তুমি বললে আজ ২ পর্ব -২৬ (প্রথমাংশ)

#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ২৬. ( প্রথমাংশ )

.
তাসফি ভাইয়ের দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টায় আছি ওনাকে, ভেবে চলেছি কি হয়েছিলো সেদিন? উনি নিজেকে দোষী করলেও সকলের আধো বার্তায় যে আমিই আছি, সেটা এতদিনে বুঝে গেছি। কিন্তু আমার অগোচরে কি হয়েছিলো সেটাই আমার অজানা। হালকা করে হাসলেন উনি। বলে উঠলেন,
“এই পিচ্চি মেয়েটার প্রতি কখন কিভাবে নিজের মন হারিয়ে ফেলেছিলাম সেটা আজও মনে করতে পারি না। নিজের অজান্তেই কখন কিভাবে ভালোবাসায় বেঁধে গিয়েছি আজও জানতে পারি না।”

একটু থামলেন উনি। আবারও হালকা হেঁসে জোরে শ্বাস টেনে নিলেন। বললেন,
“বয়েস্ স্কুল থেকে বেড়িয়ে এতগুলে মেয়ের মাঝে কলেজে ভর্তি হলাম। বন্ধুদের দেখে রিলেশনে জড়ানোর ইচ্ছে হলেও কেন জানি সেই ফিলিংটা কাজ করতো না। এতগুলো মেয়ে বন্ধু থাকা সত্ত্বেও পড়াশোনার দোহায় দিয়ে কাটিয়ে দিলাম দুটো বছর। ভার্সিটিতে গিয়ে এত শত মেয়ের মাঝে ধরে রাখতে পারতাম না। বন্ধুদের আনলিমিটেড খোঁচাখুঁচি, সাথে মেয়ে বন্ধুদের সাথে মেলামেশায় আবেগে বশিভূত হয়ে গেলাম। নিজেকে জড়াতে চাইলাম এক নাম না জানা সম্পর্কে। কিন্তু সবকিছুর শুরুতেই ভেসে উঠতো বাসায় রেখে যাওয়া একটা তোতাপাখির বকবকানি, সারাক্ষণ তার লাফালাফি, আমাকে করা তার আবদার, হাজারো বায়না, সারাক্ষণ আমার সঙ্গ পাওয়া। তখন এতটাই ছোট ছিলি, তোকে ভালোবাসার কথা ভাবনাতেও আনি নি। সময়ের সাথে সাথে বড় হয়ে উঠলি, আর জায়গা করে নিলি গভীরভাবে। কখন কিভাবে ভালোবেসে ফেললাম নিজেই বুঝতে পারলাম না। শুধু অপেক্ষা করে থাকতাম তোর বড় হওয়া। একদিন হঠাৎ করেই জানতে পারলাম এই পিচ্চি মেয়েটাকেই সবাই আমার সাথে বেঁধে রাখার পরিকল্পনা করছে, ঠিক তখন থেকেই ভালোবাসার মাত্রাটা অধিক হতে শুরু করেছে।
এক বছর পর হুট করেই আমাদের বিয়ে, সাথে ভালোবাসার মানুষগুলোকে হারিয়ে ফেলা। সবকিছুতেই যেন মুষড়ে পড়েছিলাম, তবুও শক্ত থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছি। সেদিন রাতে হঠাৎ দাদু ভাইয়ের সাথে তোকে নিয়ে খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখি, নিজেকে সামলাতে না। ছুটে আসলাম তোর রুমে চলে আছি, একটুখানি স্বস্তির পাবার আসায়।

সেদিন তুই ঘুমিয়ে যাবার পর কেন জানি আসতে ইচ্ছে হয়নি আমার, তোকে আগলে রেখে সারাটা রাত কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়েছে। নিজের ইচ্ছেটাকে দমিয়ে চলে আসতে চেয়েছিলাম‚ কিন্তু পারি নি। কখন ঘুমিয়ে গেছিলাম সেটাও বুঝতে পারি নি। চোখ খুলে ভোরের আলো দেখতেই কিছুটা অবাক হই। মনের মধ্যে ভয় ঢুকে যায়, কেউ যদি তোর রুমে দেখে তাহলে কি না কি ভাববে। কেউই এত তাড়াতাড়ি আমাদের বিয়েটা দিতে চায় নি। কারণ একটাই, তোর বয়সটা নিতান্তই অনেক কম। বিয়ে সম্পর্কে হয়তো কোন ধারণাই ছিলো না। কিন্তু হঠাৎ নানি মনির মৃ*ত্যু তারপর দাদু ভাইয়ের অসুস্থতা।
সেদিন আমার ভয়টায় বাস্তবে রুপান্তরিত হয়েছিলো। রুম ছেড়ে বেরিয়েই বাকিদের চোখে না পরে বড় মামার সামনেই পেরেছিলাম আমি।”

