#তুমি_কোন_কাননের_ফুল
#অষ্টম_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
নয়নতারা উদভ্রান্তের মতো চাইলো আদনানের দিকে। টেবিলের উপর থেকে কাঁপাকাঁপা হাতে পানির গ্লাস নিলো। পানি পান করে, টিস্যু দিয়ে কপাল মুছলো, মুখ মুছলো। আদনান খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে মেয়েটাকে। হাত হালকা মুষ্ঠিবদ্ধ করে নিজের গালে ঠেকিয়ে বলল,
“আমাকে বিয়ে করতেই হবে, এই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন নয়নতারা। কথাটা আগেও বলেছি, এখনো বলছি। উত্তেজিত হবেন না প্লিজ। আমি আপনাকে মন থেকে হেল্প করতে চাই। নির্দ্বিধায় যেমন এত কিছু বলেছেন, তেমন-ই নির্দ্বিধায় একজন ভালো বন্ধু ভাবতে পারেন। আপনি কি অসস্তি বোধ করছেন?”
আদনানের প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে নয়ন বলল,
“আমি কি এখন আসতে পারি? আমার খারাপ লাগছে। অসহ্য লাগছে। বাসায় যাবো।”
“শিওর, আমি কি সাথে আসবো? বাড়িতেই যাবো, সো আপনি চাইলে একসাথেই আসতে পারি। আসবো কি?”
নয়নতারার ঝটপট উত্তর,
“না। আমি একা চলেই অভ্যস্ত।”
আদনান আর বাঁধা দিলো না। কারন সে জানে, এই মেয়েটা ভীষণ একরোখা। সে নিজের ছাড়া আর কারো কথা শোনে না। বাঁধ সাধতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। আদনানের মনে হঠাৎ প্রশ্ন জাগে,’আচ্ছা? আরজু ছেলেটা হলেও কি শুনবে না?’ নিজে নিজেই উত্তর দেয়, অবশ্যই শুনবে। ভালোবাসার মানুষকে প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা খুব কম মানুষকেই দেন বিধাতা। এই মেয়েটার মাঝে নেই খুব সম্ভবত। থাকলে সে এখনও তার আশায় থাকতো না। মনে রেখে দিতো না নিশ্চই। নয়নতারার চলে যাওয়ার পথে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুঝলো আদনান। মনে মনে একটা কঠিন কমিটমেন্ট করলো। যেই কাজ এতদিন এই মেয়ে করে নাই, সেই কাজগুলা সে করবে। প্রিয় মানুষদের খুশি-ই-বা কয়জন উপহার দিতে পারে? যদিও আদনান জানে না ঠিক খুশিটা উপহার দিতে পারবে কি-না তবুও চেষ্টা করতে তো দোষ নেই!
আদনানের সাথে পরিচয়টা খুব একটা ঘটা করে হয়নি নয়নতারার। ওরা এখন যেই বাড়িটায় থাকে সেই বাড়ির পাশের বাড়িটাতে থাকে আদনানের পরিবার। আদনানের মায়ের সাথে নয়নতারার মায়ের খুব ভাব। দুজন দুজনের বাড়িতে আশা-যাওয়ার বিস্তর আনাগোনা। আদনানের সাথেও দেখা হয়েছে মাঝেসাঝে। একদিন হুট করেই আদনানের মা আবদার করে বসলো তার ঘরের রাজরানী করে রাখতে চায় নয়নতারাকে। নয়নতারা শোনার পর খুব রাগারাগি করলো। এক পর্যায়ে জানতে পারলো, আদনানের পছন্দের কারনেই তার মায়ের এত আগ্রহ।
এরপর অনেকটা জিদ করেই আদনানের সাথে দেখা করেছিল। বেশকিছু কড়াকড়া কথাও শুনিয়েছিল।
এইবার কেন যেনো এই অচেনা ছেলেটাকে সবটা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল। বলতে ইচ্ছে করার শক্তপোক্ত কারন অবশ্য একটা ছিলো।
আরজু আর এই ছেলেটা আকাশ পাতাল তফাত। একজন হরবর করে মনের কথা বলে দিতে পারে আরেকজন আমতা আমতা করতে করতেই দিন পার করে ফেলে। একজন চুপচাপ আরেকজন অস্থির স্বভাবের। তবুও এই দুই স্বভাবের দুই মানুষের মাঝে কমন একটা মিল আছে। দুজনের কেউ-ই নয়নতারার কান্নাটা ঠিক নিতে পারে না।
সেদিন যখন নয়ন আদনানের সামনে কেঁদে ফেললো, আদনান খুব ঘাবড়ে গেলো। আরজু যেমন অস্থির হয়ে পাগল পাগল করছিলো। আদনানও তেমন অস্থির হয়ে বলেছিলো, “প্লিজ কাঁদবেন না। আমি কি বাজে কিছু করে ফেলেছি? বলুন আমায়! এই মেয়ে? এভাবে কাঁদে কেউ? ওকে, বিয়ে ক্যান্সেল!”
