাহলে চুপ করে থাকেন। তবু আবোলতাবোল নামে ডাকবেন না। শুধু আপুর দেবর হন বলে এতো ভদ্রভাবে কথা বলি নাহলে,,,,
কথা পুরোটা বলার আগেই ইশান কথার দিকে হালকা ঝুঁকে বললো, নাহলে কী করতে পিচ্চি ?
কথা একটু পিছনে সরে গিয়ে বললো, ওফ সেকেন্ডে সেকেন্ডে আমার নাম চেঞ্জ না করলে আপনার হয় না ?
ইশান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বললো, না হয় না, তোমাকে দেখলে আমার বিভিন্ন নাম মাথায় আসে বুঝছো ?
কথা জানে এর সাথে যত কথা বলা হবে এ ততই কথা পেঁচাবে তাই প্রসঙ্গ চেঞ্জ করার জন্য বললো, হঠাৎ করে এমন ভূতের মতো সামনে আসার কারণ জানতে পারি ?
ইশান মুচকি হেঁসে বললো, অবশ্যই জানতে পারেন তবে তার আগে গাড়িতে উঠে বসুন।
কথা অবাক হয়ে বললো, আমি আপনার গাড়িতে কেনো বসবো ?
ইশান আগের ভঙ্গিতে বললো, ভাইয়া অসুস্থ তুমি জানো না ? একবার দেখতেও গেলে না। ভাবি তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে আমার সাথে।
কথা চমকে উঠে বললো, কীহ,,,,, ইয়াদ ভাইয়া অসুস্থ ? আপু তো আমাকে কিছু বলেই নি, চলুন চলুন।
ইশান কথাকে গাড়ির দরজা খোলে দিলো আর নিজেও ভেতরে বসে পড়লো। মনে মনে বললো, সরি তোতাপাখি মিথ্যা বলার জন্য। ভাবির কথা না বললে তুমি যেতে না, তাই বাঁধ্য হয়ে মিথ্যাটা বললাম। জানি না তুমি কীভাবে নেবে তবে আজ আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।
—–
ইমা বেডে বসে আছে গালে হাত দিয়ে। ইয়াদ ছবিগুলো নিয়ে এই অসুস্থ শরীর নিয়ে বের হয়ে গেছে। সারাদিন পেড়িয়ে গেলো তার খোঁজ খবর নেই। ইমার টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে। একে তো তখন কিছুই খোলে বললো না। ইমার মাথায় প্রশ্ন আর ইয়াদের চিন্তায় খারাপ অবস্থা।
বৌমা রুমে আছো ?
গলার আওয়াজ শুনে ইমার কাছে মনে হলো রুবিনার গলা। আজ রুবিনার আওয়াজ কানে যেতেই ঘৃণায় মনটা বিষিয়ে উঠলো ইমার। মানুষ কতো সুন্দর নিখুঁত অভিনয় দিয়ে নিজের আসল চেহারা লুকিয়ে রাখে সেটাই ইমা ভাবছে। এই মানুষটার মুখ দেখে মনে হয় কত নিষ্পাপ আর সে নিজের হাতে একজনকে খুন করেছে। ভাবতেই ইমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো।
তখনই রুবিনা আবার বললো, বৌমা তুমি কী আমার কথা শুনতে পাচ্ছো ?
ইমা ভয়ে একটা ঢোক গিললো। রুবিনাকে এখন তার প্রচন্ড ভয় করছে। কখনো সে ইমাকে খোঁজে না আজ কেনো খোঁজছে সেটা ভেবে ইমার গলা শুকিয়ে আসছে বারবার।
চলবে,,,,,#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ২৭
ইমা ধীর পায়ে গিয়ে দরজা খোলে দিলো। দরজার বাইরে রুবিনা বিরক্ত মাখা মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ইমাকে দরজা খুলতে দেখে বললো, কোথায় ছিলে এতো সময় লাগলো কেনো দরজা খুলতে ?
ইমা জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললো, ওয়াশরুমে ছিলাম শুনতে পায়নি।
রুবিনা আগের ভঙ্গিতে বললো, ইয়াদ কোথায় ইয়াদের সাথে দেখা করতে এসেছি আমি।
রুবিনা ইমাকে সাইড কাটিয়ে রুমে ঢুকে দেখলো কেউ নেই। ইমার দিকে তাকিয়ে বললো, ইয়াদ কোথায় ?
ইমা আমতা আমতা করে বললো, উনি বাইরে গেছেন ?
রুবিনা চমকে উঠে বললো, হোয়াট,,, এই অসুস্থ শরীর নিয়ে বাইরে গেছে আর তুমি যেতে দিয়েছো ?
ইমা মাথা নিচু করে বললো, আমি উনাকে না করলেই, আমার কথা শুনবেন নাকি ?
রুবিনা রেগে বললো, কেমন স্ত্রী তুমি ? তোমার কথা তোমার স্বামী শুনবে না ?
দরজার কাছে থেকে হঠাৎ কেউ বলে উঠলো, বাহ্ মিসেস রুবিনা কবির শিখাচ্ছেন আদর্শ স্ত্রীর দ্বায়িত্ব, ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর।
ইমা আর রুবিনা দু’জনেই দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে পকেটে দু’হাত গুঁজে দাড়িয়ে আছে ইয়াদ। দৃষ্টি ফ্লোরে সীমাবদ্ধ। ইমা আর রুবিনা তাকাতেই ইয়াদ চোখ তুলে তাদের দিকে তাকালো। ইমা আঁতকে উঠলো ইয়াদের চোখ দেখে। অসম্ভব পরিমাণ লাল হয়ে গেছে ইয়াদের চোখ আর দেখে মনে হচ্ছে খুব ক্লান্ত।
রুবিনা আমতা আমতা করে বললো, ইয়াদ তুমি ভুল বুঝছো আমাকে ?
