তুমি অতঃপর তুমিই পর্ব ১৫+১৬

তুমি অতঃপর তুমিই
পর্ব-১৫
Writer -Taniya Sheikh

” এমন সর্বনাশা কাজ তুই করতে পারলি ইমা? এই জন্যে এতো স্বাধীনতা দিয়েছি তোরে? সবার সামনে মুখ দেখানোর উপায়টাও রাখলি না। এমন প্রতিদান দিলি আমার স্নেহের?”

” মা ভুল বুঝতাছ তুমি। একবার আমার কথা তো শোনো।”

” কী শুনাবি আর? বল! এলাকায় তোর মামাদের কতো সম্মান। তুই সব শেষ করে দিলি। আমাদের না জানিয়ে ঐ ছেলের সাথে বিয়ে করে নিয়েছিস। তো যা! আর এই মুখ আমাদের দেখাতে আসিস না৷ যা ঐ ছেলের কাছে। যা!”

বিভা সজোরে ধাক্কা দিতেই ইমা পড়ে যায়। ঠিক তখনই ঘুম ভাঙে ইমার। তড়াক করে বিছানায় বসে। ঘামে ভেজা শরীর কাঁপছে ভয়ে। শ্বাস টানছে জোরে জোরে। শান পাশে হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে কোলে উপর ল্যাপটপে নিয়ে কাজ করছিল। ইমার আতঙ্কিত মুখটা দেখে ল্যাপটপ সাইড টেবিলে সরিয়ে রাখে। ইমার দিকে ঘুরে বসে ইমার মুখটা দু’হাতে তুলে চিন্তিত মুখে বলে,

” কী হয়েছে? ”

” আমি বাসায় যাব।” বসা গলায় জবাব দিল ইমা।

” বিকেলে যেয়ো।”

” না এক্ষুণি যাব।” ইমা শানের হাতের মধ্যে থেকে মুখটা সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়। উদভ্রান্তের মতো এদিক সেদিক ঘুরতে থাকে শুধু। ওকে বিচলিত হতে দেখে শানও বিচলিত হয়। এগিয়ে গিয়ে ইমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মাথার উপর থুতনি রাখে।

” দুঃস্বপ্ন দেখেছ?”

ইমা মুখ নুয়ে ফুপাচ্ছে। শান বাহুধরে মুখোমুখি দাঁড় করাতেই ইমা ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে।

” আমার ভয় করছে। আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন। অনেক শক্ত করে যেন হারিয়ে না যাই। শান আমাকে ছাড়বেন না প্লীজ। আমি ছাড়লেও না।”

শান গভীর বাঁধনে বেঁধে নিল। নিঃশব্দে রইল ওভাবে কিছুক্ষণ ওরা। ধীরে ধীরে ইমা স্বাভাবিক হয়। শান জিজ্ঞেস করলেও দুঃস্বপ্নে কী দেখেছে বলে না। দ্বিতীয় জিজ্ঞেস করে নি শান। হাসি মুখে ইমার সাথে খুনশুটিতে মেতে ওঠে। অবশেষে ইমার মনটা ভালো হয় আগের মতো। আরও কিছুসময় একান্তে কাটিয়ে বিকেলে ইমা একাই চলে যায়। শান বাঁধা দেয় নি এবার। ইমা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর শানের মোবাইলে মোবারকের কল আসে। বেচারা কাঁদছে রীতিমত। তার স্ত্রী’র অবস্থা আশংকা জনক। সিজার করতে গিয়ে সমস্যা হয়েছে। শান মোবারককে অভয় দিতে দিতে তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেল কুমিল্লার উদ্দেশ্যে। তাকে এখন প্রয়োজন মোবারকের। গাড়িতে উঠে কয়েকবার কল করলেও ইমাকে পাওয়া গেল না। শেষে বার্তা পাঠিয়ে রওনা হলো সে।

