তুমি কোন কাননের ফুল, পর্ব:৫

#তুমি_কোন_কাননের_ফুল
#পঞ্চম_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

আমার পরিবারে আম্মু-আব্বু আর আমার দুই বোন ছাড়াও আরো একজন থাকতেন। সে হলো আমার দাদু। আমাদের ঘরে দাদুর সাথেই আমার সখ্যতা বেশি। তানিশা ব্যাতিত এই বুড়িটাই আমার আরেক বেস্টফ্রেন্ড।
ছেলেটার প্রতি যত রাগ-ক্ষোভ সব কিছুই দাদুকে শেয়ার করতাম। আমার কাছে তার সম্পর্কে বদনাম শুনতে শুনতে প্রথম প্রথম দাদু ছেলেটাকে একদমই পছন্দ করতো না। তাকে দেখলেই ঘ্যাট ঘ্যাট করতো। কিন্তু হায় আফসোস! এই বেয়াদপ ছেলেটা বোধহয় খুব ভালো ব্রেইনওয়াশ করতে পারতো। কিভাবে যেন দাদুকেও পটিয়ে ফেললো অল্পকিছু দিনের মধ্যেই। যেখানে আগে দাদু তাকে সারাক্ষণ খ্যাঁচখ্যাঁচ করে বকতো সেখানে পছন্দের শীর্ষে স্থান দিয়ে ফেললো। আমাকে মিষ্টি মিষ্টি হেসে বলল,
“দাদুভাই? পোলাডারে যতডা খারাপ ভাবছি অতডা খারাপ না। একটু মাথা খারাপ আছে, কিন্তু পোলা ভালা। মনডা ভালা।”
এখানেই শেষ নয়! আমার পেয়ারের দাদিরে সে ক্রমশই তার দলে নিয়ে নিচ্ছিল। বিকেল হলেই দাদিকে ছাদে নিয়ে গিয়ে গল্প করতো। আমি ডাকলেও আমাকে বিশেষ পাত্তা দিত না। বড়জোড় বলত, তাদের সঙ্গে আড্ডায় জোগ দিতে।
মাঝে-মধ্যে বোরিং হয়ে তাদের সাথেই বসে থাকতাম। তাদের গল্পের টপিক গুলো হতো, দুনিয়ার তন্যতম জঘন্য টপিক। দাদির সাথে তাল মিলিয়ে পান খেয়ে মুখ লাল করে ফেলতো। ঠোঁট উল্টে জিজ্ঞেস করতো,
“এই ফুলটুসি? ঠোঁট লাল হয়েছে দাদির মতো? দেখ তো। সুন্দর লাগছে, না?”
আমি চোখমুখ খিঁচে বলতাম,
“ইয়াক! জঘন্য লাগছে! জোকার লাগছে, ভুতের মতো লাগছে। ছিঃ!”
সে বত্রিশ কপাটি বের করে হাসতো। দাদুর সামনেই আমার হাত টেনে তার মুখের সামনে নিয়ে বলতো,
“তোমার হাতে পানের চিপটি লাগিয়ে লাল করে দেই?”
