#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ২৫.
.
ঘুমটা গভীর না হতেই তন্দ্রা ভাবটা কে*টে গেল, অনুভব হলো নিজের শরীরের উপর করোর অস্তিত্ব। সেই কেউটা যে কে, সেটা না বোঝার কোন কারণ নেই। পুরো শরীরের ভার আমার উপর ছেড়ে দিয়ে গলার ভাঁজে মুখ গুঁজে আছেন মি. বজ্জাত তাসফি। থেকে থেকে ভারী নিশ্বাস ফেলছেন, যেটা আমার গলায় আছড়ে পড়ছে। শিরশির করছে পুরো শরীর, তাতে বার কয়েক কেঁপেও উঠলো পুরো শরীর।
ঘুমের ঘোরেই হোক বা জেনে শুনে, পুরো শরীর কেঁপে উঠতেই হুট করেই দু’ হাতে আগের চেয়েও গভীর ভাবে চেপে ধরলেন নিজের সাথে। ব্যাথায় কাতর হওয়া শরীরের সর্বাঙ্গ চিনচিনে ব্যাথায় কুঁকড়ে গেলাম যেন। অস্পষ্ট সুরে অজান্তেই ‘আহ্!’ করে আর্তনাদ বেরিয়ে এলো মুখ ফুটে, চোখ থেকে টপটপ করে গড়িয়ে পরলো অশ্রুধারা। এবার মাথা তুলে আমার দিকে তাকালেন তাসফি ভাই। একহাতে আমাকে ছেড়ে দিয়ে গালে হাত রাখলেন। ঘুম ঘুম ভারী গলায় বললেন,
“কি হয়েছে রুপু? শরীর খারাপ লাগছে?”
মাথা ঝাকালাম ওনার কথার জবাবে, বোঝালাম না। ব্যাথায় কাতর হওয়া শরীরে কোন কথায় যেন বেরুলো না মুখ ফুটে, শুধু বেরিয়ে আসলো চোখের জলগুলো। ওনার হয়তো এবার খেয়াল হলো আমার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জলের দিকে। হাত দিয়ে মুছে কপালে গালে হাত দিলেন বললেন,
“রুপুসোনা, কি হয়েছে? শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে? জ্বরও খুব একটা নেই। বলছিস না কেন?”
“ব্য্… ব্যাথা… প্লিজ সরে যান।”
এবার হয়তো বুঝতে পারলেন উনি। বিছানায় নেমে গিয়ে দু’ হাতে আগলে নিলেন। কপালে আলতে করে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে বললেন,
“সরি রুপু! খুব বেশি ব্যাথা হচ্ছে কি?”
“উহুম!”
.
নীরবতায় কে*টে গেল বেশ কিছু সময়, ফজরের আজানের প্রতিধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে চারদিকে, দূর দূর থেকে ভেসে আসছে। আজানের ধ্বনি থেমে যেতেই শান্ত হয়ে গেল চারপাশটা। রাতের ঝড় বৃষ্টির তান্ডবের পর শুনশান নীরবতায় ছেয়ে গেছে পরিবেশটা, শীতল ঠান্ডা ভাবটা রয়েই গেছে।
একটু সময় নিয়ে ডেকে উঠলাম ওনাকে। সাথে সাথে ধমকে উঠলেন উনি। অবাক হলাম কিছুটা। বুঝতে পারলাম না ওনার হঠাৎ ধমকে ওঠার কারণ। অনেকটা কৌতুহল নিয়ে বললাম,
“কি হয়েছে? এভাবে ধমকাচ্ছেন কেন?”
“আজকের পর থেকে এই ফালতু ওয়ার্ডটা ভুলে যাবি। একদম আর ভাই বলে ডাকবি না আমাকে।”
“মানে?”
অবাক হলাম আমি। হঠাৎ ভাইয়া ডাকতে বারণ করার মানে বুঝতে পারলাম না। আবারও হালকা ধমকে উঠলেন উনি। বললেন,
“মানেটা তোর এই মস্তিষ্ক বিহীন মোটা মাথায় ঢুকবে না। একবার যখন বলছি ডাকবি না, তখন আজকের পর আর ডাকবি না।”
“আচ্ছা… আচ্ছা, ঠিক আছে। এবার ছাড়েন আমায় উঠবো আমি, ফ্রেশ হতে হবে।”
“এই জ্বর জ্বর শরীর নিয়ে এত সকালে ফ্রেশ হবি মানে? ঠান্ডা লাগবে তো, আবারও জ্বর আসবে।”
“উফ্! ছাড়েন তো আপনি, কি সব পাগলের মতো কথা বলছেন? ফ্রেশ না হয়ে এভাবে থাকবো আমি?”
