তুমি আমার প্রেয়সী ২ পর্ব -০৬

#তুমি_আমার_প্রেয়সী
#সিজন ২
#তাসনিম_জাহান_রিয়া
#পর্ব_৬

কথাগুলো বলে সাফাত এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না। দ্রুত পায়ে সেই স্থান ত্যাগ করে। হয়তো আর কিছুক্ষণ থাকলে সে নিজেকে সামলে রাখতে পারতো না। ইমোশনাল হয়ে যেতো। কণা নিষ্পলক তাকিয়ে আছে সাফাতে যাওয়ার পানে। চোখ থেকে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে কণার। সাফাতকে যতক্ষণ দেখা গেলো ততক্ষণ কণা তাকিয়ে রইল। সাফাত কণার চোখের আড়াল হতেই কণা দৃষ্টি সরিয়ে নেই।

সাফাতের জায়গায় সাফাত ঠিক। কণা নিজের জায়গায় কণা নিজেও ঠিক। কোনো বোনই চাইবে না তার জন্য তার ভাইয়ের স্বপ্ন ভেঙে যাক। আলতো হাতে চোখের জলটা মুছে নেয়। কণা ভাবেনি সাফাতের ভালো করতে গিয়ে সাফাতকে এতো বড় কষ্ট দিয়ে ফেলছে। সে কী করবে বুঝতে পারছে না? তার জন্য তার বাবা আর ভাই আলাদা হয়ে গেলো।

তিন মাস আগে

সাফাত কণা আর তাহসিন আহম্মেদকে সারপ্রাইজ দিবে বলে কাউকে না জানিয়ে হুট করে দেশে চলে আসে। যখন নিজের বাসাই ঢুকবে তখনি পাশের বাসার এক মহিলার কথা শুনে সে থমকে যায়। পাশের বাসার মহিলা আরেক মহিলার সাথে কণার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বলছিল। আর আপসোস করছিল কণার প্রতি হওয়া অন্যায়ের কোনো বিচার হয়নি বলে। অপরাধীরা কোনো শাস্তি পায়নি বলে। তার পা দুটো নড়ছে না। সাফাতের শরীর অবশ হয়ে আসছে। মহিলার কথাগুলো তার বিশ্বাস হচ্ছে না।

সে দ্রুত পায়ে ফ্ল্যাটের কাছে যায়। দুই বার কলিংবেল বাজাতেই তাহসিন আহম্মেদ এসে দরজা খুলে দেয়। সাফাতকে দেখে তিনি অবাক হয়ে যান। এতোবছর পর চোখের সামনে নিজের ছেলেকে দেখে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। কিন্তু পরক্ষণেই সেই হাসি গায়েব হয়ে যায় কণার কথা ভেবে। তিনি চিন্তায় পড়ে যান সাফাত কণার এই অবস্থা দেখে কেমন রিয়েক্ট করবে? তাহসিন আহম্মেদকে অবাক করে দিয়ে সাফাত তার সাথে একটা কথাও না বলে যাস্ট ইগনোর করে ফ্ল্যাটের ভিতরে ঢুকে পড়ে। ফ্ল্যাটে ঢুকেই চিৎকার করে কণাকে ডাকতে থাকে।

কণা,,, কণা,,,, কণা,,,, কণা।

কণা লাঞ্চ করছিল। সবে মাত্র খাবার মুখে দিয়েছিল। সাফাতের কথা শুনে মুখ থেকে খাবার পড়ে যায়। সাফাতকে সে এখন মোটেও আশা করেনি। বিষ্ময়ে তার চোখ মুখ স্বাভাবিকের তুলনায় বড় হয়ে যায়। পরমুহুর্তেই ভয়ে সিটিয়ে যায়। পিছন ঘুরে সাফাতকে এক পলক দেখে আবার সামনের দিকে ঘুরে যায়। গলায় ঝুলানো স্কাফ দিয়ে ভালো করে মুখ ঢেকে নেয়।

