তুমি আমার প্রাণ পর্ব -০৯+১০

#তুমি আমার প্রাণ
#পর্বঃ০৯
#Mitu-মিতু

“আমার আম্মার পছন্দের জিনিস কিনেছি আমি।তুই চুপ থাক। টাকা থাকলো না শেষ হলো সেগুলো আমার ভাবনা।”

_________________

মজিদ মিঞার সাথে রিশার বেড়াতে যাওয়া,,মুখে তুলে খাওয়ানো,, এগুলো দেখে সেলিনা বেগম রিশার ওপর আক্রোশে ফেটে পড়ছে। সতীনের মেয়ের প্রতি এতো আহ্লাদ সেলিনা বেগমকে হিংস্র করে তুলছে দিনকে দিন। সব আদর যদি মেয়েকে দেয় তাহলে রিয়াদের কি হবে?বাবা-মায়ের ভালোবাসা কখনো ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা হয় না।তবুও সেলিনা বেগম এটা সহ্য করতে পারছে না। কামালের মা যখন আরো একটু ফুসলিয়ে যায় তখন হয়তো রিশাকে হাতের কাছে পেলে খুন করতেও সেলিনার দ্বিধা হবে না। এমনি একদিনে রিশার ক্লাস থ্রীতে উত্তীর্ণ হওয়ায় মজিদ মিঞা রিশাকে স্কুলের নতুন ড্রেস বানানোর জন্য সাথে করে দর্জির দোকানে নিয়ে যায়। ড্রেস সহ বাড়িতে পড়ার জন্য আরো কয়েকটা জামা কিনে দেয়। রিশার খুশি দেখে কে। বাবা-মেয়ের হাতে জামা-কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে বাড়ি ফিরতে দেখে সেলিনা বেগম তাড়াতাড়ি মজিদ মিঞার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিলো।ব্যাগ থেকে যখন শুধু রিশার জামা বের হচ্ছিলো তখন সেলিনা বেগম ভেতরে ভেতরে রেগে অস্থির। এই বুঝি ছেলের প্রতি ভালোবাসা,, শুধু মেয়ের জন্য এনেছে। অতিরিক্ত হিঃসায় সেলিনা বেগমের এটা একবারও মনে হলো না যে দুইদিন আগেই রিয়াদের জন্য পোশাক এনেছে মজিদ মিঞা।

“কামালের মা বুবু ঠিকই বলেছে,, এই মেয়ে সংসারে থাকলে আমার ছেলে সবকিছু থেকে বঞ্চিত হবে। মেয়ের পেছনে সব টাকা-পয়সা ফুরিয়ে ফেলবে” মনে মন বললো সেলিনা বেগম।

হাতের ব্যাগটা উঠানে ঢিল মেরে রিয়াদকে কোলে নিয়ে সেলিনা বেগম কামালের মায়ের কাছে গেলো।কিছু একটা করতে হবে। এভাবে বসে বসে সে এগুলো দেখতে পারবে না।

_________________

“হুনো বইন!তুমি আর আমার কাছে আইসো না।কামাল তোমার সাথে আমারে কতা কইতে না করছে”

সেলিনা বেগমকে দেখে কামালের মা কথাটা বললো।ছোট বাচ্চার সাথে এমন নিষ্ঠুরতম ব্যবহার করার জন্য কামাল আর কামালের বউ সেলিনা বেগমকে দেখতে পারে না।মায়ের সাথে এতো মিল দেখে কামাল তার মাকে শাসিয়ে গেছে।

“শুনো মা!মজিদের বউ যেনো আমারে বাড়ি না আসে।”

তারপর থেকে কামালের মা সেলিনা বেগমের সাথে তেমন কথা বলে না।ছেলের ঘরে খায়।অন্যের জন্য তিনি নিজে বিপদে পরবে কেনো?কামালের মায়ের কথায় সেলিনা বেগমের মুখটা চুপসে গেলো।সেখানে আর না থেকে সোজা বাড়ি চলে আসলো,,ভাবলো যা করার তার নিজেকেই করতে হবে। এভাবেই দিন কাটতে লাগলো।রিশা মনে ছোট মায়ের ভয় আর বাবার আদর নিয়ে বড় হতে লাগলো। ৭ বছরের শিশু পা দিলো ৯ বছরে।মায়ের ভালোবাসা কেমন সে অভিজ্ঞতা রিশার নেই। বাবার আদরের ছায়াতলে বেড়ে ওঠা রিশা বাড়ির কাজে পটু হয়ে গেলো মজিদ মিঞার অজান্তেই। যখন মজিদ মিঞা বাড়ি থাকে না তখন সেলিনা বেগম রিশাকে দিয়ে বাড়ির সব কাজ করায়।তবে সে রিশাকে বাড়ি থেকে বের করার চিন্তা এখনো বাদ দেয়নি।

