তুমি আমার পর্ব -০৯+১০

#তুমি_আমার
#পর্ব_০৯
#লেখনীতে_নাজিফা_সিরাত

রং বেরঙের বাতি আর কালারিং কাপড় দিয়ে সেজেছে খান বাড়ির পুরো ছাদ।আবিদ পরেছে মেরুন রঙের পাঞ্জাবী।আরু রিয়া আর আয়েশা পরেছে কচু পাতা রঙের শাড়ি।সবাইকে বেশ লাগছে আজ।সিরাত গাপটি মেরে এক কোণে বসে আছে।সকলে আবিদ কে রঙ মাখাচ্ছে এগুলো দেখছে।সিরাতের পাশ ঘেঁষে এসে বসলো আয়ান।চোখ নাচিয়ে বলল,

-‘কি মনু মন খারাপ’?সিরাত মাথা ঝাকিয়ে না জানালো।মৃদু হেসে বলল,’তাহলে শরীর খারাপ।লাগছে’?এবারও না জানালো সে।’তাহলে বফ ছ্যাঁকা দিছে নাকি তোরও বিয়ের শখ জেগেছে’?কথাটা শোনে চোখ গরম করে তাকালো সিরাত।আয়ান বএিশ পাটি দাঁত বের করে বললো,

-‘রাগ করছিস কেন মজা করছিলাম।তুই সবকিছুতে না বলছিস তাই’।ওর কথার পিঠে কোনোকথা বলতে ইচ্ছে করলো না তার।আজ চুপ থাকতে বড্ড ভালো লাগছে।আবেশ ক্যামেরা হাতে সকলের ছবি তুলতে ব্যস্ত।সিরাত মাঝেমধ্যে ওকে আড়চোখে দেখছে।আরু আর আয়েশা সেল্ফি তুলছে মনের সুখে।কিছুক্ষণ পর পর এসে সিরাতের খবর নিচ্ছে।সকলে হলুদ নিয়ে মাতামাতি করছে।একে অপরকে রাঙিয়ে দিচ্ছে।আবেশ সেগুলো দেখছে আর সুন্দর মূহুর্ত গুলোর ক্যামেরা বন্দি করছে।সিরাতের এখন খুব বিচ্ছিরি একটা ইচ্ছে জেগেছে মনে।এই মুহূর্তে আবেশকে হলুদের মধ্যে চুবিয়ে মারতে।তাহলে হয়তো মনের রাগ কিছুটা কমতো তার।

একগাদা হলুদ নিয়ে সিরাতের সামনে দাঁড়ালো রিয়া।সেগুলো দেখে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো সিরাত।ফোকলা দাঁতের হাসি দিয়ে বলল,

-‘দোস্ত ল্যাংড়া হয়ে বসে আছিস বলে কি ভেবেছিস তোকে কেউ হলুদ দেবে না।তোর তো আফসোস হয় নাকি।একদম ভাবিস না দোস্ত আমি থাকতে তোর কোনো আফসোস থাকতে দিবো না’।সকলে উৎসুকভাবে তাকিয়ে আছে রিয়ার দিকে আর হাসছে।তখনই কোথা থেকে ঝড়ের বেগে এসে রিয়ার হাত চেপে ধরলো সিয়াম।সিয়ামকে দেখে রেগে গেলো রিয়া।রেগে কর্কশ কন্ঠে বলে,

-‘আপনার সাহস তো কম নয় আপনি কোন সাহসে আমার হাত ধরেছেন?ছ্যাঁচড়া কোথাকার এখানেও আমাকে ফলো করতে করতে চলে এসেছেন’?হাত মোচড়াতে মোচড়াতে সিয়াম বলল,

-‘সাহসটা বরাবরই আমারর বেশি।তোমার মত ঝগড়ুটে কে ফলো করবো আমি।এ্যাহ আমার এখনও এত খারাপ দিন আসে নি।তুমি ওকে হলুদ দিতে পারবে না’।

-‘ফালতু কথা না বকে আমার হাত ছাড়ুন।আমার বন্ধুকে আমি হলুদ লাগাব তাতে বাধা দেওয়ার আপনি কে’?পাশ থেকে সিরাত বলল,

-‘রিয়া তুই ভুল বুঝছিস আমার কথাটা শোন।ঝগড়া করিস না।উনি হ….সিরাতকে থামিয়ে বলল ‘তুই থাম আমাকে কথা বলতে দে’!