তারপর চেয়ার ছেড়ে ওঠে সাফাতের সামনে দাঁড়ায়। সাফাতের চোখ দুটো অশ্রুতে টলমল করছে। যেকোনো সময় এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়বে। সাফাতের চোখের অশ্রুর কারণ কণা বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ ভাবার পর বুঝতে পারে অনেকদিন পর দেশে ফিরেছে কাছের মানুষগুলোকে চোখের সামনে দেখতে পারছে। তাই হয়তো খুশিতে আঁখি অশ্রুতে টলমল করছে।

সাফাতের চোখ থেকে টুপ করে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। সাফাত নিজের কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে দেয় কণার দিকে। যখনি স্কাফে হাত দিতে যাবে তখনি কণা দুই পা পিছিয়ে যায়। কণা ভাবছে সাফাত কিছু জানে না। কিন্তু সাফাত তো সবটা জানে। সাফাত কণাকে প্রশ্ন করে।

কী হলো পিছিয়ে গেলি কেনো? তোর মুখটা দেখতি দিবি না? তুই মুখ এমন স্কাফ দিয়ে ঢেকে রেখেছিস কেনো? কতদিন হলো তোকে দেখি না। ৪ মাস ধরে ভিডিও কলেও কথা বলিস না।

উহু মুখ দেখানো যাবে না। মুখে প্রচুর পিম্পল হয়ছে। তাই স্কাফ দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছি। আমাকে এখন পেত্নীর মতো দেখতে লাগছে। তুমি পরে এ নিয়ে আমার সাথে ফাজলামো করবে।

সাফাতের কণা কথাটা বিশ্বাস হলো না। বিগত চার মাস ধরে সাফাতে ভিডিও কলে কথা বলতে চাইলে কণা এই এক বাহানা দিয়ে কথাটা এড়িয়ে চলতো। সাফাতও কিছু বলেনি। সে ভেবেছিল চার মাস পর দেশে ফিরে নিজের বোনকে দু চোখ ভরে দেখবে। সাফাত জোর করেই কণার মুখের ওপর থেকে স্কাফটা সরিয়ে নেয়। কণার মুখ দেখে সাফাত আৎকে ওঠে।

কণার এমন চেহেরা দেখে সাফাতের শরীর কেঁপে ওঠে। তার টুকটুকে বোনটার এ কেমন হাল হয়েছে। সাফাত কণার মুখে হাত বুলাতে। সে তো ভেবেছিল তার বোনের মায়াবী মুখটা দু চোখ ভরে দেখবে। কিন্তু তার বোনের এমন বিভৎস চেহেরা দেখতে হবে এটা সে কল্পনাতেও ভাবেনি।

সাফাত ছেলে না হলে হয়তো এতক্ষণে সাফাতের চিৎকারে কম্পিত হতো আশপাশ। কিন্তু ছেলেদের যে কাঁদতে নেই। কান্না-কাটি ছেলেদের মানায় না। ছেলেদের চোখের জল মানায় না। তাদের ভিতরটা পাথরের মতো শক্ত হতে হয়। কিন্তু প্রিয়জনের এমন করুন অবস্থা দেখলে কী ঠিক থাকা যায়? সাফাতের চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার কান্না সব গলায় দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। চোখ থেকে টুপ টাপ জল গড়িয়ে পড়ছে। ভিতরে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।

এটাই তোর মুখের পিম্পল?

কণা মাথা নিচু করে ফেলে। সে কী বলবে? সে তো তার ভাইকে মিথ্যা বলতে চায়নি। কিন্তু মিথ্যা বলা ছাড়াও তো আর কোনো উপায় ছিল না। কণা যদি সবটা সাফাতকে বলতো। তাহলে সাফাত নিজের পড়াশোনা ছেড়ে দেশে চলে আসতো। দেশে বাইরে গিয়ে হায়ার স্টাডি করার যে তার ভাইয়ের স্বপ্ন ছিল। সে কী করে পারতো নিজের ভাইয়ের স্বপ্ন ভেঙে দিতে?

বাবা, কণা আমি তোমাদের এতোটা পর হয়ে গেছি। এতবড় একটা এক্সিডেন্ট ঘটে গেলো কণার জীবনে আর তোমরা আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলে না। কণা আমার বোন না নাকি তোমরা আমার কেউ হউ না?