_____________

ঋতুরাজ বসন্তকালে প্রকৃতি ডুবে গেছে নিজস্ব সজীবতায়।গাছে গাছে লাল রাঙ্গা কৃষ্ণচূড়া ফুল সবার মনে জাগায় প্রেম। এমনি একদিনে রিশা ভাই রিয়াদকে নিয়ে বসে আছে বাড়ির সাথে থাকা এক পুকুর পাড়ে। গত বছর মজিদ মিঞা পুকুর খনন করেছে মাছ চাষ করার জন্য। প্রচন্ড চঞ্চল রিয়াদ বোনের সাথে বসে থাকতে নারাজ। সে তার মতো খেলতে চায়।সেলিনা বেগম রিয়াদের দায়িত্ব রিশাকে দিয়ে ঘরে প্রশান্তির ঘুম দিচ্ছে।

“ভাই তুমি আমার সাথে বসে থাকো তো!পানির কাছে যাওয়া যাবে না।পড়ে যাবে।”

“আমি পানির কাছে যাচ্ছি না বুবু।”

রিয়াদকে নিয়ে বসে থাকতে না পেরে রিশা তাকে নিয়ে চলে গেলো বাড়ির ভেতরে। রিয়াদকে রান্নাঘরে পাশে বসিয়ে রেখে সে তরকারি কাটতে লাগলো।বিকালে সেলিনা বেগম রান্না করতে বসলে রিশাকেই এগুলো করতে হবে তাই এখনই করে রেখে দিতে চাইলো।রিশা নিজের কাজে মগ্ন থাকায় রিয়াদ কখন তার পাশ থেকে উঠে গেছে সে খেয়াল করেনি।রিয়াদের বুবু বলে আত্ন চিৎকার শুনে রিশার হাত থেমে গেলো।পাশে ভাইকে না দেখতে পেয়ে দৌড় দিলো পুকুর পাড়ে। রিয়াদকে পানির ওপর ভাসতে দেখে রিশার জান বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। সে কিছু না ভেবে নিজেও ঝাপ দিলো পানিতে।রিয়াদের চিৎকারে সেলিনা বেগমের ও ঘুম ভেঙে গেছে ছেলের চিৎকার শুনে সেও ঘর থেকে বের হয়ে আসলো।কাওকে না দেখতে পেয়ে পুকুর পাড়ে আসতেই দেখে রিশা রিয়াদকে নিয়ে পানিতে হাবু-ডুবু খাচ্ছে। ছেলের এমন অবস্থা দেখে হায় হায় শুরু করলো সেলিনা বেগম। সে গলা সমান পানিতে নেমে ছেলেকে তুলে আনলো।সেলিনার হইচই শুনে আশেপাশের মানুষেরা আসলো ওদের বাড়ি।রিশা ততক্ষণে পানি থেকে উঠে পরেছে। ছেলেকে আগলে নিয়েছে সেলিনা। প্রতিবেশী সবাই জিজ্ঞেস করছে ওরা পানিতে পরলো কি করে? রিশাকে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেখে সেলিনা বেগম কারো কথায় টু শব্দ না করে উঠানের একপাশে পড়ে থাকা ফাটা বাঁশের ফালি নিয়ে রিশাকে মারতে শুরু করলো

“হা*জাদি!তুই আমার ছেলেকে মেরে ফেলতে চাস।কি করেছে ও তোর? বল কি করেছে। দুধ-ভাত দিয়ে আমি ঘরে কালসাপ পুসছি।কালনাগিনী। ”

“ছোট মা আমার লাগছে। আমি দেখিনি কখন রিয়াদ পুকুর পাড়ে গেছে। ” কাঁদতে কাঁদতে বললো রিশা।

