তুমি আসবে বলে পর্ব -০২+৩

#তুমি_আসবে_বলে
#পর্ব_২+৩
#ইভা_রহমান

সময় পেড়িয়ে এক বছরের কোঠাতে এসে সামিল। এই এক বছরে হিয়া যতোটা পেরেছে নিজেকে শক্ত করে,সমাজের মানুষের করা কটুক্তিকে পেছনে ফেলে নিজের জীবনটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছে। তার মেরুদণ্ড যে কতেটা শক্তিশালী তা সে সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আজো প্রতি রাতে তাকে বিহানের শেষ কথা গুলো বড্ড ভাবিয়ে তুলে। এতো দিনে সে এটা খুব ভালো করে বুঝে গেছে বিহানের প্রতি তার কখনো কোনো ভালোবাসা জন্মেনি বরং বিহানের প্রতি তার যে অনুভূতি ছিলো সেটা শুধু একটা নিরাপদ আশ্রয়ের ঠিকানা। সে বিহানকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চেয়েছিলো ঠিকই কিন্তু ভালোবাসার উপরে ছিলো তার একটা নিরাপদ আশ্রয় পাবার বাসনা। হ্যা তবে বিয়ে হলে একদিন ঠিকই বিহানের প্রতি তার সত্যিকার অর্থে ভালোবাসা জন্মাতো কিন্তু সেটা যখন আর হয়নি তাই সেসব সে গুড়ে বালি চিন্তা করে আর লাভ কি। তাই হিয়া আর চায় না বিহান তার জীবনে আর কখনো ফিরে আসুক কিন্তু সে চায় আসল সত্যে টা জানতে। সে জানতে চায় শুধু কি পরিস্থিতির চাপে পড়েই বিহান এই সিদ্ধান্ত টা নিয়েছে নাকি সব কিছুর পেছনে দায়ী উজান শাহরিয়ার বলে সেই নরপশুটা। যে মানুষকে মানুষ বলেই গণ্য করতে জানে না। এই একটা বছরে বিহানের প্রতি হিয়ার যতোটা না ঘেন্না জন্মেছে তার চাইতে উজানের প্রতি তার মনে আসা তিক্ততা হিয়ার মনের পরোতে পরোতে স্তুপ আকারে বাসা বেঁধে পাহাড় সমান আকার ধারণ করেছে।

!
!

ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজের নকশার পৃষ্ঠাটায় চোখ পড়লো হিয়ার,বাহ! এবারের নকশার ডিজাইন গুলো সত্যি অনেক মনকড়া বলে মনে হচ্ছে। পেপার টা হাতে নিয়ে খুতিয়ে খুতিয়ে দেখতে থাকলো হিয়া। জামার ডিজাইন গুলো তার মনে বড্ড ভালো লেগেছে। টুকিটাকি হাতের কাজ জানায় হিয়া ঠিক করে এবারের বৈশাখে এরকমই একটা জামা বানিয়ে সে উপহার দিবে তার ফুফাতো বোন বুলিকে। তাই পৃষ্ঠা টাকে পেপার থেকে তুলে নিতেই হঠাৎই হিয়ার চোখ যায় চাকরির বিজ্ঞপ্তির পাতাতে। উজান বলে লেখা নাম টার দিকে চোখ পড়তেই চোখ আঁটকে যায় তার। শান্ত হয়ে বসে বিজ্ঞপ্তি টা পড়তে গিয়েই হিয়া পেয়ে যায় তার সেই তাসের তুরুপ। উজান শাহরিয়ারের বড়বোনের এক বছরের বাচ্চা আর তার মধ্যবয়স্ক দাদিমনির দেখাশোনার জন্য একজন আয়ার প্রয়োজন। যার নার্সিং বিষয়ে জ্ঞান আছে তাকেই এই কাজের জন্য দেখেশুনে নিয়োগ দেওয়া হবে। তবে সেই মেয়েকে উচ্চমাধ্যমিক এর কোঠা শেষ করতে হবে আর নিয়ম অনুযায়ী তাকে তাদের বাড়িতেই থাকতে হবে”বিজ্ঞপ্তিটা পড়ে খবরের কাগজ টাকে হাতে নিয়েই হিয়া প্রায় বেশ কিছুক্ষন নিজের রুমে পায়চারি করলো। এই সুযোগ টাই তো সে চেয়ে এসেছিলো এতোদিন। অনেক ভেবে চিন্তে হিয়া সিদ্ধান্ত নিলো সে এই কাজের জন্য এপ্লাই করবে৷ যেই বলা সেই কাজ,ওখানে লিখে দেওয়া নির্ধারিত ওয়েবসাইটে গিয়ে হিয়া তার যাবতীয় ডিটেইলস দিয়ে ফর্ম টা পূরণ করেই তবেই শান্ত হলে। যদি সে সিলেক্ট হয়ে যায় তাহলে যেমন শাহরিয়ার বাড়িতে গিয়ে বিহানের খোঁজ পাওয়া যাবে ওমনি সে এই সত্য মিথ্যের বেড়াজাল থেকে আসল ঘটনা উন্মোচন করতে সক্ষমও হবে। সাথে হিয়া এটাও ঠিক করে নেয় যদি তার এই করুন পরিণতির জন্য উজান বলে লোকটা সত্যি দায়ী থাকে তাহলে সে উজানকেও ঠিক সেরকমই আঘাত দিয়ে বুঝিয়ে দেবে প্রতরণা ঠিক কি জিনিস। কোনো মেয়েকে ঘন্টার পর ঘন্টা বউ সাজিয়ে কাজি অফিসে বসিয়ে রাখা কতোটা হৃদয়বিদায়ক!