সেদিন এক মূহুর্তের জন্য আদনের জায়গায় আরজুকে আবিষ্কার করেছিলো। অনেকদিন বাদে কারো সাথে প্রিয় মানুষটার মিল পেয়ে পুরোনো অনুভূতিটা বলে দিতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। আর সেই ইচ্ছে থেকেই আজ দেখা করা, সবটা বলা।
.
নয়নতারা রাস্তায় বেড়িয়ে একটা রিকশা নিলো। অনবরত ঘামছে মেয়েটা। এই প্রথম গলগল করে কাউকে তার অনুভূতির কথা বলেছে সে। উঁহু, প্রথম না। আরো একজন জানতো। নয়নতারার দাদু। মানুষটা বেঁচে নেই দের বছর হলো। ওর পর এই মানুষটাই আরজুর কথা স্মরণ করতো প্রতিনিয়ত। দাদু মারা যাওয়ার দুই মাস পর আরজুর সেই পাখিটাও মারা গেলো। ওরা ঢাকা ছেড়ে আসার সময় পাখিটাকে সাথে করে নিয়ে এসেছিলো। সবার নিষেধ মেনে এক প্রকার জোর করেই নিয়ে এসেছিলো। পাখিটা যখন ডাকতো তখন মনে হতো কোথাও না কোথাও হতে সেই ছেলেটা দেখছে আর হাসছে। নয়নতারা কয়েকবার খুব চেষ্টা করেছিলো পাখিটার মুখ থেকে ‘ফুলটুসি’ ডাকটা শুনতে। কিন্তু পারেনি। যতবারই বলতো, ‘একবার ফুলটুসি বলে ডাক প্লিজ!’
ততোবারই পাখিটা মুখ ঘুরিয়ে থাকতো। গুরু আজ্ঞা সে যথাযথ ভাবেই পালন করে গিয়েছে শেষ অব্দি। পাখিটাই ছিলো ছেলেটার একমাত্র স্মৃতি। সে-ও রইলো না শেষমেশ।
খুব কাছের কেউ-ই নেই তার। ঢাকা থেকে চলে আসার পর তানিশার সাথেও তেমন যোগাযোগ হয়নি। মা বাবার উপর চাপা ক্ষোভের কারণেই তাদের সাথে তৈরি হয়েছে দূরত্ব। বোন দুটো হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। সে একা, ভীষণ একা। আর তার এই একাকীত্বের সঙ্গী কিছু ধুলো পড়া পুরোনো স্মৃতি। যেখানে আগাগোড়া একটা উদ্ভট ছেলের বিচরণ।
একের পর এক বিয়ে ভেঙেছে ছেলেটার জন্য, তবুও একটাবার তার খোঁজ নেয়নি। ইচ্ছে হয়নি তা কিন্তু নয়, তবে ইচ্ছেটাকে প্রাধান্য দিতে দেয়নি তার অবচেতন মন। ওকে ঘিরে পজেটিভ চিন্তাটা যেন নেগেটিভ চিন্তায় রূপান্তরিত না হয় সেটাই কারণ।
.