“তুই আমার ছেলেকে রেখে কি করছিলি।” আজ তোকে আমি মেরেই ফেলবো।

সেলিনার এমন হঠাৎ আক্রমণ কেউ তখন বুজতে না পারলেও এখন কেউ তাকে বাঁধা দিচ্ছে না।দুই-একজন এগিয়ে গেলেও সেলিনার কথায় আর কেউ কিছু বললো না।

“খবরদার কেউ আজকে আমাকে বাঁধা দিবেন না।আজকে একে আমি মেরেই ফেলবো। আপনারা নিজের বাড়ি যান।অন্যের বাড়ি সামলাতে আসতে হবেনা।”

সবাই যার যার বাড়ি চলে গেলো।কামালের বউ থাকলে হয়তো এ যাত্রায়ও রিশা বেঁচে যেতো কিন্তু জুইয়ের মা বাপের বাড়ি গেছে। প্রত্যেকটা বারিতে বাঁশের ধারালো শির গেছে যাচ্ছে রিশার শরীরে। প্রথমে চিৎকার করলেও এখন চিৎকার করার শক্তি আর অবশিষ্ট নেই রিশার। রাগে সেলিনা বেগম বাঘিনীর রুপ ধারণ করেছে।এতো দিনের জমানো আক্রোশ সুদে-আসলে তুলে নিলো সে।রিশাকে নিশ্চুপ হয়ে যেতে দেখে সেলিনা বেগম থামলো।

______________

মজিদ মিঞা সন্ধ্যার একটু আগে বাড়ি ফিরে এসেছে। বাড়িতে ঢুকতেই উঠানে মেয়েকে এমন নিথর হয়ে পরে থাকতে দেখে সে দৌড়ে গেলো মেয়ের কাছে।

“আম্মা ও আম্মা তোমার কি হয়েছে আম্মা? ঐ সেলিনা তুই আজকে আবার আমার আম্মার গায়ে হাত তুললি?” কাঁদতে কাঁদতে বললো মজিদ মিঞা।

মেয়ের রক্তাক্ত শরীর দেখে মজিদ ভর সন্ধ্যায় গ্রামের সরকারি হাসপাতালে গেলো মেয়েকে নিয়ে। বাঁচবে তো তার আম্মা। ডুকরে কেঁদে উঠলো মজিদ। ছেলের মতো মেয়েকে একটু ভালোবাসলে কি হতো সেলিনার?ডাক্তার রিশার শরীর পরিষ্কার করে ঔষধ লাগিয়ে চলে গেলে মজিদ মেয়ের পাশে থেকে রাতটা নির্ঘুম কাটালো।

_________________

সকালে আনন্দপুর গ্রামের এক লোকের মাধ্যমে ভাগ্নীর এমন অবস্থার কথা শুনে মতিন সাহেব আর একমুহূর্ত দেরি না করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরলেন।স্বামীর এমন তারাহুরো দেখে মুর্শিদা বললো

“এই সাত-সকালে এমন তারাহুরো করছেন কেনো?কার কি হয়েছে?”

“বাড়ি এসে সব বলবো মুশি।আমার বোনের মুখের হাসি আনতে যাচ্ছি আমি।”

হাসপাতালে মতিন সাহেব কে দেখে মজিদ মিঞা কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। নিঃস্প্রাণ চোখে সে তাকিয়ে আছে তার আম্মার দিকে।রিশার শরীরের প্রত্যেকটা আচর দেখে মতিন সাহেব শিউরা উঠলেন।

“তোমার আর কোনো কথা শুনবো না মজিদ। এবার আমি আমার ভাগ্নীকে নিয়ে তবেই যাবো।তুমি বাঁধা দিতে আসলে আমি পুলিশের সাহায্য নিবো।তোমার কথা না শুনলে আজ আমার ভাগ্নীর এমন অবস্থা হতো না”

“নিয়ে যান ওকে।”

মজিদ মিঞার এমন সহজ স্বীকারোক্তি দেখে মতিন সাহেব অবাক হলেও আর কোনো কথা বললো না।এতোদিন পর বোন তার কলিজাকে পাবে এতেই তিনি খুশি। ডাক্তারদের সাথে কথা বলে সব ঔষধ নিয়ে মতিন সাহেব ভ্যানে করে ভাগ্নীকে নিয়ে রসুলপুর গ্রামের উদ্দেশ্যে চললেন।যাওয়ার আগে মজিদকে বলে গেছে