হিয়ার যাবতীয় ডিটেইলস দেখে শাহরিয়ার বাড়ির ম্যানেজার তার ফর্মটাকে এ্যাপ্রোভ করে দিয়ে আগামী সপ্তাহের বুধবার হিয়াকে ইন্টারভিউ এর জন্য ডাক পাঠালো,আর সেই উদ্দেশ্য হিয়া এখন প্রস্তুত তার গন্তব্যের পথে রওনা দিতে!

-আমার খুব ভয় হচ্ছে তোর জন্য হিয়া,কি করে একটা অচেনা শহরে তুই একা একা এভাবে।

-কোনো ভয় নেই। এতোটা দূর্বল আমি নই অর্পা। তুই শুধু এদিকে ঔষধজ্যেঠু আর ফুফুকে দেখে রাখিস ওরা যেনো কেউ ঘুনাক্ষরের এটা টের না পায় যে আমি বিহানের খোঁজ নিতে বা উজান বলে লোকটার থেকে প্রতিশোধ তুলতে তাদের শহরে পাড়ি জমাচ্ছি।

-তুই পারবি তো হিয়া। শুনেছি উজান বলে লোকটা নাকি খুবই বদমেজাজি। তার সব সহ্য হয় কিন্তু প্রতরণা আর মিথ্যে তিনি দুচোখে সহ্য করতে পারে না। যদি তুই ধরা পরে যাস তখন।

-ধরা পড়ে গেলেও সমস্যা নেই। দাদি কে বলে মনে নেই তোর। ছেলেদের কাবু করার জন্য মেয়েদের দুটো অস্ত্র আছে এক তাদের মুখের হাসি আর দুই চোখের জল। হাসি দিয়ে সব ছেলেকে কাবু করা না গেলেও প্রত্যেক নারীর চোখের জলের কাছে হার মানতে বাধ্য এই পুরুষজাতি!

-এটা ছেলেমানুষী হিয়া।

-আমার জীবনটাই তো ছেলেমানুষী হয়ে ভোগের বস্তু হিসাবে এখন সবার হাসির পাএ হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্পা। হোক না আরেকটু ছেলেমানুষী…!

-হিয়া(অস্ফুটে)তবে যা করবি সাবধানে আর গিয়েই আমাকে ফোন দিস কিন্তু।

-হুম আর বাড়িতে যেনো কেউ না জানে বিষয়টা কেউ না মানে কেউ না।কেমন।

!
!
সব পেড়িয়ে হিয়া এসে পৌঁছালো তার গন্তব্যে।পা রাখলো উজান শাহরিয়ার এর শহরে তাদেরই এলাকায়।কথা ছিলো শহরের এই নামকরা কাঁচা বাজারের সামনটাতে বাড়ির ম্যানেজার হিয়াকে নিতে আসবে কিন্তু দীর্ঘ এক ঘন্টা অপেক্ষা করবার পরেও সেই ম্যানেজারের খোঁজ নেই উপরন্তু আর কিছু ভেবে না পেয়ে হিয়া সিদ্ধান্ত নিলো সে একাই ঠিকানা খুঁজে শাহরিয়ার কুঞ্জে গিয়ে পৌঁছাবে। যদিও সে ঠিকানা জানে তবুও একদম নিশ্চিত হবার জন্যেই সে একটু সামনে গিয়ে একজন ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলো “দয়া করে শাহরিয়ার কুঞ্জ টা এখান থেকে কোনদিক টায় একটু বলতে পারবেন”লোকটা কথা টা কানে নিতেই বিস্মিত চোখে হিয়ার দিকে তাকিয়ে আরেকবার হিয়ার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকালো। কিছু না বলেই দূত জায়গা প্রস্থান নিতেই হিয়া একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। লোকটা তার দিকে ওভাবে তাকিয়ে কিছু না বলে চলে গেলো কেনো। নিজের মনে আসা প্রশ্নটাকে তুচ্ছ করে হিয়া সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকজন ভদ্রমহিলার কাছে ঠিকানা জানতে চাওয়ার উনিও হালকা হেঁসে দিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালো। ব্যাপারটা কিছু বুঝলো না হিয়া। বিহান তো বলেছিলো শহরে নাকি শাহরিয়ার কুঞ্জ বলতে সবাই এক নামে চিনে তাহলে সবাই এরকম করছে কিসের জন্য।

হিয়ার মনের উথাল-পাতাল ঢেউ টাকে আর বইতে না দিয়েই পেছন থেকে এক পুরুষালী কন্ঠ ডেকে উঠলো হিয়াকে। হিয়া পেছন ফিরতেই দেখতে পারে তার ঠিক এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে এক সুঠাম দেহের সুপুরুষ,সাদা পাঞ্জাবির সাথে সাদা চুড়িদার। হাতে এক ব্লাক ঘড়ি চুল গুলোও নিয়ম করে আছড়ানো। গায়ের রঙ যথেষ্ট সুন্দর সাথে সেই চওড়া ছাতি বলিষ্ঠ তেজ। সাধারণ কিন্তু পরিপাটি পরিমার্জিত সাজসজ্জা যেকোনো নারী মনকে আকর্ষণ করতে যথেষ্ট!নিজের চোখ টাকে সামলে নিয়ে হিয়া এবার কথা শুরু করলো। তাকে হঠাৎ এভাবে পেছন থেকে ডাকার কারণ।

-জ্বী কিছু বলবেন?