ইয়াদ রুমে ঢুকে গায়ের ব্লেজার খুলতে খুলতে বললো, আমি খুব ক্লান্ত এখন আমার রুম থেকে গেলে আমি খুশি হবো।
রুবিনা একবার ইমার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
ইমা দ্রুত ইয়াদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো, কোথায় গিয়েছিলেন আপনি এই অসুস্থ শরীর নিয়ে ? সারাদিনের মেডিসিনও নেননি।
ইয়াদ কিছু না বলে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। ইমা সেদিকে তাকিয়ে কিচেনে চলে গেলো ইয়াদের জন্য খাবার নিয়ে আসতে। সুপ রান্না করে নিয়ে রুমে এসে দেখে ইয়াদ ব্লাংকেট মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। ইমা ব্লাংকেটের ভেতর হাত দিয়ে ইয়াদের কপাল স্পর্শ করতেই চমকে গেলো। ধুম জ্বর উঠেছে আবার ইয়াদের। ইমার প্রচন্ড রাগ লাগছে এখন ইয়াদের উপর। লোকটার নিজের প্রতি কোনো গুরুত্ব নেই। এতো অবহেলা কেউ নিজের প্রতি কীভাবে করতে পারে ইমা বুঝে পায় না।
ইমা রাগ করে ইয়াদরে ব্লাংকেট টেনে সরিয়ে মুখ বের করলে ইয়াদ দুর্বল গলায় বিরক্ত হয়ে বললো, কী হয়েছে ?
ইমা কিছু না বলে টেনে ইয়াদকে আধশোয়া করে বসানোর চেষ্টা করলে ইয়াদ নিজেই সেভাবে বসে ইমার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকালো।
ইমা সুপের বাটি থেকে চামচ দিয়ে এক চামচ সুপ তুলে হালকা হালকা ফু দিয়ে একটু ঠান্ডা করে ইয়াদের মুখের সামনে ধরলো। ইয়াদ মুখ ফিরিয়ে নিলো, মানে সে খাবে না।
ইমা রেগে শাসনের সুরে বললো, এখন যদি এটা না খান আমি কিন্তু আপনার মাথায় ঢেলে দেবো। আর আমি মিথ্যা কথা একদম বলি না।
ইয়াদ চমকে ইমার দিকে তাকালো। রাগে ইমার নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে। তবে দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে ইমাকে। ইয়াদ ইমার দিকে তাকিয়ে আনমনে সুপ টুকু মুখে নিয়ে নিলো। মুখে দিতেই ইয়াদ মুখ কুঁচকে ফেললো। মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে গেছে তেতো লাগছে খেতে। ইয়াদ মুখ থেকে ফেলে দিতে গেলে ইমা ইয়াদের মুখের উপর হাত দিয়ে চেপে ধরলো।
ইয়াদের চোখে চোখ রেখে বললো, জানি খেতে ভালো লাগছে না তবু একটু কষ্ট করে খেয়ে নিন প্লিজ। সারাদিনের মেডিসিন বাদ পড়ে গেছে, ধুম জ্বর উঠে গেছে আপনার। এখন যদি এটা খেয়ে মেডিসিন না খান তাহলে আবার হসপিটালে যেতে হবে। প্লিজ লক্ষিটি খেয়ে নিন।
ইমা অসহায় মুখ করে ইয়াদকে কথাগুলো বলছে। যেনো ইয়াদ খাবারটা না খেলে ইয়াদের না বরং ইমার ক্ষতি হয়ে যাবে। ইয়াদ ইমার মায়ায় পড়ে গেলো, ইমার চোখে চোখ রেখে সুপ টুকু গিলে নিলো। ইমা মুচকি হেঁসে আবার এক চামচ সুপ তুলে ফু দিয়ে ঠান্ডা করতে লাগলো। ইয়াদ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইমার দিকে আর ভাবছে সবসময় শুনে এসেছে শ্যামলা মেয়েদের মুখে অদ্ভুত এক মায়া থাকে তাহলে ইমার মুখে এতো মায়া কেনো ? ইমা তো শ্যামবর্ণ নয় ধবধবে ফর্সা তাহলে ? ইমা ফু দিচ্ছে আর ইয়াদ তাকিয়ে আছে ইমার ঠোঁট জোড়ার দিকে। খাওয়া শেষ হয়ে গেলেও ইয়াদ হা করে আছে দেখে ইমা ভ্রু কুঁচকালো।
আপনি না খেতে চাইছিলেন না, এখন যখন শেষ হয়ে গেছে আরো খেতে চাইছেন ?
ইমার কথায় ইয়াদের হুশ ফেরে। বেশ লজ্জাও পায় নিজের কাজের জন্য। তবে সেটা ইমাকে বুঝতে দেয় না একদমই।
মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে, এবার আমি শুতে পারি ?
ইমা কিছু না বলে উঠে গিয়ে মেডিসিন নিয়ে এসে ইয়াদকে একটা একটা খাইয়ে দিলো তারপর বললো, এবার শুয়ে পড়ুন আমি আর বিরক্ত করবো না।
ইমা উঠে দাঁড়িয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ইয়াদ পেছন থেকে হাত টেনে ধরলো। ইমা কেঁপে উঠলো ইয়াদের হাতের স্পর্শে।
ঘুরে তাকিয়ে বললো, আপনার আর কিছু লাগবে ?
ইয়াদ আনমনে বলে উঠলো, তোমাকে লাগবে।
ইমা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলে, মানে ?
ইয়াদ চোখ বন্ধ করে বলে, মাথাটা ব্যাথা করছে একটু হাত বুলিয়ে দেবে ?