-‘অনেককিছু।কিছুতেই ওর গায়ে হলুদ দিতে পারবে না তুমি’!একটু চেঁচিয়ে রিয়া বলল, ‘কিহ্!কেন’?

-‘কারণ আমি চাই না ওর তাড়াতাড়ি বিয়ে হোক।আমি শুনেছি বিয়ের হলুদ আবিয়াওা মেয়ের উপর লাগলে তার তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যায়’।

-‘ওর বিয়ে হলে আপনার কি’?মৃদু হেসে ওর হাত ছেড়ে সিরাতের দিকে তাকিয়ে বলল,’অনেক কিছু।কারণ ওটা আমার কলিজার টুকরো আর আমার কলিজা আমাকে এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে যাক আমি চাই না’।

ওদের কথা শুনে সকলে হতভম্ব।আবেশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে।বন্ধুর সাথে তাঁর ছাএী ঝগড়া করছে বেশ দারুন।কিন্তু রিয়া কি ওকে চেনে না নাকি?সিরাত কি বলবে কিভাবে বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।আবার রিয়া বলার সুযোগও দিচ্ছে না।আবেশ একটু কাছে গিয়ে বলল,

-‘কি হয়েছে রিয়া’?রিয়া অভিযোগের সুরে বলল,

-‘দেখুন না স্যার এই লোকটা সেদিন রাস্তায় আমার সাথে অসভ্যতামি করেছে তারপর জুয়েলারি শপে ইচ্ছে করে আমার জিনিস নিয়ে নিয়েছে আর এখন তো দেখলেনই’।

-‘সিয়াম এটা কিন্তু তুই ঠিক করছিস না।তুই আমার ছাএীকে ইভটিজিং করছিস।রাস্তায় শপিংমল আবার এখানেও ছি ছি’।বলে মুখ চেপে হাসছে আবেশ।সিয়াম ওর পিঠে চাপড় দিয়ে বলল,

-‘তুইও মজা নিচ্ছিস শালা।বোনটা ত খাঁটি হারামি এখন দেখছি তুই তার থেকেও বড় হারামি’।বলে ওখান থেকে চলে গেলো।এখানে থাকলে ওর মান সম্মান আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।তাছাড়া আজ বোনের উপরও খুব রাগ লাগছে তাঁর।ভাইয়া ভাইয়া কয়েকবার পেছন ডেকেও কোনো লাভ হলো না সিরাতের।এখন নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে।কেন সেদিন এরকম করেছিল কে জানে।সকলেই বিষয়টা জানার জন্য অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।তারপর সিরাত রিয়াকে পুরোটা খুলে বলায় সকলের কাছে বিষয়টা ক্লিয়ার।রিয়া নিজের কাছে নিজেই এখন লজ্জিত।সিরাতের সবকয়টা বান্ধবী কত সম্মান করে তাকে আর সে কিনা না জেনে কত কি উপাধি দিয়ে বসে আছে।আবেশ টিটকারির সুরে বলল,

-‘কারও বোনও এমন দুশমন হয় জানা ছিল না তো!এই তোমাকে দেখে নতুন নতুন অনেক কিছু জানতে পারছি’।

ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছে সিরাত।আকাশের উজ্জ্বল তারার মাঝখানে ওই তালার মত চাঁদটাকে দেখছে।কি আকর্ষণীয় আর মায়াবী লাগছে।এই দৃশ্য দেখাতেই মগ্ন সে।এখন বরের হাতে মেহেদী দেওয়া হচ্ছে।সকলে বিজি ও মেহেদী দেবে না বলে এক রকম পণ করে বসে আছে।কেউ জোর করেও ওর সাথে পারে নি।তবে আরু বলে গেছে ঘুমের মধ্যে হলেও ওকে মেহেদী পরিয়ে ছাড়বে ও।আবেশ ওকে এক পাশে দাঁড়াতে দেখে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

-‘এখানে একা একা দাঁড়িয়ে আছো কেন? পায়ে ব্যাথা করছে না’?আবেশের দিকে একবার তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সিরাত মনে মনে বলল,

