তুমি কোন কাননের ফুল, পর্ব:৬+৭

#তুমি_কোন_কাননের_ফুল
#ষষ্ঠ_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

সেই মূহুর্তে তার কাকুতিমিনতি টা আমি প্রাধান্য দিলাম না। বলা চলে, দেয়ার মতো পরিস্থিতে ছিলাম না। রাগে-জিদে, অভিমানে কান্নার পরও আমার মন শান্ত হলো না। রেজাল্ট খুব ভালো হয়েছে জানার পর ছেলেটাকে ভয়াবহ কিছু করে ফেলতে ইচ্ছে হলো। নিজের পরিবারটার উপর ও চাপা রাগ অনুভব হলো। তারা ও জানতো, আমি কতটা চিন্তায় ছিলাম। কতটা ভয়ের মধ্যে ছিলাম রেজাল্ট নিয়ে। তারপরও কি করে সবাই মিলে প্রাংক করার চেষ্টা করলো?
এই ভাবনাটা আমার খুব বেশি দিন থাকলো না। যখন দেখলাম সে আগের মতো মজা করছে না, পাগলামি করছে না, আমাকে ক্ষ্যাপাচ্ছেও না তখন আমি উপলব্ধি করলাম, আমার সেদিনের কর্মকান্ডে সবাই বিব্রত হয়েছে। এই বিষয়টা অনুধাবন করার পর খুব লজ্জা লাগলো। এভাবে কেঁদে ফেলে খুব বেশি বাচ্চামো করে ফেলেছি। কান্নাকাটি করে ভাসিয়ে ফেলার মতো তেমন কিছুই সে করেনি। এমন মজা সে প্রায়শই করে। তবুও আমি ব্যাপারটা নিতে পারি নি। সে কারণেই হয়তো অমন করে কেঁদে ফেলেছিলাম।