তাহসিন আহম্মেদ নিরবে চোখের জল ফেলছেন। তিনি জানতেন সাফাত সব কিছু জানার পর এভাবেই রিয়েক্ট করবে।

এসব কী বলছো তুমি? তুমি আমার ভাই। তোমাকে এসব বলিনি তোমার ভালোর জন্য।

আমার ভালোর জন্য। এতে করে আমার কী ভালো হয়েছে? নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে গেলাম। নিজের বিবেকের কাছে অপরাধী হয়ে গেলাম। সারাজীবন এই অপরাধ বোধ নিয়ে বাঁচতে হবে।

সাফাত কাঁদতে কাঁদতে হাঁটু গেড়ে নিচে বসে পড়ে। কণাও সাফাতের সামনে বসে।

প্লিজ ভাইয়া এভাবে কেঁদো না। তুমি কাঁদলে আমার ভীষণ কষ্ট হয়।

তুই শুধু নিজের কষ্টটাই বুঝলি আমারটা না। তোর আমার চোখের পানি দেখে কষ্ট হচ্ছে। তোকে এভাবে দেখে আমার কতটা কষ্ট হচ্ছে তুই বুঝতে পারছিস? বুকের ভিতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।

ভাইয়া আমি তোমাকে তখন সবটা বলল তুমি দেশে চলে আসতে। তোমার স্বপ্ন ভেঙে যেতো। এতোদিনের পরিশ্রম বিফলে যেতো। তোমাকে সবটা বললে কী আমার চেহেরা আগেরা মতো হয়ে যেতো?

তোর চেহেরা হয়তো ঠিক করতে পারতাম না। কিন্তু তোর সাথে যারা অন্যায় করেছে তাদের কঠিন থেকে কঠিন শাস্তি দিতাম।

ওদের শাস্তি দিলে কী আমার চেহেরা ঠিক হয়ে যাবে?

সাফাত প্রচন্ড রেগে যায় চিৎকার করে বলে,

তোর চেহেরা ঠিক না হলেও আমি শান্তি পেতাম। ওদের শাস্তি পেতে দেখলে আমার কলিজা ঠান্ডা হতো। আমার পৈশাচিক আনন্দ হতো। কিন্তু তোরা আমাকে তার সুযোগ দিলি না। তোদের সারপ্রাইজ দিতে এসে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম। এই দিনটার কথা আমি কখনো ভুলবো না। তোদের আমি কোনোদিন ক্ষমা করবো না। কোনদিন না।

কথাগুলো বলে সাফাত চোখের পানি মুছতে মুছতে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। সাফাতকে ডাকতে ডাকতে তাহসিন আহম্মেদও সাফাতেও পিছন পিছন যায়। কণা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কণা বিড়বিড় করে বলে,

তোমার ভালোর জন্য আমি নিজের জীবনও শেষ করে দিতে পারি। সেখানে আমি তোমাকে কী করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতাম?

তাহসিন আহম্মেদ একা ফিরে আসেন। সাফাত উনার সাথে আসেনি। কণা কিছু না বলে সেখান থেকে চলে যায়। সাফাত একটা হোটেলে ওঠে। বুকিং করা রুমে এসেই সাফাত চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। সে মেনে নিতে পারছে না এসব। ঐ দিনের পর থেকে সাফাত সত্যি কণাদের সাথে যোগাযোগ করা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু আড়ালে ঠিকই ওদের খেয়াল রাখতো।

১১

কণা দৌড়ে লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে আসে। পিছন থেকে আভিয়ান আর ঐশি কণাকে অনেক ডাকে। কিন্তু কণা তাদের ডাক উপেক্ষা করে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে আসে। সাফাতও পার্কিং এড়িয়ার দিকে যাচ্ছিল। হুট করে একটা মেয়ে এসে সাফাতকে জড়িয়ে ধরে। মেয়েটাকে দেখে কণার মুখে আলতো হাসি ফুটে ওঠে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here