-‘মনের ব্যাথায় দিন রাত কাতরাতে থাকি সেটা চোখে পরে না আর এখন এসেছেন পায়ের ব্যাথার খবর নিতে’।

-‘কি হলো কিছু বললে না ত’?মৃদু হেসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ মনে বলল,

-‘গতকাল আমাকে বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ।আমার জন্য আপনার এই অবস্থায় পরতে হলো।অহেতুক ঝামেলায় পরে শুধু শুধু নিজের ক্ষতি করলেন এতটা রিস্ক না নিলেও পারতেন।পুলিশ ছিল তারা খুঁজে পেলে পেত নাহলে…. চোখ বন্ধ করে সেই মুহূর্ত মনে হতেই সাড়া শরীর কেঁপে উঠলো ওর।শুকনো গলা ভিজিয়ে আবার বলল,’তখন ভয়ে আমি কি করেছি নিজেই জানি না।হয়তো এমন অনেককিছুই ঘটেছে যেগুলো করা উচিৎ হয় নি।কি করবো বলুন তখন আমার কাছে ভাল মন্দের হিতাহিত জ্ঞান ছিলো না।আমি হেল্পলেস ছিলাম।সরি!সবকিছুর জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন’।আবেশ গম্ভীর মুখে পুরো কথা মনযোগ দিয়ে শুনলো।ফুস করে একটা শ্বাস ছেড়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল,

-‘ওসবের জন্য তোমাকে ক্ষমা চাইতে হবে না।সেটা আমিও জানি তোমার ইচ্ছাকৃত ভুল ছিল না।জেনে বুঝে করো নি।পরিস্থিতি টাই ভয়াবহ ছিল।আর কি বললে পুলিশ!নইলে যা হওয়ার হতো।কথাটা দারুন এটাই তোমার কাছ থেকে আশা করা যায়।এজন্যই তোমাকে সবাই ছোট বলে।তবে যাই বলো তুমি আমাদের বাসায় ছিলে সে অনুযায়ী তোমাকে সেইফ রাখা আমাদের দায়িত্ব ছিল কিন্তু পারিনি।যদি তোমার কিছু হয়ে যেতো তাহলে সিয়ামের কাছে ছোট হয়ে যেতাম নিজেকে কোনোদিনও ক্ষমা করতে পারতাম না’।

আবারও দায়িত্বের বেড়াজাল।চোখ দুটো পানিতে ভিজে যাচ্ছে কিন্তু সেগুলো কে গড়িয়ে পরতে দিলো না সিরাত অতি সন্তর্পনে আড়াল করে নিলো।আবেশ কিছুক্ষণেই উধাও হয়ে গেলো।পেছনে আর তাঁকে দেখা গেলো না।কেন আজ মনটা এত বিষণ্ণ নিজেরই জানা নেই সিরাতের।ও তো জানে আবেশ ওকে নিয়ে তেমন কিছু ফিল করে না তাহলে কেন এত অভিমান।

শরীরটা আর ভালো লাগছে না।ছাদে বসে থাকতে আরো বোরিং লাগছে।একটা লম্বা ঘুমের প্রয়োজন।তাই উঠে যেতে নিলেই একটা বড়সড় ধমক শুনতে পায় সিরাত…

-‘এই মেয়ে আর এক পাও ফেলবে না।এখানে স্থির হয়ে বসে থাকো’।আবেশের কথা শোনে থমকে গেলো।লোকটা হঠাৎ এভাবে সবার সামনে ধমকাধমকি করছে কেন?উনি কাছে এসে কিছু ঔষধ এগিয়ে দিয়ে বললেন,

-‘এগুলো খেয়ে নাও।ভালো লাগবে।আগামীকাল বর যাএী যেতে হবে ত নাকি’।মাঝেমাঝে উনার ব্যবহারে সিরাত অবাক না হয়ে পারে না।একটু আগেও লোকটা কেমন করে কথা বললো আর এখন মুখে কি অমায়িক হাসি।না করতে যেয়েও করতে পারলো না। হাতে নিয়ে খেয়ে নিলো হয়তো পায়ের ব্যাথাটা কিছু কমবে তাঁর।