-আপনি কি মিস হিয়া মুনতাসীর বলছেন?

-জ্বী বলছি।

-আপনিই কি আজ নার্স হিসাবে ইন্টারভিউ দিতে শাহরিয়ার কুঞ্জে এসেছেন?

-জ্বী। কিন্তু আপনার পরিচয়?

-জ্বী আমি উজান শাহরিয়ার। শাহরিয়ার বাড়ির বড় ছেলে বলছি!

কথাটা শোনামাএই থমকে যায় হিয়া,যেই মানুষটাকে দেখার জন্যেই তার এতো দূর যাএা এতোক্ষণ কি না সেই মানুষটার সামনেই সে দাঁড়িয়ে ছিলো। ওহ মানুষগুলো এজন্যেই বোধহয় তার প্রশ্নের উওরে এরকম বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিলো। হিয়া ভাবতে পারে নি উজান এতো টা সুদর্শন দেখতে হবে। বিহানের ভাষ্য মতে তো উজান দেখতে বখাটে টাইপ ছেলেদের মতো হবার কথা কিন্তু এই কন্ঠে যে এক অন্য রকম গাম্ভীর্যের দেখা পাচ্ছে সে। এতো সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তিত্ব যাকে সে স্বপ্নে চেয়ে এসেছিলো এতোদিন। কি জানি উজান হয়তো শুধুই সুদর্শনের ভান্ডার তার আচরণ টাও যে ঠিক কতোখানি খাঁটি এবার সেটাও না হয় আস্তে আস্তে করে যাচাই করে নেওয়া যাবে!

-আচ্ছা বুঝলাম……আপনার বাড়ি থেকে আমাকে নিতে আসার কথা ছিলো। আমি দীর্ঘ এক ঘন্টা ধরে আপনাদের ম্যানেজারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু সে নেই!

-আমি আন্তরিকভাবে সে জন্য দুঃখিত।আপনি আমাদের বাড়িতে ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন,সে হিসাবে আপনি আমাদের বাড়ির অতিথি। আপনাকে নিতে আসার ব্যাপারে আমাদের আরো সচেতন হওয়া দরকার ছিলো। আপনি আমার গাড়িতে বসুন।আমি আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসছি।

-আপনি!

-কোনো সমস্যা?

-না,,বলুন কোথায় বসতে হবে,,

উজান গাড়ির দরজা খুলে হিয়াকে বসতে দিয়ে নিজে হিয়ার হাতের ব্যাগ টা পেছনে গিয়ে রেখে আসে। বাজারের লোকগুলোর সাথে দু একটা জরুরি কথা বলে নিয়ে উজান এসে ড্রাইভিং সীটে বসে যায়। গাড়ি স্টার্ট দিতে যাবে ওমনি সে খেয়াল করে হিয়ার সীট বেল্ট টা লাগানো নেই। উজান অনুরোধের সুরে বলে উঠে,

-কাইন্ডলি যদি সীট বেল্ট টা লাগিয়ে নিতেন?

উজানের কথা অনুযায়ী হিয়া সীট বেল্ট টা হাতে নেয় ঠিকই কিন্তু এটা কি করে লাগাতে হয় তা তো হিয়া জানে না।

-যদি কিছু মনে না করেন আমি কি সীট বেল্ট টা লাগাতে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?

-জ্বী মানে আমি..

হিয়াকে খানিকটা অপ্রস্তুত দেখে উজান নিজে হিয়ার দিকে ঝুঁকে এসে সীটবেল্ট টা লাগিয়ে দিতে থাকে। আর উজানকে নিজের এতো কাছে আসতে দেখে হিয়া খানিকটা ভয় পেয়ে যায়। উজান এ-ই গাড়ির মধ্যে ওর কোনো ক্ষতি করে দেবে না তো। বিহান তো বলেছিলো উজান বিয়ে সংসার এসবে বিশ্বাস না করলেও মেয়ে নিয়ে ফূর্তি করতে তার জুড়ি মেলা ভার!ভয়ে নিজের সীটে কুঁচকে গিয়ে আরো জড়োসড়ো হ’য়ে যায় হিয়া। না না প্রথমেই এতো দূর্বল হয়ে গেলে তাকে চলবে না,সে যে কাজের জন্য এতোদূর এসেছে সে বিষয়ে তাকে পরিষ্কার সবটা জানতে হবে,হিয়ার সীট বেল্ট টা লাগিয়ে দিয়ে উজান গাড়ি ড্রাইভ করতে শুরু করলো। উজানের কানে ছিলো ব্লুটুথ সেটা দিয়েই সে কথা বলতে শুরু করলো তার সহযোগী নিবিড় এর সাথে;

-তুমি খুব ভালো করে জানো নিবিড় দায়িত্বে অবহেলা আমি একদমই পছন্দ করি না। তার উপর উনি এতোদূর থেকে একটা দীর্ঘ জার্নি করে এসে এভাবে একটা ঘন্টা বাজারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এটা শাহরিয়ার পরিবারের জন্য কতোটা অপমানজনক তুমি বুঝো।