যাইহোক, এরপর বাড়ির কাছের ভালো কলেজ টাতেই এডমিশন নিলাম। আম্মুর ইচ্ছে ছিলো দূরের ভালো কোনো কলেজে দিবে। কিন্তু আমার জেদ, এত দুরে গিয়ে আমি পড়বো না। আব্বুর আদরের কন্যা হওয়ার সুবাদে আমার ইচ্ছেটাই প্রধান্য পেলো।
রেজাল্টের পর থেকে ভর্তি হয়ার আগ অব্দি তার সঙ্গে দেখা-টেখা হতো না, বললেই চলে। ‘
সে-ই আমার আশেপাশে কম আসতো। দূর থেকে দেখত। চোখে চোখ পড়লে শুধু একটু হাসতো। ধরা পরে যাওয়া টাইপ হাসি। সুন্দর দেখাতো, ভালো লাগতো। সে এভাবে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার ফলে কিনা জানি না, তার জন্য আমার মনে প্রগাঢ় মায়ার সৃষ্টি হলো।
আমার ইগোর কারনে কখনই তাকে বুঝতেই দেইনি যে, আমি তাকে মিস করছি কিংবা তার জন্যে মায়া অনুভব হচ্ছে। তার এই পরিবর্তনটাতে আমি মারাক্তক অসন্তুষ্ট সেটাও প্রকাশ করিনি। প্রকাশ করা ব্যাপারটা আমার স্বভাবে নেই। সব কিছু প্রকাশ করতে হয় এমন তো কোনো কথা নেই, তাই না?
এভাবেই চলে গেলো বেশ কিছু দিন। সেও ব্যাস্ত থাকে, ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়। তবে আমার ধারনা এর আগে পড়াশোনা না করে যেই ফাঁকিবাজি মেরেছিলো, সেই ফাঁকিবাজিটাই তখন উশুল করছিল সারা দিন-রাত পড়ে।
তার মা আমায় খুব পছন্দ করতো। আমাকে দেখলেই খুশি হয়ে যেতেন। কেন এত পছন্দ করে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারলাম, তার বড় মেয়ে নাকি দেখতে আমার মতো। আমাকে দেখলেই নাকি তার মেয়ের কথা মনে পড়ে। সাত মাসেও যখন তার বোনকে আসতে দেখিনি, তখন জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপু আসে না কেন? কই সে?’
আন্টি তখন নানান কথায় প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলতো। যেহেতু খুব সীমিত কথা বলতো, সেহেতু এই রহস্যের সমাধান আর করা হয়ে উঠেনি।
আঙ্কেল মারা গিয়েছিল অনেক আগেই। ভালো মানুষ গুলো বোধহয় বেশিরভাগ সময় নিঃসঙ্গ হয়। সেও একা তার ছেলেটাও একা। ছেলেদের কত বন্ধু থাকে। কিন্তু তার কোনো বন্ধু নেই। আমি দেখি নি। অদ্ভুত!
.
.
তখন আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সময়। সারাদিনই থেমে থেমে বৃষ্টি হয়। বৃষ্টির পর আকাশটাকে আরো খানিকটা সুন্দর করতেই বোধহয় এই বিশাল চাঁদটার আগমন ঘটে। বৃষ্টি শেষে যখন আকাশটা আলোকিত করতে সুন্দর চাঁদটা আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে, তখন আমি মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করি। শেষ কয়েকদিনে রোজ একবার করে সন্ধ্যের পর ছাদে আসাটা যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে আমার। চাঁদনীরাত, থেকে থেকে চিরিচিরি বৃষ্টির ফোটা! পরিবেশটা খুব শান্তির। সেই সাথে আমার কিশোরী মনের কিশোরী ভাবনা। বেশির ভাগ ভাবনা জুড়েই একজন মানুষের বিস্তার। সেদিনও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জোছনা বিলাস করছিলাম। পাশ থেকে মৃদু স্বরে ভেসে আসলো,
“কে বেশি সুন্দরী? আমার পাশে দাঁড়ানো ফুলের মতো সুন্দর এই মেয়েটা নাকি উপরের ঐ চাঁদ সুন্দরী?”
আমি পাশে ফিরে তাকালাম। কালো টি-শার্ট আর টাউজার পরিহিত ছেলেটাকে দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। বা হাতে বেল্ট টাইপ কিছু প্যাঁচানো। এটা দেখে আমার মনে এবারও সেই পুরোনো প্রশ্ন উঁকি দিলো, ‘ভালো ছেলেরা কি এগুলা হাতে পরে? বখাটে!’
সে নির্বিকার ভঙ্গিতে আকাশের দিকে চেয়েছিলো তখনও। আমার মনটা হঠাৎ-ই খারাপ হয়ে গেলো। পাশে দাঁড়ানো যুবক টাকে নিজের অবচেতন মনের কল্পনা বলে বোধ হলো। আজকাল তাকে নিয়ে খুব বেশি ভাবি বলেই হয়তো এমনটা হচ্ছে। না চাইলেও ততদিনে , আমার মনে, মস্তিষ্কে সবখানেই তার আগমন ঘটে গিয়েছিলো। হুটহাট আসে, হাসায়, রাগায়, মন খারাপ করিয়ে আবার ফট করে চলে যায়। আমি ভাবি, এ আমার কি হয়ে যাচ্ছে! এমনটা তো হওয়ার ছিলো না!
আমার মন খারাপের ভাবনার মাঝেই আবারও সেই মানবীয় কন্ঠটা ভেসে আসলো।
“ফুলটা বেশি সুন্দর। অনেক সুন্দর, অনেক অনেক বেশি সুন্দর। অনেক প্রিয় ফুল আমার। চাঁদের সৌন্দর্য ও তার কাছে ফিঁকে”
আমার কপাল কুঁচকে এলো। পুনরায় পাশে ফিরলাম। আগের মতোই দাঁড়ানো। ছাদের গ্রিল ধরে দাঁড়ানো, আকাশের দিকেই তার দৃষ্টি। বুঝলাম, সে এখন আমার কল্পনা নয়, বাস্তবেই। একবার ইচ্ছে হলো সেখান থেকে চলে আসি, আবার ইচ্ছে হলো আরো কিছুক্ষণ থাকি। আমার এই দোটানার ভাবনার মাঝেই হঠাৎ সে আমার চোখে দু হাতে আবদ্ধ করে নিলো। আমি হকচকিয়ে গেলাম। সে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদু কন্ঠে বলল,
“আবার কেঁদে ফেলো না,প্লিজ। একটা সুন্দর দৃশ্য দেখাবো বলেই চোখে হাত রেখেছি। রাগ করো না, কেমন?”
আমি শুধু বললাম,
“কিছু দেখতে পাচ্ছি না। ছাদ থেকে ফেলে দিবেন কি আমায়?”
সে হো হো করে হেসে ফেললো। ছেলেটা ভীষণ পঁচা। আমি কিছু বললেই হাসে। আমাকে কিছুদূর এগিয়ে নিয়ে চোখ থেকে হাত সরালো। বলল,
“যার কান্না-ই সইতে পারি না, তাকে আঘাত কেমনে করি বলো? যার সেই দুঃখি দুঃখি মুখটা মনে পড়লেই দম বন্ধ লাগে, তাকে আবারও দুুঃখ পেতে কেমনে দেই বলো?”
আমি চোখ মেলে মুগ্ধ শ্রোতার মতো তার দিকে চাইলাম। সে হালকা হাসলো। চোখের ইশারায় সামনে তাকাতে বলল। আমিও বাধ্য মেয়ের মতো সামনে তাকালাম। অবাক হলাম, বিমোহিত হলাম। ছাদের এক কোনায় নয়নতারা ফুলের গাছ। আর সেই ছোট গাছটাকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু জোনাকিপোকা ঘুরে ঘুরে জ্বলছে-নিভছে। কি যে সুন্দর সেই দৃশ্য। পাশেই তার পোষ মানানো সেই পাখিটা তার নিজ স্বরে বলে উঠলো,
“সুন্দর, সুন্দর। নয়ন-তা-রা, জোনাকি-পোকা, সুন্দর, সুন্দর চাঁদ।”
আমি হেসে দিলাম। খিলখিল করে হাসলাম। সচারচর আমি শব্দ করে হাসি না। সেদিন হাসলাম। জোনাকি ছুঁতে চাইলাম। একটু ছুঁতে পারলেই চেঁচিয়ে উঠলাম। দেয়ালে হেলান দেয়া মুগ্ধ মানুষটাকে নজরে পড়লো না তখন। আমি বিমোহিত হচ্ছি তার তৈরি করা মুগ্ধতায়।
ততক্ষণে চাঁদ হারাতে আরম্ভ করেছিলো মেঘের আঁড়ালে। চিরিচিরি বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়ছিলো চোখে, মুখে। আমি মুখ আকাশ পাণে তাক করে দাঁড়ালাম। আমার ঠিক পাশে এসে দাঁড়ালো ছেলেটা। আমি মুখ ঘুরিয়ে তাকালাম তার দিকে। সে তাকাতেই আমি মৃদু হাসলাম। খুব সম্ভবত কোনো কারন ছাড়া সেবারই প্রথম তার দিকে তাক করা আমার হাস্যজ্বল মুখ। আমার এলোমেলো চুলগুলো উড়ে উড়ে তার মুখে পড়ছে আর সে খুব যত্নে তা সরাচ্ছে আর মিটমিট করে তাকাচ্ছে। মৃদু আলোতে এই চুল সরানো খেলাটায় আমি বেশ মজা পেলাম। মানুষ কোনো কাজে একবার মজা পেয়ে গেলে, সেই কাজ সে বারংবার করতে থাকে। হোক সেটা ভালো কিংবা খারাপ, মজার কিংবা অ-মজার! আমিও মজা পেয়ে একই কাজ বারংবার করতে লাগলাম। সে চুল সরায় আর আমি মাথা ঝাঁকিয়ে পুনরায় চুলগুলো তার চোখেমুখে আছড়ে ফেলি। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর সে আমার চুল গুলো মুষ্ঠিবদ্ধ করে নাকের কাছে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘ্রান শুকলো। আমি সেই ছেলেটাকে দেখলাম এবং হঠাৎ-ই অনুভব করলাম, আজ তার মাঝে কোনো চাঞ্চল্য নেই। কেমন যেন অদ্ভুদ শান্ত সে।
টুপটুপ করে বৃষ্টির ফোঁটা বাড়ছিল আর সেই সাথে আমার কৌতুহল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
“এই যে নিহা আর নয়নার ‘দি গ্রেইট আরজু ভাই’? আপনার কি মন খারাপ? কেউ কি বকা দিয়েছে?”
সে চোখ মেললো। আমার চুল গুলো ছেড়ে দিয়ে চমৎকার হাসলো। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, এই প্রথম তার হাসি অসম্ভব ভালো লাগলো। বৃষ্টি বাড়ছে কিন্তু আমার কিংবা তার কারোরই কোনো প্রকার হম্বিতম্বি নেই। সে খুব আয়েশ করে ছাদের গ্রিলের সাথে হেলান দিয়ে আমার সামনাসামনি দাঁড়ালো। তার মলিন চাহনিতে বিরক্ত হলাম আমি। এমন দুঃখি দুঃখি ভাব করছে কেন ছেলেটা?