রুমে এসে ড্রেস চেঞ্জ করে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে সিরাত।পায়ের ব্যাথাটা ক্রমশ আরো বাড়ছে।হয়তো হাঁটাচলা করার ফল এটা।উপরে এখনও সবাই আছে।ও টায়ার্ড ফিল করছে বলে তাকে রেখে গেছে।হঠাৎ দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে কেঁপে উঠলো সে।হয়তো ওর মা এসেছেন।কিন্তু না ওকে অবাক করে দিয়ে আবেশ রুমে ঢুকেছে।কিন্তু দরজা বন্ধ করলেন কেন উনি।ভেবেই গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ওর।বসা থেকে লাফ দিয়ে উঠতে যেয়ে আহ্ বলে আবারও বসে পরলো সে।ওর আর্তনাদ শুনে দৌড়ে ওর কাছে এলো আবেশ।পায়ের দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল,

-‘কেয়ারলেস মেয়ে একটা। এভাবে লাফ দেওয়ার মত কি হয়েছিল।এক জায়গায় স্থির থাকতে পারো না তাই না’।

-‘আপনি এখানে কেন?আর দরজাই বা বন্ধ করলেন কেন’?উনি কোনোকথা না বলে ধুমধাম পা ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেন।সিরাত ক্যাবলাকান্তের মত দাঁড়িয়ে রইলো।পুরো রুম জুড়ে পাইচারী করতে শুরু করে দিল।ওর মাথায় এটা ঢুকছে না বাসায় এতগুলো ওয়াশরুম থাকতে ওর রুমে হঠাৎ ঢুকলো কেন?ও রুম থেকে বেরিয়ে বেলকোনিতে গিয়ে দাঁড়ালো।হঠাৎ গালে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো।পেছন ঘুরে তাকাতেই আবেশকে দেখে আরেকদফা চমকালো।এক গাল হাসি নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে।নিজের গালে স্পর্শ করে হাতে নিয়ে দেখলো হলুদ।অবাক চোখে তাকালো আবেশের দিকে।আবেশ একটু এগিয়ে ফিসফিস করে বলল,

-‘আমি চাই খুব তাড়াতাড়ি তোমার বিয়ে হোক।যদিও আমি এসবে বিশ্বাস করিনা তবুও তোমাকে রাঙিয়ে দিলাম।এবার দ্রুত বিয়েটা হয়ে যাক’।

বলে চট করে দরজা খুলে হাসতে হাসতে চলে গেলেন তিনি।স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সিরাত।এতক্ষণ ওর সাথে কি হলো যেন কিছুই বোধগম্য নয় তার কাছে।এই লোকটার মতিগতি বোঝার ক্ষমতা নেই ওর।কেমন রহস্যেঘেরা মানব।গালে স্পর্শ করে আনমনে হেসে উঠলো সিরাত।মাঝে মাঝে উনার ব্যবহারে কেমন সুখ সুখ অনুভূত হয়।এই সুখের চাদরে সারাজীবন নিজেকে জড়িয়ে রাখতে মন চায়।
#তুমি_আমার
#পর্ব_১০
#লেখনীতে_নাজিফা_সিরাত

গতকালকের ক্লান্তি আর অবসাদের কারণে রাএের ঘুমটা দারুণ আর জবরদস হয়েছে। আড়মোড়া ভেঙ্গে বসতেই মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠলো।পাশে আরু আর রিয়া এখনও ঘুমিয়ে আছে।আয়েশা ফোন কানে হেসে হেসে কথা বলছে।এই মেয়েটা পারেও বটে।সব জায়গায় কেমন নিজের বাড়ি স্পেস বানিয়ে নেয়।লাইনে দাঁড় করিয়ে সবাইকে সময় দিতে পারে।আর আমি একজনকেই ঠিকমত বুঝে উঠতে পারি নি।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম।পায়ের ব্যাথাটা ম্যাজিকের মত সেরে গেছে।ওয়াশরুমে ঢুকে হাতের দিকে তাকিয়ে আপনাআপনি মুখে হাসি চলে এলো।খুব সুন্দর ডিজাইন করে হাতে মেহেদী দিয়ে দিয়েছে।মেয়েটা পারেও বটে।একটা লম্বা শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে আসলাম।তখনই পান চিবুতে চিবুতে একজন অর্ধ বয়স্ক মহিলাকে রুমে দেখে থমকে গেলাম।তিনি ঘুরে ফিরে পুরো রুমটা পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত।আমাকে দেখে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আরুকে একবার ডেকে চলে গেলেন তিনি।এতে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি।কারণ উনার চাহনী ঠিক ভালো লাগছিলো না আমার।

