তুমি বললে আজ ২ পর্ব -৩২ (প্রথমাংশ)

#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ৩২ ( প্রথমাংশ )

.
“তোর ফুপি খুব কান্নাকাটি করছে, এতক্ষণে হয়তো হাসপাতালেও চলে গেছে। সামলাতে হবে ওকে, তুই সাবধানে থাকিস।”

আম্মুর কথাটা কর্ণপাত হলেও ঠিক সেভাবেই তাকিয়ে রইলাম আম্মুর দিকে। কয়েক সেকেন্ডর ব্যাবধানে যখন দরজার শব্দ হলো তখনই কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলাম। খেয়াল হলো, আম্মু ঠিক কি বলে বেরিয়ে গেল। তাসফি ভাইয়ের এক্সিডেন্টের কথা খেয়াল হতেই চমকে উঠলাম আবারও। বার কয়েক শ্বাস টেনে নিলাম জোরে জোরে। পাশ থেকে ওড়নাটা হাতে নিয়েই এক ছুটে বেরিয়ে এলাম রুম ছেড়ে।
বাইরে এসে ড্রয়িং রুম পেরিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে যেতেই ফট করে কেউ হাত টেনে ধরলো আমার। হঠাৎ হাত টেনে ধরার উৎস খুঁজে পিছন ফিরে তাকাতেই বড়মাকে নজরে এলো। ছটফট করে হাতটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলে আরও শক্ত করে হাতটা চেপে ধরলেন বড়মা। বললেন,

“এভাবে কোথায় যাচ্ছিস তুই?”

“আ..আমাকে ছাড়েন বড়মা, ওনার কাছে যাবো আমি, তা..তাসফি ভাইয়া….”

“তুই গিয়ে কি করবি মা? আমরা যাচ্ছি তো, তুই বাসায়…. ”

“না, আমি…. আমি যাবো, ওনার কাছের যাবো আমি।”

আমার উত্তেজিত কণ্ঠে বলা কথায় চুপ হয়ে গেল বড়মা। আম্মুর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করলো হয়তো। বললো,
“আচ্ছা চল, ছটফট না করে সবসময় আমার সাথে থাকবি।”

সাথে সাথে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালাম বড়মার কথার। সময় না নিয়ে দরজা খুলে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যেতে লাগলাম। পিছন থেকে আম্মুকে ভালোভাবে দরজা লাগিয়ে দিতে বলে বড়মাও দ্রুত পায়ে নিচে নামতে লাগলেন। গেইট পেরিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়াতেই বড়মাও পাশে দাঁড়ালেন, ফট করে আবারও আমার হাতটা চেপে ধরলেন। কিছুটা সময় নিয়ে আম্মুও এসে দাঁড়ালো। একটা রিকশা থামিয়ে উঠার উদ্যোগ হতেই বেড়ে উঠলো বড়মার মোবাইল। স্ক্রিনে বড় বাবার নামটা দেখেই চট করে মোবাইলটা নিজের হাতে নিয়ে নিলাম। রিসিভ করে সাথে সাথে বলে উঠলাম,

“হ্যালো বড় বাবা, উনি… উনি এখন কেমন আছে? কি হয়েছে ওনার, কতটা আঘাত পেয়েছেন?”

উত্তেজিত কণ্ঠে তাড়াতাড়ি কথা গুলো জানতে চাইলেও কোন জবাব দিলেন না বড় বাবা। অপর পাশে একেবারেই চুপ হয়ে গেল। আবারও বেশ কয়েকবার জানতে চাইলে ক্লান্তি মাখা কণ্ঠে আস্তে করে বলে উঠলেন,

“তাসফির অবস্থা খুব একটা ভালো নয় রে মা। মাথায় খুব বাজে ভাবে আঘাত পেয়েছে, বেশ কয়েকবার বমিও করেছে। ডাক্তাররা ভালোভাবে কিছু বলতেও পারছে না। ঢাকায় নিয়ে যেতে হচ্ছে ওকে, এম্বুলেন্সে উঠে গেছি। তোরা আর হসপিটালে আসিস না।”