ইমা বাড়িতে এলো ভয়ে ভয়ে। যদিও সেটা কারো সামনে প্রকাশ পেল না। ভেবেছিল আজও মায়ের প্রশ্নের সম্মুখীন হবে কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। তার মা ব্যস্ত রান্নাঘরে। রান্নার জমজমাট আয়োজন চলছে দুই মামির রান্নাঘরে। তার মায়ের স্পেশাল তেহারির সুবাস নাকে লাগতেই ইমা ভ্রুকুটি করে। এই পদটা মা এখন তেমন একটা রান্না করে না। আজ রান্না কেন করছে তবে? অদূরে সমবয়সীদের সাথে খেলতে থাকা সাজ্জাদ কে ইশারায় কাছে ডাকে ইমা। সাজ্জাদ দাঁত বের করে হাসতে হাসতে খেলা রেখেই ছুটে আসে। সাজ্জাদের কাঁধে হাত রেখে এগিয়ে মায়ের রুমে গিয়ে বসে ইমা।

” বাড়িতে এতো রান্না বান্না কিসের জন্যে রে?” ইমা বললো।

” ইরাপুকে দেখতে আসবে তাই।” সাজ্জাদের কথা শুনে কপাল কুঁচকে যায় ইমার।

” কী বলছিস? হঠাৎ! ”

” হ্যাঁ! কাল রাতে ছোট কাকা আব্বাকে বলছে। তুমি তো রুমে ছিলা তাই জানো না।”

” ইরা কই?”

” রুমে। কান্দে।”

” কেন? ”

” সে এখন বিয়ে করবে না।”

” ওহ! আচ্ছা তুই যা আমি দেখছি ওকে।” সাজ্জাদ রুম ছেড়ে বেরোনোর পর ইমা নিজের রুমে গিয়ে গোসল সেড়ে কাপড় পাল্টে নিল। ভেজা চুল তোয়ালেতে পেঁচিয়ে এলো ইরার রুমে। ইরা তখনও কাঁদছিল নিরবে। পাশে বসতেই ইমাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কাঁদতে লাগল।

” দেখলেই কী বিয়ে হয়ে যাবে নাকি? কতোবারই তো এলো গেলো। বিয়ে হইছিল কী?”

ইরার মাথায় হাত রাখল ইমা। ইরা ওভাবেই বসে বললো,

” তুমি জানো না,এবার সত্যিই হয়ে যাবে। ছেলে নাকি নিজে পছন্দ করেছে আমাকে। পরিবারকেও রাজি করাইছে, হয়ত আজই ওরা আকদ করে যাবে।”

” আরে যাহ! বলছে তোকে?”

ইমা ঠেলে সরিয়ে সোজাসুজি বসায় ইরাকে। ইরা অশ্রুসিক্ত মুখে টেনে টেনে বলে,

” সত্যি বলছি। আব্বু বড় চাচাকে তাই বলছে সকালে। আপু আমি বিয়ে করব না।”

ফের জড়িয়ে ধরে কাঁদছে ইরা।

” মোর জ্বালা! আরে সোজা ব।” ইরাকে মুখোমুখি ধরে ইমা বলে,

” আসুক তো আগে তারপর দেখছি কী করা যায়। ছেলে ভালো হলে বিয়ে করতে সমস্যা কোথায়?”

” না আমি বিয়ে করব না।” ইরা মাথা নাড়িয়ে বলে

” একেবারেই না!” চোখ ছোট করে ফেলে ইমা। ইরা মুখ নামিয়ে নিচু স্বরে বলে,

” আপাতত না। তুমি আব্বুরে বলো।”

” আগে ছেলে দেখি তারপর। ছেলে যদি আমারও পছন্দ হয় তবে বিয়ে ফাইনাল।”

” আপু!”

” আরে মজা করলাম৷ আসতে দে জ্বামাই বাবাজিকে, তারপর দেখছি কী করা যায়। চোখ মোছ। অ্যা! এমনে কানতাছোস যেন এক্ষণি তোর বিয়া হইয়্যা যাইতাছে। চোখ মোছ ছেরি।” ইমার ধমকে ইরা চোখ মোছে। তবে বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তা তার মনে রয়েই যায়।

” ভাত খেয়েছিস দুপুরে?”