ড্রয়িংরুমে মেহমানরা গিজগিজ করছে।সেখানে ভাইয়ার কাঁধে হাত দিয়ে আবেশ ভাইয়া বসে আছেন।সাথে আরও কয়েকজন ইয়াং ছেলেপোলে ত আছেই।উনাদের দেখে মাথায় ঘোমটা টেনে রান্নাঘরে গেলাম।ভাইয়ার সাথে গতকালের পর আর কথা হয়নি।হয়তো রেগে আছে সে। টায়ার্ড থাকায় কথা বলার স্পেস পায় নি আজ বলতে হবে।রান্নাঘরে ওই মহিলা আন্টির সাথে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছেন।কিন্তু কাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন বুঝতে পারিনি।কথাগুলো এরকম ছিল

-‘তুমি যাই বল না কেন? কিছু তো একটা আছেই।এই মেয়ের মতিগতি আমার কাছে ভালো টেকছে না’।

-‘রাবেয়া তুমি বেশি বুঝছ।কিছু নেই ওকে আমরা ছোট থেকে চিনি ও সেরকম মেয়েই না।বিপদে পরেছিল ব্যস ওকে বাঁচিয়েছে এইটুকুই আর কিছু না’।

-‘ওসব তোমার চোখে পরবে না।যখন একটা অঘটন ঘটবে তখন বুঝবে’তিনি হয়তো আরো কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু তার পূর্বে আন্টি আমাকে দেখে মাঝ পথে থামিয়ে দিলেন।হাস্যজ্জ্বল মুখে আমার দিকে এগিয়ে এসে আন্টি বললেন,

-‘এখন কেমন লাগছে?পায়ে ব্যাথা সেরেছে’?আমি মৃদু হেসে হ্যাঁ বললাম।কথার ফাঁকে ভদ্র মহিলাকে উদ্দেশ্য করে আন্টি বললেন,

-‘রাবেয়া এই হলো সিরাত আরুর বান্ধবী।আর সিরাত ও হলো আবেশের ছোট ফুপি।গতকাল মাঝ রাতে এসেছে’।উনার সাথে কুশল বিনিময় করলাম।কিন্তু উনাকে খুব একটা ভাল লাগলো না আমার।এই বাড়ির প্রায় সকল আত্মীয়দের আমি চিনি কিন্তু উনাকে কখনও দেখি নি কিন্তু কেন।আমাকে উদ্দেশ্য করে আন্টি বললেন,

-‘আরু কোথায়?ওকে একটু ডেকে আনবে।আবেশের বন্ধুরা এসেছে সখিনাও নেই এগুলো একটু সার্ভ করে দিত’।

আন্টির ইতস্তত বোধ করছেন দেখে নিজে থেকেই বললাম,আন্টি আমাকে দিন আমি দিয়ে আসছি’।আন্টির কাছ থেকে নাস্তার ট্রে নিয়ে টেবিলে গিয়ে খাবার গুলো রাখলাম।ভাইয়া আমার দিকে তাকালো না গাল ফুলিয়ে বসে আছে।ওখান থেকে তিহান ভাইয়া বলল,

-‘আরে সিরাত যে কেমন আছো’?সৌজন্যতার খাতিরে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম।পাশ থেকে অন্য একজন বলল,’এটা কে আবেশের বোন নাকি?’উনার কথায় বিষম খেলেন তিনি।তিহান ভাইয়া বললেন,

‘আরে না এটা হলো সিয়াম,পুরোটা শেষ করার আগেই ভাইয়া বলল,’সিয়ামের বাসার কাজের মেয়ে।সাথে সাথে আবেশ আর তিহান ভাইয়া অট্রহাসিতে ফেটে পরলেন।ভাইয়ার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়েও কোনো লাভ হলো না।উনি বিস্ময় নিয়ে বললেন,