ইমা ইয়াদের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো, আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি এগুলো নিচে রেখে এখনই আসছি।
ইয়াদ কিছু বললো না, ইমা খাবারের ট্রে নিচে নিয়ে গেলো। রুমে এসে দেখে ইয়াদ আগের মতোই শুয়ে আছে। ইমা আস্তে করে কপালে হাত রেখে বুঝতে পারলো জ্বরটা বাড়ছে। ইমা কিছু না ভেবে জলপট্টি দেওয়ার সব নিয়ে এসে ইয়াদের কপালে জলপট্টি দিতে লাগলো। ইয়াদ হালকা কেঁপে কেঁপে উঠছে একটু পর পর। ইমার ভয় লাগছে ইয়াদের এভাবে জ্বর বাড়তে দেখে। ইয়াদকে দেখে মনে হচ্ছে না তার কোনোদিকে হুশ আছে। ইমার মনে পড়লো ডক্টর বলেছিলো জ্বর আবার বাড়লে জলপট্টি দেওয়ার সাথে শরীরও মুছিয়ে দিতে। ইমা ইয়াদের গা থেকে ব্লাংকেট সরাতেই ইয়াদ শীতে কেঁপে উঠে ইমার হাত আঁকড়ে ধরলো। শরীর মুছাতে হলে ইয়াদের গায়ের টিশার্ট খুলে নিতে হবে কিন্তু ইমা বেশ ইতস্তত বোধ করছে। ইমা ইয়াদের ধরা হাতের দিকে তাকালো। কী করবে বুঝতে পারছে না। চোখ বন্ধ করে সাহস বাড়িয়ে নিলো আর মনে মনে ভাবলো ইয়াদ কোনো পরপুরুষ নয় তার স্বামী তাই তাকে এটা করতেই হবে। ইয়াদ চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে ইমার দিকে, এতে ইমার অস্বস্তি আরো বেড়ে যাচ্ছে। তবু কাঁপা হাতে ইয়াদের গা থেকে টিশার্ট খুলে স্পঞ্জ ভিজিয়ে গা মুছে দিতে লাগলো। ইমার হাত খুব কাঁপছে তবু ইমা নিজের কাজ করে যাচ্ছে। গা মুছিয়ে দেওয়া হলে ইমা যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। টিশার্ট পড়িয়ে দিয়ে আবার বেডে শুইয়ে দিলো ভালো করে আর জলপট্টি দিতে লাগলো। এভাবে অনেকটা সময় পর ইয়াদ ঘামতে শুরু করলো। ইমা কপালে হাত দিয়ে বুঝতে পারলো তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমে আসছে। ইয়াদও ঘুমিয়ে পড়লো জ্বর কমতে শুরু করলে। তবে ইমা জলপট্টি দেওয়া বন্ধ করলো না।
২৯.
বেডে শুইয়ে এপাশ ওপাশ করে যাচ্ছে কথা, কিছুতেই ইশানের বলা কথাগুলো ভুলতে পারছে না সে। যারা ভালোবাসার কাঙাল তাদের পক্ষে ভালোবাসা পেয়ে ফিরিয়ে দেওয়া কতটা যন্ত্রণার সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে কথা। ইশান তখন তাদের বাড়ির রাস্তায় না গিয়ে অন্য রাস্তায় গেলে কথার মনে সন্দেহ জাগে।
আপনি এদিকে কোথায় যাচ্ছেন ? এটা তো আপনাদের বাড়ির রাস্তা নয়।
ইশান মুচকি হেঁসে বললো, কেনো ভয় করছে ?
কথা থতমত খেয়ে বললো, ভয় করবে কিসের জন্য ? আজগুবি কথা বার্তা।
ইশান দুষ্টুমি করে বললো, কেনো ভয় করছে না ? তোমার তো ভয় পাওয়া উচিত ।
কথা আমতা আমতা করে বললো, কেনো ভয় পাওয়া উচিত ?
ইশান কথাকে ভয় দেখানোর জন্য বললো, এখন যদি আমি তোমাকে কোনো নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে খুন করে গুম করে দেই।
কথা ভয় পেলেও প্রকাশ করলো না বরং আগের মতো আমতা আমতা করেই বললো, আমাকে খুন করে আপনার কোনো লাভ হলে এই ভয় পাওয়া উচিত হতো। কিন্তু আমাকে খুন করে আপনার দশ পয়সার লাভও হবে না বরং বিপদ হবে। তাই এটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
ইশান দুষ্টু হেঁসে বললো, কে বললো লাভ নেই।
কথা বুঝতে না পেরে বললো, মানে,,,, আমাকে মেরে আপনার কী লাভ হবে ?
ইশান সিরিয়াস মুড নিয়ে বললো, একটা মেয়ের থেকে একটা ছেলের কী লাভ হতে পারে জানো না নাকি তুমি ?
কথা এবার ভয়ে কেঁপে উঠলো। মুখ দেখে মনে হচ্ছে এখনই কেঁদে দিবে। ইশান বেশ মজা পাচ্ছে কথার এমন রিয়াকশন দেখে। ইশান কথার ভয়টা বাড়ানোর জন্য কথার পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্ক্যান করছে। কথা ভয়ে নিজের গায়ের জামা খামচে ধরে আছে শক্ত করে।
এরপর ধীর গলায় বললো, আমি বাড়ি যাবো প্লিজ আমাকে যেতে দিন।
ইশান মুচকি হেঁসে বললো, আরে আমি কী গুন্ডা নাকি আমাকে এভাবে বলছো কেনো ? তোমাকে অবশ্যই বাড়ি পৌঁছে দেবো। তার আগে আমি যেটা করতে চাই,,,
ইশানের কথা শেষ হওয়ার আগেই কথা বললো, করতে চান মানে,,,?