ইরা মাথা নাড়ায় সে খায় নি। ইমা মুখটা কুঁচকে বললো,

” হাত মুখ ধুয়ে আয়। আমি ততোক্ষণে খাবার নিয়ে আসতাছি।”

ইরা উঠল না দেখে টেনে, ঠেলে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে খাবার আনতে গেল ইমা। রান্নাঘরে ঢুকতেই মা’কে দেখল সে। ভীরু চাহনিতে মা’কে দেখতে দেখতে খাবার বাড়ছে ইমা।

” ইরাকে সন্ধ্যায় দেখতে আসবে। বোনকে তৈরি করে নিজেও পরিপাটি থেকো একটু।”

খুব বেশি অভিমান করলে “তুমি, তুমি”করে ইমার মা। ইমার তখন মনে হয় মা যেন পর করতে চাইছে তাকে। কষ্ট হয় খুব৷ মেয়েকে চুপচাপ দেখে বিভার মলিন মুখ আরও মলিন হয়ে গেল। পাশ কাটিয়ে হেঁটে যেতেই আচমকা ইমা দু’হাতে জড়িয়ে ধরে তাকে।

” আমাকে ক্ষমা করো মা। আমি আর তোমার সাথে ওমন করব না।”

ধড়া গলায় বলে ইমা৷ বিভা শান্ত স্বরে বলে,

” তুই সবসময়ই বলিস এই কথা। তারপর ঠিকই ওমন করিস।”

” আর করব না। সত্যি বলছি।”

” হয়েছে ছাড় এবার।”

” না।”

” ইমা ছেলেমানুষী করিস না ছাড়। বহুকাজ পড়ে আছে।”

” না। আগে আমার কথা শোনো তারপর।”

বিভা ঘুরে দাঁড়িয়ে মেয়েকে বুকের টেনে নেয়। মায়ের বুকে মাথা রেখে ইমা আদুরে গলায় ফের বলে,

” তোমাকে একটা কথা বলার ছিল। তার আগে কথা দাও রাগ করবা না।”

আজ বহুবছর পর ইমা এমন করে কথা বলছে মায়ের সাথে। বিভার মন ভরে যায় মেয়ের আহ্লাদিত গলা শুনে৷ সাথে সাথে কিছু ভাবনা ভাবায় তাকে। মা’কে চিন্তিত দেখে ইমা “মা” বলে ডাকে। বিভা বলে,

” বল কী বলবি।”

” তুমি রাগ করবা না তো? ছুঁয়ে কও আমারে।”

” আচ্ছা ঠিক আছে। বল।” ইমা কিছু বলবে তার আগেই বাইরে সাবিহা চেঁচিয়ে বিভাকে ডাকল। সাবিহার ডাক শুনে মেয়েকে টেনে ছাড়িয়ে বলে,

” হায়রে আমার তো মনেই ছিল না চুলায় মাছ দিয়ে আসছি। মন খারাপ করিস না সোনা মা আমার। রাতে মা তোর সব কথা শুনবে।”

মেয়ের গালে চুমু দিয়ে দ্রুত পায়ে সাবিহার রান্নাঘরের দিকে ছোটে বিভা। ইমা বিক্ষিপ্ত মনে দাঁড়িয়ে রয়। সে মা’কে বলতে বাঁধা পেল কেন? এসব কী ভালো কিছুর সংকেত নাকি তার কুসংস্কার। ইমার বিক্ষিপ্ত ভাবনার অবসান হয় হাতের মোবাইল জ্বলে ওঠায়। শান কল করেছে। ইমার ঠোঁটে সহসায় হাসি ফুঁটে ওঠে। মনটাও ভালো হয়ে যায় শানের গলা শুনে।

” এখন কিছু বললে বলবা আমি কাইষ্টা। তাই তো বলো তাই না?”

শানের কথার ঝাজে ভ্রু কুঁচকে ফেলে ইমা। গাল ফুলিয়ে বলে,

” আবার কী করছি?”

” মোবাইল কেন চালাও তুমি? তুমি যাওয়ার একঘণ্টা পর থেকে এ পর্যন্ত পঞ্চাশ টার মতো কল করেছি। এসএমএস কয়টা দিছি জানো? ছিলে কোথায় এতোক্ষণ? ”

শানের ধমকে মোবাইলটা কান থেকে সামনে এনে জিহ্বা কামড়ায় চোখ বন্ধ করে। শান কঠিন গলায় বললো,

” খালি জিহ্বায় কামড়াবা। অকাজের ঢেঁকি একটা।”

” এই দেখেন।”

” ভিডিও কল দেব।” শানের হাসির শব্দে ইমা স্বস্তি পায়। মুচকি হেঁসে বলে,

” বদ একটা। আমি কী তাই বলছি? মোবাইল সাইলেন্ট করা ছিল। এসে গোসল করছি, ইরাকে সামলে মা’কে আমাদের কথা বলতে যাচ্ছিলাম।”

শানের নড়াচড়া শব্দ পেয়ে থামল ইমা। শান অস্থির হয়ে বললো,

” বলেছ? ”

” না!”

