তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব -১৬

#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_ষোল

“আম্মা, আমি তোমার পায়ে ধরি, ওই বিয়াইত্তা পোলার কাছে, আমারে বিয়া দিও না। তোমাগো যত ঋণ আছে, আমি শোধ কইরা দিমু। তাও আমারে বিয়া দিও না। আমার জীবনডা নষ্ট হইয়া যাইব আম্মা।”
তানিশা বাড়ি ফিরেছে দুই ঘন্টা হলো। বাড়িতে ফিরেই দেখে বিয়ের সব তোড়জোড় চলছে। ঘরোয়াভাবে আজকেই তানিশার আয়োজন করা হয়েছে। উঠানে ছোটখাটো সবার খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বারান্দায় অতিথিরা বসে আছে। বাড়িতে পা রেখেই তানিশা আঁতকে উঠে ভয়ে। সবার সামনে হাসি খুশি থাকলেও, সাহেলা বেগমকে রুমের ভেতরে ডেকে এনে অনুরোধ বাক্যে উপরোক্ত কথা গুলো বললো তানিশা। তানিশার সাথে যেই ছেলের বিয়ে ঠিক করা হয়েছে সে বিবাহিত, তার বউ তাকে ছেড়ে চলে গেছে এমনটাই জানে তানিশা। তানিশার কথাগুলো শুনে সাহেলা বেগম স্বান্তনার স্বরে বললো,
“বিয়াইত্তা পোলার কাছে বিয়া হইলে যে জীবন শেষ হইয়া যায়, তোরে কেডায় কইছে? আমরা তোর বাপ-মা, আমরা কি তোর খারাপ চাইমু? দেখ মা, যা ভাইগ্যে আছে তাই হইবো। তুই যদি অহন এই বিয়াতে না কইরা দেস, তাই আমাগো সব শেষ হইয়া যাইব মা। তোর বাপে আমারে বাইর কইরা দিব। তোর দুইডা ছোড বইন আছে, ওগোরে লইয়া আমি কই যামু? তুই যদি বিয়া না করস, তাইলে ম*রণ ছাড়া আমার আর তোর বাপের কোনো রাস্তা খোলা নাই রে মা। ”
বলে মুখে আঁচল চে*পে কান্না করে দিলো। সে নিজেও অসহায় স্বামীর কাছে। স্বামী যে ঋণে ডুবে গেছে। এই একটাই রাস্তা খোলা আছে, সব ঋণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য। শুধু একটা ঘর বাদে তাদের আর কিছু অবশিষ্ট নেই। দুই টাকা দিয়ে যে কেউ সাহায্য করবে, তেমন কেউ নাই। কোনো কূলকিনারা না পেয়ে, মেয়েকে জোর করে হলেও বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে তারা। তানিশার চোখ বেয়ে অনবরত পানি পড়ছে। সারারাস্তা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে এসেছে। তাই চোখ, মুখ ফুলে গেছে। নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে অসহায় মেয়ে মনে হচ্ছে। একদিকে ভালোবাসা আরেক দিকে পরিবার। দোটানায় পড়ে গেছে। অসহায় স্বরে হুট করেই বলে উঠলো,
“টাকার জন্য মাইয়ারে বেইচা দিতাছো আম্মা?”
কথাটা শুনে সাহেলা মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো। কান্না করে দিলো শব্দ করে। তানিশা কাঁদলো না। কাঁতর স্বরে আবার শুধালো,
“আমি তোমাগো কইছিলাম আম্মা, আমি একটা চাকরি পাইছি। দশ হাজার টাকা বেতন দিব। তোমরা লোন নিয়ে সব ঋণ শোধ কইরা দাও, লোনের বোঝা আমি টানুম৷ তোমরা আমার কথা দাম দিলানা আম্মা। আমারে বলি পা*ঠা বানাইয়া দিলা, আম্মা। আব্বায় তো কোনো জনমেও আমারে বুঝেনাই। আজকে তুমিও আমারে বুঝলানা আম্মা।”
সাহেলা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“আমি কি করুম মা? আমার হাতে কিছু নাই যে। আমি নিজেই তো বলি হইয়া গেছি। আমারে তুই মাফ কইরা দিস। দেখিস তুই শাকিলের লগে সুখে থাকবি। শাকিল বহুত ভালো একখান পোলা। তোরে খুব ভালোবাসে। কইছে কোনোদিন তোরে কান্দাইবো না। আবার আমাগো ঋণ শোধ করার লেইগা অর্ধেক টাকা দিছে, বাকি অর্ধেক বিয়ার পর দিব কইছে। তুই কান্দিস না মা। সব ঠিক হইয়া যাইব।”