ইশান কথার দিকে তাকিয়ে বললো, করতে চাই না, মানে যা বলতে চাই সেটা বলে নেই, তারপর বাড়ি পৌছে দিবো।
কথা বললো, আমি কিছু শুনতে চাই না আমি বাড়ি যাবো এখনই।
কথা চলন্ত গাড়ির দরজা খোলে নামতে চাইলে ইশান একহাতে কথাকে আটকায় আর অন্যহাতে গাড়ি কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে।
ইশান রেগে বলে, তুমি পাগল হয়ে গেলো নাকি, চলন্ত গাড়ি থেকে নামবে তুমি ?
কথা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, আপনি আমাকে এখন না নামালে চলন্ত গাড়ি থেকে লাভ দিবো।
কথা ইশানের সাথে ধস্তাধস্তি শুরু করলে ইশান বাধ্য হয়ে গাড়ি সাইড করে থামায় আর সাথে সাথে কথা গাড়ি থেকে নেমে উল্টো পথে হাঁটা শুরু করে। ইশান তাড়াতাড়ি নেমে পেছন থেকে হাত টেনে ধরে।
কথা পেছনে ঘুরে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে, আপনি আমার হাত না ছাড়লে আমি কিন্তু চিৎকার করবো ?
ইশান এবার সত্যি সত্যি রেগে গেলো আর কথাকে কোলে তুলে গাড়ি ব্যাক সিটে শুইয়ে দিলো। নিজে কথার দিকে ঝুঁকে একদম কাছাকাছি চলে এলো, কথা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।
ইশান রেগে বললো, তোমার কী মনে হয় এখানে চিৎকার করলেই কেউ আসবে ?
ইশানের কথা শুনে এবার কেঁদেই দেয় কথা। ইশানের এখন ইচ্ছে করছে নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে। তার আগেই ভাবা উচিত ছিলো সে একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে মজা করছে। ইশান চোখ বন্ধ করে নিজের রাগ কন্ট্রোল করে নিলো। এখন রাগ করলে সব উল্টো হয়ে যাবে ভেবে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টার করে। ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকায় কথার দিকে। মেয়েটা ঠোঁট ফুলিয়ে বাচ্চাদের মতো ফুপিয়ে কান্না করে যাচ্ছে। চোখের পাপড়িগুলো ভিজে চিকচিক করছে পানির কণা। ইশানের ঘোর লেগে গেছে কথার দিকে তাকিয়ে। অনেক সময় পর ইশানের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে পিটপিট করে তাকালো কথা। তাকাতেই দেখলো ইশান ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
কথাকে তাকাতে দেখে ইশান হুট করে বলে উঠলো, I love you Kotha,,,, i love a lot of you..
কথা ইশানের কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকায় আর বলে, কী বলছেন এসব আপনার মাথা ঠিক আছে তো নাকি ?
ইশান কথার দু’হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে কিস করে বলে, আমি একদম ঠিক আছি আর যা বলছি তাও একদম সত্যি। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি তোতাপাখি খুব। প্রথম আমার মনে হয়েছিলো তোমাকে বিরক্ত করতে আমার ভালো লাগে তাই সবসময় সুযোগ খুঁজতাম তোমাকে বিরক্ত করার। কিন্তু তোমাকে না দেখে দুদিন থাকতে আমার দম বন্ধ হয় এসেছে। তোমার কী মনে হয় ? আমার সাথে মাঝে মাঝে তোমার দেখা হয়ে যেতো। নাহ, আমি প্রত্যেকটা দিন তোমার আশেপাশেই থাকতাম, যেদিন খুব বেশি ইচ্ছা করতো তোমার সাথে কথা বলার তখন তোমার সামনে আসতাম। আমি নিজেও বুঝতে পারিনি কেনো প্রতিদিন তোমাকে দেখতে ছুটে আসতাম। দুদিন তোমাকে না দেখে বুঝতে পেরেছি আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না কথা।
কথা শান্ত গলায় বললো, আমার বাড়ি যেতে লেট হচ্ছে, মা চিন্তা করবে।
ইশান সরে এলো কথার থেকে তারপর বললো, ঠিক আছে এখনই উত্তর দিতে হবে না। তোমার যতটা সময় লাগে নাও, তারপর উত্তর দিয়ো।
কথা কিছুই বললো না। ইশান ব্যাক সিট থেকে নেমে ড্রাইভিং সীটে এসে বসলো। কথা নিজের বিস্ময় কাটিয়ে সামনের সীটে এসে বসলো। এখনো কথার বিশ্বাস হচ্ছে না ইশানের একটু আগের বলা কথাগুলো। দুজনই চুপচাপ বাকিটা রাস্তা পারি দিলো।
কথার বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামতেই কথা সামনের দিকে তাকিয়েই বললো, আপনি আমাকে যে কথাগুলো বলেছেন সব ভুলে যান আমিও ভুলে যাবো। এটা আপনার কোনো ভালোবাসা নয় ক্ষনিকের মোহ, যা একটা সময় কেটে যাবে। আমার জায়গায় অন্যকেউ হলে হয়তো খুশিতে আত্মহারা হয়ে একসেপ্ট করে নিতো। কিন্তু আমি বরাবরই বাস্তববাদী মানুষ। ছোটবেলা থেকে বাস্তবতা মেনে নিয়ে বড় হতে শিখেছি তাই আপনাকে একসেপ্ট করা, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। একটা সময় যখন আপনার সমাজের মানুষ বলবে আমি আপনার যোগ্য নই, আপনার বন্ধুমহলে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি হবে তখন আপনারও মনে হবে, ভুল করেছেন। আমি বামুন হয়ে চাঁদ ধরার স্বপ্ন দেখি না মিস্টার ইশান হামিদ। ভালোবাসার কাঙাল হলেও আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে আমি রাজি নই। আমার জীবনে আমি এমন কাউকে চাই যে আমাকে কখনো তার অযোগ্য মনে করবে না। আশা করি আজকের কথাগুলো এই পর্যন্তই থাকবে। আপনাকে রিজেক্ট করার মতো যোগ্যতা আমার নেই তাই রিজেক্ট করার অপরাধে প্রতিশোধ নিতে আসবেন না আবার। আমি আপনার যোগ্য নই বলেই নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছি, তাই আশা করবো আপনার ইগো হার্ট হয়নি। ভালো থাকবেন আর নিজের যোগ্য কাউকে ভালোবাসবেন, অযোগ্যকে নয়।
কথাগুলো বলে এক মুহুর্ত দেরি না করে বাসার ভিতরে চলে গেলো কথা। ইশান পাথরের মুর্তির মতো বসে আছে। কথা এতোক্ষণ কী বলে গেলো সব যেনো ইশানের মাথার উপর দিয়ে গেলো৷ এতো কম বয়সে এতোটা ম্যাচিউরড কথা বার্তা কীভাবে বলতে পারে বিশ্বাস করতে পারছে না ইশান এখনো।
কথা বেড থেকে উঠে দাঁড়ালো কিছুতেই ঘুম আসছে না তার। ইশানের দুষ্টুমিগুলো কথার চোখে ভাসছে। কথা ইশানকে পছন্দ করে না এমনটা নয়। প্রথম থেকেই ইশানকে ভালো লাগে তার, তবে সেটাকে কখনো নিজের মনকে প্রাধান্য দিতে দেয়নি কথা। ইশানের পাশে দাঁড়ানোর মতো যোগ্যতার কথার নেই। তাই এসব ভালো লাগা ভালোবাসা তাকে মানায় না। একটা বিষয় ভেবে পাচ্ছে না ইশান কীভাবে তাকে পছন্দ করতে পারে। কথা ধীর পায়ে ছাদের উদ্দেশ্যে রওনা হলো অন্ধকারে ভয় পায় না কারণ অন্ধকারের সাথে তার খুব মিল। দু’জনেই কালো আর দু’টোই মানুষের অপছন্দ।
৩০.
রাত গভীর হয়ে গেছে, ব্যস্ত শহরটা নিরবতায় ছেয়ে গেছে। ইমা ফ্লোরে বসে বেডে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে আর তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইয়াদ। যতো দিন যাচ্ছে ততই মেয়েটার প্রতি মায়া বেড়ে চলেছে, শুধুই কী মায়া ? ইয়াদের ইচ্ছে করছে নিজের মনের অনুভূতিগুলোকে অন্য একটা নাম দিতে। কিন্তু ইয়াদ বড্ড ভয় পায় বিশ্বাস করতে, ভালোবাসতে। সবাই যে ভালোবাসার মূল্য দিতে জানে না। তবে ইয়াদ নিজের আর ইমার মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পায় না। দুজনেই ভালোবাসার কাঙাল। দুজনকেই ঘিরে আছে কিছু তিক্ততার সম্পর্ক, যেটা কারোই কাম্য নয়।
ইয়াদ বিড়বিড় করে বললো, আচ্ছা যখন তোমার সামনে কিছু তিক্ত সত্য বেড়িয়ে আসবে তখনও কী তোমার মনে আমার জায়গাটা এমনই থাকবে ? যখন জানতে পারবে তোমার জীবন এতোটা এলোমেলো হওয়ার পিছনে আমার পরিবার দায়ী তখনও কী তোমার আমার সম্পর্কটা এমনই থাকবে, নাকি আরো #তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ২৮
ইয়াদ উঠে বসলো তবে দৃষ্টি ইমার দিকেই। ইমাকে সে এমনই এমনই মাফ করেনি। ইয়াদের জানাটা পুরোপুরি ঠিক না হলেও পুরোপুরি ভুলও ছিলো না। ইয়াদকে বিয়ে করার জন্য মোটা অংকের টাকা নিয়েছে ইমা এমনটাই সে জেনেছিলো। তবে টাকা নিয়েছে ঠিকই কিন্তু ইমা নয় ইমার মণি ছাহেরা বেগম আর খালুজান আমিনুল মাহমুদ। আর তা শুধু বিয়ের জন্য নয় বরং ডি কের সব কাজে সাহায্য করার পারিশ্রমিক হিসাবে নিয়েছে। কিন্তু সে বিষয়ে ইমা কিছুই জানে না। বিয়ের কয়েকদিন পর অফিসে ডি কে আর আমিনুল মাহমুদের কথোপকথনে সেটা জানতে পারে ইয়াদ। ইমা তো ছিলো কেবল একটা গুটি মাত্র। যে ভুল ইমা করেনি তার শাস্তি তাকে দেওয়াটা অন্যায়। তারপর থেকেই ইয়াদ ইমার সাথে ভালো ব্যবহার করতে না পারলেও খারাপ ব্যবহার না করার চেষ্টা করে গেছে। ইমা ইয়াদের মনে ভালো লাগার একটা জায়গা তৈরি করতে পারলেও বিশ্বাসের জায়গাটা এখনো মজবুত করে উঠতে পারেনি। ইয়াদ ইমার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বেড থেকে উঠে দাঁড়ালো। জ্বর কমে গেলেও শরীরটা বেশ দূর্বল লাগছে ইয়াদের। তবু ইমাকে কোলে তোলে বেডে শুইয়ে দিলো তাতে ইমার চুলগুলো মুখের উপর পড়ে মুখটা ঢেকে গেছে। ইয়াদ ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুলের সাহায্যে চুলগুলো কানের পিছনে গুজে দিলো। ইয়াদের খুব ইচ্ছে করছে ইমার কপালে একবার ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতে তবে কোথাও একটা অদৃশ্য বাঁধা অনুভব করছে। বেশি সময় ইমার দিকে তাকিয়ে থাকলে ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখা কষ্ট হবে তাই উঠে সোফায় বসলো। নিজের দূর্বলতা মানুষের থেকে যতো আড়ালে রাখা যায় ততই নিজের জন্য