” কেন?” শানের হতাশ গলার স্বর শুনে ইমারও খারাপ লাগল। নিচু গলায় বললো,

” রাতে পাক্কা বলব।”

” সত্যি? ”

” হুম।” প্রসঙ্গ পাল্টাতে ইমা বলল,”আপনি এতোবার কল কেন করেছিলেন তাই বলেন।”

” ওহ! হ্যাঁ। তুমি যাওয়ার পরই মোবারককে কল করেছিলাম। ওর স্ত্রীর সিজারে বাচ্চা হয়েছে। বাচ্চা আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ আছে। তবে মোবারকের স্ত্রীর সিজার পরবর্তী জটিলতা ধরা পড়েছে। বেচারা মোবারক একা ওখানে। আমার সাপোর্ট এই মুহূর্তে খুব প্রয়োজন ওর।”

” আপনি কোথায় এখন?”

” কুমিল্লার পথে। আগামী দুই একদিনে ফিরে আসব ইনশাআল্লাহ। চিন্তা করো না।”

” সাবধানে যাবেন। পৌঁছে কল করবেন কিন্তু। আল্লাহ পাক মোবারকের স্ত্রীর উপর থেকে বালা মুসিবত দূর করে দিন। দ্রুত সুস্থতা কামনা করি তার।”

” আমিন। একটা কথা বলি?”

” হুমম!”

“এতো সুন্দর করে যখন কথা বলো তখন,,!”

” হ্যাঁ! হ্যাঁ! ” শানকে থামানোয় বিরক্ত হয় শান। বলে,

” কথা শেষ করতে দাও।”

” আর কথা শেষ করতে হবে না। বেশি রোমাঞ্চ স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর। আমি এখন ইরাকে খাওয়াব বাই। টা টা।” শানের নিষেধ অমান্য করে ইমা ব্যঙ্গাত্মক হেঁসে কল কেটে দেয়। শান মুচকি হেঁসে মোবাইল পাশে রেখে আবার ড্রাইভ শুরু করে। আর এদিকে ইমার লজ্জা রাঙা হাসি সহজে কমতে চায় না। কিছুদিনের পরিচয়ে শান তার জীবনের অংশবিশেষ হয়ে গেছে। সুখের আরেক নাম শান। ইমার ম্লান জীবন ভালোবাসার রঙে, রসে ভরিয়ে তুলেছে শান৷ ছন্দপতন জীবনে আবার ফিরে এসেছে ছন্দ। জীবন কতো সুন্দর তাই না!
তুমি অতঃপর তুমিই
পর্ব-১৬
#Taniya Sheikh

মাগরিবের পরপরই ছেলেপক্ষ ইরাকে দেখতে এলো। গৌরবর্ণ, লম্বাটে মোটকথা সুদর্শন ইরার হবু বরটি। হবু জামাতাকে ইমার মামার পরিবারের সবার পছন্দ হলো। ছেলের ঐটুকু আচার ব্যবহার দেখে তারা যে, রীতিমতো মুগ্ধ। তা তাদের চোখের উজ্জ্বলতায় প্রকাশ পাচ্ছে। ইরাকে আগে থেকেই পছন্দ ছিল ছেলেপক্ষের। সুতরাং দু’পক্ষের কথাবার্তা আকদের সিদ্ধান্তে গিয়ে ঠেকল। ইরা একটিবারও ছেলের দিকে তাকাল না। মুখ ফুলিয়ে রইল অবগুন্ঠনের আড়ালে। ছেলেটা অবশ্য মাঝেসাঝে চোখের কোনা দিয়ে দেখল ওকে। ছেলের বাবা, দুলাভাই দু’জন, বড় বোন এবং কিছু আশেপাশের আত্মীয় স্বজনকে আনা হয়েছে আকদ উপলক্ষে। ইরা রুমে আসতেই বিছানার উপর হুমড়ে পড়ে কাঁদছে। তার মনে কালবৈশাখীর ঘন কালো মেঘ জমেছে। ঝড়ের মাত্রা কতোটুকু কেবল সেই জানে।