-‘সত্যি’ আবেশ ভাইয়া বললেন,’অবশ্যই তাঁর প্রমাণ আমি নিজেই’।উনার দিকে চোখ কটমট করে তাকালাম।তাতে উনার কোনো হেলদোলই নেই দিব্যি হাসছেন তারা।রাগে পুরো শরীর জ্বলে যাচ্ছে।এই হাসি একদম সহ্য হচ্ছে না আমার।রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ভাইয়ার চুল টেনে আবেশ ভাইয়ার চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে দিচ্ছি।উপস্থিত সকলে হতভম্ব বিস্মিত।কিন্তু সকলের নজরকে উপেক্ষা করে উনার চুলের উপর টর্চার চলতেই থাকলো।কখন যে হাতগুলো উনার কপালের ক্ষতস্থানে চলে গেছে সেটা টেরই পাই নি।উনি আহ্ বললে হুশ ফিরে আমার।নিজের কাজে এখন নিজেই লজ্জিত।সকলের দিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখলাম যেন কোনো এলিয়েন দেখছে তারা।এক মুহূর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে দৌড়ে পালালাম।

রেডি হওয়ার জন্য লেহেঙ্গা পরে রুমে পায়চারী করছি।ওড়না আরু সেট করে দিবে বলেছিল কিন্তু ওর দেখা নেই।দরজার পাশে উঁকি দিয়ে আবার রুমে পায়চারি করছি।হঠাৎ পেছন ফেরতে যাবো তখনই কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে বিছানায় হুমড়ি খেয়ে পরলাম।ভয়ে চোখ বন্ধ করায় সামনে থাকা লোকটাকে দেখতে পাইনি।আস্তে আস্তে চোখ খুলে আমার চোখ ছানাবড়া।একি আবেশ ভাইয়া!উনি উঠার চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেন না।এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ কারো কন্ঠস্বর শুনে কেঁপে উঠলাম আমি।

-‘ছি ছি এই মেয়ে আমার ভাইপোর সাথে বিছানায় কি করছো’?উনার এই কথাটা কর্ণগোচর হতেই আমাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।উনার ফুপির কথাটা যে খারাপ অর্থ বহন করছে সেটা ভালোভাবে টের পেয়েছেন তিনি।আমি লজ্জায় মহিলাটির প্রতি ঘৃণায় মাথা নিচু করে আছি।উনি বিষয়টাকে পরিষ্কার করতে বললেন,

-‘ফুপি এটা একটা এক্সিডেন্ট!তুমি প্লিজ তিল কে তাল বানিও না’।উনার কথায় ক্ষেপে গেলেন তিনি।আমাকে ভালোভাবে দেখে বললেন,

-‘তাহলে ওর ওড়না কই?এত বড় মেয়ে নির্লজ্জের মত কীভাবে তোর আমার সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে আছে।নিশ্চয় এই মেয়ের খারাপ কোনো ইনটেনশন আছে’!দু ফোঁটা জল টুপ করে গড়িয়ে পরলো আমার চোখ থেকে।ওড়না টা চট করে গায়ে জড়িয়ে নিলাম আমি।উনি রাগী স্বরে বললেন,

-‘ফুপি!এবার কিন্তু বেশি বলছো চুপ করো।ও ওর রুমে ছিল আমি জাস্ট আরুকে ডাকতে এসেছিলাম তখন ধাক্কা খেয়ে পরে যাই।এটাকে নিয়ে এভাবে ওকে অপমান করো না।দোষ আমার ওর না।ও নিজের রুমে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে থাকতে পারে আমার উচিৎ ছিল নক করে রুমে ঢোকার।যেহেতু এখানে আরু ছাড়াও আরো তিনজন থাকে।সিরাত তুমি কিছু মনে করো না।ফুপির হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি’।

বিশেষ কোনো সুবিধা করতে না পারায় রাগে গজগজ করতে করতে কেটে পরলেন তিনি।যাওয়ার সময় চোখ রাঙিয়ে গেলেন আমায়।আমি চোখের জলগুলো মুছে বললাম,