কেঁপে উঠলাম আমি, হাত থেকে মোবাইল পড়ে যেতে নিতেই ধরে ফেললো বড়মা। অপর হাতে আমার হাতের বাহু জড়িয়ে ধরলো। ফোন কানে নিয়ে কথা বলতে লাগলো বড় বাবার সাথে। কিন্তু কোন কথাই আমার কর্ণপাতে এসে পৌছালো না।

.
একের পর এক গাড়িকে পাল্লা দিয়ে শা শা করে ছুটে চলেছে গাড়িটা। গভীর রাতের সোনালী চাঁদের হালকা আলোয় চারদিকে আবছায়া হয়ে আছে। একটু পর পর অপজিটের গাড়িগুলোর আলো এসে বারি লাগছে চোখে। তবুও স্থির ভাবে তাকিয়ে আছি দূর প্রান্তে।
তাসফি ভাইয়াকে ঢাকায় নিয়ে যাবার পরেই আব্বু বাসায় চলে আসে। দুই ঘন্টার ব্যাবধানে সবকিছু ঠিকঠাক করে নেয়। ফুপি সহ আমাদের সাথে নিয়ে রওনা হয় ঢাকার উদ্দেশ্যে। কান্নার ফলে সবার চোখে ঘুমের রেশ দেখা দিলেও আমার চোখে তার বিন্দুমাত্র নেই। থাকবেই বা কিভাবে? চোখ থেকে তো দু’ফোটা অশ্রুও বিসর্জন হয় নি। শুধু বারবার তাসফি ভাইয়ের সাথে হওয়া শেষ কথাগুলো এবং বিকেলে ওনাকে দেখা সেই চেহারাটাই ভেসে উঠছে চোখে। সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত ওনার প্রতি হাজারো অভিযোগ, হাজারো ঘৃণা জমা পড়ে থাকলেও এখন নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে। বারংবার মনের কোণে উকি দিচ্ছে ওনাকে সাথে এতটা বাজে ব্যবহার না করলেও পারতাম।

“রূপা… এই রূপা, এসে গেছি তো মা, নেমে আয় এখন।”

চট করে মাথা তুলে তাকালাম আব্বুর কথায়। ভাবনাগুলো ছুটে বেরিয়ে গেল আপন মনে। দাঁড়িয়ে থাকা আব্বুর পাশ দিয়ে পিছনে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম হসপিটালের সামনে। নিজের ভাবনায় এতটায় মসগুল ছিলাম যে , কখন হসপিটালের সামনে এসে গাড়ি থেমেছে বুঝতেই পারি নি। সময় নষ্ট করলাম না, দ্রুত নেমে গেলাম গাড়ি থেকে। এর মাঝে আম্মু, বড়মা ও ফুপিও নেমে গেছেন। আমি নেমে দাঁড়াতেই আমাদের ভেতরে যেতে লাগলো আব্বু।

.
ভোর রাত, একটু আগেই চারদিকে ফজরের আজানের প্রতিধ্বনি থেমে গেছে কিছুক্ষণ আগেই। শুনশান নীরবতার মাঝেই চার তলায় এসে থামলাম। করিডোর পেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতেই বড় বাবা ও ফুপাকে নজরে এলো। তাদের দেখে হাউমাউ করে কান্না করে উঠলো ফুপি, এগিয়ে গিয়ে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো তাসফি ভাইয়ের কথা। কিছুটা সময় চুপ করে থেকে বড় বাবা জানালেন, একটু আগেই ডাক্তার দেখেছেন, কিন্তু এখনো অবস্থান গতিবেগ জানায় নি।