মঙ্গল। ইয়াদ নিজের দূর্বলতা কারো সামনে প্রকাশ করতে চায় না। সেও রক্তে মাংসে গড়া একজন মানুষ, কোনো রোবট নয়। তারও প্রাণ খোলে হাসতে ইচ্ছে করে, চিৎকার করে কেঁদে বুকের চাপা কষ্টগুলো কমাতে ইচ্ছে করে, নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে ইচ্ছে করে কিন্তু ইয়াদ সেটা করে উঠতে পারে না। নিজের অনুভূতি লুকিয়ে রাখতে রাখতে, ইয়াদের এখন নিজের কাছেই নিজেকে রোবট মনে হয়। ইয়াদ কিছুটা সময় নিজেকে নিয়ে ভাবতেই দূর্বলতার জন্য চোখে ঘুম নেমে আসতে লাগলো। সোফায় ঘুমানোর অভ্যাস নেই ইয়াদের আর শরীরটাও সায় দিচ্ছে না তাই ধীরপায়ে বেডের একপাশে গিয়ে ব্লাংকেট মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো।
——
ছাঁদে তিন সাইডে রেলিং আছে, পূর্ব পাশটা খোলা। নানা রঙের ফুলে ছেয়ে আছে পুরো ছাঁদ। ইমা আলতো হাতে ফুলগুলো ছুঁয়ে দিচ্ছে। পূর্ব আকাশে লাল টকটকে সূর্যটা উঁকি দিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে ব্যস্ত আর ইমা ভোরের আলোয় ফুলগুলো দেখতে ব্যস্ত। ছাঁদ পুকুরে কয়েকটা পদ্মা ফুল, জল গোলাপ আর শাপলা দেখে খুশিতে আত্মহারা ইমা। দৌড়ে গিয়ে ফুলগুলো ছুঁয়ে দেখতে লাগলো, ছোট ছোট লাল মাছগুলো মুখ উচু করে কিছু খাচ্ছে। ইমা একটা পদ্মফুল ছিঁড়ে নিজের লম্বা খোলা চুলে একটা ক্লিপ দিয়ে আঁটকে নিলো। ছাঁদের পূর্বদিকে গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসলো। ইমা জানে না কেনো তবে তার খুব ভালো লাগছে আজ। গুনগুন করে একটা গান গাইতে শুরু করলো। কিছু সময় পর উঠে দাঁড়িয়ে ঘুরতেই কেউ সজোরে ধাক্কা দিলো তাকে। কী রিয়াকশন দিবে বুঝতে পারছে না ইমা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ধাক্কা দেওয়া মানুষটার দিকে তবে মুখটা স্পষ্ট নয় ইমার কাছে। হঠাৎ ইয়াদ সেই মানুষটাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে ইমা বলে চিৎকার দিয়ে ইমার হাতটা ধরতে গেলো। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে ইয়াদ ইমার হাত ধরার আগেই ইমা নিচে পড়ে যেতে লাগলো। ইয়াদ তার দিকে হাত বাড়িয়ে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তখনো।
ইমা,,,,,,,
ফট করে চোখ খুলে ফেললো ইমা। উঠতে গিয়েও উঠতে না পেরে আগের জায়গায় শুয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো সে।
ইয়াদ ইমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ব্যস্ত গলায় বললো, কী হয়েছে এমন করছো কেনো ?
ইমা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ইয়াদকে আর জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে।
ইয়াদ আবার ইমার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, কী হয়েছে এমন করছো কেনো ? খারাপ লাগছে নাকি তোমার ?
ইয়াদের ধাক্কায় ইমার হুঁশ ফিরলো কিছুটা। নিজের দিকে খেয়াল করে সে তব্দা খেয়ে গেলো। ইয়াদের বুকে মাথা রেখে তাকে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে ইমা। ইয়াদের এক হাত ইমার মাথায় আর অন্যহাত পিঠে। নিজের অবস্থান বুঝতে পারতেই ইমার হাত আলগা হয়ে গেলো তবে ইয়াদ আগের মতোই আছে আর প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। বিয়ের এতোদিনে ইমা আর ইয়াদ কখনো এক বিছানায় ঘুমাইনি। ইমা সবসময় সোফাতেই ঘুমায় আর ইয়াদ বেডে। তবে এখন কী করবে কিছুতেই মাথায় আসছে না ইমার। লজ্জায় মাটির নিচে ঢুকে পরতে ইচ্ছে করছে। লজ্জায় স্বপ্নের কথাও ভুলে গেছে এখন। সে কীভাবে ইয়াদর দিকে তাকাবে বুঝতে পারছে না। ইমা ইয়াদের হাতের বাঁধন উপেক্ষা করে উঠে বসলো, হাতের বাঁধন শক্ত না হওয়ায় সমস্যা হলো না খুব একটা। ইমা বসে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে আর ইয়াদ কিছু বুঝতে না পেরে ইমার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ঘুমের মধ্যে হঠাৎ বুকে চাপ অনুভব করলে ইয়াদের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙতেই বুঝতে পারে ইমা তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে আর ক্রমশ তার হাতের বাঁধন শক্ত হচ্ছে আর তাতেই ইয়াদ বুকে চাপ অনুভব করেছে। ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে কিছু বলার আগেই খেয়াল করলো ইমা কেমন যেনো অস্থির অস্থির করছে। তাই হালকা ধাক্কা দিয়ে ইমার নাম ধরে ডাকতে থাকে।
ইয়াদ উঠে বসে বললো, কী হয়েছে এমন করছো কেনো, খারাপ স্বপ্ন দেখেছো ?