-সরি স্যার,আমি ঠিক সময় গাড়ি নিয়ে বেড়িয়েছিলাম কিন্তু মাঝপথে,

-আমি কোনো এক্সকিউজ শুনতে ইচ্ছুক নই নিবিড়,আই হোপ এরপর থেকে তুমি তোমার কাজের প্রতি আরো দায়িত্বশীল হবে।

কথাটা বলেই অপর পাশ থেকে আর কিছু শোনার প্রয়োজনটুকু বোধ না করেই উজান ফোন টা কেটে দিলো। তার চোখ মুখ দেখে এটা স্পষ্ট যে নিবিড়ের থেকে এরকম একটা কাজ কখনোই সে আশা করে নি। নিবিড়ের এই কাজে সে ভীষণ আশাহত।

-আপনি ওনাকে এভাবে না বললেও পারতেন। মানুষের তো সমস্যা থাকতেই পারে। তবে হ্যা উনি যদি আমাকে ফোন করে ব্যাপারটা বলতো তাহলে আমি অপেক্ষা না করেই ঠিক ঠিকানা খুঁজে পৌঁছে যেতে পারতাম,

-আপনি শহরে নতুন,এতোটাও নিজের উপর কনফিডেন্স থাকা উচিৎ নয়……আপনার বায়োডাটা দেখে যা বুঝলাম আপনি ইংলিশে অর্নাস করছেন তা হঠাৎ পড়াশোনার পাশাপাশি এই কাজে যোগ দিতে চাইছেন?

-আসলে সত্যি বলতে আমি অনাথ। ফুফুর বাড়িতে ছোট থেকে মানুষ। চেষ্টা করি নিজের যতোটুকু সামর্থ্য তা দিয়ে পরিবারে কিছু সহয়তা করতে। আর পরীক্ষা যেহেতু বছরের একদম শেষে তাই ভাবলাম বাড়িতে বসে থেকে আর করবো টা কি। আর যেহেতু ঔষধজ্যেঠুর সাথে কাজ করে নার্সিং এর জ্ঞান টুকু জানা আছে তাই আর সাত পাঁচ না ভেবে এপ্লাই করে ফেললাম।

-দুঃখিত,আমি জানতাম না আপনি অনাথ আর দ্বিতীয়ত্ব আপনার কাজের প্রতি আগ্রহ দেখে জিনিসটা ভালো লাগলো।

-ধন্যবাদ!….আচ্ছা আপনি কি করে বুঝলেন যে আমিই সেই মেয়ে যে আপনাদের বাড়িতে ইন্টারভিউ দিতে এসেছি?

-এই শহরের প্রত্যেকটা মানুষ আমাদের বিশেষত্ব আমাকে চিনেন আর আপনি যেভাবে ব্যাগপএ হাতে নিয়ে সবাইকে জিজ্ঞেস করছিলেন তাই আমি আন্দাজ করে বললাম যে। আর নিবিড়েরও তো আপনাকে এখানেই নিতে আসার কথা ছিলো।

-ওহ!তা ঠিক,

-আপনার কোয়ালিফিকেশন দেখে আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে এখন সবটা দাদিমণির হাতে। উনি আপনাকে দেখে পছন্দ করলেই আপনার চাকরি টা কর্নফার্ম।

-আমি চেষ্টা করবো আপনার দাদির মন রাখতে,আর যেই বাচ্চা টার কথা লেখা ছিলো?

-কে স্পর্শ?সে আমার বড় বোনের ছেলে। এ্যাকসিডেন্টের সময় আপুকে হারিয়ে সে এখন আমাদের কাছেই মানুষ।

-আচ্ছা,আর স্পর্শের বাবা?

-স্পর্শ কে গ্রহন করতে অস্বীকার জানায়। দাদিমণি আর চায়নি ব্যাপারটা জল ঘোলা হোক তাই স্পর্শ আমাদের সাথেই থাকে,

হিয়া একটা দম ছাড়লো,খুলে রাখা জানালার দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠলো,,

-জীবন টা সত্যি কতো অদ্ভুত তাই না। আমার বাবা মা নেই বলে আমি অনাথ আর স্পর্শের বাবা থেকেও সে!

-হুম জীবনটা সত্যিই খুব অদ্ভুদ। আসুন,বাড়ি এসে গিয়েছে। নামুন এবার,,সাবধানে।

-জ্বী!নামছি।

চলবে…..

#তুমি_আসবে_বলে
#পর্ব_৩
#ইভা_রহমান

হিয়াকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই হিয়ারই বয়সী এক তরুণী কোথা থেকে দৌড়ে এসে জাপ্টে ধরলো উজানকে। ব্যাপারটাতে ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেলো উজান। অনেক ভণিতা করে মেয়েটাকে তার চওড়া বুক থেকে সরিয়ে সামনে দাঁড় করাতে সক্ষম হলো। মেয়েটা হাসিমুখে কিছু বলার আগেই তার চোখ পড়লো উজানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হিয়ার উপর। ভূ-কূঁচকে এক পলকেই হিয়ার পা হতে মাথা অবধি পরখ করে নিয়েই সে একটা কৌতূহলী চাহনিতে উজানের দিকে প্রশ্ন ছুড়লো,

-মেয়েটা কে উজান?