-‘আপনার এখানে সরি বলার কিছু নেই।উনার যা মনে হয়েছে সেটাই বলেছেন’।

-‘প্লিজ সিরাত’!করুন চাহনী নিক্ষেপ করে নিচে যাওয়ার জন্য বলে গেলেন তিনি।আমি অনেক্ষণ বসে উনার বলা কথাগুলো ভাবতে লাগলাম।একজন মেয়ে আরেকজন মেয়েকে কীভাবে সহজেই অপমান করে দিতে পারে সেটা উনাকে না দেখলে হয়তো বুঝতেই পারতাম না আমি।ছি মানুষ কি জঘন্য!কি জঘন্য মানুষের মানসিকতা।

বর যাএী যাওয়ার জন্য পুরো রেডি।ভাইয়ার দেওয়া লেহেঙ্গা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছি সাথে কসমেটিকস।হালকা সাজ সজ্জা চুলগুলো অবহেলায় পরে রয়েছে পিঠের উপরে।আমার আবার যত্ন করে চুল বাধার অভ্যেস নেই।সকালের ঘটনার পর থেকে ভাইয়ার মুখোমুখি হইনি আমি।লজ্জায় এখন মরে যেতে ইচ্ছে করছে কি করে অতগুলো মানুষের সামনে এমন কান্ড ঘটালাম ভেবে কুল পাই না আমি। নিজের কান্ডে নিজেই শকড।রিয়া আয়েশা আরু আর আমি মিলে বের হয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি।কিছুটা দূরে উনাকে দেখালাম কার সাথে যেন উচ্ছাসিত হয়ে কথা বলছেন।মুখ থেকে হাসি সরছেই না তার।আমি কিৎয়ক্ষণ সেদিক পানে তাকিয়ে দৃষ্টি সংযত করে নিলাম।কিছু সময় আগের কাহিনী মনে হতেই এক রাশ লজ্জা ঘিরে ধরলো আমায়।দ্বিতীয়বার আর তাকানোর সাহস হয়ে উঠলো না।

বিয়ে বাড়ী মানুষে গিজগিজ করছে পুরো বাড়ী।আমি এদিক ওদিক হাঁটছি।আরু একটু সামনে গিয়েছে।তখনই এক গাল হাসি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন ডক্টর রাদিফ ভাইয়া।উনাকে দেখে পুরো চমকে গেলাম আমি।আমাকে অতি বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলেন,

-‘কেমন আছেন আপনি?পায়ের কন্ডিশন এখন কেমন’?নিজের বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে হিমশিম খাচ্ছি সেখানে পা।নিজেকে ধাতস্থ করে বললাম,

-‘আগপর থেকে অনেক ভাল আছি।ব্যান্ডেজ খুলে ফেলেছি।আপনি এখানে’?উনি হাসলেন।হেসে বললেন,’বোনের বিয়েতে ভাই থাকবে না এটা কি হয় নাকি’?কথাটা কর্ণগোহরে পৌছাতেই আরেকদফায় অবাক হলাম আমি।অস্ফুট স্বরে বললাম,’ভাই’?

-‘হুম তিন্নি আপু আর তিথির কাজিন।আমার কোনো বোন নেই ওরাই আমার বোন।আপনি অবাক হয়েছেন হওয়ারই কথা।একচুয়েলি আমিও জানতাম না আপনারা আমার রিলেটিভ কিন্তু সেদিন আপনার নিখোঁজ হওয়ার পর বাসায় গিয়ে জানতে পারি এন্ড সিওর হই।আপনি বাদে বাকি সবাই জানে’।এবার ব্যাপারটা ক্লিয়ার হলো আমার কাছে।

-‘আপনি একা?আপনার সাথের অন্যরা কোথায়’?