ইমা চুপিচুপি এলো ইরার রুমে। বোনের কান্না দেখে ইমার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। পরের লোকের অন্যায় যত সহজে দমন করা যায়, আপন লোকের বেলায় তত সহজ হয় না। ইমা গিয়েছিল মামির কাছে। তার পুরো কথা শোনার আগেই ইরার মায়ের তিরিক্ষি মেজাজের কোপানলে পড়তে হয়। পুরো বাড়ি মাথায় তুলেছিল সামান্য এক কথাকে কেন্দ্র করে। শেষে মামাদের মধ্যস্থতায় সে যাত্রায় পরিস্থিতি শান্ত হয়। মায়ের কাছে মার না খেলেও ধমক খুব খেয়েছে ইমা। তারপর থেকেই মায়ের সাথে কথা বন্ধ ওর একপ্রকার। ক্রন্দনরত বোনটির শিওরে বসে মাথায় হাত রাখল ইমা। ইরা মুখ তুলে বোনের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল,

” আপু আমি বিয়ে করব না।”

ইমা নিচু গলায় বললো,
” আমি কী করব বল? দেখলি তো কেমন করছে সবাই। কাছেও ঘেঁষতে দিচ্ছে না তোর।”

ইরা অসহায়ের মতো চেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। অভিমানি গলায় বললো,

” সবার জন্য সব পারো কেবল আমার বেলায় কিছুই পারো না। চলে যাও আমার সামনে থেকে। যাও।”

ইরার কথায় যতোটা না কষ্ট পেল। তারচেয়ে দ্বিগুণ রাগ জমলো নিজের উপর। আসলেই তো! এমন দমে যাওয়ার মেয়ে তো সে নয়। তবে কী হলো তার সাহসের!

” তুই আবার আমার মেয়ের রুমে আইছোস?”

মেয়ের জন্য আনা কাপড়ের ব্যাগ বিছানার উপর ছুঁড়ে চেঁচিয়ে উঠল ইরার মা। তার হুশজ্ঞান রইল না কোনোদিক। রাগে চোখ দু’টো জ্বলছে। সাবিহা ততক্ষণে ছুটে এসেছে। ইমার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছোট জা’কে ধমকের সুরে বললো,

” মাথা খারাপ হইছে তোর? বাড়িভর্তি মেহমান আর তুই কী’না গলা ফাটাইতাচ্ছোস। হেরা শুনলে কী কইব?”

” চিল্লামু না কী করমু। অলক্ষি ঘুরতাছে দেহো না। এই ছেরি আমার মাইয়্যার কপালের সুখ নষ্ট করতে উইঠা পইড়া লাগছে। ও ভাবি, ভাবি গো! আমার ইরার কপালে সুখ ওর সহ্য হচ্ছে না। কিছু করো নয়ত এ বিয়ে ও হইতেই দিতো না।”
ইরার মা পারে না কেঁদে ফেলতে। সাবিহা ছোট জা’র কাঁধে হাত রেখে ইমার দিকে তাকিয়ে বললো,

” তুই শান্তি দ্যাস না ক্যান আমাগো? তোরে কইছি ইরার আশেপাশে ঘুরিস না। তাও কিসের জন্য ঘুরঘুর করতাছোস? নির্লজ্জ, বেয়াহায় কোনহানকার। যা নয়ত লাথি দিয়া বাইর করুম।”

ইমাকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে ইরার রুম থেকে বের করে দিল ওরা। ইমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায়। তর্জনী তুলে দুই মামিকে বললো,

” অতিরিক্ত হচ্ছে মামি। আমি শুধু বলছি ইরার মর্জির বাইরে বিয়ে দিয়েন না। এর বেশি কিছু কী বলছি বলেন?”

ইরার মা ব্যঙ্গ করে বললো,
” আহা! কী রঙের কথা। মেয়ে আমার। মেয়ের জন্যে কী ভালা না মন্দ সেটাও আমিই দেখুম। তুই এরমধ্যে নাক গলাতে আইছোস কেন? ইরার মর্জি বাইরে যাইয়েন না। তোর মা’র মতো মাইয়্যার কথায় উঠমু বসমু নাকি? রাত বিরাত ঘরের বাইরে কাটাইতে শিখামু মাইয়্যারে। তুই কী করোস না করোস বুঝিনা ভাবছোস।”