“তোমাকে দেখার দুই বছর হয়ে গেলো ফুলটুসি। খুব বেশিদিন না, তাই না?”
পাখিটা উড়ে এসে তার কাঁধে বসলো। তার সাথে সুর মিলিয়ে বললো,
“দুই বছর, দুই বছর!”
সে আবার বললো,
“আরো অনেক পিচ্চি ছিলা তখন। ছোট্ট একটা বাচ্চা ফুল! কেমন করে যেন সেই ফুলের মাঝেই হারিয়ে ফেললাম আমার আমিকে।
বৃষ্টি থেকে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করেও যখন সফল হতে পারছিলো না, তখন তার সে-কি তেজ! ছাতাটা ছুড়ে ফেলে রাগী ফুলটা ভিজে একাকার হয়ে গেলো। আর আমি? আমি একাকার হয়ে গেলাম ওই ভেজা ফুলটায়!
এর পর আরো বহুবার মুগ্ধ হলাম, বিমোহিত হলাম। প্রেমে পড়েছি কিনা জানি না। তবে মায়ায় পড়েছি। যতবার সে আমার উপর বিরক্ত হয় ততবার আমি তার মায়ায় পরি। আরো পড়তে চাই, শত বছর, হাজার বছর! তুমি চাও কিংবা না চাও! আচ্ছা? আমি যদি হারিয়ে যাই, ভুলে যাবা আমায়? অপেক্ষা করবা আমার জন্য? করবা না, না? অসুবিধা নেই ফুলটুসি, শুধু একটু মনে রেখো কেমন?”