“মেয়ের প্রতি তোমার ভালোবাসার কোনো খাদ ছিলো না মজিদ। কিন্তু তোমার বউয়ের নিষ্ঠুরতার জন্য আমি আমার ভাগ্নীকে তো আর বলি দিতে পারিনা। তোমার ইচ্ছে হলে মেয়ের সাথে দেখা করতে পারো আমার কোনো আপত্তি নেই। ”

রিশা সবকিছু শুধু দুচোখ দিয়ে দেখছিলো আর শুনছিলো।বাবাকে শুধু একবার বলেছিলো আমি কোথাও যাবো না বাবা।

“আম্মা তুমি তোমার মায়ের কাছে যাও।তোমার মা তোমাকে খুব ভালোবাসে,,ভালো থাকবে তুমি সেখানে। ”

“তুমি যে বলতে আমার মা আমায় ভালোবাসে না।”

“ওগুলা মিথ্যা ছিলো আম্মা।তুমি ভালো থেকো।আমি যাবো তোমার সাথে দেখা করতে। তোমার বাবাকে তুমি ভুলে যেও না।”

আর কেউ কোনো কথা বলেনি।মজিদ মিঞা ছন্নছাড়ার মতো হাসপাতাল থেকে বের হয়ে হাটতে শুরু করলো।

তবে কি এবার রিশার জীবনে সুখ আসবে?

চলবে……#তুমি আমার প্রাণ
#পর্বঃ১০
#Mitu-মিতু

মতিন সাহেব একমাত্র ভাগ্নীকে নিয়ে বাড়ি আসলেন দুপুরের দিকে। চেয়ারম্যান বাড়ির সবাই তখন বসার ঘরে বসে গল্প করছিলো।মতিন সাহেবের কোলে ছোট এক মেয়েকে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে গেলো।

“আপনার কোলে মেয়েটা কে?”

মুর্শিদার প্রশ্নে কিছু না বলে মতিন সাহেব বোনের দিকে তাকালেন।

“সারু বোন আমার দেখ কাকে নিয়ে এসেছি! তোর কলিজার পুতুল। ”

মতিন সাহেবের কথা শোনামাত্র সাহেরা বানু দৌড়ে গেলো মেয়ের কাছে।

“ভাইয়া তুমি আমার পুতুল কে এনেছো ভাইয়া!আমার পুতুল। ”

ভাইয়ের কোল থেকে মেয়েকে নিয়ে সাহেরা বানু মেঝেতেই বসে পরলো।কত বছর পর সে তার কলিজার টুকরাকে কাছে পেলো। দেখতে পেলো।সাহেরা বানু কাঁদতে শুরু করলো। মুর্শিদা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে রিশার শরীরের দিকে,,এ কি অবস্থা মেয়েটার? শরীরে ছোপ ছোপ রক্ত আর কাটা দাগ দেখে মুর্শিদা শিউরে উঠলো। সাহেরা বানু মেয়ের শরীরের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলো। তার পুতুলের কি হয়েছে?

“ভাই আমার পুতুলের কি হয়েছে? ওর শরীরে এমন দাগ কেনো? রক্ত। ”

“সারু পরে কথা বলার অনেক সময় আছে। এখন তুই মেয়েকে নিয়ে ঘরে যা।”

সাহেরা বানু আর মুর্শিদা রিশাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলো।রিশা কারো সাথে কথা না বলে শুধু দেখে যাচ্ছে সবকিছু। রাতে খাবারের টেবিলে একে একে সবকিছু খুলে বললো মুর্শিদাকে।সাহেরা বানুর কাছে গোপন করা হলো সবকিছু।রিশার এতোদিনের কথা শুনে মুর্শিদা চমকে উটলো।মানুষ এমনও হয় বুঝি?