-উনি শহর থেকে এসেছেন দাদিমনি আর স্পর্শের নার্স হিসাবে জয়েন করবার জন্য ইন্টারভিউ দিতে।

-আচ্ছা,কিন্তু তাকে তো নিবিড়ের নিয়ে আসার কথা ছিলো। তুমি হঠাৎ?

-নিবিড় ঠিক সময় পৌঁছাতে পারেনি তাই জন্য আমাকেই নিতে আসতে হলো। বাই দা ওয়ে তুমি কি কোথাও এখন বের হচ্ছো মেহু?

-হুম জয়ের বার্থডে উপলক্ষে একটা ছোট্ট গেটটুগেদার এর আয়োজন করা হয়েছে।সেখানেই যাচ্ছি দুপুরের আগেই ফিরে আসবো,,,,থাকো এসে কথা হবে।

উজান কিছু বলার আগেই মোহিনী হিয়ার দিকে একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে বাহিরে বেড়িয়ে পড়লো। উজান হিয়াকে সোজা নিয়ে আসলো তার দাদিমণির রুমে। হিয়ার সাথে ওনার পরিচয় করিয়ে দেবার মুহুর্তেই দাদিমণি আর হিয়া একে অপরকে দেখে বিস্ময়ে তাকিয়ে উঠলো। হিয়া মুখে এক বালতি হাসি টেনে বললো ম্যাম আপনি এখানে?__দাদিমণি উওর দিলো তার বাড়ি সে এখানে না থেকে আর কোথায় যাবে বল দেখি। হিয়া হাসলো। আলতো করে হিয়াকে জড়িয়ে নিলেন উনি। তাদের কথাবার্তা শুনে এটা স্পষ্ট যে তারা দু’জনেই পূর্বপরিচিত। উজান একটু অবাক হলো। বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো আপনারা কি একে অপরকে আগে থেকেই চিনতেন? দাদিমণি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বললো হুম তিনি হিয়াকে আগে থেকেই চিনে৷ মূলত হিয়ার সাথে তার পরিচয় টা ঔষধজ্যেঠুর মাধ্যমে। তার হাঁটুর চিকিৎসার জন্য যখন তিনি ঢাকা গিয়েছিলেন সেসময়ই তার সাথে হিয়ার পরিচয়।

-তাহলে দাদিমণি তুমি ওনার সাথে কথা বলে কি ঠিক করলে আমাকে জানিয়ে দিও। যদি তুমি ওনাকে রাখতে ইচ্ছুক হয়ে থাকো তাহলে আমি আজই ওনার সব থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

-ইচ্ছের আবার কি আছে৷ এ-ই মেয়েকে দেখেই তো আমার মন জুড়িয়ে গেলো। তা হিয়া’মা কতো স্যালারি দিলে তোমার হবে শুনি?

-আমি কি বলবো ম্যাম। আমার তো এ বিষয়ে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। একটা মানসম্মত স্যালারি পেলেই আমি সন্তুষ্ট। আর শুধু কি স্যালারি নিলেই চলবে আমাকেও তো তার বিনিময়ে যোগ্য সেবিকার মতো সেবা দিতে হবে বলুন।

-সেবার তুমি আমার জন্য যা করেছিলে আমি জানি তুমি এবারো ঠিক তোমার যোগ্যতার পরিচয় দিতে সক্ষম হবে।

দাদিমণির কথায় হিয়াকে নিয়োজিত করা হলো তার ও স্পর্শের সেবিকা হিসাবে। গেস্ট রুমের পাশের রুমটাতে ব্যবস্থা করা হলো হিয়ার থাকার। স্পর্শ আপাতত ঘুমোচ্ছে তাই ঠিক করা হলো সে ঘুম থেকে উঠে গেলেই তার সাথে হিয়ার দেখা করানো হবে। দাদামণি হিয়াকে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে বললো দুপুরের খাবারের জন্য ঠিক আড়াইটের দিকে ডাইনিং এ এসে জড়ো হতে। সময়ের ব্যাপারে উজান নাকি বড্ড সচেতন। হিয়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বললো ঠিক আছে আমি সময় মতো খাবার টেবিলে উপস্থিত থাকবো। দাদামণির থেকে বিদায় নিয়ে হিয়া তার রুমে আসলো। ঘড়িতে তখন ২টা ১০ হাতে সময় খুবই কম। তাই এদিক সেদিক না তাকিয়েই হিয়া চটজলদি ওর গোসল টা সেরে নিয়ে বেড়িয়ে আসলো। গায়ে জড়ালো একটা হালকা বেগুনি রঙের সুতির কামিজ। চুল গুলো এখনো চিপচিপে ভেজা তার। মোছার সময় টাও যেনো নেই আর তার হাতে!