বৃষ্টি পড়ছে তখন অঝোরে। চোখ, মুখ, শরীর ভিজে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই আমার মস্তিষ্কে কেবল এবং কেবলমাত্র তার বলা প্রতিটা কথা প্রতিধ্বনি হচ্ছিল। সে আমার গালে হাত রাখলে। তারপর তার সেই হাত নিয়ে তার বুকে ঠেকালো। নিচ থেকে আম্মু কন্ঠ ভেসে আসতেই সজ্ঞানে ফিরে আসলাম। নিভুনিভু চোখে কপাল কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে ছুটে চলে আসলাম নিচে।…..(চলবে)

#তুমি_কোন_কাননের_ফুল
#সপ্তম_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

সারা রাত অনেকটা ঘোরের মধ্যে কেটে গেলো। তার প্রতি আমার ভালো লাগা কিংবা ভালোবাসা যেটাই বলেন না কেন, তৈরি হয়ে গেলো। অপছন্দ করতে করতে খুব করে পছন্দ করে ফেলেছি কবে ঠিক বুঝতে পারি না আজও।
তক্ষুনি ছুটে গিয়ে তানিশাকে বলতে ইচ্ছে করছিলো, তার কথা। কিন্তু আফসোস মেয়েটা ছিলো না বাসায়। বেড়াতে গিয়েছে। রাতে ফুটে ওঠা তাজা নয়নতারা ফুলের মতোই ফুটে উঠলো আমার মন, প্রাণ। দাদুকে গিয়ে বললাম,”দাদু? তুমি ঠিকই বলেছো। ছেলেটা খুব একটা খারাপ না। একটু মাথায় ব্যামো আছে, এই যা! হি হি।”
দাদু প্রথমে হাসলো, পরে সরু চোখে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করলো,
“দাদুভাই? হঠাৎ কি হইলো? জ্বর-টর আইলো নাকি?”
আমি তার তাচ্ছিল্যের কারন ধরে ফেললাম চট করেই। বিরক্তি নিয়ে বললাম,
“আশ্চর্য! তুমি আমার কথাটাকে এভাবে অপমান করছ কেন! কেউ একজনকে ভালো মনে হয়েছে, ভালো বলবো না? আগে খারাপ বলতাম সেটাও দোষ ছিলো, এখন ভালো বলছি সেটাও দোষ? তোমার কাছে আসাটাই ভুল হইছে।”
ফসফস করতে করতে চলে আসলাম। দাদু তখনও কলকল করে হাসছিলেন।
কষ্টে কষ্টিত মন নিয়ে রুমে এসেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখলাম খালামনি বসে আছে মাথার কাছে। আমি অবিশ্বাস নিয়ে চোখ কচলে বসলাম। খালামনির মুখ তখন হাসিহাসি। আমি খালামনিকে ধরে বললাম,
“তুমি সত্যি আসছো? নাকি স্বপ্ন দেখছি!”
খালামনি হেসে দিয়ে বলল,
“স্বপ্ন!”
আমি খালামনিকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদ করে বললাম,
“দিস ইজ নট ফেয়ার মটু! তুমি আসবা, আগে বলবা না?”
“বললে কি হইতো? তোকে চমকে দেয়ার জন্যই তো না বলে এসেছি। এখন চল আমার সাথে।”
আমি বিস্ময় নিয়ে বললাম,
“কই যাবো?”
“আমাদের বাসায়। তোকে না বলেছি, জেরিনের বিয়ের এক সপ্তাহ আগে থেকে তুই আমাদের বাসায় চলে যাবি?”
“যাবো না। তুমি পঁচা।”