ইমা কাঁপা গলায় বললো, হুম।
ইয়াদ আর কিছু বলার আগেই ইমা বেড থেকে উঠে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। চোখে মুখে পানি পড়তেই আবার স্বপ্নের কথা মনে পরে গেলো আর ভয়ে গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো।
ইমা মনে মনে বললো, একটা সময় তো মনে হতো এই জীবনটার থেকে মরে গিয়ে মুক্তি পেলে ভালো হতো। জীবনটা মূল্যহীন মনে হতো সবসময়। তাহলে আজ এমন একটা স্বপ্ন দেখে ভয় কেনো করছে আমার ? কেনো মনে হচ্ছে আমি বাঁচতে চাই আরো অনেকগুলো বছর বাঁচতে চাই। মাথায় পাকা চুল আর গায়ে কুঁচকানো চামড়া নিয়ে উনার কাঁধে মাথা রেখে পড়ন্ত বিকেলের তেজ বিহীন সূর্যটা দেখতে পায়। জানি আমার এই স্বপ্নগুলো হয়তো কখনো পূরণ হওয়ার নয় তবু দেখতে ভালো লাগে আমার।
ইমা খেয়াল করলো চোখ ভিজে যাচ্ছে নোনাজলে। মুচকি হেঁসে কষ্টগুলো সাইডে রেখে ফ্রেশ হয়ে ওযু করে নিলো। ফজরের আযান শুরু হয়ে গেছে বাইরে। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে ইয়াদ আগের মতোই বেডে বসে আছে।
ইমা ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো, এখন তো অনেকটা সুস্থ মনে হচ্ছে। দু’দিন এক ওয়াক্তের নামাজও পড়েননি, চাইলেই পড়তে পারতেন। আজ অন্তত নামাজ বাদ দিয়েন না।
ইয়াদ ইমার কথা উপেক্ষা করে বললো, তুমি তখন ওরকম করেছিলে কেনো ?
কাবার্ড থেকে জায়নামাজ বের করতে করতে বললো, বাজে স্বপ্ন দেখেছিলাম আর আপনাকে জড়িয়ে ধরেছি ঘুমের ঘোরে। তার জন্য কিন্তু সরি বলবো না কারণ আপনার উপর আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। আর এমনিতেও দোষটা আমার না কারণ আমার যতটুকু মনে আছে আমি ফ্লোরে বসেছিলাম আর ঘুমালে সেখানেই ঘুমিয়েছি। যে বেডে নিয়ে গেছে সব তার দোষ।
ইয়াদ ইমার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালো ইমার দিকে আর ইমা তা আড়চোখে দেখে মুচকি হাঁসলো।
তারপর আবার বললো, তবে স্বপ্নটা সত্যি হলে আপনার হয়তো বেশ ভালো হতো। আমাকে সহ্য করতে হতো না দিনরাত ২৪ ঘণ্টা।
ইয়াদ বুঝতে না পেরে বললো, মানে ?
ইমা জায়নামাজে দাঁড়িয়ে বললো, কিছু না আপনি ওযু করে এসে নামাজে দাঁড়ান সময় চলে যাচ্ছে।
ইয়াদ কিছু না বলে উঠে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো আর ইমা নামাজ শুরু করে দিলো। নামাজ শেষ করে সালাম ফেরানোর সময় পাশে ইয়াদকে নামাজরত অবস্থায় দেখে মুগ্ধ হলো, একদম পবিত্র লাগছে তাকে। নামাজ শেষ করে কোরআন শরিফ বের করে কিছুটা সময় তিলাওয়াত করলো আর ইয়াদ নামাজ শেষে পাশে বসে তিলাওয়াত শুনতে লাগলো। ইমা কোরআন শরিফ বন্ধ করে পাশে তাকিয়ে দেখলো ইয়াদ তার দিকে তাকিয়ে আছে, তাতে ইমা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো, মুচকি হাসলে ইয়াদ কোনো রিয়াকশন না করে উঠে গেলো। ইমা সব গুছিয়ে উল্টো ফিরে দেখে ইয়াদ বেডে শুয়ে পড়েছে আবার। ইমা গিয়ে ইয়াদের কপালে হাত রাখলো জ্বর আছে কিনা দেখার জন্য। ইয়াদ চোখ মেলে তাকালো ইমার দিকে।
ইমা ইয়াদের চোখে চোখ রেখে বললো, জ্বর নেই তাই এখন আর শুয়ে থাকার প্রয়োজন নেই। গার্ডেনে গিয়ে একটু হাটাহাটি করুন, সকালের সতেজ বাতাসে ভালো লাগবে।
ইয়াদ উঠে দাঁড়ালো ইমার কথা শুনে, দরজার কাছে থেমে গিয়ে বললো, ছাঁদে যাচ্ছি পারলে এক কাপ কফি দিয়ে যেও।
ইয়াদ আর না দাঁড়িয়ে চলে গেলো। ইমা বেশ অবাক হলো, ইয়াদ তার এক কথায় সত্যি সত্যি হাঁটতে চলে গেলো। পরক্ষণে ভ্রু কুঁচকে ভাবলো জ্বরের মুখে কফি খাবে পাগল নাকি ? ইমার আর কী করার, চেয়েছে যখন দিতে তো হবেই। ইমা কিচেনে গিয়ে দুকাপ কফি বানিয়ে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো। ছাঁদের গেইটের সামনে আসতেই সকালের স্বপ্নের কথা মনে পরে গেলো। ভয় করতে শুরু করলো ইমার। ভয়ে ভয়ে ছাঁদে পা রাখলো, ইয়াদকে দেখতে না পেয়ে আশেপাশে তাকাতেই ছাদ পুকুরের সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো। ধীর পায়ে কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
ক্ষীণ গলায় বললো, আপনার কফি।
ইয়াদ ইমার দিকে তাকিয়ে ইমার হাত থেকে কফির কাপ নিয়ে এক চুমুক দিলো। মুহুর্তে মুখ কুঁচকে গেলো ইয়াদের। কফিটা অতিরিক্ত মাত্রায় তেতো লাগছে তবে কিছু বললো না। কাপটা ছাদ পুকুরের রেলিঙের উপর রেখে পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়ালো। ইমা ব্যাপারটা খেয়াল করলেও কিছু বললো না।
ইমা ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো, আচ্ছা আপনার দম বন্ধ হয়ে আসে না এভাবে সবসময় চুপ করে থাকতে ?