চুপ হয়ে গেলেন উনি, হয়তো নিজের বোকামিটা বুঝতে পারলেন। কিছুটা সময় নিয়ে উঠে পরলেন আমাকে ছেড়ে। মোবাইলে সময়টা দেখে নিয়ে খাট থেকে দাঁড়ালেন। বললেন,
“এখানেই থাক, আমি চাচীর থেকে জেনে আসছি বাথরুমটা কোথায়?”
“আন্টির থেকে জেনে আসবেন মানে? কিছু বলতে হবে না, কি মনে করবেন উনি?”
“কি মনে করবে মানে? জেনে না নিলে যাবি কিভাবে? বেয়াদব! চুপচাপ থাক এখানে।”
আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলেন না উনি, দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন রুম ছেড়ে। এতক্ষণে বিছানা ছেড়ে উঠে বসেছি আমি। চাদর টেনে শরীরটা আবৃত করে বিছানা ছেড়ে নামার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই বাইরের আলো জ্বলে উঠলো। এতক্ষণে হয়তো বিদ্যুৎ চলে আসলো অথবা বাইরের আলোটা জ্বালিয়ে দিয়েছেন আন্টি। একটু পরেই ভেসে আসলো তাসফি ভাইয়ের গলা। জানতে চাইলেন বাথরুমটা কোথায়? আন্টিও হয়তো দেখিয়ে দিলেন ওনাকে, সাথে জিজ্ঞেস করলেন এই ভোর রাতে ফ্রেশ হতে হবে কেন? ওনাদের কথায় লজ্জায় যেন আমার মাথা কা*টা যেতে লাগলো আমার। ইস্! এই বজ্জাত লোকটার না জিজ্ঞেস করলেই কি হতো না। এভাবে ডেকে বলার কি ছিলো।
মনে মনে বজ্জাত লোকটাকে হাজারো গালি দিতে দিতে নামতে নিলাম বিছানা ছেড়ে। মাটিতে পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতেই শরীরের সর্বাঙ্গ চিনচিনে ব্যাথায় ব্যাথিত হলো। ‘আহ্!’ করে বেরিয়ে এলো মৃদু আর্তনাদ। তবুও ওঠার চেষ্টা করলাম। একধাপ পা বাড়াতেই হুট করে এসে কোলে তুলে নিলেন তাসফি ভাই। অবাক হলাম কিছুটা। বললাম,
“কি করছেন? নামান আমায়, যেতে পারবো তো।”
“সেটা তো দেখতেই পারছি। এক পা ও যে যেতে পারবি না সেটাও জানি।”
“প্লিজ! নামান আমাকে, বাইরে আন্টি আঙ্কেল দেখলে কি মনে করবেন?”
“কেউ কিছু মনে করবে না। আঙ্কেল নামাজে গেছেন, আন্টিও নামাজ পড়বেন রুম বেরুবে বলে মনে হয় না।”
আবারও বাঁধা দিতেই ধমকে উঠলেন উনি, আমার কথার পাত্তা না দিয়ে সোজা রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। বাথরুমে এনে নামিয়ে দিতেই চলে যেতে বললাম ওনাকে। সাথে সাথে অদ্ভুত চোখের ধারণ করে তাকালেন আমার দিকে। ধমকের সুরে বললেন,
“একধাপ পা তুলে হাঁটতে পারছিস না, অথচ চাপ কলে পানি তুলে গোছল করবি? আর এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে।”
“পারবো তো আমি, যান না আপনি। প্লিজ!”
“চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক এখানে। একদম লাফালাফি করবি না।”
আমাকে ধমকে ধামকে চুপ করিয়ে দিলেন উনি। উপায় না পেয়ে হাজারো লজ্জা আর অস্তিত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম চুপ করে।
.
ঘরের এক জায়গায় মেলে দেওয়া নিজের ভেজা জামাকাপড় গুলো না শুকানোর ফলে, আন্টির দেওয়া শাড়িটাই গায়ে জড়িয়ে নিলাম। কাঁপতে কাঁপতে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতেই তাসফি ভাইয়া ঘরে ঢুকলেন। আমার দিকে একবার তাকিয়ে দরজাটা ভিরিয়ে দিলেন, এগিয়ে এলেন আমার কাছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হুট করে কোলে তুলে নিয়ে খাটে বসিয়ে দিলেন। ফ্যালফ্যাল করে ওনার দিকে তাকালাম, কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই হাতের গামছাটা দিয়ে আমার চুলগুলো মুছে দিতে লাগলেন। বললেন,
“কাঁপা কাপি করছিস, অথচ চুলগুলো থেকে টপটপ করে পানি পরছে সে খেয়াল নেই। আবারও ঠান্ডা লাগাবি?”