খালামনি রেগে গেলো। বাচ্চাদের মতো জেদ ধরে বলল,
“এক্ষুনি আমার সাথে না গেলে তোদের বাসায় ও আর আসবো না, তোর সাথে কোনো কথাও বলবো না।”
আমি হেসে দিয়ে বললাম,
“তুমি কি বাচ্চা? বাচ্চাদের মতো জেদ করছো কেন। আমি দুদিন আগে যাবো, যাও।”
সে কোনো ভাবেই মানলো না। আব্বু-আম্মুর সাথে চেঁচামেচি করলো এবং শেষ অব্দি আমায় রাজি করিয়েই ছাড়লো।
যাওয়ার আগে খুব করে চেয়েছিলাম তার সাথে একবার দেখা হোক। কিন্তু হলো না। আন্টির কাছে জানতে চাইলে বললেন, ভার্সিটি গিয়েছে। মনটা একটু খারাপ করলো। খালামনির বাসায় গেলে কম করে হলেও পনেরো দিনের আগে আসতে দিবে না। এতদিন দেখতে পাবো না ভেবে উসখুস লাগলো। উসখুস মন নিয়েই বাড়ি ত্যাগ করলাম। গেইট দিয়ে বের হওয়ার সময় তার বারান্দা থেকে পাখিটা ডাকলো,
“নয়ন-তা-রা, নয়ন-তা-রা।”
খালামনি জিজ্ঞেস করলো,
“কে ডাকে রে?”
আমি ফিক করে হেসে ফেললাম। বললাম,
“পাখি ডাকে। দুষ্ট মালিকের দুষ্ট পাখি।”
.
.
খালামনির বাসায় আসার পর থেকে অনুভব করলাম, তার অনুপস্থিতি আমার ভালো লাগছে না। বার বার মন চাচ্ছে ছুটে বাড়ি ফিরে যাই। ছেলেটাকে বকাঝকা করে জিজ্ঞেস করি, ‘কি সমস্যা আপনার? এত ভাবাচ্ছেন ক্যান, হু?’ কারোর প্রতি টান এত বিশাল প্রভাব ফেলছে ভাবতে অবাক হলাম।