________________

রসুলপুর চেয়ারম্যান বাড়িতে আসা একমাস পেরিয়ে গেলো রিশার।সাহেরা বানু মেয়েকে নিয়ে পাগল হলেও রিশা তাকে এরিয়ে চলতে লাগলো।তার ছোট মনে প্রশ্ন শুধু এটাই

“এতোদিন কোথায় ছিলো এতো আদর।সবার ভালো মা কত আদর করতো আমারও তো মন চাইতো।”

পড়াশোনার ফাঁকে ১ মাসের ছুটি নিয়ে তাসরিফ বাড়ি আসলো।বাবার কাছ থেকে রিশা আসার সব কথা সে শুনেছে। সকালের খাওয়া দাওয়া শেষ করে তাসরিফ রিশার ঘরে দরজার সামনে দাঁড়ালো।রিশা তখন শুয়ে ছিলো। মজিদ মিঞার বাড়ির মতো এখানেও সে একাই থাকে রাতে। সাহেরা বানু থাকতে চাইলে তাকে রিশা মানা করেছিলো।সাথে থাকার জন্য জোর করায় রিশা বলেছিলো

“আমি একা থাকতে পারি। আমাকে জোর করলে আমি বাবার কাছে চলে যাবো। ”

তারপর রিশাকে আর কিছু বলা হয়নি।মেয়ের এমন এরিয়ে চলা সাহেরা বানু সহ্য করতে পারছে না। কোথায় মেয়েকে সে বুকে আগলে রাখবে কিন্তু সেখানে মেয়ে তাকে দেখতেই পারছে না।

“রাতে ঘুম হয়নি? এখন কিসের ঘুম এই সকালে?”

ঘরে কারো কন্ঠস্বর পেয়ে রিশা দরজার দিকে ঘুরে তাকালো। বছর দুয়েক আগের অল্প পরিচিত চেহারা দেখতে পেয়ে উঠে বসলো।

“তুমি এখানে কেনো ভাইয়া? ”

“এটা আমার বাড়ি তাই আমি এখানে। ঘরে একা একা কি করছিস।বাইরে আয়।”

রাশভারি গোছের মানুষ তাসরিফ। তার গম্ভীর কন্ঠস্বরে যেকোনো মানুষ তার আদেশ মানতে বাধ্য হয়। রিশাকে এখনো বসে থাকতে দেখে আবার বললো

“কি বললাম তোকে শুনিসনি। বাইরে আয় ঘর থেকে। সারাদিন ঘরে কি?”

“তুমি সেই পঁচা ভাইয়াই আছো।কেমন করে কথা বলো।আমার ভয় লাগে। ”

রিশার কথা শুনে তাসরিফ একটু আস্তে করে বললো

“বাইরে আয় পুতুল। একটু ঘুরে আসি আয়।”

রিশার একঘেয়েমি কাটানোর জন্য আর কিছুক্ষন ওর সাথে কথা বলার জন্য তাসরিফ বললো কথাটা।রিশা দ্বিমত না করে বিছানা থেকে নামলো। রিশা ঘর থেকে বের হলে তাসরিফ ওর এক হাত ধরে বাড়ির বাইরে গেলো।

“তুমি মামার ছেলে ভাইয়া?”

“হুম ”

“কিন্তু তুমি মামার মতো ভালো না কেনো? এমন গোমড়া মুখে কথা বলো কি জন্যে? আমার ভালো লাগে না তোমার কথা শুনতে”

“তাহলে কিভাবে কথা বলবো? এখন কি তোর কাছ থেকে আমায় কথা বলা শিখতে হবে”

“আমার মতো আস্তে আস্তে কথা বলবে।”

এভাবেই অনেকক্ষণ তাসরিফ আর রিশা গল্প করলো। কারো সুখ -দুঃখের কথা শুনতে হলে আগে তার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে হয়।তাসরিফ ঠিক সেটাই করছে। সাহেরা বানুকে এরিয়ে চলা নিয়ে আজকে কোনো প্রশ্ন করলো না তাসরিফ। বাড়ি থেকে একটু দূরে বাজার।রিশাকে নিয়ে সে বাজারে গেলো।

“কি খাবি পুতুল?”