মিনিট পাঁচেক পর সাদিক ভাইয়া আসতেই আবারও সবাই জানতে চাইলো তাসফি ভাইয়ার কথা। সহসায় কোন উত্তর দিতে পারলো না সাদিক ভাইয়া। কিছুটা সময় নিয়ে জানালো মাথায় নাকি বেশ বাজে ভাবে আঘাত পেয়েছে, আঘাত পাওয়ার পর বেশ কয়েকবার বমি করায় ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে পরছে। আধা ঘন্টার মাঝেই অপারেশন শুরু হবে, সেটারই ব্যাবস্থা চলছে। আবারও হাউমাউ করে কান্না করে উঠলো ফুপি। আম্মু, বড়মাও কান্না করতে লাগলে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে চুপ করতে বললো সাদিক ভাইয়া, ওনার কিছুা হবে না সেটাও বোঝালেন সবাইকে। এতকিছুর মাঝে আমি নীরব শ্রোতা হয়ে শুনে গেলাম তাদের কথা, দেখে গেলাম তাদের কর্মকাণ্ড।

.
করিডর থেকে কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে। গায়ের শক্তি যেন সামান্যতমও বিরাজমান নেই গায়ে। তবুও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।

“রূপা….”

হঠাৎ কিছুটা পরিচিত কণ্ঠস্বরে চমকে গেলাম কিছুটা। মাথা তুলে সামনে তাকিয়ে অবাক হলাম। কিন্তু কিয়ানা আপুকে দেখে অবাক হতে গিয়েও সামলে নিলাম নিজেকে। কিয়ানা আপুকে দেখে অবাক হওয়ার তো কিছু নেই, তাসফি ভাইয়ের এই পরিস্থিতিতে ওনার তো এখানেই থাকার কথা।৷ যতই হোক, ভালোবাসার মানুষ তো।

“এখানে দাঁড়িয়ে আছো যে? তাসফির সাথে দেখা হয়েছে?”

চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতেই বলে উঠলো কিয়ানা আপু। দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। ওনার দিকে তাকিয়ে দূর্বল কণ্ঠে আস্তে করে বলে উঠলাম,
“আমি আপনাদের মাঝে আসি নি কিয়ানা আপু, আপনার ভালোবাসাকে কেড়ে নিতে আসি নি। ওনার এক্সিডেন্টের কথা শুনে আঁটকে রাখতে পারি নি নিজেকে।”

“তাসফির ভালোবাসা তো আমার জন্য কখনোই ছিলো না, সবকিছু তো তোমার জন্যই বরাদ্দ ছিলো। আমিই তো উচ্ছিষ্ট হয়ে তোমাদের মাঝে এসে পরেছি।”

চমকে উঠলাম আমি। কিয়ানা আপুর দিকে চোখ দুটো নিবদ্ধ করতেই টপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো কিয়ানা আপুর চোখ থেকে। অবাকের মাত্রা কিছুটা বেড়ে যেতেই আবারও বলে উঠলো,

“তুমি আমার অনেক ছোট, তবুও তোমাকে বলছি। আমাকে ক্ষমা করে দিও রূপা, প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিও।”

অবাকের মাত্রা দ্বিগুণ থেকে দ্বিগুণ হয়ে উঠলো। কিছু না বুঝে অবুঝের মতো তাকিয়ে রইলাম কিয়ানা আপুর দিকে। বোঝার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম তার কথাগুলো। হঠাৎ ক্ষমা চাওয়ার সমীকরণ মেলাতে না পেরে বললাম,
“মানে? আপনি কেন আমার কাছে ক্ষমা চাইছেন আপু?”

“কারণ সেদিন রাতে তোমাকে বলা আমার কথাগুলো সবটাই মিথ্যে ছিলো, সাজানো ছিলো আমার ও তাসফির ব্যাপারে সেই কথাগুলো। তাসফি আমাকে নয় তোমাকে ভালোবাসে, ওর জীবনে আমি বা অন্যকেউ নয়, তুমিই প্রথম ও শেষ নারী রূপা।”

থামকে গেলাম আমি। নিজের স্তম্ভিত হারিয়ে তাকিয়ে রইলাম সামনের দিকে। গায়ের শক্তিটা নিমিষেই হারিয়ে গেল, পা দু’টো কেঁপে উঠতেই ধপ করে নিচে বসে গেলাম। বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইলাম কিয়ানা আপুর দিকে।

.
.
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here