চার-পাঁচদিন পরও যখন তার আগমনী সংকেত পেলাম না তখন মনটা প্রচন্ড রকম হতাশ হলো। ‘তবে কি সে আর আগের মতো নেই? বদলে গেলো? আমার প্রতি তার টান কমে গেলো?’ এমন নানান ভাবনায় মনটা তলিয়ে গেলো নিমিষেই।
আপুর বিয়ের আগের দিন আম্মু-আব্বু সহ আমাদের পুরো পরিবার চলে আসলো দাদু ছাড়া। দাদুর শরীর খারাপ, জার্নি করে আসতে পারবে না বলেই থেকে গেলো। আমি শুধু আশেপাশে খুঁজছিলাম সে এসেছে কিনা! না, আসেনি। সেদিনও আসেনি! ‘কেন আসেনে?’ ভেবেই অভিমানে টইটুম্বুর হয়ে গেলাম। যে মানুষ দুদিন না দেখতে পেয়ে অস্থির হয়ে বাসা অব্দি ছুটে এসেছিলো, পাগলামি করছিলো, সেই মানুষ এক সপ্তাহ না দেখে কিভাবে কাটিয়ে দিলো! রাগে-দুঃখে কান্না পেয়ে গেলো।
এর মাঝে “নিহা আর নয়না এসে বলল,
“আমাদের খুব মন খারাপ রে আপু। তোকে একটা কথা বলার আছে। অনেক বড় একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে রে। সবার মন খারাপ।”
কারন কি জানার আগে তাদের ডাক পড়লো আর তারাও চলে গেলো।
আপুর বিয়ের পর আর একদিনও থাকতে পারলাম না। কেমন যেন অস্থির লাগছিলো। বিয়ের পরদিনই এক প্রকার জোর করেই চলে আসলাম বাড়ি।
তখনও জানা ছিলো না বাড়িতে আমার জন্য ঠিক কি কি অপেক্ষা করছে!
বাড়ি আসলাম বিকেলের দিকে। সিড়ি দিয়ে উঠলেই হাতের বা’সাইডেই তাদের বাসা। আমার চোখ আপনা-আপনি সেদিকে চলে গেলো। দেখলাম,
“বড় একটা তালা ঝুলানো।”
খুব যে অবাক হয়েছি তা কিন্তু নয়, তবে কিছু প্রশ্ন জাগলো মনে।
তখন কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা না করলেও পরে জিজ্ঞেস করেছিলাম। জানতে পারলাম, তাকে মার্ডার কেইসে এরেস্ট করা হয়েছে! তার বাইকে তার-ই কলেজের সিনিয়র একজনকে ইচ্ছাকৃত ভাবে এক্সিডেন্ট করা হয়েছে। দুদিন আইসিইউতে থেকে মারা গিয়েছে লোকটা।
প্রথমে আমি হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলাম,
“মজা কর তাই না? উনি কি খুনি নাকি? ফাইজলামি করবা না তো। ফাইজলামি একদমি ভালো লাগে না। উনি কই? আন্টি কই? বেড়াতে গিয়েছে, না?”
আম্মু তখন ধমক ধমক দিয়ে বলেছিলো,
“তোর সাথে ফাইজলামি করবো ক্যান বেয়াদপ মেয়ে! ছেলেটাকে কত ভালো জানলাম আর শেষে কিনা ও…..!”

বারবার যখন সবাই তাকে খুনি খুনি বলছিলো, আমি বোঝাতে পারবো না আমার অনুভূতি টা। বীভৎস অনুভূতি!
তানিশা এসে বলল, আমার ধারনাটাই নাকি ঠিক! ছেলেটা আসলেই বখাটে!
আমি তখন স্তব্ধ ছিলাম। ঘোর কাটিয়ে উঠতেই পারছিলাম না। কিন্তু পরে যতবার তানিশার এই কথাটা মনে পরেছে ততবারই চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়েছিল,
“ভুল, ভুল, ভুল! ভুল বলেছিলাম আমি। তোমরা সবাইও ভুল করছো। এই ছেলে খুনি হতেই পারে না! কেন সবাই এমন ভুল করছো?”
আমাকে আরো একবার ভুল প্রমাণ করে দিলো ছেলেটা নিজেই! সে নিজেই আদালতে সিকারক্তি দিলো যে, ইচ্ছাকৃত ভাবে আগের মনমালিন্যের রেশ ধরে সে এক্সিডেন্ট টা করেছে। এক্সিডেন্ট টা ছিলো ইচ্ছাকৃত।