তানিশার বুকটা ফে’টে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি বুক ফে’টে যাবে। দম বন্ধ হয়ে যাবে। চিৎকার করে কাঁদলে হয়তো ওর মনের কষ্টটা খানিক কমতো। কিন্তু ও কান্না করতে পারছেনা। চাইলেও পারছেনা। বুকের ভেতরের জমানো আর্তনাদ গুলো বার বার বলে উঠছে ‘কিচ্ছু ঠিক হবে না মা। আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমি সব হারিয়ে ফেলছি। আমি আমার সুখ, ভালোবাসা সব হারিয়ে ফেলছি। পরিবার আর দরিদ্রতার কাছে, আমি হেরে গেছি মা। ” আর্তনাদ গুলো শব্দ হয়ে বের হচ্ছে না। বরং আরো বেশি এলোমেলো হয়ে ঝট পাঁকিয়ে ফেলছে ভেতরে। হায়! জীবন কি অদ্ভুত সুন্দর! কে কোথাও সুখী নেই।


তানিশা যাওয়ার পর থেকে বেলী নিশ্চুপ হয়ে আছে। দুপুরের রোদে খাঁ খাঁ করছে চারদিকে। আর বেলী তার মধ্যেও ছাদের এক কোণে বসে আছে। জায়গাটায় ছায়া আছে ঠিকি কিন্তু প্রচন্ড গরম। তবুও উঠছে না। খুব বেশি দুশ্চিন্তা হচ্ছে মেয়েটার জন্য। অনেকবার ফোন করেছে, কিন্তু রিসিভ হয়নি। কি হলো, কে জানে? আনমনে ভাবছিলো বেলী। আজকে বেলীরা এই বাড়ি ছেড়ে, ভাড়া বাসায় চলে যাবে। সবমিলিয়ে বেলীর মনটা আজ বিষাদে পরিপূর্ণ। হঠাৎ করে কাঁধে কারোর স্পর্শ পেতেই, বেলী হকচকিয়ে উঠলো। পাশ ফিরে দেখলো, নীলাভ্র দাঁড়িয়ে আছে৷ নীলাভ্রকে দেখেই বেলীর মুখে হাসি ফুটলো। নীলাভ্রর কপালে ভাঁজ পড়ে আছে। অবাক স্বরে প্রশ্ন করলো,
“এই কাঠফাটা রৌদ্দুরে তুই, এখানে বসে আছিস কেনো?”
বেলীর ছোট করে উত্তর দিলো, “এমনি”
বলে দুই হাঁটুতে থুতনি রাখলো। নীলাভ্রর বুঝতে দেরি হলো না, ‘বেলীর মন খারাপ’। তাই নিজেও বেলীর পাশ ঘেষে বসলো। হালকা বাতাসে বেলীর সামনের চুলগুলো উড়ছে। চোখে, মুখে লেপ্টে যাচ্ছে বারবার। নীলাভ্র যত্ন করে চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে বললো,
“মন খারাপ কেনো বেলীপ্রিয়া?”
‘বেলীপ্রিয়া’ আজ আবার নীলাভ্র সেই চিরচেনা নামটা ধরে ডাকলো। মনের মধ্যে প্রশান্তির ঢেউ বয়ে গেলো। সব বিষাদ যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। নীলাভ্রর দিকে তাকিয়ে হাসলো। মাথা দুইদিকে নাড়িয়ে উত্তর দিলো,
“উহু, মন খারাপ না।”
নীলাভ্র ডান ভ্রু উঁচু করে বললো,
“আমি কি জিজ্ঞেস করছি তোর মন খারাপ নাকি? আমি বলেছি ‘তোর মন খারাপ কেনো’?”
বেলী চোখ ছোট ছোট করে নীলাভ্রর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুসময়। তারপর আনমনে হেসে দিলো। নীলাভ্রর সামনের চুলগুলো হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিলো। বললো,
“এত অগোছালো কেনো আপনি?”
“তুই গুছিয়ে দিবি বলে।”
কি সুন্দর স্বীকারোক্তি ছেলেটার! যেকোনো প্রশ্নের চমৎকার উত্তর দিতে পারে নিমিশেই। নীলাভ্রর প্রশ্নে বেলী হাসলো৷ শব্দ করে হাসলো। হাসতে হাসতে নীলাভ্রর গাল দুটো অল্পস্বল্প টেনে দিলো। বললো,
“সব প্রশ্নের উত্তর, এত সুন্দর করে কি করে দেন?”
নীলাভ্র এবার নড়েচড়ে বসলো। শার্টের উপরের দুইটা বোতাম খুলে দিলো। বক্ষস্থল খানিকটা বের হলো। বেলী চেয়ে আছে নীলাভ্রর মুখপানে। রোদে চোখ, মুখ কিছুটা কুঁচকে রেখেছে। মুখের মধ্যে হালকা লাল বর্ণের আভা ফুটে উঠেছে। কি সুন্দর লাগছে ছেলেটাকে! চেয়েই থাকতে ইচ্ছে করে বারংবার। নীলাভ্র গরমে শার্টের কলারটা পেছনে ঠেলে দিলো। বেলীকে একনজরে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,
“এভাবে চেয়ে থাকিস কেনো? লজ্জা শরমের মাথা খে’য়েছিস নাকি ইদানীং?”