দূত পা চালিয়ে হিয়া ডাইনিং এ আসলো৷দেখতে পেলো দাদামণি তার জায়গায় বসে গিয়েছে। তার পাশের চেয়ারে বসে আছে মোহিনী বলে মেয়েটা,তার সামনের চেয়ারে একটা মাঝবয়সী ছেলে,আর তার পাশে একজন মধ্যবয়সী নারী। দাদামণি আর মোহিনীকে চিনলেও অপর দু’জনকে চিনতে বেগ পেতে হলো হিয়ার। ডাইনিং থেকে একটু দূরে ফোনে গভীর এক জরুরি সংলাপে উজানকে মগ্ন থাকতে দেখে হিয়া একটা শান্তির শ্বাস ছাড়লো। যাগ ঠিক সময়ে এসে পৌঁছেছে তাহলে সে। এখনো খাওয়া শুরু হয় নি। টেবিলের কাছে এসে মাঝের চেয়ার টা টেনে হিয়া বসতে যাবে ওমনি মেহু হিয়াকে থামিয়ে দিয়ে রাগান্বিত সুরে বললো”এটা উজানের চেয়ার,তুমি গিয়ে অন্য কোথাও বসো”হিয়া কথা বাড়ালো না চেয়ারটাকে আগের জায়গায় ঢুকিয়ে রেখে পিছন ফিরতে যাবে ওমনি পেছন থেকে আসা উজানের সাথে ধাক্কা খেয়ে বসলো সে। ভেজা চুলের কিছুটা মুহুর্তেই গিয়ে জড়িয়ে গেলো উজানের তিন নাম্বার বোতামের ভাঁজে। চুলে টান পড়তেই আহ বলে হালকা চিৎকার করে উঠলো হিয়া। ব্যাপারটা এতোই দূত হয়েছে যে দু’জনে বুঝতে পারে নি ঠিক কি হচ্ছে। উজান হিয়ার চঞ্চলতাকে থামিয়ে দিয়ে বললো আপনি একটু স্থির হয়ে দাঁড়ান আমি দেখছি। মুহুর্তে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো হিয়া। প্রথমদিনেই এরকম একটা মুহুর্তের সাক্ষী হতে হবে এটা ছিলো তার কাছে পুরো অকল্পনীয়-অবিশ্বাস্যযোগ্য। কতো কাছাকাছি তারা দু’জন। চুলের গিট্টু খুলতে গিয়ে যেনো আরো কাছাকাছি এসে জড়ো হলো দুটো হৃদয়❤️উজানের বুকের ঠিক মাঝ বরাবর রাখা হিয়ার মাথা। স্থির হিয়ার তপ্ত শ্বাস এসে পড়তে শুরু করলো উজানের বোতামের ফাঁক ভেদ করে খোলা বুকের উপর। এক অদ্ভুত অনুভূতি খেলে গেলো উজানের সারা শরীরে। হিয়ার গা দিয়ে ভেসে আসছে এক মিষ্টি সুবাস। যা আরো অস্থির করে তুলছে উজানকে। নারী শরীরের এ কেমন আকর্ষন,কতো মেয়েই তো তার গা ঘেঁসে চলতে চেষ্টা করে রোজ,কতো মেয়ের কথাই বা বলছি কেনো স্বয়ং মেহুই তো সবসময় তাকে ইনিয়েবিনিয়ে জড়িয়ে ধরে থাকে কোথায় তাদের বেলা তো এরকম আকর্ষন কাজ করে না তার। তাহলে আজ হঠাৎ কিছুক্ষণের পরিচয়ে একটা মেয়ের জন্য কেনো তার শরীর এভাবে কাঁপছে। দু’জনে এ মুহুর্তে প্রচন্ড রকমের অপ্রস্তুত হয়ে আছে। কাঁপা হাতের শিরশিরে আমেজ কিছুতেই বোতাম থেকে আর চুল গুলোকে সরাতে পারছেন না। একদিকে উজান চেষ্টা করছে তো আরেকদিকে হিয়া। দুজনের আঙ্গুল গুলো একে অপরের সাথে বারি খাচ্ছে।………এদিকে তাদের দু’জনের এই কান্ডে দাদিমণি সহ নিবিড় সাহেব নীরবে হেঁসে দিলেও দাবা*নলের অগ্নিশিখা এসে বিরাজ করতে থাকে মোহিনীর সারা অঙ্গ জুড়ে। সেই লেলিহান ক্রো*ধের শিখাকে নিয়ন্ত্রণ করতেই ফলের ঝুড়িতে রাখা কাঁ*চি টা হাতে তুলে নেয় মোহিনী৷ উঠে এসে একটানে কে*টে দেয় বোতামে জড়িয়ে থাকা হিয়ার কিছু চুল!!

মোহিনীর এ কাজে সবাই হতবাক। আর হতবাকের পাশাপাশি রাগান্বিত উজান। কি করলো এটা মোহিনী,কাঁ*চি টা তো হিয়ার চোখে গিয়েও লাগতে পারতো। মুহুর্তে চোখ দুটো লাল হয়ে গেলো তার। গম্ভীর কন্ঠে সে এবার ঝারি দিয়ে উঠলো মোহিনীর উপর,

-আর ইউ গোন এন ইনসেন্স মেহু। কি করতে যাচ্ছিলে এটা তুমি। একটু এদিক ওদিক হলেই কাঁ*চি টা চোখেমুখে লেগে একটা মারা*ত্মক ক্ষ*তি হতে পারতো ওনার!

-হলে তাই হতো?

-হোয়াট!

-তুমি এখন এ-ই বাহিরের মেয়ের জন্য আমাকে কথা শুনাবে উজান?