এতটুকু বলেই থামলেন উনি। শ্বাস টেনে নিলেন বার কয়েক। ওনাকে দেখে মনে হচ্ছে অনেকটা হাঁপিয়ে গেছেন। আমি ওনাকে কিছু বলার আগেই উনি আবারও বলতে শুরু করলেন‚

“মামা তখন আমাকে কিছুই বলে নি, গভীর চোখে আমাকে পরখ করে চলে গিয়েছিলো। ভেবেছিলাম আমাকে ভুল বুঝে নি, কিন্তু আমার ভাবনাকে দূরে ঠেলে তুই স্কুলে যাবার পর ডেকে নেয়। ড্রয়িং রুমে এসে আব্বুর উপস্থিতিও পেয়েছিলাম। আমি যেতেই বড় মামা বলে উঠলো,
‘পাসপোর্ট অফিসে আমার বন্ধু আছে, সেটা তো জানিস তাসফি? তোর পাসপোর্ট, এনআইডি সহ যাবতীয় কাগজ নিয়ে পাসপোর্ট অফিসে চলে যা, কয়েক দিনের মাঝেই ভিসাটা হয়ে যাবে। এর মাঝে আমেরিকার টিকিটও কেটে ফেলবো আমি।’

‘মানে? কি বলতে চাইছো তুমি মামা?’

প্রচন্ড অবাক হয়ে গেলাম মামার কথায়। আমাকে যে আমেরিকা পাঠানোর ব্যাবস্থা করছে সেটাও বুঝে যাই ততক্ষণে। আমার ভাবনা টাকে সত্যি প্রমাণিত করে আব্বু বললো,
‘আমেরিকা যাবি তুই। স্কলারশিপ পেয়েছিস কাজে লাগা, পিএইচডি শেষ করে আয়।’

‘আমি তো প্রথমেই বলেছি আব্বু পিএইচডি করবো না, বিসিএস দিবো।’

‘দিতে হবে না তোর বিসিএস। আমরা যেটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটাই হবে। তোমার দেশের বাইরে যাওয়াটাই রূপার জন্য ভালো।’

‘তাওহিদ ভাই তুমি চুপ করো, আমি বুঝিয়ে বলছি ওকে। তাসফি বস এখানে।’

আব্বুকে চুপ করে দিলো বড় মামা। ছোট মামা, আম্মু, মামীরা শ্রোতা হয়েই রইলো। আমি সোফায় গিয়ে বসতেই মামা বললো,
‘দেখ তাসফি, তোদের বিয়েটা কিভাবে হয়েছে সেটা খুব ভালো ভাবেই জানিস। রূপার বয়সটা নিতান্তই অনেক কম, আর তুই? তোর এটা উড়তি বয়স, সাথে সমস্ত কিছু বোঝার ক্ষমতা হয়েছে। এই সময়টা তে বিপরীত ধর্মীর মানুষের প্রতি ঝোঁক থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আর রূপা তো ধর্মীয় মতে তোর বউ, তোর ভালোলাগার মানুষ। গত রাতের মতো যদি ভুল হয়ে…..’

‘মামা…. তুমি যেমনটা ভাবছো তেমন কিছুই নয়।’

‘আমি তো বলছি না বাবা কিছু হয়েছে। কিন্তু ভুল হতে তো সময় লাগবে না। মেয়েটা অনেক ছোট, বিয়ে স্বামী সংসার এসব কিছু ওর বোঝার ক্ষমতা নেই। ছোট থেকেই ওর তোর সঙ্গ ভালো লাগে, সবসময় তোর সাথে থাকতে চায়। এখন যদি এর সূত্র ধরেই কোন ভুল….. ’

কোন কথায় বলতে পারলাম না আমি। বড় মামাকে থামিয়ে দিয়ে আব্বু বলে উঠলো,
‘এত কথা বলার তো কোন মানে হয় না রাজিম ভাই। তাসফি এতকিছু শুনতে চাচ্ছি না আমি, তাড়াতাড়ি কাগজপত্র দিয়ে অফিসে যা। কি কি করা লাগে সমস্তকিছু আজকেই ঠিক করে আসবি।’

‘আমি যাবো না আব্বু।’

‘যাবি না মানে? কেন যাবি না? এখানে থেকে মেয়েটার জীবন নষ্ট করতে চাস?’