“আমাকে দেন, আমি করছি।”
“আর কিছু করতে হবে না আপনার, অনেক করেছেন।”
“ইফ্! এমন করছেন যেন, মনে হচ্ছে কঠিন রোগে রোগাক্রান্ত হয়েছি। হাত পা সব কিছু পঙ্গু হয়ে গেছে। আর আমার সেবায় নিয়োজিত হয়েছেন আপনি, হু!”
“আমার হাত পা পঙ্গু হলে আপনিও এভাবেই আমার সেবায় নিয়োজিত হয়েন ম্যাডাম।”
“বলছি না, এমন আজেবাজে কথা একদম বলবেন না। আবারও শুরু করছেন?”
কিছুটা ধমকের সুরে কথাটা বলতেই হালকা হেঁসে উঠলেন তাসফি ভাই। কপাল কুঁচকে ওনার দিকে তাকাতেই উনি বললেন,
“আচ্ছা…. আচ্ছা ঠিক আছে, আর বলবো না। আর ঠান্ডা লাগাতে না চাইলে, এবার চুপচাপ কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পর।”
“আর আপনি?”
“রুপু! সারারাত আমাকে জাপটে ধরে বুকে মুখ গুঁজে থেকেও তোর শখ মিটে নি? আবারও কাছে চাইছিস? এক রাতেই ভারী নি*র্লজ্জ হয়ে গেছিস দেখি।”
উনি অবাক হবার ভান করে কথাটা বলতেই চোখ দুটো বড় বড় আকৃতির ধারণ করলো আমার। উফ্! এই বজ্জাত লোকটা এমন কেন? ওনার অ*সভ্য মার্কা কথাবার্তা কি কখনোই শেষ হবে না? আমি কিছু বলার আগেই উনি আমার দিকে একটু ঝুঁকে এলেন। বললেন,
“আমার কিন্তু সমস্যা নেই রুপু। সারারাত কেন, সারাজীবন এই বুকে তোমাকে আগলে রাখতে পারবো।”
চোখ তুলে তাকালাম ওনার দিকে। আমাকে তাকাতে দেখে উনি আবারও বললেন,
“কি? পারবে তো, এই বুকে মাথা রেখে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার সাথে পারি দিতে?”
“হুম! আপনি সাথে থাকলে সবকিছুই পারবো।”
চট করে ওনার বুকে মাথা রাখলাম, দু’ হাতে আগলে নিয়ে বলে উঠলাম। আমার কথায় হাসলেন উনি, জড়িয়ে নিলেন আলতো ভাবে। কিছুটা সময় যেতেই ওনাকে করা রাতের প্রশ্নটা আবারও মাথায় এলো আমার। সময় না নিয়েই বললাম,
“এখনো বলবেন না? চার বছর আগে আমাকে ফেলে হুট করে কেনই বা চলে গিয়েছিলেন?”
সহসায় কিছু বললেন না উনি। কিছুটা সময় নিয়ে বললেন,
“আগেও জানতে চাস নি কথাটা। কাল থেকে কেন এত উদগ্রীব হয়ে উঠেছিস?”
“আগে তো আপনাকে এতাটা কাছে পাই নি, এতটা ভালোবাসা পাই নি আপনার।”
“শোনাটা কি খুব জরুরি?”
“হুম! খুব জরুরি। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয় হয়, যখন ফুপি আর রিফাপু হুট করে বলে ফেলে আমার জন্যই আপনি চলে গিয়েছিলেন। জানতে চাই, কি করেছিলাম আমি? কি অপরাধ ছিলো আমার? হুট করে কেনই বা চলে গিয়েছিলেন সেদিন।
দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন উনি। বুক থেকে আমার মাথা উঠিয়ে দু’ হাতে গালে আগলে নিলেন। কপালে আলতে করে ঠোঁটের স্পর্শ ছুঁয়ে আস্তে করে বললেন,
“তোর কোন দোষ নেই রুপু, সেদিন ভুলটা হয়তো আমারই ছিলো। নিজের করা ছোট্ট ভুলে বড় মামা একটু বেশিই ভুল বুঝে গেল আমাকে, সাথে বড়সড় রকমের শাস্তি দিলো। ”
.
.
চলবে…..