আমি চটজলদি হাত টেনে সরিয়ে ফেলতাম। দাদুর দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলতাম,
“এই ফালতু ছেলেটার সাথে আর এক মুহূর্তও যদি থাকো তো তোমার সাথে আড়ি, আড়ি, আড়ি! কি করবা ভাবো, জলদি ভাবো।”
দাদু খিটখিট করে হাসতো। আমাকে শান্তনা দিয়ে বলতো,
“এই পাগলটা উপর রাগ করো তুমি? ওর যে মাথা আওলা জানো না? বসো আমার পাশে।”
তাকে পাগল বলায় সে যেন আহ্লাদে আটখানা হয়ে যেত। দাদুকে জড়িয়ে টড়িয়ে ধরে বলতো,
“ও তো রাগি ফুল, দাদি। আই জাস্ট লাভ রাগি ফুল! রাগতে দাও তো। সুন্দর লাগে।”
যখন দেখতাম আমার দাদুর কাছে আমার রাগ-ফাক কোনো কিছু পাত্তা পাচ্ছে না, তার আহ্লাদেই আহ্লাদিত হয়ে যাচ্ছে! তখন ফুঁসতে ফুঁসতে চলে আসা ছাড়া কিছুই করার থাকত না।
একদিন দাদুর কোলে মাথা দিয়ে, দাদু আর দাদার গল্প শুনছিলাম। হুট করে কই থেকে যেনো মহা বিরক্তিকর ছেলেটা এসে আমার মতোই শুয়ে পড়লো দাদুর কোলে। আমি উঠে যেতে লাগলে টেনে শুয়িয়ে ফেললো আবার। তার এসব আজব আজব অসভ্য কর্মকান্ডে দাদু বেশ মজা পেত। সে হেসে কুটিকুটি হয়ে যেত।
আমি তখন মুখ ফুলিয়েই শুয়ে রইলাম। কারন ততদিনে আমার বেশ ভালো করেই জানা হয়ে গিয়েছিলো, এই বেয়াদপের সাথে হাউকাউ করে কোনো প্রকার লাভ-ই হবে না। অজথাই আমার শব্দ ব্যায়, বাক্য ব্যায়!
সে হাতে দিয়ে আমার এক হাত চেপে ধরে রেখেই দাদুকে প্রশ্ন করলো,
“আচ্ছা দাদি? তোমার বিয়ে হয়েছিলো কত বছর বয়সে?”
দাদু লাজেরাঙা মুখ করে বলল,
“সে তো অনেক ছোডো বয়সে। এইসব বিয়াসাদি কিছুই বুঝতাম না তখন।”
বলেই কুটকুট করে হাসলো। আমি মজা পেলাম। এর আগে দাদুর কাছে কখনো তার বিয়ের ব্যাপারে জানতে চাইনি বলে আফসোস ও হলো। তখনই আফসোস মিটিয়ে ফেলার প্রখর ইচ্ছে জাগলো। তমুল আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“তখন তোমার বয়স কত ছিল?”
দাদু একটু ভেবে নিয়ে বলল,
“এই ধর, সাত-আট বছর।”
আমি হুরমুর করে উঠে বসলাম। মস্তিষ্কে কেবল একটাই প্রশ্ন, কেমনে কি! কেমন করে সম্ভব! দাদু ফাও কথা বলছে না তো! আমি কৌতূহল দমিয়ে রেখে হেসে দিয়ে বললাম,
“যাহ! ফাও কথা বলো ক্যান? এত জলদি কি কারো বিয়ে হয়?”
দাদু আর সে সমস্বরে হেসে উঠলো। হাসার মতো কি বললাম, ভেবে পেলাম না। দাদু হাসি থামিয়ে বলল,
“আমাগো সময় এমন বয়সেই বিয়ে হইতো। আরো ছোডো বয়সেও হইতো। পুতুল খেলার বয়সে পুতুল সংসার! হা হা হা!”
আমার অবাকের মাত্রা তরতর করে বেড়েই চলছিলো। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম,
“দাদার বয়স কত ছিলো তখন?”
“কত আর হইবো? আরজু দাদুভাই এর মতো হইবো।”
আমি কপাল কুঁচকে তার দিকে তাকাতেই সে চোখ মারলো! কোন লেভেলের অসভ্য ভাবা যায়?
সে দাদুর কাছে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,
“সে হিসেবে তো তবে ফুলটুসি আর আমার দুইজনের-ই বিয়ের বয়স হয়ে গিয়েছে, কি বলো দাদি?”
দাদু হাসতে হাসতে বলল,
“হয়, তা তো বটেই।”
আমি দাঁত কিড়মিড় করে বললাম,
“তোমরা দুজনেই খারাপ, প্রচন্ড খারাপ।”
তারা হো হো করে হেসে উঠলো। আমি উঠে চলে আসতে লাগলে, দাদু বলল,
“তোমার দাদার আর আমার মজার ঘটনাই তো শুনলা না। চলে গেলে কিন্তু ফক্কা। পরে আর বলতে বললেও বলবো না, হুহ।”
ইচ্ছে না দমাতে পেরে বসে রইলাম। বললাম,
“বলো, বলো। ঢং কইরো না তো। এখন তো ওই বেয়াদপ ছেলেই তোমার সব!”