“তোমার যা ইচ্ছা কিনে দেও।”

“তোর কি ভালো লাগে? ”

“মামা বিস্কুট ভালো লাগে। জানো আমার বাবা প্রতিদিন আমার জন্য বিস্কুট নিয়ে যেতো।”

রিশার আনন্দিত মুখটা আবার চুপসে গেলো।কতদিন হলো বাবার সাথে দেখা হয় না। তাসরিফ রিশার জন্য বিস্কুট,, চকলেট আর চিপস নিলো।আবার হাটতে হাটতে বাড়ি ফিরলো ওরা। চেয়ারম্যান বাড়ি আসার পর থেকে রিশা ঘরের মধ্যেই কাটায় দিন-রাত। মামা-মামীমার সাথে গলায় গলায় মিল হলেও তার মায়ের সাথে কথা খুব কম হয়।তানিয়ার J.S.C. পরিক্ষার জন্য সে রিশাকে সঙ্গ দিতে পারে না।

__________________

আদর-ভালোবাসায় বেড়ে উঠলে লাগলো রিশা। ছোট মায়ের করা অত্যাচার আর মায়ের প্রতি রাগ রিশাকে করে তুলেছে চুপচাপ। শান্ত -শিষ্ট মেয়েটি সবার সাথে খুব কম কথা বললেও তার কথার ঝুলি খুলে যায় তাসরিফের কাছে। আজকে রিশার নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়ার দিন। সে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে গেছে।ঘর থেকে বের হয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় এসে দেখে তাসরিফ মাটিতে উপুড় হয়ে হাত দিয়ে উঠা-নামা করছে।

“তুমি মাটির সাথে এমন করছো কেনো ভাইয়া? ”

“ব্যায়াম করি পুতুল। তুই কথা না বলে চুপচাপ ঘরে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নে।আমি তোকে স্কুলে নিয়ে যাবো।”

তাসরিফের কথায় রিশা ঘরে চলে গেলো।ফ্রেশ হয়ে মামির হাতে সকালের নাস্তাটা খেলো। মেয়ের সাথে কথা বলতে না পারায় সাহেরা বানু দিন দিন মুচড়ে যাচ্ছে। এ কোন পাপের শাস্তি সে ভোগ করছে। তার পুতুল এমন করছে কেনো মনে প্রশ্ন জাগে। তাসরিফ স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে রিশার ঘরের সামনে আসলো

“কি রে এখানো হলো না তোর?”

“আমি সেই কখন থেকে বসে আছি। তুমিই তো দেরি করলে।”

রিশার কথায় তাসরিফ ওর দিকে তাকালো।মিষ্টি কালার গোল ফ্রকটায় রিশাকে পুতুলের মতোই লাগছে। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল খোলা দেখে তাসরিফ রিশার ঘরে ঢুকলো।ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে দুটো রাবার আর চিরুনি নিয়ে রিশার বিছানায় বসে তাসরিফ রিশাকে কাছে ডাকলো।

“আমার কাছে এসে বস তো পুতুল। ”

রিশাকে বিছানায় বসিয়ে দুপাশে দুটো ঝুটি বেঁধে দিলো তাসরিফ। তারপর দুজন স্কুলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে হাটা ধরলো।রসুলপুর প্রাইমারি স্কুল চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে বেশি দূরে না হওয়ায় ওরা হেটেই গেলো। স্কুলে ভর্তির কাজ শেষ করে তাসরিফ রিশাকে নিয়ে বাজারে গেলো।পছন্দ মতো জামা,,রাবার,,কিছু চকলেট +চিপস নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরলো।মাঝ পথে তাসরিফ রিশাকে জিজ্ঞেস করলো

“তুই ফুপির সাথে কথা বলিস না কেনো পুতুল? ”

“আমার ভালো লাগে না ভাইয়া” মন খারাপ করে বললো রিশা।

“কি জন্যে ভালো লাগে না?”

“ভাইয়া আমার ভালো লাগছে না! তাড়াতাড়ি বাড়ি চলো তো।”

রিশার হঠাৎ রেগে যাওয়া আর মন খারাপ দেখে তাসরিফ কথা বাড়ালো না।ভাবলো অন্য সময় শুনলেই হবে। সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। দুঃখের পর সুখের ছোয়া সবার জীবনেই আসে। রিশার দিন কাটতে লাগলো রসুলপুর চেয়ারম্যান বাড়িতে ননীর পুতুলের মতো।

চলবে……

[আগামীকাল থেকে ইনশাআল্লাহ অ্যাডাল্ট রিশা-তাসরিফ কে নিয়ে গল্প শুরু হবে। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here