‘তোমরা খুব ভালো করেই যানো আমি রূপাকে কতটা ভালোবাসি। আমার দ্বারা ওর জীবন নষ্ট হবে, সেটা ভাবলে কি করে তুমি?’

‘ভাবছি না, নিজ চোখে দেখতেও পারছি। মেয়েটার বয়স কত কম, সেটা কি ভুলে গেছিস তুই? সারারাত কাটানোর সাহস করেছিস, এরপর সেই সাহসটা কোথায় পৌঁছাতে পারে, সেটা আমায় বোঝাতে চাইছিস? তোদের বিয়ের আগেই বারণ করেছি তোকে, রূপার থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে বলেছি। কিন্তু তুই? তুই এটা কি করে করতে পারলি তাসফি?’

আব্বুর কথায় বলার মতো ভাষা খুঁজে পেলাম না। তবুও নিজেকে শান্ত করে বললাম,
‘তোমরা যেটা ভাবছো সেগুলো কিছুই না আব্বু। তোমাদের কি মনে হয় আমি এতটাই অবুঝ? ও কিন্তু এখন আমার বউ, ওর ভালোটা আমি ঠিকই বুঝতে পারবো। কালকে তো শুধু…. ’

‘ভুলে যাস না তাসফি, বিয়েটা যেমন হয়েছে তালাক নামেও একটা জিনিস আছে।’

‘আব্বু…. কি বলছো তুমি এগুলো?’

‘ঠিক কথায় বলছি আমি, তোর ভুলের জন্য মেয়েটার কোন ক্ষতি হতে দিতে পারি না আমি। আব্বা এখন বেঁচে নেই সেটা ভুলে যাস না তুই।’

আব্বু চিৎকার করে কথাটা বলতেই নীরবতায় ছেয়ে গেল পুরো বাসা। আব্বুর সাথে রাগারাগি করে উঠে দাঁড়িয়ে গেলেও শেষ কথাগুলোই দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পেলাম না। সোফায় বসে দু’ হাতে মাথা চেপে ধরলাম নিজের। বুঝতে পারলাম না ঠিক কি করা উচিত আমার। আব্বু আবারও বলে উঠলো,
‘তুই এখন ভেবে নে ঠিক কি করবি? দেশ ছেড়ে রূপার থেকে কয়েক বছরের জন্য আলাদা থাকবি? নাকি একেবারেই আলাদা হয়ে যাবি? বিয়েটা কিন্তু এখনো রেজিস্ট্রি হয় নি।’

মনের মধ্যে অজানা এক ঝড় শুরু হয়ে গেল আমার। ভালোবাসাটাকে হারিয়ে ফেলার ভয়। মন ও মস্তিষ্কের সাথে পারলাম না আমি, ভালোবাসাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার ভয়ে সাময়িক দূরত্বটাই মেনে নিলাম। সকলের উদ্দেশ্যে ‘আমি যাবো’ বলেই চলে এলাম সেখান থেকে।

তখন শুধু মাথায় একটা কথায় এসেছিলো আমার, কিছুতেই হারাতে পারবো না তোকে, কোন মূল্যেই নয়।”

স্তম্ভিত হয়ে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছি তাসফি ভাইয়ের দিকে। ওনার কথাগুলো বুঝতে পারলেও সবকিছু যেন মাথার উপর দিয়ে গেল আমার। আমার অগোচরে এতকিছু ঘটে গেছে? আর আমি…. আমি এর একাংশও জানি না? এই মানুষটা একা একা এত কিছু সাফার করেছেন, আমাকে এর কিছুই বুঝতে দেন নি? আমার জন্য পরিবারের চাপে সমস্ত কিছু বিসর্জন দিয়ে পারি জমিয়েছেন দূর দেশে, অথচ আমাকে এর রেশ মাত্র বুঝতে দেন নি?

.
.
চলবে…..

আগামীকাল সারাদিন একটু ব্যস্ত থাকবো। এর বাকি অংশ শনিবারে পাবেন। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here