দাদু বলল,
“তোমাদের দাদা আছিল, অনেক ভালা মানুষ। অনেক বুঝদার মানুষ। আমার সব কিছু কেমনে কেমনে জানি বুইঝা যাইতো। সবচাইতে বড় কথা সে আমারে মেলা মোহাব্বত করত। কিন্তুক যেহেতু আমি ছোডো আছিলাম, আর আমার কাছে সে আছিল একেবারে অচেনা মানুষ, তাই তারে প্রথম প্রথম ভয় পাইতাম। একদমই পছন্দ করতাম না।”
সে একগাল হেসে বলল,
“ফুলটুসি যেমন আমাকে অপছন্দ করে, ঠিক তেমন, না?”
দাদু হেসে বলল,
“হ, এক্কেবারে এইরামই।”
আমি অধৈর্য হয়ে বললাম,
“ধুর! তুমি বলবা? এসব বাড়তি মানুষজনের কথায় কান দাও কেন? বলো তো!”
“আচ্ছা শোনো, তারপর কি করতাম জানো? সে বাড়িতে আসছে আলাপ পাইলেই লুকিয়ে থাকতাম। মাঝেসাঝে ইটপাটকেল ছুঁড়ে মারতাম। একবার তো ইট টুকরা মেরে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছিলাম। সে একটুও রাগ করতো না, বকতো না। আদর কইরা বুঝাইতো, আমার মা-বাবা সহ অন্যান্য আপনজনদের মতো সেও আমার আপনজন, প্রিয়জন। ছোট আমাকে এক প্রকার পেলে-লেলেই বড় করছে তোমার দাদা। চুল বাইন্ধা দিত, খাওয়ায় দিত, কাপড় পড়ায় দিত।”
আমি হেসে দিলাম। উনি ফোঁড়ন কেটে বলল,
“বাহ! দাদা তো দেখি মারাক্তক প্রেমিক পুরুষ! এক্কেবারে আমার মতো! আমিও একটা বাচ্চা ফুল বিয়ে করবো। অনেক অনেক আদর করবো, চুল বেঁধে দিবো, ফুলের মাথায় ফুল গুঁজে দিবো, খাইয়ে দিব, শাড়িও পড়িয়ে দিবো। দাদার মত খাঁটি প্রেমিক পুরুষ হবো। হা হা হা!”
দাদুর তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
পাগল একটা। তুই আসলেই অনেকটা তোর দাদার মতো। একদম ওই রকম পাগল।”
বলেই চোখ মুছলেন। আমি দ্বিমত পোষন করে বললাম,
“মোটেও না। আমার দাদা ছিলো বেশি ভালো। আর এই ছেলে হলো, বেশি খারাপ। মারাক্তক বেয়াদপ, চরম অসভ্য।”
সে মুখ চেপে হাসলো। দাদু রেগেমেগে বললো,
“দুইটা খালি ঝগড়া করিস। যাহ, গল্প-টল্প বাদ।”
সে বলল,
“নো সমস্যা দাদি। যত ঝগড়া তত প্রেম। আর তুমি তো জানোই প্রেমিক পুরুষ হতে হলে একটু-আকটু অসভ্য, বেয়াদপ হতেই হয়, তাই না?”
বলেই হো হো করে হাসলেন।
দাদি একমত পোষন করলো। দুঃখে আমার মরে যেতে ইচ্ছে হলো। এই অসহায় অবলা এক দুঃখি বালিকাকে কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। এর বেঁচে থেকে কি হবে? হায় আল্লাহ্‌, হায় কষ্ট!