-তুমি ভুল করলে আমি অবশ্যেই তোমাকে শা*সন করবো। আর উনি বাহিরের কেউ নন।উনি দাদিমণির নার্স। আজ থেকে উনি এ বাড়িতে থাকবেন,তাই ওনার ভালোমন্দ দেখে রাখার দায়িত্ব এখন আমাদেরই।

-সেই তো। দায়িত্ব!

ব’লেই হনহন করে ডাইনিং ত্যাগ করলো মেহু। ঘটনা টা এভাবে মোড় নিবে হিয়া বুঝতে পারে নি। তবে এটা সে বুঝতে পেরেছে মেহু তাকে এ বাড়িতে বেশিদিন হয়তো স*হ্য করবে না।

-কি হলো,আপনি দাঁড়িয়ে দেখছেন কি,খেতে বসুন।

উজানের গম্ভীর কন্ঠে হুঁশ ফিরলো হিয়ার,”হু হ্যা করে বসছি”বলতে বলতে বসে পড়লো নিবিড়ের পাশের চেয়ায় টাতে,শার্টের হাতা গুলো ভালো করে ফ্লোড করে নিয়ে উজান নিজের চেয়ারে বসে গেলো। কিছু সার্ভেন্ট এসে সবাইকে খাবার সার্ভ করে দিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে গেলো। নিশ্চুপ এই থমথমে পরিবেশ টাকে শান্ত করতে নিবিড়িই কথা শুরু করলো,

-আপনি তাহলে মিস হিয়া মুনতাসীর,

-জ্বী,

-আমি নিবিড়। স্যারের এ্যাসিটেন্ট,এ বাড়ির যাবতীয় কাজের ম্যানেজার। আজ আমারই আপনাকে নিতে আসার কথা ছিলো কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত গাড়িটা মাঝ রাস্তায় খারাপ হওয়াতে আমি ঠিক সময়ে আপনাকে নিতে আসতে পারিনি। তার জন্য আমি গভীরভাবে দুঃখিত

-সমস্যা নেই। জীবনে তো সমস্যা বলে কয়ে আসে না,আপনি নিতে না আসলে আমি ঠিক ঠিকানা খুঁজে চলে আসতে পারতাম।

-হুম,ধন্যবাদ!

আবার কিছুক্ষণ নীরবতা কাটিয়ে উজান একটা সার্ভেন্টকে ডেকে বললো মোহিনী ম্যামের রুমে খাবারটা নিয়ে যেতে। উজান বলা মাএই সার্ভেন্ট টা তার কাজে লেগে পড়লো। এদিকে এবার নীরবতা কাটিয়ে দাদিমণি একটা বিষয়ে কথা তুলতেই কপালের রগ ভাঁজ হয়ে আসলো উজানের।

-হয়েছে না হয় তাহেরের কিছু ভূল। তাই বলে তুই ওনাকে এভাবে তাড়িয়ে দিতে পারিস না উজান।

-আমি তোমাকে এ বিষয়ে আগেই বলেছি দাদিমণি উনি আমাদের সাথে প্রতরণা করেছেন। আমাদের মিথ্যে বলে আমাদের ব্যবসার অনেক টাকা আত্ম*সাৎ করেছেন,ওনার প্রয়োজন ছিলো সেটা উনি এসে আমাকে একবার বললেই পারতো। আমি ওনার প্রয়োজনের চাইতেও ওনাকে দ্বিগুণ ধরিয়ে দিতাম। কিন্তু তা না করে উনি ছলনায় আশ্রয় নিয়েছেন৷ আর এই সব প্র*তরণা,মিথ্যে আমি একদমই ঘে*ন্না করি তুমি খুব ভালো করে জানো সেটা,তাই আমি আশা করবো তুমিও এ বিষয়ে আর কখনো কোনো প্রশ্ন তুলে আমাকে অপ্রস্তুত করবে না।

উজানের কথায় দমে গেলো দাদিমণি,দাদিমণির চোখেমুখে হিয়া দেখতে পেলো এক অসহায়ত্বের চিহ্ন,

-আর একটা কথা। মোহিনীকে বুঝিয়ে দেবা এটা ঢাকা শহর না,যে ও ইচ্ছে মতো যেমন খুশি সেরকম জামাকাপড় পড়ে দিব্যি ফ্রেন্ডদের নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়ে যাবে। এটা শাহরিয়ার কুঞ্জ। এখানে এসব শহুরে চালচলন আমি একদমই সহ্য করবো না। শালীনতার সীমার মধ্যে থেকেই একটা মানুষের সবকিছু করা উচিৎ বলে আমি মনে করি….আশা করি মিস মুনতাসীর ও এ ব্যাপারে আমাকে নিরাশ করবেন না,যদিও আপনি ঢাকা শহরে মানুষ..!!

হিয়া কিছু বলতে পারলো না। শুধু নিজের সর্বস্ব দিয়ে হজম করে নিলো উজানের প্রত্যেকটা কথা। বিহান তাকে উজানের ব্যাপারে যে বিবরণ শুনিয়ে এসেছিলো এতোদিন তার বিন্দুমাএ ছিটেফোঁটাও সে এখন অবধি উজানের মধ্যে আবিষ্কার করতে সক্ষম হলো না উপরন্তু উজানের কথাবার্তা থেকে শুরু করে কথা বলার সময় এক অনন্য গাম্ভীর্য আর সাবলীল ব্যক্তিত্ব এই অল্পক্ষণের মধ্যেই এক অন্যরকম জায়গা তৈরি করে নিতে থাকলো হিয়ার মনে। উজান যে ভীষণ একরোখা তা তার কথাবার্তা শুনেই আন্দাজ করে নিতে পারলো হিয়া। সাথে এটাও সে উপলব্ধি করলো উজান ভীষণ রক্ষণশীল একজন মানুষ!