আমি বাসায় অনেক বুঝিয়ে তার সাথে একবার দেখা করতে গিয়েছিলাম। আম্মু আব্বুকে বাহিরে রেখে ভেতরে আমি একাই গেলাম।
আমাকে দেখে সব সময়ের মতোই সেদিনও হেসে দিয়ে বলল,
“ফুলটুসি? কেমন আছো? খুব সুন্দর লাগছে ফুলটুসি। কেন এসেছো এখানে? চলে যাও বোকা! ফুলদের এখানে আসতে নেই। চলে যাও প্লিজ!”
প্রথমবারের মতো সেদিন আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। গ্রিলের এপাশ থেকেই তার হাত চেপে ধরে অঝোরে কেঁদে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
“এসব মিথ্যে, না? আপনি মজা করছে, তাই না? আপনি তো এমন না, আমি জানি সেটা। সবাই মিলে ফাঁসাচ্ছে আপনাকে, তাই না?”
ছেলেটা তার হাতের উপর থেকে আমার হাত খুলে সরালো। মুখে মৃদু হাসি রেখেই বলল,
“নো! কেউ ফাঁসাচ্ছে না ফুলটুসি। যা দেখতে পাচ্ছো সেটাই সত্যি। চলে যাও প্লিজ।”
আমি তার কথা তখনও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। নিজের ইগো টাকে দুমড়েমুচড়ে দিয়ে বলে বসলাম,
“শোনেন? আমি আপনাকে অপছন্দ করি, কথাটা মিথ্যে। আমি আপনাকে পছন্দ করি, খুব, খুব, খুব…বেশি পছন্দ করি। প্লিজ এখন এটলিস্ট মিথ্যে বইলেন না। আমি ভুল কাউকে পছন্দ করেছি মানতে পারবো না। ”
“বাট সত্যি এটাই, তুমি ভুল মানুষকে ভুল করে একটুখানি পছন্দ করে ফেলেছো। সমস্যা নেই। একটুখানি ভুল সুধরানো যায় ফুলটুসি। সুধরে ফেলো। ভালো থেকো ফুল।”

সেবারই শেষ। এই তিন বছর নয় মাসে আর দেখা হয়নি। কথা হয়নি। তার জেল হওয়ার একমাস পরই ঢাকা ছেড়ে কুমিল্লা চলে এসেছি আমরা। ঢাকা ছাড়ার অন্যতম কারন তার প্রতি আমার পাগলামি বেড়ে যাওয়া। আম্মু-আব্বুর মনে চিন্তা ঢুকলো, হায়রে! মেয়ে আমার ভুল ছেলের পাল্লা পড়ে গিয়েছে। এই বাঁধন ছিন্ন করার প্রথম পদক্ষেপ হবে ঢাকা ত্যাগ করা!
করলো ও তাই। আসার আগে শুধু জানতে পারলাম, আন্টি তার বড় মেয়ের কাছে আছে। আমিও একটু স্বস্তি পেলাম, মানুষটা নিরাপদে আছে ভেবে।
আফসোস সময়ের সাথে সাথে সব পাল্টে গেলেও পাল্টায় নি আমার অনুভূতি। অপছন্দ করতে করতে যেমন পছন্দ করে ফেলেছিলাম, ঠিক তেমনি ভুলতে চাইতে গিয়ে আরো বেশি করে মনে রয়ে গেলো! তার ডাক, তার আহ্লাদ, তার পাগলামি, তার বাচ্চামি কিছুই ভুলতে পারি না। এতকিছুর পরও তাকে হেইট করতে পারি না। যদিও আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি সে এমন কিছুই করেনি। নিজের ঘারে দোষ কেন নিয়েছে সেটাও বুঝে উঠতে পারিনি। অবশ্য আমি তার আর খোঁজ নেই নি। কোনো অসুন্দর অনুভুতি তাকে ঘিরে তৈরি হোক সেটা চাইনি বলেই আর খোঁজ নেই নি। সেই কিশোরী বয়সের অনুভুটার প্রখরতা পরক করতে গিয়ে বারংবার চমকে উঠি। আমি সবার মাঝে তাকেই খুঁজে বেড়াই। আর বারবার ব্যার্থ হই। তার মতো দ্বিতীয় কেউ হবে না সেটা আমি বুঝে গিয়েছি।
আই এম স্যরি মিস্টার আরিয়ান! আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না। ইভেন কাউকেই পারবো না। আপনাকে আমার ভালো একজন মানুষ বলে মনে হয়েছে তাই বিয়ে না করার কারনটা ব্যাখ্যা করেছি। আই হোপ বুঝতে চেষ্টা করবেন।

আরিয়ান রেস্টুরেন্টের চারপাশে একবার চোখ বুলালো। চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কোট টা দু’হাতে টেনে আয়েশ করে বসে বলল,
“হুম, বুঝতে পেরেছি মিস নয়নতারা। আপনাকে আমার ভালো লেগেছে এটা যেমন সত্যি, ভালো লাগার মানুষের ইচ্ছে অনিচ্ছাকে প্রায়োরিটি দেয়ার মনোবল রাখি এটাও তেমন সত্য! আমি কি আপনাকে কোনো ভাবে হেল্প করতে পারি?”…….(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here