নীলাভ্রর কথায় বেলী তড়িঘড়ি করে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো। এমন করে বলে কেনো ছেলেটা? জানেনা যে ওর বেলীপ্রিয়া লজ্জা পায়। ভীষণ লজ্জা! বেলী কিছু না বলে চুপ রইলো। নীলাভ্র বললো,
“আমার প্রশ্নের উত্তরটা তো দিলিনা?”
‘কোন প্রশ্ন?’ বেলী পাল্টা প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে গেলো। মনে পড়লো, নীলাভ্রর প্রথম প্রশ্নের কথা। শান্ত স্বরেই শুধালো,
“মন খারাপ ছিলো। এখন মন ভালো হয়ে গেছে।”
“এখন ভালো হলো কি করে?”
নীলাভ্র জিজ্ঞেস করলো। বেলী একদম দেরী করলো না। প্রশ্নের উত্তরটা তৈরি ছিলো। বললো,
“আপনাকে দেখে।”
নীলাভ্রর কি হলো, কে জানে? হাহা করে হেসে দিলো। বললো,
“বাহ! চমৎকার উত্তর! ”
বলে সাথে সাথে বেলীর কান মুলে ধরলো। ধমকানো স্বরে বললো,
“বেশি পাকামো হচ্ছে ইদানীং। আমি তোর বড়, আর তুই আমাকে পটানোর চেষ্টা করছিস?”
বেলী হতবাক! এই ছেলে কি বলে? আজব! তাকে পটানোর চেষ্টা কখন করলাম? কান ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বললো,
“ব্যাথা পাচ্ছি তো নীলাভ্র ভাই। কান ছাড়ুন।”
নীলাভ্র ছেড়ে দিলো। বেলী কান ডলতে ডলতে ব্যাথাত্তুর স্বরে বললো,
“নীলাভ্র ভাই, ব্যাথা পাইনা বুঝি আমি? এভাবে কান মুলে দিলেন কেনো? আমি কি করেছি? আশ্চর্য! ”
নীলাভ্র বেলীর মাথায় গাট্টা মে*রে বললো,
“ড্রামা করেছিস তাই।”
বেলী রাগে নাক ফুলালো। চোখ ছোট,ছোট করে বললো,
“আপনার মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে? একবার বলেন পটানোর চেষ্টা করছি, আরেকবার বলেন ড্রামা করছি। মানে কি পাইছেন কি আপনি? হ্যাঁ।”
নীলাভ্র ভয় পাওয়ার ভান করে বললো,
“বাবাহ! ভয় পেয়েছি।”
বেলীর রাগ হলো। মুখ গুমড়া করে বললো,
“আমি আপনাকে পটানোর চেষ্টা করলাম কি ভাবে?”
নীলাভ্র বেশ শান্ত, শীতল কন্ঠে বললো,
“ওইযে বললি, আমাকে দেখে মন ভালো হয়ে গেছে। তুই কি ভেবেছিস, এটা শুনে আমি গলে যাব। তোকে জড়িয়ে ধরব। বলবো, ‘ভালোবাসি’। সেগুড়ে বালি, এত ন্যাকামি করতে পারিনা। আর পারবো ও না।”
বেলী ‘হা’ হয়ে আছে। অবাক স্বরে বললো,
“কিসব আবোল-তাবোল বলছেন, নীলাভ্র ভাই?”
নীলাভ্র বেলীর দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বললো,
“এত ভাই, ভাই করিস কেনো?”
বেলী এবার প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ পেলো। বেশ অসহায় মুখ করে বললো,
“আপনি তো আমার মামাতো ভাই। তাহলে ভাই ডাকবোনা তো কি বলে ডাকবো? নীলাভ্র ভাইইইইই?”
‘ভাই’ শব্দটা বেশ টেনে বললো বেলী। নীলাভ্র রাগান্বিত চোখে তাকালো বেলীর দিকে। ধমকে বলে উঠলো,
“আবার ভাই বলছিস?”
বেলী একদম শান্ত স্বরে বললো,
“আচ্ছা ভাই ডাকবো না, নীলাভ্র ভাই।”
“তোর সাথে কথা বলতে আসা আমার ভুল হয়েছে বাবা। গেলাম আমি। ”
বলেই নীলাভ্র পা বাড়ালো সিড়ির দিকে। পেছন থেকে বেলী চেঁচিয়ে ডেকে উঠলো,
” ও নীলাভ্র ভাই, যাচ্ছেন কেনো? আসেন গল্প করি।”
নীলাভ্র সাথে সাথে উত্তর দিলো,
“একদম ডাকবিনা আমাকে। ”
“ও নীলাভ্র ভাই, নীলাভ্র ভাই।”
বলেই বেলী খিলখিল করে হেসে দিলো। বেশ হয়েছে, আমার সাথে ঝগড়া করতে আসা। মনে মনে কথাটা ভেবেই, বেলী হাসতে লাগলো। নীলাভ্র আড়ালে দাঁড়িয়ে চেয়ে আছে বেলীর দিকে। মেয়েটা অবশেষে হাসলো। নীলাভ্র বুকের বা পাশে হাত রেখে, বললো,
“এভাবে হাসিস না প্লিজ, বা পাশটায় চিনচিন ব্যাথা করে তো, বেলীপ্রিয়া।”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here