নয়নতারার বাসায় আসতে আসতে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে নামলো। তার মনে জমে থাকা সুপ্ত অনুভূতিগুলো ও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে গেলো সেই সাথে। বাসায় ঢুকতেই নিহা আর নয়না ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো। দুই বোনকে বাসায় দেখে বিস্মিত হলো নয়নতারা। বিস্ময় নিয়েই জিজ্ঞেস করলো,
“তোরা কখন আসলি? আগে বলিসনি তো!”
দুজনই এক গাল হেসে বলল,
“সারপ্রাইজ আপু।”
নিহা বলল,
“আগে বলে আসলে কি সারপ্রাইজড হতি?”
নয়না বলল,
“এসব বাদ দে। আগে বল, আদনান ভাইয়াকে কেমন লাগে তোর? আমাদের কিন্তু হেব্বি লাগে রে। কত্ত ইনোসেন্ট।”
নয়নতারা অন্যমনস্ক হয়ে বলল,
“আরজুকেও তো তোদের ভালো লাগতো! মনে রেখেছিস? ঠিকই তো ভুলে গেলি! তার উপর পড়া খারাপ তকমাটাও মেনে নিলি। ভালো লাগা, খারাপ লাগা বলতে কিচ্ছু হয় না। যা হয় তা হচ্ছে, জঘন্য কিছু অনুভূতি। আমার হয়েছে, তোদের হয়নি। কখনো যেন না হয়।”
বলেই রুমে চলে গেলো নয়নতারা। নিহা আর নয়না আকস্মিক কথার প্যাঁচে পরে থমকালো। অনেকদিন পর কারো কথা মনে পড়লো। অনেক ভাবার পর অনুভব করলো, সত্যিই তারা আরজুকে ভুলে গিয়েছে। একদম ভুলে গিয়েছে! আশ্চর্য!
নয়নতারা রুমে এসে ব্যাগটা রেখে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। দূরের আকাশে জ্বলজ্বল করা চাঁদটার দিকে তাকিয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে।
খুব মনে পড়ছে আরজুর সাথের শেষ সুন্দর স্মৃতিটা। আচ্ছা? আরজু কি জানে, আজও একটা মেয়ে তার আপেক্ষায়! মনের পুরোটা জুড়ে আজও তার বিস্তর বিচরণ!
নয়নতারা ভাবে, কেন চাঁদের মতো সুন্দর মানুষের জীবন হয় না! সুন্দর স্মৃতিগুলোর ফ্রেমে এক জীবন বন্দি করে রাখা গেলে কেমন হতো?
নয়নতারার ফোন বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে ‘আদনান হাবিব’ নামটা। প্রথম রিংয়েই ফোন তুললো মেয়েটি। ওপাশ থেকে সুন্দর পুরুষালী কন্ঠে ভেসে আসলো,
“আসসালামু আলাইকুম।”
নয়নতারা সালামের জবাব নিলো।
“ওয়া-আলাই-কুমুস সালাম!”
আদনানের ব্যাস্ত প্রশ্ন,
“কেমন আছেন? বাড়ি ফিড়েছেন?”
নয়নতারার ঠান্ডা জবাব,
“হু”
“মনটা কি বেশি খারাপ নয়নতারা?”
“না।”
“গুড, ভেরি গুড। ফুলদের মন খারাপ মানায় না। ফুলদের প্রাণবন্ত থাকাটাই সোভা পায়।”
“আমাকে ফুল বলবেন না। আর এভাবে কথাও বলবেন না। আমার সহ্য হয় না। অসহ্য লাগে।”
“কোন ভাবে?”
“কোনো ভাবেই না।”
বলেই ফোনটা রেখে দিলো। মেয়েটা বলতে পারলো না, ‘আপনি এভাবে কথা বললে, আমার একজনের কথা মনে পড়ে। খুব বেশি মনে পড়ে! খারাপ লাগে, কষ্ট লাগে, অসহায় লাগে!’