ইয়াদ স্বাভাবিক ভাবেই তাকালো ইমার দিকে কিন্তু কিছু বললো না। ইমার মাঝে মাঝে খুব রাগ হয় ইয়াদের এমন চুপ করে থাকা দেখে। যেমনটা এখন হচ্ছে। ইমা ইয়াদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ছাঁদ দেখায় মনোযোগ দিলো। আজ ছাঁদটা দেখতে ঠিক তেমনি লাগছে যেমনটা ইমা স্বপ্নে দেখেছিলো। ইমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। ইয়াদ ইমাকে পাশ কাটিয়ে পূর্ব পাশটার দিকে পা বাড়ালো যেটা খোলা। ইমা ইয়াদের হাত টেনে ধরলো পেছন থেকে। ইয়াদের হাত পকেটে থাকার জন্য ইমা হাতের কনুই ধরে রেখেছে। ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে ইমার দিকে ঘুরে তাকালো।
ইমা ভয়ে ভয়ে বললো, ওদিকে কেনো যাচ্ছেন ?
ইয়াদ ভ্রু কুঁচকেই বললো, কেনো ওদিকে কী হয়েছে ?
ইমা আমতা আমতা করে বললো, ওদিকটায় রেলিং নেই তো, যেতে হবে না।
ইয়াদ বিরক্ত হয়ে বললো, আমি কী বাচ্চা রেলিং নেই বলে পরে যাবো ?
ইয়াদ ইমার কথা উপেক্ষা করে ওদিকটায় গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। আজ তিন দিন পর সকালের সতেজ বাতাস আর ভোরের স্নিগ্ধতা গায়ে মেখে বেশ ভালো লাগছে ইয়াদের। রুমে বসে থাকার অভ্যাস নেই তাই আরো বিরক্ত লাগছিলো। গতকাল বের হয়েও ভালো লাগেনি, শরীর দূর্বল থাকায় আরো খারাপ লেগেছে অনেক। তবে আজ অনেকটা ভালো লাগছে। ইয়াদ আড়চোখে পিছনে ফিরে দেখলো ইমা কফির কাপ হাতে নিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে ভয়ের ছাপ, ইয়াদের কপালে চিন্তার ভাজ পরলো ইমার ভীত মুখ দেখে।
ইয়াদ আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, ইমা,,,,
ইমা অনেকটা চমকে উঠলো ইয়াদের ডাকে। ইমার বারবার সকালে স্বপ্নের কথা মনে হচ্ছে।
ইমা থতমত গলায় বললো, কিছু বললেন ?
ইয়াদ দৃষ্টি সামনে রেখেই বললো, এদিকে এসো।
ইমা ভয়ে ভয়ে বললো, ওদিকে কেনো ?
ইয়াদ এবার ভ্রু কুঁচকে ইমার দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি কী ভয় পাচ্ছো এদিকে আসতে ?
সাহস নিয়ে বললো, ভয় কেনো পাবো ? আসছি তো এখনই।
ইমা ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো ইয়াদের দিকে। তবে কার্নিশ থেকে একটু দুরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে বললো, আপনাদের কী টাকা কম পড়েছিলো নাকি ?
ইয়াদ বুঝতে না পেরে বললো, মানে ?
ইমা উঁকি দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বললো, বাড়ি তৈরি করার সময় কী টাকা কম পড়ে গিয়েছিলো ? এপাশে রেলিং দেননি কেনো ?
ইয়াদ বিরক্ত হয়ে বললো, বাড়িটা তৈরি করেছে আমার দাদা তাও আমার জন্মের অনেক আগে। এপাশটা খোলা রাখা হয়েছে দাদার প্রাণ প্রিয় কন্যার কথায়। এখানে নাকি সে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতো সকাল সন্ধ্যা।
শেষের কথাটা বলার সময় ইয়াদের ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফোটে উঠলো। ইমা অবাক হয়ে তাকালো ইয়াদের দিকে। ইয়াদের একটা ফুপিও আছে সেটা আজ জানতে পারলো ইমা। কিন্তু কোথায় ইয়াদের সেই ফুপি।
ইমা কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আপনার ফুপিও আছে ? কিন্তু তার কথা তো কখনো শুনিনি। কোথায় আছে সে এখন ?
ইমার প্রশ্নে ইয়াদ চমকে উঠলো। তখন আনমনে বলে ফেলেছে কিন্তু এখন বুঝতে পারছে কী বলেছে সে। এখনই যে সবটা জানার সময় হয়নি সবার। ইয়াদ উত্তর না দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। ইমাও ঘুরে পা বাড়াতে গেলে পা পিছলে যায় ইমার। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে ইমা, তবে কী স্বপ্নটাই সত্যি হতে চলেছে। ইমার হাতের কফির কাপটা একদম নিচে পরে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেলো।
চলবে,,,,