!
!
!
খাবার শেষে যে যার রুমে আসলো,ভেজা চুল গুলো দিয়ে এখনো টুপটুপ পানি ঝরছে হিয়ার। সেগুলো এবার ভালো করে না মুছলেই নির্ঘাত জ্বর সর্দি বিনা নিমন্ত্রণে এসে হাজির হয়ে যাবে। পেছন ফিরে চুল গুলো ঝেড়ে নিচ্ছিলো হিয়া এর মধ্যে কখন যে উজান এসে তার পেছনে দাঁড়িয়ে গিয়েছে বুঝতে পারেনি সে। চুল ঝারা শেষে মুঠো ভর্তি চুল গুলো এক টানে পেছনে মেলে দিতেই চুলের আগায় লেগে থাকা পানি গুলো সব বৃষ্টি হয়ে টুপটাপ ঝড়ে পড়লো উজানের বুকে আর হাতে আর অল্পকিছু কণা ঝরে পড়লো মুখের কোণে। এক দু বার মিটে মিটে চোখের পলক ফেললো উজান,হিয়া পেছন ফিরতেই উজানকে দেখে রীতিমতো ভ*য় পেয়ে গেলো। নিজের দিকে তাকাতে গিয়ে খেয়াল করলো গায়ে তার ওড়না জড়ানো নেই। মুহুর্তেই চোখ নামিয়ে নিলো হিয়া,বিছানা থেকে নিজের ওড়না টা তুলে গায়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। উজান হিয়ার দিকে চোখ বুলিয়ে পেছনে ফিরলো। বুড়ো আঙ্গুলে চাপ দিয়ে চিবুকের কানিতে লেগে থাকা পানি টা মুছলো।

-আমি বুঝতে পারি নি,আমার উচিৎ ছিলো নক করে আসা?

-সমস্যা নেই,বলুন কি বলবেন?

উজান হিয়ার দিকে মুখ ঘুরে তাকালো কিন্তু হিয়ার চোখে চোখ রাখলো না,

-মোহিনীর ছেলেমানুষীর জন্য আমি আপনার কাছে আন্তরিক ভাবে দুঃখিত,মেয়েটা আসলে ছোট থেকে অনেক জে*দী আর কেনো জানি না আমার ব্যাপারে একটু প*জেসিভ তাই আপনাকে আর আমাকে একসাথে ওভাবে দেখে…

-আমি কিছু মনে করিনি। কিন্তু ও যেভাবে কাঁচি নিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসছিলো একটু অসাবধান হলেই আমার অনেক বড় ক্ষ*তি হতে পারতো,

-এরপর থেকে এসব বিষয়ে আরো যত্নবান হবার চেষ্টা করবো। আসুন..

-কোথায় যাবো?

-দাদিমণি আপনাকে ডাকছে। স্পর্শ ঘুম থেকে উঠে গেছে।

-ওহ!ঠিক আছে আপনি চলুন,আমি আসছি।

উজান চলে যেতেই হিয়ার ফোনে ফোন আসলো অর্পার,হিয়া এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে নিয়ে খুব সন্তপর্ণে ফোন টা রিসিভ করলো,ওপাশ থেকে অর্পার চিন্তারত কন্ঠ স্পষ্ট বোঝা গেলো,

-আমি ঠিক আছি অর্পা,তুই কি আমাকে এতো দূর্বল ভাবিস বল তো?

-সে যাই হোক,সাবধানে থাকবি। আর হ্যা বললি না তো উজান বলে মানুষ টা ঠিক কি রকম?

-বুঝতে পারছি না অর্পা,বিহান আমার মনে লোকটার যেই প্রতিচ্ছবি তৈরি করে দিয়েছিলো উনি তার থেকে একদম আলাদা জানিস,পরিমার্জিত সাজসজ্জা,কথা বলার সময় এক গাম্ভীর্য,চাল চলন থেকে শুরু করে সবকিছু এতো পরিপাটি…

হিয়ার কথা শেষ না হতেই অর্পা হেসে দিলো

-প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আবার প্রেমে পড়ে যাস না বান্ধবী। মনে রাখবি দুই ভাই’ই কিন্তু একই রক্তের!

-সে আর বলতে,একবার ভালোবেসে ঠকেছি দ্বিতীয়বার সেই ভুল করবো না। আমি শুধু সত্যি টা জানতে এসেছি সত্যি টা জানা হয়ে গেলেই আমি আমার উদ্দেশ্যকে সফল করে ঠিক কেটে পড়বো। লোকটাকে বুঝিয়ে দেবো একটা মেয়েকে বিয়ের সাজে বসিয়ে রাখা ঠিক কতোটা যন্ত্রণা*দায়ক!

অর্পার সাথে কথা টুকু বলে পেছন ফিরতেই আঁতকে উঠে হিয়া। ঘরের দরজার ঠিক সামনে বুকের কাছে হাত দুটোকে ভাজ করে হিয়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহু!তাহলে কি মেহু সব শুনে ফেললো এবার!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here