বিভা আজ আর প্রতিবাদ না করে পারল না। তাতে যেন আরও চটল দু’জা। মা’মেয়েকে কথার আঘাতে আঘাতে নির্বাক করে ছাড়ল। বিভা কেঁদে ফেলল ভাবিদের কটুকথার আঘাতে। মেয়ের হাত ধরে দোতলায় উঠে এলো। মেয়ে সহ ঘরবন্দী রইল আকদের শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত৷ রাগে শরীর জ্বলতে লাগল ইমার। মামিদের তিক্ত কথা বিষের ছুরি হয়ে বিঁধে আছে তার বুকে। না পারছে সহ্য করতে আর না পারছে জবাব দিতে সে। মায়ের কথায় আজও তাকে নিরবে মুখ বুঝে থাকতে হলো। বাইরে গাড়ি শব্দ শুনে বুঝল বরপক্ষ চলে যাচ্ছে। ইরার কান্নাসিক্ত মুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। শানকে মনে পড়ল ইমার। শান পাশে থাকলে আজ হয়ত কিছু করতে পারত ইরার জন্য। কিন্তু মা’কেই তো এখনও বলা হলো তা শানের কথা। ইমা কয়েকবার ডাকল মা’কে। বিভা ঘুমের ওষুধ খেয়েছে। গভীর নিদ্রা তার ভাঙল না ইমার দু’একবার ডাকা স্বত্বেও।

সবাই ঘুমিয়ে পড়লে মোবাইল হাতে নিয়ে ছাঁদে এলো ইমা। আকাশে তারার মেলা। ইমা চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিল। এই আধুনিকায়নের ছোঁয়ায় কিছুটা ম্লান আশেপাশের আঁধার। এই রাতের নিস্তব্ধতার মাঝে মনটা আপনাআপনিই শান্ত হলো। হাতের মোবাইল অন করে প্রিয় মানুষটিকে কল করল সে। রিং কেটে দিয়ে রিং করে শান। কল রিসিভ করতেই ও’পাশ থেকে শানের গলার শব্দ শুনে ইমার জমে থাকা কান্নার জল বাঁধ ভাঙে।

” কী হয়েছে ইমা। এ্যাই!” ও পাশের কন্ঠস্বরটি আতঙ্কিত শোনাল। ইমা নিজেকে সামলে একে একে সব বললো শানকে। শান কিছুসময় কথা বললো না। দু’জন মোবাইলের দু’পাশে চুপ করে রইল। যেন এরাও এই নিস্তব্ধ আঁধারে মিশে গেছে। ইমা জানে শান রেগে আছে। ইমার হঠাৎ মনে হলো এ সময় এ’কথা না জানালেই ঠিক ছিল। এমনিতেই মোবারকের বিষয়টা নিয়ে শান চিন্তিত। মোবারকের কথা মনে পড়তেই ইমা চোখ মুছে বললো,

” মোবারকের বউটার অবস্থা কী?”

ওপাশে একদম নিরবতা। ইমা ঢোক গিলল। গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বললো,

” শান, কথা বলছেন না কেন?”

” আচ্ছা তোমার কী মনে হয় আমাকে? আপন মনে করো তো না তাই না?” উচু গলায় বললো শান। ইমা বিষন্ন মুখে বললো,

” কী বলছেন এসব?”

দাঁতে দাঁত চেঁপে শান রাগত স্বরে বললো,

” কী বলছি বোঝো না। ওরা তোমাকে এতো অপমান করার পরও কেন ওখানে আছ? এক্ষুণি চলে আসো আমার ফ্লাটে।”

ইমা বললো,

” শান প্লীজ! একটু শান্ত হোন। আমি মা’কে বলতে পারি নি আমাদের কথা৷”

শান রাগ ধরে রেখেই জবাব দিল,
” তোমার দরকার নেই সেটা করার আর। তুমি যে কী পারবে! আমার জানা হয়ে গেছে। আমি আগামী কালই আসছি। তারপর, যা বলার, করার আমিই করব। থাকো তুমি চুপ করে।

” মোবারকের বউ!’

ইমার কথায় শান আবার চুপ হয়ে যায়। ইমা ফের প্রশ্ন করায় বড়সড় ধমক খেয়ে মুখ ফুলিয়ে কল কেটে দিল। সেকেন্ড অতিবাহিত না হতেই শান কল করে। ইমা দুইবার কল ড্রপের পর রিসিভ করতেই শান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

” আ’ম সরি বউ।”

” আর সরি বলতে হবে না। ধমক দেন।” অভিমানে গলা কাঁপছে ইমা। শান মৃদু হেঁসে বললো,

” ধমক খাওয়ার কাজ করো কেন তাহলে?”