আমি মৃদু হেসে বললাম ‘,আছে ওদিকটায়’।

🍁🍁🍁

সিরাতকে হারিয়ে একা একা এদিক ওদিক হাঁটছে আরু।বান্ধবী ছাড়া একা একা বিয়ে বাড়ী টিকা যায় নাকি।অসহ্য লাগছে এখন।ওকে খুঁজতে অলস চোখ এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।বিরক্তির চাপ কুচকে আসা মুখশ্রী তে স্পষ্ট।এতে যেন তার সৌন্দর্য আরও ফুটে উঠেছে।অন্যদিকে এক জোড়া তৃষ্ণার্ত চোখ দূর থেকে তার চোখের তৃষ্ণা মিটাচ্ছে।হাঁটতে হাঁটতে সামনে সেদিনের সেই ডাক্তার কে দেখে ওর হৃৎস্পন্দন লাফাতে লাগলো।লোকটাকে দেখলেই কি যেন হয় নিজেই জানে না।লোকটা হাসছে আর এদিকেই আসছে।ও উল্টো পথে যাএা শুরু করতেই পেছনে থেকে বলল,

-‘আরে বেয়াইন আমাকে দেখে পালাচ্ছেন কেন?আমি বাঘ না ভাল্লুক’?

-‘মোটেও না’! না চেনার ভান ধরে ‘কে আপনি’?মৃদু হাসলো রাদিফ পাগল করা হাসি।আরু একবার তাকিয়ে নজর সরিয়ে নিলো।উনি বললেন,

-‘তিথিরের ভাই!সে অনুযায়ী আপনার বেয়াই’।মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল,’অহ!আচ্ছা আসি সিরাতকে খুঁজতে হবে’।

-‘চলুন দুজনে মিলে খুঁজি’।রাদিফের কথার বিপরীতে না বলতে পারলো না সে।পাশাপাশি দুজনে হাঁটছে খারাপ লাগছে না ওর বরং ভালোই লাগছে।কেন যেন উনার আশেপাশে থাকলে এমনিতেই ভালো লাগে ওর।খানিকক্ষণ নীরবতায় কাটার পর রাদিফ বলল,

-‘ড্রেসটায় আপনাকে দারুন লাগছে।মিস সিরাতেরও দেখলাম সেইম ড্রেস।দুজনকেই অসাধারণ লাগছে একেবারে মায়াবিনী’।আরু আড়চোখে একবার রাদিফের দিকে দৃষ্টি দিলো।ছেলেটাকে যে কোনো গেট আপে দারুন লাগে।মৃদু হেসে খানিক লজ্জা পেয়ে বলল,

-‘থ্যাংকস’!রাদিফ হাসলো কিন্তু কিছু বললো না।হাঁটতে হাঁটতে সিরাত অব্দি পৌঁছে গেলো তাঁরা।সিরাত গাল ফুলিয়ে বলল,

-‘বাহ্!এখানে এসে আমাকে ভুলে গেলি’।

-‘ধুর না আমি তোকেই খুঁজছিলাম’।

এসেছি থেকে তিথি আপু আটার মত সেটে আছে উনার সাথে যেটা কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না আমি।দুজনের হাসাহাসি একটু বেশিই।খাবার টেবিলে বসে খাবার নাড়াচাড়া করছি কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না।বারবার চোখ দুটো উনার দিকে চলে যাচ্ছে।একটু পর আমাকে অবাক করে দিয়ে আরুর পাশে চেয়ারে বসলেন তিনি।ভাইয়াও বসলো এক পাশে।আমি বড়সড় একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে গিয়েও ফেলতে পারলাম না কারণ তিথি আপু একদম পাশে বসলেন।রাগে রিরি করে উঠলো পুরো শরীর।আমি কিছু খাচ্ছি না দেখে তিনি বললেন,

‘সিরাত তুমি দেখছি কিছুই খাচ্ছ না।খেতে না পারলে আমাকে দাও।বলে টুপ করে রোস্টের টুকরো হাতে তুলে নিলেন তিনি।প্লেটের পাশে দইয়ের বাটি নিয়ে ভাইয়া বলল,

‘তুই তো আবার এসব খাস না।ঠিক আছে চিন্তা করিস না।এগুলো সাবাড় করার জন্য আমরা তো আছিই।খাবারের ব্যাপারে একদম লজ্জা পাই না আমরা’।দুজনে সকলের প্লেট থেকে তুলে খেতে খেতে চলে গেলো।আমরা সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওরের যাওয়ার পানে।এই ছেলে দুটো এত শয়তান সেট দেখছি এখন আরও বেশি।দুজনে একসাথে থাকলল শয়তান এসে ঘাড় মটকে ধরে।নইলে এমন কেউ করে আজব পাবলিক!

#চলবে
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here