এসএসসির রেজাল্ট দেয়ার কয়েকদিন আগে থেকে আমার খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। বরাবর-ই আমি টেনশন করতে পারি না। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। পরিক্ষা ভালো হওয়া সত্বেও কেন যেন ভয় লাগতো। আমার চিন্তার মধ্যেও উনি ক্ষ্যাপানোর জন্য বলতেন,

“আরেহ! চিন্তা-ফিন্তার কি আছে? ফেইল করলে করবা। কি আর এমন হবে? বড়জোর বিয়ে-টিয়ে দিয়ে দিবে। এতে এতো হা-হুতাশের কি আছে?”
একটা মানুষ কোন লেভেলের খারাপ হলে ডিরেক্ট ফেইল এর কথা বলতে পারে? আর ফেইলের সাথে বিয়ের কানেকশন কি?
আমি রাগে ফুলেফেঁপে বলতাম,
“আপনি একটা অসহ্যকর মানুষ। আই উইশ, আই উইশ……!”
বাকিটুকু আর মুখ দিয়ে বের হতো না। অতিরিক্ত রাগ হলে কথা বলতে পারি না। সে কাছে এগিয়ে জিজ্ঞেস করতেন,
“কি?”
“মনে মনে বরদোয়া দিয়েছে। সাংঘাতিক বরদোয়া, ভয়াবহ বরদোয়া।”
বলেই ছুটে পালাতাম। সে উচ্চস্বরে হাসতো। অসহ্যময় হাসি!

যেদিন রেজাল্ট দিবে সেদিন আমি রুম থেকেই বের হইনি। টেনশনে মনে হচ্ছিল মরেই যাবো। ঠিক করলাম, রেজাল্ট-ই দেখবো না। রেজাল্ট ভালো না হলে শেষ আমি। যেই ভাবনা সেই কাজ। দরজা আটকে রুমে শুয়ে রইলাম।
বিকেলের দিকে সে এসে দরজায় নক করলো। আমি সারা দিচ্ছিলাম না দেখে আম্মু, আব্বু, দাদু সবাইকে দিয়ে ডাকালো কিন্তু কোন লাভ হলো না। কোনো কিছুতেই যখন কাজ হলো না তখন সে বলল,
“এই ফুলটুসি? গুড নিউজ আছে। খুশিতে নাগিন ডান্স দিবা। জলদি দরজা খোলো।”
এবার আমি মুখ খুললাম। জিজ্ঞেস করলাম,
“সত্যি গুড নিউজ?”
সে বলল,
“হ্যা, তিন সত্যি।”
আমি দরজা খুলে সাথে সাথে জিজ্ঞেস করলাম,
“রেজাল্ট কি? সত্যি ভালো হয়েছে? বলেন?”
সে মুখ চেপে হেসে বলল,
“তোমার বিয়ে কনফার্ম ফুলটুসি। বিয়ের জন্য রেডি হও। ফেইল মেরেছো। যেই সেই ফেইল না, রেকর্ড করা ফেইল। অঞ্জন দত্তের মতো বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, ‘বিয়েটা কেউ আটকাতে পারবে না, বেলা শুনছো? সরি, ফুলটুসি শুনছো?’ হা হা হা!”
তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমি একটা অদ্ভুত কান্ড করে বসলাম। কেঁদে ফেললাম। হাউমাউ করে কাঁদা না, নির্বাক কান্না। ঝরঝর করে চোখ দিয়ে পানি পড়ছিলো অনবরত। খুব কষ্ট লাগলো। দম বন্ধ লাগলো।
আমার কান্না দেখে সে ও হকচকিয়ে গেলো। মাথার দু পাশে দুই হাত রেখে বলল,
“এই বোকা! কাঁদছ কেন? হায় আল্লাহ! প্লিজ স্টপ! আমি স্যরি! এই দেখ কানে ধরেছি। অনেক অনেক স্যরি। এই মেয়ে? আমি তো মিথ্যে বলেছি, মজা করেছি। রেজাল্ট মারাক্তক ভালো করেছো। ফুলটুসি? প্লিজ স্টপ! আর কখনো এমন মজা করবো না। প্লিজ…!”
………….(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here