” সেধে কী করি? মেয়েলোকের জীবন আপনাদের মতো স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড হয় না। এবড়োথেবড়ো, কাঁটাবিছানো। যতোই আমি সাহসী, তেজি হই তবুও আমাকে নত হতে হয় পরিবারের সামনে। কেন হতে হয় জানেন? কারন আমি মেয়ে। আমার সিদ্ধান্ত নাকি আমারই মতো দূর্বল। যেখানে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না নারী, সেখানে অধিকার আর স্বাধীনতা কতোটা ঠুনকো তাদের জন্য ভাবুন।” ইমার গলা ধড়ে আসল। শান বললো

” আমি এখনই রওনা দিচ্ছি। ”

” না!” নড়েচড়ে দাঁড়াল ইমা। শান বিরক্ত গলায় ঢেলে বললো,

” না কেন?”

” আপনি আগে ঐদিকটা সামলে আসুন প্লীজ।”

” আর তুমি? তোমার প্রয়োজন নেই আমাকে?”

” সবচেয়ে বেশি আপনাকে আমার প্রয়োজন তবুও বলছি মোবারককে একা রেখে আসবেন না। ওর পাশে আপনার দরকারটা বেশি।”

” বেশি নীতিকথা ঝাড়বা না। আমি আসছি এটাই ফাইনাল।”

” শান, আপনি আমার কথা শুনবেন না?”

” তুমি শোনো আমার কথা।”

দু’জনই চুপ হয়ে গেল আবার। শান শব্দ করে শ্বাস ছেড়ে বললো,

” ওকে ফাইন। এদিকটা সামলে তবেই আসব কিন্তু তারজন্য আগামীকালই যথেষ্ট। পরশু ফিরছি আমি।”

ইমা প্রত্যুত্তর করে না। শান পুনরায় বললো,

” তুমি একটা নিষ্ঠুর মেয়েলোক। আমার প্রতি টান তোমার নেই বললেই চলে।”

” হ্যাঁ, আপনাকে বলেছে।”

” বলেইছে তো।”

ইমা ঠোঁট টিপে বলে,
” আপনার মাথা বলেছে।”

” আমার মাথা তাই না?”

শানের কথায় ইমা ফিক করে হেঁসে ওঠে। শান বলে,

“আহ! এতোক্ষণে হৃদয়টা ঠান্ডা হলো। ইমা,”

” হুম।”

” ইমা,” শান টেনে বললো।

” বলেন। ” লজ্জায় লাল হয়ে মুখ নুয়ে জবাব দিল ইমা।

” আচ্ছা তোমার সামনের দাঁতটা ব্যাকা কেন? ”

ইমা রাগে ফুঁসতে লাগল। বুঝতে পেরে হোঁ হোঁ করে হেঁসে ওঠে শান। ইমার ইচ্ছা করছে মোবাইলের মধ্যে গিয়ে শানের মুখ চেপে ধরতে। দাঁত কামড়ে চাপা স্বরে বললো,

” বদের বদ! আর কথায় বলব না আপনার সাথে। সামনে পায় এর শোধ না নিছি, দেইখেন খালি।”

ওপাশে শুধু হাসির শব্দ শুনতে পেল ইমা। গাল ফুলিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,

” হাসি থামাবেন নাকি ছাঁদ থেকে লাফ দিব।”

” এক লাফে আমার কাছে আসতে পারলে দাও। নয়ত থাক।”

” পাঁজির পা ঝাড়া আপনি একটা। কথা নেই আপনার সাথে যান।”

ইমা কল কাটতেই কল করে শান। এভাবে খুনশুটিতে দুজনে রাত পার করল। সকালের সূর্য ওঠা এই প্রথম অবলোকন করে ইমা। মিষ্টি একটা সকাল,অথচ দিন গড়াতেই কেমন রুক্ষ, উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শানকে বুঝিয়ে মোবাইলে কথা শেষ করে নিচে নেমে এলো ইমা। কেউ দেখার আগে সোজা রুমে গিয়ে মায়ের পাশে শুয়ে পড়ে।

চলবে,,,
চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here